‘বঙ্গবাসী’ কাগজের শিরোনাম—
দুর্ধর্ষ বিপ্লবী জীবনলালের পলায়ন।
ঘটনার বিবরণে বলা হচ্ছে, আলীপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে বন্দি স্থানান্তরের সময় জীবনলাল হাতকড়া বাধা অবস্থায় পলায়ন করেন। ওঁৎ পেতে থাকা বিপ্লবীরা পুলিশের গাড়িতে বোমাবর্ষণ করলে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন জীবনলাল।
‘ময়মনসিংহ গেজেট’ পত্রিকার শিরোনাম—
খান সাহেব ধনু শেখ মুসলিম লীগের
ময়মনসিংহ জেলার আহবায়ক নির্বাচিত।
দুই পত্রিকায় দুইজনের ছবি। ধনু শেখের মাথায় তুর্কি ফেজ টুপি। গায়ে আচকান। জীবনলালের ছবিতে ফুল হাতা গেঞ্জি পরা এক যুবক, যার চেহারায় লজ্জাভাব প্রবল। ক্যামেরায় ছবি তোলা হচ্ছে এই কারণে সে বিব্রত।
এই দুই পত্রিকার কোনোটিতেই তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লীর এক যুবকের ছবি বা খবর ছাপা হয় নি। যুবকের নাম চন্দ্ৰশেখর ভেঙ্কটরমন। তিনি ১৯৩০ সনে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, তাঁর আপন ছোটভাইয়ের ছেলে সুব্ৰমনিয়াম চন্দ্ৰশেখরও পঞ্চাশ বছর পর ১৯৮৩ সনে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান। ভারতীয় পত্রিকাগুলি এই খবর ছাপাতেও কেন জানি ভুলে গিয়েছিল।
বান্ধবপুর পদার্থবিদ্যার নোবেল পুরস্কার নিয়ে চিন্তিত না। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার সমস্যা নিয়ে চিন্তিত না। গান্ধীজি হঠাৎ করেই অসহযোগ আন্দোলন কেন ভেঙে দিলেন তা নিয়েও চিন্তিত না। বান্ধবপুর চিন্তিত তার মানুষজন নিয়ে। মাওলানা ইদরিসকে নিয়ে। মানুষটার হয়েছে কী? এই রোগের কি কোনো চিকিৎসা আছে? তাকে ধরে বেঁধে একটা বিয়ে দিয়ে দিলে কেমন হয়?
জঙ্গলে অমাবস্যা তিথিতে হো হো শব্দ কেন হয় তা নিয়ে বান্ধবপুর চিন্তিত। ভূতপ্রেতের বিষয় বোঝা যাচ্ছে। কন্ধকাটারা এমন শব্দ করে। কন্ধকাটা যতক্ষণ জঙ্গলে থাকবে ততক্ষণ ঠিক আছে, কিন্তু পাড়ায় ঢুকলে সমূহ বিপদ।
কবিরাজ সতীশ পরিবারের মেয়ে যমুনাকে নিয়ে বান্ধবপুর চিন্তিত। সালিশ বসা উচিত। এখনো বসছে না কেন? সালিশে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, ঘটনা কে ঘটিয়েছে? হিন্দু না মুসলমান? ডাকাতদল যেহেতু যুক্ত, মুসলমান হবার সম্ভাবনাই বেশি। ডাকাতি বেশিরভাগ মুসলমানরাই করে।
ভারতীয় এক বিজ্ঞানী সমুদ্রের পানির রঙ নীল দেখায় কেন তা বের করে ফেলেছেন, এটা কি কোনো বিষয়! ঈশ্বর ঠিক করে রেখেছেন সমুদ্রের পানি নীল দেখাবে, এই কি যথেষ্ট না?
হাফেজ মাওলানা ইদরিসের মাথা যে পুরোপুরি গেছে এই বিষয়ে বান্ধবপুরের মানুষদের মনে এখন আর কোনো সংশয় নেই। বান্ধবপুরের মতো এতবড় অঞ্চলে একজন ‘আউল’ মাথা থাকবে না, এটাই বা কেমন কথা? গ্রামে এক দুইজন ‘আউল’ মাথা থাকা ভালো, এতে গ্রামের উন্নতি। বদ্ধ উন্মাদ হলে ভিন্ন কথা। বদ্ধ উন্মাদকে নৌকায় করে দূরের কোনো গঞ্জে গোপনে ছেড়ে আসাটা বিধি। মাওলানা ইদরিস বদ্ধ উন্মাদ না। তিনি একটা বিষয় ছাড়া সর্ব বিষয়ে অতি স্বাভাবিক। মসজিদের নামাজ নিয়মমতো পড়াচ্ছেন। জুম্মাবারে একটা হাদিস বয়ান করা এবং তার ব্যাখ্যা করা তার অনেকদিনের অভ্যাস। এই অভ্যাসেরও পরিবর্তন হয় নি। গত জুম্মাবারে তিনি নবিজির হাদিস বয়ান করলেন।
মুসুল্লিদের আজ যে হাদিসটা বলব। এই হাদিস আমরা পেয়েছি। ইয়াজিদের কন্যা বিবি আসমার কাছ থেকে। তিনি বলছেন, একদিন নবিজি (সাল্লালালাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম) এর সামনে খাবার আনা হয়েছে। তিনি সেই খাবার আমার এবং আমার সঙ্গে উপস্থিত কিছু মহিলার সামনে রেখে বললেন, খাও। আমরা প্রত্যেকেই ছিলাম ক্ষুধার্ত, তারপরেও ভদ্রতা করে বললাম, আমাদের ক্ষুধা নাই। তখন নবিজি বললেন, ‘হে মহিলাবৃন্দা! ক্ষুধার সঙ্গে মিথ্যা মিশিও না।’
এখন মুসল্লিগণ এই হাদিসের ব্যাখ্যা চিন্তা করেন। ব্যাখ্যা হলো, ভদ্রতার কারণে মিথ্যা বলা যাবে না। যেই মিথ্যায় ক্ষতি নাই সেই মিথ্যাও বলা যাবে না। অর্থাৎ কোনো অবস্থাতেই মিথ্যা বলা যাবে না। সবাই বলেন— আলহামদুলিল্লাহ।
সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলল। মাওলানা দোয়া শুরু করলেন। কোথাও ভুল নেই। কোনো ভ্ৰান্তি নেই। শুধু এক জায়গাতেই সমস্যা। মাওলানার ধারণা ঘরে তার স্ত্রী আছে। অতি রূপবতী স্ত্রী।
বাড়িতে ঢোকার আগে উঠানে দাঁড়িয়েই তিনি কয়েকবার গলা খাকারি দেন। যেন তার স্ত্রী গায়ের কাপড় বেশামাল থাকলে ঠিকঠাক করে নিতে পারেন। স্ত্রীকে স্বামীর সামনেও আব্রু রক্ষা করার বিধান।
বাড়িতে ঢুকে পাগড়ি খুলতে খুলতে মাওলানা বলেন, বউ, রান্না কিছু হয়েছে?
তাঁর প্রশ্নের কেউ জবাব দেয় না। কিন্তু মাওলানা জবাব শুনতে পান এবং স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলেন, থাক থাক, জ্বর গায়ে নিয়ে এখন রান্না করতে বসতে হবে না। সামান্য চাল-ডাল আমি নিজেই ফুটিয়ে নিতে পারব। তুমি বরং কিছুক্ষণ শুয়ে থাক। গোসল করবে? পানি এনে দেব? তাহলে থাক গোসলের দরকার নাই। জ্বর সারুক। বউ, আমার কিন্তু ধারণা তোমার ম্যালেরিয়া হয়েছে। প্রতিদিন একই সময় জ্বর, এইটা ম্যালেরিয়া ছাড়া আর কিছু না। আমাকে মনে করিয়ে দিও, সতীশ কবিরাজের কাছ থেকে মিকচার এনে দিব। পাঁচ দাগ মিকচার খেলেই জ্বর শেষ। খেতে তিতা। নিষিন্দার রসের চেয়েও তিতা। কিন্তু ম্যালেরিয়ার যম।
মাওলানা বারান্দায় রান্না করতে বসেন। চোঙা দিয়ে চুলায় ফুঁ দিতে দিতে পরিষ্কার শুনতে পান উঠান ঝাট দেয়া হচ্ছে। পাতা জমানো হচ্ছে। মাওলানা দুঃখিত গলায় বললন, বউ, তুমি দেখি আমার কোনো কথাই শুন না। শরীরে জ্বর নিয়া উঠান ঝাঁট দিতে শুরু করলা। কয়েকটা শুকনা পাতা পইড়া আছে, এতে হইছে কী? বন কর।
ঝাড় দেয়ার শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। মাওলানা বড়ই আনন্দ পান।
হাটের দিনে মাওলানাকে তাঁর অদৃশ্য স্ত্রীর জন্যে টুকটাক অনেক কিছু কিনতে দেখা যায়। সস্তার জিনিস- কাঁচের চুড়ি, ফিতা, কাঠের কােকই। দোকানিরা এই সময় তাঁর সঙ্গে নানান রহস্য করে। তিনি সেই রহস্যের কিছুই বোঝেন না। তাদের কথার জবাব দিয়ে যান। স্ত্রী প্রসঙ্গে কথা বলতে তার ভালো লাগে।
মাওলানা সাব, কাচের চুড়ি যে কিনতেছেন ভাবি সাবের হাতের মাপ দরকার না?
এই মাপেই চলবে। মাপ আমি জানি।
সবুজ চুড়ি কিনলেন, ভাবি সাবের গায়ের রঙ কী? গায়ের রঙ শাদা না হইলে চুড়ি ফুটব না।
গাত্ৰবৰ্ণ অতি পরিষ্কার।
মাশাল্লাহ।
নতুন এক সাবান বাইর হইছে কোম্পানির, জলে ভাসা সাবান। পুসকুনিতে ছাইড়া দিবেন। পানিতে ভাসতে থাকব। ভাবি সাবের জন্যে সাবান একটা দিব?
না। সে পুকুরে স্নান করে না।
পুকুরে স্নান করতে সমস্যা কী?
সমস্যা আছে। পর্দার সমস্যা। চাইর দিক খোলা।
সেইটাও তো একটা কথা।
মাওলানাকে নিয়ে নানান আমোদ হয়। বান্ধবপুরের লোকজন আমোদ করে। পরিচিতজনরা করে। অপরিচিতজনারাও করে। সবচে’ বেশি আমোদ করেন। ধনু শেখ। আজকাল তাঁর সময়ের খুব অভাব। নানান মিটিং করতে হয়। সভা সমিতিতে যেতে হয়। ময়মনসিংহ শহরে নিজের থাকার জন্যে তিনি বাড়ি বানিয়েছেন। বাড়ির নাম ‘খান ভিলা’। বান্ধবপুরে মাসে এক দুই বারের বেশি। আসতে পারেন না। যখনই আসেন মাওলানাকে ডেকে পাঠান। ধনু শেখের সময়টা ভালো কাটে।
মাওলানা, তোমার স্ত্রী আছে কেমন?
জি জনাব ভালো। শুকুর। আলহামদুলিল্লাহ।
গতবারে তোমার কাছে শুনেছিলাম। উনার ম্যালেরিয়া হয়েছে।
জি। সতীশ কবিরাজের কাছ থেকে এনে ওষুধ খাইয়েছি। এতে আরাম হয়েছে।
এখন আর জ্বর আসে না?
জি-না। আল্লাপাকের মেহেরবানি।
এখন পর্যন্ত কেউ উনারে চউক্ষে দেখল না, এইটা কেমন কথা?
পর্দা-পুসিদার মধ্যে থাকে।
স্ত্রীলোকের সামনেও কি পর্দা করে?
জি।
ভালো তো। খুবই ভালো। তা তোমাদের সন্তানাদি কিছু হবে? আছে কোনো খবর?
এখনো খবর নাই।
খবর হইলে আগেভাগে বলবা। নয়তো একদিন হঠাৎ শুনব তোমার সন্তান হয়েছে, তারেও কেউ চোখে দেখে না।
খবর হইলে আপনারে জানাব।
তোমার স্ত্রীর নাম তো জুলেখা। নাম ঠিক বলেছি না?
জি।
সে রঙিলা নটিবাড়ির জুলেখা না তো?
জি-না। তওবা। আপনি কী বলেন!
না হইলেই ভালো। মাওলানা হইয়া নটি বিবাহ করলে লোকজন তোমার পেছনে দাঁড়ায়া নামাজ পড়বে না। ঠিক না?
জি ঠিক।
রঙিলাবাড়ির জুলেখার খবর কিছু রাখ? শুনেছি সে নাকি কলিকাতায় থাকে। তাঁর গানের থাল বাইর হইছে। দুইটাকা কইরা থালের দাম।
আমি কিছু জানি না।
না জানাই ভালো। তুমি স্ত্রীকে নিয়া আছ ভালোই আছ। ভালো কথা, তোমার কি স্ত্রীর সাথে ঝগড়া বিবাদ হয়?
হয় না।
দুইজন মানুষ একসাথে বাস করতেছ, কিছু ঝগড়া তো হওয়ার কথা। ধমক ধামাক কোনোদিনও দেও নাই?
একবার দিয়েছিলাম, শুরু করুল কান্দন। কান্দন দেইখা মন খারাপ হয়েছিল বিধায় ঠিক করেছি। আর ধমক ধামক না।
তোমার স্ত্রীর মতো স্ত্রী সবের প্রয়োজন। এই রকম স্ত্রী জনপ্রতি দশবারোটা থাকলেও ক্ষতি নাই। শোন মাওলানা, তুমি তোমার স্ত্রীকে নিয়া একবার আমার ময়মনসিংহের বাড়িতে আসা। কী বাড়ি বানাইলাম দেইখা যাও। বাড়িতে ফুঁ দিয়া যাও। স্ত্রী পর্দার মধ্যে থাকবে, অসুবিধা কী? বোরকা পইরা যাবে। বোরকা পইরা ফিরবে।
জি আচ্ছা যাব।
ধনু শেখের ময়মনসিংহের বাড়িতে মাওলানার যাওয়া না হলেও অন্য এক অতিথি হঠাৎ রাতদুপুরে উপস্থিত। মাঘ মাস। শীত পড়েছে জব্বর। সেই সঙ্গে কুয়াশা, এক হাত দূরের মানুষ দেখা যায় না। এমন অবস্থা। ধনু শেখ রাতের খাবার শেষ করেছেন। পানের জন্যে অপেক্ষা করছেন। জর্দা দিয়ে পান খেতে খেতে ইকো টানবেন। বাবুর্চি ছগীর পায়ে গরম তেল মালিশ করে দিবে। শরীর ভালো বোধ করলে পিয়ারীকে খবর দিয়ে আনবেন। কিছু গানবাজনা হবে। ইদানীং রাত জেগে দীর্ঘসময় গান শুনতে পারেন না। ঘুমিয়ে পড়েন। গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ার মধ্যেও আনন্দ আছে। ধনু শেখ পিয়ারীকে আনতে পাঠাবেন কি পাঠাবেন না তা নিয়ে আরামদায়ক অনিশ্চয়তায় আছেন। এই সময় অতিথি শোবার ঘরেই ঢুকে পড়ল। অতিথির মাথায় মাফলার। গায়ে ছাই রঙের চাদর।
ধনু শেখ চেচিয়ে উঠতে গিয়েও চুপ করে গেলেন। অতিথি অপরিচিত না। মাফলারে অতিথির মুখ প্রায় ঢাকা। তারপরেও তাকে চেনা যাচ্ছে। অতিথির নাম জীবনলাল। এই লোকের ফাঁসি হয়ে যাবার কথা। সে এখানে কী করছে? বাড়িতে দারোয়ান আছে। সে ঢুকলইবা কীভাবে? ধনু শেখের স্ত্রীদের কেউই এ বাড়িতে নেই। খানসামা এবং বাবুর্চি নিয়ে সংসার। বাবুর্চি জর্দা আনতে গিয়ে মারা গেছে নাকি কে বলবে!
আমাকে চিনেছেন? আমার নাম জীবনলাল।
ধনু শেখ ভীত গলায় বললেন, চিনেছি।
এই সময় বাবুর্চি জর্দা এবং ইকো নিয়ে ঢুকল। শোবার ঘরে অচেনা এক লোক বসে আছে। এই নিয়ে তাকে মোটেই চিন্তিত মনে হলো না। সে ব্যস্ত ইকো ঠিক করতে। জীবনলাল বললেন, আপনার ইকোবরাদারকে যেতে বলুন। আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে। কথা শেষ করি।
ধনু শেখ বাবুর্চিকে চলে যেতে ইশারা করলেন। বাবুর্চি চলে গেল। ধনু শেখ চাচ্ছিলেন বাবুর্চি যেন পুরোপুরি না যায়। দরজার পাশে থাকে। ডাকলেই ছুটে আসতে পারে এমন। কিন্তু হারামজাদা যে যাচ্ছে যাচ্ছেই। একবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছেও না। ধনু শেখের নিজেকে খুবই অসহায় লাগছে। পিস্তলের লাইসেন্স তিনি কমিশনার সাহেবের কাছ থেকে পেয়েছেন। আলসেমি করে পিস্তল কেনা হয় নাই। বিরাট বোকামি হয়েছে।
খান সাহেব, আছেন কেমন?
ধনু শেখ ক্ষীণগলায় বললেন, ভালো। আপনাকে একটা কথা আগেই বলা দরকার। আগে না বললে আপনি ধারণা করতে পারেন। আমি ঐ রাতে খবর দিয়ে পুলিশ এনেছিলাম। ঘটনা সত্যি না। তবে পুলিশের চাপে পড়ে ঐ দিন স্বীকার করেছিলাম যে আপনি হাওরের দিকে গিয়েছেন। পুলিশের চাপ কী জিনিস আপনি নিশ্চয়ই জানেন।
জানি। পুলিশের চাপের প্রসঙ্গ থাক। এখন আমার চাপটা শুনুন। মন দিয়ে শুনতে হবে।
মন দিয়ে শুনছি।
আপনি কাল পরশুর মধ্যে বান্ধবপুর যাবেন। হরিবাবুর বিষয়সম্পত্তি যা দখল করেছেন সেসব ফেরত দিবেন।
কাকে ফেরত দেব?
মূল মালিককে দেবেন।
মালিকটা কে?
মাওলানা ইদরিসকে জিজ্ঞাস করলেই জানতে পারবেন।
মাওলানা ইদরিসকে কী জিজ্ঞাস করব? তার তো মাথা নষ্ট। পুরাই নষ্ট।
হরিচরণের জমিজমার ওয়ারিশানের নাম জহির। তার মা’র নাম জুলেখা।
ধনু শেখ বললেন, কোনো একটা গণ্ডগোল হয়েছে। হরিচরণ বাবু বেশ্যাবেটির ছেলেকে সম্পত্তি কেন দিবেন? যদি দিয়ে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে উনার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মাথা খারাপ মানুষের দলিল গ্রাহ্য না। ভালো কথা, আপনি কি খাওয়াদাওয়া করবেন? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে ক্ষুধার্তা। বাবুর্চিকে খানা লাগাতে বলব?
জীবনলাল চাদরের নিচ থেকে পিস্তল বের করে নিজের হাঁটুর উপর রাখতে রাখতে বললেন, আপনার বাবুর্চিকে খাবার গরম করতে বলুন। খাওয়া শেষ করে বিদায় নেবার সময় আপনার পায়ে একটা গুলি করব। আপনি মরবেন না, তবে পায়ের হাডিড চুরমার হবে। এই কাজটা করব যাতে আপনি বুঝতে পারেন আমি সহজ পাত্র না।
ধনু শেখ হাসির চেষ্টা করতে করতে বললেন, এইসব কী বলেন? আপনার কথামতোই কাজ হবে। যা বলবেন তাই করব। আপনার নিজের যদি টাকা পয়সা লাগে সেটাও বলেন। স্বরাজ করতে টাকা লাগে। টাকা ছাড়া কিছুই হয়। না।
জীবনলাল হাই তুলতে তুলতে বললেন, গুলি খাওয়ার পরই আপনি আমার কথামতো কাজ শুরু করবেন। তার আগে না। ভয় পাবেন না, আপনার বাড়ি থেকে হাসপাতাল দূরে না। অল্প সময়েই হাসপাতালে পৌঁছতে পারবেন। আরেকটা কথা, গুলি যে আমি করেছি। এটা পুলিশকে না বললে ভালো হয়।
ধনু শেখ বললেন, ভাই সাহেব, খাওয়াদাওয়া করেন। আপনি ক্ষুধার্তা। ক্ষুধার্ত অবস্থায় কী বলতেছেন নিজেও বোধহয় জানেন না। রহমত কই? বাড়িতে অতিথি। খাবারের ব্যবস্থা কর।
ভাই সাহেব, আপনি কি রাতে আমার এখানে থাকবেন? থাকতে পারেন। দুইটা ঘর সাজানো আছে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে আসেন। দুই ভাই মিলে পুরানা দিনের মতো গল্প করি। মাওলানা মাথা খারাপ হবার পরে কী করে আপনারে বলব, আপনি যদি মজা না পান দুই কান কাঁইট্যা ফেলব।
জীবনলাল তাকিয়ে আছে। তার চোখ শান্ত। ধনু শেখ বললেন, দাড়ি ফেলে দিয়ে ভালো করেছেন। আপনার চেহারা সুন্দর। দাড়ির কারণে আগে বুঝতে পারি নাই। আপনার ভাগ্যও কিন্তু ভালো। আজ বাড়িতে মাশুল মাছ রান্না হয়েছে। মাশুল মাছের নাম শুনেছেন?
না
অনেকে বলে মহাশোল। রুই মাছ, তবে দেখতে শউল মাছের মতো। পাহাড়ি নদীতে থাকে, দু’একটা নিচে নেমে আসে। এই মাছ একবার খেলে বাকি জীবন মুখে লেগে থাকবে। ভালো কথা, দেশ স্বাধীনের দেরি কত?
দেরি নাই।
আমারও সেইরকমই ধারণা, দেরি নাই।
ধনু শেখ ভরসা ফিরে পাচ্ছেন। জীবনলাল গল্পগুজবে অংশ নিচ্ছে, এটা শুভ লক্ষণ। খাওয়াদাওয়া করার পর পেট শান্ত হবে। পেট শান্ত হলেই মাথা শান্ত। কিছু করবে বলে মনে হচ্ছে না। পিস্তল এনেছে ভয় দেখাবার জন্যে। এর বেশি কিছু না।
ধনু শেখের সমস্ত অনুমান মিথ্যা প্রমাণ করে জীবনলাল ঠাণ্ডা মাথায় কাছ থেকে পায়ে গুলি করল। ছিটকে পা সরিয়ে নিতে গিয়েও লাভ হলো না, পায়ের হাড় ভেঙে গুলি বের হয়ে গেল।
সবাই এসেছেন। মুসলমানদের মধ্যে আছেন মাওলানা ইদরিস। ন্যায়রত্ন রামনিধিও আছেন। মূল সিদ্ধান্ত তিনি দেবেন। রামনিধির শরীর খুবই খারাপ, তারপরেও গুরুতর এই বিষয়ে তাকে আসতেই হয়েছে।
ঘটনা এরকম— কালবোশোখী ঝড়ের সময় যমুনা ঘোষবাড়ির আমবাগানে আম কুড়াতে গিয়েছিল। শুরুতে ঝড় তেমন কিছু ছিল না— এলোমেলো বাতাস। হঠাৎ ঝড় প্রবল হলো। সঙ্গে তুমুল বর্ষণ। যমুনা দৌড়ে ঢুকল ঘোষবাড়িতে। ঝড় বাড়তেই থাকল। বিপদের উপর বিপদ। এই সময় ঘোষবাড়িতে ডাকাত পড়ল। তারা চিৎকার চেঁচামেচি করছে, কেউ শুনছে না। ডাকাতির শেষে ডাকাতরা, যমুনাকে ধরে নিয়ে গেল। তাকে উদ্ধার করা হয় শেষ রাতে উলঙ্গ অবস্থায়।
রামনিধি বললেন, এ তো মহাসর্বনাশ। কবিরাজ, তোমার মনে কী আছে বলো। মেয়েরে কী করব?
সতীশ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
রামনিধি বললেন, এই মেয়ে নিজ দোষে দোষী না। তস্করের কারণে দোষী। যে ঘটনা ঘটেছে তাতে তার গর্ভ সঞ্চারের সমূহ সম্ভাবনা। সেটা কোনো বিষয় না, গৰ্ভ নষ্ট করা যায়। কিন্তু মেয়ে যে পতিত হয়েছে তার গতি কী?
সমাজপতিদের একজন মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, কোনো গতি নাই।
রামনিধি বললেন, কঠিন বাস্তবতা হলো সমাজ এই মেয়েকে গ্ৰহণ করবে না। আত্মীয়স্বজন গ্ৰহণ করবে না। সে যেখানে যাবে যার কাছে যাবে সে পতিত হবে। তার ইহকাল পরকাল সবই শেষ।
সমাজপতিদের মধ্যে বিশিষ্টজন বিধান বাবু বললেন, মেয়ের বয়স অল্প এবং সে সুন্দরী বিধায় সমস্যা আরো প্রকট।
সতীশ কবিরাজ চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ফাঁসিতে ঝুলায়া মাইরা ফেলি?
বিধান বাবু বললেন, বোকার মতো কথা বলব না। ফাঁস নিয়া মরলে অসুবিধা আছে। থানা পুলিশ হবে। তোমারে ধরবে। একটা কাজ করা যায়, মেয়ের মাথা কামায়া তারে বাল বিধবা পরিচয়ে কাশিতে পার করা যায়। কাশি পূণ্যধাম। সেখানে রোজ গঙ্গাস্নান করলে এক পর্যায়ে পাপ কাটা যাবে।
সতীশ কবিরাজ বললেন, কাশিতে আমার কেউ নাই।
বিধান বাবু বললেন, আমি একটা প্রস্তাব দিতে পারি। শুনতে খারাপ লাগলেও প্রস্তাব উত্তম।
রামনিধি বললেন, কী প্রস্তাব?
মেয়েটারে রঙিলাবাড়িতে পাঠায়ে দেওয়া। আমরা ধরে নিব যমুনা নামে কেউ সমাজে ছিল না।
কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে থাকল। মাওলানা ইদরিস বললেন, এটা আপনি কী বললেন?
বিধান বাবু বললেন, অন্যায় কী বলেছি? আপনার মুসলমান সমাজ কি এই মেয়েরে নেবে? বলেন নেবে? আপনি মুসলমান বানায়া এই মেয়েরে বিবাহ করবেন?
মাওলানা বললেন, জনাব আমার স্ত্রী আছে। আমি কীভাবে বিবাহ করব? এক স্ত্রী আছে আরেক স্ত্রী হবে। আপনাদের সমাজে তিন চাইরটা স্ত্রী কোনো বিষয় না।
মাওলানা বললেন, আমার স্ত্রী রাজি হবে না। সংসারে সতীন তার পছন্দ না।
সমাজপতিদের কেউ কেউ হেসে উঠলেন। রামনিধি বিরক্ত গলায় বললেন, মূল বিষয়ে আসা। খামাখা কথা বইলা সময় নষ্ট করার কিছু নাই। সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সিদ্ধান্ত অতি অপ্রিয়, তারপরেও নিতে হবে। বিধান বাবুর কথা আমার পছন্দ হয়েছে। রঙিলাবাড়ি কিংবা এই ধরনের পতিত বাড়ি ছাড়া পতিত মেয়ের গতি নাই। আগের জন্মে। এই মেয়ে বিরাট পাপ করেছিল বলে এই জন্মে শান্তি। এই জন্মে শান্তি ভোগের পরে পরের জন্মে। সে উদ্ধার পাবে বলে আমার বিশ্বাস।
কয়েকজন একসঙ্গে বলল, খাঁটি কথা।
যমুনা এতক্ষণ কোনো কথা বলে নি। বাবার কাছ থেকে সামান্য দূরে মাথা নিচু করে বসেছিল। এইবার সে মাথা তুলে বলল, আমি রঙিলাবাড়িতে যাব না।
বিধান বাবু বললেন, তুমি কী করবা, কী করবা না এটা কেউ জিজ্ঞাস করে নাই। তুমি চুপ করে থাক।
যমুনা বলল, আমি রঙিলাবাড়িতে যাব না। বাবা, আমি রঙিলা বাড়িতে যাব না।
সতীশ কবিরাজ ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, মা’রে চুপ করে থাক।
রামনিধি বললেন, আমার শরীর ভালো না। জ্বর এসেছে। সভা এইখানেই শেষ। মেয়ে নিজের ইচ্ছায় রঙিলাবাড়িতে যাবে না। যাওয়ার কথাও না। তাকে জোর করে দিয়ে আসতে হবে। সমাজ রক্ষার জন্যে এটা ছাড়া গতি নাই। ব্যবস্থা আজই নিতে হবে। অনেক দেরি হয়েছে আর দেরি করা যাবে না।
যমুনা এই সময় দৌড় শুরু করল। তাকে ধরার ব্যবস্থা নেয়ার আগেই সে ঢুকে পড়ল জঙ্গলে। যেখান থেকে প্রতি অমাবশ্য রাতে হো হো শব্দ হয়।
সমাজপতিরা বিচলিত হলেন না। জঙ্গল থেকে যমুনাকে বের হতে হবে। কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার। বের হলে ধরে বেন্ধে রঙিলা বাড়িতে পার করা। সেখানে মেয়ে কেনাবেচার ব্যবস্থাও আছে। ভালো মহাজন পেলে বিক্রি হয়ে যাবে। সেবাদাসী হিসেবে জীবন কেটে যাবে। আগের জন্মের পাপের শাস্তি তো নিতেই হবে।
যমুনা জঙ্গলে ঢুকেছে। সন্ধ্যাবেলায়। বর্ষার জঙ্গলে নির্বিয়ে ঘোরাফেরা করা অসম্ভব ব্যাপার। ঝোপঝাড়, কাটালতা। সাপে কাটার ভয় আছে। গরু-ছাগল জঙ্গলে ঢুকে অনেক সময় সাপের কামড়ে মারা গেছে। সাপখোপ ছাড়াও ভয় আছে। ভূতপ্রেতের ভয়। খারাপ বাতাসের ভয়। বিশেষ এক ধরনের অপদেবতা আছে যারা জঙ্গলেই বাস করে। এরা ভয়ঙ্কর। নিষ্ঠুরতা তাদের খেলা।
যমুনা জঙ্গলের অনেক ভেতরে ঢুকে পড়েছে। ঘন জঙ্গল। জঙ্গলে এক ধরনের কুয়াশা পড়ে, তার নাম জংলি, কুয়াশা। দেয়ালের মতো এই কুয়াশায় কিছুই দেখা যায় না। হাতড়ে পথ চলতে হয়। দৌড়ে আসার কারণে যমুনা হাঁপাচ্ছে। গা দিয়ে গরম বাতাস বের হচ্ছে। তৃষ্ণায় কলজে ফেটে যাচ্ছে। তৃষ্ণার চেয়ে বেশি লেগেছে ক্ষুধা। তার কাছে মনে হচ্ছে, গাছ থেকে পাতা ছিড়ে সে এখন খেতে পারবে, তার কোনো সমস্যা হবে না। জঙ্গলের ভেতর মাধ্যই খালের একটা শাখা গেছে। পানি খেতে হলে খালটা খুঁজে বের করতে হবে। খালটা কোথায় কে জানে! যমুনা দম নেবার জন্যে বসে আছে। তার প্রায় গা ঘেসে একটা শিয়াল দৌড়ে গেল। তার ভয় পাওয়া উচিত, সে কেন জানি ভয় পেল না। মহাবিপদের সময় ভগবানকে ডাকতে হয়। সে ভগবানকেও ডাকল না। তার জীবন হঠাৎ করেই ভয়শূন্য এবং ভগবানশূন্য হয়ে গেল।
শশাংক পালের জীবন এখন হয়েছে ভগবানময়। তিনি সময় পেলেই ভগবানকে ডাকছেন। তাঁর শরীরের অবস্থা আরো খারাপ করেছে। তিনি এখন উঠে বসতেও পারেন না। সারাক্ষণ শুয়ে থাকতে হয়। তাঁর পা ফুলে পানি এসেছে। নিজের পায়ের দিকে তাকালেই ভয়ে তার শরীর কাপে। পায়ের দিকে তাকালেই মনে হয়, মৃত্যু দ্রুত এগিয়ে আসছে। ভগবান ছাড়া গতি নেই। ভগবান দয়া করলেই বৈতরণী পার হওয়া যাবে। ভগবান দয়া করবেন। এমন মনে হচ্ছে না।
শশাংক পালের ছোট শ্যালক এসেছে জামাইবাবুর খোজে। ছোট শ্যালকের নাম পরিমাল। তার নানান ব্যবসা আছে। পয়সাকড়ি ভালোই করেছে। তবে টাকা-পয়সার প্রকাশ নেই। সে হিসেবি ব্যবসায়ী।
পরিমল বলল, জামাইবাবু, আপনার একী অবস্থা!
শশাংক পাল বললেন, অবস্থা খারাপ কী? শুয়ে আছি। দিনরাত শুয়ে থাকার ভাগ্য সবার হয় না। আমার হয়েছে।
চিকিৎসা করাচ্ছেন?
সর্ব চিকিৎসা শেষ হয়েছে। এখন চলছে। ‘কেরোসিন’ চিকিৎসা।
‘কেরোসিন’ চিকিৎসাটা কী?
রোজ দুই চামচ করে কেরোসিন খাচ্ছি। কেরোসিন হলো বিষ। আমার উদরে আছে বিষ। বিষে বিষক্ষয়।
আমার সঙ্গে চলেন। দিদি আপনাকে নিতে বলেছে।
শশাংক পাল বললেন, সে বাঁশি বাজিয়েছে বলেই আমি দৌড় দিয়ে চলে যাব! সে শ্ৰীকৃষ্ণ না, আর আমিও রাধিকা না।
ভিক্ষুকের মতো পরের বাড়িতে থাকবেন?
শুধু যে ভিক্ষুকের মতো থাকব তা-না, ভিক্ষাবৃত্তিও শুরু করব। একটা ঘোড়া কিনব, তারপর ঘোড়ায় চড়ে ভিক্ষা।
আপনি সত্যি যাবেন না?
না।
কিছু টাকা-পয়সা এনেছিলাম।
কত?
একশ’।
সারাজীবন তোমাদের টাকা-পয়সা দিয়েছি, আজ একশ’ টাকা নিয়ে হাত গান্ধা করব না। টাকা নিয়ে বিদায় হও।
চলে যাব?
সেটা তোমার বিবেচনা। আমোদ ফুর্তি করতে চাইলে রঙিলা বাড়িতে চলে যাও। আমাকে একশ’ টাকা দিয়ে নষ্ট করার চেয়ে একশ’ টাকার আমোদ কিনে নাও। দুই রাত থাকবা, খরচ হবে পঞ্চাশ। মদ্যপান করবা। খাওয়া-দাওয়া করবা। বখশিশ। এতে খরচ করবা পঞ্চাশ। একশ’ টাকার হিসাব পেয়েছ?
জামাইবাবু আমি যাই?
যাও যাও। ভাগো।
দিদিকে কিছু বলব?
বলবা যে জামাইবাবু তোমাকে প্রতিদিন স্নানের আগে এক চামচ করে বিষ্ঠা খেতে বলেছে। বিষ্ঠা শরীরের জন্যে ভালো। গ্রামের কুকুর এত মোটাতাজা কীভাবে থাকে? বিষ্ঠা খেয়ে। তুমিও খেয়ে দেখতে পার। তোমার শরীরও দুর্বল। দুর্বল শরীরের জন্যে বিষ্ঠা মহৌষধ।
পরিমল জামাইবাবুকে প্ৰণাম না করেই বিদেয় হলো।
শশাংক পাল সুখেই আছেন। মনটা কয়েকদিন সামান্য খারাপ, কারণ সুলেমান ভিক্ষা করতে গিয়ে ফিরছে না। চারদিন হয়ে গেল। দূরে ভিক্ষা করতে গেলে ফিরতে এক দুই দিন দেরি হয়। তবে এতদিন অনুপস্থিতি এই প্রথম। শশাংক ঠিক করে রেখেছেন, এবার সুলেমান ফিরলে তার ঘোড়ায় চড়ে তিনি প্রতিদিনই খোলা হাওয়ায় কিছুক্ষণ ঘুরবেন। স্বাস্থ্যের জন্যে খোলা হাওয়ায় ঘোরাঘুরি অত্যন্ত উপকারী। তবে ঘোড়ার পিঠে সোজা হয়ে বসে থাকতে পারবেন না। ঘোড়ার গলা জড়িয়ে শুয়ে পড়তে হবে।
এক সপ্তাহ শেষ হলো, সুলেমান ফিরল না। শশাংক পাল যখন চিন্তায় অস্থির তখনই তিনি ধনু শেখের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলেন। কোলকাতা থেকে পাঠানো চিঠিতে ধনু শেখ লিখেছেন–
শ্ৰী শশাংক পাল
জনাব,
বিশেষ কারণে পত্র দিলাম। পত্রের নির্দেশ মোতাবেক কার্য করবেন। আমার শরীর ভালো না। এক দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাত পাইয়াছিলাম। আঘাতে পচন ধরিবার কারণে শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে পা কাটিয়া বাদ দিতে হইয়াছে। রোগ এখনো আরোগ্য হয় নাই। চিকিৎসা চলিতেছে।
এখন মূল বিষয়ে আসি। হরিচরণের বিষয়সম্পত্তির অধিকার আমি বিশেষ কারণে পরিত্যাগ করিয়াছি। সম্পত্তির প্রকৃত ওয়ারিশন পাওয়া গেলে তাঁহাতে সব কিছু বর্তাইবে। ওয়ারিশান পাওয়া না গেলে সরকার বাহাদুর এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন। এতদিন আপনি ভোগদখল করিলেন। নায়েবকে আমি এই বিষয়ে পত্ৰ দিয়াছি। সে আপনাকে হিসাবপত্র বুঝাইবে।
আমি সহসা বান্ধবপুরে আসিব এইরূপ মনে হইতেছে না। আর যদিও আসি হরিচরণের বাড়িঘরে উপস্থিত হইব। না। আপনি বিবেচনা মতো কাৰ্য করবেন।
ইতি
খান সাহেব ধনু শের
কলিকাতা
শশাংক পাল চিঠি পড়ে কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইলেন। তারপর ডেকে পাঠালেন নায়েবকে। নায়েবের নাম বিনয়। সে নামের মতোই বিনয়ী। হরিচরণের (বর্তমান ধনু শেখের) জমিদারির দেখাশোনার প্রধান দায়িত্ব তার। কাজকর্মে অতি দক্ষ।
বিনয়!
জে আজ্ঞে।
খান সাহেবের কোনো পত্র পেয়েছ?
পেয়েছি।
বিষয় কিছু বুঝেছ?
আজ্ঞে না। তবে বিষয় জটিল।
জটিল ভাবলেই জটিল। জটিল ভাববা না।
আপনে যেমন বলবেন।
ক্যাশে নগদ টাকা-পয়সা যা আছে আমার কাছে দিয়া যাবা।
যা বলবেন করব। চিঠিতে সেই রকম লেখা।
আমার জন্যে বিলাতি একটা বোতল জোগাড় করবা, রঙিলা বাড়িতে পাওয়া যাবে। নিজে যাইতে না চাও অন্যেরে দিয়া আনাইবা।
আচ্ছা।
রাতে মুরগির কোরমা আর পোলাও খাব। জামাই পছন্দ চাউল জোগাড় করতে পার কি-না দেখ।
আপনার শরীরের অবস্থা যেমন গুরুভোজন কি ঠিক হবে?
আমার শরীর আমি বুঝব। তোমার চিন্তার কিছু নাই।
আচ্ছা।
একজন কর্মঠ কাউরে জোগাড় করো যার কাজ আমার সেবা করা। মেয়েছেলে হলে ভালো হয়। পুরুষমানুষ রোগীর সেবা করতে পারে না। মেয়েছেলে পারে। শরীর স্বাস্থ্য যেন ভালো থাকে। মুখের কাটিং ভালো হওয়া প্রয়োজন। বয়স হইতে হবে কুড়ির নিচে।
বিনয় হতাশ গলায় বলল, কই পাব এমন মেয়েছেলে?
শশাংক পাল বললেন, নিচা জাতের মধ্যে খোঁজ। নিচা জাতের মধ্যে পাইবা। চণ্ডাল, হাড়ি, ডোম। এদের মেয়েছেলেদের শরীর স্বাস্থ্য ভালো হয়। এখন আমারে ধরাধরি করে আরাম কেদারায় শোয়ার ব্যবস্থা করো। শরীরটা আজ ভালো ঠেকতেছে।
বিনয় তাকিয়ে আছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না। শশাংক পাল বললেন, এক মেয়ে শুনেছি জঙ্গলে পালায়া আছে, তার খোঁজ নিতে পার। আমার আশ্রয়ে থাকবে, অসুবিধা কী?
বিনয় বলল, এইগুলা কী বলেন?
শশাংক পাল বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি যা বলি চিন্তাভাবনা করে বলি। আমার শরীরে পচন ধরেছে, মনে পচন ধরে নাই। বুঝেছ?
হুঁ।
সময় ফুরায়ে আসছে। আনন্দ ফুর্তি যা করার এখনই করতে হবে। হাতে সময় নাই। খাঁটিয়া ঘাড়ে নিয়া বলা হরি হরি বলের সময় আগত।
শরীরটা ঠিক করেন। চলেন কইলকাতা যাই।
কইলকাতা যাব না। কইলকাতার ডাক্তার-কবিরাজ এইখানে নিয়া আসি। সোনার মোহর দিয়া ভিজিট দিব। বুঝেছ? এখন আমার টাকার অভাব নাই। রঙিলা বাড়ির জুলেখার খোঁজ পাও কি-না দেখ। প্রতি সন্ধ্যায়। সে এই বাড়িতে গান করবে। টাকা-পয়সা যা লাগে দিব। নিয়মিত সঙ্গীত শুনলে শরীর আরোগ্য হয়। বুঝেছ?
কিছু না বুঝেই বিনয় মাথা নাড়াল। সে বুঝেছে।