ছেলে হয়ে ওঠার ইচ্ছে আমার সেদিন মরে গিয়েছিল, যেদিন ইচ্ছেয় আচ্ছত আমি দেখলাম ফুলবাহারির মা এসেছে অবকাশে। হাড্ডিসার। কামেলা রোগে মরতে বসেছিল, পীরফকিরের দোয়ায় নাকি বেঁচেছে। কাহিলাকে কেউ আর কাজে রাখে না। এর ওর বাড়ি চাল ডাল ভিক্ষে করে সে চলে। ফুলবাহারির মা যখন পাকঘরের বারান্দায় ধপাস করে বসল, আর ওঠার সময় বারান্দার থামে ভর করে দাঁড়াল, এত ক্লান্ত যে জীবনের ভার আর সে বহন করতে পারছে না। আমার দেখে মনে হয় জীবন কাঁধে এসে বসে সময় সময়, একে পিঠে ঝুলিয়ে বহুদূর হাঁটতে শরীর মন সায় দেয় না।
সেই ফুলবাহারির মা, ঘসঘস ঘসসসস শব্দে মশলা বাটত নানিদের পাকঘরে। ঘসঘস ঘসসসস। ঘসঘস ঘসসসস। শব্দটি আমি যেন শুনি যখন পা টেনে টেনে বেলগাছের তল দিয়ে সে হেঁটে চলে যাচ্ছিল। কোথায় যাচ্ছিল কে জানে, তার পেছন পেছন দৌড়ে আমার দেখা হয়নি সে যাচ্ছে কোথায়, এ জগতের কোথায় তার যাওয়ার জায়গা। ঘসঘস শব্দটি আমাকে একটি ভাঙা চৌকাঠে এনে বসায়, যেখানে বসে চেয়ে থাকতাম শিলপাটার ওপর ঝুঁকে দুলে দুলে ফুলবাহারির মা’র মশলা বাটার দিকে। সাত সকালে এসে মশলা বাটতে বসত, দুপুরের আগে আগে বাটা শেষ হত। হলুদ, মরিচ, ধনে জিরা, পিঁয়াজ, রসুন, আদা সাতরকম মশলা তাকে পিষতে হত শিলপাটায়। বড় এক গামলায় করে নানার দোকানের কর্মচারি এসে নিয়ে যেত মশলা। বিকেলে আবার বাটতে বসত, সারা বিকেল বাটত। ইচ্ছে হত আমিও বাটি, ফুলবাহারির মা’র মত দুলে দুলে। বলেওছি, একটু খানি বাটতে দিবা মশলা আমারে?
ফুলবাহারির মা মশলা বাটা থামিয়ে আমার দিকে ফক করে পান খাওয়া কালো দাঁত হাসল, বলল আপনে মশলা বাটতে পারবাইন না আপা, এইডা খুব শক্ত কাম। ফুলবাহারির মা আমার মা’র বয়সী, আমাকে সে ডাকে আপা আর আপনি সম্বোধন করে, কারণ আমি মনিবের বাড়ির মেয়ে। আমাকে মশলা বাটা মানায় না, ছোটলোকেরা বাটে এসব। ছোটলোকের হাত ময়লা হয় শক্ত আর নোংরা কাজ করে। তিন বছর বয়স থেকেই আমি বুঝতে শিখেছি, কারা ছোট আর কারা বড়। ফুলবাহারির মা দেখতে বড় হলেও ছোটলোক, এদের কোলে উঠতে হয় না, এদের গা ধরতে হয় না, এদের হাতের রান্নাও খেতে হয় না। এদের চেয়ারে সোফায় বসার অধিকার নেই, হয় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, নেহাত বসতে হলে মাটিতে, শুলে মাটিতে শুতে হয়। ডাকার সঙ্গে সঙ্গে এদের দৌড়ে আসা চাই সামনে, যে হুকুমই করা হোক, সবই মুখ বুজে পালন করতে হয় এদের। ছোটলোকদের তাই করার নিয়ম।
ফুলবাহারির মা’র পান খাওয়া কালো দাঁতের দিকে তাকিয়ে আমি একটি প্রশ্ন, প্রশ্নটি হঠাৎই উদয় হয়, করি–তুমার নাম কি ফুলবাহারির মা?
মশলা পেষার ঘসঘসস শব্দে আমার প্রশ্ন সম্ভবত থেতলে যায় বলে সে কোনও উত্তর দেয় না। চৌকাঠে বসে আমি আবারও, বিকেলে, যখন বাড়ির মানুষগুলো দুপুরের খাওয়ার পর গা টান করে শুয়েছে, চোরা বেড়ালটি চুলোর পাড়ে ঘুমোচ্ছে, প্রশ্ন করি, এবার স্বর উঁচু করে, তুমার নাম কি?
পেষণ থামিয়ে ফুলবাহারির মা তাকায় আমার দিকে, ঘামে ভেজা তার কপাল, নাক, চিবুক। নাকের ডগায় ঘাম জমলে, রুনু খালা বলেন জামাইয়ে আদর করে। ফুলবাহারির মা’র জামাই মরে ভূত হয়ে গেছে কত আগে, তাকে আদর করবে কে! এবার আর কালো দাঁত বেরোয় না হাসিতে। হাসিতে নিচের পুরু ঠোঁট উল্টে থাকে, আর দু’গালে যেন দুটো আস্ত সুপুরি।
আমার উৎসুক চোখে শান্ত চোখ রেখে ফুলবাহারির মা বলে আমার কুনো নাম নাই বইন। মাইনষে ডাহে ফুলবাহারির মা।
এবার আমি হেসে, চোখ নাচিয়ে, মেয়েমানুষটির বোকামো ধরে ফেলেছি ভঙিতে বলি ফুলবাহারি জন্মানোর আগে তুমার নাম কি ছিল? আঁচলে মুখের ঘাম মুছে ফুলবাহারির মা বলে–আমার কুনো নাম আছিল না।
–তাইলে মাইনষে তুমারে কি কইয়া ডাকত? ধর তুমার মা বাপ কি ডাকত?
ফুলবাহারির মা বড় একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে–মা বাপ কি আর আছে? কবেই মইরা গেছে।
–তা বুঝলাম, কিন্তু যহন তুমার বাপ মা মরে নাই, তুমারে নাম দেয় নাই? ধর আমার একটা নাম আছে। নাসরিন। ফুলবাহারির মা’কে আমি ইস্কুল মাস্টারের মত বোঝাই। মশলা পিষতে পিষতে বলে সে–না, আমার কুনো নাম আছিল না কুনোকালে।
আমারে এই ছেড়িডা, ছেমড়িডা, বান্দরডা, কইয়া বেহেই ডাকত।
আমি অবাক তাকিয়ে থাকি দুলতে থাকা শরীরের দিকে। যেন শিলপাটায় নয়, আমার মাথার ভেতর শব্দ হচ্ছে ঘসঘস ঘসসসস।
মা’কে, কলাগাছে কলা ধরার বা কড়ইএর ডাল ভেঙে পড়ার খবর যেমন দিই, তেমন করে এ খবরটিও দিই–জান মা, ফুলবাহারির মা’র নিজের কুনো নাম নাই।
মা শব্দ করলেন হু।
মা এতটুকু চমকান না শুনে মা’র বয়সী একজনের কোনও নাম নেই। এত নির্লিপ্তি মা’র, আমি বুঝি না, কেন।
–মা, নাম ছাড়া আবার মানুষ হয় নাকি? আমি বই থেকে চোখ সরিয়ে মনে জমে থাকা প্রশ্নটি করি।
–এত প্যাঁচাল পারিস না ত। বই পড়। জোরে জোরে পড়। মা খেঁকিয়ে ওঠেন। বাধ্য মেয়ের মত দুলে দুলে পড়ি–
আপনারে বড় বলে বড় সে নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।
লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে।
সদা সত্য কথা বলিবে।
–ফুলবাহারি, তুমার মার কুনো নাম নাই, জান? পড়ার ফাঁকে ফুলবাহারিকে বলি চাপা স্বরে।
ফুলবাহারিও একটুও অবাক হয় না শুনে যে তার মা’র কোনও নাম নেই। যেন এটিই স্বাভাবিক। যেন এটি হওয়ারই কথা ছিল। সে, বরং বাঁকা চোখে তাকিয়ে আমার চোখে, অনুমান করতে চায় কোনও লুকোনো কারণ আছে কি না তার মা’র যে কোনও নাম নেই সে নিয়ে আমার আগ্রহের।
–নাম নাই তো নাম নাই। নাম দিয়া কাম কি! গরিবের নাম থাকলেই কি না থাকলেই কি! ফুলবাহারি চোয়াল শক্ত করে বলে।
মা প্রায়ই বলেন ফুলবাহারির নাকি তেজ খুব বেশি। কথা বলে ব্যাডাগর লাহান, এক্কেরে ফাডা বাঁশ। তা ঠিক। ফুলবাহারির কথা আমাকে ভাবনায় ফেলে। তার মানে গরিবের কোনও নামের দরকার নেই! নাম দিয়ে কোনও কাজ নেই গরিবের! সম্ভবত ফুলবাহারি ঠিকই বলেছে। গরিবের ইস্কুলে যেতে হয় না, ইস্কুলের খাতায় নাম লেখানোর কোনও দরকার হয় না। গরিবের বাড়ি ঘর নেই, দলিলপত্রও তাই করতে হয় না, তাই নামেরও দরকার নেই। তাহলে নাম ছাড়াও বাঁচা যায়, অবশ্য গরিবেরাই বাঁচে কেবল। গরিবের কেবল নাম নয়, ওরা লেপ তোষক ছাড়াও বাঁচে, মাছ মাংস ছাড়াও, জুতো সেন্ডেল, জামা কাপড়, তেল সাবান, স্নো পাউডার ছাড়াও বাঁচে। ফুলবাহারির জন্য আমার খুব মায়া হতে থাকে, ওর নামহীন মা’র জন্যও। বালতির পানিতে ত্যানা ভিজিয়ে, চিপে, ফুলবাহারি উবু হয়ে মুছতে থাকে মেঝে। ওর কানে বিড়ি গোজা, কাজ কাম সেরে এই বিড়িটি ধরাবে সে। ফুলবাহারির বিড়ি খাওয়ায় বাড়ির কেউ আপত্তি করে না। ছোটলোকেরা বিড়ি তামাক খেতে পারে, কিন্তু ভদ্রঘরের মেয়েদের ওসব মুখে তোলা যাবে না। পুরুষ সে বড়লোক হোক, ছোটলোক হোক, যা ইচ্ছে করবে, যা ইচ্ছে খাবে, ফুঁকবে– বাধা নেই। ফুলবাহারির কালো লম্বা শরীরটি, বসন্তের দাগ-মুখ আর কানে গোঁজা বিড়িখানি আমার বড় চেনা। কাজের ফাঁকে মেঝেয় পাছা ঠেকিয়ে বিড়ি ধরায় ও, ফক ফক করে ধোঁয়া ছাড়ে। ফুলবাহারিকে তখনই, আমি লক্ষ করেছি সবচেয়ে খুশি খুশি দেখায়।
–তুমি স্বরে অ স্বরে আ ক খ পড়তে জান না! আমি ওর উবু হওয়া শরীরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি।
ফুলবাহারি মেঝে মুছতে মুছতে মাথা নেড়ে বলে– না।
কাগজে ঘসঘস করে স্বরে অ লিখে ফুলবাহারিকে বলি– এইটা হইল স্বরে অ। কও স্বরে অ।
ফুলবাহারি বলে–স্বরে অ।
মেঝে মোছা থামিয়ে, কৌতূহল চোখে।
— আর এই যে দেখ, এইটা তুমার নাম, ফুলবাহারি। নামটিও কাগজে লিখে মেলে ধরি ওর সামনে।
লেখাটির দিকে ও অবাক হয়ে তাকায় যেন এটি দূরের কোনও দেশের ছবি,, চিনতে পারছে না। ফুলবাহারি কাজে ফাঁকি দিচ্ছে, মা তাই বলবেন। মা ঘরে নেই বলেই ফুলবাহারি কাজ থামিয়ে মেঝেয় পাছা পেতে বসতে পারল, বসে বলতে পারল– এইটা বুঝি আমার নাম খালা?
তেজি মেয়ের মুখে তখন কচি খুকির হাসি।
ইচ্ছে করে ফুলবাহারিকে স্বরে অ স্বরে আ শেখাই, কখগঘ শেখাই, ফুলবাহারি নিজের নাম লিখতে পারবে নিজে।
–আইচ্ছা ফুলবাহারি, তুমি আমারে খালা কইয়া ডাক ক্যান? আমি ত তুমার অনেক ছোট।
আমার প্রশ্ন শুনে বোকা-চোখে তাকায় আমার দিকে ফুলবাহারি। বলে–ওরে বাবা, আপনেরে খালা কমু না ত কি! আপনেরা বড়লুক। বয়সে ছোট হইলান,তাতে কি! বড়লুক হইলে, এমন কি কুলের আবুরেও কুনোদিন নাম ধইরা ডাকতে নাই। আমরা গরিব, আমরা এই কপাল লইয়াই জন্মাইছি।
আমি হেসে নিজের কপালে হাত রেখে বলি–তুমার কপাল যেইরম দেখতে, আমার কপালও। গরিবের কপাল কি ব্যাকা হয়?
ফুলবাহারি হেসে ফেলে, কচি খুকির হাসি ওর মুখে, বলে– এইডা কি আর এই কপাল! কপাল বলতে বুঝাইছি, ভাইগ্য।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বালতির পানিতে ত্যানা ভিজিয়ে ঘরের বাকিটুকু চৌকাঠ সহ মুছে নিতে নিতে ফুলবাহারি আবার বলে–বাপ মরার পর কপাল আমগোর আরও পুড়ল। মাইনষের বাড়িত বান্দিগিরি কইরা খাইতে অয় অহন। লেহাপড়া কি আমগোর কপালে আছে!
জিজ্ঞেস করি–তুমার বাপ নাই!কবে মরছে! কেমনে?
ফুলবাহারি চোখ না তুলে বলে–বাতাস লাইগা মরছে।
–বাতাস? বাতাস লাগলে মাইনষে মরে নাকি? বকের মত গলা লম্বা হয়ে ওঠে বিস্ময়ে।
–জিনের বাতাস খালা। বাপে হাতপাও লুলা অইয়া বিছনাত পড়ল। পড়ল ত পড়লই। আর উঠল না। চৌকাঠ মুছে বড় একটি শ্বাস ছেড়ে বলে ফুলবাহারি। ওর পরনের মোটা বাইনের শাড়িটি হাঁটুর কাছে ছেঁড়া। ফুলবাহারির এটি ছাড়া আর একটি সবুজ রঙের শাড়ি আছে। ওটি আরও ছেঁড়া। ওর জন্য আমার আবারও বড় মায়া হতে থাকে।
ফুলবাহারি ঘর মুছে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। ওর প্রস্থানের দিকে নিষ্প্রাণ তাকিয়ে থাকি। ভেতরে তোলপাড় করে জিনের বাতাস রেগে মানুষ মরার খবর।
মা’কে জিজ্ঞেস করে পরে উত্তর পেয়েছি, জিনের বাতাস লাগলে হাত পা অবশ হইয়া যায়, কথাডা সত্য।
জিন ভূত ব্যাপারগুলো কেমন যেন অদ্ভুত ব্যাপার! কেবল শরাফ মামাই ভূত দেখে বাড়ি ফেরেন, আমার কখনও দেখা হয়নি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় পেত্নির বিজলি দেখতে, সেও দেখা হয়নি, সারাদিন জানালার ফুটো দিয়ে বাইরে বাঁশঝাড়ের অন্ধকারে তাকিয়ে থেকেও।
সেদিনের পর সপ্তাহ পার হয়নি, জিনের বাতাস লাগল গেঁতুর ওপর। গেঁতুর ডান পাখানা হঠাৎ অবশ হয়ে গেল। গেঁতুর মা ছেলের শোকে পাগল, নানির বাড়ি এসে সে গেঁতুর জন্য বিলাপ পেড়ে কাঁদে, দেখতে যাওয়ার তার অনুমতি মেলে না। গিয়েওছিল বাড়ির উঠোন অবদি, ঝাঁটা মেরে তাড়িয়েছে গেতুঁর বাবা। বাইন তালাকের পর গেঁতুর মা’র আর অধিকার নেই গেঁতুর ছায়া মাড়ানো, পেটের ছেলে, তা হোক। গেতুঁর মা’র বিলাপ নানির বাড়ির লোকেরা কেউ খাটে বসে, কেউ দরজায়, আমগাছতলায়, কলতলায় দাঁড়িয়ে দেখেন, ঝুনু খালা আহা আহা করে বেণি দুলিয়ে চলে যান ঘরের ভেতর। নানি পান সাজতে থাকেন নিশ্চুপ। হঠাৎ বিষম এক হুংকার ছুঁড়ে গেঁতুর মা’কে দূরে সরতে বলেন টুটু মামা। মেয়েমানুষের কান্নাকাটি তাঁর নাকি অসহ্য লাগে। মুখে আঁচল পুরে কান্না থামিয়ে চলে যেতে হয় গেঁতুর মাকে, আমাকে কেউ লক্ষ করে না যে আমিও যাচ্ছি তার পেছন পেছন। বাঁশঝাড়ের তলে আমার ভয় পাওয়ার কথা, পাই না। জিনের বাতাস লেগে আমারও যে হাত পা অবশ হয়ে যেতে পারে, ভুলে যাই। আমি বেখেয়ালি বেহিশেবি বেত্তমিজ বেয়াদ্দপ মেয়ে। গেঁতুর মা রেললাইনের দিকে হাঁটে, ছায়ার মত আমিও। লাইনের ওপর বসে গেঁতুর মা কাঁদে, আমি পাথর কুড়িয়ে ছুঁড়তে থাকি লোহার পাতে। ঠং ঠং, ঠং ঠং। গেঁতুর মা কান্না থামিয়ে দেখেন পেছনে দাঁড়িয়ে আছি আমি, আমার না আঁচড়ানো চূল, ধুলো মাখা পা, না মাজা দাঁত। বলি–কাইন্দ না গেঁতুর মা। সইরা বও, রেলগাড়ি আইয়া পড়ব। গেঁতু দেইখ্যা ওর বাপেরে বটি দিয়া কুপাইয়া মাইরা তুমার কাছে চইলা আইব একদিন।
বটি দিয়ে কুপিয়ে, মা বলেছিলেন ফুলবাহারিকে মারবেন, যেদিন শিংমাছের তরকারি চুলোয় রেখে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল, ওদিকে তরকারি পুড়ে ছাই; আর বাবার বুক পকেট থেকে গোপন চিঠিটি পাওয়ার পর মা রাজিয়া বেগমকেও চেয়েছিলেন। বটি দিয়ে কুপিয়ে মা ফুলবাহারিকে মেরে ফেলছেন বা রাজিয়া বেগমকে, ভেবে, যদিও রাজিয়া বেগম মানুষটিকে দেখিনি কখনও, মনে হত দেখতে বোধহয় ঝুনু খালার মত, মায়া হত। গেঁতু হাতে বটি নিয়ে গেঁতুর বাবাকে মেরে ফেলছে দৃশ্যটি আমি খুব সহজে কল্পনা করতে পারি। রক্তে ভেসে যাচ্ছে গেঁতুদের বাড়ির উঠোন ভাবতে আমার গা কাঁপে না, বাঁশঝাড়ের তল দিয়ে সন্ধেয় আসার মত গেঁতুর মার পেছন পেছন, যেমন গা কাঁপেনি।
গেঁতু মরে যাওয়ার দিন পাঁচেক পর আবার জিনের বাতাস লাগল ঠান্ডার বাপের ওপর। জিলিপির দোকান বন্ধ করে ঠান্ডার বাপ পড়ে রইলেন বিছানায়। কাশির সঙ্গে বেরোতে লাগল দলা দলা রক্ত। মৌলবি এসে মাঝে সাঝে ফুঁ দিয়ে যায়, শর্ষিনার পীরের কাছ থেকে পড়া পানি এনে খাওয়ানো হল ঠান্ডার বাপকে। রক্ত ঝরা থামেনি তবুও। জিনের বাতাস লাগলে লোক বাঁচে না, তাই বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়ে ঠান্ডা হয়ে বসে রইল ঠান্ডার বাপের আত্মীয়রা। খবর পেয়ে বাবা একদিন নিজে বস্তিতে গিয়ে হাজির, কি ব্যাপার দেখি কী হইছে বলে ঠান্ডার বাপের নাড়ি টিপে, চোখের পাতা টেনে নামিয়ে, জিভ বের করতে বলে কী সব দেখলেন, এরপর ঠান্ডাকে বললেন দোকান থেকে যক্ষার ওষুধ কিনে আনতে। ওষুধ খেয়ে সেরে গেলেন ঠান্ডার বাপ। এ কী কান্ড, জিনের বাতাস লাগা লোক দেখি দিব্যি তাজা। সপ্তাহও পেরোল না, ঠান্ডার বাপ আবার জিলিপির দোকান খুলে বিক্রিবাটা শুরু করলেন। চোখের সামনে এই ব্যাপারটি ঘটে যাওয়ার পর আমার জিনের বাতাসকে মোটেও মারাত্মক কিছু বলে মনে হল না। বাবাকেও দেখি ঠান্ডার বাপ বেঁচে উঠল বলে মোটে অবাক হলেন না, যেন তাঁর বাঁচারই কথা ছিল। বাবা, আমার বিশ্বাস হয়, চাইলে গেঁতুকেও বাঁচাতে পারতেন।
সম্পর্কে ফুলবাহারির লতায় পাতায় মামা হন ঠান্ডার বাপ। অবশ্য ফুলবাহারি বা তার মা সম্পর্কের দাবি করলে ঠান্ডার বাপ স্বীকার করেন না যে তিনি আদৌ এদের আত্মীয়। ফুলবাহারি নিজে বিড়ি খেতে খেতে আমাকে বলল একদিন–দুহান আছে তার, পইসা অইছে। অহন আর স্বীকার যায় না আমরা যে হের আত্মীয়, মাইনষের বাড়িত বান্দিগিরি করি যে, হেইলিগা। গরিবের মধ্যেও উচা নিচা আছে।
ঠান্ডার মা পাড়ায় বলে বেড়িয়েছে যে শর্ষিনার পীরের পড়া পানি খেয়ে জ্বিনের বাতাস ছেড়েছে তার খসমের। অবশ্য ফুলবাহারির বিশ্বাস–নানার ওষুধেই বালা হইছে মামু। মাইনষে কয়, বাতাস লাগলে নাহি বাচে না। কই বাচল ত।
ফুলবাহারি মানুষের কথায় তেমন আস্থা রাখে না। কালো ঘাড় সে টান টান করে রাখে যখন কথা বলে।
পঞ্চাশের মন্বন্তরে হাশেম মামা জন্মানোর পর নানির দুটো ছেলে পর পর জন্ম নিয়ে জ্বিনের বাতাস লেগে মরেছিল, মা সে কথা স্মরণ করেন ঠান্ডার বাপের বাতাস লাগার পর। ছেলে পাতলা পায়খানা করছে, বুকের দুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, কবিরাজ এসে ফুঁ দিয়ে গেল, বলল সাহাবউদ্দিনের বাড়ির জামগাছটিতে যে জিন বসে থাকে, সেই জিনেরই বাতাস লেগেছে ছেলের গায়ে। নানিকে বলা হল চামড়া আর লোহা সঙ্গে রাখতে। চামড়া বা লোহা দেখলে জিন ভেড়ে না। নানি এক টুকরো চামড়া, ভাঙা এক লোহা হাতে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরোন, রান্নাঘরে, পেশাবখানায় যেখানেই যান। জিন যদি আবার নানির কাধেঁ চড়ে ছেলের সামনে হাজির হয়, তাই ঘরের ভেতরে ঢুকেও নানিকে ডিঙোতে হত আগুন, মুড়া ঝারু দিয়ে গা ঝেড়ে নিতেন নিজের, যেন শরীরের আনাচ কানাচে লুকিয়ে থাকা দুষ্ট জিন বিদেয় হয়। এত করেও অবশ্য ছেলেদুটো বাঁচেনি। ছেলে জন্ম দেওয়ার পর মা’র জন্যও একইরকম আয়োজন করেছিলেন নানি, ঘরে আগুন জ্বেলে রাখতেন, মা পেশাব পায়খানা করতে ঘরের বাইরে গেলে মুড়া ঝাড়ু নিয়ে বসে থাকতেন ঘরে, ফিরে এলে মা’কে আগুন টপকে আসতে বলতেন, এলে হাতের ঝাড়ু দিয়ে গা ঝেড়ে দিতেন। একই আয়োজন জ্বিনের বাতাস থেকে সন্তান বাঁচানোর।
আমি জন্ম নিলে মা’র আগুন টপকে ঘরে ঢোকা দেখে বাবা বলেছিলেন এইগুলা আবার কি কর?
করতে হয়, মা বলেন বাচ্চার বাতাস লাগলে দুধ খাওয়া ছাইড়া দিব, আমাশা হইয়া মরব।
মা’র চার ছেলেমেয়ে আমরা দিব্যি বেঁচে আছি। কেউ আমরা দুধ ছাড়িনি, আমাশা হলেও, মরিনি। কারও গায়ে জিনের বাতাস লাগেনি। মা অবশ্য আলহামদু লিল্লাহিল্লাযি খালাকাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা ওয়া জায়ালাজ জুলুমাতে ওয়াননূর, ছুম্মাল্লাযীনা কাফারু বিরাব্বিহিম ইয়াদিলুন বলে বলে তাবৎ রোগ থেকে নিজেকে এবং ছেলেমেয়েদের বাঁচিয়েছেন বলে অনেককে বলেন, বাবাকেও। বাবা শুনেও শোনেননি ভাব করেন। ঠান্ডার বাপের রোগ সারার পর বস্তি থেকে বাতাস লাগার খবর কমে এল, আর মাঝে মাঝে যে সব বাতাস লাগা দু’চারজনকে দেখেন বাবা, সারিয়ে ফেলেন ওষুধে, কারু কারুকে আবার হাসপাতালে পাঠান। সুস্থ হয়ে ফিরে আসে ওরাও।
ফুলবাহারি এ বাড়ির কাজ ছেড়ে দেবার পর জ্বরে ধরল তাকে। এবার আর জিনের বাতাস কেউ বলল না। এতদিনে আল্লায় একটা কামের কাম করছে। লাজ শরম একদম আছিল না বেটির। ধপধপাইয়া হাঁটত। জ্বরে ভুইগা যেন এই বেটি মরে আল্লাহ। মসজিদের ইমাম সেরে যাওয়া ঠান্ডার বাপের বাহুতে তাবিজ লাগিয়ে দিয়ে বলে গেলেন। জ্বর হয়েছে খবর পেয়ে ফুলবাহারিকে দেখতে যাব বললে মা আমাকে কানের লতি টেনে বললেন ঠ্যাং লম্বা হইয়া গেছে, টই টই কইরা খালি ঘুরাঘুরির তাল!
আমার আর দেখতে যাওয়া হয়নি ফুলবাহারির জ্বর। জ্বর সারলে শুনি ফুলবাহারির বিয়ে হয়ে গেছে বস্তিরই এক ফোকলা দাঁতের বুড়ো, বয়স সত্তর মত, ঘরে তিনটে বউ আছে, তার সঙ্গে। ফুলবাহারির বিয়ের জন্য তার মা টাকা চাইতে এল নানির বাড়ি। নানি তাকে, দেখলাম, আঁচলের খুঁট খুলে পাঁচ টাকা বার করে দিলেন। আরও দুটো তিনটে বাড়ি থেকে টাকা যোগাড় করে ফুলবাহারির জন্য একটা লাল শাড়ি কেনা হল। বুড়োকে দেওয়া হল দু’শ টাকা যৌতুক। ফুলবাহারিকে আমার মনে হল, হঠাৎ যেন বড় দূরে সরে গেছে। তাকে আর আমাদের রান্নাঘরের বারান্দায় অলস বিকেলে বিড়ি ফুঁকতে দেখব না, তার সঙ্গে আমার গল্পও আর হবে না আগের মত। ফুলবাহারি এখন আর কারও বাড়িতে বান্দিগিরি করবে না। সে তার স্বামীর জন্য রাঁধবে বাড়বে, মাথায় ঘোমটা দিয়ে কলসি কাঁখে পুকুরে যাবে পানি আনতে। ফুলবাহারিকে এমন রূপে, আমার মনে হয় না, ঠিক মানায়। ওর ধপধপাইয়া হাঁটাটিই ছিল সুন্দর। রাস্তার ছোকরারা ওর পেছন পেছন নেচে নেচে চুতমারানির বেডি বলেছিল যেদিন, আমার চোখের সামনে ঘুরে দাঁড়িয়ে ফুলবাহারি চড় কষিয়েছিল এক ছোকরার গালে। আমি মুগ্ধ দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, হাতে ধরা গ্যাস বেলুনটি কখন উড়ে গিয়েছিল আকাশে, টের পাইনি।
বেল গাছ তলা ধরে যেতে যেতে গোধূলির ধূলির মত আবছা আঁধারে মিশে যেতে যেতে ফুলবাহারির মা বলে–ফুলবাহারিডারে মাইরা ফেলছে হের জামাই, গলা টিইপা। কান্দি না। কাইন্দা কী লাভ। কানলে কি আমার ফুলবাহারি ফিইরা আইব! আল্লায়ই বিচার করব।
বেদেনির ঝুড়ি থেকে বের হয়ে এক বিশাল অজগর তার বিশাল হাঁ মুখে আমাকে গিলে ফেলে যেন। এক বোবা বিকট কষ্ট আমাকে আমি শতটুকরোয় ছিঁড়তে থাকে, আমার নিজের গুঁড়ো গুঁড়ো কষ্টকে থেতলে ফেলে বুকের পাটায়। ভেতরে শব্দ শুনি ঘসঘসসস ঘসসসস।