সৌদামিনীর তিন ছেলের বিয়ে হয়েছে। ঘরে এসেছেন প্রমোদকুমারী, নিশিবালা ও সুহাসিনী। নাতি-নাতনীদের নিয়ে ভরা সংসার। ছেলের বৌয়ের সাংসারিক কাজে সুনিপুণ। প্রমোদকুমারী, নিশিবালা এবং সুহাসিনীর কথা আমরা খুব বেশি জানতে পারিনি। তারা বাড়ির সনাতন নিয়ম মেনে ঘরকন্নার কাজ নিয়ে থাকতেই ভালবাসতেন। এদের মধ্যে প্রমোদকুমারীর ছিল দুরন্ত সাহস। সবাই তার ওপর নির্ভর করতে পারতেন। পারিবারিক নাট্যানুষ্ঠানে তাদের যোগ দিতে দেখে মনে হয় এদিকে একটু উৎসাহ পেলে তারাও নিজেদের দক্ষতা দেখাতে পারতেন। একবার রত্নাবলী নাটকের অভিনয়ে তারা তিন বোই অংশগ্রহণ করেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁদের দুই ননদ! তবে গান বা নাটক-অভিনয় নিয়ে মেতে না উঠলেও পাঁচ নং বাড়ির পরিবেশটি সব দিক থেকেই মনোরম ও অন্তরঙ্গ করে রেখেছিলেন তিনজনে। অতিথিসেবা, দেবপূজা, ছেলেমেয়েদের মানুষ করা, সংসারের কাজ দেখা সবই করেন তারা। সৌদামিনী বালিশে আধশোয়া হয়ে সব দেখতেন আর স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তেন। তার নাতনীরা ঘর-সংসারের চার দেওয়ালের গণ্ডির মধ্যে থেকেও জীবনকে সুন্দর করে তুলতে শিখেছিলেন। তাই বড় কিছু না করলেও এই পরিবারের মেয়েদের বুকে ছিল তৃপ্তির নিঃশ্বাস, শান্তির স্বাদ। অনেক পৌত্রী সৌদামিনীর। গগনেন্দ্রর তিন মেয়ে সুনন্দিনী, পূণিমা ও সুজাতা; সমরেন্দ্রের পাঁচ মেয়ে মাধবিকা, মালবিকা, কমলা, সুপ্রিয়া ও অণিমা; আর অবনীন্দ্রের তিন মেয়ে উমা, করুণা ও সুরূপা। সবাই সমান গুণের নয় তবে ঘর-সংসারের কাজে সবাই বেশ দক্ষ। তাদের সেলাই শেখাবার জন্যে এলেন এক ব্রাহ্ম মহিলা ইন্দুবালা দেবী। সবার চেয়ে বড় হচ্ছেন উমা। তার চেয়ে কয়েক মাসের ছোট সুনন্দিনী একেবারে পিঠোপিঠি বোন আর কি। এখন আর দুজনের কেউ নেই। অথচ কয়েক মাস আগেও ছিলেন উমা। ছিয়াশী বছর বয়সে অপটু দেহের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন এক প্রাণচঞ্চল দশ বছরের কিশোরীকে। কিশোরীটির মনে দুঃখ ছিল বেথুন স্কুলে ভাল রেজাল্ট করেও প্রাইজটা আনতে যাওয়া হয়নি বলে। যাওয়া হয়নি বিয়ে ঠিক হয়েছিল তাই।
ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের মতো উমারও নানা ধরনের গুণ ছিল। একবার নাটকের রূপ দিয়েছিলেন বাবার লেখা ক্ষীরের পুতুলকে। ঘরোয়া নাটকে মাঝে মাঝে অভিনয় করা ছাড়াও দুবার তিনি বেশ বড় মাপের অভিনয় করেছিলেন। একবার আলিবাবা নাটকের মর্জিনা আর একবার বিরহের গোলাপী। রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন সে নাটক। মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন তার সঙ্গে জাভায় যেতে, যাওয়া হয়নি। বাধা দিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। বলেছিলেন, উমা! ও কি পারবে অত ধকল সহ্য করতে? কাজেই যাওয়া হল না।
কলকাতায় বসে বসেই তিনি এই সেদিন পর্যন্ত কাঁপা কাঁপা হাতে বুনে গেছেন সুতোর নকশা, মাকড়সা জালের মতো সূক্ষ্ম আঁকিবুকিতে ফুটে উঠেছে লতা-পাতা-কলকা—সে যুগটাও যেন বাঁধা পড়ে আছে উমারাণীর সুতোর ফাসের বঁধনে। সেলাই ফোঁড়াইয়ে উমার হাত বড় ভাল, তার বোনেরাও কেউ কম যান না। ইন্দুবালা সকলকেই যত্ন করে শেখাতেন। সেকালের মেয়েরা সেলাই-টেলই ভালই শিখতেন, এখনও শেখেন কিন্তু তার সঙ্গে উমার সেলাইয়ের পার্থক্য ছিল। তিনি ছিলেন শিল্পী-পিতার শিল্পী মেয়ে। মেয়ের সীবন-দক্ষতা বাবার মনে উৎসাহ জাগাত। তিনি এঁকে দিতেন নানারকম নকশা, সুতোর রঙের সাথে রঙ মিলিয়ে!
পশ্চিমবঙ্গে কাঁথার চল্ ছিল না, ছিল লেপ, বালাপোষ। পূর্ববঙ্গে ছিল কাঁথর বাহার। ঠাকুরবাড়ির বৌয়েরা আসতেন যশোর থেকে। তাই তারাও জানতেন নকশী কাঁথা সেলাই করতে। অবন ঠাকুর ছিলেন নকশী কাথার সমঝদার। তিনি নানারকম কঁথার নকশা ও ফোড়নের নমুনা সংগ্রহ করে রাখতেন; উমা কাঁথায় তুলতেন সেইসব বয়কা-বাঁশপাতা-তেরসী সেলাই। এখনও সেসব কথা আছে তার ছেলেমেয়েদের কাছে। অনেক রকম নতুন টীচেরও উদ্ভাবক তিনি। তবে এসব তো লিখে রাখেননি তাই ছড়িয়ে পড়েনি দশ জনের মধ্যে। এসময় অনেকেই সেলাইয়ের বই লিখেছেন। তার মধ্যে তুষারমালা দেবীর কাট ছাট বুনন সূচের কাজ, সুশীলা দেবীর আদর্শ সূচী শিল্প, কাননবালা ঘোষের আদর্শ সূচীচিত্র, অপরাজিতা দেবীর সূচীচিত্র শিক্ষা, গায়ত্রী দেবীর সূচীলিখন, যমুনা সেনের সেলাইয়ের নক্শা, সুলেখা দেবীর সূচীরেখা, প্রকৃতি দেবীর চিত্রন, উমা দেবীর কাঠিয়াবাড়ী সেলাই ও কাচের কাজ, মীরা দেবীর সচিত্র উল শিল্প সেলাইয়ের বই হিসেবে স্বতন্ত্র দাবি করে।
বৃদ্ধ বয়সে, হাতে যখন অনেক সময়, ক্ষীণদৃষ্টিতে সেলাই করা যায় না তখন উমারাণী শুরু করলেন স্মৃতিকথা লিখতে। কার কথা লিখবেন? কেন, বাবার কথা! উমার বইয়ের নামও বাবার কথা। অবনীন্দ্রনাথকে এত কাছে থেকে জানবার সুযোগ আর মিলবে না। শেষ বয়সে স্মৃতির আকার দিয়ে আঁকা ছবিগুলো তিনি কারুর কথা ভেবে আঁকেননি। পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হয়েছিল লিখে রাখার কথা। তাহলে লেখার রেললাইন বেয়ে হয়ত পোঁছনো যাবে ছবির ইস্টিশনে। আমার বাবা ছবি আঁকতেন, আমি লিখব পুরনো দেখা ছবির কথা। এর মধ্যে কোন ধারাবাহিকতা নেই, ইতিহাস নেই, এ শুধু এক নিতান্ত ঘরোয়া মেয়ের পিছন ফিরে চাওয়া। তার মধ্যে সবার কথাই আছে, বাবার কথাই বেশি। কোন বিখ্যাত মানুষকে আমরা তার আপনজনের দৃষ্টি দিয়ে যখন দেখি, নতুন করে আবিষ্কার করি। রবীন্দ্রনাথের সংসার, সোনার বোম পরা নিয়ে মৃণালিনীর সঙ্গে মতান্তর, রান্নার এক্সপেরিমেন্ট, বাসর ঘরে গান কিংবা রোগশয্যায় স্ত্রীকে হাওয়া করার মতো ঘটনাগুলো কি কোনো পুরুষের চোখে ধরা পড়ত? ধরা পড়েছিল হেমলতার চোখে। সেই কাকারই ভাইপো অবন। কাকা সোনার বোম পরতে চান না, ওপাল পাথর পরেন দায়ে পড়ে। ভাইপোই বা কম কী? খুঁটিনাটি নিয়ে তারও আপত্তি। ছোট ছোট ছবি এঁকেছেন উমারাণী। একটা কঁসার ঘটিতে জল খেতেন অবনীন্দ্রনাথ। সাবিত্রী ব্রত উদ্যাপন উপলক্ষ্যে তার স্ত্রী তাকে একটি রূপোর ঘটি করিয়ে দিলেন। কিন্তু বাবা কিছুতেই সে ঘটিতে জল খাবেন না। আমি তাই শুনে তাঁকে বল্লম, মা দুঃখ পাবেন। তুমি কিছুদিন জল খাও, তারপর আবার তুলে রেখে দিও। তখন থেকে সেই ঘটিতে জল খেতে লাগলেন।
মা মারা যাবার পর বাবা বললেন, ও ঘটি তোলো। চোর ডাকাতে লুটে নেবে। আমি সব সময় ও ঘটি সামলাতে পারবো না। তারপর আর কখনো সে ঘটিতে জল খাননি।
এখানেই মেয়েদের লেখা স্মৃতিকথার সার্থকতা। এমন ঘরোয়া ছবি, খুঁটিনাটি দেখবার চোখ মেয়েদেরই আছে। পুরুষ বড় প্রাণ, বড় মান, বড় কথার বেসাতি করে; মেয়েরা পায় বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর স্বাদ! ধনীর দুলালের সাদাসিধে জীবন কাঁটানোর সহজ-অভ্যেস আর স্ত্রীর প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধা উমার আঁকা অবন ঠাকুরের এই ছোট্ট ছবিতে যতটা ফুটেছে একটা বিরাট প্রবন্ধে তত ভাল ফুটত না। এরপর উমা বসেছিলেন নিজের আত্মকথা লিখতে। শেষ হবার আগেই শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। বেথুন স্কুলের শতবার্ষিকীতে সেই প্রাইজ পেয়েও পাওয়া মেয়েটিকে প্রাইজ দেবার তোড়জোড় চলছিল বোধহয়। কিন্তু উমারাণীর আর প্রাইজ নেওয়া হল না এবারও।
উমার সঙ্গে তার ছোট বোনেদের কথাও সেরে নেওয়া যাক। করুণার মৃত্যু হয়েছিল অল্প বয়সেই। তার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল লেখক মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের। দুটি ছোট ছোট ছেলেকে রেখে ওপারে পাড়ি দিলেন করুণা। তাঁর ছোট বোনের নাম সুরূপা। খুব ছোটবেলাতেই ডাকঘরের সুধা মালিনী সেজে তিনি সবার মন কেড়ে নিয়েছিলেন। ডাকঘরের সেই প্রথম অভিনয়ে অমল সেজেছিলেন আশামুকুল। অভিনয় হয়েছিল চমৎকার। সুরূপার মনে আছে অভিনয় হয়েছিল পাঁচ দিন। অভিনয়ের শেষে সবাই দুই শিশু অভিনেতাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতেন। সুরূপ লিখেছেন, আমাদের কেউ মেডেল দেয়নি কিন্তু সবাই এত আদর করেছিলেন, সে কি বলব। রবিদা তো। খুশি হয়ে আমার বেনে পুতুলের জন্যে একটা চমৎকার সবুজরঙের জরি-পড় দেওয়া সিল্কের রুমালই আমাকে বকশিশ দিলেন। পরে ডাকঘরের কথা উঠলেই কবি দুঃখ করে বলতেন, আমার অমল সুধা বড় হয়ে গেল, আর কে অভিনয় করবে। সুরূপাকে বড় ভালবাসতেন কবি, আদর করে তাকে ডাকতেন মালিনী বলে। দ্বারে কেন নাড়া দিলে ওগো মালিনী বুঝি এই মালিনীর উদ্দেশ্যেই লেখা। বড় হয়ে তিনি একবার হয়েছিলেন নটীর পূজার মালতী। সেও বেশ মজার ঘটনা। আগে থেকে কোন ঠিক ছিল না। রূপা লিখছেন, ও-বাড়ির দালানে নটীর পূজা হবে। শান্তিনিকেতন থেকে মেয়েরা এসেছে, তারা অভিনয় করবে। অভিনয়ের একদিন আগে হঠাৎ মালতী সাজবে যেমেয়েটি তার খুব জ্বর এসে গেল। মহা বিপদ! রবিদাদা তৎক্ষণাৎ দিনুদাদাকে ডেকে হুকুম দিলেন, আমার মালিনীকে নিয়ে এস। ব্যস, দিনুদা বিপুল বপু টেনে ঝড়ের গতিতে পালতোলা নৌকোর মত এ-বাড়িতে এসে আমাকে নিয়ে হাজির করল রবিদাদার সামনে। যত বলি, পারব না এত তাড়াতাড়ি, ছেড়ে দিন আমাকে, অন্য কেউ করুক। কে কার কথা শোনে! করতেই হবে তোকে, নিজে শেখাব। শিখিয়েও ছিলেন কবি যত্ন করে। অভিনয় ভালভাবেই উতরে গেল। অভিনয়ের পর কবি ওপরের বারান্দায় সুরূপাকে ডেকে আদর করে গলায় পরিয়ে দিলেন একটি ফুলের মালা। বললেন, এই তোর প্রাইজ। কিন্তু খুব বেশি অভিনয় করেননি সুরূপা তবে লিখেছেন, মৃত্যুর আগেও লিখতেন মাঝে-সাঝে, কবিতা কিংবা প্রবন্ধ। ছোট ছোট প্রবন্ধ অবনীন্দ্রনাথ, সোমেন্দ্রনাথ ডাকঘর, সুধার স্মৃতি সাময়িক পত্র-পত্রিকার পাতা খুঁজলে হয়ত চোখে পড়বে। ডাকঘর নাটক সম্বন্ধেও অনেক কথা জানা যায়। একদিন রবীন্দ্রনাথ অবনঠাকুরকে হুকুম করলেন, তোমাদের বাড়ির একটি ছোট মেয়ে জোগাড় করো। তখন ছোটদের দিয়ে অভিনয় করাতে কেউই সাহস করত না। ঠাকুরবাড়ির ছেলেমেয়েরাই একটু-আধটু গান করত। রবীন্দ্রনাথ ডাকঘরে দেখালেন ছোটরাও ভাল অভিনয় করতে পারে। বাবার সঙ্গে ভয়ে ভয়ে এলেন সুরূপা, কবির আদেশে পড়লেন ডাকঘর। রবীন্দ্রনাথ খুশি হয়ে বললেন, অবন একে সুধার ভূমিকায় তৈরি করে, তবে তুমি আবার বেশি শিখিও না। ওকে নিজের মতো করতে দিও। সুরূপা লিখেছেন, বাবা আমাকে সাজাতেন মাথায় উবু ঝুটি, গলায় পুতির মালা, পায়ে মল, পরণে। লাল শাড়ি আঁট করে পর, এক হাতে ফুলের সাজি এক বগলে বেনে পুতুল। সুধার স্মৃতি থেকে জানা যায়, ডাকঘরের অভিনয়ের সময় আরো একটা ঘটনা ঘটেছিল। ঠিক অভিনয়ের আগে সুরূপা দেখলেন মঞ্চের সামনে চেয়ার-টেবিল পেতে লাট কারমাইকেল ও অন্যান্যদের বসবার জায়গা হয়েছে। টেবিলে ফুলদানীতে বড় বড় লাল গোলাপ সাজিয়ে দিচ্ছেন সমরেন্দ্রনাথ। সঙ্গে সঙ্গে সুরূপা বায়না ধরলেন, একটা লাল গোলাপ দাও, সাজিতে দেব। সমরেন্দ্রনাথও দেবেন না। বলেন, তোর সাজি তো খালি থাকবে, তুই ফুল তুলতে যাচ্ছিস। সুরূপাও নাছোড়বান্দা। রবীন্দ্রনাথ দেখে বললেন, আহা দাও দাও। মালিনীর বাড়িতেও তো বাগান আছে, সেখানকার ফুল ও তুলেছে। ছোটখাট কাজে বাবার মতো সুরূপারও উৎসাহ ছিল। দিদির মত সেলাই-বোনা নিয়ে না থাকলেও তিনি অবন ঠাকুরের দেখাদেখি তৈরি করতেন ঝিনুকের কুটুমকাঁটাম পুতুল কিংবা আরো টুকিটাকি দু-একটা জিনিষ এই আর কি!
হাতে তৈরি খেলনা কিংবা পুতুলের ওপর ঝোঁক ছিল সুনলিনী, পূর্ণিমা ও সুজাতা তিন বোনেরই। সুনন্দিনী গগনেন্দ্রর বড় মেয়ে। প্রভাতনাথের সঙ্গে তাঁর বিয়ে ঠিক হয়েছিল বলতে গেলে জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গেই। বেশ চঞ্চল আর হাসিখুশি মেয়ে। দুষ্ট মি বুদ্ধিতেও সেরা। দাদাদের পরামর্শে ঘুমন্ত পণ্ডিতমশাইয়ের টিকি কেটে দিলে ঠাকুরমা সৌদামিনী বললেন, অনেক পড়াশুনো হয়েছে, এবার বিয়ে দিয়ে দাও।
খুব ধুম করে বিয়ে হল। গৌরীদান করলেন গগনেন্দ্রনাথ। বিবাহবাসরে সেলাই করা কাপড় নিয়ে আপত্তি উঠেছিল সেকথা আগেই বলেছি। গগন দেখালেন তিনি মেয়েকে যে ধাঁচে শাড়ি পরিয়েছেন সেটি যেমন আর্টিস্টিক তেমনি সুন্দর। সবারই ধরনটি বেশ পছন্দ হল। মেয়ে প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাবে। গগনেন্দ্র আর্টিস্টকে দিয়ে মেয়ের প্রমাণ সাইজের একটা ছবি আঁকালেন—সেই কেতায় শাড়ি পরা, হাতে কাজললতা, অপূর্ব ছবিটি—এখনো আছে সুনন্দিনীর ছেলে দ্বারকানাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে।
এই বিয়ের পরে বেশ একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। গগনেন্দ্র বড় মেয়েকে দিয়েছেন একসেট হীরের গয়না। তাই নিয়ে মেয়েমহলে এক তর্ক ওঠে। চিরকেলে মেয়েলি তর্ক যেমন হয় আর কি? একদল বললেন, ও হীরে নয়, পোখরাজ। আরেকদল বললেন, না, ও হীরেই। তর্কের মীমাংসার জন্যে ব্যাপারটা অনেকদূর গড়ায় এবং শেষ পর্যন্ত মেয়েদের থামতে হয় বাড়ির কাদের কাছে ধমক খেয়ে। যারা বলেছিলেন পোখরাজ তারা বাজি হেরে একশ টাকার মিষ্টি তত্ত্ব পাঠালেন।
এতটা হবে মেয়েরাও বুঝতে পারেননি। এই সুন্দর গল্পটি উপহার দিয়েছেন সুনন্দিনীর সেজো বোন পূর্ণিমা। কিন্তু তাঁর গ্রন্থে প্রদত্ত বিবরণটি সত্য নয়। এই তর্কের মধ্যে মহর্ষি পরিবারের মেয়েরা ছিলেন না, ছিলেন পাথুরেঘাটার ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা। ব্রাহ্ম বলে মহর্ষি পরিবারের মেয়েরা সেখানে সেদিন নিমন্ত্রিত হননি। কিছু কিছু ভুলভ্রান্তি এবং তথ্যগত প্রমাদ থাকলেও পূর্ণিমার লেখা ঠাকুরবাড়ির গগন ঠাকুর পাঁচ নম্বর বাড়ির অন্দরমহলের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ। তিনি সবার কথাবার্তা ভাবভঙ্গি এমন কি কণ্ঠস্বরটি পর্যন্ত যেন পৌছে দিয়েছেন ভাবীকালের পাঠকদের কাছে। তার বই পড়ে বোঝা যায় এ সময় বাইরের ঘটনার বর্ণবিচ্ছুরণে অন্তঃপুরের কোণগুলো আর আলোকিত হয়ে উঠছে না। সেখানে তখনো সেই পুরনো চাল, সাবেকী ঢং বজায় আছে। হয়ত মেয়েরা শাড়ির বদলে ফ্রক পরছেন, স্কুলে যাচ্ছেন এইমাত্র। তার বেশি নয়। স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে কত মেয়ে জেলে গেল, হারিয়ে গেল, কে তার খোঁজ রাখে? কল্পনা দত্ত, বীণা দাস, প্রীতিলতা ওহদেদারের কথাও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু ঠাকুরবাড়ি—সেই অন্ধকারের বুক চিরে উষার অস্ফুট আভাস ফোঁটানো বাড়ির মেয়েরা এখন যেন অনেকটা পিছিয়ে পড়েছেন। কিংবা বলা যায় তারা এখনো ধরে আছেন উনিশ শতকের সোনালি সময়টাকে।
যাক সে কথা, পাঁচ নম্বর বাড়ির মেয়েরা শিখেছিলেন কি করে গাৰ্হস্থ্য জীবনকে সুন্দর করে তুলতে হয়, সরল করে রাখতে হয়। সাধারণ জীবনে এর দামও তো কম নয়। শিল্পীকন্যারা শিখেছিলেন নানারকম হাতের কাজ। বিদেশী পুতুল বর্জন করে দেশী পুতুলকে আদর করতে শেখালেন তারা। সুনন্দিনী কাপড় দিয়ে সুন্দর সুন্দর পুতুল তৈরি করতে পারতেন। একে বলা হত গুড়িয়া পুতুল। তাঁর পানওয়ালী ও সাপুড়ে পুতুল যে দেখেছে সে-ই মুগ্ধ হয়েছে। হিতকারী সভা থেকে সাপুড়ে পুতুলটি পুরস্কৃত হয়, প্রাইজ পেয়েছিলেন ক্যালকাঁটা একজিবিশন থেকেও। ইদানিং হাতের কাজ বিশেষ করে পুতুলটুতুলের খুব আদর, মেয়েদের হাতে তৈরি খেলনা-পুতুল চড়া দরে বিকোয়। অনেক মহিলা কিংবা মহিলা-প্রতিষ্ঠান মাঝে মাঝে প্রদর্শনীর আয়োজনও করেন। ঠাকুরবাড়ি থেকেই এসব জিনিষের আদর শুরু। সুনন্দিনী অবশ্য শুধু পুতুলই করতেন না, ভাল অভিনয়ও করতে পারতেন। গানের গলাটিও ছিল চমৎকার। একবার মৃণালিনী নাটকে সেজেছিলেন গিরিজায়া, সবার ভাল লেগেছিল সে অভিনয়। লোককে বোকা বানাতেও তার জুড়ি ছিল না। তার দুব্বোঘাসের চচ্চড়ি খেয়ে যে কত লোক বোকা বনেছেন তার ঠিক নেই। কারুর বাড়িতে জামাই ঠকানোর দরকার হলেই ডাক পড়ত নন্দিনীর। তিনিও কোমর বেঁধে বসে পড়তেন রাধতে। সেও যেন শিল্প-ব্লটিংয়ের রাবড়ি, তুলোর বেগুনি, খড়কুটোর হেঁচকি খেতে গিয়ে ঠাকুরবাড়ির জামাইরা যে কত ঠকেছেন তার ইয়ত্তা নেই।
পূর্ণিমা অনেকটা উমারাণীর মতোই শিল্পী। তার হাতের কাজ বিশেষ করে নকশী কাথাগুলো চোখে না দেখলে ধারণা করা শক্ত। এ ছাড়াও তিনি তৈরি করতেন কাগজের বাড়ি, মেওয়ার পুতুল, ডালের ছবি। সেগুলো কি কাজে লাগত? মেয়ের বিয়েতে তত্ত্ব পাঠানো হত। ঠাকুরবাড়ির তত্ত্ব দেখবার মতো জিনিষ ছিল। একশো-দেড়শেজন লোক যেত। পুরনো ঝিচাকরেরা নিয়ে যেত কলকাতার সব বিখ্যাত খাবার। যশোর থেকে আসত স্পেশাল অর্ডার দেওয়া নারকেল চিড়ে, জিরে-নারকেলের ফুল-মেয়েরা হাতে তৈরি করে চিনিতে পাক করে পাঠাত। এক এক থালা ভরা এক একটা বাতাসা, বড় ঝুড়িতে একটা কদমা। কত রকম ঠাট্টার জিনিষ। এদের সঙ্গেই পাঠানো হত ট্রে ভর্তি মেওয়ার পুতুল, নানারকম ডাল দিয়ে ট্রের ওপরে সাজানো নানারকম ছবি। কাগজের বাড়িগুলোও ছিল খুব সুন্দর। কিন্তু কালের কবল থেকে তারা কেউ রক্ষা পায়নি। আজ পূর্ণিমাও নেই, শুধু আছে তার লেখা ঠাকুর বাড়ির গগন ঠাকুর। আছে তার অধসমাপ্ত আত্মাহিনীর পাণ্ডুলিপি চাঁদের বুড়ি। নাতিদের ভোলাবার জন্যে লেখা—গগনের মেয়ে পূর্ণিমা, জামাই নিশানাথ, সবাই যেন চন্দ্রলোকের বাসিন্দা। ঘর আলো করা মেয়েটি এসেছিল চন্দ্রলোক থেকে।
অতি বৃদ্ধ বয়সে লেখা ঠাকুরবাড়ির গগন ঠাকুর-এর মধ্যে দু-চারটে ঘটনা হয়ত ঠিকমতো সাজান হয়নি। তবু তথ্যপূর্ণ এবং রসগ্রাহী। পড়তে পড়তে মনে হয় যেন লেখা জিনিষ নয়। মুখের সামনে বসে কেউ গল্প বলে যাচ্ছে, কানের ভিতর দিয়ে গল্প প্রবেশ করছে মরমে। খবরও আছে অনেকরকম। যেমন ধরা যাক হিতকারী সভার কথা। আত্মীয় পোষণ ছিল সে যুগের ধনীদের দস্তুর। তাই রবীন্দ্রনাথ গগনেন্দ্র ও অন্যান্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির করেন যে, সব বাড়ি থেকে কিছু কিছু উঁদা তুলে একটা সাহায্য ফাণ্ড খোলা হবে। হলও তাই। দুঃস্থ ঠাকুররা সাহায্য পেতেন। তহবিলে টাকা তোলার জন্যে বছরে একবার করে হত দানমেলা। বাড়ির মেয়েরা হাতে তৈরি জিনিষ দিত এবং তা বিক্রী করে টাকা জমানো হত। পরে অবশ্য হিতকারী সভা থেকে গগনেন্দ্র সরে দাঁড়ালেন। এই খবরটা আমাদের জানিয়েছেন পূর্ণিমা। গগন ঠাকুরকে এই বইয়ে বড় আপন করে পাওয়া যায়।
সুজাতার হাতের কাজও বড় সুন্দর। দিদিদের মতো তিনিও শিল্পী। নানারকম জিনিষ তৈরি করতে পারেন তবে তার পানমশলার বাড়ি বোধহয় অনেকেই দেখেছেন। এই মশলার বাড়িও পাঠানো হত বিয়ের তত্ত্বে। সুজাতা মশলার বাড়ি করতেন শিল্পী মনের স্বপ্ন মিশিয়ে! যেমন তার নিজের বাড়ি ছিল পার্ক সার্কাসের কাছে। গগনেন্দ্রনাথ নিজের কয়েকখানি সুন্দর ছবি দিয়ে সে বাড়ি সাজিয়ে দিয়েছিলেন-রায়টের সময় সে বাড়ি লুঠ হয়ে যায়। সুজাতার বিয়ে হয়েছিল বিদ্যাসাগরের পুত্রের দৌহিত্র সরোজ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। নতুন বাড়ি আবার সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হয়েছিল সুজাতাকে। পানমশলা। দিয়ে বাড়ি করা ছাড়াও তিনি তৈরি করেছেন সেতার-তবলা-হারমোনিয়াম। শর্মিলার বিয়েতে তো তৈরি করে দিয়েছিলেন একটা আস্ত ক্রিকেট টীম! এ ছাড়া সুজাতার ঝোঁক ফেলে দেওয়া, কুড়িয়ে-পাওয়া জিনিষ দিয়ে সুদৃশ্য পুতুল বা টুকিটাকি জিনিষ তৈরি করা। নতুন জিনিষ দিয়ে তো সবাই পারে। কিন্তু ফেলনা জিনিষ দিয়ে? সুজাতা দেখেছিলেন তার ছোটকাকা অবনঠাকুর নানারকম ফেলে দেওয়া জিনিষকেই কাজে লাগাচ্ছেন। তুচ্ছ কাঠের টুকরাকে কুটুমকাঁটামে রূপান্তরিত করাই শুধু নয়, তিনি লেখার পাণ্ডুলিপিতেও খবরের কাগজ, পাজী, শাড়ির লেবেল, বোতলের লেবেল, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ছবি, বিজ্ঞাপন, কাটুন কেটেকুটে লাগসই করে জুড়ে জুড়ে ছবি বানাতেন। খুদুর রামায়ণের পাণ্ডুলিপিটি এভাবেই তৈরি হয়েছিল। তিনি জানতেন তুচ্ছ কভু তুচ্ছ নয় শিল্পীর কাছে। সুজাতাও তৈরি করেছেন আইসক্রীম কাঠির বাড়ি, শিশিবোতলের পিনকুশান-মুনদান-পুতুল! আজকাল অব্যবহার্য জিনিষে তৈরি ঘর সাজাবার পুতুল সাজিয়ে অনেকেই বাহবা পাচ্ছেন। ফেনা জিনিষ তুলে এনে অসুন্দরকে সুন্দর করার জাদু জানতেন ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা। খুব সম্ভব জাপানী শিল্পীদের আনাগোনার ফলে তারা চিনতে শিখেছিলেন প্রতিদিনের শত তুচ্ছের আড়ালে আড়ালে হারিয়ে যাওয়া সুন্দরকে।
দিদির মতো সুজাতা লেখেন না বড় একটা কিন্তু বাবার কথা যে অফুরান। তাই পূর্ণিমার পরে গগনেন্দ্র শতবার্ষিকী কমিটির উদ্যোক্তারা সুজাতাকে দিয়েও লিখিয়েছেন। সেই ছোট্ট লেখাটিতে আছে আপন করা ঘরোয়া কথা ও সুর। একটুখানি দেখা যাক :
দার্জিলিং-এ দেখেছি বাবা কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন। শিল্পীর চোখে তিনি যা দেখেছিলেন আমাদেরও তাই দেখতে শেখালেন। মহাদেব শুয়ে আছেন—নাক মুখ চোখের রেখা তখন স্পষ্ট দেখতে পেলাম। তিনি আমাদের চোখ ফুটিয়ে দিলেন, তাই, নাহলে আগে শুধু বরফের পাহাড় বলেই দেখেছিলাম।
এভাবে দেখতে শেখানই ছিল অবন-গগনের নিজস্ব আর্ট। সুজাতার শিল্পীজীবনে এসেছে পরিতৃপ্তির আনন্দ। ছোটখাট অনেক কিছু করেছেন। তিনি। কয়েকবার পুরস্কার পেয়েছেন হাতের কাজ—সেলাই আর আলপনার জন্যে। শুধু দুঃখ এসব কিছুই থাকে না। শুধু পঞ্চাশ বছরের পুরনো, নিজের হাতে করা বনসাই বটগাছটাই যা চারপাশে ঝুরি নামিয়ে বেঁচে আছে। আর কিই বা আছে? যে সব মেয়েদের কনে সাজালেন তারাও তো আজ গিন্নী। এখন আর পারেন না, হাত কেঁপে যায়। তবু এখনও অনেকে ধরে সাজিয়ে দেবার জন্যে। ঐ যে আদরের নাতনী শিঞ্জিতা, ঐ কি ছাড়ল? যতই মডার্ণ আর আলট্রা মডার্ণ হোক না কেন, বিয়ের দিন সেও চেয়েছিল শিল্পীকন্যার শিল্পমণ্ডিত হাত দুখানির চির নবীন স্পর্শ!
কনে সাজানোর কথায় মনে পড়ছে আরেকজনের কথা। তিনিও খুব ভাল কনে সাজাতেন, তার নাম মাধবিকা। সমরেন্দ্রনাথের মেয়ে। মাধবিকার পাঁচ বোন। যমজ বোন মালবিকা ছাড়াও ছিলেন সুপ্রিয়া, কমলা ও অণিমা। মাধবিকার বিয়ে হয়েছিল কবিকন্যা রেনুকার ছোট দেবর শচীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে। ঠাকুরবাড়িতে মেয়ে সাজানোর ব্যাপারে নাম ছিল মাধবিকার। সেখানে মেয়ে সাজানোর একটি বিশেষ ধরন ছিল। নিশ্চিত করে বলতে না পারলেও মনে হয় তখনকার সন্ত্রস্ত পরিবারগুলির মধ্যে এক এক ধরনের মেয়ে সাজানোর বৈশিষ্ট্য ছিল। যাইহোক, ঠাকুরবাড়িতে এখনকার মতো লবঙ্গের টিপ দিয়ে চন্দনের নকশা কেটে মেয়ে সাজানো হত না। তার বদলে অনেকখানি চন্দন লেপে দেওয়া হত পুরো কপালে। ভুরু থেকে সিথি পর্যন্ত চন্দন লেপা হলে খুব সরু যশুরে চিরুনি দিয়ে চন্দনটা আঁচিড়ে দেওয়া হত। ভুরু থেকে চুল পর্যন্ত সারা কপালে চন্দনের খড়কে ডুয়ে কাঁটার পর চন্দন শুকোলে তার ওপর সিঁদুর-কুমকুমের টিপ ও নকশা কাঁটা হত।
ইন্দিরা যখন স্ত্রী-আচারের একখানি সংকলন প্রকাশের কথা ভাবছিলেন, তখন তার এ ব্যাপারে মাধবিকাকেই যোগ্যতমা বলে মনে হয়েছিল। একান্নবর্তী পরিবারে বহু বিয়ে তিনি দেখেছেন এবং এ বিষয়ে স্বাভাবিক ঔৎসুক্য থাকায় সবই মাধবিকার মনে ছিল। তার দেওয়া বিবরণ থেকেই আমরা ঠাকুরবাড়ির বিয়ের স্ত্রী-আচার সম্বন্ধে সব কিছু জানতে পারি। মহর্ষি পরিবার ব্রাহ্ম হয়ে যাবার পরেও মহর্ষি বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে স্ত্রী-আচার বাদ দেননি। পাঁচ নম্বরে তো সাবেকী নিয়মই ছিল। মাধবিক। সব জানতেন। সবই মনে রেখেছিলেন। কত নিয়ম! নিয়ম তো নয় সে হল রীতি বা রীত। গায়ে হলুদ থেকে শুরু, বিয়ের পর নদিনে শেষ। মাধবিকা লিখেছেন ঠাকুরবাড়ির কথা, তার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের স্ত্রী-আচারের তফাৎ নেই বললেই চলে। দু-একটার একটু নতুনত্ব আছে। যেমন :
বরণের পরে মা ছেলের কাছ থেকে কনকাঞ্জলি নেবে। ছোট একটি থালাতে অল্প একটু আতপ চাল, একটি টাকা দিয়ে ছেলের হাতে দিতে হয়, দিয়ে মা সামনে আঁচল পেতে দাঁড়ায় ও ছেলেকে তিনবার জিজ্ঞাসা করে, বাবা কোথায় যাচ্ছে? ছেলে বলে, মা তোমার বৌ আনতে যাচ্ছি।…তিনবার সেই কথাটি বলে মায়ের আঁচলে ঐ চাল ঢেলে দিয়ে নারায়ণ প্রণাম ও মাকে প্রণাম করে যাত্রা করে। সম্প্ৰদান হয়ে গেছে এই খবর মায়ের কানে দিতে হয়; দিলে সারাদিনের উপোসের পর ঐ কনকাঞ্জলির চাল মা একটু ফুটিয়ে মুখে দেন ও দুধ মিষ্টি খান।
মাধবিকা এভাবে খুঁটিনাটির দিকে নজর দিয়ে যত্ন করে লিখেছেন। তবে বইয়ে তার নাম লেখা হয়েছে শুধু মাধবী।
মাধবিকার ছোট বোনেরা কোথাও কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেননি বা করতে চাননি। তাঁর যমজ বোন মালবিকা ছোটবেলায় মুখে মুখে ছড়া বানিয়ে সবাইকে হাসাতে পারতেন। একবার এক আত্মীয়াকে নিয়ে ছড়া বানাতে গিয়ে খুব ধমক খেয়েছিলেন। দিদিমা সৌদামিনী ধমক দিলেও ছড়া শুনে না হেসে পারেননি। পরবর্তীকালে কিন্তু এই আমুদে মহিলাটির ছড়া লেখায় উৎসাহ ছিল কিনা জানা যায়নি। তবে কমলা কিছু কিছু কবিতা লিখতেন। তিনি দু-একটি নারী সমিতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তাঁর লেখা কয়েকটা অপ্রকাশিত কবিতা এখনো আছে। মেয়ের মৃত্যুর পরে লেখা একটা কবিতায় দেখা যাচ্ছে তিনি বেছে নিয়েছেন গদ্য ছন্দের আঙ্গিক :
আমার হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে কেড়ে
নিয়েছে কে তাকে, সব শূন্য করে দিয়ে
তারপরে তার বন্ধু দুটি এসে
বসলো আমার কাছে, একবার
আমার দিকে চেয়ে মাথা বইল
নীচু করে, চোখের জল নিলে
সাম্লে আমার কাছে, মাসীমা
বলে ডাকলে আমায় তারা;
এ জন্মের মতো সে গেল চলে, রেখে
গেল বুঝি, এদের আমার কাছে
ভোলাতে আমায়।
বৈঠকখানা বাড়ির বৌয়েদের কথাও এই ফাঁকে সেরে নেওয়া যাক। আমাদের কালসীমার মধ্যে ঐ বাড়িতে বৌ হয়ে এসেছেন কনকেন্দ্রের স্ত্রী সুরমা, নবেন্দ্রের স্ত্রী অপর্ণা ও অলোকেন্দ্রের স্ত্রী পারুল। গগনঠাকুরের বড় ছেলে গেহেন্দ্র ও তার স্ত্রী মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল অল্প বয়সে। মেজো ছেলে কনকেন্দ্র। সুরমা ছিলেন ভাল অভিনেত্রী। ঘরোয়া আমোদ আদে মেতে উঠতেন। তাঁর গায়ের রঙ ছিল খুব ফরসা আর গাল দুটি পাকা। ডালিমফলের মতো লাল। হাসলে আরো টুকটুকে হয়ে উঠত। বিচিত্রায় হত নানারকম অনুষ্ঠান। একবার হল শকুন্তলা ট্যাবলো। সুরমা সেজেছিলেন দুষ্যন্ত আর সুধীন্দ্রনাথের মেয়ে এণা শকুন্তলা। সুন্দর হয়েছিল সে অভিনয়! আরেকবার হয়েছিল মৃণালিনী নাটক। সুরমা সেজেছিলেন পশুপতি আর মনোরমার ভূমিকায় পূর্ণিমা। মেয়ে মহলের ব্যাপার বলে অভিনয়ের শেষটা বদলে দেওয়া হয়। পশুপতির মৃত্যুর পর মনোরমা বিধবা হবে—সে দৃশ্যের বদলে দেখান হল পশুপতি মনোরমার হাত ধরে কাশী চলে যাচ্ছে।
সুরসিক গগনেন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে মজার কাজ করতেন। একবার একজন প্রৌঢ়া মহিলাকে ঠকাবার জন্যে তিনি সুরমাকে রাজা যতীন্দ্রমোহনের বাড়ির দারোয়ান সাজিয়ে দিলেন। সুরমা এসে লাঠি ঠুকে দাঁড়ালেন। মাথায় পাগড়ি, মস্ত গোঁফ-কে বলবে ভোজপুরী দারোয়ান নয়। সেই ভদ্রমহিলাও চলো যাই বলে যতীন্দ্রমোহনের বাড়িতে ফিরে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াতেই সবাই হেসে উঠলেন। এ ভাবেই রসের হাট জমে উঠত।
সুরমার ছয় মেয়ে—অনুভা, গৌরী, বকুল, করবী, শুক্লা ও সীমা। তারা প্রত্যেকেই গুণী শিল্পী। গান-বাজনা-সেলাই-বাটিকের কাজ প্রভৃতি নিয়ে বেশ নাম করেছেন। এঁদের মধ্যে অনুভা ঠাকুরের নাম আর একটি কারণেও উল্লেখযোগ্য। তিনি গ্রামোফোন রেকর্ডের প্রথম যুগে দুখানি রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেছিলেন। গান দুটি হল দেখো দেখো শুকতারা আঁখি মেলি চায় ও নাই বা এলে যদি সময় নাই। আজ রেকর্ডটি দুষ্প্রাপ্য। কবির সত্তর বৎসর পূর্তি উপলক্ষে যে অনুষ্ঠান হয় তাতেও তিনি গান গেয়েছিলেন। ছোটবেলায় একবার সেজেছিলেন বিসর্জনের হাসি, একটু বড় হয়ে ভৈরবের বলি নাটকে ইলার সখী। কিন্তু বিয়ের পর রুড়কিতে চলে যাওয়ায় অনুভ। আর
অভিনয় ও সঙ্গীতচর্চার সুযোগ বেশি পাননি। এ সময় তিনি সমাজ সেবার। কাজে যোগ দিয়ে একটা চাইল্ড সেন্টার গড়ে তোলেন। বম্বেতেও তিনি বাটিক শেখর স্কুল, নিউ ওয়ার্ক সেন্টার প্রভৃতি নিয়ে কাজের মধ্যে ডুবে থাকতেই ভালবাসতেন। সীমাও গানের ক্ষেত্রে তার যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। গৌরী ভাল সেলাই জানেন। শান্তিনিকেতনে যোগ দিয়েছেন সমবেত গানে। কখনো ভৈরবের বলি কখনো বা শাপমোচনে। এই সুরমারই এক পৌত্রী চিত্রাভিনেত্রী শর্মিলা। সত্যজিৎ রায়ের অপুর সংসার-এ তাঁর প্রথম চিত্রাবতরণ থেকে ক্রিকেট খেলোয়াড় পতৌদির নবাব মনসুর আলি খানের বেগম আয়েস। সুলতানা হয়ে ওঠার গল্প আজ সকলেই জানে। সুরমার অপর পৌত্রী ঐন্দ্রিলাও শৈশবে কাবুলীওয়ালা চিত্রের মিনির ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন।
অপর্ণা দ্বিপেন্দ্রনাথের দৌহিত্রী। তারা তিন বোন সুরমা, অপর্ণা আর পুর্ণিমা। তাদের মা নলিনীর বিয়ে হয়েছিল সেই বিখ্যাত চৌধুরী পরিবারে, যেখানে বধূ হয়ে প্রবেশ করেছিলেন প্রতিভা ও ইন্দিরা। কাজেই ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের যা যা গুণ থাকে তার সবই ছিল বোনেদের মধ্যে। অপর্ণা ও পুর্ণিমার বিয়ে হয়েছিল ঠাকুরবাড়িরই দুই ছেলের সঙ্গে। অপর্ণার স্বামী গগনেন্দ্রর ছেলে নবেন্দ্র আর পূর্ণিমার বিয়ে হয়েছিল সত্যেন্দ্রনাথের পৌত্র সুধীরেন্দ্রর সঙ্গে। অপর্ণার গান ও বেহালা বাজানোর কথা ইন্দিরা বারবার বলেছেন। শোনা গেছে দুটি রবীন্দ্র সঙ্গীত দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার ও যদি প্রেম দিলে না প্রাণে তার কণ্ঠে যত ভাল শোনাত অমনটি আর কেউ গাইতে পারতেন না। এক একটা গান বা অভিনয় সম্বন্ধে শোনা যায় এক একজনের কৃতিত্বের কথা। এভাবে যদি কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত বা রবীন্দ্ৰনাটকের একটা ধারাবাহিক ইতিহাস লেখেন তাহলে দেখা যাবে সঙ্গীত ও নাটকের প্রয়োগরীতির দিক থেকে কবি তাঁদের বাড়ির ছেলেদের চেয়েও মেয়েদের সাহায্য পেয়েছেন অনেক বেশি। ভৈরবের বলি ও আরো দু-একটা নাটকে অভিনয়ও করেছেন অপর্ণা। ভৈরবের বলিতে তিনি সেজেছিলেন ইলা।
পারুল ঠাকুরও এ বাড়ির দৌহিত্রী। সৌদামিনীর বড় মেয়ে ইরাবতী, তার মেয়ে পারুল। দুই বাড়ির দুই সৌদামিনীর মধ্যে ভারি ভাব ছিল। দুজনেরই এক নাম, তাই সই পাতিয়েছিলেন দুজনে। ইরাবতীর তিন দিনের মেয়েকে দেখে তার সঙ্গে নাতি অলোকেন্দ্রের বিয়ে ঠিক করেছিলেন সৌদামিনী। তাঁর কথার নড়চড় হয়নি। অবনীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্রবধু হয়েই এলেন পারুল। তখন অবশ্য সৌদামিনী পরলোকে। পাঁচ নম্বরে তখনও সাবেকী রীতি বজায় আছে। বৌদের সকালে যেতে হয় তরকারি বানানোর আসরে। তিন শাশুড়ীর একজন এসে বসতেন চৌকীতে। সামনে দু পাশে সার দিয়ে আসন পেতে বসে পড়তেন বৌ-ঝিরা। দাসীরা তরকারির খোসাটোসা ছাড়িয়ে এনে দিলে তারা গিন্নীর নির্দেশে কুটতেন ঝালের তরকারি, ঝোলের ব্যঞ্জন, কালিয়ার আলু, ঘণ্টর আলু কিংবা ডালনার তরকারি। পারুলের কাজ শেখার শুরুও এমনিভাবে। নাচগান-অভিনয়ে তার বড় সংকোচ। তবু রবীন্দ্রনাথ জোর করে তাকে একবার নামিয়েছিলেন বর্ষামঙ্গলে। হে ক্ষণিকের অতিথি গানের সঙ্গে তার নীরব আবির্ভাব হবে শরৎলক্ষ্মী রূপে। কথা বলতে হবে না, গান গাইতে হবে না শুনে রাজী হলেন পারুল। তা বলে যে গান শেখেননি তা নয়। বিয়ের আগে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গান ও সেতার শিখতেন, বিয়ের পরে শ্যাম সুন্দর মিশ্রের কাছে। ছবি আঁকা শেখাতেন নন্দলাল বসু, তবু এসবে বড় সংকোচ। শেষ পর্যন্ত অবশ্য মেঘের মতো একটাল চুল এলিয়ে সাজলেন শরৎলক্ষ্মী। গানের সঙ্গে তাঁর নীরব আবির্ভাব আবার পিছনে হেঁটে প্রস্থান এই ছিল তার ভূমিকা। এখনকার মতো সেকালে তোল অডিয়েন্সের দিকে পিছন ফিরে প্রস্থানের রেওয়াজ ছিল না। তাই পিছনে পায়ে পায়ে সরে গিয়ে প্রস্থান করা হত! মাঝে মাঝে পারুল গিয়ে বসতেন রবীন্দ্রনাথের বিচিত্রার আসরে। শুনেছিলেন প্রথম শেষের কবিতা পাঠ। সেখানে তিনি দেখেছিলেন কবি যখন হাসির গল্প পড়তেন তখন তিনি নিজে হাসতেন না, অন্যের প্রতিক্রিয়া ক্ষ্য করতেন। পারুল তার নাতনী তাই ভয়টা কম; হেসে গড়িয়ে পড়তেন। কবি জিজ্ঞেস করতেন, তোরা হাসছিস কেন? অন্যরা চুপ করে যেতেন। পারুল হেসে বলতেন, তুমি হাসির কথা বলছে, হাসবো না? গল্পটা আমরা তার মুখেই শুনেছি।
পুরনো দিনগুলো কেটে গেছে স্বপ্নের মতো। সুখের স্মৃতির মতো ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা এই পর্বে যেন নিজেদের অনেকখানি গুটিয়ে নিয়েছেন। শুক্তি যেমন সযত্নে মুক্তোটিকে লুকিয়ে রাখে এঁরাও তেমনি সযত্নে নিজেদের মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন সে যুগের সেই দুর্লভ স্মৃতি আমাদের কাছে এসব গল্প, কিন্তু সুরূপা, সুজাতা, সুরমা, পারুলের কাছে তো গল্প নয়। বৈঠকখানা বাড়ি আর নেই, মিশে গেছে মাটির সঙ্গে ধূলো হয়ে তবু মনে তার নিত্য যাওয়াআসা। স্মৃতির সরণি বেয়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে সেই রূপকথার ঘুমন্ত রাজবাড়িটিতে। এখনো তাদের বুকে মৌন বেদনা গুমরে গুমরে ওঠে কেন ভাঙা হল বাড়িটা? মহর্ষিভবনের মত নব কলেবর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও যে মাঝে মাঝে দেখে আসা যেত নিজেদের হারানো শৈশবকে।