পরের দিন ঠিক সময় চারিং ক্রশ-এ কালেক্টস পেঙ্গুইন বুকশপে একটু ঘোরাঘুরি করতেই তন্ময়ের দেখা পেলাম। ও বেশ কয়েকটা বই কিনেছিল। তাছাড়া একটা বড় ও ভারী ব্রীফ কেস তো ছিলই। দোকান থেকে বেরুবার সময়ই ওকে অত্যন্ত ক্লান্ত মনে হল। ভাবছিলাম, বইগুলো। আমিই নেব কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই তন্ময় বলল, কবিতা, বইগুলো ধরবে?
হঠাৎ ও আমার নাম ধরে কথা বলতেই আমি একটু বিস্মিত হলাম কিন্তু তা প্রকাশ না করে বললাম, নিশ্চয়ই।
বইগুলো আমার হাতে তুলে দিয়েই ও রুমাল দিয়ে মুখ মুছে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। বলল, বড্ড টায়ার্ড হয়ে গেছি।
আমি কিছু বলার আগেই তন্ময় আবার বলল, এ দেশে লেখা-পড়া কাজকর্মের অনেক সুযোগ, কিন্তু বড্ড পরিশ্রম করতে হয়।
এবার আমি বললাম, এ ব্যাপারে আমার এখনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়নি, কিন্তু দেখে শুনে। তাই মনে হয়।
তন্ময় বলল, আমাদের কলকাতার অধ্যাপকরা নোটস্ লিখিয়ে লিখিয়ে এমন অভ্যাস খারাপ করে দিয়েছে যে বিদেশে পড়াশুনা করতে এসে বড় কষ্ট হয়।
আমি বললাম, হতে পারে, কিন্তু আমরা তো মনে করি ইউনিভার্সিটিতে পড়ার চাইতে আনন্দ আর নেই।
ও সঙ্গে সঙ্গে বলল, তোমার মতো বান্ধবী থাকলে নিশ্চয়ই আনন্দের।
তার মানে?
তন্ময় হাসে! বলে, তুমি তো জানো না তোমাকে নিয়ে আমাদের কত আলোচনা, কত গবেষণা হতো।
আমি বিস্ময়ের হাসি হেসে প্রশ্ন করি, আমাকে নিয়ে গবেষণা?
হ্যাঁ, গবেষণা।
আমি আপনার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে ও বলল, তুমি আমাকে আপনি আপনি বলছ কেন? হাজার হোক এটা লন্ডন; তার ওপর আমরা সমসাময়িক।
অভ্যাস।
চেঞ্জ দ্যাট হ্যাবিট।
আই উইল ট্রাই।
ট্রাই ফ্রম নাউ অন।
আমি আর কিছু বলি না। শুধু হাসি।
কথা বলতে বলতে আমরা বাস স্টপে এসেছি। দু-এক মিনিট দাঁড়িয়েছি। তারপর বাসে উঠেছি। বাসে পাশাপাশি বসে কথা হচ্ছে।
তন্ময় বলল, সত্যি বলছি, এমন কোনো দিন যায়নি যেদিন আমরা তোমাকে নিয়ে আলোচনা করিনি।
ওর কথা শুনে আমার মজা লাগে। জিজ্ঞাসা করি, এত আলোচনা কী ছিল?
তোমার মতো সুন্দরী ও বিদুষী মেয়েকে নিয়ে…
আমি সুন্দরী? আমি বিদুষী?
তন্ময় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সত্যি সুন্দরী।
আমি তাড়াতাড়ি দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলাম।
তন্ময় আবার বলল, কাল তোমাকে দেখে আমি সত্যি অবাক হয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম, কোনো রাজপুত্তুর পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে এসে তোমাকে নিয়ে অচিন দেশে চলে গেছে।
আমি হেসে বললাম, ইতিহাস নিয়ে গবেষণা না করে বাংলার গল্প উপন্যাস লিখলেও আপনার ভবিষ্যত উজ্জ্বল।
আপনি নয়, তুমি!
আমি হাসতে হাসতেই বললাম, তুমি।
ধন্যবাদ!
.
যাই বল ভাই রিপোর্টার, ছাত্রজীবনের শেষে কলেজ ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে খুব ভালো লাগে। সব মানুষের কাছেই ছাত্র জীবনের স্মৃতি বড় সুখের, বড় আনন্দের। তন্ময়ের সঙ্গে আমি একই ক্লাসে পড়িনি; কিন্তু সমসাময়িক তো। তাই বিবর্ণ বিষণ্ণ জীবনের এক শূন্য মুহূর্তে ওর সঙ্গে দেখা হওয়ায় সত্যি ভালো লাগল। কিছু দিন আগে ওর সঙ্গে দেখা হলে। নিশ্চয়ই এত ভালো লাগত না। কিন্তু কক্ষচ্যুত গ্রহের মতো মহাশূন্যে তিল তিল করে জ্বলে পুড়ে ঘুরে বেড়াবার সময় ওর দেখা পাওয়ায় আমি পরম আশীবাদ বলে মনে করলাম। তুমি আমার মনের অবস্থা উপলব্ধি করবে কিনা জানি না। তবে ভাঙাচোরা নোনা ধরা বাড়িকে মেরামত করে কালার-ওয়াশ করলে যেমন ভালো লাগে, সুন্দর মনে হয়, আমিও সেই রকম বদলে গেলাম।
.
দেখ কবিতা, মানুষ হলেই দুঃখ পেতে হবে। এর থেকে কারুর মুক্তি নেই।
তা ঠিক, কিন্তু…
এর মধ্যে আর কোনো কিন্তু নেই। সব দুঃখকে হয়তো মানুষ ভুলতে পারে না কিন্তু তাকে জয় না করলে তো আমরা কেউ বাঁচব না।
আমি মুখ নীচু করে বলি, সবাই কী দুঃখ জয় করতে পারে?
হ্যাঁ, সবাই পারে; কেউ দুদিনে, কেউ দু বছরে। স্বামী হারাবার পর, সন্তান হারাবার পর, বাবা-মা হারাবার পর কটা মানুষ এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়?
আমি উত্তর দিতে পারি না। তন্ময় একটু হাসে। তারপর আবার বলে, তুমি তো নিশ্চয়ই স্বীকার করবে যে বুড়ি বিধাবারা যত বেশি দুঃখ পেয়েছে তারা সংসারের প্রতি তত বেশি আসক্ত, তারা তত বেশি অত্যাচারী কিন্তু এত দুঃখ পাবার পর তো তাদের সন্ন্যাসিনী হওয়া উচিত ছিল।
তন্ময় ওপাশ থেকে উঠে এসে আমার পাশে বসে। আলতো করে কাঁধে হাত রাখে। তারপর বলে, এই পৃথিবীর দিকে তাকাও। দেখবে দারুণ গ্রীষ্মের পরই বর্ষা; আবার পচা ভাদ্দরের পরই শরতের আনন্দ।
তন্ময়ের কথায় বড় যাদু। ওর স্পর্শে সারা শরীরে কি যেন একটা উন্মাদনা আনে। আমি তর্ক করতে পারি না, প্রতিবাদ করতে পারি না। ও আর একটু নিবিড় হয়। আমি বাধা দিতে পারি না। ওর হুইস্কীর গেলাসটা আমার ঠোঁটের সামনে ধরে, আমি চুমুক দিই।
ঠিক মনে নেই; তবে বোধহয় পুরো গেলাসটাই আমি শেষ করেছিলাম। সেই কলকাতায় কাকাবাবুর কাছে একটা হুইস্কী খাবার পর এই প্রথম হুইস্কী খেয়ে বেশ লাগল। আর ভালো লাগল ওর আলিঙ্গন, নিবিড় আলিঙ্গন আর চুম্বন। আমার আবার বাঁচতে ইচ্ছা করল। সন্দীপনকে হারাবার দুঃখ ভুলতে পারলাম না কিন্তু যে বেদনা বিষণ্ণতায় মন ভরে গিয়েছিল, তার থেকে মুক্তি পেলাম। তন্ময়ের সঙ্গে দিন দশ-পনেরো মেলামেশা করার পরই হঠাৎ কলকাতা থেকে খবর এলো, ডক্টর সরকারের হোট-ভাই মারা গিয়েছেন।
খুব জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডক্টর সরকার বললেন, জানো মা, সন্দীপন চলে যাবার পর থেকেই মনে হচ্ছিল আমার কপালে আরো অনেক দুঃখ আছে।
ওঁকে সান্ত্বনা জানাবার ভাষা আমার ছিল না। শুধু বললাম, এখন তো আপনার অনেক কর্তব্য। ছোট ছোট ভাইপো-ভাইঝিদের মানুষ করতে হবে।
হ্যাঁ, খুব তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার কিন্তু মনে হয় আর ফিরতে পারব না।
আমার জন্য চিন্তা করবেন না। বোধহয় সামনের সপ্তাহেই আমি চাকরি পাব।
কিন্তু থাকবে কোথায়?
আমার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে। তাকে বললেই ব্যবস্থা করে দেবে।
পরের দিনই প্যাকিং কোম্পানির লোকজন এসে ডক্টর সরকারের বইপত্তর ও অন্যান্য সবকিছু প্যাক করা শুরু করল। মালপত্র ওরাই জাহাজে কলকাতা পাঠাবে বলে দিন তিনেক পরেই উনি একদিন ভোরে বি-ও-এ-সিতে কলকাতা রওনা হলেন।
ডক্টর সরকার ভিক্টোরিয়া এয়ার টার্মিনাল থেকেই চলে যেতে বললেও আমি চলে গেলাম। এয়ারপোর্ট পর্যন্ত গেলাম।
উনি বললেন, মা, তোমাকে এভাবে হঠাৎ ফেলে রেখে চলে যেতে হচ্ছে বলে মনে মনে বড়ই দুশ্চিন্তা রইল। তবে তোমাকে বলে রাখছি, তোমার যে কোনো প্রয়োজনে এই বুড়ো ছেলেকে মনে করলে আমি সত্যি খুশি হব।
বেশি কথা বলার মতো আমার মনের অবস্থা ছিল না। শুধু বললাম, প্রয়োজনের কথা আপনাকে ছাড়া আর কাকে জানাব? আমার তো আর কেউ নেই।
ডক্টর সরকার কোনোমতে চোখের জল সম্বরণ করে বললেন, তোমার এই বুড়ো ছেলে একাই একশো। আর কাউকে কী দরকার?
হিথরো এয়ারপোর্টের অত লোকজনের ভীড়ে আমার চোখ দিয়ে এক ফোঁটাও জল পড়ল কিন্তু বাড়ি ফিরে আসতেই শূন্যতা আর নিঃসঙ্গতার জ্বালায় আমি হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম।
কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তা টের পাইনি। কোথা দিয়ে যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল, তাও টের পেলাম না।
যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখি ঘরের মধ্যে বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ ওই অন্ধকারের মধ্যেই চুপচাপ বসে রইলাম। খুব ক্ষিদে লেগেছিল কিন্তু তবু শুধু নিজের জন্য কিচেনে গিয়ে খাবার-দাবার তৈরি করতে ইচ্ছা করল না।
বোধহয় ঘণ্টাখানেক পরে হঠাৎ তন্ময় এলো। আমার চোখ-মুখের দিকে তাকিয়েই বলল, বুড়ো ছেলের জন্য এত মন খারাপ কোরো না। তোমার ছেলে আবার একদিন হঠাৎ এসে হাজির হবে।
ওর কথার কি জবাব দেব? মুখ নীচু করে চুপচাপ বসে রইলাম।
দু-এক মিনিট পরে তন্ময় প্রশ্ন করল, নিশ্চয়ই এয়ারপোর্ট গিয়েছিলে?
আমি মাথা নাড়লাম।
দেখে মনে হচ্ছে, সারাদিন শুধু কেঁদেছ; খাওয়া-দাওয়া করনি।
আমি এ প্রশ্নেরও কোনো জবাব দিই না।
তন্ময় প্রায় জোর করে টেনে নিয়ে কিচেনে গেল। দুজনে মিলেই কিছু খাবার-দাবার তৈরি। করলাম। খেলাম। তারপর টুকটাক এ-কথা সে-কথার পর ও জিজ্ঞাসা করল, তুমি এখানে কতদিন থাকবে?
ডক্টর সরকারের কিছু কাজ আছে বলে এ মাসটা এখানেই থাকতে হবে।
একলা একলা থাকতে পারবে?
বিকেলের দিকে তুমি রোজ একবার এসো।
তা আসব, কিন্তু…তন্ময় কথাটা শেষ করে না।
আমি একটু ম্লান হেসে বললাম, অনেক কিন্তু নিয়েই আমার জীবন সুতরাং সেজন্য চিন্তা কোরো না।
তুমি বললেই কী চিন্তা না করে থাকতে পারব?
তুমি আর কদিনই বা এখানে আছ? দু-এক মাসের মধ্যেই তো চলে যাবে।
তন্ময় হেসে বলল, তোমাকে একলা ফেলে যাব, তা ভাবলে কী করে?
তবে কী আমিও তোমার সঙ্গে স্টেট-এ যাব?
দোষ কী?
এবার আমি হেসে বললাম, কলকাতা ছেড়ে লন্ডন এসেছি, এই যথেষ্ট। আর আমেরিকা গিয়ে কাজ নেই।
.
ভাই রিপোর্টার, তোমাকে তো আগেই বলছি, আমার জীবনে অনেক পুরুষ এসেছেন। তাদের অনেকেই আমাকে এক এক ধাপ এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন কিন্তু ওই বৃদ্ধ ডক্টর সরকার আর আমার কলকাতার ভাই ছাড়া আর কোনো পুরুষই নিঃস্বার্থ ভাবে সাহায্য করেননি। বাকি সবাই কিছু না কিছু কানাকড়ি নিয়েই আমাকে একটা খেয়াঘাট পার করে দিয়েছেন।
তুমি রাগ কর না। আমি জানি, এ পৃথিবীতে মেয়েদের চাইতে পুরুষের মহত্ত্ব অনেক বেশি। ভগবান যীশু, ভগবান বুদ্ধ থেকে শুরু করে এই পৃথিবীতে কত মহাপুরুষের আবির্ভাব হয়েছে তার ঠিকঠিকানা নেই। ধর্ম, ত্যাগ, তিতিক্ষা, সাধনায় পুরুষদের চাইতে মেয়েরা অনেক পিছিয়ে কিন্তু তবু বলব, উবর্শী রম্ভা বা ক্লিওপেট্রার মতো লক্ষ কোটি পুরুষও ওই রকমই খ্যাতি অর্জন করলেও পুরুষ ঐতিহাসিকেরা ইতিহাসের পাতায় তাদের স্থান দেননি। শুধু নিজের অভিজ্ঞতা নয়, কলকাতা, লন্ডন, নিউইয়র্ক ও আরো অনেক শহর-নগরের বহুমেয়ের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জোর করে বলতে পারি, বনের হিংস্র পশুর চাইতে বহু পুরুষই আরো ভয়ঙ্কর। ভদ্রলোকের মুখোশ পরে যারা থাকেন তাদের হয় সাহস নেই, নয় তো সুযোগ নেই। কলকাতার বা ভারতবর্ষের বহু নিরীহ গোবেচারা ভদ্দরলোকদের যে রূপ বিদেশে দেখেছি, তাতে ভদ্দরলোক সম্পর্কে আমার আর শ্রদ্ধা ভক্তি নেই।
তন্ময়ের সাহায্য সহযোগিতার কথা সকৃতগজ্ঞ চিত্রে চিরকাল মনে রাখব কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ভুলতে পারব না তার হিংস্র লোলুপ লালসার রুদ্রমূর্তি।