পুষ্প হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। এই ব্যাপারটা কি সত্যি-সত্যি ঘটছে না এটা তার অন্যান্য দুঃস্বপ্নের মতো দুঃস্বপ্ন? মিজান বসার ঘরে বসে আছে। চোখে সানগ্লাস। পরনে। চকলেট রঙের একটা শার্ট। মাথার চুলগুলি ছোট্ট-ছোট্ট করে কাটা। মুখ হাসি-হাসি।
ভাবি চিনতে পারছেন? অধমের নাম মিজান। দরজা খোলা ছিল, বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়েছি। নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন। রকিব বাসায় নেই? ওর সঙ্গে দরকার ছিল।
পুষ্প কী বলবে ভেবে পেল না। তার বুক ধকধক করছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আবার ঐ দিনকার মতো হবে নাকি? সে প্ৰাণপণে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছে। পারছে না। সে খুব ঘামতে শুরু করেছে।
আপনি কী চান?
কিছুই চাই না ভাবি। নাথিং। পুলিশ যা যন্ত্ৰণা করেছে বলার না! কোর্টে হাজির করেই আবার পুলিশ রিমান্ডে। ঐ ইন্সপেক্টার বিরাট হারামজাদা। এখন অবশ্যি ঠাণ্ডা।
পুষ্প মনে-মনে লোকটির সাহসের তারিফ করল। কী সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে যেন কিছুই হয় নি। অনেক দিন পর বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। চা-টা খেয়ে বিদায় নেবে।
রকিবকে খুঁজছিলাম যন্ত্রণা মিটিয়ে ফেলবার জন্যে। এই জিনিস কোর্টে গেলে তারই অসুবিধা, আমার কিছু না। আমি আজও যেমন ফ্রী ম্যান, দশ দিন পরেও ফ্রী ম্যান।
মিজান সিগারেট ধরাল। সানগ্লাস খুলে রুমাল দিয়ে পরিষ্কার করে আবার চোখে পরল। হাসিমুখে বলল, ঐ দিন তেমন কিছু হয় নি। ঠাট্টা-তামাশা করেছি। ভয় পেয়ে আপনি হয়ে গেলেন অজ্ঞান। জাস্ট বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিলাম। এর বেশি কিছু না। আপনি ভাবলেন কি না কি।
আপনি এখন দয়া করে যান।
যাব তো বটেই। এটা তো ভাবি আমার বাড়িঘর না। তবে এই কথাগুলি রকিবকে বলা দরকার, যাতে তার মনে আবার আমার সম্পর্কে কোনো খারাপ ধারণা না থাকে। বহুদিনের পুরনো দোস্ত।
আপনাকে যেতে বলছি যান। আমি চিৎকার করে তোক জড়ো করব।
বেশ তো, করুন।
মিজান কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে রইল, যেন সত্যি-সত্যি চিৎকারটার জন্যে অপেক্ষা করছে।
ভাবি, ঠাণ্ডা মাথায় একটা কথা শুনুন। কোনো বাপের ব্যাটার সাধ্য নেই এই কেইস প্রমাণ করে। কেন তা হলে শুধু-শুধু ঝামেলা করছেন? লজ্জা অপমান যা সবই তো আপনার।
আমার অপমান নিয়ে আপনি এত ব্যস্ত কেন?
বন্ধুর স্ত্রী, আমি ব্যস্ত হব না? কী বলেন আপনি। অবশ্যি এটা আমার জন্যেও বড় পাবলিসিটি। ব্যবসা করি তো! নানান লোকজনদের সঙ্গে মিশতে হয়। আপনি ভাবি রকিবকে বলবেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আমি এখন মালিবাগের বাসায় আছি। ও ঠিকানা জানে।
মিজান উঠে পড়ল। পুষ্প ছুটে গেল পাশের ফ্ল্যাটে। নিশাত নেই। নিশাতের বোনদুলাভাই আজ চলে যাচ্ছেন। তাঁদের ফ্লাইট রাত দেড়টায়। আজ আর তার দেখা পাওয়া যাবে না। পুষ্প একবার ভাবল বাবুকে সঙ্গে নিয়ে কল্যাণপুর চলে যায়। ভয়ে তার গা কাঁপছে। তার কেন জানি মনে হচ্ছে মিজান কিছুক্ষণ পরে আবার ফিরে আসবে। দরজা বন্ধ থাকলেও কোনোনা-কোনোভাবে ঢুকে পড়বে ভেতরে। হাসি-হাসি গলায় বলবে, ভাবি চিনতে পারছেন? অধমের নাম মিজান।
পুষ্প অবশ্য নিশাতের বাসার ঠিকানা জানে। রিকশা নিয়ে চলে যেতে পারে। যাওয়াটা কি ঠিক হবে? আপা নিশ্চয়ই খুব ব্যস্ত। এই ব্যস্ততার মধ্যে নতুন ঝামেলা। এমনিতেই আপা যা করছেন, তার নিজের ভাই বা বোন তা করবে না। উকিল সাহেবের ফিসের টাকা পুরোটা উনি দিয়েছেন। অবশ্যি তাকে প্রথম বলেছিলেন, উকিল সাহেব প্রথম দফায় ন হাজার টাকা চেয়েছেন। দিতে পারবে পুষ্প?
পুষ্প বলেছে, আমার কাছে চার হাজার টাকা আছে। আমি ওকে বলব। ও জোগাড় করবে।
রকিব সব শুনে রাগী গলায় বলেছে, প্রথম বারেই নয় হাজার টাকা! এইটা কীরকম উকিল? একজন ব্যারিস্টারও তত পাঁচ শ টাকার বেশি নেয় না। ঐ উকিল বাদ দিতে বল, আমি দেখব।
তুমি চেন কাউকে?
চিনব না কেন? ভালেই চিনি।
পুষ্প নিশাতকে বলল, ও নিজে একজন উকিল দিতে চায় আপা। ওর চেনা কে নাকি আছে। টাকা নেবে না।
নিশাত বলেছে, আচ্ছা ঠিক আছে। দু-তিন দিন পর জিজ্ঞেস করল, রকিব। সাহেব কি কিছু করেছেন?
না আপা।
জিজ্ঞেস করেছিলে কিছু করেছেন কি না?
জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল করবে। কেইসটার নাকি অনেক দেরি।
খুব দেরি কিন্তু নেই পুষ্প।
ও গা করছে না আপা। শুধু বলছে দেখি। ওর বোধহয় টাকাও নেই। আমার গলার একটা হার দিই আপা, দু ভরি সোনা আছে।
নিশাত বলেছে, আমি পরে তোমার কাছ থেকে হার নিয়ে যাব। এখন আমি চালিয়ে নিই। তুমি চল, তোমার সঙ্গে উকিল সাহেবের পরিচয় করিয়ে দিই। ওঁকে দেখে প্রথমে ভক্তি হবে না, কিন্তু উনি খুবই নামকরা। উনি যা বলবেন মন দিয়ে শুনবে।
উকিল সাহেব প্রথমে সমস্ত ব্যাপারটা খুটিয়ে-খুটিয়ে শুনলেন। প্রথম মিজান কবে। এ-বাসায় এল, কখন এল, তার পরনে কী ছিল থেকে শুরু। তারপর কত রকম যে। প্রশ্ন। যেমন, মিজান সাহেবের ড্রাইভার কি কখনো বাসায় এসেছিল? মিজান সাহেব কি কখনো চিঠিপত্র লিখেছিলেন?
বেশির ভাগ প্রশ্নেরই পুষ্প জবাব দিতে পারল না। এর মধ্যে একটি হচ্ছেআপনার স্বামী কি কখনো মিজান সাহেবের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে নিয়েছেন। আপনি কিছু জানেন না?
জ্বি-না।
আপনার স্বামীকে জিজ্ঞেস করবেন।
জ্বি আচ্ছা।
আপনার স্বামীকে বলবেন তিনি যেন অবশ্যই আমার সঙ্গে দেখা করেন।
জ্বি আচ্ছা।
তাঁকে কিছু শিখিয়েপড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপার আছে। কারণ মিজান সাহেবের উকিল তাঁকে কোর্টে তুলবে। আপনি আগামী পরশু আপনার স্বামীকে আসতে বলবেন। বিকেল পাঁচটায় আমি ফ্রী থাকব। অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুকে লিখে রাখছি।
জ্বি আচ্ছা।
আপনাকে ফাঁদে ফেলবার চেষ্টা করবে। আপনি ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসবার জন্য উল্টোপাল্টা কথা বলবেন না। যা জানেন তাই বলবেন। উকিল আপনাকে প্রশ্ন করলে জবাব নিয়ে আপনি ধাঁধায় পড়ে গেছেন, তখন তাকাবেন আমার দিকে। যদি দেখেন আমি ডান হাত মুঠি করে আছি তা হলে বলবেন, আমার মনে নেই। আর যদি দেখেন আমি দুটি হাতই মুঠি পাকিয়েছি তা হলে বলবেন, এই বিষয়ে আমি কিছু জানি না।
আমার এসব মনে থাকবে না।
বাজে কথা বলবেন না। অবশ্যই মনে থাকবে।
পুষ্প রকিবকে টাকার কথাটা জিজ্ঞেস করল। রাতে ভাত খেতেখেতে বলল, তোমার বন্ধু কি তোমাকে কোনো টাকা ধার দিয়েছিল?
রকিব চোখ কুঁচকে বলেছে, কেন?
উকিল সাহেব জানতে চাচ্ছিলেন। দিয়েছিল?
এর সাথে মামলার কী সম্পর্ক?
জানি না কি সম্পর্ক। উকিল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন বলেই বললাম। তোমাকে যেতে বলেছেন।
কী মুশকিল, আমি কেন যাব?
যেতে বলেছেন, যাও।
রকিব গেল না। কেন গেল না কে জানে। নিশাত বলল, ঠিক আছে, যেতে না চাইলে কি আর করা। জোর করে তো আর নেওয়া যাবে না। আমি তোমার ল ইয়ারকে বলব। তিনি কিছু বুদ্ধি নিশ্চয়ই বের করবেন। উনি বোধহয় চান না তোমার কেইস কোর্টে উঠুক, তাই না পুষ্প?
আমি জানি না আপা। মাঝে-মাঝে মনে হয় চায়। আবার মাঝে-মাঝে মনে হয় চায় না। কী যে মুশকিলে পড়েছি আপা।
কোনো মুশকিল নেই। আমি আছি তোমার পাশে।
নিশাত আপার কথায় পুরোপুরি ভরসা করা যায় না। যার কথায় ভরসা পাওয়া যেত সে আছে চুপ করে। মিজান আজ এসেছিল এই খবর শুনলে সে কী করবে কে জানে। হয়তো সঙ্গে-সঙ্গে ছুটে যাবে। তাকে এই খবর কিছুতেই বলা যাবে না। বরং একতলার বাড়িওয়ালার বাসা থেকে নিশাত আপাকে টেলিফোন করে বলা যায়।
পুষ্প তাই করল।