গোপীরা কৃষ্ণকে লইয়া যে-সকল লীলা করিয়াছে, তাহা মাধুর্য্য-পূর্ণ হইলেও একঘেয়ে হয় নাই, মাঝে মাঝে পরিহাসের চাটনি দিয়া তাহার আস্বাদ মুখরোচক করা হইয়াছে। সত্য বটে কৃষ্ণ রাধার পায়ে ধরিয়া সাধিয়াছেন। এতটা করার পর রাধার তাঁহাকে ক্ষমা করা উচিত ছিল, রাধা তাহা করেন নাই। এখন কৃষ্ণ-বিরহে রাধার প্রাণান্ত হইবার উপক্রম হইয়াছে, বৃন্দা নিজেও অনেক ঘোরা ফেরা করিয়া মনঃ ক্লেশ পাইয়াছেন। গোপীরা স্বভাবতঃই মুখরা ও পরিহাস-প্রিয়া; বৃন্দা এখানে একটা চাতুরী খেলিয়া কৃষ্ণকৃত তাহাদের এই কষ্টের প্রতিশোধ লইতে ইচ্ছুক হইলেন। রাজকুমারী রাধার একটা মান-সম্ভ্রম আছে, সখীদের কাছে তাঁহার মান বজায় রাখিতে হইবে। এখন যদি সে হঠাৎ দেখা দেয়, তবে তিনি নিশ্চয়ই ভাবিবেন, রাধা তাঁহার বিরহে একান্ত অধীরা হইয়া তাঁহাকে খুজিবার জন্য বৃন্দাকে পাঠাইয়াছেন; কৃষ্ণের কাছে রাধাকে এতটা খেলো করিতে বৃন্দা রাজী নহেন। কৃষ্ণকে পাইয়া বৃন্দার দেহে প্রাণ আসিয়াছে, কিন্তু সে তাহার সামনে আনন্দ গোপন করিয়া ফেলিল। সে যেন কৃষ্ণকে দেখিতেই পায় নাই–এই ভাবে তাঁহার পাশ কাটিয়া হন্ হন্ করিয়া চলিয়া গেল। এদিকে কৃষ্ণ দূর হইতে বৃন্দাকে দেখিতে পাইয়া মনে করিলেন, নিশ্চয়ই মানভঙ্গের পর অনুতপ্তা হইয়া রাধা তাঁহার সন্ধানে দূতীকে পাঠাইয়াছেন, তখন হর্ষের উচ্ছ্বাসে তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিয়া কৃষ্ণ গায়ের ধূলা ঝাড়িতে লাগিয়া গেলেন; অতিশয় ক্ষিপ্রতার সহিত ময়ূরপুচ্ছের চূড়াটা মাথায় আঁটিয়া বাঁধিয়া, বাঁশী হাতে সাজগোজ করিয়া বৃন্দার আগমনের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেনঃ–
কিন্তু একি? বৃন্দা তো তাহার কাছে আসিয়া থামিল না, রবঞ্চ যেন তাঁহাকে দেখিতেই পায় নাই, এইভাবে অতিবেগে তাঁহার পাশ কাটিয়া চলিয়া গেল! তখন হতবুদ্ধি হইয়া কৃষ্ণ পেছনে পেছনে ‘দূতি দূতি’ বলিয়া ডাকিতে লাগিলেন।
‘‘দূরে হেরি নাগর, চতুরা সহচরী
ঠমকি ঠমকি চলি যায়।
জনু আন কাজে, চলত বররঙ্গিনী
ডাহিনে-বামে নাহি চায়।
হরি হরি লুটায়ত কান, সহচরী গমন হেরইতে তৈখন,
হৃদয়ে করত অনুমান।
“কি এ অতি সদয়, হৃদয় ইহ মঝু পর,
সহচরী ভেজল কি রাই।
কি এ আন কাজে, চলত বর রঙ্গিনী,
কারণ পুছই বোলাই।
“সহচরি, সহচরি, সহচরি, করি হরি বেরিবেরি,
বহু বেরি করত ফুকার।
“চতুরিণী সহচরী ঝুঁকি কহত মধু,
নাম লেই কোন গোঙার।’’
‘‘চমকি কহত হরি হাম রাইকিঙ্কর
করুণা করিয়া অব আহ।
দাম মনোহর এক নিবেদন,
শুনি তবে আন কাজে যাহ।’’
কৃষ্ণের ধূলিঝাড়া, ময়ূরপুচ্ছ-পরা প্রভৃতি সম্বন্ধে পদটি তালে গীত হইয়া থাকে। এই তাল অতি ত্রন্ত, কৃষ্ণের মনের ব্যস্ততার সঙ্গে উহার বেশ ঐক্য হয়।
বহু আহবানে বৃন্দা যে উত্তর দিল, তাহ মোটেই উৎসাহ-ব্যঞ্জক নহে। আমি কুলনারী, আমার পেছন-পেছন এমন করিয়া ডাকিতেছে কোন্ দুর্ব্বত্ত? “দুর্ব্বৃত্ত” কথাটি আমার। পদে “গোঙার” শব্দটি দেখিতেছেন। “গোঙার” শব্দটির আদি অর্থ “গোয়াল”। প্রাকৃত পিঙ্গলে “গোঙার” শব্দ এই অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। কালে এই শব্দ অর্থদুষ্ট হইয়াছে, ‘গোঁয়াড়’ বলিতে এখন আমরা দুর্ব্বৃত্ত বুঝি।
এই উত্তরে কৃষ্ণ একবারে মুসড়াইয়া পড়িলেন, তিনি বলিলেন- “আমি রাধার দাস, একবার করুণা করিয়া আমার একটি কথা শোন।” তখন বৃন্দা বলিতেছেন,
‘‘কি কহবি রে মাধব তুরতহি কহ কহ
হাম যাওবা আন কাজে।
তো সঞে বাত নহে মধু সমুচিত,
দোষ পাওব সখী মাঝে।’’
বাহিরের লোকে নিন্দা করিবে, বৃন্দা একথা বলে নাই। গোপীরা বাহিরের লোকের নিন্দা-প্রশংসা এড়াইয়া গিয়াছে। বৃন্দা বলিতেছে, যে রাধার মনে কষ্ট দিয়াছে–তাহার সঙ্গে কথা বলিলে সখীরা আমাকে ক্ষমা করিবে না। কৃষ্ণ বলিতেছেন–
‘‘কি কহব সজনি, কহিতে বা কিবা জানি,
রাই তেজল অভিমানী।
রাই তেজল বলি, তুহুঁ সব ভেজবি,
তবে বিষ ভুঞ্জব আমি।’’
বৃন্দার উত্তরে যেমনি শ্লেষ ফুটিয়াছে, তেমনই কৃষ্ণ চিরজীবী হইয়া বাঁচিয়া থাকুন, এই প্রার্থনা আছে। বলা বাহুল্য, এই প্রার্থনা গোপীর প্রাণের প্রার্থনা-আন্তরিকতাপূর্ণ।
‘‘আহিরিণী কুরূপিনী, গুণহীনী, ভাগিহীনী–
তাহে লাগি কাহে বিষ পিঅবি?
চন্দ্রাবলী সঙ্গসুখ সুধারস,
পিবি পিবি যুগে যুগে জীরবি!’’
এই গানগুলিতে ব্যঙ্গের আপাততঃ উপভোগ্য রস হইতে আর একটা রসের দিক্ আছে, তাহাতে শ্লেষের উপর খুব রং-চড়ান হইয়াছে। কৃষ্ণের ত্রস্ততার সহিত যোগ রাখিয়া প্রথম গানটির তাল দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু বৃন্দার “কি কহবি রে মাধব” গানটির তাল, খুব বিলম্বিত, বৃন্দার ছলকরা ব্যস্ততার সহিত এই বিলম্বিত তালের একবারেই ঐক্য হয় না। তাহার কথাগুলি এত ধীর ছন্দে গীত হয়–যে, তাহাতে এম্বতার চিহ্ন মাত্র নাই; “কি কহব–রে মাধব অ অ, তুরতহি কহ কহ–অ অ, হাম হাম যাওব আন কাজে–এ এ”, এই একটি ছত্র গাহিতেই পুরো এক মিনিট সময় লাগিবে। এই বিলম্বিতছন্দ দ্বারা কবি রহস্যের মাত্রা খুব বাড়াইয়াছেন; বৃন্দা বহু কষ্টে হারাণো ধন পাইয়াছেন, তাঁহাকে কি সহজে ছাড়িয়া দিতে পারে! সে মুখে এন্ততার ভাণ করিতেছে, কিন্তু কণ্ঠের ছন্দে প্রতিবাদ করিতেছে।
বৃন্দা শেষে কৃষ্ণের অপরাধের কথা বলিল। কৃষ্ণ বহু সাধাসাধি করিয়াছেন–কিন্তু রাধা তাঁহাকে উপেক্ষা করিয়াছেন, এই কথার উত্তরে সে বলিল।
“দুতি কহত তুয়া,
কৈছন পীরিতি রীতি বুঝই নাই পারি।
সো যদি মন ভরমে তোহে রোখল,
তুহুঁ কাহে আওড় ছোড়ি”—
তোমার প্রেমের রীতি, আমি বুঝি না, সে যদি ভ্রমেই মান করিয়া রাগ করিয়াছিল, তুমি তাকে ছাড়িয়া আসিলে কোন্ প্রাণে? বৃন্দা আরও বলিল, রাই প্রায়শ্চিত্ত করিবেন, তোমার জন্য যে অপবাদ হইয়াছে—ইহা তাহারই প্রায়শ্চিত্ত, আমি ব্যবস্থার জন্য যাইতেছি, দেরি করিতে পারিব না। এ-কথা শুনিয়া কৃষ্ণের মুখখানি শুকাইয়া গেল। সহ্য করিবার সীমা আছে–কৃষ্ণের কষ্ট বৃন্দা আর সহিত পারিল না, এবার ভরসা দিয়া তাঁহাকে সঙ্গে লইয়া চলিল।
এই মান-লীলায়, তরল আমোদ-প্রমোদ, হাসি-ঠাট্টা ও বিদ্রুপের মধ্যে সুগভীর সরসী-নীরোদ্ভব প্রেমের ফুল্ল কমল ফুটিয়াছে, মানুষের মনে তিনি যে রস দিয়াছেন, তাহার মধ্যে তিনি আছেন। প্রেম-সরোবরে যে শতদল ফোটে, তাহার শোভার মধ্যে তিনি আছেন, শুক্তির মধ্যে মুক্তা খুঁজিবার জন্য এখানে ডুবারুকে হাতড়াইতে হয় না, পদাবলীর ভাণ্ডারে তাহা আপনিই হাতে আসিয়া পড়িবে।
সখীরা কৃষ্ণ-রাধার লীলায় সর্ব্বদা ইন্ধন জোগাইয়াছে, তাঁহাদের সাহচর্য্য ছাড়া হ্লাদিনী-শক্তির বিকাশ তেমন করিয়া দেখান যাইত না। গোবিন্দ দাস সখীদের কথা বলিয়াছেন-
‘‘প্রেম কারিগর মোরা যত সখীগণ।
নিতি নিতি ভাঙ্গি-গড়ি পীরিতি-রতন।
অন্তরে হাফরে মান অঙ্গারের খনি,
বিরহ-অনলে তাহে ভেজাই আগুনি।
সোণাতে সোহাগা দিয়া সোনাতে ভেজাই,
রসের পাইন দিয়া ভাঙ্গিলে জোড়াই।’’