১৪. পত্রাদি

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
পত্রাদি

বাতি নিবাইয়া গৌরী শয্যায় শয়ন করিল; অন্ধকারের মধ্যে চোখ মেলিয়া চাহিয়া রহিল। পরিষ্কারভাবে চিন্তা করিবার সামর্থ্য তাহার ছিল না; মস্তিষ্কের মধ্যে দুই বিরুদ্ধ শক্তির প্রচণ্ড সংগ্রাম চলিতেছিল। শরীর মনের সমস্ত অণুপরমাণু যেন দুই বিপক্ষ দলে সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া পরস্পরকে হানাহানি করিয়া ক্ষতবিক্ষত করিয়া তুলিতেছিল।

বুকজোড়া এই অশান্ত অন্ধ সংগ্রাম যে কেবল একটিমাত্র দুষ্প্রাপ্য নারীকে কেন্দ্র করিয়া–তাহা ভাবিয়া গৌরীর কষ্ঠ হইতে একটা চাপা বেদনাবিদ্ধ শব্দ বাহির হইল— উঃ! কস্তুরী আজ  বাসক-সজ্জায় সাজিয়া নববধুর মত দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল, আর—সে তাহাকে দেখিয়াও মুখ ফিরাইয়া চলিয়া আসিয়াছে। কর্তব্যবুদ্ধির সমস্ত সান্ত্বনা ছাপাইয়া এই দুঃসহ মনঃপীড়াই তাহার হৃৎপিণ্ডকে পিষিয়া রক্তাক্ত করিয়া তুলিতেছিল।

সে ভাবিতে লাগিল—পলাইয়া যাই! চুপি চুপি কাহাকেও কিছু না বলিয়া নিজের দেশে, নিজের আত্মীয়-স্বজনের কাছে ফিরিয়া যাই, যেখানে দাদা আছেন, বৌদিদি আছেন ভুলিতে পারিব না? এই মায়াপুরীর মোহময় ইন্দ্রজাল হইতে মুক্তি পাইব না? না পাই —তবু তো প্রলোভন হইতে দূরে থাকিব; পরস্ত্রীলুব্ধ মিথ্যাচারীর জীবনযাপন করিতে হইবে না।

কিন্তু–

পলাইবার উপায় নাই। তাহার হাতে-পায়ে শিকল বাঁধা। সে তত ঝিন্দের রাজা নয়—ঝিন্দের বন্দী। আরব্ধ কাজ শেষ না করিয়া, একটা রাজ্যের শান্তি শৃঙ্খলা ওলটপালট করিয়া দিয়া সে পলাইবে কোন মুখ? নিজের দুঃখ তাহার যত মর্মভেদীই হোক, একটা রাজ্যকে বিপ্লবের কোলে তুলিয়া দিয়া ভীরুর মত পলাইবার অধিকার তাহার নাই; পলাইলে শুধু সে নয়, সমস্ত বাঙালী জাতির মুখে কালি লেপিয়া দেওয়া হইবে। —না, তাহাকে থাকিতে হইবে। যদি কখনো শঙ্কর সিংকে উদ্ধার করিতে পারে, তবে তাহার হাতে কস্তুরীকে তুলিয়া দিয়া মুখে হাসি টানিয়া বিদায় লইতে পারিবে–তার আগে নয়।

সমস্ত রাত্রি গৌরী ঘুমাইতে পারিল না; মোহাচ্ছন্ন অবস্থার ভিতর দিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা নহবৎখানার বাজনা শুনিয়া গেল। ভোরের দিকে একটু নিদ্রা আসিল বটে, কিন্তু নিদ্রার মধ্যেও তাহার মন অশান্ত সমুদ্রের মত পাষাণ প্রতিবন্ধকে বারবার আছাড়িয়া পড়িয়া নিজেকে শতধা চূর্ণ করিয়া ফেলিতে লাগিল।

বেলা আটটায় সময় বজ্ৰপাণি আসিয়াছেন শুনিয়া সে জবাফুলের মত আরক্ত চোখ মেলিয়া শয্যায় উঠিয়া বসিল। চম্পা সংবাদ দিতে আসিতেছিল, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল– কি চান তিনি?

চম্পা গৌরীর মুখের চেহারা দেখিয়া সঙ্কুচিতভাবে দাঁড়াইয়া ছিল, গিন্নীপনা করিবার সাহসও আজ তাহার হইল না। সে মাথা নাড়িয়া বলিল— জানি না।

গৌরী বোধ করি বজ্ৰপাণিকে বিদায় করিয়া দিবার কথা বলিতে যাইতেছিল; কিন্তু তাহার পূর্বে তিনি নিজেই কক্ষে প্রবেশ করিলেন। গৌরীর মুখের দিকে একবার চাহিয়া বলিয়া উঠিলেন—একি! আপনার চেহারা এত খারাপ দেখাচ্ছে কেন? শরীর কি অসুস্থ? চম্পা, ডাক্তার গঙ্গানাথকে খবর পাঠাও।

চম্পা গমনোদ্যত হইলে গৌরী বলিল–না না—ডাক্তার চাই না, আমি বেশ ভালই আছি। আপনি কি জরুরী কিছু বলতে চান?

বজ্ৰপাণি একটু ইতস্তত করিয়া বলিলেন— হ্যাঁ— কিন্তু আপনার শরীর যদি–

গৌরী শয্যা ত্যাগ করিয়া বলিল–আপনি ও-ঘরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, আমি মুখ-হাত ধুয়েই যাচ্ছি।–চম্পা, আমার জন্যে এক গেলাস ঠাণ্ডা সরবৎ তৈরি করে আনতে পার?

চম্পা একবার মাথা ঝুকাইয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিল। আধঘণ্টা পরে কনকনে ঠাণ্ডা জলে স্নান করিয়া অনেকটা প্রকৃতিস্থ হইয়া গৌরী ভোজন কক্ষে আসিয়া বসিল। প্রাতরাশ টেবলে সজ্জিত ছিল, কিন্তু সে তাহা স্পর্শ করিল না। চম্পা থালার উপর সরবতের পাত্র লইয়া দাঁড়াইয়া ছিল— বাদাম, মিছরি ও গোলমরিচ দিয়া প্রস্তুত উৎকৃষ্ট ঠাণ্ডাই সহাস্যমুখে এক চুমুক পান করিয়া গৌরী বলিল— আঃ! চম্পা, তোমার জন্যেই ঝিন্দের রাজাগিরি কোনোমতে বরদাস্ত করছি; তুমি যেদিন বিয়ে করে বরের ঘরে চলে যাবে, আমিও সেদিন ঝি ছেড়ে বিবাগী হয়ে যাব।

চম্পার মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল; সে বলিল— রাজবাড়ি ছেড়ে আমি একপাও নড়ব না— আপনি যদি তাড়িয়ে দেন তবুও না।

সরবতের পাত্রে আর এক চুমুক দিয়া গৌরী বলিল— তোমাকে রাজবাড়ি থেকে তাড়াতে পারি এত সাহস আমার নেই। বরঞ্চ তুমিই আমাকে তাড়াতে পার বটে। তুমি চলে গেলেই আমাকেও চলে যেতে হবে। কিন্তু তুমি যাতে না যাও, তার ব্যবস্থা আমায় করতে হচ্ছে। দেওয়ানজী, চম্পার বিয়ের আর কোনো কথা উঠেছে?

বজ্ৰপাণি অদূরে কৌচে বসিয়াছিলেন, বলিলেন— হ্যাঁ, ত্রিবিক্রম তো অনেক দিন থেকেই চেষ্টা করছেন—

তাঁকে চেষ্টা করতে বারণ করে দেবেন। চম্পার বিয়ের ব্যবস্থা আমি করব কি বল চম্পা?

চম্পা কিছুই বলিল না। বিবাহের ব্যবস্থা বাবাই করুন আর রাজাই করুন, বিবাহ জিনিসটাতেই তাহার আপত্তি। সে ক্ষীণভাবে হাসিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু হাসি ভাল ফুটিল না।

রুদ্ররূপ দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে লক্ষ্য করিয়া গৌরী বলিল— আর, রুদ্ররূপেরও। একটা বিয়ে দিতে হবে। আমার আশেপাশে যারা থাকে তাদের আমি সুখী দেখতে চাই। গৌরীর ঠোঁটের উপর দিয়া ক্ষণকালের জন্য যে ব্যথা-বিদ্ধ হাসিটা খেলিয়া গেল তাহা কাহারও চোখে পড়িল না।

কিন্তু গৌরীর কথার ইঙ্গিত রুদ্ররূপের কানে পৌঁছিল। তাহার মুখ ধীরে ধীরে লাল হইয়া উঠিল; সে ফৌজী কায়দায় শূন্যের দিকে তাকাইয়া শক্ত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

এই সময় সর্দার ধনঞ্জয় প্রবেশ করিয়া রাজাকে অভিবাদন করিলেন। গৌরী নিঃশেষিত সরবতের পাত্র চম্পাকে ফেরত দিয়া মুখ মুছিয়া বলিল— এবার কাজের কথা আরম্ভ হোক। দেওয়ানজী, আরম্ভ করুন।

বজ্ৰপাণি তখন কাজের কথা ব্যক্ত করিলেন। রাজবংশের রেওয়াজ এই যে, যুবরাজের তিলক সম্পন্ন হইয়া যাইবার পর ভাবী যুবরাজ-পত্নীকে বংশের সাবেক অলঙ্কারাদি উপঢৌকন পাঠান হয়—এই সকল অলঙ্কার পরিয়া কন্যার বিবাহ হয়। এই প্রথা বহুদিন যাবৎ চলিয়া আসিতেছে। কিন্তু বর্তমানে নানা কারণে এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় নাই। শঙ্কর সিংকে ফিরিয়া পাওয়া যাইবে, এই আশাতেই এতদিন বিলম্ব করা হইয়াছে। কিন্তু আর বিলম্ব করা সমীচীন নয়; অদ্যই সমস্ত উপঢৌকন ঝড়োয়ায় পাঠানো প্রয়োজন। নচেৎ, এই ত্রুটির সূত্র ধরিয়া অনেক কথার উৎপত্তি হইতে পারে।

শুনিয়া গৌরী বলিল— বেশ তো। রেওয়াজ যখন, তখন করতে হবে বৈকি। এর জন্যে আমার অনুমতি নেবার কোনো দরকার ছিল না—আপনারা নিজেরাই করতে পারতেন। তা কে এসব গয়নাপত্র সঙ্গে করে নিয়ে যাবে? এ বিষয়েও রেওয়াজ আছে নাকি?

ধনঞ্জয় বলিলেন— চম্পা নিয়ে যাবে। অবশ্য তার সঙ্গে রক্ষী থাকবে।

গৌরী বলিল— বেশ। রুদ্ররূপ চম্পার রক্ষী হয়ে যাক।–তাহলে দেওয়ানজী, আর বিলম্ব হবেন না–সওগাত পাঠাবার ব্যবস্থা করুন।

বজ্ৰপাণি ও ধনঞ্জয় প্রস্থান করিলেন। চম্পা মহানন্দে সাজসজ্জা করিতে গেল।

গৌরী মুষ্টির উপর চিবুক রাখিয়া অনেকক্ষণ শুন্যের দিকে তাকাইয়া রহিল। তারপর মনে মনে কেট সঙ্কল্প স্থির করিয়া সন্তর্পণে উঠিয়া গিয়া দরজার বাহিরে উঁকি মারিয়া দেখিল সম্মুখের যায় কেবল রুদ্ররূপ পায়চারি করিতেছে। গৌরী অঙ্গুলির ইঙ্গিতে তাহাকে ডাকিল। রুদ্ররূপ কাছে  আসিলে বলিল–সর্দার কোথায়?

তিনি আর দেওয়ানজী তোশাখানার দিকে গেছেন।

গৌরী তখন গলা নামাইয়া বলিল— তুমি যাও, চম্পার কাছ থেকে চিঠির কাগজ আর কলম চেয়ে নিয়ে এস। চুপি চুপি, বুঝলে?

রুদ্ররূপ প্রস্থান করিল। সদর হইতে লেখার সরঞ্জাম না আনাইয়া চম্পার নিকট হইতে আনাইবার কারণ কি তাহাও আন্দাজ করিয়া লইল। অন্দরের যে অংশটায় চম্পার মহল সেখানে রুদ্ররূপ পূর্বে কখনো পদার্পণ করে নাই; একজন পরিচারিকাকে জিজ্ঞাসা করিয়া সে ঠিকানা জানিয়া লইল। দ্বারের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া দেখিল, দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ। একটু ইতস্তত করিয়া দরজায় টোকা মারিল, তারপর ভাঙা গলায় ডাকিল— চম্পাদেঈ!

কবাট খুলিয়া একজন দাসী মুখ বাড়াইল। রুদ্ররূপকে দেখিয়া সসম্রমে জিজ্ঞাসা করিল—কাকে দরকার সর্দারজী!

চম্পাদেঈ আছেন?

আছেন। ঝড়োয়ায় যেতে হবে তাই তিনি সাজগোজ করছেন।

রুদ্ররূপ বড় বিপদে পড়িল। চম্পাকে সে মনে মনে ভারি ভয় করে, এ সময় তাহাকে ডাকিলে সে যে চাটিয়া যাইবে তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু এদিকে রাজার হুকুম। সাহসে ভর করিয়া যে বলিল–তাঁর সঙ্গে জরুরী দরকার আছে, তাঁকে খবর দাও। আর, তুমি কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যাও।

পরিচারিকা চম্পার খাস চাকরানী, বাপের বাড়ি হইতে সঙ্গে আসিয়াছে; সে একটু আশ্চর্য হইল। একে তো অন্দরমহলে পুরুষের গতিবিধি অত্যন্ত কম, তাহার উপর রুদ্ররূপের অদ্ভুত হুকুম শুনিয়া সে থতমত খাইয়া বলিল— কিন্তু, এত্তেলা তাঁকে আমি এখনি দিচ্ছি। কিন্তু তিনি এখন সিঙাব করছেন—

রুদ্ররূপ একটু গরম হইয়া বলিল—তা করুন—

ভিতর হইত চম্পার কণ্ঠ শুনা গেল—রেওতি, কে ও? কি চায়?

রেবতী দ্বার ভেজাইয়া দিয়া কর্ত্রীকে সংবাদ দিতে গেল। রুদ্ররূপ অস্বস্তিপূর্ণ দেহে দাঁড়াইয়া রহিল।

অল্পক্ষণ পরে আবার দরজা খুলিল, রেবতী বলিল— আসুন।

রুদ্ররূপ সসঙ্কোচে ঘরে প্রবেশ করিল। ঘরের ভিতর আর একটি ঘর, মাঝখানে পদা। এই পদার ভিতর হইতে কেবল মুখটি বাহির করিয়া চম্পা দাঁড়াইয়া আছে, রুদ্ররূপকে দেখিয়াই বলিল— তোমার আবার এই সময় কি দরকার হল? শিগগির বল; আমার সময় নেই। এখনো চুল বাঁধতে বাকি।

রুদ্ররূপ রেবতীর দিকে ফিরিয়া বলিল— তুমি বাইরে যাও। –চম্পার প্রতি করুণ দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল— ভারী গোপনীয় কথা।

চম্পা মুখে অধীরতাসূচক একটা শব্দ করিল। রেবতীকে মাথা নাড়িয়া ইশারা করিতেই সে বাহিরে বারান্দায় গিয়া দাঁড়াইল।

গোপনীয় কথা বলিতে হইবে, চিৎকার করিয়া বলা চলে না। রুদ্ররূপ কৈ মাছের মত কোণাচে ভাবে চম্পার নিকটবর্তী হইল। চম্পা চোখে বোধ করি কাজল পরিতেছিল, প্রসাধন এখনো শেষ হয় নাই; সে কাজলপরা বামচক্ষে তীব্র দৃষ্টি হানিয়া বলিল— কি হয়েছে?

রুদ্ররূপের অবস্থা শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছিল, সে একবার গলা খাঁকারি দিয়া চম্পার কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া গদগদ স্বরে বলিল— রাজা চিঠির কাগজ চাইছেন।

এই তোমার গোপনীয় কথা! রাগের মাথার চম্পা পর্দা ছাড়িয়া বাহির হইয়া আসিল; আবার তখনি নিজের অসম্পূর্ণ বেশবিন্যাসের দিকে তাকাইয়া পদার ভিতর লুকাইল। ওড়না গায়ে নাই শাড়ির আঁচলটাও মাটিতে লুটাইতেছে; এ অবস্থায় রুদ্ররূপের সম্মুখীন হওয়া চলে না—তা যতই রাগ হোক।

রুদ্ররূপ কাতরভাবে বলিল— সত্যি বলছি চম্পা, রাজা বললেন, তোমার কাছ থেকে চুপি চুপি চিঠির কাগজ আর কলম চেয়ে আনতে। বোধ হয় চিঠি লিখবেন।

তুমি একটা—তুমি একটা–চম্পা হাসিয়া ফেলিল— তুমি একটি বুন্ধু।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় রুদ্ররূপ বলিয়া ফেলিল—আর তুমি একটি ডালিম ফুল। বলিয়া ফেলিয়াই তাহার মুখ ঘোর রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল।

চম্পা কিছুক্ষণ চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া তাহার সিন্দুরের মত মুখের পানে তাকাইয়া রহিল; তারপর পর্দা আস্তে আস্তে বন্ধ হইয়া গেল।

রুদ্ররূপ ঘর্মাক্ত দেহে ভাবিতে লাগিল— পলায়ন করিবে কিনা। কিছুক্ষণ পরে চম্পার হাত পদার ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিল—এই নাও।

কাগজ কলম লইয়া মুখ তুলিতেই রুদ্ররূপ দেখিল, পদার ফাঁকে কেবল একটি কাজলপরা চোব তাহাকে নিরীক্ষণ করিতেছে। ভড়কানো ঘোড়ার মত সে ঘর ছাড়িয়া পলায়ন করিল; হোঁচট খাইতে বাইতে রাজার কাছে ফিরিয়া গেল।

লেখার সরঞ্জাম লইয়া গৌরী বলিল— তুমি পাহারায় থাক। যদি সর্দার কিম্বা আর কেউ আসে, আগে খবর দিও।

রুদ্ররূপকে পাহারায় দাঁড় করাইয়া গৌরী চিঠি লিখিতে বসিল। দুইখানা কাগজ ছিড়িয়া ফেলিবার পর সে লিখিল :

কৃষ্ণা,

তোমার কাছে আমার অপরাধ ক্রমে বেড়েই যাচ্ছে; তবু যদি সম্ভব হয় ক্ষমা কোরো। কস্তুরী কি খুব রাগ করেছেন? তাঁকে বোলো, আমি অতি অধম, তাঁর অভিমানের যোগ্য নই। এমন কি, তাঁর হৃদয়ে করুণা সঞ্চার করবার যোগ্যতাও আমার নেই। তিনি আমাকে ভুলে যেতে পারবেন না কি? চেষ্টা করলে হয়তো পারবেন। আমার বিনীত প্রার্থনা তিনি যেন সেই চেষ্টা করেন। ইতি—

শঙ্করসিং নামধারী হতভাগ্য

চিঠি লিখিয়া গৌরী নিজের কোমরবন্ধের মধ্যে খুঁজিয়া রাখিল। তারপর চম্পা যখন সাজিয়া গুজিয়া প্রস্তুত হইয়া তাহার হুকুম লইতে আসিল, তখন সে চিঠিখানা তাহার হাতে খুঁজিয়া দিয়া চুপি চুপি বলিল-যাও, কৃষ্ণার হাতে চিঠি দিও।চম্পা বুকের মধ্যে চিঠি লুকাইয়া রাখিল।

অতঃপর শোভাযাত্রা করিয়া উপঢৌকনবাহীর দল যাত্রা করিল। চারিটি সুসজ্জিত হাতি; প্রথমটির পৃষ্ঠে সোনালী হাওদায় সুক্ষ্ম মলিনের ঘেরাটোপের মধ্যে চম্পা বসিল। বাকী তিনটিতে অলঙ্কারের পেটারি উঠিল। ত্রিশজন সওয়ার লইয়া রুদ্ররূপ ঘোড়ায় চড়িয়া সঙ্গে সঙ্গে চলিল। পশ্চাতে একদল যন্ত্রবাদক ঝলমলে বেশভূষা পরিয়া অতি মিঠা সুরে বাজনা বাজাইতে বাজাইতে অনুসরণ করিল।

তাহাদের বিদায় করিয়া দিয়া গৌরী, ধনঞ্জয় ও বজ্ৰপাণি বৈঠকে আসিয়া বসিলেন। বাহিরের কেহ ছিল না; অন্যমনস্কভাবে কিছুক্ষণ একথা-সেকথা হইবার পর গৌরী সহসা বলিয়া উঠিল—ভাল কথা, সর্দার, ওরা আমার নাম-ধাম পরিচয় সব জানতে পেরে গেছে।

ধনঞ্জয় চকিত হইয়া বলিলেন–কি রকম?

গতরাত্রে প্রহ্লাদ দত্তের দোকানে ও উদিতের বাগানবাড়ির সম্মুখে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, গৌরী সব বলিল। টেলিগ্রামখানাও দেখাইল। দেখিয়া শুনিয়া ধনঞ্জয় ও বজ্ৰপাণি অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। শেষে ধনঞ্জয় বলিলেন–হুঁ, ওরাই আমাদের সব খবর পাচ্ছে দেখছি, আমরা ওদের। সম্বন্ধে কিছুই পাচ্ছি না। যাহোক, ঐ হতভাগা স্বরূপদাসটাকে গ্রেপ্তার করিয়ে আনতে হচ্ছে; ওই হল ওদের গুপ্তচর! আর প্রহ্লাদ দত্ত যখন এর মধ্যে আছে, তখন তাকেও সাপটে নিতে হবে। এরাই উদিতের হাত-পা, এদের শায়েস্তা না করতে পারলে, উদিতকে জব্দ করা যাবে না। বলিয়া বজ্ৰপাণির দিকে চাহিলেন।

বজ্ৰপাণি ঘাড় নাড়িলেন–স্বরূপদাসকে সহজেই গ্রেপ্তার করা যাবে। স্টেট রেলওয়ের চাকর, বিনা অনুমতিতে স্টেশন ছেড়েছিল এই অপরাধে তার চাকরি তো যাবেই, তাকে জেলে পাঠানোও চলবে। কিন্তু প্রহ্লাদ সাধারণ দোকানদার—তাকে কোন্ অজুহাতে দেওয়ান জু কুঞ্চিত করিয়া চিন্তিত হইয়া পড়িলেন।

ধনঞ্জয় বলিলেন–যাহোক, কোতোয়ালীতে খবর দিই, তারা স্বরূপদাসকে ধরুক, আর আপাতত প্রহ্লাদের ওপর নজর রাখুক – তিনি উঠিবার উপক্রম করিলেন।

এই সময় একজন দ্বাররক্ষী আসিয়া খবর দিল যে, শহর হইতে এক দোকানদার মহারাজের ক্রীত জিনিসপত্র পাঠাইয়াছে। ধনঞ্জয় সপ্রশ্ননেত্রে গৌরীর পানে তাকাইলেন, গৌরী বলিল–হ্যাঁ, প্রহ্লাদের দোকানে কিছু জিনিস কিনেছিলাম। এখানেই আনতে বল।

একখানা বড় চাঁদির পরাতে রেশমের খুঞ্চেপোষ ঢাকা দ্রব্যগুলি লইয়া ভৃত্য উপস্থিত হইল। আবরণ খুলিয়া সকলে সুদৃশ্য শৌখিন জিনিসগুলি দেখিতে লাগিলেন। গৌরী দেখিল, জিনিসগুলির মধ্যে একটি ক্ষুদ্র হাতির দাঁতের কৌটা রহিয়াছে, যাহা সে কেনে নাই। সেটা তুলিয়া লইয়া ঢাকনি খুলিতেই দেখিল, তাহার ভিতরে একখানি চিঠি।

গৌরী প্রথমে ভাবিল, পণ্যদ্রব্যগুলির মূল্য তালিকা; কিন্তু চিঠি খুলিয়া দেখিল— বাংলা চিঠি। সবিস্ময়ে পড়িল :

দেবপাদ মহারাজ,

আপনাকে বাংলায় চিঠি লিখিতেছি যাহাতে অন্য কেহ ও চিঠির মর্ম বুঝিতে না পারে। আপনি কে তাহা আমি জানি।

কাল আপনাকে স্বচক্ষে দেখিয়া ও আপনার সহিত কথা কহিয়া আমার মনের ভাব পরিবর্তিত হইয়াছে। আমি এতদিন অন্য পক্ষে ছিলাম। কিন্তু আমি বাঙালী। আমি যদি আপনাকে সাহায্য না করি তবে এই বিদেশে আর কে করিবে। তাই আজ হইতে আমি ও-পক্ষ ত্যাগ করিলাম।

কিন্তু প্রকাশ্যভাবে সাহায্য করিতে পারিব না; যদি উহারা আমায় সন্দেহ করে তাহা হইলে আমার জীবন সঙ্কট হইয়া পড়িবে, আপনি বা আর কেহই আমাকে রক্ষা করিতে পারিবে না। আমি গোপনে যতদূর সম্ভব আপনাকে সাহায্য করিব। ও-পক্ষের অনেক খবর আমি পাই—প্রয়োজন মনে হইলে আপনাকে জানাইব।

আপনাকে চিঠি লেখা আমার পক্ষে নিরাপদ নয়; কিন্তু আমাদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হওয়া আরও বিপজ্জনক। তাই চিঠিতেই সংক্ষেপে যাহা জানি আপনাকে জানাইতেছি। আপনি যদি আরো কিছু জানিতে চাহেন, এই কৌটায় চিঠি লিখিয়া কৌটা ফেরত পাঠাইবেন বলিয়া দিবেন কৌটা পছন্দ হইল না।

উপস্থিত সংবাদ এই—আপনারা যদি শঙ্কর সিংকে উদ্ধার করিতে চান তবে শীঘ্র শক্তিগড়ে গিয়া সন্ধান করুন। তিনি সেখানেই আছেন। কেল্লার পশ্চিম দিকের প্রাকারের নীচে নদীর জলের চার-পাঁচ হাত উপরে একটি ক্ষুদ্র চতুষ্কোণ জানালা আছে। ঐ জানালা যে ঘরের—সেই ঘরে শঙ্কর সিং বন্দী আছেন। প্রায় সকল সময়েই তাঁহাকে মদ খাওয়াইয়া অজ্ঞান করিয়া রাখা হয়। তাছাড়া, একজন লোক সর্বদা পাহারায় থাকে।

এই চিঠি অনুগ্রহপূর্বক পত্রপাঠ ছিড়িয়া ফেলিবেন। মহারাজের জয় হোক। ইতি–

পরম শুভাকাঙক্ষী চরণাশ্রিত শ্রীপ্রহ্লাদচন্দ্র দত্ত

গৌরী চিঠি হইতে মুখ তুলিয়া ভৃত্যকে বলিল— এ সব জিনিস তুমি চম্পাদের মহলে পাঠিয়ে দাও। যে-লোক এগুলো নিয়ে এসেছে, তাকে বল, যদি কোনো জিনিস অপছন্দ হয় ফেরত পাঠানো হবে।

ভৃত্য যো হুকুম বলিয়া পরাত হস্তে প্রস্থান করিল।

ধনঞ্জয় ও বজ্ৰপানি দুইজনেই গৌরীর মুখের ভাব লক্ষ্য করিয়াছিলেন; ভৃত্য অন্তর্হিত হইলে ধনঞ্জয় জিজ্ঞাসা করিলেন চিঠিতে কি আছে?

গৌরী বলিল–আগে দরজাগুলো বন্ধ করে দিয়ে এস।

দরজা বন্ধ করিয়া তিনজনে ঘেঁষাঘেঁষি হইয়া বসিলেন। গৌরী তখন প্রহ্লাদের চিঠি পড়িয়া শুনাইল। তারপর তিনজনে মাথা একত্র করিয়া নিম্নস্বরে পরামর্শ আরম্ভ করিলেন। অনেক যুক্তিতর্কের পর স্থির হইল–কোনো ছুতায় শক্তিগড়ের নিকটে গিয়া আড্ডা গাড়িতে হইবেরাজধানীতে বসিয়া থাকিলে কোনো কাজ হইবে না। উদিত সিং কেল্লায় তাহাদের ঢুকিতে না দিতে পারে, কিন্তু কেল্লার বাহিরে যদি তাঁহারা তাঁবু ফেলিয়া থাকেন, তাহা হইলে সে কিছু করিতে পারিবে না। তখন সেখানে বসিয়া স্থান কাল ও সুযোগ বুঝিয়া শঙ্কর সিংকে উদ্ধার করিবার একটা মতলব বাহির করা যাইতে পারে।

উপস্থিত দেওয়ান বজ্ৰপাণি রাজধানীতে থাকিয়া এদিক সামলাইবেন। ধনঞ্জয় ও রুদ্ররূপ আরো সহচর সঙ্গে লইয়া গৌরীর সঙ্গে থাকিবেন। এইরূপ পরামর্শ স্থির করিয়া যখন তাঁহারা শ্রান্তদেহে গাত্রোত্থান করিলেন তখন বেলা দ্বিপ্রহর অতীত হইয়া গিয়াছে।

কিন্তু তখনো তাঁহারা নিষ্কৃতি পাইলেন না। এই সময় সদরে দ্রুত অশ্বক্ষুরধ্বনি শুনিয়া ধনঞ্জয় জানালা দিয়া গলা বাড়াইয়া দেখিলেন, ময়ূরবাহন তাহার কালো ঘোড়ার পিঠ হইতে নামিতেছে। তিনি চকিতে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন— ময়ূরবাহন এসেছে। বসুন—উঠবেন না।  

তিনজনে আবার উপবিষ্ট হইলেন। পরক্ষণেই দৌবারিক খবর দিল, ময়ূরবাহন জরুরী কাজে মহারাজের দর্শন চান।

গৌরী বলিল— নিয়ে এস।

ময়ূরবাহন প্রবেশ করিল। তাহার মাথার পাগড়ির খাঁজে ধুলা জমিয়াছে পাতলা গোঁফের উপরেও ধুলার সূক্ষ্ম প্রলেপ; দেখিলেই বোঝা যায়, সে শক্তিগড় হইতে সোজা ঘোড়ার পিঠে আসিয়াছে। কিন্তু তাহার অঙ্গে বা মুখের ভাবে ক্লান্তির চিহ্নমাত্র নাই। ঘরে ঢুকিয়া সম্মুখে উপবিষ্ট তনজনকে দেখিয়া সে সকৌতুকে হাসিয়া অবহেলাভরে একবার ঘাড় নীচু করিয়া অভিবাদন। করিল। বলিল–সপার্ষদ মহারাজের জয় হোক।

রাজার সম্মুখে আদব কায়দার যে রীতি আছে তাহা সম্পূর্ণ লঙ্ঘন না করিয়াও ধৃষ্টতা প্রকাশ করা যায়। ময়ূরবাহনের বাহ্য শিষ্টাচারের ক্ষীণ পর্দার আড়ালে যে বেপরোয়া ধৃষ্টতা প্রকাশ পাইল তাহা কাহারও দৃষ্টি এড়াইল না। তাহার দুই চক্ষে দুষ্ট কৌতুক নৃত্য করিতেছিল; রক্তের মত রাঙা ওষ্ঠাধরে যে হাসিটা খেলা করিতেছিল, তাহা যেমন তীক্ষ্ণ তেমনি বিদ্রূপপূর্ণ। তাহার কথাগুলার অন্তর্নিহিত গুপ্ত শ্লেষ সকলের মর্মে গিয়া বিধিল।

গৌরী মনে মনে স্থির করিয়া রাখিয়াছিল যে ময়ূরবাহনকে অবজ্ঞাপূর্ণ তাচ্ছিল্যের সহিত সম্ভাষণ করিবে। কিন্তু তাহার এই স্পর্ধা গৌরীর গায়ে যেন বিষ ছড়াইয়া দিল; সে অবরুদ্ধ ক্রোধের স্বরে বলল–কি চাও তুমি? যা বলতে চাও শীঘ্র বল, সময় নষ্ট করবার আমাদের অবকাশ নেই।

ময়ূরবাহনের মুখের হাসি আরো বাঁকা হইয়া উঠিল; সে কৃত্রিম বিনয়ের একটা ভঙ্গি করিয়া বলল–ঠিক বলেছেন মহারাজ; রাজ্য ভোগ করবার অবকাশ যখন সংক্ষিপ্ত তখন সময় নষ্ট করা বোকামি। আমি কারুর সুখভোগে বিঘ্ন ঘটাতে চাই না, আমার জীবনের উদ্দেশ্যই তা নয়। কুমার উদিত সিং আপনাকে একটি নিমন্ত্রণলিপি পাঠিয়েছেন, সেইটে হুজুরে দাখিল করেই আমি ফিরে যাব। কোমরবন্ধ হইতে একখানা চিঠি লইয়া গৌরীর সম্মুখে ধরিল।

গৌরী নিষ্পলক চোখে কিছুক্ষণ ময়ূরবাহনের দিকে তাকাইয়া রহিল, কিন্তু ময়ূরবাহনের চোখের পল্লব পড়িল না। তখন সে চিঠি লইয়া মোহর ভাঙ্গিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল। চিঠিতে লেখা ছিল :

ওরে বাঙালী নটুয়া, তুই কি জন্য মরিতে এদেশে আসিয়াছিস? তোর কি প্রাণের ভয় নাই! তুই শীঘ্র এ দেশ ছাড়িয়া পলাইয়া যা— নচেৎ পিঁপড়ার মত তোকে টিপিয়া মারিব।

তোর নিজের দেশে ফিরিয়া গিয়া তুই নটুয়ার নাচ দেখা–পয়সা মিলিবে। এদেশে তোর দর্শক মিলিবে না।

পড়িতে পড়িতে গৌরীর মুখ আগুনের মত জ্বলিয়া উঠিল। সে দাঁতে দাঁত ঘষিয়া আরক্ত চক্ষে বলল—এ কি চিঠি? বলিয়া কম্পিতহস্তে কাগজখানা ময়ূরবাহনের সম্মুখে ধরিল।

ময়ূরবাহন বিস্ময়ের ভান করিয়া চিঠিখানার দিকে দৃষ্টিপাত করিল; তারপর যেন ভুল করিয়াছে এমনিভাবে বলিল–ওঃ তাইতো! ও চিঠিখানা আপনার জন্য নয়, ভুলক্রমে আপনাকে দিয়ে ফেলেছি। এই নি আপনার চিঠি! বলিয়া আর একখানা চিঠি বাহির করিয়া গৌরীর হাতে দিল। প্রথম চিঠিখানা গৌরীর হাত হইতে লইয়া অবহেলাভরে গোলা পাকাইয়া ঘরের এক কোণে ফেলিয়া দিল।

গৌরী অসীমবলে আত্মসম্বরণ করিয়া বলিল— তোমার কাজ শেষ হয়েছে, তুমি এখন যেতে পার।

ময়ূরবাহন বলিল— নিশ্চয়। শুধু বুড়ো মন্ত্রীর কাছে একটা পরামর্শ নেওয়া বাকি আছে। –দেওয়ানজী, বলতে পারেন, যারা রাজ-সিংহাসনে বিদেশী মর্কটকে বসিয়ে নাচ দেখে তাদের শাস্তি কি?

গৌরী আর ধৈর্য রাখিতে পারিল না, গুণ-ছেঁড়া ধনুকের মত উঠিয়া দাঁড়াইয়া গর্জিয়া উঠিল—চোপরও বদজাত কুকুরের বাচ্চানইলে তোকে ডালকুত্তা দিয়ে খাওয়াব।

ময়ূরবাহনের মুখের হাসি মিলাইয়া গেল। তাহার ডান হাতখানা সরীসৃপের মত কোমরবন্ধে বাঁধা তলোয়ারের দিকে অগ্রসর হইল। সাপের মত চোখ দুইটা গৌরীর মুখের উপর ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া ধনঞ্জয়ের দিকে ফিরিল। কিন্তু ধনঞ্জয়ের মুষ্টিতে যে জিনিসটা ছিল তাহা দেখিবামাত্র ময়ূরবাহনের হাত তরবারি হইতে সরিয়া গেল। সে আবার উচ্চৈঃস্বরে হাস্য করিয়া উঠিল, সেই নির্ভীক বেপরোয়া হাসি! তারপর দেহের একটা হিল্লোলিত ব্যঙ্গপূর্ণ ভঙ্গি করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে তাহার ঘোড়র ক্ষুরের শব্দ অস্পষ্ট হইয়া ক্রমে মিলাইয়া গেল।

গৌরীর হাত হইতে চিঠিখানা মাটিতে পড়িয়া গিয়াছিল। বজ্ৰপাণি এইবার সেটা তুলিয়া লইয়া পড়িলেন।

স্বস্তি শ্ৰীমন্মহারাজ শঙ্কর সিং দেবপাদ জ্যেষ্ঠের নিকট অনুগত অনুজ শ্রীউদিত সিংয়ের সানুনয় নিবেদন—আমার জমিদারীতে সম্প্রতি হরিণ শুকর প্রভৃতি অনেক শিকার পড়িয়াছে। অন্যান্য বৎসরের ন্যায় এবারেও যদি মহারাজ মৃগয়ার্থ শুভাগমন করেন তাহা হইলে কৃতার্থ হইব। অলমিতি।

বজ্ৰপাণি পত্রটি নিঃশব্দে ধনঞ্জয়ের হাতে দিলেন। গৌরী কিছুক্ষণ অসহ্য ক্রোধে শক্ত হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া হঠাৎ অন্দরাভিমুখে প্রস্থান করিল। ময়ূরবাহনের ধৃষ্টতা তাহার দেহ-মনে আগুন ধরাইয়া দিয়াছিল; নূতন চিঠিতে কি আছে না আছে তাহা দেখিবার মত মনের অবস্থা তাহার ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *