নীলু খুব মন খারাপ করে একা একা বসে ছিল। রাত প্রায় আটটা। চারদিক অন্ধকার। ইলেকট্রিসিটি আছে। তবু রান্নাঘরের বাতিটি ছাড়া আর সব বাতি নিভিয়ে রাখা হয়েছে। দাদুমণি নীলুর ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, একা একা বসে আছ কেন? এসো, আমার সঙ্গে এসে বসো।
না।
ভয়ের কিছু নেই নীলু।
আমার ভয় করছে না।
সাজ্জাদরা কোথায়?
জানি না। রান্নাঘরে বোধহয়।
আমি কি বসব তোমার সঙ্গে।
জানি না, ইচ্ছা হলে বসেন।
দাদুমণি বসলেন। নিচুস্বরে বললেন, আমরা গ্রামে চলে যাব। সুযোগ পেলেই চলে যাব। নীলু কিছু বলল না। দাদুমণি বললেন, কার্ফু ওদের একসময় তুলতেই হবে। হবে না?
তুলতেই হবে কেন? না তুললে কে কী করবে?
দাদুমণি এর উত্তর দিতে পারলেন না। তিনি আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে নিজের ঘরে চলে গেলেন। তার হাতে একটি ট্রানজিস্টার। তিনি বিদেশের রেডিও স্টেশনগুলি ধরতে চেষ্টা করছেন। পারছেন না। এই ট্রানজিস্টারটি বেশি ভালো না। ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে এখনো হামদ ও নাতে রসূল হচ্ছে। মাঝে মাঝেই ইংরেজি বাংলা ও উর্দুতে বলা হচ্ছে–শহরে কারফিউ বলবত আছে।
সাজ্জাদ ও সাজ্জাদের বোন চুপচাপ রান্নাঘরে বসে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। রান্নাবান্না হয়ে গেছে। শুধু ডাল-ভাত। কিন্তু কেউ খেতে বসছে না। কারও খিদে। নেই। একসময় সাজ্জাদের বোন কী বলল, সাজ্জাদ জবাব দিল না। তার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। এটা এমন একটা সময় যখন কারও কথা বলতে ইচ্ছা করে না। দেখল দাদুমণি দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি নরমস্বরে বললেন, সাজা তোমরা রান্নাঘরে বসে আছ কেন? এসো সবাই একসঙ্গে বসি। নীলুকেও ডেকে এসো। ও খুবই মন খারাপ করছে।
নীলু এল না। তার নাকি কিছুই ভালো লাগছে না। কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। শেষপর্যন্ত দাদুমণি এলেন তাকে নিতে।
একা একা থাকলে আরও খারাপ লাগবে।
না, লাগবে না।
তাহলে বরং খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
আমি এখন ঘুমুব না।
দাদুমণি চলে এলেন। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল নীলু দরজা বন্ধ করে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়েছে। ট্রাংক খুলে তার বাদামি রঙের খাতা বের করেছে। এখানে সে মাঝেমাঝে নিজের মনের কথা লেখে। সেই লেখাগুলি খুব গোপন। কেউ পড়তে পারে না। এমনকি দাদুমণিও না। তিনি জানেনও না যে তার এরকম একটা খাতা আছে। এটি সে জন্মদিনে পাওয়া টাকায় নিজে গিয়ে কিনে এনেছে। নীল খাতা সামনে রেখে পুরনো দুএকটা লেখা পড়ল, তারপর লিখতে শুরু করল–
২৬ মার্চ, রাত নটা
আমরা আজ সারা দিন ঘরে বন্দি হয়ে আছি। খুব খারাপ লাগছে আমার। বাইরের সব দরজা জানালা বন্ধ। বারান্দায় উঁকি দেওয়ার হুকুম নেই। এত খারাপ লাগছে। এই দেশটা লরা মেরীর দেশের মতো কেন হলো না। তাহলে কী চমৎকার হতো! ঘাসের বনে একটা ছোট্ট কুটির বানিয়ে আমরা থাকতাম। শীতকালে তুষারঝড় হতো। জানালার পাশে বসে বসে দেখতাম সাদা বরফে চারদিক ঢেকে যাচ্ছে। দাদুমণি ঘরে একটা আগুন করে মজার মজার সব গল্প বলা শুরু করতেন। বাইরে ঝড়ের মাতামাতি। কোথাও যাবার উপায় নেই। এখনো অবশ্যি কোথাও যাবার উপায় নেই। কিন্তু এই দুয়ের মধ্যে কত তফাৎ! আমার খুব খারাপ লাগছে। কাঁদতে ইচ্ছে
হচ্ছে। এইটুকু লেখা হওয়া মাত্রই খুব কাছেই কোথাও ঝাকে ঝাকে গুলির শব্দ হতে লাগল। ক্যাট ক্যাট করতে লাগল মেশিনগান। দাদুমণি নীলুর দরজায় ধাক্কা দিয়ে ভীতস্বরে বললেন, দরজা খোল নীল।
নীলু দরজা খুলল না। দাদুমণি দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বললেন, মেঝেতে শুয়ে পড় নীলু, মেঝেতে শুয়ে পড়।
নীলু তাও করল না। পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল। গুলির শব্দ থেমে গেল। কিন্তু একজন পুরুষমানুষের চিৎকার শোনা যেতে লাগল। ভয়াবহ চিৎকার। নীলু দরজা খুলে বেরিয়ে এল। তার মুখ রক্তশূন্য। সে কাঁপা গলায় বলল, ওর কী হয়েছে দাদুমণি?
জানি তো না নীল।
কেউ কি দেখতে যাবে না ওর কী হয়েছে?
দাদুমণি সে-কথার জবাব দিতে পারলেন না। নীলু দ্বিতীয়বার বলল, কেউ কি যাবে না?
সাতাশ তারিখ চার ঘণ্টার জন্যে কার্ফু তোলা হলো। মানুষের ঢল নামল রাস্তায়। বেশিরভাগই শহর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। করুণ অবস্থা। যানবাহন সেরকম নেই। সময়ও হাতে নেই। যে অল্প কয়েক ঘন্টা সময় পাওয়া গেছে তার মধ্যেই শহর ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে হবে। পথে পথে মানুষের মিছিল। কিন্তু এই মিছিলের চরিত্র
বড় রাস্তার সব কটি মোড়ে সৈন্যবাহিনী টহল দিচ্ছে। তাদের চোখেমুখে ক্লান্তি ও উল্লাস। তাদের ধারণা যুদ্ধে তাদের জয় হয়েছে। তারা অলস ভঙ্গিতে নতুন ধরনের মিছিল দেখছে। এই মিছিলে আকাশফাটানো ধ্বনি নেই। এই মিছিলে কেউ পাশের মানুষটির সঙ্গেও কথা বলে না। শিশু কেঁদে উঠল মা বলেন, চুপ চুপ। শিশুরা কিছুই বোঝে না, তারা কাঁদে এবং হাসে। নিজের মনে কথা বলে। বয়স্ক মানুষেরা বলে, চুপ
যারা পালিয়ে যাচ্ছে তাদের মধ্যে অনেককেই কাঁদতে দেখা যায়। তাদের কী হয়েছে। প্রিয়জন পাশে নেই? যার রাতে বাড়ি ফেরার কথা ছিল সে কি ফিরেনি? প্রশ্ন করার সময় নয় এখন। যে চার ঘন্টা সময় পাওয়া গেছে এর মধ্যেই শহর ছাড়তে হবে। সময় ফুরিয়ে আসছে। সবাই দ্রুত যেতে চেষ্টা করে। শিশুরা হাসে ও কাঁদে, কোনো কিছুই তাদের বিচলিত করে না।
মিলিটারিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জনস্রোত দেখে। তাদের চকচকে বন্দুকের নল রোদের আলোয় ঝকমক করে। তারা মাঝেমাঝে কথা বলে নিজেদের মধ্যে, মাঝে মাঝে হেসে ওঠে। নিশ্চয়ই কোনো আশা ও আনন্দের গল্প। মজার কোনো স্মৃতি নিয়ে তামাশা। ওদের উচ্চস্বরের হাসির শব্দে শুধু শিশুরাই অবাক হয়ে তাকায়। আর কেউ তাকায় না।
কার্ফু শুরু হয় চারটায়। রাস্তাঘাট আবার জনশূন্য হয়ে যায়। শহরের অবস্থা যারা দেখতে বেরিয়েছিল তারা ঘরে ফিরে অসম্ভব গম্ভীর হয়ে যায়। দাদুমণি ঘণ্টাখানেকের জন্যে গিয়েছিলেন, তিনি ফিরেই শান্তস্বরে বললেন, শহর ছাড়তে হবে। কালই আমরা শহর ছাড়ব। তারপর আর কোনো কথা বলেন না। বিকাল চারটা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তিনি তার ঘরে একা একা বসে থাকেন।