নান্টু ভাই পোলাও রান্না করছেন। পোলাও এবং মুরগির কোরমা। তাঁকে খুবই আনন্দিত মনে হচ্ছে কারণ অর্ণব খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। আজ রাতে সে। বাবার সঙ্গে থাকবে। অর্ণব গভীর আগ্রহে বাবার কর্মকান্ড দেখছে। নান্টু ভাই। ছেলের আগ্রহ দেখেও মজা পাচ্ছেন। তিনি ফরহাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। ফরহাদ এলে তাকে ডিম আনতে পাঠাবেন। ফার্মের ডিম না, দেশী ডিম। ডিমের পুডিং বানাতে হবে। ডিমের পুডিং ছেলের খুব পছন্দ। রান্না শেষ করেই ভিডিওর দোকানে যেতে হবে। মিকি মাউসের ক্যাসেট আনতে হবে। খাওয়া দাওয়ার পর বাবা বেটা মিলে ক্যাসেট দেখা হবে। যে ভাবেই হোক ছেলেকে আনন্দে রাখতে হবে। আজ অর্ণবের দুঃখের দিন। কারণ আজ সন্ধ্যায় তার মার বিয়ে। মা-বাবার দ্বিতীয় বিয়েতে ছেলে মেয়ের উপস্থিত থাকা নিষিদ্ধ। সেই জন্যেই বোধ হয় শর্মিলা এত সহজে ছেলেকে ছেড়ে দিয়েছে।
নান্টু বলল, মনটা খারাপ না-কি রে ব্যাটা?
অর্ণব বলল, না।
কখনোই কোন কিছু নিয়ে মন খারাপ করবি না। সব সময় Do ফুর্তি।
অর্ণব পা দুলাতে দুলাতে বলল, আচ্ছা।
আর এই যে আমি এক জায়গায় থাকছি, তোর মা অন্য জায়গায় থাকছে। এটাও কোন ব্যাপার না। তোর জন্যে বরং লাভ। তুই একটা জায়গার বদলে দুটা জায়গা পাচ্ছিস।
হুঁ।
অর্ণবকে এখন কেন জানি অবোধ শিশু মনে হচ্ছে না। সে কেমন বয়স্ক মানুষের মত গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছে। নান্টুর মনে হচ্ছে অর্ণবের সঙ্গে জটিল সংসারিক বিষয় নিয়ে আলাপ করা যায়, এবং আলাপ করাই উচিত। এই পৃথিবীতে সবচে বড় বান্ধবী হয় মা এবং কন্যা, এবং সবচে বড় বন্ধু পিতা ও পুত্র। দুই বন্ধু জটিল আলাপ যদি না করে, কে করবে?
অর্ণব।
হুঁ।
তোর মার আজ যে বিয়ে হচ্ছে সেই লোকটা কেমন?
হুঁ।
তোকে আদর করে?
হুঁ।
বেশি?
হুঁ।
আমার চেয়েও বেশি?
একটু বেশি।
ছেলের শেষ উত্তরটা নান্টুর ভাল লাগল না। নিজেকে সে এই ভেবে সান্তনা দিল যে ছেলে মানুষ, না ভেবে চিন্তে কথা বলছে। সে ঠিক করে রাখল যে ছেলেকে সত্যি ভালবাসা এবং নকল ভালবাসার মধ্যে প্রভেদটা বুঝতে হবে। তবে এখন না, একটু বড় হলেই বুঝতে হবে। সব কিছুরই একটা সময় আছে।
তোর মা আমার সম্পর্কে তোকে কিছু বলে?
না।
ভাল মন্দ কিছুই বলে না?
অর্ণব বাবার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পা নাচাতে নাচাতে বলল–পেপসি খাব।
নান্টু বলল, একটু ধৈর্য ধরে বস বাপধন। তোর ফরহাদ চাচু চলে আসবে। সে এলেই তাকে পেপসি আর ডিম আনতে পাঠাব। ডিমের পুডিং বানাব। ডিমের পুডিং কি তোর পছন্দ?
হুঁ।
ফরহাদ চাচুকে কি পছন্দ?
হুঁ।
ফরহাদ খুবই ভাল ছেলে। এরকম ভাল ছেলে বাংলাদেশে নাই। ভাল ছেলেদের কপালে দুঃখ থাকে। এই জন্যে তার কপালেও দুঃখ।
নান্টু আশা করেছিল ছেলে বলবে, কেন দুঃখ?
অর্ণব তা করল না। সে আগের মতই পা দুলাতে লাগল। নান্টুর ইচ্ছা করছে ফরহাদের দুঃখ কষ্ট নিয়ে ছেলের সঙ্গে আলাপ করতে। অল্প বয়স থেকেই মানুষের দুঃখ কষ্ট সম্পর্কে ধারণা হওয়া দরকার। তাহলে বয়স কালে দুঃখী মানুষের প্রতি মমতা হয়।
নান্টু গরম ঘিয়ে চাল দিয়ে নাড়তে নাড়তে বলল, যে মেয়েটির সঙ্গে ফরহাদ চাচুর বিয়ের কথা হয়েছিল তার একটা ভয়ংকর অসুখ করেছে। খুবই ভয়ংকর অসুখ। সে চিকিৎসার জন্যে দেশের বাইরে গেছে। বুঝতে পারছিস?
হুঁ।
তোর ফরহাদ চাচুর খুব ইচ্ছা ছিল সেও সঙ্গে যাবে। টাকা নেই যাবে কি ভাবে? এখন সে পাগলের মত রাস্তায় হাঁটে। রাতে ঘুমায় না। যতবারই আমার ঘুম ভাঙ্গে আমি দেখি সে চুপচাপ বিছানায় বসে আছে। আমার চোখে পানি এসে যায়।
অর্ণব বলল, বাবা পেপসি খাব।
ধৈর্য ধর বাবা। একটু ধৈর্য ধর। জীবনে বড় হতে হলে ধৈর্য ধরতে হয়। ধৈর্য ইংরেজি কি জানিস?
পেশেন্স। আমার ধৈর্য ছিল না বলে—আজ এই দশা। টিভি দেখবি। টিভি ছেড়ে দেব?
না।
এটা ভাল। দিনরাত টিভি দেখা কোন কাজের কথা না। চোখের ক্ষতি হয়।
নান্টু পোলাও এ পানি দিয়ে পাতিলের মুখে ঢাকনা দিয়ে ছেলের কাছে এসে বসল। সে সামান্য উদ্বিগ্ন। কারণ ভাজা চালে গরম পানি দেয়ার কথা, সে দিয়েছে ঠাণ্ডা পানি। পোলাও হয়ত বা নরম হয়ে যাবে।
অর্ণব।
হুঁ।
তোর ফরহাদ চাচুর জন্যে আজ একটা সুসংবাদ আছে। সে মেসে এলেই সুসংবাদটা দেব তারপর দেখব সে কত খুশি হয়। সুসংবাদটা কি জানতে চাস?
না।
এটাতো বাবা ঠিক না। মানুষের সুখের সংবাদ, দুঃখের সংবাদ সব জানার আগ্রহ থাকতে হবে। সুসংবাদটা হল তোর ফরহাদ চাচুর জন্যে আমি টাকা জোগাড় করেছি। এখন শুধু একটা পাসপোর্ট করিয়ে প্লেনে তুলে দেয়া। পাসপোর্ট বের করা একদিনের মামলা। ইনশাল্লাহ আগামী পরশুর ফ্লাইটে তাকে তুলে দেব। বাবা কাজটা ভাল করেছি না?
জানি না।
খবরটা যখন তাকে দেব সে যে কি খুশি হবে এটা ভেবেই আনন্দে আমার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। খুব যখন আনন্দ হয় তখন মানুষের চোখে পানি আসে। তোর আসে না বাবা?
না।
এখন না এলেও পরে আসবে। পৃথিবীর সবচে পবিত্র পানি কি জানিস বাবা?
না।
মনের আনন্দে চোখে যে পানি আসে সেই পানি পৃথিবীর সবচে পবিত্র পানি।
বাবা পেপসি খাব।
আর দশটা মিনিট পোলাটা নামিয়ে আমি নিজেই যাব।
আমিও যাব।
অবশ্যই যাবি। তোকে ফেলে যাব না-কি? বাবারে আমি কাউকে ফেলে যাই না। লোকজন আমাকে ফেলে যায়।
নান্টু ঘড়ি দেখল। নটা বাজে। শর্মিলার বিয়ে হয়ত হয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিয়েতো কোন জাকজমকের বিয়ে না। দায়সারা বিয়ে। কাজির সামনে দুটা সিগনেচার। তারপর শুকনা খোরমা চিবানো। নান্টুর বিয়ের সময় খোরমা বাদ পড়ে গিয়েছিল। সব আনা হয়েছে। খোরমা আনা হয় নি। কন্যা পক্ষের একজন খুব হৈ চৈ শুরু করল—খোরমা আনতে হয় এটা জানেন না?
খোরমা নিয়ে হৈ চৈ করলেও কনের গয়না দেখে সবাই খুশি। পুরানো আমলের ভারী ভারী গয়না। খাদ কম সোনা বেশি। একটু চাপ দিলে গয়না বেঁকে যায়। সবই নান্টুর মায়ের গয়না। নান্টুর মা খুব অভাবে অনাটনে দিন কাটালেও তার বিয়ের একটি গয়না হাত ছাড়া করেন নি। ছেলের বৌকে কোন একদিন দেবেন বলে যক্ষের মত আগলে রেখেছিলেন।
নান্টু আজ সকালে খুব একটা খারাপ কাজ করেছে। শর্মিলার কাছ থেকে মার গয়না চেয়ে নিয়ে এসেছে। শর্মিলা এতে নিশ্চয়ই মনে কষ্ট পেয়েছে। কষ্ট পেলেও কিছু করার নেই। গয়না বিক্রি করে টাকার ব্যবস্থা না করলে ফরহাদকে আসমানীর কাছে পাঠানো যেত না।
নান্টুর মনে হল বেহেশতে বসে তার মা তার উপর খুব রাগ করছেন। বিরক্ত গলায় বলছেন—নান্টু তুই কেমন ছেলে বলতো। গয়না চেয়ে নিয়ে চলে এলি? মেয়েটার কাছেই থাকতো। অর্ণবের বিয়ের সময় সে গয়নাগুলি অর্ণবের বৌকে দিত। গয়না যে বিক্রি করলি এখন অর্ণবের বৌকে কি দিবি?
নান্টু মনে মনে প্রশ্ন করল, মা কাজটা কি খুব ভুল করেছি? নান্টুর মনে হল তার মা বলছেন—তুই আমার পাগলা ছেলে। ভুল তুই করবি নাতো কে করবে? ব্যাটা শোন, ভুল করে মনে যদি আনন্দ পায় তাহলে ভুলগুলিই শুদ্ধ।
অর্ণব বিস্মিত হয়ে দেখছে তার বাবার চোখে পানি। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, বাবা কাঁদছ কেন?
নান্টু বলল, রান্নার সময় চোখে ধোঁয়া লেগেছে। এই জন্যে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কাঁদছি নাতো। আমি কাঁদব কেন? নান্টু অবাক হয়ে দেখল তার ছেলের ঠোট বেঁকে যাচ্ছে। বাবার কান্না দেখে ছেলের কান্না পেয়ে যাচ্ছে। অর্ণব প্রাণপণ চেষ্টা করছে কান্না সামলাবার। পারছে না। এইতো ছেলের চোখে পানি।
নান্টু ছেলেকে কাছে টেনে নিল। তার মনে হল এই পৃথিবীতে তারচে সুখী মানুষ আর কেউ নেই।