সিদ্দিকুর রহমান আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন।
নানান ধরনের পাখি খান খাচ্ছে। কাক, শালিক, কবুতর, টুনটুনি, সাতরা পাখি। গ্রামাঞ্চলে কাক থাকে না। এই দুই দাড়কাক কোত্থেকে এসেছে? তিনি আগ্রহ নিয়ে কাক দুটিকে দেখছেন। সাধারণ কাকের দ্বিগুণ আয়তন। চোখ টকটকে লাল। পাখিসমাজ এই দুজনকে সমীহের চোখে দেখছে। কাক দুটির উপর দিয়ে বিকট শব্দ করে অচেনা একটি পাখি উড়ে গেল। কাক দুটি নড়ল না। আবার ঘাড় কাত করে দেখারও চেষ্টা করল না। কী হচ্ছে।
পাখির সংখ্যা গুনতে পারলে ভালো হতো। দিন দিন পাখির সংখ্যা বাড়ে না কমে এটা দেখা যেত। একজন কাউকে কি রেখে দেবেন যার কাজ হবে দিনে তিনবার পাখি গোনা! সকালে একবার, দুপুরে একবার, সন্ধ্যায় আরেকবার।
লোকমান-সুলেমান দুই ভাইই তাঁর সঙ্গে আছে। তাদের চোখে মুখে কোনো পরিবর্তন নেই। বিশাল একটা জংলা কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা হয়েছে, সেখানে ধান ছড়ানো হচ্ছে। পাখি এসে এই ধান খাচ্ছে। এই বিষয়গুলি তাদেরকে স্পর্শ করছে না। ধান ছড়ালে পাখি খাবে— এর মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নাই। এই দৃশ্য আয়োজন করে দেখারও কিছু নাই।
সুলেমান!
জি চাচাজি?
একটা জিনিস কি লক্ষ করেছ, পাখি যখন ধান খায় সে কোনো শব্দ করে না? ডাকাডাকি নাই, ক্যাচক্যাচানি নাই।
সুলেমান কিছু লক্ষ করে নি, তারপরেও সে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
আমি কিছুক্ষণ একা একা জঙ্গলে হাঁটাহাঁটি করব। তোমরা দুজন বাইরে অপেক্ষা করো।
দুই ভাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। উনাকে একা রেখে তাদের ঘরে যাবার কোনো ইচ্ছা নেই। এই কথাটা বলার সাহসও পাচ্ছে না।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও। কাঁটাতারের বাইরে থাকো। আমি না ডাকলে ভিতরে ঢুকবে না।
তিনি বনের ভেতরে ঢুকে গেলেন। সাপখোপের ব্যাপার এখন থাকবে না। শীতের সময় সাপ গর্তে ঢুকে এক ঘুমে সময় পার করে দেয়। একেক প্রাণীজগতের জন্যে একেক ব্যবস্থা। সব ব্যবস্থার পিছনে সূক্ষ্ম কোনো হিসাব আছে। এই হিসাব সবার বোঝার বিষয় না।
তিনি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাঁটছেন। নজর করে কিছু দেখছেন না। আবার সবকিছুই দেখছেন। জঙ্গলের মাঝখানে বড়-সড় ডোবার দেখা পেলেন। ডোবায় রোদ পড়েছে। ঝিলমিল করছে ডোবার পানি। পানিও পরিষ্কার। তার কাছে মনে হলো, এত পরিষ্কার পানি তিনি অনেকদিন দেখেন নি। ডোবাটাকে আরো বড় করলে কেমন হয়? দিঘি হবে না। বিলের মতো হবে। এই ঝিল বনের ভেতর দিয়ে সাপের মতো একেবেঁকে যাবে।
তার গরম লাগছে। বনের ভ্যাপসা গরম। তিনি গায়ের পাঞ্জাবি খুললেন। হঠাৎ মনে হলো, শুধু পাঞ্জাবি কেন খুলবেন? কেন সম্পূর্ণ নগ্ন হবেন না? আব্রুর জন্যেই তো পোশাক। এখন তাঁর আব্রু ঘন বন। এই বনে দ্বিতীয় কেউ ঢুকবে না। নগ্ন হবার চিন্তাটা বাদ দিলেন। সব চিন্তাকে প্রশ্ৰয় দিতে নাই। শুধুমাত্র মস্তিষ্ক বিকৃত মানুষই সকল চিন্তাকে প্রশ্ৰয় দেয়।
তার মাথার উপর দিয়ে ট্যা ট্যা করে এক ঝাক টিয়া পাখি উড়ে গেল। তিনি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন। এই বনে নিশ্চয়ই প্রচুর টিয়া পাখি বাস করে। তার মনে হলো–বনের নাম টিয়া বন দিলে কেমন হয়? লীলাবতীকে একবার এনে বন দেখাতে হবে। সেটা কি আজই দেখাবেন? নাকি আরো কিছু পরে? লীলা চলে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে। যে-কোনো একদিন সে বলবে— আমি আজ দুপুরের গাড়িতে যাব। তখন তাকে যেতে দিতে হবে। পশুপাখি আটকে রাখা যায়। মানুষ আটকে রাখা যায় না।
শব্দ করে ঝোপ-ঝাড় নাড়িয়ে কোনো একটা জন্তু ছুটে গেল। বনবিড়াল হতে পারে। আবার খরগোশও হতে পারে। বনের পশু যা আছে কাঁটাতারের বেড়ায় আটকা পড়েছে। এটা মন্দ কী! এই বনে কী কী পশু আছে তার একটা হিসাব থাকলে ভালো হতো। তিনি ডোবার পানিতে নামলেন। পানি ঠাণ্ডা হবে ভেবেছিলেন। পানি ঠাণ্ডা না, যথেষ্টই গরম। পানিতে ছপছপ শব্দ তুলে হাঁটতে তার ভালো লাগছে।
লীলাবতী মঞ্জুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লীলাবতীর চোখে কৌতূহল, ঠোঁটের ফাকে চাপা হাসি। মঞ্জুমামার কর্মকাণ্ডে না হেসে উপায় নেই। একদল মানুষ আছে যাদের বয়স বাড়ে না। মঞ্জুমামা সেই দলের।
মঞ্জু অতি আগ্রহে পাথরে ঝিনুক ঘষছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কাজটা করে তিনি খুব মজা পাচ্ছেন।
মামা, কী করছ?
মঞ্জু। চোখ না তুলেই বললেন, ঝিনুকের ছুরি বানাচ্ছি। ঝিনুকের ছুরি হচ্ছে পৃথিবীর সবচে’ ধারালো ছুরি। ব্লেডের চেয়ে ধার।
ধারালো ছুরি দিয়ে কী করা হবে?
ছুরি বানানো শেষ হোক – তারপর দেখবি কী করা হবে।
লীলাবতী পাশে বসতে বসতে বলল, তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল মামা— এখন কি বলা যাবে?
খুবই জরুরি।
তাহলে বলে ফেল।
ঝিনুকের ঘষাঘষি বন্ধ রাখো, তারপর বলি?
তোর যা বলার এই ঘষাঘষি শব্দের মধ্যেই বলতে হবে। আমি কাজ বন্ধ করব না। তোর এমন কোনো জরুরি কথা আমার সঙ্গে নেই যে কাজ বন্ধ করে
শুনতে হবে।
তুমি এইখানেই থেকে যাবে এমন পরিকল্পনা কি নিয়েছ?
না।
বাবা তোমাকে না-কি জমি দিয়েছেন?
হুঁ।
রোজ না-কি তুমি তোমার জমিতে বসে থাকো?
না। আমি আমার নিজের জমির দেখভাল করব এটাই কি স্বাভাবিক না?
মামা, তুমি কি বুঝতে পারছ বাবা চেষ্টা করছেন তোমাকে এখানে আটকে ফেলতে?
আমাকে আটকে ফেলে তার লাভ কী?
লীলাবতী শীতল গলায় বলল, বাবার আসল চেষ্টা আমাকে আটকানো। তোমাকে দিয়ে শুরু।
মঞ্জু কাজ বন্ধ করে লীলাবতীর দিকে তাকালেন। তার কাছে মনে হলো, এখানে এসে মেয়েটা আরো সুন্দর হয়ে গেছে। সৌন্দৰ্যও জায়গা-নির্ভর। যে মেয়েকে মরুভূমিতে সুন্দর লাগে সেই মেয়েকে পানির দেশে সুন্দর লাগবে না।
লীলাবতী বলল, বাবা অতি বুদ্ধিমান মানুষদের একজন। তিনি আমাকে এই অঞ্চলে আটকাবার জন্যে সুন্দর সুন্দর বুদ্ধি বের করছেন। তিনি তাঁর ছেলের বিয়ে দিলেন। তারপর সেই ছেলেকে তালাবদ্ধ করে রাখলেন। যাতে বাড়িতে বড় ধরনের ঝামেলা তৈরি হয়। আমি যেন বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার কথা ভাবতে না পারি।
কোনো বাবা যদি তার মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে চায় তাতে দোষ কী?
তাতে কোনো দোষ নেই, কিন্তু কৌশল খাটানোটা দোষ।
লীলা উঠে দাঁড়াল। মঞ্জু বললেন, আমার জন্যে চা পাঠিয়ে দে।
লীলা বলল, চা পাঠাচ্ছি। মামা তুমি তৈরি থেকে, আমি কিন্তু যেকোনোদিন একঘণ্টার নোটিশে রওনা হব।
মাসুদকে জেলখানা থেকে উদ্ধার করে তারপর তো যাবি?
উদ্ধারের ব্যবস্থা তার স্ত্রী করবে। পরী মেয়েটাও খুব বুদ্ধিমতী।। ও জানে কখন কী করতে হয়। তোমার দুই অ্যাসিসটেন্ট কোথায়? কই আর জই?
ওদের কাজে পাঠিয়েছি। বড় সাইজের ঝিনুক আনতে গেছে।
মামা, তুমি সুখে আছ।
আমি সুখে থাকলে তোর কোনো সমস্যা আছে?
না। সমস্যা নেই।
মঞ্জু বিরক্ত গলায় বললেন, সুখী মানুষ দেখতে তোর যদি খারাপ লাগে যা একজন অসুখী মানুষ দেখে যা। লিচুতলায় চলে যা, কুঁজা মাস্টার মুখ ভোঁতা করে বসে আছে। এখন মনে হয় মাথাও খারাপ হয়ে গেছে — বিড়বিড় করে নিজের সঙ্গে কথা বলে।
আনিস লিচু গাছে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসেছিল। তার আবার জ্বর এসেছে। জুরের লক্ষণ সুবিধার না। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। মনের জোর দিয়ে নাকি অসুখ সারানো যায়— আনিস সেই চেষ্টা করছে। নিজেকে বোঝাচ্ছে— আমার কিছু হয় নি। আমি ভালো আছি। সামান্য গা ম্যাজম্যাজ করছে। এটা কোনো ব্যাপারই না। অসময়ে ঘুমানোর কারণেই এই গা ম্যাজম্যাজানি।
লীলা নিঃশব্দে আনিসের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। মঞ্জু মামার কথা সত্যি, মানুষটা নিজের মনে বিড়বিড় করছে। লীলা স্পষ্ট শুনেছে–লোকটা বলছে— অসময়ের ঘুম। অসময়ের ঘুম।
লীলা বলল, কেমন আছেন?
আনিস চমকে পিছনে ফিরল। তার সঙ্গে দুটি খাতা। সে দ্রুত চান্দরের নিচে খাতা দুটি টেনে নিল। পারলে নিজেও চাঁদরের নিচে ঢুকে যায় এমন অবস্থা। লীলার কাছে মনে হলো, এই মানুষটার কর্মকাণ্ড অস্বাভাবিক। তাকে দেখে সে এত চমকাবে কেন? শুধু মাত্র ভূতপ্ৰেত দেখলেই মানুষ এতটা চমকায়।
লীলা বলল, আমাকে চিনেছেন?
কেন চিনব না! আপনি লীলাবতী।
আপনার কি শরীর খারাপ? চোখ লাল হয়ে আছে। এইজন্যে জানতে চাইলাম।
জ্বর নিয়ে রোদে বসে আছেন কেন? ছায়ায় বসুন। বাঁ-দিকে ছায়া আছে।
আনিস সরে বসল। সঙ্গে সঙ্গেই তার শীত লাগতে লাগল। জ্বর মনে হয় ভালোই এসেছে।
লীলা বলল, গাছতলায় বসে না থেকে বিছানায় শুয়ে থাকুন। আমি ডাক্তার সাহেবকে খবর দেবার ব্যবস্থা করব। ডাক্তার এসে দেখে যাবে।
দরকার নেই।
দরকার নেই কেন?
লীলা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে প্রশ্নের জবাব চাচ্ছে। আনিস কী জবাব দেবে বুঝতে পারছে না। মেয়েটার সঙ্গে যূথির কোনো মিল নেই। যূথি কখনো কোনো প্যাচ খেলানো প্রশ্ন করে না। প্রশ্ন করলেও জবাব শোনার অপেক্ষা করে না। তারপরেও এই মেয়েটাকে দেখলেই যূথির কথা মনে আসে। এই রহস্যের মানে কী!
লীলা বলল, আপনি তো বললেন না— কেন ডাক্তার দেখানোর দরকার নেই।
আনিস বলল, আমি নিজেই নিজের চিকিৎসা করছি। চিকিৎসার ফলাফল দেখতে চাই।
কী রকম চিকিৎসা?
মানসিক চিকিৎসা। অন্য একসময় আপনাকে বুঝিয়ে বলব।
অন্য সময় কেন? এখন বুঝিয়ে বলতে সমস্যা কী?
আনিস হতাশ গলায় বলল, এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না।
লীলা বলল, আপনি আমাকে দেখেই চাঁদরের নিচে কী যেন লুকিয়েছেন। কী লুকিয়েছেন?
আনিস বলল, কিছু না।
লীলা বলল, আমি দেখলাম সবুজ মলাটের দুটা খাতা। খাতায় কী লেখা?
আনিস বলল, আপনাকে এখন বলব না। পরে কোনো একদিন বলব।
লীলা বলল, এখন বলতে সমস্যা কী?
আনিস বলল, এখন আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না।
লীলা চলে যাচ্ছে। আনিসের মনে হলো, মেয়েটা রাগ করে চলে যাচ্ছে। এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না–এ ধরনের কথা বলা ঠিক হয় নি। মেয়েরা এই ধরনের কথায় খুবই আহত হয়। সে একবার যূথিকে বলেছিল— যূথি, এখন আমি লিখছি। তুই পরে আয়। যূথি প্রায় দৌড়ে সামনে থেকে চলে গেল। ঘটনাটা ঘটেছিল। সকাল দশটার দিকে। সে সকাল দশটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত দরজা বন্ধ করে কাদল। কাঁদতে কাঁদতে অসুখ বাঁধিয়ে ফেলল।
আনিস দুপুর নাগাদ প্রবল জুরের ঘোরে চলে গেল। দিনের আলো কড়কড় করে চোখে লাগতে লাগল। নিঃশ্বাসেও কষ্ট। কানের ফুটো দিয়ে ভাপের মতো বের হচ্ছে। আলো চোখে লাগে বলে যতবারই সে চোখ বন্ধ করে ততবারই দেখে যূথিকে। যূথি অনেক অদ্ভুত কর্মকাণ্ড করছে— যেমন একবার দেখা গেল বড় একটা কলাপাতা নিয়ে কলাপাতা ছিড়ছে। কলাপাতার রঙ হয় সবুজ। এই কলাপাতাটা সোনালি রঙের। আরেকবার দেখল, কাসার জগে। সে যেন কী ঘুটছে, শব্দ হচ্ছে সাইকেলের ঘণ্টার মতো ক্রিং ক্রিং ক্রিং। আনিস বলল, কী বানাচ্ছিস? যূথি বলল, শরবত বানাচ্ছি। বেলের শরবত। খাবে? তারপর সে দেখল, যূথি শরবত বানানো বন্ধ করে কঠিন গলায় কথা বলছে। কাকে যেন আদেশ দিচ্ছে–মাথায় পানি ঢালতে শুরু করো। ডাক্তার না। আসা পর্যন্ত পানি ঢালতে থাকবে। আনিসের তখন মনে হলো–কঠিন গলায় যে কথা বলছে তার নাম যূথি না। তার নাম লীলাবতী।
মাথায় পানি ঢালা পর্ব শুরু হয়েছে। বদু পানি ঢালছে। বরফের মতো ঠাণ্ডা পানি। এরা কি বরফকল থেকে বরফ নিয়ে এসে পানির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে? পানি গন্ধহীন হবার কথা। এই পানির গন্ধ আছে। মাছ মাছ গন্ধ।
লীলাবতী বলল, আপনার কি খুব বেশি খারাপ লাগছে?
আনিস বলল, হঁ।
ডাক্তার আনতে লোক গেছে। ডাক্তার চলে আসবে। আপনি এক-দুই দিন পরে পরেই বিরাট অসুখ বাধাচ্ছেন। আপনার ভালো চিকিৎসা হওয়া উচিত।
আনিস বিড়বিড় করে বলল, আচ্ছা চিকিৎসা করাব। আপনি এখন চলে চলে যেতে বলছেন কেন?
আনিস জবাব দিল না। তবে সে মনে-প্ৰাণে চাচ্ছে মেয়েটা চলে যাকপানির আঁশটে গন্ধ পেটের ভেতর পাক দিচ্ছে। এক্ষুনি বমি হবে। এই মেয়েটার সামনে বমি করতে মন চাচ্ছে না। আনিস বলল, আপনি চলে যান। আপনি চলে যান। আপনি চলে যান। সে বলেছে মাত্র একবার কিন্তু আপনি চলে যান’ বাক্যটা মাথার ভেতর বেজেই চলছে। ঐ তো মেয়েটা চলে যাচ্ছে, এখন আর তাকে আপনি চলে যান বলার দরকার নেই। তারপরও সে বলে যাচ্ছে। আশ্চর্য তো!
লীলা শহরবাড়ি ছেড়ে মূল বাড়ির দিকে এগুচ্ছে। তবে সে মনস্থির করতে পারছে না— সে মূল বাড়িতে যাবে না-কি কিছুক্ষণ পুকুরঘাটে বসে থাকবে! পানির কাছাকাছি থাকলে মন শান্ত হয়। কে জানে, কেন হয়!
পরীবানু দিঘির জলে পা ড়ুবিয়ে একা একা বসে আছে। লীলাকে দেখতে পেয়েই সে হাত ইশারা করে ডাকল। আনন্দিত গলায় বলল, বুবু, একটা মজার জিনিস দেখে যাও। পরীবানুর এমন আনন্দিত গলা লীলা আগে শোনে নি। সে বিস্মিত হয়ে বলল, কী?
আমার মতো করে বসো বুবু, পানিতে পা ড়ুবাও, তারপর দেখবে।
কী দেখাব?
আগে বলব না। আগে বললে মজা চলে যাবে।
লীলা পা ড়ুবিয়ে বসল। আসলেই তো মজা। কড়ে আঙুলের মতো সাইজের মাছ এসে পায়ে ঠোকর দিচ্ছে। একটা দুটা মাছ না— অনেক মাছ।
লীলা বলল, এই মাছগুলোর নাম কী?
দাড়কিনি মাছ। এই পুষকুনিতে অনেক বড় বড় মাছ আছে। বুবু, তুমি কোনোদিন বর্শি দিয়ে মাছ ধরেছ?
না।
আসো না। আমরা একদিন বর্শি ফেলে মাছ ধরি। ধরবে?
লীলা বলল, তুমি কি পুকুরপাড়ে প্রায়ই আসো?
পরী বলল, হঁ।
কাঁদার জন্যে আসো?
পরী কিছু বলল না।
তোমার সারা মুখে কাজল লেপ্টে গেছে। পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলো।
পরী আজলা ভর্তি পানি মুখে ছিটাচ্ছে। লীলা সহজ গলায় বলল, ঘাটে বসে কাঁদার মতো কিছু হয় নাই। বাবার রাগ পড়ে যাবে। তুমি মাসুদের সঙ্গে সুখে দিন কাটাবে। কয়েকটা দিন কষ্ট করে পার করো।
উনার রাগ পড়বে না। উনি অন্যদের মতো না।
লীলা বলল, তোমার ধারণা বাবা সারাজীবন মাসুদকে আটকে রাখবে?
পরী কিছু বলল না। তার মুখের কাজল ধুয়ে গেছে, তারপরও সে মুখে পানি ছিটিয়ে যাচ্ছে।
লীলা বলল, মাসুদের সঙ্গে তোমার কথা হয় না?
পরী বলল, না। উনি আমাকে কথা বলতে নিষেধ করেছেন। আমি উনার নিষেধ মানছি।
মাসুদকে আটকে রাখা হয়েছে মূল বাড়ির শেষপ্রান্তে। ঘরের সামনে বদু বসে থাকে। তার দায়িত্ব বদুর উপর লক্ষ রাখা। রাতে বদু ঘরের সামনের বারান্দায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমায়।
দিন-রাতের বেশির ভাগ সময় মাসুদ বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে। ঘরের ভেতর গুমোট গরম। এই গরমে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা কষ্টের ব্যাপার। মাসুদকে দেখে মনে হয় না সে কষ্টে আছে। যতক্ষণ সে ঘুমায় না। ততক্ষণ খাটে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে। বদু তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে গল্প করতে আসে। বদু নিজের মনে কথা বলে যায়। এই বাড়ির কোথায় কী ঘটছে তা শোনায়। দায়িত্ব নিয়েই শোনায়। একজন মানুষ আটকা পড়ে আছে, কোথায় কী হচ্ছে কিছুই জানে না। তাকে জানানো প্রয়োজন।
ভাইজান শুনেন–আপনের পিতা কী করে শুনেন। জঙ্গলে বইসা থাকে। একলা যায়। কাউরে সাথে নেয় না। এইটা আচানক ঘটনা না? আপনে বলেন। আপনের নিজেরও তো একটা বিবেচনা আছে। আপনের বিবেচনা কী বলে— ঘটনা। কী? জিন সাধনার বিষয় আছে। যারা জিন সাধনা করে তারার একা কিছু সময় থাকতে হয়। এই সময় তারা জিনের সাথে কথা কয়।
আবার স্মরণ কইরা দেখেন আপনের পিতারে কি আপনে কোনোদিন পুযকুনিতে সিনান করতে দেখছেন? দেখেন নাই। ঘটনা কী বলেন দেখি। বিবেচনা কইরা বলেন। যারা জিন সাধনা করে তারা কি পুষকুনিতে সিনান করতে পারে? পারে না। নিয়ম নাই। তারারে সবসময় তোলা পানিতে সিনান করতে হয়।
এখন আপনারে বলি আরেক বিবেচনার কথা, যে বাড়িতে জিন সাধনা হয় সেই বাড়িতে সবসময় অসুখ-বিসুখ লাইগ্যা থাকবে। কুঁজা মাস্টারের কথাটা বিবেচনায় আনেন। তার কপালে অসুখ আছে কি-না এইটা বলেন। এখন তার জুরি। এমন জুরি যার মা-বাপ নাই। জ্বর কী জন্যে হয় জানেন? জিনের বাতাস লাগিলে হয়। জিনের শইল্যের বাতাস খুব ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডা বাতাস শইল্যে লাগলেই হয়। জুর। ঘটনা কেমন আশ্চর্য চিন্তা করেন। একটা জিনিস আগুনের তৈয়ারি কিন্তুক তার বাতাস ঠাণ্ডা। আর আমরা মানুষ আমরারে পয়দা করা হইছে মাটি দিয়া। কিন্তুক আমরার শইল্যের বাতাস গরম। আশ্চর্য কি-না বলেন!
জিনের দোজখ যে পানি দিয়া তৈয়ারি এইটা কি জানেন ভাইজান? আগুনের দোজখে এরার কিছু হবে না। নিজেরাই তো আগুনে তৈয়ার। এই জন্যে আল্লাহপাক তারার জন্য বানায়েছেন পানির দোজখ। সেই দোজখে হাঁটু পানি। চব্বিশ ঘণ্টা বৃষ্টি হয়। বৃষ্টির পানি বরফের মতো ঠাণ্ডা।
জিনের খাওয়া খাদ্য কী জানেন ভাইজান? প্রধান খাদ্য ছানার মিষ্টি। ভূতপ্রেতের প্রধান খাদ্য মাছ ভাজা। সব মাছ না— শউল মাছ। শউল মাছের পরেই বোয়াল মাছ।
বদু কথা বলেই যায়, মাসুদ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সে গল্প শুনছে। এরকম মনে হয় না, আবার শুনছে না। এরকমও মনে হয় না। মাঝে মাঝে সে হঠাৎ করেই বন্দুকে থামিয়ে দিয়ে চাপা গলায় বলে— বদু একটা কাজ করেন। পরী কোথায় আছে একটু দেখে আসেন।
এখন যাব?
হ্যাঁ, এখন যান।
কিছু বলা লাগবে?
কিছু বলা লাগবে না, শুধু দেখে আসেন।
বদু গল্প বলায় সাময়িক বিরতি দিয়ে খোঁজ নিতে যায়। আবার ফিরে এসে গল্প শুরু করে। জিন-ভূত-প্ৰেত বিষয়ক গল্প। জুম্মাঘরের কাছে তেঁতুল গাছে যে পেত্নী থাকে তার গল্প বদু খুব আগ্রহের সঙ্গে করে। কারণ এই পেত্নীটাকে বদু নিজেও কয়েকবার দেখেছে। পেত্নীর নাম কলন্দির বিবি। সে অনেক দিন থেকেই না-কি তেঁতুল গাছে বাস করছে।
ভাইজান শুনেন, তেঁতুল গাছটা নজর কইরা কোনোদিন দেখছেন? তেঁতুল গাছে তেঁতুল হবে এইটাই জগতের নিয়ম। এই গাছে ফুল আসে। কিন্তু তেঁতুল হয় না। ঘটনা বুঝতেছেন তো? কোনো পাখি দেখছেন এই গাছে বসেছে? দেখেন নাই। কারণ একটাই কলিন্দর বিবি। তিনবার তার সাথে আমার দেখা হয়েছে। একবার তো মরতেই বসছিলাম। সেই গল্পটা শুনেন।