১৪. নদ্দিউ নতিম সাহেবের গল্পের বই

হ্যালো মতিন,

তোর পাঠানো নদ্দিউ নতিম সাহেবের গল্পের বইটির শেষ গল্পটা দ্বিতীয় রাত্রি কিছুক্ষণ আগে শেষ করলাম। উজবেক এই মরমী কবির (!) গল্পের হাত তো খুব ভালো। এই ব্যাটার কবিতার চেয়ে গদ্য ভালো লাগে। গদ্যের সারল্য এমন যে অন্যের লেখা পড়ছি তা মনেই হয় না। যেন এই লেখাটা আমার নিজের। দ্বিতীয় রাত্রি গল্পটা পড়ে এত আনন্দ পেয়েছি! বুকের ভেতরে একধরনের হাহাকার বোধ করেছি। আমার নিজের মধ্যে কোনো হাহাকার আছে তা আগে বুঝতে পারি নি। তবে গল্পের শেষ লাইনটা আমি বুঝতে পারি নি। তুই লিখেছিস (সরি নদ্দিউ নতিম সাহেব লিখেছেন) তখন পশ্চিম আকাশে সূর্য উদিত হইল। পশ্চিম আকাশে সূর্য উদয় মানে কী? সূর্য কি পশ্চিম আকাশে উঠে? শেষ বাক্যটা সাধুভাষায় কেন লেখা তাও বুঝলাম না। অবশ্য পাঠককে যে সবকিছুই বুঝতে হবে তাও না। লেখক নিজে বুঝে লিখেছেন কি-না সেটাই বিবেচ্য।

মতিন, নদ্দিউ নদ্দিউ খেলা তো অনেকদিন হলো, এখন স্বনামে আত্মপ্রকাশ কর। সূর্য পশ্চিমে না, পূর্ব দিকেই ঠিকঠাক মতো উঠুক। প্রতিভা নামক ঐশ্বরিক জিনিসটা তোর আছে। প্রতিভাকে লালন করতে হয়। প্রতিভাকে অবহেলা করলে যিনি এই বস্তুটা দিয়ে পাঠিয়েছেন তাঁকে অবহেলা করা হয়। আমার লেখায় আস্তিক আস্তিক গন্ধ পাচ্ছিস না? আমি মনে হয় নাস্তিকের খোলস ছেড়ে বের হয়ে পড়েছি। যে দিকে তাকাই, যা দেখি তার মধ্যেই মহৎ পরিকল্পনা দেখি। যেন কেউ একজন অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সব ঘটিয়ে যাচ্ছেন। এই বিষয়ে সাক্ষাতে তোর সঙ্গে কথা বল।

তোর গল্পগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে আজহার উল্লাহ খান নামের একজনকে পাওয়া গেল। উৎসর্গপত্র পড়ে জানলাম তার হৃদয় স্বর্ণখণ্ডের। তোর জীবনে এই চরিত্র কখন উদিত হয়েছে? সে কে? কী করে? কেনই বা তোর ধারণা হলো মানুষটার হৃদয় স্বর্ণখণ্ডের? আমাকে জানাবি। সবচে ভালো হয় মানুষটাকে যদি আমার কাছে পাঠিয়ে দিতে পারিস। হৃদয় স্বর্ণখণ্ডের এমন মানুষের সঙ্গে অনেকদিন কথা হয় না। জঙ্গলে থেকে পুরোপুরি জংলি হয়ে যাচ্ছি।

একটা হাতির বাচ্চার কথা লিখেছিলাম না? হাতির বাচ্চা পুরোপুরি সুস্থ হয়েছে। এক রাতে তার মা তাকে নিয়ে গেছে। খুবই মন খারাপ হয়েছিল। হাতির বাচ্চার মতো সুন্দর কোনো প্রাণী আছে বলে মনে হয় না। মানুষের বাচ্চার মতো হাতির বাচ্চাও জানে কী করে আদর আদায় করতে হয়। আমি তার নাম দিয়েছিলাম বাবাজি।

বাবাজি কী করত জানিস? ধর আমি উঠানে বসে কোনো একটা কাজ করছি, সে আমার পেছনে এসে নিঃশব্দে দাঁড়াত। (হাতি বেড়ালের চেয়েও নিঃশব্দে চলাফেরা করতে পারে। বিশাল একটা প্রাণী, তার চলাফেরা নিঃশব্দে। অদ্ভুত না?) তারপর বাবাজি কী করত শোন। আমাকে চমকে দিয়ে সে তার শুড়টা রাখত আমার কাঁধে। আমাকে চমকে দেয়াটাই তার খেলা।

বাবাজি চলে যাবার পর আমার জীবন হঠাৎ করে শূন্য হয়ে গেল। একদিন বাবাজির কথা ভাবতে ভাবতে চোখে পানি এসে গেল। চিন্তা করে দেখ, আমার মতো মানুষের চোখে পানি। কুমিরের চোখে পানির ব্যাখ্যা থাকতে পারে। আমার মতো প্রস্তর মানুষের চোখে পানি!

এখন বলি সবচে মজার ঘটনা। গত পূর্ণিমার রাতে বাবাজিকে তার মা আমার এখানে রেখে গেছে। আমাকে দেখে বাবাজির সে-কী লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি।

আবারো আমার চোখে পানি এসে গেল। দীর্ঘদিন পর হারানো সন্তান ফিরে এলে বাবা যা করেন আমি তাই করলাম। ছুটে গিয়ে বাবাজিকে জড়িয়ে ধরলাম। পুরোপুরি হিন্দি ছবির মিলন দৃশ্য। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকসহ। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দিচ্ছিল বাবাজির মা। সে দূর থেকে ঘোৎ ঘোঁৎ ধরনের শব্দ করছিল। শূকর ঘোৎ ঘোৎ করে জানতাম, হাতিও যে করে জানতাম না।

বাবাজি এখন আসা-যাওয়ার মধ্যে আছে। কিছুদিন পর পর তার মা তাকে আমার এখানে দিয়ে যায় আবার নিয়ে যায়। আমার এখানে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ বাবাজির চেষ্টা আমাকে বিরক্ত করার। সে আমার শোবার ঘরে ঢুকে পড়ে। শুড় দিয়ে টান দিয়ে বিছানা-বালিশ নামিয়ে তছনছ করে। আমি যাতে বিরক্ত হবো সে তাই করবে। বিরাট যন্ত্রণায় আছি।

বাবাজি শুধু যে আমাকে যন্ত্রণা করে তা-না, মাসি পিসিকেও খুব যন্ত্রণা করে। তাদেরকে তাড়া করে। তারাও কম যায় না। প্রায়ই দেখি দাত-মুখ খিচিয়ে বাবাজির দিকে। আসছে। তাদের বৈরীতার ভেতরও মনে হয় একধরনের সখ্য আছে। কবে একদিন দেখলাম, বাবাজির পিঠে মাসি পিসি বসে আছে। বাবাজি ওদের পিঠে নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই হেলেদুলে হাঁটছে। বাঘ এবং হরিণের সঙ্গে বানরের সখ্যের কথা শুনেছি। হাতির বিষয়ে শুনি নি।

নিজের আনন্দের কথা লিখেই চিঠি ভরে ফেললাম–ততার বিষয়ে কিছুই জানতে চাইলাম না। সরি এবাউট দ্যাট। তুই লিখেছিস তৌ-এর সঙ্গে শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হয় নি। বিয়ে হবে না জানতাম। তারপরেও কষ্ট লেগেছে। তৌ মেয়েটার জন্যে কষ্ট। বিয়ে ভাঙার ঘটনায় মেয়েরা খুব কষ্ট পায়। এই বিষয়টা আমি জানি। আমার বড় বোনের বিয়ে এভাবেই ভেঙেছিল। গায়েহলুদের পর বিয়ে ভাঙল। বড় আপার মাথা খারাপের মতো হয়ে গিয়েছিল। তাঁকে মানসিক ডাক্তার দেখাতে হয়েছিল। এই ঘটনার পর অনেক ভালো ভালো পাত্র বাবা এনেছিলেন, বড় আপা বিয়ে করতে রাজি হন নি। তিনি বেঁচেছিলেনও অল্পদিন। আমার কেন জানি মনে হয়, বড় আপার সঙ্গে তৌ মেয়েটার চেহারারও মিল আছে। দেখলে বলতে পারতাম। সেই সুযোগ তো নেই।

মতিন শোন, তৌ মেয়েটার বিয়ে তুই ভেঙেছিস, কাজেই তোর দায়িত্ব মেয়েটার যেন ভালো বিয়ে হয় সেটা দেখা। আমি চাই না আমার বড় আপার ভাগ্যে যা ঘটেছে তৌ-এর ভাগ্যে তাই ঘটে।

আজ এই পর্যন্ত।

ইতি–
কঠিন গাধা

পুনশ্চ-১: তোকে বই পাঠাতে বলেছিলাম, বই এখনো পাই নি। সূর্যমুখী ফুলের বিচি পাঠাবি। অনেক বিচি। আমি ঠিক করেছি, একটা গোটা পাহাড়ে সূর্যমুখীর চাষ করব।

পুনশ্চ-২; আসল কথাটাই তোকে লেখা হয় নি। Autobiography of a Fictitious Poet শেষ হয়েছে। কপি নাসির ভাইয়ের কাছে। পাঠিয়ে দিয়েছি।

নাসির ভাইকে মনে আছে না? আমার চাচাতো ভাই। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের শিক্ষক। উনার মতামত জানার জন্যে পাঠিয়েছি। দেখি উনি কী বলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *