১৪. ধর্ম কি আমাদের অসুখ সারাতে পারে?
(এই প্রবন্ধটির দুটি অংশ স্টকহোমের সংবাদ পত্রিকা Dagens Nyheter-এ প্রকাশিত হয় ৯ই নভেম্বর ও ১১ই নভেম্বর ১৯৫৪ সালে।)
মনুষ্যজাতি আজ ভয়ঙ্কর বিপদ ও ভীতির সম্মুখীন। ভীতি মানুষকে আজ ঈশ্বরের আশ্রয় খোঁজার প্রবণতাসম্পন্ন করে তুলেছে। সমগ্র পশ্চিমে ধর্মের সাধারণ পুনরভ্যুত্থান ঘটে গেছে। নাৎসি ও কমুনিষ্টরা খ্রীষ্টান ধর্মকে পরিত্যাগ করেছে এবং আমাদের অনুশোচনাকর সব কাজগুলোই তারা করেছে। এই সিদ্ধান্তটি নেওয়া খুব সহজ হবে যে হিটলার এবং সোভিয়েত সরকারের দ্বারা খ্রীষ্টানধর্মকে অস্বীকার আমাদের অসুখের কারণের জন্য অন্তত আংশিকভাবেও দায়ী, কেননা যদি জগৎ খ্রীষ্টীয়ধর্মে আবার ফিরে আসত তবে আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান হত। আমার বিশ্বাস যে সন্ত্রাস থেকেই এই ধরণের সম্পূর্ণ ভ্রমের জন্ম হয়ে থাকে এবং আমি মনে করি যে এটা একটা বিপজ্জনক ভ্ৰম কারণ এটা সেইসব মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে যাদের চিন্তাভাবনা হয় ফলপ্রসূ হতে পারত অথবা ন্যায্য সমাধানের পথে পরিচালিত হত।
এর সঙ্গে জড়িত প্রশ্নটি কেবলমাত্র বর্তমান জগতের অবস্থার সঙ্গেই সম্পর্কিত নয়। এটা খুবই সাধারণ প্রশ্ন এবং তাকে নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহু বিতর্কই ঘটে গেছে। প্রশ্নটি হল এই যে গোঁড়া ধর্মের সাহায্য না পেলে সমাজগুলো সামান্য নৈতিকতাকেও যথার্থভাবে পালন করতে পারত না। আমি নিজেই মনে করি না যে ধর্মের উপর নীতিগুলোর নির্ভর ততটাই। যতটা ধার্মিক মানুষেরা তাদেরকে মনে করে। এমন কি আমি এও মনে করি যে যারা ধর্মীয় গোঁড়ামীকে অস্বীকার করে তারা বরঞ্চ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক উৎকর্ষতাকে পালন করে থাকে তাদের চেয়ে বেশি যারা ধর্মের গোঁড়ামীকে গ্রহণ করে থাকে। বিশেষ করে সত্যের ধর্ম এবং বিদ্যাবুদ্ধিগত অখণ্ডতার ক্ষেত্রে এই সত্যকে মেনে নিতে হবে বলে আমি মনে করি। বিদ্যাবুদ্ধিগত অখণ্ডতা বলতে আমি বোঝাতে চাইছি প্রমাণ সাপেক্ষে কষ্টকর প্রশ্নসমূহ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবার অভ্যাসকে অথবা সেইসব প্রশ্নসমূহকে সিদ্ধান্তহীন ভাবে পরিত্যাগ করার অত্যধিক অভ্যাসকে যেখানে প্রমাণ অমীমাংসিত। যদিও এই ধরনের নৈতিক উৎকর্ষতা গোড়া ধর্মব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত মানুষের দ্বারা অবহেলিত, কিন্তু আমার মতে এই ধরণের ধর্মের বিরাট সামাজিক গুরুত্ব আছে এবং খ্রীষ্টধর্ম বা যে-কোন সংগঠিত বিশ্বাসের ব্যবস্থার চেয়ে এই ধর্ম জগতের কাছে লাভজনক।
আসুন আমরা কিছুক্ষণের জন্য বিবেচনা করে দেখি কি নৈতিক নিয়মগুলি গৃহীত হয়েছে। নৈতিক নিয়মগুলি বিশদভাবে দু’প্রকার, ধর্মীয় শাস্ত্রে যে নৈতিক নিয়মগুলি দেখা যায় সেগুলির শাস্ত্রীয় ভিত্তি ছাড়া আর কোন ভিত্তি নেই এবং এমন কিছু নৈতিক নিয়ম আছে যা স্পষ্টতই সামাজিক উপযোগিতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। গ্রীসের গোঁড়া (orthodox) গীর্জার নিয়ম অনুযায়ী একই বাচ্চার দু’জন ধর্মপিতামাতা (Godparents) অবশ্যই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবে না। স্পষ্টতই এই নৈতিক নিয়মের শাস্ত্রীয় ভিত্তি ছাড়া আর কিছুই নেই এবং যদি আপনি মনে করেন যে নিয়মটি গুরুত্বপূর্ণ তা হলে একথা বলে আপনি ঠিক করবেন যে ধর্মের ক্ষয় ব্যাপারটিকে পরিহার করে চলতে হবে কারণ তা না হলে তা লজ্জিত নৈতিক নিয়মের দিকে পরিচালিত হবে। কিন্তু এই নৈতিক নিয়মগুলি এমন কোন নিয়ম নয় যাকে ঘিরে প্রশ্ন উখিত হবে। যে-সমস্ত নৈতিক নিয়মগুলি প্রশ্নের সম্মুখীন, বুঝতে হবে সেগুলির শাস্ত্রীয় নিয়মের বাইরে সামাজিক গুরুত্ব আছে।
উদাহরণস্বরূপ, আমরা চৌর্যবৃত্তিকে নিতে পারি। যে সম্প্রদায়ে প্রত্যেকেই চুরি করে সেখানে তা প্রত্যেকের পক্ষে অসুবিধাজনক, কিন্তু যেখানে চৌর্যবৃত্তি নেই বললেই চলে সেখানে মানুষ তাদের ইচ্ছামত জীবন চালাতে পারে। কিন্তু আইন, নৈতিক নিয়ম ও ধর্মের অনুপস্থিতিতে মুশকিল হতে পারে। প্রতিটি ব্যক্তির কাছে একটি আদর্শ সম্প্রদায় সেই জায়গা যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি সৎ এবং সে একমাত্র চোর, এর ফলে বলা যায় যে ব্যক্তির উৎসাহকে সেই সম্প্রদায়ের সঙ্গে পুনর্মিলিত করতে গেলে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান একান্ত জরুরী হয়ে পড়ে এবং এই অপরাধমূলক আইন ও পুলিশ এই বিষয়ে সকল ভাবে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু অপরাধীরা সর্বদাই ধরা পড়ে না, এবং পুলিশ শক্তিমানের পক্ষে অনৈতিকভাবে প্রবণতাসম্পন্নও হয়ে উঠতে পারে। যদি মানুষ এই বিষয়ে প্ররোচিত হতে পারে যে এখানে ঈশ্বর আছেন যিনি পুলিশ ব্যর্থ হলেও চৌর্যবৃত্তিকে শাস্তি দেবেন, তবে মনে করা যায় যে এই বিশ্বাস সতোকে বৃদ্ধি করবে। যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখে তারা আগেভাগেই বিশ্বাস করে নেবে যে ঈশ্বর চৌর্যবৃত্তিকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। এই বিষয়ে ধর্মের উপযোগিতা সম্পর্কে নাবোথার আঙুর বাগানের গল্পে চিত্রিত আছে যে সেখানে রাজাই চোর যিনি যে-কোন পার্থিব বিচারের উর্ধ্বে।
আমি অস্বীকার করব না যে অতীতের অর্ধ-সভ্য সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে এই ধরণের বিচার সামাজিকভাবে আকাক্ষিত আচরণকে বর্ধিত করত। কিন্তু বর্তমান দিনে নৈতিক নিয়মগুলোর উপর ধর্মতত্ত্বের উৎসকে (Theological origin) আরোপ করে এই ধরণের মঙ্গল করা যেতে পারে যা এমন গভীর অমঙ্গলের সঙ্গে জড়িত যার থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়। এর ফলে মঙ্গল বিষয়টি তুলনামূলকভাবে তুচ্ছ হয়ে পড়ে। সভ্যতা যত এগিয়েছে, পাথির্ব অনুমোদন বা সমর্থন ততই নিশ্চিত হয়েছে এবং সেই সঙ্গে স্বর্গীয় সমর্থন অনিশ্চিত হয়েছে। মানুষ চিন্তা করবার মতো অনেক যুক্তি খুঁজে পেল, যেমন– যদি তারা চুরি করে তাহলে তাদের ধরা হবে এবং এই ধারণা ক্রমশ কমে যেতে থাকল যে যদি তারা ধরা না-ও পড়ে তবুও ঈশ্বর তাদের শাস্তি দেবেন। এমনকি বর্তমানে উচ্চ ধার্মিক মানুষেরাও আশা করতে পারে না যে চুরি করার জন্য তাদের নরকে যেতে হবে। তারা মনে করে ঠিক সময় মতো অনুতপ্ত হলেই হল এবং যে-কোন ঘটনাতেই নরক আর আগের মতো নিশ্চিত বা খুব ভয়ঙ্কর নেই। কোন সভ্যসমাজে বেশিরভাগ মানুষই চুরি করে না। আমি মনে করি সাধারণ উদ্দেশ্য পৃথিবীতে শাস্তির মতো একই বস্তু। এই ঘটনার প্রমাণ মেলে খনি থেকে সোনা-উত্তোলনকারীদের শিবিরে ও যে-কোন বিশৃঙ্খল সমাজে যেখানে প্রায় প্রত্যেকেই চুরি করে।
কিন্তু আপনি একথা বলতে পারেন, যদিও চুরি করার বিষয়ে শাস্ত্রীয়নিষিদ্ধ করণ বেশি দিন প্রয়োজনীয় হয়ে থাকেনি, তবুও তা কোনভাবে আমাদের ক্ষতি করেনি যেহেতু আমরা সবাই চাই মানুষ যাতে চুরি না করে। যদিও সমস্যাটা দাঁড়ালো এই যে, শাস্ত্রীয়বিধি গ্রহণের বিষয়ে মানুষ যখন সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়ে, তখন তার সেই সন্দেহ প্রবণতা ক্ষতিকর ও অপ্রীতিকর পথে সমর্থিত হয়। যদি নৈতিক উৎকর্ষতার জন্য ধর্মতত্ত্ব প্রয়োজনীয় বলে মনে হয় এবং যদি নাছোড়বান্দা অনুসন্ধানকারীরা ধর্মতত্ত্বকে সত্য বলে ভাবার কোন যুক্তি না দেখে, তবে দেখা যায় যে কর্তৃপক্ষ নাছোড়বান্দা অনুসন্ধানকারীদের ভগ্নোৎসাহ করবার জন্য কোমর বেঁধে নেমে পড়েন। পূর্বের শতকগুলোতে তারা যে-কোনভাবে এই সব নাছোড়বান্দা অনুসন্ধানকারীদের পুড়িয়ে মেরে তাদের ক্ষান্ত করত। রাশিয়াতে তারা যে পদ্ধতিসমূহ ব্যবহার করে তা কিছুটা উন্নত, কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোতে কর্তৃপক্ষ জনগণকে মৃদুভাবে প্ররোচিত করবার পদ্ধতিটিকে যথার্থ করে তুলেছে। এদের মধ্যে বোধহয় বিদ্যালয়গুলির ভূমিকা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে কর্তৃপক্ষ যা অপছন্দ করে সে বিষয়ে কোন রকম যুক্তিতর্ক শোনার থেকে যুবকদের সরিয়ে রাখা হয়, তবুও যারা অনুসন্ধানকারী মনোভাব দেখাতে আগ্রহী হয়ে পড়ে তারা সামাজিক বিপদের সম্মুখীন হয় এবং যদি সম্ভব হয় তাদের ভাবতে বাধ্য করা হয় যে তারা নৈতিকভাবে দূষণীয় হয়ে পড়েছে। এইভাবে নৈতিক নিয়মসমূহের যে-কোন ব্যবস্থা যা ধর্মতত্ত্বের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে তা এমন সব যন্ত্র যার দ্বারা ক্ষমতার ধার করা তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখে এবং যুবকদের বিদ্যাবুদ্ধিগত উৎসাহকে ধ্বংস করে।
বর্তমানে বহু মানুষের মধ্যে আমি সভ্যতা সম্পর্কে উদাসীনতা দেখি যাকে আমি ভয়ঙ্কর ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না। উদাহরণস্বরূপ, খ্রীষ্টীয়ধর্মের পক্ষ নিয়ে যখন মানুষ তর্ক করে তখন তারা থমাস অ্যাকুইনাসের মতো এই যুক্তি তোলে না যে ঈশ্বর আছেন এবং তিনি বাইবেলে তার ইচ্ছাকে প্রকাশ করেছেন। এর পরিবর্তে তারা এই বিষয়ে তর্ক করে যে যদি মানুষ এই ধরণের চিন্তা করে তবে সে যতটা ভালো কাজ করতে পারবে, সে যদি না ভাবে তবে ততটা পারবে না। এই কারণে ঈশ্বর বিদ্যমান কিনা সেই বিষয়ে চিন্তাভাবনা করবার অনুমতি আমাদের নিজেদেরকে দেওয়া উচিত নয়– সাধারণ মানুষ তর্ক করে এইরকম সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছায়। যদি কোন অসতর্ক মুহূর্তে সন্দেহ মাথা তোলে তাহলে আমরা তাকে জোর করে দমন করব। যদি নাছোড়বান্দা চিন্তাভাবনা সন্দেহের কারণ ঘটায় তবে সেই নাছোড়বান্দা চিন্তাভাবনাকে আমরা অবশ্যই চিবিয়ে ফেলবো। যদি গোঁড়া ধর্মের সরকারী ব্যাখ্যাকাররা আপনাকে বলে যে মৃত স্ত্রীর ভগ্নীকে বিবাহ করা মন্দ কাজ তবে আপনি পাছে নৈতিক ভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন তাই তাদের অবশ্যই বিশ্বাস করবেন। যদি তারা আপনাকে বলে যে জন্মনিয়ন্ত্রণ একটি পাপ তাহলে আপনি তাদের মতামত গ্রহণ করবেন, যদিও স্পষ্টভাবে আপনি জানেন জন্মনিয়ন্ত্রণ ছাড়া বিপর্যয় নিশ্চিত। যদি কোন বিশ্বাস, সে যাই হক না কেন, সত্যের চেয়ে অন্য কোন কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তাহলে সমস্ত ধরণের অশুভ বা অমঙ্গলজনক বিষয়গুলি লাফিয়ে উপরে উঠে আসবার জন্য প্রস্তুত থাকে। অনুসন্ধান সম্পর্কে অনুৎসাহ, যার সম্পর্কে আগেই আমি বলেছি, তা উঠে আসা অমঙ্গলজনক বিষয়গুলির মধ্যে প্রথম, কিন্তু বাদবাকি অন্য বিষয়গুলি ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গোঁড়া ধর্মাবলম্বীদের কাছে কর্তৃত্বের স্থানটি ভোলা থোকবে। ঐতিহাসিক নথি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে যদি তারা গৃহীত মতামতসমূহ সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করে। আগে বা পরে উদারতাকে একটি অপরাধ বলে মনে করে নিয়ে তাকে কোন খুঁটিতে বেঁধে রাখা হবে, কিংবা তাকে বাজে বস্তু বলে পরিত্যাগ করা হবে অথবা বন্দী শিবিরে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। আমি সেই মানুষটিকে শ্রদ্ধা করি যে যুক্তি দেয় যে ধর্ম সত্য এবং এইজন্যই তাকে বিশ্বাস করা উচিত, কিন্তু আমি তাদের জন্য প্রগাঢ় নৈতিক দোষ অনুভব করি যারা বলে থাকেন যে ধর্মকে অবশ্যই বিশ্বাস করা উচিত কারণ ধর্ম কার্যকরী এবং ধর্ম সত্য কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন করে যারা সময় কাটান তাদের সম্পর্কেও আমি ওই একই দোষ অনুভব করি।
খ্রীষ্টীয় আত্মপক্ষ সমর্থনকারীদের (Christian apologist) মধ্যে সাম্যবাদকে খ্রীষ্টধর্মের থেকে খুব স্বতন্ত্র বলে মনে করাটা একটা প্রচলিত ব্যাপার এবং খ্রীষ্টীয় ধর্মাবলম্বী জাতিগুলি সাম্যবাদের অমঙ্গলজনক দিকগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখিয়ে তার তুলনায় তারা কত সুন্দর আছে, আনন্দে আছে তা দেখাতে সর্বদা ব্যস্ত। আমার কাছে একটা বিরাট ভুল। সাম্যবাদের অমঙ্গলজনক দিকগুলো বিশ্বাসের যুগগুলিতে (Ages of Faith) খ্রীষ্টধর্মের যে অমঙ্গলজনক দিকগুলো ছিল তারই মতো। অগপু (The Ogpu) প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধমত দমনের জন্য স্থাপিত বিচারালয়ের বিপক্ষে গিয়েছিল কেবলমাত্র আকারগত দিক থেকে। নিষ্ঠুরতাও ওই একই রকম। এই ধরণের বিচারালয় যেখানেই সুযোগ পেয়েছে সেখানেই ধ্বংস করেছে। যেমন–সে বর্তমানে রুশিয়দের বিদ্যাবুদ্ধিগত ও নৈতিক জীবনকে ধ্বংস করে। সাম্যবাদীরা ইতিহাসকে মিথ্যা প্রমাণিত করে এবং গীর্জাগুলো নবজাগরণের আগে পর্যন্ত ওই একই কাজ করেছিল। যদি গীর্জা সোভিয়েত সরকারের মতো এখন বাজে না-ও হয় তবে তার কারণ, যারা গীর্জা আক্রমণ করেছিল তাদের প্রভাব ট্রেটের কাউন্সিলের (Council of Trent) থেকে আজ পর্যন্ত গীর্জার যা কিছু উন্নতি হয়েছে তা তার শত্রুদের জন্যই হয়েছে। এমন অনেকে আছে যারা সোভিয়েত সরকারকে আপত্তিজনক বলে ভাবেন কারণ তারা সাম্যবাদের অর্থনৈতিক মতবাদকে অপছন্দ করেন, কিন্তু এই বিষয়ে ক্রেমলিন প্রাচীন খ্ৰীষ্টীয়ধর্ম, ফ্রানসিসকান ও প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধী মধ্যযুগীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্ৰীষ্টীয় ধর্মাবলম্বী মানুষের সঙ্গে তুলনীয়। প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধী মানুষের মধ্যে যদিও সাম্যবাদ আবদ্ধ নয়। একজন গোড়া ধর্মের শহীদ স্যার টমাস মুর সাম্যবাদীদের সুরেই বলেছিলেন খ্রীষ্টধর্মের এটাই বৈশিষ্ট্য যে এটি একমাত্র কল্পনার কাছে আত্মসমর্পণ করে। এটি কোন সোভিয়েত মতবাদ নয় যাকে বিপজ্জনক বলে ভাবা যেতে পারে। এটি একটি পথ মাত্র যে পথে মতবাদটি গড়ে উঠেছে। যে পবিত্র ও অলঙ্নীয় সত্যটি উঠে এসেছে তা হল সেই পাপকে সন্দেহ করা যে পাপের ফলে কঠোরতম শাস্তি জোটে। খ্রীষ্টানদের মতো কমুনিষ্টরাও বিশ্বাস করে যে মুক্তির জন্য মতবাদটিই একান্ত প্রয়োজনীয় এবং এটি সেই ধরণের বিশ্বাস যা তার জন্য মুক্তির পথকে সম্ভাবনায় করে তোলে। খ্রীষ্টধর্ম ও সাম্যবাদের মধ্যে এটাই এমন একটি সাদৃশ্য যেখানেই তারা পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধ হয়ে ওঠে। যখন বিজ্ঞানের দুটি মানুষের মধ্যে এত বিরোধ হয় তখন তারা ধর্মনিরপেক্ষ কোন হস্তের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে না। যে বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে মত বিরোধ দেখা দিয়েছিল সেই বিষয়টির উপর সিদ্ধান্ত নেবার জন্য বিষয়টির পরবর্তী উন্নয়নের জন্য তারা অপেক্ষা করে, কারণ বিজ্ঞানের মানুষ হিসেবে তারা জানেন যে, কোন কিছুই অভ্রান্ত নয়। কিন্তু দুজন শাস্ত্রজ্ঞ যখন পরস্পর মতবিরোধী হয়ে ওঠেন তখন যেহেতু প্রমাণ করবার মতো এমন কিছু সামনে থাকে না যা দিয়ে দুজনের মধ্যে কেউ তার আবেদন রাখতে পারে, তাই দুজনের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা ও জোর যার মুলুক তার ধরণের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি স্বীকার করব যে খ্রীষ্টধর্ম আগে যা ক্ষতি করত এখন তার চেয়ে অনেক কম ক্ষতিকর। এর কারণ এখন তা আগের মতো আগ্রহপূর্ণ বিশ্বাসের বিষয় নয়। সম্ভবত ঠিক সময়ে এই একই ধরণের পরিবর্তন সাম্যবাদেও ঘটবে এবং যদি তা ঘটে তবে আজ যে ধর্মমতকে নিন্দনীয় করে তোলা হচ্ছে সেই ধর্মমত অনেক কম নিন্দনীয় হবে। কিন্তু যদি পশ্চিমা দেশগুলোর এই দৃষ্টিভঙ্গি জয়লাভ করে যে ন্যায় ও সামাজিক স্থায়িত্বের জন্য খ্রীষ্টধর্ম একান্ত প্রয়োজনীয় তবে খ্রষ্টধর্ম আবার একবার অমঙ্গলজনক প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে উঠবে যা সে হয়ে উঠেছিল মধ্য যুগগুলোতে এবং ক্রমশ বর্তমান সাম্যবাদের মতো হয়ে উঠে সে এমন একটি জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে যেখানে দুজনের মধ্যে কোন মীমাংসা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠবে। এটি সেই পথ নয় যে পথ দিয়ে জগৎকে ধ্বংসের হাত থেকে মুক্ত করা যেতে পারে।
(২)
আমার প্রথম প্রবন্ধে যে-কোন গৃহীত ধর্মমতের ব্যবস্থাজাত অমঙ্গলসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম সত্যের উপর ভিত্তি করে নয়, কেবল সামাজিক উপযোগিতার উপর ভিত্তি করে। খ্রীষ্টধর্ম, সাম্যবাদ, ইসলাম ধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম এবং সব ধর্মমত ব্যবস্থার উপর সমানভাবে প্রযোজ্য কিন্তু একমাত্র সেই ব্যবস্থা ছাড়া যে ব্যবস্থা বিজ্ঞানের মানুষের দ্বারা গঠিত এক চিরন্তন আবেদনের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। যদিও খ্রীষ্টধর্মের স্বপক্ষে একটি বিশেষ বিতর্ক গড়ে উঠে আজ সম্মুখে অগ্রসর যা উক্ত ধর্মে বিশেষ যোগ্যতার উপর নির্ভর করেই হয়েছে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ইতিহাসের অধ্যাপক হারবার্ট বাটারফিল্ড তাঁর বাগ্মিতা ও পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করে এইসব যোগ্যতাসমূহকে আমাদের সামনে রেখেছেন (গ্রন্থটির নাম Christianity and History, লন্ডন, ১৯৫০) এবং তাকে আমি গ্রহণ করব একটি বিশাল জনসমর্থনের মুখপাত্র হিসেবে যে জনসমর্থনের সঙ্গে তিনি নিজেও সংযুক্ত।
অধ্যাপক বাটারফিল্ড বিশেষ কিছু বিষয়কে নিজের কোলে টেনে নিয়ে সেইসব যুক্তিতর্ক-সাপেক্ষ বিষয়ের সুবিধাজাত সুযোগ নিয়েছেন যাতে মনে হবে তিনি বাস্তবে তার থেকে অনেক বেশি মুক্ত-মনের মানুষ। তিনি স্বীকার করেন যে খ্ৰীষ্টীয় গীর্জা নির্যাতনে বিশ্বাসী ছিল এবং চাপের ফলেই এই ধরণের কার্যকে পরিত্যাগ করেছে এবং করতে বাধ্য হয়েছে। তিনি স্বীকার করেন যে বর্তমানে রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে চাপা উত্তেজনা ক্ষমতার রাজনীতির ফল যা রাশিয়ার সরকার যদি গ্রীসের গোঁড়া গীর্জার সঙ্গে সংযুক্ত থাকত তা হলেও ঘটত। তিনি মনে করেন কিছু কিছু নৈতিক উৎকর্ষতা কিছু স্বাধীন চিন্তাবিদদের দ্বারাও প্রদর্শিত হয়েছে যা অনেক খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীদের আচরণে দেখা যায়নি। কিন্তু এইরকম স্বীকৃতি সত্ত্বেও তিনি এই ধরণের মনোভাব ধরে রেখেছেন, যে-সব অমঙ্গলজনক অবস্থার জন্য জগৎ এখনো ভুগছে তা দূর হতে পারে যদি জগৎ খ্ৰীষ্টীয়ধর্মমতের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং তার মতে কিঞ্চিত পরিমাণ খ্রীষ্টীয় ধর্মমতকে মানতে গেলে কেবলমাত্র ঈশ্বর ও তার অমরত্বকে মানলেই চলবে না, তার সঙ্গে অবতারত্বেরও বিশ্বাস রাখা একান্ত প্রয়োজন। তিনি বিশেষ কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে খ্রীষ্টধর্মের সংযোগের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন এবং ঐতিহাসিক সাক্ষ্য হিসেবে এইসব ঘটনাসমূহকে গ্রহণ করেছেন যে ঘটনাগুলি তার ধর্মের সঙ্গে সংযুক্ত না হলে কোনভাবেই তাঁর কাছে বিশ্বাসজনক হয়ে উঠত না। আমি মনে করি না যে কুমারী জননী বিষয়টি এমন একটি প্রমাণ যাকে ধর্মতত্ত্বে বিশ্বাস রাখায় অভ্যস্ত ব্যক্তি ছাড়া কোন নিরপেক্ষ অনুসন্ধানকারী বিশ্বাসজনক বলে মেনে নেবেন। পৌত্তলিক পুরাণে (Pagan mythology) এমন অনেক গল্প আছে যেখানে এ-ধরণের কাহিনী পাওয়া যায়, কিন্তু কেউই এধরণের কাহিনীকে স্বপ্নেও সত্য বলে ধরে নিতে পারে না। একজন ঐতিহাসিক হওয়া সত্ত্বেও অধ্যাপক বাটারফিল্ড যেখানে খ্রীষ্টধর্মের বিষয় জড়িত সেখানে সঠিক ইতিহাসমূলক প্রশ্ন উত্থাপনের বিষয়ে অনাগ্রহোদ্দীপক। তাঁর ভদ্রতা ও প্রতারণাপূর্ণ যুক্তি তার নিজের ভদ্রতা প্রতারণাপূর্ণ আবহাওয়ার মুখোশের তলায় অপরিণত হলেও তা অতি সূক্ষ্মতার সঙ্গে বিবৃত হতে পারে যেমন ‘খ্রীষ্ট সত্যই কুমারী মায়ের সন্তান কিনা, কিংবা কুমারী মা সত্যই পবিত্র আত্মাকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন কিনা সে বিষয়ে অনুসন্ধান করা উচিত নয়, এই ঘটনাটি সত্য কিনা তা জানা না গেলেও এই ঘটনাটিকে সত্য বলে বিশ্বাস করে নিলে বর্তমান জগৎ সমস্যার হাত থেকে রেহাই পাবে।’ অধ্যাপক বাটারফিল্ডের কাজের কোন জায়গাতেই খ্রীষ্টধর্মের মতাদর্শকে সত্য বলে প্রমাণ করবার কোন চেষ্টাই নেই। সেখানে প্রচলিত একটি ধারণা দেখা যায় যে খ্রীষ্টধর্মে বিশ্বাস রাখাটা কার্যত্র। অধ্যাপক বাটারফিল্ডের যুক্তিতে এমন অনেক স্তর আছে যা একজনের বোঝার পক্ষে যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন ও যথার্থ নয়, কেননা যদি সেখানে পরিচ্ছন্নতা ও যথার্থতা থাকত তবে তা ওইসব যুক্তিগুলিকে বেঠিক বা অসত্য বলে প্রতীয়মান করে ছাড়ত। আমার মনে হয় বাটারফিল্ডের বিতর্কটি কতকগুলি অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তায় পূর্ণ, যেমন– যদি মানুষ তার প্রতিবেশীকে ভালোবাসে তবে তা ভালো হবে, কিন্তু তা করবার জন্য তাদের মধ্যে বেশি প্রবণতা নেই। খ্রীষ্ট বলেছেন এই কাজটা তাদের করা উচিত এবং যারা খ্রীষ্টকে একজন ভগবানের মর্যাদা প্রদান করে না তাদের চেয়ে যারা তাকে সেই মর্যাদা দিয়ে থাকে তাদের খ্রীষ্টের শিক্ষার উপর অনেক বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এইজন্য যারা চায় যে মানুষ তার প্রতিবেশীকে ভালোবাসুক তারা তাদের এই বুঝিয়ে প্ররোচিত করবার চেষ্টা করেন যে খ্রীষ্ট একজন ভগবান ছিলেন।
এই ধরণের যুক্তির ক্ষেত্রে এত আপত্তি রয়ে যায় যে কোন আপত্তিটি দিয়ে শুরু করা যাবে সেটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমত, অধ্যাপক বাটারফিল্ড এবং তাঁর মতো যারা অপরকে প্ররোচিত করে বোঝাবার চেষ্টা করেন যে প্রতিবেশীকে ভালোবাসা মঙ্গলজনক বিষয় এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তারা বলে থাকেন যে তারা উক্ত দৃষ্টিভঙ্গি খ্রীষ্টের শিক্ষা থেকে গ্রহণ করেননি। অন্যদিকে, ঠিক উল্টোভাবে তারা বলে থাকেন যে তারা এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন এই কারণে যে তারা খ্রীষ্টের শিক্ষাকে তার স্বর্গীয়ত্বের প্রমাণ হিসেবে শ্রদ্ধা করেন। বলতে গেলে ধর্মতত্ত্ব-নির্ভর কোন নীতিবিদ্যা তাদের নেই, কিন্তু তাঁদের নিজেদের নীতিবিদ্যা নির্ভর একটি ধর্মতত্ত্ব আছে। তাঁরা এইরকম ভাব দেখাতে চাইছেন যেন অ ধর্মতত্ত্বগত ভিত্তি দেখালেই প্রতিবেশীকে ভালোবাসার বিষয়টি জমে উঠবে এবং তা একটি বড় আবেদন রাখতে পারবে এবং এইভাবেই তারা অন্য যুক্তিগুলোকে দেখিয়েছেন এই মনে করে যে সেগুলোকে ধর্মতত্ত্বের চৌহদ্দির বাইরে রাখলে তা অনেক বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠবে। এটি একটি বিপজ্জনক পদ্ধতি। অনেক প্রোটেস্টান্ট এই মনোভাব পোষণ করত যে সাব্বাথকে (ছুটির দিন) ভঙ্গ করাটা খুন করার অপরাধের সামিল। যদি আপনি তাদের এই বলে প্ররোচিত করেন যে সাব্বাথকে ভঙ্গ করাটা কোন দোষের নয় তাহলে তারা এটাও মনে করে নেবে যে খুন করাটাও কোন অপরাধ নয়। প্রতিটি ধর্মতত্ত্বগত নীতিবিদ্যাকে এইরকম যৌক্তিকভাবে সমর্থনও যেমন করা যেতে পারে, আবার অন্যদিকে তাকে কেবলমাত্র কুসংস্কারমূলক নিষেধের সমাহার বলেও মনে করা যেতে পারে। ধর্মতত্ত্বের যে অংশটিকে যৌক্তিকভাবে সমর্থন করা যেতে পারে তাকে সমর্থন করাই দরকার এই কারণে যে যারা তার অযৌক্তিক অংশটিকে আবিষ্কার করে, সুযোগ পেলে তারা হঠকারিতার সঙ্গে সমস্ত নীতিগুলোকেই বাতিল করে দেবে।
কিন্তু বাস্তবে খ্রীষ্টধর্ম তার বিরোধী পক্ষ ও শত্রুদের চেয়ে উত্তম নৈতিকতার জন্য দাঁড়িয়ে আছে? আমি মনে করি না যে ইতিহাসে কোন সৎ ছাত্র বিষয়টিকে একটি ঘটনা বলে মেনে নেন। অন্যান্য ধর্ম থেকে খ্রীষ্টধর্ম যেখানটায় স্বতন্ত্র তা হল এই ধর্ম নির্যাতনের বিষয়ে সর্বদাই দারুণভাবে প্রস্তুত থাকে। বৌদ্ধধর্ম কখনই একটি নির্যাতনমূলক ধর্ম হয়ে দেখা দেয়নি। খলিফার সাম্রাজ্য ইহুদি ও খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীদের কাছে অনেক বেশি উদার কিন্তু খ্রীষ্টীয় ধর্মাবলম্বী রাষ্ট্রগুলি ইহুদি ও মুসলমানদের কাছে অতটা উদার নয়। তাদেরকে কর প্রদান করেই ইহুদি ও খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীরা অনুৎপীড়িত অবস্থায় থাকতে পেরেছে। যখন রোম সাম্রাজ্য খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বী হল ঠিক সেই মুহূর্তে ইহুদি-খেদানো আন্দোলন খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীদের দ্বারাই পরিচালিত হয়েছিল। ধর্মযুদ্ধের ধর্মীয় আগ্রহ পশ্চিম ইউরোপে ইহুদিদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়েছিল। খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীরাই অন্যায়ভাবে দ্ৰেইফুসকে ও স্বাধীন চিন্তাবিদদের অভিযোগ করেছিল যারা তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছিল। আধুনিক যুগে কেবলমাত্র ইহুদিদের বেলাতেই নয়, অন্যান্যরাও যখন বলি হয়েছে তখন অতিশয় ঘৃণার বিষয়টি খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীদের দ্বারাই রক্ষিত হয়েছে। কঙ্গোর রাজা লিওপোল্ডের সরকারের অতিশয় ঘৃণা গীর্জার দ্বারাই গোপন ছিল এবং তার দ্বারাই তা হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছিল এবং তা শেষ হয় কেবলমাত্র স্বাধীন পরিচালনার দ্বারা। সমগ্র তর্কটি যেখানে গিয়ে দাঁড়ায় তা হল খ্রীষ্টীয়ধর্ম এমন একটি নৈতিক প্রভাব উত্তোলন করেছে যা সমগ্র ঐতিহাসিক প্রমাণকে অবজ্ঞা করে এবং তাদের মিথ্যা প্রমাণিত করার দ্বারা রক্ষিত হতে পারে।
প্রথাগত উত্তরটি হল, যে-খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীরা আমাদের অনুশোচনাকর কোন কিছু করে তারা প্রকৃত খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বী নয় এই অর্থে যে তারা খ্রীষ্টের শিক্ষাকে অনুসরণ করে না। যে-কেউ ওই একইভাবে বলতে পারে যে সোভিয়েত সরকার প্রকৃত মার্কসবাদের দ্বারা গঠিত নয়, কেননা মাকর্স এই শিক্ষা দিয়েছেন যে স্লাভরা জার্মানদের থেকে নিম্ন মানের এবং এই মতবাদ ক্রেমলিনের দ্বারা গৃহীত হয়নি। কোন শিক্ষকের অনুসরণকারীরা সর্বদা তার মতবাদকে কিছু কিছু জায়গা থেকে পরিত্যাগ করে। যাদের লক্ষ্য গীর্জার প্রতিষ্ঠা করা কথাটি তাদের মনে রাখা উচিত। প্রতিটি গীর্জাই আত্ম-সংরক্ষণের একটি প্রবৃত্তিকে গড়ে তোলে এবং সেই প্রবৃত্তিগত আত্ম-সংরক্ষণের পক্ষে প্রতিষ্ঠাতার মতবাদের যে যে অংশ সাহায্য করতে পারে না সেই অংশসমূহ ক্রমশ হ্রাস পায়। কিন্তু যে-কোন ঘটনা যাকে আধুনিক আত্ম-পক্ষ সমর্থনকারীরা সত্য’ খ্রীষ্টধর্ম বলে থাকে, তা স্বযত্নে নির্বাচিত পদ্ধতির উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। সুসমাচারগুলিতে যা দেখতে পাওয়া যায় তাকে এই ‘সত্য ধর্ম বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এড়িয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, ভেড়া ও ছাগলের নীতিকথা এবং সেই মতবাদ যেখানে বলা হয়েছে যে বদমাইসরা অনন্ত নরকের আগুনে ঝরে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করবে। এই ধর্ম গিরিচূড়ার উপর ধর্মোপদেশের থেকে বিশেষ কিছু অংশ তুলে নেয়, যদিও সেই অংশগুলোকেও তারা কার্যক্ষেত্রে বাতিল করে দেয়। তারা প্রত্যাহার বা নিরোধের মতবাদকে ত্যাগ করে, উদাহরণস্বরূপ, যা গান্ধীর মতো অ-খ্রীষ্টীয়রা করে থাকেন। তারা যে-বিশেষ উপদেশগুলিকে সমর্থন করে থাকেন সেই উপদেশগুলি এমন সব উচ্চ নৈতিকতার অন্তর্ভুক্ত যাতে মনে হয় যে সেগুলি অবশ্যই একটি স্বর্গীয় উৎস থেকে নিঃসৃত। অধ্যাপক বাটারফিল্ড অবশ্যই জানেন যে এই সব উপদেশগুলো খ্রীষ্টের সময়ের আগে ইহুদিদের দ্বারাই উচ্চারিত হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, তাদের দেখা যায় হিল্লেলের (Hillel) শিক্ষা ও বারোজন কুলপতির টেষ্টামেন্ট (Tes-taments of the Twelve Patriarcs), এই বিষয়ে বর্তমানে বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত রেভারেণ্ড ড. আর. এইচ. চার্লস বলেন, গিরিচূড়ার ধর্মোপদেশে আত্ম (Spirit) সম্পর্কে বহুরকম উদাহরণ পাওয়া যায় এবং তা আমাদের পাঠ্যগ্রন্থের প্রধান শব্দগুচ্ছসমূহের জন্ম দেয়। যেমন সুসমাচারগুলি উক্ত বিষয়ের চিহ্নগুলিকে প্রদর্শন করে থাকে এবং মনে হয় সেন্ট পল গ্রন্থটিকে নিরবচ্ছিন্ন সঙ্গী হিসেবে (Vade mecum) ব্যবহার করতেন। ড. চার্লস মত পোষণ করেন যে খ্রীষ্ট উক্ত গ্রন্থের সঙ্গে অবশ্যই পরিচিত ছিলেন। আমাদের যেমন বলা হয়ে থাকে যে যদি নৈতিক শিক্ষা উৎকর্ষতা উক্ত গ্রন্থের রচয়িতার স্বর্গীয়ত্বকে প্রমাণ করে, তবে টেষ্টামেন্টের অজ্ঞাত লেখক অবশ্যই স্বর্গীয় ছিলেন। জগৎটি যে একটি বাজে আকারে সজ্জিত ছিল তা অস্বীকার করা যায় না এবং সেখান থেকে বেরোবার একটি রাস্তা হিসেবে খ্রীষ্টধর্ম কোন কাজ করেছে এই রকম মনে করার সামান্য কারণও ইতিহাস থেকে খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের সমস্যাগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের থেকে গ্রীক ট্র্যাজেডির অপ্রতিরোধ্যতার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে এসেছে এবং সাম্যবাদী ও নাৎসিরা যার ফল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধটি উৎসের দিক থেকে সমগ্রভাবে খ্ৰীষ্টীয়। তিনজন ম্রাট যেমন ভক্তিনিষ্ঠ ছিলেন অন্যদিকে ব্রিটিশ ক্যাবিনেটের মতো যুদ্ধপ্রিয় ছিলেন। জার্মান ও রাশিয়ার যে-সব সমাজবাদীদের পক্ষ থেকে যুদ্ধ সম্পর্কে বিরোধিতা এসেছিল তারা খ্রীষ্টবিরোধী ছিল। ফ্রান্সে জোরের গুপ্তহত্যা আন্তরিক খ্ৰীষ্টীয়দের দ্বারা উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল, কিন্তু বিরোধিতা এসেছিল ইংল্যান্ডের উল্লেখযোগ্য নাস্তিক জনি মর্লের কাছ থেকে। সাম্যবাদের সব থেকে বিপজ্জনক বৈশিষ্ট্যটি হল যে এটি মধ্যযুগীয় গীর্জার বৈশিষ্ট্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তারা তাদের সেইসব গৃহীত মতবাদ- সমূহের সঙ্গে উন্মত্তভাবে যুক্ত যে-মতবাদগুলি তাদের পবিত্র গ্রন্থে লিপিবদ্ধ। তারা এইসব মতবাদগুলিকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে অনিচ্ছুক এবং যারা সেই মতবাদ-গুলিকে বাতিল করে তাদের তারা বর্বরদের মতো শিরচ্ছেদ করে। আমরা পশ্চিমে সেই ধর্মোন্মত্তা ও গোড়ামীর উত্থানের কথা বলছি না যা আমাদের কাছে অবশ্যই একটি সুখের বিষয় হয়ে উঠতে পারে, বরঞ্চ সেই মনোভাবের উত্থানের কথা বলা হচ্ছে যার অর্থ দাঁড়ায় এই যে সাম্রাজ্যবাদী রাজত্বের ঘৃণ্য বৈশিষ্ট্যগুলো চিরন্তন বলে প্রমাণিত হয়েছে। জগতের যা প্রয়োজন তা হল মানব পরিবারের পরস্পর নির্ভরশীলতার ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা, সহনশীলতা ও অনুভব। এই পরস্পর নির্ভরশীলতা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে আধুনিক আবিষ্কারগুলির মধ্য দিয়ে এবং শুদ্ধ পার্থিব যুক্তি তাদের প্রতিবেশীর উপর তাদের দয়ালু আচরণকে যতটা শক্তিশালী করে গড়ে তোলে ততটা পূর্বে কোন যুগেই তারা হতে পারেননি। এইরকম বিবেচনার দিকে আমাদের অবশ্যই তাকাতে হবে, এবং কোন মতেই অপরিষ্কার পুরাণগুলির দিকে আমাদের ঘুরে দাঁড়ালে চলবে না। বলা যেতে পারে যে, বিদ্যাবুদ্ধি আমাদের রোগের কারণ হয়েছে, কিন্তু অবিদ্যাবুদ্ধি সেই রোগকে কখনই সারিয়ে তুলবে না। কেবলমাত্র জ্ঞানদীপ্ত বুদ্ধিই জগৎকে সুখী করে তুলতে পারে।