চৌদ্দ
দুপুরের খাবার খারাপ ছিল না। স্বজন প্রথমে আপত্তি করেছিল, কিন্তু পৃথা তাকে বুঝিয়েছিল না খেলে তার শরীরই কষ্ট পাবে, কাজের কাজ কিছু হবে না। স্ত্রী অথবা নিকটতম বান্ধবীকে পুরুষমানুষ সহজে নিজের কাজের কথা বলতে চায় না। খামোকা বিব্রত না করার ইচ্ছেই হয়তো তার কারণ। কিন্তু সমস্যা যখন প্রবল হয়ে ওঠে, যখন পিঠের পেছনে দেওয়াল নেই, তখন সে তাদের কাছেই নিজেকে মুক্ত করে।
পৃথা সব কথা চুপচাপ শুনেছিল। তারপর বলল, ‘আমি এখন যা-ই বলি না কেন, তা এই অবস্থায় বলা অর্থহীন।’
‘কি বলবে বললা না, হয়তো— ।’ স্বজন থেমে গেল।
‘তুমি ভারতবর্ষ থেকে চলে এলে একজন পেশেন্টের চিকিৎসা করতে অথচ তার নাম জানলে না, পেশা জিজ্ঞাসা করলে না?’ পৃথা মুখ তুলল।
‘সত্যি ভুল হয়ে গেছে। আসলে তখন মাথায় আসেনি। স্যার বললেন এমন করে যে রাজি না হয়ে পারিনি।’
‘তুমি একটা বিদেশি রাজ্যে আসছ, তোমার নিরাপত্তা, আমার নিরাপত্তা নিয়ে না ভেবেই চলে এলে?’ পৃথার গলায় ঝাঁঝ।
‘স্যার বলেছিলেন কোনও অসুবিধে হবে না। ওরা আমাদের জন্যে টুরিস্ট লজে ঘর ঠিক করে রেখেছে। যে কয়দিন কাজ করতে হবে ওরাই সব ব্যবস্থা করবে, আর কাজের শেষে দেশটা ঘুরিয়ে দেখাবে। এটা শুনেই তোমাকে নিয়ে এসেছিলাম।’
‘ওরা তোমাকে টাকা দেবে বলেছিল?’
‘হ্যাঁ। ওরা মানে স্যার আমাকে বলেছিলেন।’
‘তার মানে তোমার স্যার এ সবই জানতেন।’
‘আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। স্যারকে আমি অনেক বছর ধরে চিনি। ওঁর মধ্যে কোনও প্যাঁচ নেই। এরা আমাদের বন্দি করে রাখবে জানলে উনি আসতে বলতেন না।’
পৃথা মাথা নাড়ল, ‘এখন এসব কথা বলার কোনও মানে হয় না।’
তখন প্রায় বিকেল। ঘরে আলো জ্বালা রয়েছে। স্বজন পৃথার কাছে এগিয়ে এল, ‘পৃথা, যে করেই হোক আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে।’
পৃথা মাথা নাড়ল, ‘কিন্তু দিনের আলোয় সেটা অসম্ভব। রাত নামলেও তা কি করে যে সম্ভব হবে তা বুঝতে পারছি না। এই বাড়ির চারপাশে পাহারা আছে।’
স্বজন গলা নামাল, ‘তুমি বুঝতে পারছ এরা কারা?’
‘এদেশের সরকার-বিরোধী কোনও দল।’
‘ইয়েস। এদেশের পুলিশ কমিশনার আমাকে অভদ্রের মতো ধরে নিয়ে গেলেও কোনও অশালীন ব্যবহার করেনি। লোকটা আমাকে ছেড়ে দিয়েছিল সকাল হতেই। এদের মতো ঘরের ভেতর জোর করে আটকে রাখেনি। তোমার মনে আছে ওই বাংলোয় আমি একটা ডেডবডি দেখেছিলাম। আমি নিশ্চিত, এরাই লোকটাকে খুন করেছে। অথচ এই মনে হওয়ার কথা আমি পুলিশ কমিশনারকে বলিনি। খুব ভুল করেছি।’
পৃথা স্বামীর দিকে তাকাল, ‘সেই পুলিশ অফিসারের কথা বলেছ?’
‘হ্যাঁ। ওঁর সাহায্যেই আমরা বাংলো থেকে বেরিয়ে এসেছি একথা বলেছিলাম।’
‘তা শুনে উনি কি বললেন?’
‘খুব খেপে গেলেন।’
‘তার মানে ওই লোকটাও এদের দলে?’
‘ঠিক তা নয়, বুঝলে। ব্যাপারটা গোলমেলে।’
‘শোনো, এদেশের ব্যাপারে আমাদের থাকার কোনও দরকার নেই। রাত হোক, তারপর একটা উপায় বের করতেই হবে এখান থেকে পালাবার। তুমি যদি আগে আমাকে বলতে এখানে কাজ নিয়ে আসছ, তা হলে আমি কিছুতেই রাজি হতাম না।’ পৃথা ঠোঁট ফোলাল। স্বজন তাকে জড়িয়ে ধরল, ‘সরি, আমি আর কখনও তোমার অবাধ্য হবো না। কোনও কথা তোমার কাছে লুকোব না।’
‘ছাই।’ মুখ ফেরাল পৃথা।
‘মানে?’ দুহাতে কাছে টানল স্বজন।
‘এখন বলছ, ফিরে গিয়ে যেই নিজের জগৎ পাবে সব ভুলে যাবে।’
ওই অবস্থাতেও স্বজনের মনে হল এই মেয়েটাকে ভাল না বেসে এক সেকেন্ডও নিশ্বাস নেবার কোনও মানে হয় না। সে মুখ নামাচ্ছিল, এমন সময় দরজায় শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে সরে গেল পৃথা। আর স্বজনের গলা থেকে অসাড়ে একটিই শব্দ বেরিয়ে এল, ‘শালা!’
স্বজন দরজার দিকে তাকাল। দ্বিতীয়বার শব্দ হল। সে গলা তুলে প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘আবার কি হল? দরজা তো ভেতর থেকে বন্ধ নেই।’
দরজা খুলে গেল। একটি নতুন লোক, হাতে অস্ত্র, ঘরে ঢুকে খুব বিনীত ভঙ্গিতে বলল, ‘আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।’
‘নিয়ে যেতে এসেছেন মানে?’ স্বজন খিচিয়ে উঠল।
‘আমাদের নেতা আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন।’
‘তিনি কে হরিদাস পাল যে নিয়ে যেতে বললেই আমি যাব।’
‘তিনি আমাদের মহান নেতা, তাই আপনি ওঁর সম্পর্কে শ্রদ্ধা নিয়ে কথা বলবেন। উনি আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।’ লোকটার গলার স্বর যেভাবে পাল্টে গেল তাতে সংশয় রইল না যে সে তার কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন।
পৃথা এবার কথা বলল, ‘ভালই হয়েছে। আমরা ওদের নেতাকেই সরাসরি প্রশ্ন করতে পারি কেন আমাদের এভাবে আটকে রাখা হয়েছে।’
কথাটা মনে ধরল স্বজনের। সে উঠল, ‘চলো।’
পৃথা এগোচ্ছিল কিন্তু লোকটি বাধা দিল, ‘মাফ করবেন, আপনি এখানেই অপেক্ষা করুন।’
‘তার মানে?’ পৃথা অবাক।
‘শুধু ডাক্তার সাহেবকে নিয়ে যাওয়ার হুকুম হয়েছে।’
স্বজন পৃথার দিকে তাকাল, ‘অসম্ভব! এরা ভেবেছে কী! যা ইচ্ছে বলবে আর তাই আমাদের শুনতে হবে? তোমাকে না যেতে দিলে আমি যাচ্ছি না।’
পৃথা জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি গেলে অসুবিধে কোথায়?’
লোকটা মাথা নাড়ল, ‘আমাকে বলা হয়েছে শুধু ডাক্তার সাহেবকে নিয়ে যেতে।’
হঠাৎ পৃথা বসে পড়ল বিছানায়, ‘তুমি একাই যাও।’
স্বজন স্ত্রীর দিকে এগিয়ে এল, ‘মানে?’
‘দুজনের যাওয়ার জেদ ধরলে হয়তো নেতার সঙ্গে কথা বলার সুযোগই পাওয়া যাবে না। তাছাড়া তুমি ডাক্তার। পেশেন্টের সঙ্গে যখন কথা বলো তখন সাক্ষী হিসেবে কি আমি উপস্থিত থাকি? এটাকেও সেইরকম ভেবে নেব।’ পৃথা বলল।
কাঁধ ঝাঁকাল স্বজন। কথাটায় যুক্তি আছে। তারপর দ্রুত লোকটার দিকে এগিয়ে যেতেই সে দরজার বাইরে পৌঁছে ওপরের দিকে হাত দেখল। লোকটাকে অনুসরণ করে স্বজন হলঘর পেরিয়ে দেখল দোতলায় যাওয়ার দুটো সিঁড়ি আছে। লোকটা তাকে বাঁ দিকের সিড়ি দিয়ে ওপরে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তার মনে হল এটা এ বাড়ির সামনের দিক হতে পারে না। বাড়িটার পেছনের দিকটাই এরা ব্যবহার করছে।
দোতলায় চারজন মানুষ অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে। হায়দারকে এগিয়ে আসতে দেখল সে। হাসিমুখে কাছে এসে হায়দার বলল, ‘আসুন ডাক্তার, আকাশলাল আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে। আপনার সঙ্গে কথা শেষ না হলে আমাদের ডাক্তার ওকে ঘুমের ওষুধ দিতে পারছে না। এদিকে আসুন।’ হায়দার এগিয়ে যাচ্ছিল।
ঘুমের ওষুধ! আকাশলাল! প্রথমটা থেকে বোঝা যাচ্ছে অসুস্থ কেউ এখানে আছেন। আর আকাশলাল শব্দটার সঙ্গে পোস্টারের কল্যাণে ইতিমধ্যে পরিচিত হয়ে গিয়েছে।
ঘরে অল্প আলো। খাটে একটি মানুষ আধা শোওয়া অবস্থায় ছিল, তারা ঢুকতেই উঠে বসল। এই হল আকাশলাল। যার জন্যে লক্ষ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। ছবির চেহারার সঙ্গে কোনও পার্থক্য নেই, শুধু সামনে বসা মানুষটাকে বেশ রোগা বলে মনে হচ্ছে। ঘরে আরও তিনজন মানুষ, যাদের একজন বৃদ্ধ এবং গলায় স্টেথো প্রমাণ করে উনি একজন ডাক্তার। দু-হাত জড়ো করে আকাশলাল বলল, ‘আসুন, আসুন। নমস্কার। আপনাকে বিপাকে ফেলার জন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। বসুন। আমার নাম আকাশলাল।’
স্বজন আকাশলালকে দেখল। এরই মুখ পোস্টারে দেখেছে সে। তবে পোস্টারের থেকে এখন ওকে অনেক রোগা দেখাচ্ছে। চোখের কোল বসা। নাকটা বেশ এগিয়ে আছে। গায়ের রং পাহাড়িদের যেমন হয়। লোকটার চোখ দুটো খুব উজ্জ্বল, দৃষ্টি ধারালো।
‘আপনি অনুগ্রহ করে বসুন।’ আকাশলালের গলা শুনে সে চেয়ারটার দিকে তাকাল। তারপর নেহাতই বসতে হয় বলে বসে প্রশ্ন করল, ‘আপনাদের উদ্দেশ্য কি?’
‘হ্যাঁ। সেটা নিয়ে আলোচনা করব বলে আমরা এখানে সমবেত হয়েছি।’ আকাশলাল সামান্য কাশল। সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ ডাক্তার উঠে এল, ‘কি ব্যাপার? কাশিটা কখন শুরু হয়েছে? এর আগে শুনিনি তো!’
‘না। এমন কিছু নয়। হঠাৎই হল।’
‘এই সময় কাশি হওয়া ভাল নয়।’ বৃদ্ধকে চিন্তিত দেখাল। সেটা উপেক্ষা করে আকাশলাল বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি আপনি খুব টেনশনে আছেন। আসলে আজ পর্যন্ত আপনার এমন অভিজ্ঞতা হবার কথা ছিল না। আপনি সরাসরি টুরিস্ট লজে উঠবেন, ঘুরে বেড়াবেন এবং প্রয়োজনের সময় আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব, এমনই স্থির ছিল। কিন্তু ঠিক সময়ে আপনি পৌঁছালেন না, সঙ্গে স্ত্রীকে নিয়ে এলেন, তার ওপর ভার্গিসের সঙ্গে আপনার দেখা হয়ে যাওয়া—এ সব ব্যাপার পরিকল্পনাটা পাল্টে দিস’।
স্বজন জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার সিনিয়রের মাধ্যমে আপনারাই যোগাযোগ করেছিলেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমাকে বলা হয়েছিল একজন পেশেন্টের কথা, যিনি অসুস্থতার কারণে এই শহর ছেড়ে যেতে পারছেন না। তিনি কে?’
‘আমি। এই মুহূর্তে আমি সম্পূর্ণ সুস্থ নই। আপনার সঙ্গে আমার ডাক্তারবাবুর আলাপ করিয়ে দিই। এঁর কথাই আপনাকে বলেছিলাম।’ বৃদ্ধ ডাক্তারকে শেষ সংলাপটি বলল আকাশলাল।
ডাক্তারকে নমস্কার করল স্বজন। তারপর আকাশলালকে বলল, ‘কিন্তু এই শহরের যে কোনও রাস্তা বলে দেবে পুলিশ আপনাকে চাইছে এবং ধরিয়ে দিলে লক্ষ লক্ষ টাকা। পুরস্কার পাওয়া যাবে। পুলিশের চোখে আপনি ক্রিমিন্যাল।’
‘হ্যাঁ। আপনি নিশ্চয়ই জানেন প্রতিবাদ করলে বুর্জোয়া শক্তি কি ভাবে রি-অ্যাক্ট করে।’
এই প্রথম এখানে আসার পর স্বজনের হাসি পেল, ‘সেই রি-অ্যাকশন শুধু বুর্জোয়া শক্তি করে বলছেন কেন? যারা সর্বহারাদের নেতৃত্ব দেয় বলে দাবি করে তারাও তাদের কাজের বিরুদ্ধে কারও প্রতিবাদ হজম করতে পারে না। সঠিক হলেও না।’
‘আপনি হয়তো ঠিকই বলেছেন। কিন্তু ডাক্তার, আমরা আপনার সাহায্য চাই।’
‘কিন্তু আমি যদি সাহায্য করতে রাজি না হই?’
আকাশলালের প্রায় রক্তশূন্য মুখ হঠাৎ খুব শক্ত হয়ে গেল। বোঝা গেল বেশ কষ্ট করেই নিজেকে সামলাচ্ছে সে। এই সময় হায়দার কথা বলল, ‘ডাক্তার! আপনাদের ভারতবর্ষ গণতান্ত্রিক দেশ। ভোটের বাক্সে সেখানে আপনারা নিজেদের মত ব্যক্ত করতে পারেন। সরকার অত্যাচারী হলে তাকে উৎখাত করতে পারেন ভোট না দিয়ে। কিন্তু আমাদের দেশে ভোট হয় না। একজন নাবালক রাজাকে সামনে রেখে বোর্ড রাজত্ব চালাচ্ছে। এই বোর্ডের ইচ্ছের বিরুদ্ধে এখানে কোনও কাজ হয় না। পুলিশ তাই এখানে প্রচণ্ড শক্তিমান। গরিব নিম্নবিত্ত মানুষেরা দিনের পর দিন অত্যাচার সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছে। আমরা এই অবস্থা পাল্টাতে চাই। আমরা চাই জনসাধারণের নির্বাচিত সরকারই দেশ শাসন করুক। আর সেটা চাই বলেই ওরা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমাদের শেষ করে দিতে চাইছে।’
স্বজন বলল, ‘দেখুন, আমি একজন বিদেশি। আপনারা সরকার-বিরোধী কাজকর্ম করছেন। এই অবস্থায় আপনাদের সাহায্য করা মানে এদেশের সরকারের বিরোধিতা করা।’
‘এক সেকেন্ড!’ আকাশলাল হাত তুলল, ‘আপনি চিকিৎসক হিসেবে পেশেন্টকেই, দেখবেন বলে আশা করব, তার ব্যাকগ্রাউন্ড, দেখার কি প্রয়োজন আছে?’
স্বজন আকাশলালের দিকে তাকাল। হঠাৎ তার মনে হল যাকে এখানকার পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে সে কি করে শহরের মধ্যেই এমনভাবে থাকতে পারে? লক্ষ লক্ষ টাকার লোভ কেন ওর সঙ্গীদের বিশ্বাসঘাতকতা করতে উদ্বুদ্ধ করেনি? নিশ্চয়ই এই মানুষটার মধ্যে এমন কিছু আছে, যা ওকে আলাদা করেছে। সে ইচ্ছে না করলে এরা তাকে বাধ্য করতে পারে না কাজ শুরু করতে। হয়তো অত্যাচার সহ্য করতে হবে। কিন্তু তার কৌতূহল হচ্ছিল। একজন অসুস্থ মানুষ, যাকে বিপ্লবের নেতা বলে সবাই জানে তার মনে কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে অত দূর থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডেকে আনার?
স্বজন বলল, ‘বলুন, আমাকে কি করতে হবে?’
আকাশলালের গম্ভীর মুখে ধীরে ধীরে হাসি ফুটল। দেখা গেল ঘরের অন্য মানুষরাও কথাটা শুনে স্বস্তি পেল। আকাশলাল বলল, ‘থ্যাঙ্কু ডক্টর। আপনি কিছু খাবেন? চা বা কফি?’
‘না।’ মাথা নাড়ল স্বজন।
‘দেখুন ডাক্তার, এদেশের সব মানুষ আমাকে চেনে। আমাকে চেনে আমার মুখ দেখে। পুলিশ ওয়ান্টেড পোস্টারে আমার মুখের ছবি ছেপেছে। ঈশ্বরের দেওয়া এই মুখ নিয়ে আমি কখনই প্রকাশ্যে কাজ করতে পারব না। প্রকাশ্যে কাজ করতে না পারলে আমি বিপ্লবের কোনও সাহায্যেই আসব না। আমি ওভাবে বেঁচে থাকতে রাজি নই। আমি জার্নালে পড়েছি, বিজ্ঞান মানুষের মুখের চেহারা একদম পাল্টে দিতে পারছে। আপনাদের দেশে আপনি ওই ব্যাপারে একজন প্রথম শ্রেণীর বিশেষজ্ঞ। এই কারণেই আপনার শরণাপন্ন হয়েছি আমরা।’ আকাশলাল দ্রুত কথা বলছিল। ফলে শেষের দিকে হাঁপাতে দেখা গেল তাকে।
স্বজন মাথা নাড়ল, ‘কিন্তু ওই অপারেশনের জন্যে যেসব যন্ত্রপাতি দরকার— !’
ত্রিভুবন বলল, ‘বেশির ভাগই আমরা আপনার সিনিয়রের সঙ্গে কথা বলে আনিয়ে রেখেছি। কিছু আপনাকে সঙ্গে নিয়ে আসতে বলেছিলাম।’
‘আচ্ছা, আমার সিনিয়র কি এসব জানেন?’
ত্রিভুবন মাথা নাড়ল, ‘তিনি জানতে চাননি।’
‘আপনাকে দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে। অপারেশন শুরু করার আগে আপনার শরীরের অবস্থা পরীক্ষা করা দরকার। ওঁর কন্ডিশন কি?’ স্বজন বৃদ্ধ ডাক্তারকে প্রশ্ন করল।
তিনি উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন কিন্তু আকাশলাল তাঁকে ইশারায় নিষেধ করল, ‘আমি ভাল আছি। আমার শরীর নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা নেই।’
বৃদ্ধ ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার অপারেশনের জন্যে বডি কন্ডিশন কি রকম থাকা উচিত? কতটুকু ঝুঁকি নিতে পারেন?’
‘পেশেন্টের ব্লাডসুগার একদম নর্মাল থাকবে। প্রেসারও।’
বৃদ্ধ ডাক্তার চিন্তিত হলেন, ‘প্রেসারটা— !’
‘নর্মাল থাকবে।’ আকাশলাল বলে উঠল, ‘আমার ব্লাডসুগার নেই, এবং রক্ত এখন পর্যন্ত সব দিক দিয়েই ঠিক আছে। কিন্তু অপারেশনের পর মুখে কোনও দাগ থাকবে না তো?’
স্বজন হেসে ফেলল, ‘সেটা নির্ভর করছে অপারেশন কি ধরনের হচ্ছে, তার ওপরে। আপনি চাইছেন আপনার মুখের পরিবর্তন এমন ভাবে করতে যাতে কেউ দেখে আপনাকে চিনতে না পারে। তাই তো?’