১৪. দুঃস্বপ্ন দেখে প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ

দুঃস্বপ্ন দেখে প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদের ঘুম ভাঙল। ভয়ে এবং উত্তেজনায় তার হাঁপানির মতো হয়ে গেল। অনেকক্ষণ ধরে বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্ত করার চেষ্টা করলেন। নিজেকে সামলানো যাচ্ছে না। তার হাত পারকিনসন্স রোগীর মতো কাঁপছে। পিপাসায় বুক শুকিয়ে কাঠ।

তাঁর স্বপ্ন খুব ভয়ংকর কিন্তু ছিল না। স্বপ্নটা বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক। আতংকে অস্থির হওয়ার মতো কিছু না।

তিনি দেখেছেন তাঁর আগামসি লেনের বাড়ির ছাদে তিনি বসে আছেন। তাঁর সামনে একগাদা কবুতর। তিনি কবুতরকে চাল খাওয়াচ্ছেন। হঠাৎ চিলেকোঠার দরজায় প্রচণ্ড শব্দ হতে লাগল। শব্দে সব কবুতর উড়ে গেল। তিনি তাকিয়ে দেখেন ছাদের দরজা এবং দেয়াল ভেঙে প্রকাণ্ড এক ট্যাংক ঢুকেছে।

স্বপ্নে ছাদে ট্যাংক আসা খুবই স্বাভাবিক মনে হলো। ট্যাংকের ভেতর কর্নেল ফারুক বসে আছেন। ফারুকের চোখে কালো চশমা, গায়ে কিছু নেই, খালি গা। স্বপ্নে এই বিষয়টাও মোটেই অস্বাভাবিক মনে হলো না। কর্নেল ফারুক বললেন, কবুতরগুলি খুবই যন্ত্রণা করছে। দিন-রাত বাকবাকুম ডাক। আমি কবুতর মারতে এসেছি।

মোশতাক বললেন, উত্তম কাজ করেছেন। সব কবুতর মেরে ফেলা উচিত। কাকগুলি থাকুক। এরা ময়লা খেয়ে আবর্জনা পরিষ্কার করে। কবুতর কোনো কাজের পাখি না।

ছাদে আবারও ঘড়ঘড় শব্দ। আরেকটা ট্যাংক ঢুকছে। তার পেছনে আরেকটা, তার পেছনে আরেকটা। ট্যাংকগুলি নির্বিচারে কামান দাগতে শুরু করেছে।

 

খন্দকার মোশতাক যখন ট্যাংকের স্বপ্ন দেখছেন তখন কাকতালীয়ভাবে মেজর ফারুক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে আটটা ট্যাংক এনে বঙ্গভবনের চারদিকে বসাচ্ছিলেন। বঙ্গভবনে আগেই আটটা ট্যাংক ছিল, এখন হলো যোলটা। বঙ্গভবন পুরোপুরি সুরক্ষিত। ষোলটা ট্যাংক ডিঙিয়ে কেউ এখানে ঢুকবে না। সে যত বড় বীরপুরুষই হোক।

ফারুক আতংকে অস্থির হয়ে ছিলেন, কারণ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মমাশাররফের ভাবভঙ্গি মোটেই তার ভালো মনে হচ্ছিল না। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কর্নেল শাফাত জামিল। বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট থেকেও ট্রপস মুভমেন্ট শুরু হয়েছে।

খালেদ মোশাররফের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কর্নেল হুদাও যুক্ত হয়েছেন। কর্নেল হুদার ভাবভঙ্গিও ভালো না। রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ১০ এবং ১৫ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট আসছে। এরা মুক্তিযুদ্ধের সময় খালেদ মোশাররফের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে।

কোনো কারণে যদি খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবন আক্রমণ করেন তাহলে ভরসা ট্যাংকবহর।

ফারুকের আতংকগ্রস্ত হওয়ার আরেকটি কারণ আন্ধা হাফেজ। আন্ধা হাফেজ খবর পাঠিয়েছেন—ফারুকের বাহিনী পনেরই আগস্টে বাড়াবাড়ি করেছে, তার ফল অশুভ হয়েছে। ফারুকের উচিত জীবন বাঁচানোর জন্যে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া এবং কোনোদিন দেশে ফিরে না আসা।

নভেম্বরের দুই তারিখ ভোরে ফারুক ব্যাকুল হয়ে টেলিফোন করলেন কর্নেল ওসমানীকে। তিনি যেন খালেদ মোশাররফের সঙ্গে কথা বলে একটা সমঝোতায় আসেন। এখন মোটামুটি পরিষ্কার, খালেদ মোশাররফ কিছু ঘটাতে যাচ্ছেন। সেনাকর্মকর্তারা সবাই কোনো-না-কোনো সময়ে বঙ্গভবনে এসেছেন। চা-পানি খেয়েছেন। মেজর ফারুক, মেজর রশীদ ও মেজর ডালিমের সঙ্গে গল্পগুজব করেছেন। একমাত্র ব্যতিক্রম খালেদ মোশাররফ। তিনি কখনো আসেন নি।

কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে খালেদ মোশাররফের সংক্ষিপ্ত টেলিফোন কথোপকথন—

ওসমানী : খালেদ, এইসব কী হচ্ছে!

খালেদ : কিছুই হচ্ছে না স্যার। আপনি ট্যাংকগুলিকে ঘরে যাওয়ার নির্দেশ দিন।

ওসমানী : আমি বঙ্গভবনে যাচ্ছি, তুমিও আসো। আমরা কথা বলি। মেজর রশীদ তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে।

খালেদ মোশাররফ : আমার সঙ্গে কী কথা? খুনি মেজররা যারা দেশ শাসন করছে তাদের সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই।

ওসমানী : বঙ্গভবনে জোর গুজব, জিয়াকে হত্যা করা হয়েছে। তুমি কি জিয়াকে হত্যা করেছ?

খালেদ মোশাররফ : আমি রক্তপাতে বিশ্বাস করি না। জিয়াকে আটক করা হয়েছে, হত্যা করা হয় নি। তবে বঙ্গভবনে ঢুকে একজনকে আমার হত্যা করার ইচ্ছা আছে। আপনি কি তার নাম শুনতে চান? তিনি প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক। শ্বেত সর্প।

ওসমানী : কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে যাবে না। [এই পর্যায়ে টেলিফোনের লাইন কেটে গেল।]

 

বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট সাহেব জোহরের নামাজ শেষ করে, চোখ বন্ধ করে জায়নামাজে বসে আছেন। তিনি দরুদে তুনাজ্জিনা পাঠ করছেন। মানবজীবনের যাবতীয় বিপদ-আপদ থেকে মুক্তিলাভের জন্যে এই দোয়ার শক্তি সর্বজনস্বীকৃত।

মোশতাক সাহেবের একাগ্র মনোেযোগ ব্যাহত হলো। মেজর রশীদের গলা— আপনি দেখি বঙ্গভবনকে মসজিদ বানিয়ে ফেলেছেন! সারাক্ষণ নামাজ কালাম পড়লে রাষ্ট্রকার্য পরিচালনা করবেন কীভাবে?

মোশতাকের মুখে চলে এসেছিল বলবেন, রাষ্ট্রকার্য পরিচালনার জন্যে তো আপনারাই আছেন। তিনি শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলালেন। সবসময় সব কথা বলা যায় না।

আপনার নামাজ কি শেষ হয়েছে? আমি জরুরি কাজ নিয়ে এসেছি।

জরুরি কাজটা কী?

আপনাকে দুশ্চিন্তামুক্ত করা।

খন্দকার মোশতাক বললেন, আমার কিসের দুশ্চিন্তা? আমি কাউকে খুন করে ক্ষমতায় আসি নি। আমাকে জোর করে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে।

মেজর রশীদ কড়া গলায় বললেন, বুরবাকের মতো কথা বলবেন না। আপনি ক্ষমতায় বসার জন্যে জিভ বের করে বসে ছিলেন।

খন্দকার মোশতাক বললেন, বাহাসের প্রয়োজন নাই। কী বলতে চান বলুন।

সেনাবাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমানকে যে আটক করা হয়েছে, এটা জানেন?

জানি না। ডিজিএফআই আমাকে কোনো খবর দেয় না। তারা আমাকে ভাসুর জ্ঞান করে। ভাসুরকে সব কথা বলা যায় না।

মেজর রশীদ বিরক্তির সঙ্গে বললেন, রসিকতা করবেন না। সময়টা রসিকতার জন্যে উপযুক্ত না।

খন্দকার মোশতাক বললেন, অবশ্যই অবশ্যই।

মেজর রশীদ বললেন, খালেদ মোশাররফ আমাদের ক্যান্টনমেন্টে নিজ নিজ রেজিমেন্টে ফিরে যেতে বলেছেন। এর অর্থ জানেন?

এর অর্থ হলো সব স্বাভাবিক। ঘরের পাখি ঘরে ফিরিয়া গেল। ঘরে ফিরিয়া ধান খাইতে লাগিল।

আবার রসিকতা?

আলহামদুলিল্লাহ্। রসিকতা কেন করব? আপনি যেমন আমার শালা না, আমিও তেমন আপনার দুলাভাই না, যে, কথায় কথায় রসিকতা করব।

মেজর রশীদ হতাশ গলায় বললেন, রেজিমেন্টে ফিরে যাওয়া মানে সরাসরি কোর্টমার্শালে উপস্থিত হওয়া। খালেদ মোশাররফ হচ্ছে ময়মনসিংহের ছেলে। এদের ঘাড়ের তিনটা রগ থাকে তেড়া। তেড়াগের কারণে সে আমাদের গুলি করে মারবে। নামকাওয়াস্তে কোর্টমার্শাল হবে। বুঝতে পারছেন?

পারছি।

খন্দকার সাহেব মনে মনে বললেন, ঘরের পাখি ঘরে ফিরিয়া ধানের বদলে গুলি খাইয়া মরিল।

মেজর রশীদ বললেন, আওয়ামী লীগের প্রেতাত্মা যেন ফিরে আসতে না পারে সেই ব্যবস্থা করে যাব। আওয়ামী লীগের সব নেতা শেষ করে দিয়ে যাব। বিশেষ করে যারা জেলে আছে তাদের। এদের খুঁজে বেড়াতে হবে না। সবাই

একসঙ্গেই আছে। নেতা নিমূলে আপনার কি সমর্থন আছে?

খন্দকার মোশতাক সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আছে, সমর্থন আছে। এই কাজটা করতে পারলে দেশের জন্যে বড় কাজ করা হবে। বাকশালের কবর হয়ে যাবে। দেশ চলতে শুরু করবে সোনার রথে।

মেজর রশীদ বললেন, কাজ শেষ করে বিদেশ চলে যাওয়া যায়। সময়সুযোগমতো আবার ফিরে আসা।

খন্দকার মোশতাক বললেন, অবশ্যই ফিরে আসবেন। আপনারা দেশের সূর্যসন্তান। আপনাদের ছাড়া দেশ চলবে কীভাবে? দেশে কেউ আপনাদের ছায়াও স্পর্শ করতে পারবে না। আমি ইনডেমনিটি বিলে সই করেছি, গ্যাজেটে তা প্রকাশিত হয়েছে।

আপনি কথা বেশি বলেন। কম কথা বলুন। পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে তা খেয়াল করুন।

 

শফিককে থানাহাজত থেকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। আসামিকে কোর্টে চালান দিলে তাকে আর থানায় ফেরত আনা যায় না। তবে তদন্তের স্বার্থে পুলিশ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। তিন দিন ধরে শফিক জেলহাজতে আছে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে এখনো কেউ আসে নি। শফিক খবর পেয়েছে, পুলিশের এই জিজ্ঞাসাবাদ নাকি ভয়ংকর। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে মরা মানুষও নাকি উঠে বসে। সমস্ত অপরাধ স্বীকার করে, আবার মৃতমানুষ হিসেবে মেঝেতে পড়ে যায়।

জেলহাজতে শফিকের পরিচয় হয়েছে বরিশালের আলিম ডাকাতের সঙ্গে। আলিম ডাকাত আটক হয়েছে—এক পরিবারে তিনজনকে হত্যার জন্যে। যে কোনো কারণেই হোক, আলিম ডাকাত শফিককে স্নেহের চোখে দেখছে। হাজতে তার জন্যে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করেছে। একজন হাজতিকে নিযুক্ত করেছে শফিকের গা-হাত-পা মালিশ করার জন্যে।

শফিক বলেছিল, গা-হাত-পা মালিশের কোনো প্রয়োজন নেই। আলিম ডাকাত বলল, প্রয়োজন অবশ্যই আছে। পুলিশের মারের সময় যেন ব্যথা-বেদনা কম হয় এইজন্যেই শরীর তৈরি করা। পুলিশ যখন নিয়ে যাবে তখন দু’টা ট্যাবলেট দিব। একফাকে গিলে ফেলবেন। এরপর পুলিশ যদি মারতে মারতে হাড়ি ভেঙে ফেলে, ব্যথা-বেদনা হবে না। আরও টেকনিক আছে, সময়মতো সব শিখায়ে দিব।

আলিম ডাকাতের মাধ্যমে শফিক অবন্তিকে একটা চিঠি পাঠিয়েছে। আলিম বলেছে, চিঠি জায়গামতো পৌঁছে গেছে। শফিক জানে না পৌঁছেছে কি না।

অবন্তিকে লেখা শফিকের চিঠি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। সেখানে লেখা–

অবন্তি,

আমি জেলহাজতে আছি। রাধানাথ বাবু খুন হয়েছেন। পুলিশের হাস্যকর ধারণা, খুন আমি করেছি। তোমার দাদাজানকে বলে তোমার পক্ষে কি সম্ভব আমাকে নরক থেকে উদ্ধার করা?

ইতি
শফিক

 

৩ নভেম্বর। রাত আড়াইটা। হঠাৎ জেলখানার পাগলাঘণ্টি বাজতে লাগল। শফিক পাগলাঘণ্টি শুনে ধড়মড় করে উঠে বসল। কারারক্ষীদের ছোটাছুটি দেখা যাচ্ছে। তারা কেউ কোনো প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে না। আলিম ডাকাত শফিকের চিন্তিত মুখ দেখে বলল, নিশ্চিন্তে ঘুমান। এরা পাগলাঘণ্টি বাজানোর প্র্যাকটিস করতেছে।

পাগলাঘণ্টি বাজানোর নির্দেশ দিয়েছেন আইজি প্রিজন নুরুজ্জামান। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের জেলার আইজি প্রিজনকে খবর দিয়ে এনেছেন। সেনাবাহিনীর রিসালদার মুসলেহ উদ্দিন অস্ত্র হাতে একদল সৈনিক নিয়ে এসেছে। তারা জেলখানায় ঢুকে কিছু দুষ্ট বন্দিকে শায়েস্তা করতে চায়। কী অদ্ভুত কথা!

আইজি প্রিজন হতভম্ব হয়ে লক্ষ করলেন, রিসালদার মুসলেহ উদ্দিন এবং তার লোকজনের ভাবভঙ্গি ভয়ংকর। জেল গেট না খুলে দিলে তারা এখানেই খুনখারাবি করবে।

তাঁর নিজের জীবন নিয়েই এখন সংশয়। তিনি প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাককে টেলিফোন করলেন। অবস্থা জানালেন।

প্রেসিডেন্ট মোশতাক নির্বিকার গলায় বললেন, যারা ঢুকতে চাচ্ছে তাদের ঢুকতে দিন।

নুরুজ্জামান বললেন, স্যার, আপনি কী বলছেন?

খন্দকার মোশতাক ধমক দিয়ে বললেন, আমি কী বলেছি আপনি শুনেছেন। আপনি কানে ঠসা না।

স্যার, জেল গেট খুলে দিতে বলছেন?

মোশতাক জবাব না দিয়ে টেলিফোন লাইন কেটে দিলেন।

মুসলেহ উদ্দিনের বন্দুকের মুখে আইজি প্রিজন দলবল নিয়ে এক নম্বর সেলে গেলেন। সেখানে তাজউদ্দীন এবং নজরুল ইসলাম ছিলেন। দুই নম্বর সেলে ছিলেন মনসুর আলী এবং কামারুজ্জামান। এই দু’জনকে এক নম্বর সেলে আনা হলো। রিসালদার মুসলেহ উদ্দিন খুব কাছ থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে চারজনকে হত্যা করে। তাজউদ্দীন ছাড়া বাকি তিনজন তাৎক্ষণিকভাবে মারা যান। তাজউদ্দীনের হাঁটুতে ও পেটে গুলি লেগেছিল। তিনি পানি পানি’ বলে কাতরাচ্ছিলেন। তাঁকে পানি দেওয়ার মতো পরিবেশ ছিল না।

মুসলেহ উদ্দিন চলে যাওয়ার পর আরেকটি ঘাতক দল আসে। এই দলের প্রধান নায়েক আলী। তাকে মৃত চার নেতাকে দেখানো হয়। নায়েক আলি মৃত শবের ওপরে বেয়োনেট চার্জ করে।

তিন নম্বর সেলে ছিলেন আওয়ামী লীগের আরেক নেতা। আব্দুস সামাদ আজাদ। ঘাতকেরা তাকে কিছুই বলে না। সবাই শেষ হলেও তিনি কেন টিকে থাকেন কে বলবে! রাজনীতির খেলা বোঝা বিচিত্র। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই খেলা ‘বোঝার আশায় দিয়েছি জলাঞ্জলি।

জেলখানার পাগলাঘণ্টি বাজতেই থাকল। সব বন্দি তখন জেগে উঠেছে। তারা প্রচণ্ড হইচই করছে। দরজায় বাড়ি দিচ্ছে। তারা তখনো কী ঘটেছে জানে না। তবে কাতরানি ধ্বনি এবং পানির কাতর উচ্চারণ শুনছে।

শফিক এই উত্তেজনা সহ্য করতে পারল না। সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। এই রাত থেকেই তার এপিলেপসির শুরু। শফিক তার প্রতিটি এপিলেপটিক সিজারের আগে আগে কালাপাহাড়কে দেখত। কালাপাহাড় নাকি মানুষের মতো গলায় বলত—সাবধান, এখনই ঘটনা ঘটবে। শুয়ে পড়েন। দাঁতের ফাঁকে কিছু একটা রাখেন, না রাখলে জিহ্বা কেটে যাবে।

জেলহত্যা-বিষয়ে আইজি প্রিজনের জবানবন্দি তুলে দেওয়া হলো অধ্যায়ের শেষে। এই জবানবন্দি একুশ বছর পর উদ্ধার করা হয়েছে।

ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে কী কাণ্ড ঘটেছে কেউ তা জানে না। প্রেসিডেন্ট সাহেব জানেন এবং ডিজেএফআই প্রধান মেজর জেনারেল খলিল জানেন। এই দুজনের কেউই মুখ খুলছেন না। প্রেসিডেন্ট আছেন বঙ্গভবনে। রাত চারটায় তিনি ঘুমুতে গেছেন। তখনো তিনি জানেন না বঙ্গভবনের নিরাপত্তায় নিয়োজিত তিন শ’ সৈন্যের পদাতিক দল নিয়ে মেজর ইকবাল বঙ্গভবন ছেড়ে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে গেছেন।

নভেম্বর মাসের হালকা শীতে প্রেসিডেন্ট সাহেবের ভালো ঘুম হচ্ছিল। ঘুম ভাঙল বিকট শব্দে। কী হচ্ছে কী হচ্ছে বলে তিনি জেগে উঠলেন। কী হচ্ছে কেউ বলতে পারল না। বঙ্গভবনের ওপর দিয়ে বিকট শব্দে দুটি মিগ বিমান উড়ে গেল। এর মধ্যে একটি আবার ফিরে এসে বঙ্গভবনের ওপর দিয়ে চক্কর খেতে লাগল। মিগ বিমানের সঙ্গে যুক্ত হলো দুটি হেলিকপ্টার। হেলিকপ্টার দুটির সঙ্গে আছে ট্যাংকবিধ্বংসী মিসাইল। প্রেসিডেন্ট মোশতাক আতঙ্কে অস্থির হয়ে গেলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল যে-কোনো মুহূর্তে তিনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন।

তিনি কর্নেল ওসমানীকে টেলিফোন করে কাঁদো কাঁদো গলায় তক্ষুনি বঙ্গভবনে আসতে বললেন।

প্রেসিডেন্টের জন্যে সকালের নাশতা নিয়ে এসেছে। প্রেসিডেন্ট চায়ের কাপে বড় চুমুক দিয়ে মুখ পুড়িয়ে ফেললেন। তিনি হা করে বসে আছেন। মুখের জ্বলুনি কমছে না। মাথার ওপর মিগ বিমান চক্কর দিচ্ছে। তারা কি বোমা বর্ষণ করবে? তিনি বোমার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবেন? কবর দেওয়ার মতো শরীরের কোনো অংশ কি অবশিষ্ট থাকবে? মনে হয় না।

রেডিও বাংলাদেশ নীরব। তার মানে বড় কিছু-একটা ঘটেছে। সেটা কী?

 

ওসমানী বঙ্গভবনে ঢোকার পর জানা গেল, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। খালেদের সঙ্গে আছেন তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ সহচর ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়েত জামিল। ক্যান্টনমেন্টের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এখন তাঁদের হাতে। এয়ার মার্শাল তোয়াব খালেদকে সমর্থন জানিয়েছেন। তাঁর নির্দেশেই আকাশে মিগ বিমান উড়ছে। শুধু যে ভয় দেখানোর জন্যে উড়ছে তা না। ফারুকের ট্যাংকবহরের ওপর বোমাবর্ষণের পরিকল্পনাও তার আছে।

খালেদ মোশাররফের নির্দেশে ৪৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টের অ্যান্টি ট্যাংক কামান নিয়ে বঙ্গভবন ঘিরে ফেলল। পুরোপুরি যুদ্ধাবস্থা। একদিকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফের বাহিনী, অন্যদিকে ফারুকের ট্যাংক ও আর্টিলারি বহর। দুই দলই মুখখামুখি বসা।

সেনাবাহিনী প্রধান জিয়া বন্দি। জিয়ার বাসভবন ঘিরে রাখা সৈন্যদলের প্রধান মেজর হাফিজকে জিয়া জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি বন্দি?

মেজর হাফিজ হাসলেন। এই হাসির অর্থ জেনারেল জিয়া বুঝতে পারলেন।

অজানা আশংকায় অস্থির হয়ে বেগম জিয়া টেলিফোন করলেন ওসমানীকে। তার একটাই অনুরোধ, জিয়াকে যেন নিরাপত্তা দেওয়া হয়।

 

বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের কাছে খালেদ মোশাররফ তিনটি দাবি পাঠিয়েছেন। দাবিগুলো হচ্ছে—

১. সমস্ত ট্যাংক ও কামান ক্যান্টনমেন্টে ফেরত আসবে। শহরে কিছুই থাকবে না।

২. বঙ্গভবনে বসে ফারুক-রশীদের দেশ চালানোর অবসান ঘটবে। তাদের ক্যান্টনমেন্টে ফিরে চেইন অব কমান্ড মানতে হবে।

৩. জিয়া চিফ অব স্টাফ থাকতে পারবেন না।

মেজর ফারুক, মেজর রশীদ, ওসমানী এবং প্রেসিডেন্ট রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেছেন। খালেদ মোশাররফের তিন দাবি নিয়ে আলোচনা চলছে।

ফারুক বললেন, আমি আমার ট্যাংক ও আর্টিলারি নিয়ে যুদ্ধ করব। ক্যান্টনমেন্টে আমার ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

প্রেসিডেন্ট বললেন, যুদ্ধ করলে ব্যাঙা হয়ে যাবেন।

ফারুক চোখমুখ লাল করে বললেন, ব্যাঙা হয়ে যাব মানে কী?

ওপর থেকে যখন বোমা পড়বে তখন ব্যাঙের মতো চ্যাপ্টা হয়ে যাবেন। একে বলে ব্যাঙা হয়ে যাওয়া।

ফারুক বললেন, জটিল সময়ে আপনার তৃতীয় শ্রেণীর রসিকতা আমার খুবই অপছন্দ।

প্রেসিডেন্ট বললেন, রসিকতা বাদ। এখন একটা প্রস্তাব দেই? আপনাদের দেশের বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করি? আমার প্রস্তাব নিয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করুন। মাথা গরম করবেন না। আপনারা দেশত্যাগ করবেন। আমিও দেশত্যাগ করব।

কর্নেল ওসমানী অবাক হয়ে বললেন, দেশত্যাগ করে আপনি কোথায় যাবেন?

প্রেসিডেন্ট বললেন, আমি বঙ্গভবন ছেড়ে আগামসি লেনের নিজ বাড়িতে চলে যাব। এটাই আমার জন্যে দেশত্যাগ।

 

খালেদ মোশাররফ বিকাল তিনটায় জেলহত্যার খবর পেলেন। তিনি শীতল গলায় বললেন, একজীবনে অনেক রক্ত দেখেছি, আর রক্ত দেখতে চাই না, তবে খন্দকার মমাশতাকের বুকে আমি নিজ হাতে চারটা বুলেট ঢুকিয়ে দেব। চার নেতার সৌজন্যে চার বুলেট। ফারুক রশীদ গং-এর অবসানও আমি ঘটাতে যাচ্ছি। প্রয়োজনে বঙ্গভবন আমি ধুলায় মিশিয়ে দেব।

খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনের উদ্দেশে নিজেই যুদ্ধযাত্রা করলেন। তখন সময় সন্ধ্যা সাতটা। একটু আগেই মাগরেবের আযান হয়েছে।

একই সময়ে তেজগা বিমান বন্দরে একটা বিমান ব্যাংককের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছিল। বিমানে আছেন মেজর ফারুক এবং মেজর রশীদসহ ১৭জন সেনা কর্মকর্তা এবং তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা। মহিলাদের অনেককেই নীরবে অশ্রুবর্ষণ করতে দেখা গেল।

ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের বঙ্গভবনের গেট দিয়ে ঢোকার মুহূর্তে তেজগা বিমান বন্দর থেকে বিশেষ বিমান ব্যাংককের উদ্দেশে দেশ ছাড়ল।

 

আইজি প্রিজন নুরুজ্জামানের জেলহত্যা রিপোর্ট

১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর ভোের তিনটায় আমি বঙ্গভবন থেকে মেজর রশীদের একটা ফোন পাই। তিনি আমার কাছে জানতে চান, ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে কোনো সমস্যা আছে নাকি? আমি জানালাম, ঠিক এই মুহূর্তের অবস্থা আমার জানা নেই।

এরপর তিনি আমাকে জানালেন কয়েকজন বন্দিকে জোর করে নিয়ে যেতে কিছু সেনাসদস্য জেল গেটে যেতে পারে। আমি যেন জেল গার্ডদের সতর্ক করে দেই। সেই অনুযায়ী আমি সেন্ট্রাল জেলে ফোন করি এবং জেলগেটে দায়িত্বে থাকা ওয়ার্ডারকে ম্যাসেজটি জেলারকে পৌঁছে দিতে বলি, যাতে নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়।

৩/৪ মিনিট পর বঙ্গভবন থেকে আরেকজন আর্মি অফিসারের টেলিফোন পাই। তিনি জানতে চান আমি ইতিমধ্যেই জেল গার্ডদের সতর্ক করে দিয়েছি কি না। আমি ইতিবাচক জবাব দেওয়ার পর তিনি আমাকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্যে জেলগেটে চলে যেতে বলেন।

আমি তখন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ডিআইজি প্রিজনকে ফোন করি। খবরটা জানিয়ে আমি তাকে তাৎক্ষণিকভাবে জেলগেটে চলে যেতে বলি। দেরি না করে আমিও জেলগেটে চলে যাই এবং ইতিমধ্যেই সেখানে পৌঁছে যাওয়া জেলারকে আবার গার্ডদের সতর্ক করে দিতে বলি। এরই মধ্যে ডিআইজিও জেলগেটে পৌঁছেন। বঙ্গভবন থেকে পাওয়া খবরটা আমি আবার তাঁকে জানাই।

এর পরপরই মেজর রশীদের আরেকটি ফোন পাই। তিনি আমাকে জানান, কিছুক্ষণের মধ্যেই জনৈক ক্যাপ্টেন মোসলেম জেলগেটে যেতে পারেন। তিনি আমাকে কিছু বলবেন। তাকে যেন জেল অফিসে নেওয়া হয় এবং ১. জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, ২. জনাব মনসুর আলী, ৩. জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ৪. জনাব কামারুজ্জামান—এই ৪ জন বন্দিকে যেন তাকে দেখানো হয়।

এ খবর শুনে আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে চাই এবং টেলিফোনে প্রেসিডেন্টকে খবর দেওয়া হয়। আমি কিছু বলার আগেই প্রেসিডেন্ট জানতে চান, আমি পরিষ্কারভাবে মেজর রশীদের নির্দেশ বুঝতে পেরেছি কি না। আমি ইতিবাচক জবাব দিলে তিনি আমাকে তা পালন করার আদেশ দেন।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই চারজন সেনাসদস্যসহ কালো পোশাক পরা ক্যাপ্টেন মোসলেম জেলগেটে পৌঁছেন। ডিআইজি প্রিজনের অফিসকক্ষে ঢুকেই তিনি আমাদের বলেন, পূর্বোল্লিখিত বন্দিদের যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে তাকে নিয়ে যেতে। আমি তাকে বলি, বঙ্গভবনের নির্দেশ অনুযায়ী তিনি আমাকে কিছু বলবেন। উত্তরে তিনি জানান, তিনি তাদের গুলি করবেন। এ ধরনের প্রস্তাবে আমরা সবাই বিমূঢ় হয়ে যাই। আমি নিজে এবং ডিআইজি প্রিজন ফোনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি, কিন্তু ব্যর্থ হই। সে সময় জেলারের ফোনে বঙ্গভবন থেকে মেজর রশীদের আরেকটি কল আসে। আমি ফোন ধরলে মেজর রশীদ জানতে চান, ক্যাপ্টেন মোসলেম সেখানে পৌঁছেছেন কি না। আমি ইতিবাচক জবাব দেই এবং তাকে বলি, কী ঘটছে, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

ক্যাপ্টেন মোসলেম বন্দুকের মুখে আমাকে, ডিআইজি প্রিজন, জেলার ও সে সময় উপস্থিত অন্যান্য কর্মকর্তাদের সেখানে যাওয়ার নির্দেশ দেন, যেখানে উপরোল্লিখিত বন্দিদের রাখা হয়েছে। ক্যাপ্টেন ও তার বাহিনীকে তখন উন্মাদের মতো লাগছিল এবং আমাদের কারও তাদের নির্দেশ অমান্য করার উপায় ছিল না। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী পূৰ্বোল্লিখিত চারজনকে অন্যদের কাছ থেকে আলাদা করা হয় এবং একটি রুমে আনা হয়, সেখানে জেলার তাদের সনাক্ত করেন। ক্যাপ্টেন মোসলেম এবং তার বাহিনী তখন বন্দিদের গুলি করে হত্যা করে। কিছুক্ষণ পর নায়েক এ আলীর নেতৃত্বে আরেকটি সেনাদল সবাই মারা গেছে কি না তা নিশ্চিত হতে জেলে আসে। তারা সরাসরি সেই ওয়ার্ডে চলে যায় এবং পুনরায় তাদের মৃতদেহ বেয়নেট চার্জ করে।

স্বাক্ষর
এন জামান
মহা কারাপরিদর্শক
৫.১১.৭৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *