১৪. দার্শনিক জ্ঞানের প্রয়োগক্ষেত্র
এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা দর্শন সম্বন্ধে যা বলেছি তাতে আমরা কদাচিৎ সেইসব বিষয়ে আলোচনা করেছি যা বেশির ভাগ দার্শনিকদের লেখায় একটা বড় অংশ দখল করে থাকে। বেশির ভাগ দার্শনিকই পূর্বতসিদ্ধ অধিবিদ্যার অনুমান দিয়ে সেইসব বিষয় প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন, যেমন ধর্মের মূল নীতিগুলো, জগতের প্রয়োজনীয় বৌদ্ধিক বিষয়, দ্রব্যের ভ্রান্ত প্রত্যক্ষ, পাপের অসত্যতা ইত্যাদি। এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে এই ধরনের বক্তব্যের কারণ খুঁজে পাওয়ার আশাটা দর্শনের অনেক আজীবন ছাত্রের উৎসাহের মূল উৎসাহের মূল উৎস হয়ে থেকেছে। আমার মতে এই আশা হল নিষ্ফল। এটা মনে হয় যে জগতের সমগ্র জ্ঞান অধিবিদ্যার সাহায্যে পাওয়া যায় না এবং প্রস্তাবিত প্রমাণগুলো যুক্তিবিজ্ঞানের নীতির সাহায্য এই-এই বিষয় অবশ্যই থাকবে এবং এই-এই বিষয়গুলো থাকবে না-এর বিচারমূলক পরীক্ষণের দ্বারা টিকে থাকে না। এই অধ্যায়ে আমরা সংক্ষেপে সেই পথের কথা আলোচনা করব যেভাবে এই ধরনের যুক্তি দেয়ার চেষ্টা হয়েছে, এবং আমাদের উদ্দেশ্য হবে এটি আবিষ্কার করা যে এগুলো বৈধ হবে বলে আমরা আশা করতে পারি কিনা। . আধুনিককালে এই ধরনের মতের বড় প্রবক্তা হলেন হেগেল (১৭৭০ –১৮৩১), যার মত আমরা পরীক্ষা করতে চাই। হেগেলের দর্শন খুবই দুরূহ এবং ব্যাখ্যাকাররা এর যথার্থ ব্যাখ্যার ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন। আমি যে ব্যাখ্যা গ্রহণ করব তা সমস্ত ব্যাখ্যাকারদের মত না হলেও অনেকের মত, এবং যা এক গুরুত্বপূর্ণ দর্শন দেয়ার যোগ্যতা রাখে। তার প্রধান মত হল পূর্ণতা ছাড়া সমস্ত কিছুই অসম্পূর্ণ এবং স্বাভাবিকভাবেই জগতের থেকে পূরক না পেলে অস্তিত্বের অনুপযুক্ত। ঠিক যেভাবে একজন তুলনামূলক শারীরবিদ একটি হাড় থেকে দেখতে পান কি ধরনের জন্তুর শরীরের অংশ এটি, সেভাবেই একজন অধিবিদ্যাবিদ, হেগেলের মতে, সত্যের যে কোন অংশ থেকে দেখতে পান সত্যের সামগ্রিক রূপ আবশ্যিকভাবে কি হবে অন্তত তার রূপরেখাঁটি তো দেখতে পানই। সত্যের সব আপাত– ভিন্ন অংশের যেন এটি আঁকশী রয়েছে যা তাকে পরের অংশের সঙ্গে সংযুক্ত করে। পরবর্তী অংশের আবার নতুন আঁকশী থাকে, তার পরের অংশেরও, যতক্ষণ না সম্পূর্ণ জগৎ পুনর্গঠিত হয়। হেগেলের মতে এই আবশ্যিক অসম্পূর্ণতা সমভাবে চিন্তার জগৎ ও বিষয়ের জগতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। চিন্তার জগতে যদি আমরা এমন কোন ধারণা দিই যা বিমূর্ত ও অসম্পূর্ণ, তাহলে আমরা পরীক্ষার পর দেখি যে যদি আমরা এর অসম্পূর্ণতাকে ভুলে যাই, তাহলে আমরা বিরোধিতায় জড়িয়ে পড়ি; এই বিরোধিতাগুলো উক্ত ধারণাকে এর বিপরীতে বা বিরোধাভাসে পরিণত করে; এবং এর থেকে বাঁচার জন্য আমাদের এক নতুন ও কম অসম্পূর্ণ ধারণা খোঁজা প্রয়োজন যা আমাদের আসল ধারণা ও তার বিরোধাভাসে পরিণত করে; এবং যার সঙ্গে এটিকে অবশ্যই যুক্ত করতে হবে নতুন সংযুক্তিকরণে পৌঁছানোর জন্য। এভাবে হেগেল অগ্রসর হয়েছেন যতক্ষণ না তিনি পরম তত্ত্বে উপনীত হয়েছেন, তার কাছে যার কোন অসম্পূর্ণতা নেই, কোন বিরোধী নেই এবং আরও উন্নতি ঘটানোর কোন প্রয়োজন নেই। সুতরাং এই পরম ধারণা পরম সত্যকে ব্যাখ্যা করে যা আংশিকভাবে প্রতিভাত হয় এবং ব্যক্তির কাছে নয়, যে একইসঙ্গে সমগ্রকে পর্যবেক্ষণ করে। এভাবে হেগেল এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে পরম সত্য একটি একক ঐক্যবদ্ধ তন্ত্র তৈরি করে দেশ বা কালে নয়, যার কোন দোষের মাত্রা নেই, যা সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত ও সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক। অপরপক্ষে, তিনি বিশ্বাস করেন যে কোন দৃশ্যমান সত্তা, যাকে আমরা জানি, তা আমাদের জগৎ সম্পর্কে অসম্পূর্ণ জ্ঞান থেকেও যৌক্তিকভাবে প্রমাণ করা সম্ভব। যদি আমরা ঈশ্বর যেভাবে দেখেন সেভাবে জগৎকে সম্পূর্ণভাবে দেখি, তাহলে দেশ, কাল, জড় ও সমস্ত অশুভ শক্তি, সব ঝগড়া-বিবাদের অবসান হবে এবং এর পরিবর্তে আমরা শাশ্বত, সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত আত্মাকে (Spiritual unity) দেখব।
এই ধারণার মধ্যে অবশ্যই কোন অনস্বীকার্য মহত্ত্ব রয়েছে, এমন কিছু যাতে আমরা ধরা দিতে পারি, আত্মসমর্পণ করতে পারি। কিন্তু যখনই এর সপক্ষের যুক্তিগুলোকে সাবধানতার সঙ্গে করা হয়, তখনই দেখা যায় যে এদের মধ্যে অনেক জটিলতা ও আপত্তিকর মত রয়েছে। যে মূল শর্তের উপর এই মতবাদ গড়ে উঠেছে তাহল–যা অসম্পূর্ণতা অবশ্যই স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে না, অস্তিত্বের জন্য এটি অন্য বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। বলা হয় বিষয়ের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত যা কিছু বিষয়ের বাইরে থাকে তার উপরে অবশ্যই বিষয়ের বাইরের বস্তুর কিছু নির্দেশ থাকে এবং বিষয়টা যেভাবে রয়েছে তা হতে পারে না যদি না বাইরের বিষয়গুলোর অস্তিত্ব থাকে। উদাহরণস্বরূপ, একটি মানুষের স্বভাব গঠিত হয় তার স্মৃতি দ্বারা এবং বাদবাকী জ্ঞান, তার ভালবাসা, ঘৃণা ইত্যাদি দিয়ে। এভাবে যে বিষয় সে জানে, ভালবাসে ঘৃণা করে তা আবশ্যিকভাবে ও স্বাভাবিকভাবে হল খন্ডিত, সত্যকে সম্পূর্ণভাবে নিলে তা হবে স্ববিরোধী।
এই সম্পূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য বিষয়ের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে, যা বিষয় সম্পর্কে যাবতীয় সত্যতাকে বুঝায়। এটি অবশ্যই সঠিক যে, যে সত্য একটি বিষয়ের সঙ্গে অপর একটি বিষয়কে সংযুক্ত করে সেটি অপর বিষয়টি না থাকলে থাকতে পারে না। কিন্তু বিষয় সম্পর্কে সত্যতা বিষয়ের নিজস্ব অংশ নয়, যদিও উপরিউক্ত ব্যবহার অনুযায়ী অবশ্যই এটিকে বিষয়ের প্রকৃতির অংশ হতে হবে। যদি আমরা বিষয়ের প্রকৃতি বলতে বিষয়ের সমস্ত সত্যকে বুঝি, তাহলে স্বাভাবিকভাবে আমরা কোন বিষয়ের প্রকৃতিকে জানতে পারব না যতক্ষণ না আমরা জগতের সমস্ত বিষয়ের সঙ্গে অপর বিষয়ের সঙ্গে অপর বিষয়ের সম্পর্ককে জানকে পারছি। যদি প্রকৃতিকথাটি এই অর্থে ব্যবহৃত হয় তাহলে আমাদের বলতে হবে যে একটি বিষয়কে হয়তো জানা যাবে যখন তার প্রকৃতি জানা যাবে না বা কোনভাবেই সম্পূর্ণ করে জানা যাবে না। যখন প্রকৃতি এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়, তখন বিষয়ের জ্ঞান ও সত্যতার জ্ঞানের মধ্যে কিছু বিভ্রান্তি দেখা দেয়। আমাদের কোন বিষয়ের জ্ঞান পরিচিতির সাহায্যে হতে পারে, এমনকি আমরা এর সম্বন্ধে খুব অল্পই জানলেও তত্ত্বগতভাবে আমাদের এর সম্বন্ধে কোন বচনই জানার প্রয়োজন নেই। এভাবে উপরিউক্ত অর্থে বিষয়ের সঙ্গে পরিচিতি এর প্রকৃতিগত জ্ঞানে জড়ায় না। যদিও বিষয়ের সঙ্গে পরিচিতি কোন বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার জন্য প্রয়োজন, কিন্তু উপরিউক্ত অর্থে এর প্রকৃতিগত জ্ঞানের কোন প্রয়োজন নেই। এভাবে (১) বিষয়ের সঙ্গে পরিচিতি যুক্তিগতভাবে এর সম্বন্ধের জ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করে না, এবং (২) এর সম্বন্ধের কিছু জ্ঞান সমস্ত সম্বন্ধের জ্ঞান সম্বন্ধে অবহিত করে না বা উপরিউক্ত অর্থে এর জ্ঞানও দেয় না। উদাহরণস্বরূপ, আমি আমার দাঁতব্যথা সম্বন্ধে অবহিত থাকতে পারি এবং এই জ্ঞান পরিচিতির জ্ঞানের মতই সম্পূর্ণ হতে পারে–এর কারণ সম্পর্কে দন্তবিশারদ (যিনি এর সঙ্গে পরিচিত নন) যা বলবেন তা না জেনেও এর প্রকৃতি সম্বন্ধে না জেনে। অতএব, কোন বিষয়ের বিভিন্ন সম্বন্ধ আছে এই ঘটনা এটা প্রমাণ করে না যে সম্বন্ধগুলো যৌক্তিকভাবে আবশ্যিক। অর্থাৎ, বস্তুটির এটিই স্বভাব, এই ঘটনা থেকে বাস্তবিকভাবে এর যে বিভিন্ন সম্বন্ধে রয়েছে তা আমরা নিঃসৃত করতে পারি না। বিষয়গুলো এর থেকে অনুসৃত হয় বলে মনে হয় যেহেতু আমরা এটি আগে থেকেই জানি।
আমরা প্রমাণ করতে সক্ষম হই না যে জগৎ সম্পূর্ণভাবে একটি একক ঐক্যবদ্ধ তন্ত্র (System), যা হেগেল বিশ্বাস করতেন। যদি আমরা এটি প্রমাণ করতে না পারি তাহলে আমরা দেশ, কাল, বস্তু ও অশুভ জিনিসের অযথার্থতাও প্রমাণ করতে পারব না, কেননা হেগেল এই বিষয়গুলোর খণ্ডিত ও সম্বন্ধযুক্ত চরিত্র থেকেই এগুলো নিঃসৃত করেছিলেন। এভাবে আমরা জগতের খণ্ডিত অনুসরণে আটকে থাকি এবং জগতের সেসব অংশের সঙ্গে অপরিচিত থাকি যা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে বহু দূরে রয়েছে। এই ফলাফল তাদের কাছে নিরাশাজনক যাদের আশা দার্শনিক সম্প্রদায়ের দ্বারা জাগ্রত হয়েছে, কিন্তু এই ফলাফল আমাদের যুগের আরোহমূলক ও বৈজ্ঞানিক চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সমগ্রামনবজ্ঞানের পরীক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত, যে জ্ঞান প্রসঙ্গে পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলোতে আলোচনা করেছি আমরা।
বেশিরভাগ অধিবিদ্যাবিদ দার্শনিকরা প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে জগতের দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলো হল স্ববিরোধী এবং এই কারণে সত্য নয়। অবশ্য সমগ্র আধুনিক চিন্তাধারা এই চেষ্টাতে ব্যাপৃত যে এই স্ববিরোধিতাগুলো হল ভ্রমাত্মক এবং পূর্বতসিদ্ধভাবে খুব কম বিষয়েই প্রমাণ করা যেতে পারে যে বিষয়টি অবশ্যই কি হবে। এই বিষয়ের একটি ভাল উদাহরণ দেশ ও কাল দিয়ে দেয়া যেতে পারে। দেশ ও কাল হল অনন্ত বিস্তৃত ও অনন্ত খণ্ডিত। যদি আমরা একটি সমান্তরাল রেখার যে কোন দিকে যাই, তাহলে এটি বিশ্বাস করা খুবই অসুবিধাজনক হবে যে আমরা কোন শেষ সীমায় পৌঁছাতে পারব যার পরে আর কিছুই থাকবে না, এমনকি শূন্যস্থানও নয়। একইভাবে যদি আমরা কল্পনার সময়ের আগে বা পরে ভ্রমণ করি, তাহলে এটি বিশ্বাস করা খুবই কষ্টকর হবে যে আমরা প্রথম বা শেষ সময়ে পৌঁছাতে পারব যার পরে শূন্য কালও থাকবে না। এভাবে স্থান ও কাল হল অনন্ত বিস্তৃত।
আবার যদি আমরা একটি রেখার দুটি বিন্দু নিই, তাহলে এটি পরিষ্কার যে যতই কম দূরত্ব হোক না কেন এদের মধ্যে অবশ্যই আরো বিন্দু রয়েছে প্রতিটি দূরত্বকে ভাগ করা যায়, এই ভাগগুলোকে আবার ভাগ করা যায় এবং এভাবে চলতেই থাকে। একইভাবে সময়ের ক্ষেত্রেও যত ক্ষুদ্র সময়ই দুটি মুহূর্তের মধ্যে চলে যাক না কেন, এটি স্পষ্ট যে এদের মধ্যে আরও মুহূর্ত রয়েছে। এভাবে স্থান ও কাল অনন্তভাবে খণ্ডিত। কিন্তু এই সীমাহীন বিস্তৃত ও সীমাহীন খণ্ডিতের প্রেক্ষাপটের বিরুদ্ধে দার্শনিকরা এই যুক্তি দিয়েছেন যে বিষয়ের সীমাহীন সগ্রহ থাকতে পারে না এবং সেই কারণে স্থানগত বিন্দুর সংখ্যা বা কালের দৃষ্টান্ত অবশ্যই সীমাবদ্ধ হতে হবে। এভাবে দৃশ্যমান স্থান ও কালের প্রকৃতি ও সীমাহীন সগ্রহের অসম্ভাব্যতার মধ্যে বিরোধিতা দেখা দেয়।
কান্ট, যিনি প্রথম এই বিরোধিতায় জোর দিয়েছিলেন, তিনি স্থান ও কালের অসম্ভাব্যতা নিঃসৃত করে দেখিয়েছিলেন যে এগুলোর ধারণা হল নিছক ব্যক্তিগত, এবং তার সময় থেকে বহু দার্শনিকই বিশ্বাস করতেন যে স্থান ও কাল হল পরিদৃশ্যমান সত্তা যা এই জগতের আসল বৈশিষ্ট্য নয়। কিন্তু গণিতজ্ঞদের শ্রমের ফলে, বিশেষত গেয়র্গ ক্যানটরের কাজ থেকে দেখা গিয়েছে যে সীমাহীন সংগ্রহের অসম্ভাব্যতা হল একটি ভুল। তারা আসলে স্ববিরোধী নয়, বরং কিছু উদ্ধত মানসিক সংস্কারের বিরোধী। এভাবে স্থান ও কালকে অসত্য মনে করার কারণগুলো কাজ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে ও অধিবিদ্যার কাজের একটি প্রধান উৎস নষ্ট হয়ে যায়।
অবশ্য গণিতজ্ঞরা এটা দেখিয়েই সন্তুষ্ট নন যে সাধারণভাবে স্থানকে যা মনে করা হয় তা সম্ভব। তারা আরও দেখিয়েছেন যে অন্যান্য স্থানের ধারণাও একইভাবে সম্ভব, যতদূর যুক্তিবিজ্ঞান দেখাতে পারে। ইউক্লিডের কিছু সূত্র যা সাধারণ মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়, এবং পূর্বে দার্শনিকদেরও প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছিল, এখন জানা গেছে সেগুলো প্রয়োজনীয় উঠেছিল দৃশ্যমান কোন পূর্বতসিদ্ধ যৌক্তিক ভিত্তির মাধ্যমে নয়, বরং আমাদের সত্য স্থানের নিছক পরিচিতির মাধ্যমে। সেই ধরনের পৃথিবী কল্পনা করে যেখানে এই সূত্রগুলো মিথ্যা হতে পারে, গণিতজ্ঞরা যুক্তি ব্যবহার করেছেন সাধারণ মানুষের সংস্কারকে ঢিলে করতে এবং দেখাতে যে বিভিন্ন স্থান সম্ভব–কোনটি বেশি, কোনটি কম– তার থেকে যাতে আমরা বাস করি। এদের মধ্যে আমাদের পক্ষে পরিমাপযোগ্য দূরত্ব সম্পর্কিত কিছু স্থানের সঙ্গে ইউক্লিডের স্থানের পার্থক্য এতই কম যে শুধুমাত্র দেখার ভিত্তিতে বলা অসম্ভব আমাদের সত্য স্থানের ধারণা সম্পূর্ণভাবে ইউক্লিডিয়ান বা অন্য কোন ধরনের কিনা। এভাবে অবস্থান সম্পূর্ণভাবে উল্টে গেছে। পূর্বে অভিজ্ঞতা শুধুমাত্র একধরনের স্থানই যুক্তিবিজ্ঞানকে দিয়েছে এবং যুক্তিবিজ্ঞান এই ধরণকে অসম্ভব বলেছে। এখন যুক্তি বিজ্ঞান অভিজ্ঞতা ছাড়া বিভিন্ন ধরনের স্থানের ধারণা দেখাচ্ছে এবং অভিজ্ঞতা এদের মধ্যে শুধুমাত্র আংশিকভাবে স্থির করছে। এভাবে আমাদের যা আছে তার জ্ঞান পূর্বে যা ধরা হয়েছিল তার থেকে কম হচ্ছে, কিন্তু আমাদের কি হতে পারে তার জ্ঞানের আতিশয্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার সমস্ত আনাচ-কানাচ আবিষ্কার করা যায় এমন কোন ক্ষুদ্র গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ না থেকে, আমরা একটি মুক্ত জগতের স্বাধীন সম্ভাবনায় নিজেদের খুঁজে পাচ্ছি যেখানে বেশিরভাগই অজ্ঞাত, কেননা জানার বহু বিষয় রয়েছে।
স্থান ও কালের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা অন্য দিকেও কিছু অংশে ঘটেছে। পূর্বতসিদ্ধ নীতির সাহায্যে জগতের নিয়মকে নির্দিষ্ট করে দেয়ার প্রচেষ্টা ভেঙে পড়ছে; যুক্তিবিজ্ঞান পূর্বের মত সম্ভাব্যতার প্রাচীর না হয়ে কল্পনার মহান মুক্তিদাতা হিসেবে কাজ করছে, অসংখ্য বিকল্প হাজির করছে যা বিচারবিহীন সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং যেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব সেখানে অভিজ্ঞতার হাতে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার কাজ ছেড়ে দিচ্ছে অভিজ্ঞতা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বহু পৃথিবীর মধ্যে, যা যুক্তিবিজ্ঞান আমাদের পছন্দের উপর ছেড়ে দিয়েছে। এভাবে যা আছে তার জ্ঞান যা আমরা অভিজ্ঞতা থেকে শিখছি তার তুলনার সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে–তার উপরে নয় যা আমরা সত্যিই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানি, কেননা আমরা দেখেছি যে বিষয়ের বহু জ্ঞানই আমরা বর্ণনার সাহায্যে জানি যার কোন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। কিন্তু সমস্ত বর্ণনামূলক জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমাদের সামান্য সম্পর্কে কিছু যোগসূত্র থাকা চাই যা আমাদের এই ধরনের উপাত্ত থেকে অনুমান করতে সাহায্য করবে সেই বিষয়ের অস্তিত্বকে, যা আমাদের এই উপাত্ত দ্বারা নির্দেশিত হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বাহ্য বিষয়ের ক্ষেতে ইন্দ্রিয়-উপাত্ত হল বাহ্য বিষয়ের প্রতীক যা নিজে সামান্যের যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে এবং এটি শুধুমাত্র এই নীতির জন্যই যে অভিজ্ঞতা আমাদের বাহ্য বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করতে সাহায্য করে। এই একই বিষয় কার্যকারণ নীতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য অথবা কম সাধারণ নীতির ক্ষেত্রেও, যেমন মাধ্যাকর্ষণ নীতির ক্ষেত্রে।
মাধ্যাকর্ষণ নীতির মত নীতিগুলো প্রমাণিত হয়েছে বা বেশি সম্ভাব্য বলে দেখানো হয়েছে অভিজ্ঞতার সাহায্যে, পূর্বতসিদ্ধ নীতির মাধ্যমে, যেমন আরোহের নীতির মাধ্যমে। এভাবে আমাদের স্বজ্ঞাকৃত জ্ঞান, যা অন্যান্য সত্য জ্ঞানের উৎস হিসেবের পরিগণিত, তা হল দুধরনের : শুদ্ধ ব্যবহারিক জ্ঞান যা আমাদের জানায় কিছু বিশেষ বিষয়ের অস্তিত্ব এবং তার গুণাবলি যার সঙ্গে আমরা পরিচিত এবং শুদ্ধ পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞান যা আমাদের বিভিন্ন সামান্যের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে এবং আমাদের বিশেষ ঘটনা অনুমান করতে সাহায্য করে যা ব্যবহারিক জ্ঞানে পাওয়া যায়। আমাদের গৌণ জ্ঞান (Derivative knowledge) সবসময় কিছু শুদ্ধ পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞানের উপর নির্ভর করে এবং সাধারণত কিছু শুদ্ধ ব্যবহারিক জ্ঞানের উপরেও নির্ভর করে।
উপরে যা বলা হয়েছে তা যদি সত্য হয় তাহলে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সঙ্গে দার্শনিক জ্ঞানের খুব একটা পার্থক্য দেখা যায় না। এরকম কোন বিশেষ জ্ঞানের উৎস দর্শনের ক্ষেত্রে ভোলা নেই যা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নেই এবং দর্শনের ফলাফলও বিজ্ঞানের ফলাফলের থেকে খুব একটা আলাদা নয়। দর্শনের আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য হল বিচার যা একে বিজ্ঞানের থেকে আলাদা করেছে। বিজ্ঞান ও প্রাত্যহিক জীবনের নীতিগুলোকে বিচারপূর্ণভাবে পরীক্ষা করে দর্শন। এটি এসব নীতিগুলোর মধ্যে কোন অসামঞ্জস্য থাকলে তা খোঁজে এবং তখনই এই নীতিগুলোকে গ্রহণ করে যখন বিচারপূর্বক অনুসন্ধান চালিয়ে দেখে যে এদের বাদ দেয়ার কোন কারণ নেই। অনেক দার্শনিক যেমন বিশ্বাস করেন সেইভাবে বিজ্ঞানের অন্তর্গত নীতিগুলো, অপ্রাসঙ্গিক তথ্যগুলো বাদ দিলে, যদি সমগ্র জগৎ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান দিতে সক্ষম হয়, তাহলে এরকম জ্ঞানের সেই একই ধরনের দাবি থাকবে যে রকম বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের উপর আমাদের বিশ্বাস রয়েছে; কিন্তু আমাদের অনুসন্ধান এরকম ধরনের কোন জ্ঞান প্রকাশ করেনি, সুতরাং সাহসি অধিবিদ্যাবিদ দার্শনিকদের বিশেষ মতবাদগুলোর প্রধানত নঞর্থক ফলই হয়েছে। কিন্তু যাকে সাধারণত জ্ঞান বলে স্বীকার করা হয়, সেই সম্পর্কে আমাদের প্রত্যাশা প্রধানত সদর্থকই হয়েছে: আমরা কদাচিৎ আমাদের সমালোচনার ফলেই এই ধরনের জ্ঞানকে বাদ দেয়ার কারণ খুঁজে পেয়েছি। এছাড়া আমাদের মনের করার কোন কারণ নেই যে মানুষ এই ধরনের জ্ঞান লাভ করতে অসমর্থ যা সাধারণত তার আছে বলে মনে করা হয়।
অবশ্য যখন আমরা দর্শনকে জ্ঞানের বিচার (Criticism কথাটি এখানে বিচার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে) বলে বর্ণনা করি, তখন কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন। যদি আমরা সন্দেহবাদীদের আচরণ গ্রহণ করি, নিজেদেরকে জ্ঞানের সম্পূর্ণ বাইরে রাখি এবং এই বাইরের অবস্থান থেকে প্রশ্ন করি, জ্ঞানের বৃত্তে ফিরতে বাধ্য হতে চাই, তাহলে আমরা যা অসম্ভব তা-ই চাইছি এবং সেক্ষেত্রে আমাদের সন্দেহবাদকে কখনই খন্ডন করা যাবে না। কেননা সমস্ত খন্ডনই অবশ্যই কিছু জ্ঞান দিয়ে শুরু হয় যা সব বিতর্কবাদীরা গ্রহণ করে, শূন্য সন্দেহ থেকে কোন যুক্তি শুরু হতে পারে না। সেই কারণে জ্ঞানের বিচার, যে কাজে দর্শন ব্যাপৃত, অবশ্যই ধ্বংসাত্মক ধরনের হতে পারে না–যদি কোন ফলাফলে পৌঁছাতে হয়। এই ধরনের নিরঙ্কুশ সন্দেহবাদের মধ্যে কোন যৌক্তিক তর্ক এগোতে পারে না। কিন্তু এটা দেখা কষ্টকর নয় যে এই ধরনের সন্দেহবাদ হল অযৌক্তিক। ডেকার্টের প্রনালীবদ্ধ সন্দেহ, যা থেকে আধুনিক দর্শনের শুরু, এরকম ধরনের নয়, বরং তা এমন ধরনের বিচার যাকে আমাদের দর্শনের সার বলে মেনে নিই। তাঁর প্রণালীবদ্ধ সন্দেহ হল যা কিছু সন্দেহজনক তাতে সংশয় প্রকাশ করা; প্রত্যেক খন্ডিত জ্ঞানের ক্ষেত্রে বিরাম নিয়ে, নিজেকে গভীর চিন্তার মাধ্যমে প্রশ্ন করে যে সে নিশ্চিত হতে পারছে কিনা যা সে জানে তা সত্যিই জানে কিনা। এই ধরনের বিচার দর্শনকে তৈরি করে। কিছু জ্ঞান, যেমন আমাদের ইন্দ্রিয়-উপাত্তের অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান, সম্ভবত সন্দেহের ঊর্ধ্বে, যতই আমরা এর সম্বন্ধে শান্তভাবে ও গভীরভাবে চিন্তা করি না কেন, এই ধরনের জ্ঞানের ক্ষেত্রে দার্শনিক বিচারের প্রয়োজন হয় না যে আমরা এই ধরনের বিশ্বাস থেকে দূরে থাকি। কিন্তু কিছু বিশ্বাস আছে, যেমন বাহ্য বিষয়, যা সম্পূর্নভাবে আমাদের ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সঙ্গে মেলে-যেগুলো মেনে নেয়া হয় যতক্ষণ না আমরা গভীরভাবে চিন্তা করা শুরু করি, কিন্তু গভীর অনুসন্ধান করলেই তা অন্তর্হিত হয়। এই ধরনের বিশ্বাসকে দর্শন প্রত্যাখ্যান করতে বলে, যতক্ষণ না এদের সমর্থন করার সোন নতুন যুক্তি পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু গভীর পর্যবেক্ষণেও যে বিশ্বাসগুলোর কোন আপত্তিযোগ্যতা পাওয়া যায় না, সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করা যুক্তিসঙ্গত নয় দর্শনও তা চায় না।
এক কথায়, যে বিচারের লক্ষ্য রয়েছে তা কোন কারণ ছাড়া প্রত্যাখ্যান করা নয়, বরং যা প্রতিটি জ্ঞানের মত অংশকে তার যোগ্যতার ভিত্তিতে বিবেচনা করে এবং সেগুলোকে জ্ঞান হিসেবে রাখে যখন এই বিবেচনা সম্পূর্ণ হয়। কিন্তু কিছু ভুলের সম্ভাবনা অবশ্যই থেকে যায় যেহেতু মানুষেরা ভুল করতেই পারে। দর্শন ন্যায়সঙ্গতভাবে দাবি করে যে এটি ভুল কমাতে সক্ষম এবং কিছু ক্ষেত্রে এটি ভুলের সম্ভাবনা এত কমিয়ে আনে যে তাতে বাস্তবিকপক্ষে নজর না দিলেও চলে। এর থেকে বেশি কিছু জগতে করা সম্ভব নয় যেখানে ভুল আবশ্যিকভাবে ঘটেই; এই দর্শনের কোন বিজ্ঞ ব্যক্তিই এর থেকে বেশি দাবি করতে পারেন না।