১৪. দারুচিনি দ্বীপে জোছনার ফিনিক ফুটেছে

দারুচিনি দ্বীপে জোছনার ফিনিক ফুটেছে। দ্বীপের চারপাশের জলরাশিতে প্রতিফলিত হচ্ছে চাঁদের আলো! এই আলো স্থলভূমির আলোর চেয়েও অনেক রহস্যময়। তীব্ৰ অথচ শান্ত। এই আলো কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে সরাসরি হৃদয়ের অন্ধকার কুঠরিতে চলে যায়। মানুষের মনে তীব্র এক হাহাকার জেগে ওঠে। সেই হাহাকারের কারণ মানুষ জানে না। প্রকৃতি তার সব রহস্য মানুষের কাছে প্ৰকাশ করে না।

শুভ্র বসেছে একেবারে জরীর গা ঘেষে। জরীর অন্য পাশে আনুশকা। তাদের কাছ থেকে অনেকটা দূরে সমুদ্রের কাছাকাছি মুনা আছে। মোতালেব এবং রানা অস্থির ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করছে। তাদের দৃষ্টি বড় একটা প্রবাল খণ্ডের উপর বসে থাকা পাগলী মেয়েটির দিকে। মেয়ের ভাবভঙ্গি ভালো লাগছে না। মাথা ঠিক নেই কখন কি করে বসে। হয়তো ঝাপ দিয়ে সমুদ্রে পড়ে গেল।

আনুশকা শুভ্রের দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন লাগছে শুভ্র?

খুব খারাপ লাগছে।

আনুশকা বিস্মিত হয়ে বলল, খারাপ লাগছে কেন?

শুভ্র সহজ গলায় বলল, এত সুন্দর পৃথিবী। কিন্তু আমি এই সুন্দর বেশিদিন দেখব না। আমার চোখ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর অল্প কিছুদিন, তারপর আমি সত্যি সত্যি কানা-বাবা হয়ে যাব।

জরী বলল, কি বলছ তুমি?

সত্যি কথা বলছি। আমি তো কখনো মিথ্যা বলি না। যার নাম শুভ্র সে মিথ্যা বলবে কি করে? আমার চোখের নার্ভ শুকিয়ে যাচ্ছে।

আনুশকা বলল, এই প্রসঙ্গটা থাক। অন্য কিছু নিয়ে কথা বলা যাক। এসো আমরা সবাই আমাদের জীবনের একটা সুন্দর অভিজ্ঞতার গল্প বলি। ডাকো ডাকো সবাইকে ডাকো। এই তোমরা আসো।

সবাই এলো। শুধু পাগলী বসে রইল। পাথরের উপর। আমি আমার জীবনের একটা সুন্দর অভিজ্ঞতার গল্প বলব-তারপর তোমরা বলবে। তারপর সবাই মিলে হাত ধরাধরি করে সমুদ্রে নামব। গল্পটা হচ্ছে—ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর আমার মা মারা যান। আমি খুব একলা হয়ে পড়ি। তখন আমার বাবা প্রায়ই আমাকে নিয়ে গ্রামে ঘুরতে যেতেন। একবার নেত্রকোনার এক গ্রামে গিয়েছি। সন্ধ্যাবেলা এক বাউলের ঘরে বাবা আমাকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। কি যে সুন্দর সেই বাউলের চেহারা—অবিকল শুভ্রর মতো। বড় বড় চোখ, কি অদ্ভুত দৃষ্টি। বাবা বললেন—আমার এই মেয়ের মনটা খুব খারাপ। আপনি গান গেয়ে আমার মেয়েটার মন ভালো করে দিন। বাউল এক আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গান ধরল-

তুই যদি আমার হইতি
আমি হাইতাম তোর।
কোলেতে বসাইয়া তোরে করিতাম আদর
বন্ধুরে …

কি যে অদ্ভুত গান—আমার শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। ইচ্ছে করল। কাঁদতে কাঁদতে বাউলকে বলি-আমি আপনার কোলে বসছি-নিন আমাকে আদর করুন।

বলতে বলতে আনুশকার চোখে পানি এসে গেল। সে চোখ মুছল না। জলভরা চোখে জরীর দিকে তাকিয়ে হাসল।

জরী ছটফট গলায় বলল, আমার কেমন জানি লাগছে। শুভ্ৰ, আমার কেমন জানি লাগছে।

আনুশকা জরীর হাত ধরে ফেলল। ভীত গলায় বলল, তুই এমন করছিস কেন? তোর হাত-পা-কাঁপছে!

জরী বলল, তুই আমার হাত ছাড়, আমি সমুদ্রে নামব।

অসম্ভব! আমি তোকে ছাড়ব না।

নীরা বলল, পাগলী মেয়েটাকে তো দেখছি না। ও কোথায়?

মোতালেব আঙুলের ইশারা করে দেখাল—ঐ তো, মেয়েটা সমুদ্রের ধার ঘেঁষে ছুটে যাচ্ছে।

আনুশকা বলল, ওকে তোমরা আটকাও। কী করছে এই মেয়ে?

মোতালেব অস্বস্তির সঙ্গে বলল, আনুশকা মেয়েটার কাছে তুমি একা যাও। বুঝতে পারছি না ও সব কাপড় খুলে ফেলেছে? ও নগ্ন হয়ে দৌড়াচ্ছে।

আনুশকা বলল, তোমরা আমার সঙ্গে আসো। আমার একা যেতে ভয় লাগছে। কী হচ্ছে এসব?

আনুশকা ছুটে যাচ্ছে। পাগলী মেয়েটার খিলখিল হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। আনুশকার পেছনে পেছনে যাচ্ছে মোতালেব এবং রানা।

জরী বলল, শুভ্ৰ, সমুদ্রে নামবো? এসো।

শুভ্র বলল, এখন সমুদ্রে নেমো না জরী। আমার কেন জানি ভালো লাগছে। না। যদি নামতে হয় আমরা সবাই হাত ধরাধরি করে একসঙ্গে নামব।

না, আমি এখন নামব।

প্লিজ জরি, প্লিজ।

 

মধ্যরাতে তারা সবাই হাত ধরে একসঙ্গে সমুদ্রে নামল। আনুশকা বলল, তোমরা সবাই তোমাদের জীবনের সবচে’ কষ্টের কথাটা সমুদ্রকে বলো। আমরা আমাদের সব কষ্ট সমুদ্রের কাছে জমা রেখে ডাঙায় উঠে আসব। বলো বলো মুনা, তুমি প্রথম বলো–

মুনা শান্ত গলায় বলল, আমার কোনো দুঃখ নেই।

মুনার কথা শেষ হবার আগেই সমুদ্রের একটা বড় ঢেউ এসে সবাইকে ভিজিয়ে দিল। সমুদ্র মনে হয় মিথ্যা কথা বুঝতে পারে। পাগলী মেয়েটি হেসে উঠল খিলখিল করে।

শুভ্ৰ হঠাৎ আতঙ্কিত গলায় বলল, আচ্ছা, জোছনা হঠাৎ কমে গেল কেন?

জোছনা কমে নি, জোছনা আরো তীব্র হয়েছে। মনে হচ্ছে সারা দ্বীপে হঠাৎ করে সাদা রঙের আগুন লেগে গেছে। কিন্তু শুভ্ৰ কিছু দেখতে পাচ্ছে না কেন? শুভ্রের হাত ধরে জরী দাঁড়িয়ে-এত কাছে, কিন্তু কই—জরীকে সে তো দেখতে পাচ্ছে না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *