দরজায় বেল শুনে দৌড়ে এসে খুলে দিল টুনটুনি, আগন্তুককে দেখেই সে কাঠ হয়ে গেল। বাড়িওয়ালার ছেলে পরেশ। সাদা প্যান্টের ওপর ভোয়ালের মতন কাপড়ের টি শার্ট পরা, ঘাড়ে পাউডার, চোখে হাল্কা নীল রঙের রোদ চশমা। টুনটুনির দিকে কয়েক পলক স্থিরভাবে তাকিয়ে থেকে সে চশমাটা খুললো, তার একটা চোখ টকটকে লাল, থুতনিতে স্টিকিং প্লাস্টার। সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের মতন বললো, আমি প্রতাপবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
টুনটুনি কিছু বলার আগেই সে ভেতরে ঢুকে এসে একটা বেতের চেয়ারে বসলো এবং সিগারেট ধরালো। টুনটুনির বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করছে, সে দাঁড়িয়েই রইলো দরজার কাছে।
পরেশ হুকুমের সুরে বললো, প্রতাপবাবুকে খবর দাও, আমার তাড়া আছে!
মামাকে ডাকবার আগে টুনটুনি চলে এলো মুন্নির কাছে। খাটের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে একরাশ বই ছড়িয়ে পড়াশুনো করা স্বভাব মুন্নির বাবলুর ঘরটা এখন মুন্নির দখলে। তার পিঠে লাল রঙের ব্লাউজের ওপর খোলা চুল ছড়ানো। টুনটুনি খাটের পাশে বসে পড়ে ফিসফিস করে বললো, এই মুন্নি, এই মুন্নি, সে এসেছে!
সপ্তম শতাব্দীর ইতিহাস থেকে মন ফিরিয়ে এনে মুন্নি তাকালো টুনটুনির দিকে। টুনটুনির মুখখানা ভয়ে সরু হয়ে গেছে, চোখদুটিতে রাজ্যের উৎকণ্ঠা।
মুন্নি বললো, এসেছে তো কী হয়েছে, তাকে কী বললো?
–আমাকে কিছু বলেনি। মামার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
–বাবাকে ডেকে দে!
–এই মুন্নি, ও যদি মামাকে সব কথা বলে দেয়!
মুন্নির চোখে এখনও সপ্তম শতাব্দীর ঘোর। হঠাৎ তার বাবাকে মনে হলো কোনো রাজ্যহীন প্রৌঢ় রাজার মতন। কপাট বক্ষে চামড়ার বর্ম, কোমরে তলোয়ার, ক্রোধদীপ্ত চক্ষু, বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি দেবার জন্য তাঁর ওষ্ঠে শপথের কঠোর ভঙ্গি। সে হেসে বললো, বলুক না বাবাকে, বলুক, তারপর ও ঠ্যালা বুঝবে। বসবার ঘরের দেয়ালে একটা চাবুক ঝুলছে দেখিসনি!
–মুন্নি, তুই একটু গিয়ে মামাকে বল!
–আমি এখন উঠতে পারবো না। যাঃ, অত ভয়ের কী আছে? বাবা তোকে কিছু জিজ্ঞেস করলে সব সত্যি কথা বলবি! তবে দ্যাখ, ও বোধহয় তাকে বিয়ে করতে চায়!
প্রতাপ যখন বসবার ঘরে ঢুকলেন তখনও পরেশের সিগারেট শেষ হয়নি, কিন্তু আর টান না। দিয়ে সেটা সে অ্যাসট্রেতে গুঁজে দিল। টুনটুনির সামনে প্রতাপবাবু বললেও এখন সে অস্পষ্টভাবে বললো, কাকাবাবু, আপনার কাছে একটা বিশেষ দরকারে এসেছি।
প্রতাপ বললেন, হুঁ, বসো। তোমার বাবা কেমন আছেন? মাথা নীচু করে অ্যাশট্রেটা ঘোরাতে ঘোরাতে পরেশ বললো, এখন ভালো আছেন। কাকাবাবু, শুনেছেন বোধহয়, আমার দিদির বিয়ের চেষ্টা চলছিল অনেকদিন ধরে, এবারে ঠিক হয়েছে। এই সামনের মাসেই
প্রতাপ স্পষ্টত খুশী হয়ে বললেন, তাই নাকি, বাঃ, শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে তাহলে? কোথায় ঠিক হলো? পাত্র কী করে?
–সায়েন্স কলেজের রীডার। দিদির সঙ্গে একসঙ্গেই… মানে, কাকাবাবু, বলছিলুম কী।
–তোমার বাবাকে বলল, খুব খুশী হয়েছি। হ্যাঁ যাবো, নিশ্চয়ই যাবো, কত তারিখ পড়েছে?
–তারিখ এখনো ঠিক হয়নি, মানে, আমি আজ…
এ বাড়ির মালিক জ্ঞানাঞ্জন গুহনিয়োগীর সঙ্গে প্রতাপের পরিচয় বহুদিনের। ক্রিমিন্যাল কেসের উকিল হিসেবে একসময় বেশ নাম করেছিলেন এবং প্রচুর টাকা। কলকাতা শহরে তাঁর তিনখানা বাড়ি। দৃষ্টিশক্তি খুবই ক্ষীণ হয়ে যাওয়ায় তিনি ওকালতি বন্ধ করে দিয়েছেন অনেক আগেই। তাঁর ছেলেরা কেউ বাবার পেশা নেয়নি, তারা লেখাপড়ায় সুবিধে করতে পারেনি, বরং তাঁর মেজোমেয়ে সুমিতা ন্যাশনাল স্কলার হয়েছিল। এখন সে অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিকসে পি এইচ ডি করে সায়েন্স কলেজে পড়াচ্ছে। সুমিতাকে দেখতেও বেশ সুশ্রী, কিন্তু সে জেদ ধরেছিল কিছুতেই বিয়ে করবে না। এই নিয়ে জ্ঞানাঞ্জনবাবু অনেকবার আক্ষেপ করেছেন প্রতাপের কাছে। যে পিতার আর্থিক সঙ্গতি আছে, তিনি মেয়ের বিয়ে দিতে না পারলে যেন সমাজে অপদস্থ হয়ে যান। ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দেওয়া গেল না, তাহলে আর এত টাকা রোজগার করে লাভ কী হলো!
কিন্তু পরেশ তার দিদির বিয়ের নেমন্তন্ন করতে আসেনি। এ বাড়িতে সে সিগারেট ধরিয়ে ঢোকেনি আগে কখনো, আজ তার চালচলন অন্যরকম। প্রতাপের সামনে প্রাথমিক জড়ত। কাটিয়ে উঠে সে এবার বললো, কাকাবাবু, আমি অন্য একটা কথা বলতে এসেছিলুম।
–বলো!
–দিদির বিয়ে ঠিক হয়েছে… আমাদের এখন খুব জায়গার টানাটানি, তাই এই বাড়িটা আমাদের লাগবে। সেইজন্যই বলছিলাম, আপনারা যদি একটা অন্য বাড়ি খুঁজে নেন।
সামান্য একটা ছোট একতলা বাড়ি, জ্ঞানাঞ্জন গুহ নিয়োগীর অন্য সম্পত্তির তুলনায় অতি নগণ্য। বউবাজারে তাঁর অন্য একটি বাড়িতে তিরিশ ঘর ভাড়াটে। সম্প্রতি নিউ আলিপুরে আর একটি জমি কিনেছেন। প্রতাপ অবিশ্বাসের হাসি নিয়ে বললেন, তোমার দিদির বিয়ের জন্য এই বাড়ি লাগবে কেন, পাত্রটি কি ঘরজামাই হতে চায় নাকি?
পরেশ নিরস স্বরে বললো, এ বাড়িতে আমাদের কিছু আত্মীয়স্বজন এসে থাকবে বিয়ের সময়, তার আগে বাড়িটা মেরামত করতে হবে!
প্রতাপ বললেন, বাড়িটা বিক্রি করতে চাও নাকি? জমির দাম যেরকম হু হু করে বাড়ছে, এই বাড়িটাই ভেঙে যদি এখানে একটা তিন চারতলা তুলতে পারো, লাভ হবে অনেক বেশী! তাই করতে বলো না বাবাকে। আমাদের একটা ফ্ল্যাট দিও।
–কাকাবাবু, সেরকম কোনো প্ল্যান আমাদের নেই এখন। নিজেদের লোকজনদের জন্যই লাগবে।
–আমাদের তুলে দিতে চাইছো? বেশ তো, যাবো।
–আপনারা যদি এ মাসের মধ্যেই—
–এ মাসের মধ্যেই কোথায় যাবো? অন্য একটা বাড়ি খুঁজে পেতে হবে তো!
–দিদির বিয়ে সামনের মাসের দশ বারো তারিখের মধ্যেই পড়বে, তার আগে এ বাড়িটা সরিয়ে না নিলে, …আমি বাইরে থেকে দেখছিলুম, বিচ্ছিরি চেহারা হয়েছে! সব ভাড়াটেরাই বাড়ির এত অযত্ন করে!
প্রতাপ ভুরু কুঁচকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন পরেশের দিকে। তার মধ্যেই তাঁর একটা কথা মনে পড়ে গেল। বছর তিনকে আগে এই পরেশের ঠিক ওপরের ভাই ধীরেশ এইরকমভাবে প্রতাপের কাছে এসে বাড়ি ছেড়ে দেবার খুব বায়নাক্কা ধরেছিল। প্রতাপ তখন জ্ঞানাঞ্জনবাবুর সঙ্গে দেখা করতেই তিনি সব শুনে অবাক হয়েছিলেন এবং ধমক দিয়েছিলেন নিজের ছেলেকে। যে-ভাড়াটে নিয়মিতভাবে ভাড়া দিয়ে যায়, তাকে যে হুট করে তুলে দেওয়া যায় না, তা তিনি নিজে ঝানু উকিল হয়ে ভালোই জানেন।
প্ৰতাপ বললেন, তোমার বাবার সঙ্গে এক জজের শ্রাদ্ধবাড়িতে দেখা হলো গত সপ্তাহে, কই তিনি তো কিছু বললেন না। অনেকক্ষণ গল্প করলেন আমার সঙ্গে!
পরেশ বললো, বাবা আর এখন এসব নিয়ে মাথা ঘামান না। প্রপার্টির ব্যাপারগুলো আমিই দেখাশুনো করছি! আপনাকে কাকাবাবু এমাসের মধ্যেই বাড়ি ছাড়তে হবে। আমি ঠিক করেছি…
–তুমি কী ঠিক করেছে, তা আমার শোনার আগ্রহ নেই পরেশ। বাপের সম্পত্তি দেখাশোনা করছে, বেশ ভালো কথা, তার আগে সব নিয়মকানুন শিখে নাও! আধখানা মাসের মধ্যে কোনো ভাড়াটেকে তুলে দেবার নোটিশ দেওয়া যায়?
-–ঠিক আছে, আজ তো মাসের ছ’ তারিখ। আপনাকে আগামী মাসের ছ’ তারিখ পর্যন্ত টাইম দিচ্ছি!
–তুমি বোধহয় জানো না, তোমার বাবা আমাকে নিজে ডেকে এনে এই বাড়ি ভাড়া দিয়েছিলেন। এখনও ভাড়ার রশিদে তাঁর সই থাকে। তোমার কোনো কথা আমি শুনতে চাই না। তোমার বাবার কাছ থেকে চিঠি নিয়ে এসো, কিংবা, তোমার কাছে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি আছে? কই দেখি?
–কাকাবাবু, এসব কথা তুললে শুধু ঝামেলা বাড়বে। এ বাড়ি আপনাদের এবার ছেড়ে দিতে হবেই। এত কম ভাড়ায় ভাড়াটে রাখলে আমাদের হেভি লস্।
এই পরেশকে অনেক ছোট বয়েস থেকে দেখছেন প্রতাপ। একবার ওকে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল, সেখান থেকে পালিয়ে আসে। আর একবার তাকে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল বেহালার একটি কারখানায় অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে। জ্ঞানাঞ্জনবাবু চেয়েছিলেন, তাঁর ছেলেরা খেটে খেতে শিখুক, কিন্তু কিছুতেই তা হবার নয়, ওরা অল্প বয়েস থেকেই বাবার টাকার স্বাদ পেয়ে গেছে।
প্রতাপ বললেন, ঝামেলা বাড়বে মানে? একবার তোমার দাদা এই নিয়ে বাঁদরামি করতে এসেছিল, তোমার বাবা তাকে শুধু মারতে বাকি রেখেছিলেন। সে এখন গেল কোথায়? তুমিও কি তার পথ ধরেছে নাকি? অন্য বাড়ি পছন্দ হলে এ বাড়ি ছেড়ে দেবো, এক মাস দু’মাসের মধ্যে ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না।
–এখানে এত কম ভাড়ায় আছেন, এরপর আর কোনো বাড়িই আপনাদের পছন্দ হবে না। সব ভাড়াটেই এই কথা বলে, আমি জানি, এই বলে টাইম পাস করে।
–তুমি বেশি পাকা পাকা কথা বলছে, পরেশ! তোমার বাবার সই করা নোটিস দাও আগে, তারপর দেখবো কবে উঠে যাওয়া যায়।
–তাহলে আর বাবার চিঠি নয়, আপনাকে উকিলের চিঠিই পাঠাবো! মানে পাঠাতে বাধ্য হবো! উইথ ওয়ান মানথস নোটিস!
দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো প্রতাপের মাথায়। প্রায় থাপ্পড় মারার জন্য হাত উঠিয়েছিলেন তিনি, অতি কষ্টে সামলে বললেন, কী, তুমি আমাকে উকিলের চিঠির ভয় দেখাচ্ছো? বেয়াদপি করতে এসেছো এখানে? জ্ঞানাঞ্জনবাবু একজন সজ্জন, ভদ্রলোক, তার যত কুলাঙ্গার সন্তান! বেরোও, বেরোও এখান থেকে!
পরেশও উঠে দাঁড়িয়ে বললো, দেখুন, চোখ রাঙাবেন না! ওসব ঢের দেখা আছে। আপনার সঙ্গে এতক্ষণ সম্মান করে কথা বলেছি… আপনি বেরুতে বলছেন কাকে? এটা আমার নিজের বাড়ি!
প্রতাপ বললেন, বাড়ি একবার ভাড়া দিলে সে বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে বিনা অনুমতিতে বাড়িওয়ালার ঢোকার অধিকার থাকে না। তুমি খবর্দার আর এ বাড়িতে ঢুকবে না! যাও, আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও…
চ্যাঁচামেচি শুনে ছুটে এলেন মমতা। স্বামীকে আড়াল করে বললেন, আঃ, কী শুধু শুধু মাথা গরম করছো! চুপ করো তো। কী হয়েছে পরেশ? বসো, বসো, একটু চা খাবে তুমি?
পরেশ ঠোঁট বেঁকিয়ে বললো, চ্যা? এখন আমাকে চা খেতে বলছেন! আপনারা যতদিন থাকবেন, ততদিন এ বাড়িতে আমি পেচ্ছাপও করতে আসবো না। আর এ কথাও বলে দিচ্ছি, এই মাসের মধ্যে বাড়ি না ছেড়ে দিলে আপনাদের আমি রাস্তায় দাঁড় করিয়ে ছাড়বো! যদি না পারি, তাহলে আমার নাম পরেশ গুহ নিয়োগী নয়! সব জিনিসপত্র ছুঁড়ে ছুঁড়ে রাস্তায় ফেলে দেবো। যদি হিম্মৎ থাকে, আমায় রুখবেন!
অতি নাটকীয় ভঙ্গিতে সে দড়াম করে দরজা ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেল!
প্রতাপ বললেন, আমাকে থ্রেট করে গেল? এক্ষুনি থানায় ডায়েরি করবো, ওর নামে ক্রিমিন্যাল কেস আনবো! একটা হতচ্ছাড়া বাঁদর।
মমতা বললেন, কী হচ্ছে কী? প্লিজ চুপ করবে একটু! তোমার হাই প্রেসার, এরকম বাড়াবাড়ি করলে… তুমি ছেলেটাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বললে কেন? এটা তোমার অন্যায়
মমতাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে প্রতাপ তখনই বাইরে যেতে উদ্যত হয়েছিলেন, হঠাৎ তাঁর মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো। তিনি বসে পড়লেন চেয়ারে।
টুনটুনি আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনছিল, সে এবার মুন্নির কাছে এসে কেঁদে ফেললো। তার মনে ক্ষীণ আশা জেগে ছিল, হয়তো পরেশ তাকে বিয়ে করার প্রস্তাবই দেবে!
মুন্নি আবার ফিরে গেছে সুদূর অতীতে, বাইরের ঘরের গোলমাল তার কানে আসেনি। সে টুনটুনিকে দেখে বললো, কী হলো রে, সব ঠিক হয়ে গেল?
টুনটুনি বললো, ঐ লোকটা মামাকে অপমান করলো, খারাপ খারাপ কথা বললো। এই মুন্নি, মামা অজ্ঞান হয়ে গেছে!
রাজ্যহীন, অভিমানী প্রৌঢ় রাজার মুখখানা আবার ভেসে উঠলো মুন্নির চোখে। এইসব রাজারা বারবার লাঞ্ছিত, অপমানিত হন বটে, কিন্তু শেষপর্যন্ত ঠিকই জিতে যান!
টুনটুনির সঙ্গে মুন্নিও চলে এলো বাবাকে দেখতে। প্রতাপ অজ্ঞান হয়ে যাননি বটে, কিন্তু চোখ বুজে মাথা এলিয়ে বসে আছেন পরেশেরই পরিত্যক্ত চেয়ারে। পাখাটা ফুল স্পীডে চালিয়ে দিয়ে মমতা হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তাঁর কপালে। প্রতাপের ঠোঁটের দু’পাশ কেঁপে কেঁপে উঠছে।
মুন্নি তাকালো টুনটুনির দিকে, এবারে আসল ঘটনাটা আর গোপন রাখা যায় না।
একটু বাদে প্রতাপ অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠে স্নান করতে গেলে মুন্নি মমতাকে ডেকে বললো, মা শোনো, একটা কথা আছে!
ঘটনাটা ঘটেছে মাত্র দু’ দিন আগে।
কলেজে ভর্তি হয়েও টুনটুনির পড়াশুনায় মন যায়নি। সে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। তাকে সামলানোর দায়িত্ব মুন্নির, যদিও সে টুনটুনির চেয়ে বয়েসে ছোট। টুনটুনিকে বিয়ে দেবার চেষ্টা হচ্ছে, কিন্তু এখনো ঠিক হয়নি কিছু।
দু’দিন আগে সন্ধেবেলা টিউশানি সেরে ফেরার পথে মুন্নি হঠাৎ দেখতে পেয়েছিল টুনটুনি পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে এই পরেশের সঙ্গে, হাজরা পার্কের পাশে। মুন্নি শুধু অবাক হয়নি, রেগেও গিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে। এই পরেশের দাদা ধীরেশের সঙ্গে বাবলুর একবার হাতাহাতি হয়েছিল, কারণ সে একটা খারাপ কথা বলেছিল ফুলদির নামে। পরেশটাও বদ ছেলে, মুন্নি জানে, সে মেয়েদের দিকে বিশ্রীভাবে তাকায়। এই পরেশের সঙ্গে কোথায় যাচ্ছে টুনটুনি!
সন্ধেবেলা রাস্তায় অনেক মানুষজন, তাই মুন্নি ভয় পায়নি, সে সোজা ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলেছিল, এই টুনটুনি, বাড়ি চল!
পরেশ বলেছিল, না, ও এখন বাড়ি যাবে না। ওর জন্য আমি থিয়েটারের টিকিট কিনেছি, ও আমার সঙ্গে থিয়েটারে যাবে!
মুন্নি টুনটুনির চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, টুনটুনি, তুই থিয়েটারে যাবি, বাড়িতে বলে এসেছিস?
টুনটুনি সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বলেছিল, না, আমি থিয়েটারে যাবো না!
ব্যাপারটা বেশি দূর গড়াতো না। এরকম ছোটখাটো নাটক তো রাস্তাঘাটে প্রায়ই হয়, কেউ বিশেষ মাথা ঘামায় না। কিন্তু জগুবাবুর বাজারের দোতলার মদের দোকানে পরেশ সারা। দুপুর-বিকেল মদ্যপান করেছিল বলেই সে কাণ্ডজ্ঞানটুকু হারিয়েছিল। কলকাতার রাস্তায় চলাফেরার কয়েকটি অঘোষিত নিয়ম রীতি আছে। তার মধ্যে একটা হলো এই যে প্রতিটি মোড়ের মাথায় গুচ্ছ গুচ্ছ নিষ্কম যুবকেরা যদি পথ-চলতি যুবতীদের দিকে নানা রকম রসালো মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়, তা কেউ গায়ে মাখে না। আরও কিছু কিছু অসভ্যতাও সহ্য করা হয়। কিন্তু প্রকাশ্যে কোনো মেয়ের গায়ে হাত দেওয়া অমার্জনীয় অপরাধ! তখনই জেগে ওঠে নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালিদের নীতিবোধ ও বীরত্ব।
মুন্নির সঙ্গে কথা কাটাকাটি করতে করতে পরেশ এক সময় টুনটুনির হাত চেপে ধরে জড়িত গলায় বলেছিল, আলবাৎ ও যাবে আমার সঙ্গে! তুই যা না, পুঁচকে মেয়ে বাড়িতে গিয়ে মায়ের আঁচল ধরে দুধ খেগে যা! এ আমার গার্ল ফ্রেন্ড, একে আমি যেখানে খুশী নিয়ে যাবো!
টুনটুনি হাত ছাড়াবার চেষ্টা করে বলে উঠেছিল, না, না, আমি যাবো না! আমি বাড়ি যাবো!
তক্ষুণি কোথা থেকে চার পাঁচটি ছেলে হৈ হৈ করে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পরেশের ওপর! মেয়েছেলের ইজ্জৎ নিয়ে টানাটানি! বাড়িতে মা-বোন নেই!
তারা কিল-ঘুঁষি-লাথি মারতে লাগলো পরেশকে। মুন্নিরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। পরেশ তাদের বাড়িওয়ালার ছেলে, তাকে ওরা এতটা শাস্তি দিতে চায় নি। কিন্তু তখন আর ওদের বাধা দেবারও ক্ষমতা নেই। একজন প্রৌঢ় ওদের বললেন, মা, তোমরা বাড়ি চলে যাও। এই নোংরা ব্যাপারের মধ্যে আর থেকো না!
ফেরার পথে মুন্নির জেরার উত্তরে টুনটুনি বলেছিল, তার কোনো দোষ নেই, পরেশ প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা করে বলে, আমি তোমায় ভালোবাসি! আমি তোমায় ভালোবাসি! আইসক্রিম খাওয়াতে চায়, বালিগঞ্জ লেকে নিয়ে যেতে চায়। টুনটুনি যত বলে যে মামা জানতে পারলে রাগ করবেন…
সরল মেয়েরাও খুব মিথ্যেবাদী হতে পারে। মুন্নির কাছে নিখুঁত নিরপরাধের ভাব করে থাকলেও টুনটুনি এর আগে তিনবার পরেশের সঙ্গে জোড়া গীজার পাশে পাঞ্জাবী হোটলের পর্দা ঢাকা কেবিনে বসে চপ কাটলেট খেয়েছে ও চুমু পর্যন্ত সম্মতি দিয়েছে। তার মুখ দেখে এসব কিছুই বোঝার উপায় নেই, সব দোষ সে দিয়ে দিল পরেশের ঘাড়ে।
এ কাহিনী শুনে মমতা দারুণ আতঙ্কিত হলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে ফেললেন, এ বাড়িতে আর কিছুতেই থাকা চলবে না। পরেশ প্রতিশোধ নিতে এসেছে, সে ছাড়বে না। সহজে। জ্ঞানাঞ্জনবাবু বুড়ো হয়েছেন, চোখে দেখতে পান না, তিনি কী করে সামলাবেন এই অসভ্য ছেলেদের। প্রতাপ বুঝবেন না, শুধু আইন কানুন দিয়ে দেশটা চলে না, মামলা করে ওরা ভাড়াটে ওঠাতে না পারলেও এমন অত্যাচার শুরু করবে যে টেকা যাবে না। আগেরবার তবু বাবলু ছিল বাড়িতে, বাবলুর বন্ধুবান্ধবের দল ছিল, তাদের ভয় পেতে ধীরেশ-পরেশরা। এখন প্রতাপ আদালতে চলে গেলে বাড়িতে শুধু চারটি নারী, ওরা কখন কী উৎপাত করবে, তার কিছু ঠিক নেই। এই সময় নকশালদের নাম করে বাড়িতে যখন তখন ছেলেরা ঢুকে পড়তে পারে।
মমতার প্রস্তাব শুনে প্রতাপ যথারীতি গর্জন করে বলে উঠলেন, এ বাড়ি ছাড়বো? কক্ষনো! যদি ভালো করে, ভদ্রভাবে বলতো, অন্য বাড়ি দেখেশুনে নিশ্চয়ই ছেড়ে দিতাম। কিন্তু আমাকে ভয় দেখাবে? মুখের ওপর শাসিয়ে যাবে? করুক ওরা মামলা, অন্তত তিন চার বছর চলুক।
সুপ্রীতি সকালবেলা জপে বসেছিলেন, তাই পরেশের চোটপাট তখন শোনেননি। তিনি মৃদু গলায় বললেন, এত শস্তার ভাড়া, এখন ছাড়তে গেলে নতুন বাড়িতে অনেক বেশী ভাড়া দিতে হবে না? তবে দিনকাল খারাপ, ওরা যদি মারতে-টারতে আসে।
প্রতাপ বললেন, বিমান আমাকে একটা রিভালভার দিতে চেয়েছিল, সেটা এবার এনে। বাড়িতে রাখবো। এইসব ত্যাঁদোড় ছেলেদের কী করে শায়েস্তা করতে হয় আমি জানি।
মমতা চোয়াল শক্ত করে স্বামীর দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলেন। তিনি জানেন, প্রতাপের সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই, একবার গোঁ ধরলে প্রতাপ যুক্তির ধার ধারেন না। টুনটুনির সঙ্গে পরেশের ঘটনাটাও জানানো যাবে না প্রতাপকে, তা হলে তিনি হয়তো টুনটুনিকে তুলে আছাড় মেরেই বসবেন।
প্রতাপের গোঁ-এর একমাত্র উত্তর মমতার জেদ। ওদের দু’জনের কথার মাঝখানে তিনি দৃঢ়ভাবে বললেন, আমি এ বাড়িতে আর কিছুতেই থাকবো না!
প্রতাপ বললেন, তুমি বলছো কি মমো! একটা চ্যাংড়া ছেলে এসে ভয় দেখালেই আমাদের উঠে যেতে হবে?
মমতা বললেন, পরের বাড়িতে জোর করে থাকতে আমার ঘেন্না করে! আমি থাকবো না বলেছি, কিছুতে থাকবো না, এটা অপয়া বাড়ি। দরকার হয় টালিগঞ্জ, যাদবপুরে উঠে যাবো। কিংবা আরও দূরে।
বিকেলবেলা আদালত থেকে ফিরেও প্রতাপ মমতার জেদ টলাতে পারলেন না একটুও। মমতার মুখ থমথমে হয়ে আছে। মুন্নি আর টুনটুনি একবারও বেরুলো না ঘর থেকে। প্রতাপ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন, আবার বাড়ি খুঁজতে হবে!
এককালে কলকাতার অনেক বাড়িতে টু-লেট লেখা বোর্ড ঝুলতো, সেই সব বোর্ড কবেই অদৃশ্য হয়ে গেছে! এখন লোকে বাড়ি ভাড়ার সন্ধান পায় কী করে? খবরের কাগজে যেসব ফ্ল্যাটের বিজ্ঞাপন থাকে, সেগুলোর ভাড়া আড়াই হাজার তিন হাজার টাকা! অত টাকা বাড়ি ভাড়া দেবার মত লোকও আছে এ শহরে! ডাকাতি না করে কেউ এতটাকা রোজগার করতে পারে?
আদালত থেকে ফেরার সময় আজকাল প্রতাপের নিজস্ব আদালি রজ্জব শেখ ফাঁইলপত্র নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত আসে। এক হিসেবে সে এখন প্রতাপের বডি গার্ডও বটে। তার কাছ থেকে প্রতাপ বাড়ি খোঁজার ব্যাপারে পরামর্শ নিলেন। রজ্জব শেখ বললো যে অনেক পানের দোকানে বাড়ি ভাড়ার সন্ধান পাওয়া যায়। পানওয়ালারা খবর রাখে পাড়ার কোন বাড়ি খালি হলো কিংবা ভাড়াটে এলো। পানের দোকানের সামনে বাড়ির দালালরাও দাঁড়িয়ে থাকে। রজ্জব শেখের বাড়ি বেহালায়, দরকার হলে সে সেদিকে সাহেবের জন্য বাড়ি খুঁজে দিতে পারে।
মমতা এ বাড়ি তো ছাড়বেনই, কালীঘাট পাড়াতেই আর থাকবেন না বলেছেন। প্রতাপ দেশপ্রিয় পার্কের মোড়ের পানের দোকানের সামনে একজন দালালের সন্ধান পেলেন। তার হাতে পাঁচখানা বাড়ি আছে। প্রতিটি বাড়ি দেখানোর জন্য তাকে দিতে হবে দশটাকা, আর কোনো বাড়ি পছন্দ হলে তাকে দিতে হবে একমাসের ভাড়া। অগত্যা সেই দালালের সঙ্গেই এক সন্ধেবেলা মমতাকে নিয়ে বেরুলেন প্রতাপ। পর পর চারটি ফ্ল্যাট দেখলেন, প্রত্যেকটিই অখাদ্য, মমতা নাক সিটকে রইলেন। পঞ্চম ফ্ল্যাটটি কিন্তু চমৎকার, বেশ পছন্দসই। যতীন দাস রোডে একটি ছোট দোতলা বাড়ির পুরো দোতলাটা ভাড়া দেওয়া হবে, বেশ ঝকঝকে পরিষ্কার আলো-হাওয়া যুক্ত, তিনখানা শোওয়ার ঘর, আর একটি ছোট ঘর ও টানা বারান্দা। ভাড়া তিন শো পঁচিশ টাকা, প্রতাপের সাধ্যের অতিরিক্ত নয়। বাড়িওয়ালাটি ফুটফুটে ফস ছোট্টখাট্টো মানুষ, বেশ নম্র ও ভদ্র, তিনি থাকেন একতলায়, তাঁর স্ত্রীর বাতের অসুখ, সিঁড়ি ভাঙতে পারেন না বলে দোতলাটা ভাড়া দিচ্ছেন।
মমতার মুখে হাসি ফুটেছে। প্রতাপও অনেকটা হালকা বোধ করছেন। এত সহজে যে এমন সুন্দর একটা বাড়ি পাওয়া যাবে তিনি আশাই করেননি। বস্তুত, কালীঘাটের বাড়ির তুলনায় এ বাড়ি অনেক বেশী মনোমত, পাড়াটাও ভালো। বাড়িওয়ালা চা আনিয়েছেন, সেই চায়ে চুমুক দিতে দিতে প্রতাপ বললেন, তাহলে আজই ফাইনাল করে নিতে চাই। অ্যাডভান্সের টাকাটা…
বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকটি দালালটির দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, অ্যাই বেচু, তুই এনাদের সব কন্ডিশন বলে এনেছিস তো?
দালালটি বললো, না বলিনি, তবে তাতে কোনো অসুবিধে হবে না। ইনি হলেন হাইকোর্টের জাজ…
প্রতাপ বাধা দিয়ে বললেন, না, হাইকোর্টের নয়…
দালালটি বললো, ঐ হলো গিয়ে, আপনি স্যার জাজ তো! স্যার, এ বাড়ির দুটি কন্ডিশন আছে। একগাদা বাচ্চাকাচ্চা থাকলে চলবে না। আর স্যার সেলামি দিতে হবে দশ হাজার টাকা!
প্রতাপ প্রায় আঁতকে উঠে বললেন, সেলামি? দশ হাজার টাকা?
সেলামি কথাটা যে প্রতাপ আগে শোনেননি তা নয়। বাড়ি ভাড়ার ব্যাপারে এই জিনিসটা যে চলছে সে কথা খবরের কাগজেও বেরোয়। কিন্তু অন্যের মুখে শোনা আর খবরের কাগজে পড়ার তুলনায় নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে জানার তীব্রতা অনেকখানি। কথাটা শুনেই প্রতাপের মনে হলো, এই ছোট্টখাট্টো ফর্সা মানুষটিকে যেন তিনি সত্যিই সেলাম করতে বাধ্য হবেন এবং এর পায়ের কাছে বসে বাণ্ডিল বাণ্ডিল একশো টাকার নোট উৎসর্গ করবেন। এই লোকটি বাড়িওয়ালা, শুধু সেই যোগ্যতাতেই তার সেলাম ও নৈবেদ্য প্রাপ্য।
প্রতাপ আবার বললেন, দশ হাজার টাকা!
বাড়িওয়ালাটি মিষ্টি করে বললেন, তার থেকে তো কম করা যাবে না। এই ফ্ল্যাটের ভাড়া এমনিতে কত হয় জানেন? অন্তত সাড়ে পাঁচশো। ভাড়া কমিয়ে রেখেছি।
প্রতাপ কাঁচুমাচুভাবে বললেন, তিনখানা ঘর তিনশো টাকা কম তো নয়। তারপরেও পঁচিশ টাকা।
–বাজার ঘুরে দেখুন, তাহলে রেট বুঝতে পারবেন। একজন মাড়োয়ারী তো এ বাড়ি নেবার জন্য ঝুলোঝুলি করছে, নেহাৎ কোনো বাঙালিকে দেবো বলেই…। বেশী ভাড়া নিয়ে লাভ নেই, বুঝলেন, কপোরেশন ট্যাক্স কাটবে, তারপর ইনকাম ট্যাক্স, প্রায় সবই কেটে নেবে। সব টাকাটা হোয়াইটে নিলে লাভের ধন পিঁপড়েয় খেয়ে যায়।
প্রতাপ মাথা নীচু করে বসে রইলেন। কত কারণে মানুষের কাছে ছোট হয়ে যেতে হয়। এই লোকটা তাকে অসহায় করে দিয়েছে, সেটা উপভোগ করে মিটিমিটি হাসছে। এই লোকটা জানে না, এই বাড়ির অন্তত কুড়ি গুণ দামের সম্পত্তি তাদের ছিল এক সময়। কিন্তু সে কথা এখানে উচ্চারণ করাও যাবে না!
দশ হাজার টাকা এখন প্রতাপের কাছে স্বপ্নেও স্পর্শযোগ্য নয়। বাবলুকে বিদেশে পাঠাবার সময় মমতার গয়নাগুলো সব গেছে। লাইফ ইনসিওরেন্স থেকে ধার করতে হয়েছে, এছাড়াও ধার আছে বিমানবিহারীর কাছে। বাড়ি ভাড়া সওয়া তিনশো টাকা দিতে হলেই সংসারের কিছু কিছু খরচ কাটছাঁট করতে হবে!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রতাপ বললেন, দশ হাজার টাকা ব্ল্যাক মানি ক’জন বাঙালি দিতে পারবে?
বাড়িওয়ালাটি শব্দ করে হাসতে লাগলেন। সেই হাসির মধ্যে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে তাঁর মনের কথাটি অর্থাৎ, দশ হাজার টাকার কথা শুনলেই যাদের মুখ শুকিয়ে যায়, তাদের আবার এই রকম বাড়ি দেখতে আসার শখ কেন?
লোকটি আবার বললো, আপনি জজ, আপনাদের তো নানা রকম রোজগার। আপনারা ইচ্ছে করলে…
লোকটি বাঁ হাত বাড়িয়ে একটা বিশ্রী ধরনের ইঙ্গিত করতে যাচ্ছিল। মমতা তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে তাকে আড়াল করলেন। স্বামীর মেজাজ যে ক্রমশ চড়ছে, তা তিনি বুঝে গেছেন।
লোকটির ব্যবহার এতক্ষণ বেশ ভদ্র ছিল, কিন্তু হাসির শব্দটি যেন খুবই অশ্লীল। প্রতাপের ইচ্ছে হলো, পা থেকে চটি খুলে লোকটার দু গালে ঠাস ঠাস করে পেটাতে। আর কোনো কথা। না বলে মমতাকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন বাড়ির বাইরে।
দালালটি বিদায় নিল একটি দশ টাকা নিয়ে। আজ শুধু শুধু প্রায় পঞ্চাশ টাকা গচ্চা গেল।
একটুখানি এগিয়ে এসে মমতা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বললেন, ইস, বাড়িটা বড় পছন্দ হয়েছিল। গো। কী সুন্দর শান্ত পাড়া।
বাড়িওয়ালার ওপর যতটা রাগ জমেছিল সবটা মমতার মুখের ওপর ফাটিয়ে দিয়ে প্রতাপ বললেন, তোমরা কি আমাকে চুরি-ডাকাতি করতে বলো? অত টাকা পাবো কোথায় আমি?
অবুঝ রমণী তবু হেসে বললেন, আহা, কলকাতায় যারা বাড়ি ভাড়া নেয়, তারা সবাই বুঝি চুরি-ডাকাতি করে?
সেদিন রাত্রে পর পর দুটো বোমা পড়লো কালীঘাটের বাড়ির সদর দরজায়। রাত তখন পৌনে একটা, ঘুমিয়ে পড়েছিল সবাই, বোমা ফাটার বিকট শব্দে জেগে উঠে মমতা ভাবলেন, পরেশ বুঝি দলবল নিয়ে এখুনি বাড়ির মধ্যে ঢুকে আসবে। অন্য অস্ত্রের অভাবে প্রতাপ ছুটে গিয়ে চাবুকটা হাতে নিলেন। কিন্তু আর কিছুই ঘটলো না। এ শুধু পরেশের ক্রোধের দুটি স্ফুলিঙ্গ। সে জানিয়ে দিচ্ছে, ক্রমশই এরকম ঘটতে থাকবে।
সদর দরজার একটা পাল্লা কাত হয়ে পড়েছে। বোমার শব্দে প্রতিবেশীদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। নকশালদের দৌরাত্ম্যে দুটি মাত্র বোমা পড়া অতি সামান্য ঘটনা। থানায় খবর দিলেও পাত্তা দেবে না। কেউ খুন-জখম হয়নি, এটা আবার কোনো কেস নাকি?
পরদিন প্রতাপ টেলিফোনে জ্ঞানাঞ্জনবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে জানলেন, তিনি গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছেন। মমতা, মুন্নি আর টুনটুনির বাড়ি থেকে বেরুনো বন্ধ করে দিলেন একেবারে। প্রতাপকে তিনি বললেন, যেমন করে হোক, এ মাসের মধ্যে উঠে যেতেই হবে!
এখন প্রতাপ ঢাকুরিয়া, টালিগঞ্জের দিকে বাড়ি দেখতে শুরু করেছেন। রজ্জব শেখ খিদিরপুরে একটা সস্তার বাড়ির সন্ধান এনেছে, সেখানেও দু’ মাসের ভাড়া অগ্রিম দিতে হবে। এজলাশে বসে শুনানি শুনতে শুনতে প্রতাপ অন্যমনস্ক হয়ে যান। যাকে বলে হাঘরে, তাঁর এখন সেই অবস্থা। একবার যে বাস্তৃভূমি থেকে দ্রুত হয়, সে বোধহয় আর কোনোদিনই স্থির বাসস্থান। পায় না। প্রতাপের কথাবার্তায় বোধহয় বোঝা যায় যে তাঁর টাকার জোর নেই, নইলে সব বাড়িওয়ালাই তাঁর সঙ্গে অবজ্ঞার সুরে কথা বলে কেন?
মাস শেষ হতে আর মাত্র ছ’দিন বাকি। এর মধ্যে প্রতাপ জ্ঞানাঞ্জনবাবুর প্যাডে লেখা ফর্মাল নোটিস পেয়ে গেছেন। পরেশকে দেখেছেন দু’একবার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। প্রতাপ যে ভয় পেয়ে বাড়ি খুঁজছেন, তা ওরা নিশ্চয়ই জেনে গেছে। প্রতাপের মুখের ওপরে পড়েছে একটা কালো ছাপ। এ সময় নিজের ছেলেটা যদি অন্তত পাশে থাকতো। না, ছেলে বিপ্লব ও দেশোদ্ধারের ছুতোয় এই সংসারটাকে সর্বস্বান্ত করে এখন বিদেশে বসে আছে, সেখানে সে মজায় আছে, নিজস্ব গাড়ি চালিয়ে ঘুরে বেড়ায়…
আদালত থেকে বেরুবার মুখে একজন সুদর্শন যুবক প্রতাপের সামনে এসে নমস্কার জানিয়ে বললো, স্যার, আমি খবরের কাগজের রিপোটার, একজন বাংলাদেশী ভদ্রলোক আপনার নামে একজনকে খুঁজছেন! আপনিই তো প্রতাপ মজুমদার?
একটু দূরে দাঁড়ানো একজন দাড়িওয়ালা মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিকে ডেকে সে বললো, সৈয়দসাহেব, দেখুন তো, ইনিই কি আপনার–
সুদীর্ঘ চব্বিশ বছরের ব্যবধান। মামুন ও প্রতাপ দু’জনেরই চেহারার অনেক পরিবর্তন। হয়েছে, মামুনের গালে অযত্নবর্ধিত দাড়ি, প্রতাপের চুলে পাক ধরেছে, তবু দু’জনে দু’জনের চোখের দিকে তাকিয়েই চিনতে পারলেন।
এতদিন পরে বাল্যসুহৃদকে দেখে যতটা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠা উচিত ছিল, ততটা পারলেন না প্রতাপ। তাঁর মুখে একটা তেতো তেতো ভাব। প্রতাপ বললেন, মামুন! তুমি কবে এসেছো!
মামুনও প্রতাপকে দেখেই লাফিয়ে উঠলেন না। বরং একটু অপরাধীর মতন হেসে বললেন, এসেছি বেশ কিছুদিন, তোমার সন্ধান পাই নাই!
তারপর আলিঙ্গনবদ্ধ হলেন দুই বন্ধু!
রিপোটার অরুণ সেনগুপ্ত বললো, আপনারা আমে-দুধে মিশে গেলেন তো! আমি তাহলে এবার চলি?
মামুনের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে প্রতাপ সংক্ষেপে শুনে নিলেন ঢাকার খবর ও মামুনদের রোমহর্ষক পলায়নবৃত্তান্ত। তারপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মেয়ে, তোমার ভাগ্নী সঙ্গে এসেছে, তারা আছে কোথায়?
মামুন বললেন, বেকবাগানের কাছে একটা বাসা ভাড়া নিয়েছি, সেখানে আছে কোনোরকমে!
প্রতাপ আবার বিমর্ষ হয়ে গেলেন। মামুনের মেয়ে-ভাগ্নী এসেছে, তারা অন্য জায়গায় থাকবে কেন? প্রতাপের বাড়িতে এক্ষুনি তাদের নিয়ে আসা উচিত! প্রতাপ সে কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। কোথায় আনবেন ওদের? আজ রাত্তিরেই যদি আবার বোমা পড়ে! কলকাতা শহরেই প্রতাপের যে প্রায় বাস্তুহারার মতন অবস্থা, তা কি প্রথম দিনেই মামুনকে বোঝানো যাবে!