থ্রি পি কনস্ট্রাকশনের মালিকানা বদল
থ্রি পি কনস্ট্রাকশনের মালিকানা বদলে তেমন কোনো পরিবর্তন হলো না। তবে সবাইকে খানিকটা উদ্বিগ্ন মনে হলো। প্রধান ব্যক্তির প্রতি আস্থার অভাব থাকলে সবাই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। সেই ধরনের নিরাপত্তাহীনতা। উড়া-উড়া খবর পাওয়া গেল অনেকের চাকরি চলে যাবে। নতুন স্টাফ আসবে। কোম্পানির কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ অন্য কোথাও যাবার চেষ্টা করছেন। কিছু গুজব নিয়ে কানাম্বুষা হচ্ছে। তার মধ্যে সবচে’ আতঙ্কজনক গুজব হচ্ছে–বেতন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বড় সাহেব তিন কোটি টাকা নিয়ে আমেরিকা চলে গেছেন। কোম্পানির লিকুইড প্রপার্টি বলতে কিছুই নেই। ঈদ বোনাস তো দূরের কথা, বেতনই হবে না। এই গুজব বিশ্বাসযোগ্যভাবে ছড়িয়েছে। উপরের মহলের অফিসারও বিশ্বাস করেছেন।
আজ সেই গুজব মিথ্যা প্রমাণিত হলো। সবার বেতন হলো, যাদের ইয়ারলি ইনক্রিমেন্ট ডিউ হয়েছিল, তারা তা পেল। ঈদের বোনাস পাওয়া না গেলেও বলা হলো ঈদের ছুটির আগের দিন দেয়া হবে। যে চাপা উদ্বেগ ও অস্বস্তি সবার মধ্যেই ছিল তা অনেকাংশেই কেটে গেল। দুপুরের দিকে মনজুর ডেকে পাঠাল চিফ অ্যাকাউনট্যান্ট করিম সাহেবকে।
করিম সাহেব ঘরে ঢুকলেন চিন্তিত মুখে। তাকে ছাঁটাই করা হচ্ছে। এ রকম একটি গুজবও খুব ছড়িয়েছে। গুজব অবশ্যি শুরু করেছেন তিনি নিজেই।
মনজুর হাসিমুখে বলল, কেমন আছেন করিম সাহেব?
জ্বি স্যার ভালো।
বসুন। আমার সঙ্গে চা খান।
করিম সাহেব বসলেন। মনজুর নিজেই চায়ের কাপ এগিয়ে দিল। সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিল। করিম সাহেব চায়ে চুমুক দিলেন, সিগারেট নিলেন না।
কোম্পানির অর্থনৈতিক অবস্থা তো আপনার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। সবার বেতন হবে, ঈদ বোনাস হবে–এগুলো আপনি জানেন–তারপরেও কী করে গুজব ছড়াল যে বেতন বন্ধ?
গুজবের কি স্যার কোনো মা-বাবা আছে?
অবশ্যই আছে। গুজবের মা থাকে, বাবা থাকে এবং গুজবের পেছনে একটা উদ্দেশ্যও থাকে। গুজবটা আপনার অফিস থেকে ছড়িয়েছে এটাই দুঃখজনক।
আমার অফিস থেকে ছড়িয়েছে এটা কে বলল?
আমি অনুমান করছি। করিম সাহেব, আমার অনুমান খুব ভালো।
করিম সাহেব। আর কিছুই বললেন না। নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। ঠাণ্ডা
ঘর, তবু তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। তাঁর সামনে বসা মানুষটিকে আজ এত অন্যরকম মনে হচ্ছে কেন? কেমন কঠিন চেহারা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। ক্ষমতা মানুষকে বদলে দেয় তা ঠিক, কিন্তু এত দ্রুত বদলাতে পারে? এই লোকটির পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত বদলে গেছে।
করিম সাহেব।
জ্বি স্যার।
আমি যে ঘরে বসতাম। এ ঘরটা আপনার বেশ পছন্দ–আপনি ঐ ঘরে বসুন। নিজের মতো করে ঘরটিা সাজিয়ে নিন।
করিম সাহেব কিছুই বললেন না। তাঁর হঠাৎ পানির পিপাসা পেয়ে গেল। আগের বড় সাহেবের বেলায় এ রকম কখনো হয় নি। আজ কেন হচ্ছে? ব্যাপারটা কী? তিনি এত ভয় পড়েছেন কেন?
করিম সাহেব।
জ্বি স্যার।
আমাদের বেশ বড় একটা সরকারি বিল দীর্ঘদিন আটকে ছিল। নুরুল আফসার সাহেব দেশ ছাড়ার আগে ঐ বিল ছাড়িয়ে দিয়ে গেছেন–কোন বিলটির কথা বলছি বুঝতে পারছেন?
পারছি।
আমি ঐ বিলের টাকার অর্ধেকটা একটা বিশেষ কাজে ব্যবহার করতে চাই।
বলুন স্যার কী কাজ।
আমাদের এত বড় কনস্ট্রাকশন ফার্ম— বাড়িঘর সমানে তৈরি করে যাচ্ছি। যাচ্ছি না?
যাচ্ছি।
অথচ আমাদের কর্মচারীদের কোনো কোয়ার্টার নেই। ভাড়া বাসায় তারা থাকে। তাদের বেতনের একটা বড় অংশ চলে যায় বাড়িভাড়ায়। আমি চাই থ্রি পি কনস্ট্রাকশনের প্রতিটি কর্মচারীর জন্যে ফ্ল্যাট হবে। কাউকেই ভাড়া করা বাড়িতে থাকতে হবে না।
অনেকগুলো টাকা ব্লকড হয়ে যাবে স্যার।
হোক। কত দ্রুত কাজটা করা যাবে বলুন তো? মালিবাগে আমাদের কিছু রিয়েল এক্টেট আছে না?
আছে।
ঐখানেই ফ্ল্যাট উঠুক। তিন ধরনের ফ্ল্যাট হবে। প্রথম শ্রেণীর অফিসারদের জন্যে এক ধরনের, দ্বিতীয় শ্রেণীর জন্যে এক ধরনের, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের জন্য ধরনের। আমি চাই কাজটা যেন দ্রুত শেষ হয়। দ্রুত। আমার হাতে সময় বেশি।
সময় বেশি নেই বলছেন কেন?
আমি অসুস্থ এটা আপনার চোখে পড়ছে না?
চিকিৎসা তো স্যার হচ্ছে। কিডনি ট্র্যান্সপ্লেন্ট হবে, তখন আর সমস্যা থাকার কথা
তা ঠিক! আচ্ছ। আপনি এখন উঠুন। বিকেলের দিকে একটা মিটিং ডাকুন। সেখানে ঠিক করব কীভাবে কী করা যায়।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
করিম সাহেব চলে যাবার পরপরই কুদ্দুস ঢুকল হাসিমুখে। তার হাতে কাঁঠাল আকৃতির দুটি পাকা পেঁপে। সে স্যারের জন্যে নিয়ে এসেছে। কুদ্দুস মাথা চুলকে বলল, গাছের পেঁপে স্যার।
তাই নাকি?
বাবার নিজের হাতে পোঁতা গাছ।
ভালো, খুবই ভালো–দাম পড়ল কত?
চল্লিশ টাকা। পঞ্চাশ টাকা জোড়া চায়–চল্লিশে দিল।
মনজুর হেসে ফেলল। কুদ্দুসের মুখ অসম্ভব বিষগ্ন হয়ে গেল। জেরার মুখে সে এক সেকেন্ডও টিকতে পারে না। তাছাড়া এই মানুষটাকে সে আগে থেকেই ভয় পায়। এখন যেন সেই ভয় সাতগুণ বেড়েছে। ছায়া দেখলেই ভয় লাগে। মূল মানুষটাকে দেখতে হয় না।
কুদ্দুস।
জ্বি স্যার।
ওয়েটিং রুমে আমানুল্লাহ নামে একটা ছেলে বসে আছে। তাকে নিয়ে আস।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
কুদ্দুস ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল। মনে মনে ঠিক করল, আগামী এক মাস এই মানুষটার ত্ৰিসীমানায় সে থাকবে না। নগদ টাকা সাধলেও না।
আমানুল্লাহর সঙ্গে মনজুরের আগে একবার দেখা হয়েছে। এটা দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। আজ সে আমানুল্লাহকে আসতে বলেছে। আজ তাকে টাকা দেয়ার কথা। মনজুর রাজি আছে আমানুল্লাহর শর্তে। নগদ এক লক্ষ টাকা আগেই দেয়া হবে।
আমানুল্লাহ আজ সুন্দর একটা শার্ট পরেছে। চুল আঁচড়ানো। ইন্ত্রি করা প্যান্ট। সকালবেলাতেই গোসল করেছে বলে বোধহয় তাকে সুন্দর লাগছে। চোখে-মুখে স্নিগ্ধ ভাব।
কেমন আছ আমানুল্লাহ?
জ্বি স্যার ভালো।
মনজুর ব্ৰাউন রঙের একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল। নিচু গলায় বলল, তোমার টাকা এখানেই আছে। পাঁচশ টাকার নোট দিয়েছে। তুমি গুণে নাও।
আমানুল্লাহ টাকা গুনছে।
মনজুর বলল, তুমি কিছু খাবে?
জ্বি না।
চ-টাও খাবে না?
না।
টাকা গোনা শেষ হয়েছে। প্যাকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে আমানুল্লাহ বলল, আমি একজনকে টাকাটা দেয়ার জন্যে তিন চারদিনের জন্যে বাইরে যাব। আপনারা হয়তো ভাবতে পারেন। আমি পালিয়ে গেছি। এই জন্যে বললাম।
মনজুর বলল, আমি এ রকম কিছুই ভাবব না।
আমার পাসপোর্ট হয়ে গেছে। যেদিন যেতে বলবেন আমি যাব। শুধু …
শুধু কী?
না কিছু না।
তুমি কি ভয় পাচ্ছ?
ভয়? হ্যাঁ একটু পাচ্ছি।
cror’?
মনে হচ্ছে অপারেশনে আমি মারা যাব।
তাই যদি মনে হয় তাহলে রাজি হলে কেন?
টাকাটা আমার খুবই দরকার।
মরে যাবে জেনেও টাকার জন্যে তুমি রাজি হচ্ছে?
জ্বি। অবশ্যি তাতে কোনো অসুবিধা নেই। মানুষতো আর সারাজীবন বেঁচে থাকে না। এক সময় না এক সময় মরতে হয়। আগে আর পরে—এই আর কী। আচ্ছা আমি যাই।
তোমার সঙ্গে একটা গাড়ি দিয়ে দি। গাড়ি নিয়ে যাও–এতগুলো টাকা সঙ্গে নোবে!
অসুবিধা নেই। কেউ বুঝবে না আমার কাছে এত টাকা–স্নামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
মনজুর চুপচাপ বসে আছে। তার খুব খারাপ লাগছে। মন খারাপ শুধু না, শরীরও খারাপ। বমি ভাব হচ্ছে। মাথায় যন্ত্রণা। কুদ্দুস। দরজার ফাঁক দিয়ে মাথা ঢোকাল। মনজুর বলল, কিছু বলবে কুদ্দুস?
স্যার পেঁপে কেটে দিব?
না। তোমার দেশের বাড়ির পেঁপে পরে খাব।
আপনার কি স্যার শরীর খারাপ লাগছে?
হুঁ।
বাসায় চলে যাবেন?
তাই ভাবছি।
গাড়ি বের করতে বলব স্যার?
মনজুরের মনে পড়ল এখন তার দখলে একটা গাড়ি আছে যে গাড়িতে চড়ে সে এখন সারা শহর ঘুরতে পারে।