১৪
থার্ড ইয়ার ফাইনালের ডেট দিয়ে দিয়েছে।
মেডিকেলের ছাত্রদের কারোর দম ফেলার সময় নেই। ক্লাস এখন সাসপেণ্ডেড। আজমল ঠিক করে রেখেছে, সে এখন থেকে নাশতা খেয়ে পড়তে বসবে এবং একটানা পড়বে লাঞ্চ টাইম পর্যন্ত। এক ঘন্টার ব্রেক নেবে লাঞ্চে, তারপর আবার পড়া। তা ছাড়া পাস করার উপায় নেই। নানান দিক দিয়ে খুব ক্ষতি হয়েছে এবছর। প্রতিদিনই কোনো-না-কোনো ঝামেলায় পড়া হচ্ছে না। এ-রকম চললে পরীক্ষা দেয়া হবে না। এবার পরীক্ষায় না বসলে ডাক্তারি পড়া বন্ধ করে দিতে হবে। খরচ চালিয়ে যাবার ক্ষমতা নেই। গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে দিলে হত, কিন্তু মা বেঁচে থাকতে তা সম্ভব নয়। তা ছাড়া বিক্রি করেও লাভ হবে না কিছু। ভাঙা রাজপ্রাসাদ কে কিনবে? কার এত গরজ?
আজমল বই নিয়ে বসেই উঠে পড়ল—-জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে মিসির আলি ঢুকছেন। তার খুব ইচ্ছা হতে লাগল, বইপত্র নিয়ে অন্য কোনো ঘরে চলে যায়। কিছুক্ষণ খুঁজেটুজে তিনি চলে যাবেন। কিন্তু ভদ্রলোকের যা স্বভাব-চরিত্র, তিনি আবার আসবেন। আবার আসবেন! অসহ্য! কেন জানি আজমল তাঁকে সহ্য করতে পারে না। কেন সহ্য করতে পারে না–এ নিয়েও সে ভেবেছে, কিছু বের করতে পারে নি। লোকটি ভালোমানুষ ধরনের, তবে অসম্ভব বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমান কেউ ভালোমানুষ হতে পারে না। ভালোমানুষেরা বোকাসোকা ধরনের হয়।
ভেতরে আসব?’
আজমল বিরক্তি গোপন করে বলল, ‘আসুন।’
‘আমি পরশুও এক বার এসেছিলাম। তোমার রুমমেটকে বলে গিয়েছিলাম, আজ সকালে আসব। সে তোমাকে কিছু বলে নি?’
‘জ্বি-না, বলে নি। ভুলে গেছে বোধহয়। বসুন।’
মিসির আলি বসতে-বসতে বললেন, ‘অনেক দিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা। এর মধ্যে তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। জান বোধহয়।
‘জ্বি, জানি। নাজ চিঠি লিখেছিল।’
‘খুব যন্ত্রণায় ফেলেছিলাম ওদের। অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।’
আজমল কিছু বলল না।
মিসির আলি বললেন, ‘বেশিক্ষণ তোমাকে বিরক্ত করব না। একটা কথা শুধু জিজ্ঞেস করতে এসেছি।’
‘জিজ্ঞেস করুন।’
‘তোমাদের বাড়িতে একটা ঘর আছে, যেখানে তোমাদের পূর্বপুরষদের কিছু ছবিটবি আছে। তুমি কি সেই ঘরে ফিরোজকে নিয়ে গিয়েছিলে?’
‘জ্বি হ্যাঁ, নিয়ে গিয়েছিলাম।’
‘কিন্তু ঐ ঘর তো তালাবন্ধ। ওর চাবি থাকে নাজনীনের কাছে। সে তো বলল, ও ঘর খোলা হয় নি।’
‘আমার কাছে একটা চাবি আছে, ও জানে না।
‘খালিগায়ে এক জনের ছবি আছে। ঐ ছবিটা কি ফিরোজকে দেখিয়েছ?’
‘সব ছবিই দেখিয়েছি।’
‘আমি এই বিশেষ ছবিটি প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করছি। শুনেছি এঁকে ক্ষিপ্ত প্রজারা লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এটা কি সত্যি?’
‘জ্বি, সত্যি। শাবল দিয়ে পিটিয়ে মারে।’
এই গল্পটি কি তুমি ফিরোজের সঙ্গে করেছ?’
‘জ্বি-না, করি নি।’
‘অন্য কেউ কি করেছে বলে তোমার ধারণা?’
‘মনে হয় না। গল্প করে বেড়াবার মতো কোনো ঘটনা এটা না।’
মিসির আলি উঠে পড়লেন। আজমল বলল, ‘আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না?’
‘না। উঠি এখন। তুমি পড়াশোনা করছিলে, কর। আর ডিসটার্ব করব না।’
আজমল তাঁকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এল। মিসির আলি বললেন, ‘নাজনীন মেয়েটি বড় ভালো। ওকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। চমৎকার মেয়ে!’
আজমল কিছু বলল না।
মিসির আলি বললেন, ‘নাজনীন আমাকে বলেছে শীতের সময় একবার যেতে। আমি কথা দিয়েছি, যাব। এ-শীতেই যাব। যাই আজমল, আর আসতে হবে না।’
তিনি মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলেন। ফিরোজ ছবিটা দেখেছে। জট খুলতে শুরু করছে। এই ছবির ছাপ পড়েছে ফিরোজের চেতনায়। এবং মিসির আলির ধারণা, লোকটির মৃত্যুসংক্রান্ত গল্পটিও সে শুনেছে। লোহার রড নিয়ে তার খালিগায়ে বের হবার রহস্যটি হচ্ছে ছবিতে এবং গল্পটিতে।
বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। মিসির আলি গ্রাহ্য করলেন না। বরং বৃষ্টিতে ভিজতে-ভিজতে এগিয়ে যেতে তাঁর ভালোই লাগছে। ফিরোজের অসুখের পেছনের কারণগুলো দাঁড় করাতে চেষ্টা করতে লাগলেন। অনেকগুলো ঘটনাকে একসঙ্গে মেলাতে হবে। ঘটনাগুলো এ-রকম-
(১) অসম্ভব রূপবতী একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা হল। মেয়েটির পলিও। এই ঘটনাটি তাকে অভিভূত করল।
(২) মেয়েটি তাকে আহত করল, সে কড়া গলায় বলল–আমার হাত ছাড়ুন।
(৩) ফিরোজ খালিগায়ের লোকটির ছবি দেখল, এবং খুব সম্ভব তার মৃত্যুবিষয়ক গল্পটিও শুনল।
(৪) রাতে তার প্রচণ্ড জ্বর হল। জ্বরের ঘোরে ঐ লোকটির ছবি বারবার মনে হল।
(৫) সে নির্জন নদীর পাড় ধরে একা-একা হাঁটতে গেল, তখুনি একটি হেলুসিনেশন হল।
মিসির আলি বৃষ্টিতে নেয়ে গেছেন। রাস্তার লোকজন অবাক হয়ে তাঁকে দেখছে। ঢালাও বর্ষণ উপেক্ষা করে কেউ এমন নির্বিকার ভঙ্গিতে হাঁটে না।