১৪. জোড়াসাঁকোর বাড়ির সম্মুখে

জোড়াসাঁকোর বাড়ির সম্মুখের অলিন্দে একটি আরাম কেদারায় বসে আছেন দেবেন্দ্র। সময় প্রায় মধ্যরাত্রি, সমস্ত গৃহটি অন্ধকার। বার্তাসে ধারালো শীতের ভাব, কিন্তু দেবেন্দ্ৰ শুধু পিরানের ওপর একটা মুগার চাদর জড়িয়ে আছেন, অন্তরের চাঞ্চল্যের জন্য তাঁর এখন শীতবোধ নেই।

দেবেন্দ্ৰ এখন ছাব্বিশ বৎসর বয়স্ক যুবা পুরুষ। সবল, দীর্ঘকায়, গৌরবর্ণ, আয়তচক্ষু। কিন্তু তাঁর মুখখানিতে বিষাদের ছায়া মাখা। মাথার ওপরে নক্ষত্ৰখচিত নীলাকাশ, তিনি মধ্যে মধ্যে সেদিকে চোখ তুলে দেখছেন। এইরূপ আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি প্রায়ই প্ৰগাঢ় প্রশান্তি বোধ করেন, কিন্তু আজ মন কিছুতেই যেন স্ববশে আসছে না।

একটু আগেই তিনি বেলগাছিয়ায় তাঁর পিতার বিলাসপুরী থেকে চলে এসেছেন। এর ফলাফল কতদূর গড়াবে কে জানে। তাঁর পিতা সিংহবিক্রম পুরুষ, তাঁর অনুগতরা কেউ তাঁর ইচ্ছবিরুদ্ধ কাজ করছে, এ তিনি কিছুতেই সহ্য করেন না। কিন্তু দেবেন্দ্র আর কোনোক্রমেই থাকতে পারছিলেন না সেখানে, তাঁর অসহ্য বোধ হচ্ছিল। অতগুলি মানুষ নিছক লঘু আমোদে মত্ত। নৃত্য, গীত আর অবিরাম সুরার স্রোতে কারুর ক্লান্তি নেই। সেখানে অবস্থানের সময় একটি কথা বার বার দেবেন্দ্রর মস্তিষ্কে ঘুরছিল। কথাটি আছে কঠোপনিষদে। প্ৰমাদী ও ধনমদে মূঢ় নির্বোধের নিকট পরলোক সাধনের উপায় প্ৰকাশ পায় না। ইহলোকই আছে, পরলোক নাই—যাহারা এ প্রকার মনে করে, তাহারা পুনঃ পুনঃ আমার বশে (অৰ্থাৎ মৃত্যুর বশে) আসে। চেষ্টা করেও দেবেন্দ্ৰ কিছুতেই কথাগুলি মন থেকে বিতাড়ন করতে পারছিলেন না, ক্ৰমে দামামা ধ্বনির মতন এর প্রতিটি শব্দ যেন আঘাত করছিল তাঁকে। তিনি প্ৰায় দৌড়ে চলে এলেন সেখান থেকে।

পিতা ক্রুদ্ধ হবেন। তবু আজ দেবেন্দ্রর জীবনে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেবার সময় এসেছে। তিনি আজ সাবালক, তবু তাঁর পিতা তাঁকে সর্ববিষয়ে উপদেশ ও পরামর্শ দিয়ে চালিত করতে চান। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ইউনিয়ন ব্যাঙ্কে বসে টাকাকড়ি গণনা করতে করতে তাঁর চিত্ত বিকল হয়ে যায়, তবু তাঁর পিতার আদেশে তাঁকে সেই কর্মই করতে হবে। পিতা চান সম্পদে ও ক্ষমতায় ভারতীয়দের মধ্যে শীর্ষস্থান অধিকার করবেন এবং তাঁর প্ৰিয়তম পুত্র তাঁর ছত্ৰছায়ায় থেকে এই অভিপ্ৰায় সিদ্ধির সহায়তা করবে। বস্তুতান্ত্রিক পিতা একেবারেই রাখেন না পুত্রের মনের খবর। প্রৌঢ় দ্বারকানাথ জানেন না। তরুণ দেবেন্দ্রর মনে জেগেছে ঐহিক সম্পদের বদলে পারিত্রিক জ্ঞানের জন্য আকুলত। কপিলাবস্তুর রাজা শুদ্ধোদন যেমন জানতেন না। তাঁর তরুণ পুত্র যুবরাজ শাক্য সিংহের বৈরাগ্য অনুভূতির কথা।

জীবনের উদ্দেশ্য কী?

এই প্রশ্ন দেবেন্দ্রর মনে এসেছিল। এমনই এক মধ্য রাত্রে, গঙ্গার তীরে। এ জগতে সবচেয়ে যাঁকে তিনি ভালোবাসতেন, তাঁর সেই ঠাকুরমা তখন মৃত্যুপথযাত্ৰিনী। এই ঠাকুরমা দেবেন্দ্ৰকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন, শুনিয়েছেন কত রূপকথা, কত পুরান কাহিনী। ঠাকুরমাকে আনা হয়েছে। অন্তর্জালী যাত্রার জন্য, শুইয়ে রাখা হয়েছে কাঁচা ঘরে। অর্ধেক শরীর তীরের ওপরে, পা দু-খানি জলমগ্ন, একদল কীর্তন গায়ক সেই মুমূর্ষর কানে হরিনাম শোনাচ্ছে।

সেখান থেকে একটু দূরে একটা চাঁচের ওপর বসেছিলেন দেবেন্দ্র। তখন বয়েস একুশ, কী এক কাযোঁপলক্ষে দ্বারকানাথ সে সময় এলাহাবাদে, দেবেন্দ্র সর্বক্ষণ রয়েছেন পিতামহীর সঙ্গে। গঙ্গার স্রোতের কুলুকুলু ধ্বনি, বার্তাসে ভেসে আসা কীর্তনের সুর, মাথার ওপর জ্যোৎসাধৌত অনন্ত আকাশ—এইসব মিলেমিশে এক বিচিত্র অনুভূতি হলো তাঁর।

তিনি নিজেকেই প্রশ্ন করলেন, জীবনের উদ্দেশ্য কী?

তিনি এ দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনীর সন্তান, তাঁর অঙ্গুলি হেলনে যে-কোনো বিলাসদ্রব্য মুহূর্তে চলে আসবে তাঁর কাছে, ভোগের পরাকাষ্ঠা তিনি দেখিয়ে যেতে পারেন। কিছুদিন সব কিছুই চোখে দেখেছেন। কিন্তু এই ভোগবিলাস ও মৃত্যু, এই কি জীবনের চরম পরিণতি? পশুর জীবনের সঙ্গে এ জীবনের পার্থক্য কী? এ জীবন আর কি কোনো বৃহত্তর মহত্তর আনন্দের স্বাদ পাবার যোগ্য নয়? শোক ও সংশয় নিয়ে বসে থাকা সেই একাকী যুবকের মনে হঠাৎ যেন একটা দিব্য আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল। আকাশের জ্যোৎস্নায় যেন ধুয়ে গেল তাঁর চিত্ত। জীবনের উদ্দেশ্য কী, সে উত্তর তিনি তখুনি পেলেন না। কিন্তু এই নিশ্চিন্ত উপলব্ধি হলো যে, এই ভোগমত্ততাই জীবনের সব নয়। ঐশ্বর্য, আড়ম্বর, অপরের ওপর প্রভুত্ব করার দাপট, এসব অতি তুচ্ছ। সামান্য যে চাঁচের ওপর তিনি বসেছিলেন সেটাই যেন তাঁর যোগ্য স্থান, গালিচা দুলিচা সব হেয় বোধ হলো।

শেষ রাত্রে তিনি বাড়ি ফিরলেন, কিন্তু ঘুম হলো না। সারা শরীরের প্রবাহিত আনন্দে তিনি ছটফট করতে লাগলেন।

পরদিন সকালে আবার তিনি পিতামহীকে দেখতে এলেন শ্মশানঘাটে। বৃদ্ধর আজ শেষ সময় উপস্থিত। সকলে ধরাধরি করে তাঁকে গঙ্গাগর্ভে নামিয়ে চিৎকার করছে গঙ্গা নারায়ণ ব্ৰহ্ম।। দেবেন্দ্ৰ জলে নেমে পাশে দাঁড়ালেন, তাঁর চোখে অশ্রু নেই। তখন দ্বারকানাথের পালিক-জননী, পুণ্যশীলা অলকাদেবী প্রিয়তম নাতির দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে একটি হাত নিজের বুকে রাখলেন, অন্য হাতের একটি আঙুল উঁচু করে ওপরের দিকে ঘোরাতে ঘোরাতে হারিবোল বলে ইহলোক ছেড়ে চলে গেলেন। দেবেন্দ্রর মনে হলো যেন ঠাকুরমা ঈশ্বর ও পরকালের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন তাঁকে।

ঠাকুরমার শ্রাদ্ধের পর কল্পতরু সাজলেন দেবেন্দ্র। যে যা চায়, সবই তিনি বিলিয়ে দেবেন। ংক্ষিপ্ত বিলাসের আমলে যত সাজ-সজ্জা অলঙ্কার তিনি প্ৰিয়বোধে সংগ্রহ করেছিলেন, সে সব কিছু থেকে আবার মুক্ত হতে চান। আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে যারা সামান্য সুখ নিয়ে মত্ত, তাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। এক একজন এক একটি দ্রব্য হাতে তুলে বলছে, নেবো? তিনি তৎক্ষণাৎ মাথা হেলিয়ে বলছেন, নাও। এক একজনের দু-হাতেও জিনিস ধরে না। তাঁর একজন জ্যাঠতুতো ভাই নিয়েছে তাঁর জড়ির পোষাক, দেয়াল থেকে খুলে নিচ্ছে মূল্যবান সব ছবি, তবু তার লোভ যায় না। শ্বেত মর্মরের টেবিল, আবলুষ কাষ্ঠের কোচ এগুলোর দিকে চেয়েও সে জিজ্ঞেস করে, নেবো? দেবেন্দ্ৰ ক্ষণমাত্র দ্বিধা না করে বললেন, নাও! সে তখন মুটে ডেকে সব নিয়ে গেল।

শ্মশানে যে তীব্র আনন্দ হয়েছিল, তা বেশীদিন স্থায়ী হলো না। আবার এক দুঃখবোধ তাঁকে ঘিরে ধরলো। তিনি নেতি পেয়েছেন, কিন্তু অস্তি পাননি। কিসে সুখ নেই, তা বুঝেছেন, কিন্তু যাতে চিরসুখ ও চিরশান্তি তা অবলম্বন করতে পারছেন না। ঈশ্বর অনন্ত সুখের আকার, কিন্তু ঈশ্বর কে? তিনি কোথায়? কী তাঁর স্বরূপ?

প্রথম বয়েসে উপনয়নের পর তিনি মন দিয়ে শালগ্রাম শিলার পূজা দেখতেন। তখন বোধ হতো ঐ শিলাই ঈশ্বর। দুর্গাপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, সরস্বতী পূজায় তিনি আর পাঁচজনের মতই মেতে উঠতেন। প্রতিদিন কলেজ যাবার পথে ভক্তিভরে প্রণাম করতেন, ঠনঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরী দেবীকে, অপরাপর বালকদের মতন তিনিও পরীক্ষার আগে দুরুদুরু বক্ষে দেবীর কাছে পাশ করার বর প্রার্থনা করতেন। তখন জানতেন যে শালগ্রাম শিলার মতনই দশভূজা দুর্গা বা চতুর্ভূজা সিদ্ধেশ্বরী—সবই ঈশ্বরের প্রকাশ।

এখন বুঝতে পারছেন, এই সব কাষ্ঠ লোষ্ট্র দিয়ে গড়া মূর্তি কখনো ঈশ্বর হতে পারে না। কিন্তু ঈশ্বরের স্বরূপ কী? নব্য বঙ্গীয় যুবকরা এই কাষ্ঠ লোষ্ট্র পূজায় তিতিবিরক্ত হয়ে অনেকেই নাস্তিকতার দিকে ঝুকেছে, আবার অনেকে খৃষ্টীয় ধর্ম বরণ করে নিচ্ছে। দেশের ভালো ভালো মেধা চলে যাচ্ছে খৃষ্টীয় ধর্মের দিকে। কিন্তু দেবেন্দ্র চান নিজেই নিজের ঈশ্বরকে খুঁজে বার করতে।

এই অনুসন্ধানের যাতনা যে কী তীব্র, তা আর অন্য কে বুঝবে? বিষয় কর্মে একেবারেই মন টেকে না। মানুষের সংসৰ্গও ভালো লাগে না। এক একদিন অফিস ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যান, নৌকোয় গঙ্গা পার হয়ে চলে আসেন শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে। এ স্থান অতি নির্জন। কিড সাহেবের স্মৃতিস্তম্ভের ওপর একাকী বসে থেকে তিনি মনের বিষাদ অপনয়নের চেষ্টা করেন। কিছুতে যায় না সে বিষাদ। রোদুরের রঙ-ও তাঁর ঘোর কালো বলে বোধহয়।

তীব্ৰ অনুসন্ধিৎসায় তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্যের দর্শন গ্রন্থগুলি মন্থন করতে লাগলেন। তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে হিউম ও লকের দর্শনের খুব প্ৰতপত্তি। এরা জড়বাদ ও সংশয়বাদের প্রবক্তা। আমাতেই আমি-র শেষ। আগুনের যে পোড়াবার ক্ষমতা আছে তা চিরসত্য কে বলেছে? আমি ইন্দ্ৰিয়ের সাহায্যে অগ্নিকে প্রত্যক্ষ করি, তার দাহিকা শক্তি আমি অনুভব করি, কিন্তু যেখানে আমি নেই, সেখানেও অগ্নির দাহিকা শক্তির কথা আমি স্বীকার করবো কী করে? মানুষের মন একটা শূন্য পাতা, সেখানে শুধু অভিজ্ঞতার আচড় পড়ে। সমস্ত জ্ঞানই আমাদের অভিজ্ঞতা, এ ছাড়া আর কোনো জ্ঞান নেই। এই জড়বাদ দেবেন্দ্ৰকে তৃপ্তি দেয় না।

প্রকৃতিবাদীরা আবার অন্য কথা বলে। প্রকৃতির অধীনতাই মানুষের সর্বস্ব। এ তত্ত্বে শিউরে ওঠেন দেবেন্দ্র। প্রকৃতির অধীনতাই মানুষের সর্বস্ব? এই পিশাচীর পরাক্রম দুনিবার।–এই পিশাচী প্রকৃতির হাতে তো কারুর নিস্তার নেই। এর কাছে নতশিরে বসে থাকাই যদি চরম কথা হয়, তাহলে আর আশা কৈ ভরসা কৈ?

সংস্কৃত শাস্ত্ৰসমূহ অধ্যয়ন করেও তিনি তৃপ্ত হন না। মাঝে মাঝে একটু একটু যেন আলোক দেখতে পান, আবার হারিয়ে যায়! মনের বিষাদ আর কিছুতেই দূর হয় না। তারপর একদিন অকস্মাৎ এলো সেই উন্মোচনের মুহূর্তটি।

 

একদিন তিনি উপর মহলের সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছেন, এমন সময় দোতলার বারান্দায় দেখলেন কোনো একটি বইয়ের ছিন্ন পৃষ্ঠা উড়ছে। কৌতূহলী হয়ে তিনি কাগজটি তুলে নিলেন। তাতে কিছু সংস্কৃত শ্লোক লেখা আছে। দেবেন্দ্ৰ মোটামুটি সংস্কৃত ভাষা রপ্ত করেছেন, কিন্তু সেই শ্লোকের অর্থ বুঝতে পারলেন না।

সংস্কৃত চচার জন্য তিনি একজন গৃহশিক্ষক রেখেছিলেন। সেই শ্যামাচরণ পণ্ডিতকে ডেকে তিনি বললেন, দেখুন তো, এই পৃষ্ঠাটি কোথা থেকেই বা এলো এবং এতে যা মুদ্রিত রয়েছে, তার অর্থই বা কী?

পণ্ডিত ভ্ৰ কুঞ্চিত করে রইলেন। এই শ্লোক তাঁর কাছেও অপরিচিত, সঠিক অর্থ তাঁর কাছেও পরিষ্কার হচ্ছে না।

দেবেন্দ্র তখন বেশী দেরি করতে পারছেন না। সকাল দশটা বেজে গেছে, এখন তাঁর ইউনিয়ন ব্যাঙ্কে যাবার কথা। তিনি না গেলে ক্যাশ খোলা হবে না। পণ্ডিতকে বললেন, আপনি এর অর্থ করে রাখুন, আমি বৈকালে এসে দেখবোখন।

অফিসে গিয়েও তিনি সর্বক্ষণ ছটফট করতে লাগলেন। নিদারুণ ঔৎসুক্যে তাঁর মর্মপীড়া হতে লাগলো। কোথা থেকে এলো ঐ কাগজটা, কী ওতে লেখা আছে? দ্বিপ্রহরের পর আর থাকতে পারলেন না তিনি। অন্য একজনকে ক্যাশ বুঝিয়ে দিয়ে তিনি দ্রুত গৃহে ফিরে এলেন।

শ্যামাচরণ পণ্ডিতের মুখখানি তখনও মলিন। তিনি শ্লোকের অর্থ উদ্ধার করতে পারেননি। খানিক ইতস্তত করে তিনি বললেন, আপনি বরং রামচন্দ্ৰ বিদ্যাবাগীশকে ডাকাইয়া লউন। আমার মনে হয় এসব ব্ৰহ্মসভার কথা!

ব্ৰহ্মসভার নাম শুনেই দেবেন্দ্রর বুক ধড়াস করে উঠলো। সেই ব্ৰহ্মসভা এখনো আছে? কে চালায়? রামচন্দ্ৰ বিদ্যাবাগীশ? হাঁ তাও তো বটে, রামচন্দ্ৰ বিদ্যাবাগীশ তাঁরই পিতার বেতনভুক। তৎক্ষণাৎ তিনি বিদ্যাবাগীশকে ডাকতে পাঠিয়ে গভীর চিন্তায় ড়ুবে গেলেন।

 

রামমোহন ব্ৰহ্মসভার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একেশ্বরবাদীদের উপাসনার জন্য। হিন্দু, ইহুদী, খৃষ্টান, মুসলমান সকলেই এতে যোগ দিতে পারবে। বিদ্যাবাগীশ তার আগে থেকেই রামমোহনের সঙ্গে আছেন। তাঁর ইচ্ছে এই সভার পক্ষ থেকে বেদান্ত প্ৰতিপাদ্য ধর্ম প্রচার করা হোক। রামমোহন রাজি হননি। নতুন ধর্মের প্রয়োজন নেই, সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যেই যারা নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ ঈশ্বরের উপাসক, তাদের মিলনই চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর উপস্থিতিতে সেখানে সব ধর্মের লোকেরাই আসতো। সন্ধ্যেবেলা ফিরিঙ্গি ও মুসলমান বালকেরা ইংরেজি ও ফারসি ভাষায় স্তব গান করে যেত। বিষ্ণু ও কৃষ্ণ নামে দুই গায়ক ধরতেন গান, তাঁদের সঙ্গে পাখোয়াজ সঙ্গত করতেন গোলাম আব্বাস। বালক দেবেন্দ্র রামমোহনের পাশে বসে শুনতেন।

ব্ৰহ্মসভার জন্য আলাদা গৃহ নির্মাণ করেছিলেন রামমোহন। কিন্তু বছর দু-এক এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার পর তিনি পাড়ি দিলেন ইংলণ্ড। আর ফিরলেন না। রামমোহনের জ্যেষ্ঠপুত্র রাধাপ্রসাদ নিষ্ঠাবান হিন্দু, পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী, পিতার এই ধৰ্মসভাকে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে তিনি আগ্ৰহী হলেন না। এই সভা বন্ধই হয়ে যেত, কিন্তু এগিয়ে এলেন দ্বারকানাথ। সারা দেশ রামমোহনের বিপক্ষে, ব্ৰহ্মসভা স্থাপনের পর থেকেই হিন্দু ধর্ম যায় যায় রব উঠেছিল, গোঁড়ার দল পালটা সভা স্থাপন করেছিল। সুতরাং বিবাদ এড়াবার জন্য দ্বারকানাথ রামমোহনের মতে পুরো মত মেলাননি। তবে বন্ধুর একটি বাসনা বা বাতিককে সম্মান প্ৰদৰ্শন করতে চেয়ে তিনি বললেন যে, ব্ৰহ্মসভা যদি চলে তো চলুক, তিনি এর ব্যয়ভার বহন করবেন।

দেবেন্দ্রনাথের মনে পড়লো একটি দিনের কথা। বালক বয়েসে তিনি মাণিকতলায় রামমোহন রায়ের গৃহে প্রায়ই যেতেন। একবার তিনি গিয়েছিলেন রাজাকে দুর্গোৎসবের নিমন্ত্রণ করতে। দেবেন্দ্র যেই বললেন, রামমণি ঠাকুরের বাড়িতে আপনার দুর্গোৎসবের নিমন্ত্রণ, অমনি চমকে উঠলেন রাজা। তিনি বললেন, আমাকে পূজায় নিমন্ত্রণ? তিনি পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে এত প্রতিবাদ করছেন, তবু লোকে তাঁকে পূজায় ডাকে? রামমোহন তাঁর বন্ধুপুত্র দেবেন্দ্রকে সম্বোধন করতেন বেরাদার বলে। তিনি বললেন, বেরাদর, আমাকে নয়, আমার পুত্র রাধাপ্ৰসাদকে নিমন্ত্রণ করো গে।

আমাকে পূজায় নিমন্ত্রণ? সেই বিস্মিত স্বর যেন দেবেন্দ্রের কানে আবার ভেসে উঠেছিল, অথচ অনেকদিন ভুলে ছিলেন মাঝখানে। আর একটা কথাও মনে পড়লো তাঁর। বিলাত যাত্রার কিছুক্ষণ আগে রামমোহন এসেছিলেন দ্বারকানাথের কাছে বিদায় নিতে। খানিক কথাবার্তার পর তিনি বলেছিলেন, দেবেন্দ্ৰ কোথায়? দেবেন্দ্ৰকে ডাকে। তার কাছ থেকে বিদায় না নিয়ে আমি যাবো না।

কিশোর দেবেন্দ্ৰ এলে রাজা সাগ্রহে তার হাত চেপে ধরেছিলেন। সেই ব্যবহারের কোনো গুঢ় অর্থ ছিল কি? রাজা কি বোঝাতে চেয়েছিলেন, বেরাদর দেবেন্দ্ৰ, আমি তোমার পিতাকে জানি। তিনি বৈষয়িক লোক। কিন্তু আমার কার্যভার তুমি লাও!

অথচ প্রমোদে প্রমাদে সে কথা ভুলে ছিলেন দেবেন্দ্ৰ। প্রবাসে রাজার মৃত্যুর পর দু-একবার মাত্র ব্ৰহ্মসভায় গিয়েছিলেন তিনি। নিছক কৌতূহল বশে। সেখানে তখন দারুণ দৈন্য দশা। প্রবল জেদে রামচন্দ্ৰ বিদ্যাবাগীশ একাই সেখানকার দীপ জ্বেলে রেখেছেন। আর একজন দ্রাবিড় ব্ৰাহ্মণ সেখানে উপনিষদ পাঠ করেন। কোনো কোনো দিন তিনি না এলে রামচন্দ্ৰ বিদ্যাবাগীশ নিজেই একমাত্র উপাসক। নিজেই উপাচার্য এবং নিজেই শ্রোতা। বৃষ্টি বাদলার দিন কিছু লোক এমনিই হঠাৎ ঢুকে পড়ে সেখানে। তাদের কারুর হাতে বুজার ভর্তি ধামা, কারুর হাতে টিয়াপাখি। উৎসাহিত হয়ে রামচন্দ্ৰ বিদ্যাবাগীশ উপদেশ শুরু করে দেন, শ্রোতারা গোল গোল চক্ষু করে শোনে এবং বৃষ্টি থামা মাত্র হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে চলে যায়।

এসব দেখে কৌতুক বোধ করেছিলেন দেবেন্দ্র। আর যাননি। মধ্যে কয়েক বৎসর তিনি ব্ৰহ্মসভার কথা একেবারেই বিস্মৃত হয়ে ছিলেন।

 

ডাক পেয়ে রামচন্দ্ৰ বিদ্যাবাগীশ জোড়াসাঁকোয় ঠাকুরবাড়িতে এসে দেবেন্দ্রর সামনে আসন গ্ৰহণ করলেন। যথাবিহিত সম্মান প্ৰTর্শনের পর দেবেন্দ্র প্রশ্ন করলেন, মহাশয়, এই ছিন্ন পৃষ্ঠাটি কোন গ্রন্থের? এই শ্লোকের অর্থ আপনি আমার নিকট ব্যাখ্যা করতে পারেন কি?

বিদ্যাবাগীশ পৃষ্ঠাটি পরীক্ষা করে বললেন, ইহা তো ঈশোপনিষদের শ্লোক। ব্ৰহ্মসমাজ সংকলিত গ্ৰন্থ হইতে ছিন্ন হইয়াছে। এ কাগজ এ স্থলে আসিল কী প্রকারে?

দেবেন্দ্র বললেন, তাহা আমি জানি না। আপনি শ্লোকের অর্থ আমাকে বুঝিয়ে দিন। বিদ্যাবাগীশ শ্লোকটি উচ্চারণ করলেন।

ঈশাবাস্যমিদং সৰ্ব্বং যৎকিঞ্চি জগত্যাং জগৎ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জ থাঃ মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনং।।

তারপর প্রথমে বললেন, আক্ষরিক অর্থ। ঈশ্বরের দ্বারা সমস্ত জগৎকে আচ্ছাদন করে। তিনি যাহা দান করেছেন, তাহাই উপভোগ করে।

এবার শুরু করলেন ব্যাখ্যা। তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ-তিনি যাহা দান করিয়াছেন, তাহাই উপভোগ করো।–তিনি কী দান করিয়াছেন? তিনি আপনাকেই দান করিয়াছেন। সেই পরম ধনকে উপভোগ করো। আর সকল ত্যাগ করিয়া সেই পরম ধনকে উপভোগ করো।…

দেবেন্দ্ৰ যেন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তিনি ঈশ্বরের স্বরূপ খুঁজছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, ঈশ্বরকে কোথায় পাবেন? এখন শুনলেন ঈশ্বরের দ্বারাই সমুদয় জগতকে আচ্ছাদন করে। তিনি আপনাকেই দান করেছেন—এর থেকে বেশী মানুষ আর কী চাইতে পারে?

এই উড়ন্ত কাগজ যেন এক দৈববাণী বহন করে আনলো তাঁর কাছে। অভিভূতের মতন উঠে গিয়ে তিনি বিদ্যাবাগীশকে প্ৰণাম করলেন।

রামচন্দ্ৰ বিদ্যাবাগীশও ব্যাকুল হয়ে খুঁজছিলেন একজন মন্ত্রশিষ্যকে। দেবেন্দ্রর মধ্যে তিনি তাকে পেয়ে গেলেন। এক প্রচারকের সঙ্গে মিলন হলো এক মুমুক্ষুর।

তাঁর এই নবলব্ধ জ্ঞানের চাচা ও প্রসারের জন্য দেবেন্দ্র কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন তত্ত্বরঞ্জিনী সভা। দ্বিতীয় বৎসর সেই সভার নাম বদলে হলো তত্ত্ববোধিনী। বাড়ির একতলার একটি অন্ধকার ঘরে বসে এর অধিবেশন, রামচন্দ্ৰ বিদ্যাবাগীশ নিয়মিত এখানে এসে বেদান্ত প্রতিপাদ্য ধর্ম বিষয়ে নানান উপদেশ দেন। দেবেন্দ্ৰ ভেবেছিলেন এ কাজ চলবে তাঁর পিতার অজ্ঞাতসারে। কিন্তু তীক্ষ্ণধী দ্বারকানাথের কাছে কিছুই গোপন থাকে না। একদিন তিনি বেদান্তবাগীশকে ডেকে ধমক দিয়ে বললেন, একেই তো দেবেন্দ্রর বিষয়বুদ্ধি অল্প, তার ওপর তার মাথায় ব্ৰহ্ম ব্ৰহ্ম ঢুকিয়ে যে তার সর্বনাশ কচ্চো।

দেবেন্দ্র পিতার এই ভ্রূকুটি মান্য করলেন না। তত্ত্ববোধিনী সভার তরফ থেকে প্রকাশিত হলো পত্রিকা, স্থাপিত হলো বিদ্যালয়। বাণিজ্য-রাজ দ্বারকানাথের পুত্র হয়ে তিনি মেতে রইলেন নিছক যত অ-বাণিজ্যিক কাজে। এমন কি একবার তত্ত্ববোধিনী সভার সাম্বাৎসরিক উৎসবে কলকাতায় তাঁদের পরিবারের যতগুলি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের অফিস আছে তার সমস্ত কর্মচারীদের নামে তিনি আলাদা করে নিমন্ত্রণ পত্ৰ পাঠালেন। তত্ত্ববোধিনী সভা ততদিন পর্যন্ত ছিল অনেকটা গুপ্ত ধরনের ব্যাপার, মাত্র একশত দেড়শত লোকের জ্ঞাত ছিল এ খবর। কর্মচারীরা এ সভার নামই শোনেনি, এমন কি নাম শুনেও অর্থ বুঝতে পারলো না। অবশ্য মালিকাপুত্রের নিমন্ত্রণই আদেশের সমান, এসে উপস্থিত হলো সকলেই। শঙ্খ, ঘণ্টা ও শিঙা বাজিয়ে রাত্রি আটটায় দরজা খোলা হলো সভাকক্ষের। লাল রঙের বনাত গায় দিয়ে দশ জন দশ জন করে দুই সারিতে বিশ জন দ্রাবিড় ব্ৰাহ্মণ সমস্বরে করলেন বেদপাঠ। তারপর দেবেন্দ্ৰ পুতুল পূজার পরিবর্তে নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ ঈশ্বরের তত্ত্ব ব্যাখ্যান করলেন। এরপর আরও বক্তৃতা। একের পর এক। রামচন্দ্ৰ বিদ্যাবাগীশ একাই লাগিয়ে দিলেন দু ঘণ্টা। রাত দুটোর পর কর্মচারীরা বিমূঢ় বিহ্বল অবস্থায় বাড়ি ফিরলো। এ সব কী কাণ্ড হচ্ছে ওখানে, কিছুই তাদের মাথায় ঢুকলো না। কিন্তু তাতেও উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলো দেবেন্দ্রর। তিনি তত্ত্ববোধিনী সভাকে প্রকাশ্যে, জনসমক্ষে নিয়ে এলেন।

কিছুদিনের মধ্যেই দেবেন্দ্ৰ বুঝলেন, তত্ত্ববোধিনী সভা ও ব্ৰহ্মসমাজকে আলাদা করে রেখে লাভ নেই। দুই সভারই উদ্দেশ্য যখন এক, তখন একসঙ্গে মিলে যাওয়াই ভালো। তত্ত্ববোধিনী সভার মাসিক উপাসনা হতে লাগলো। ব্ৰহ্মসভার উপাসনার সঙ্গে মিলিয়ে।

এই পর্যন্ত এগিয়ে দেবেন্দ্র একটু থমকে ছিলেন। রামমোহনের ব্ৰহ্মসভার সঙ্গে প্রকাশ্যে একাত্মতা স্থাপনের বহু রকম প্রতিকূলতা দেখা দেবার সম্ভাবনা। শুধু হিন্দুসমাজের কাছ থেকেই নয়, নিজেদের পরিবার থেকেও। স্বয়ং পিতা কী বলবেন ঠিক নেই। দ্বারকানাথ পুত্ৰকে মুখে রূঢ় বাক্য বলেন না, কিন্তু সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণে তিনি অবিচল।

কিন্তু দেবেন্দ্র তখনও অস্থির হয়ে আছেন। তাঁর নির্মল চিত্তে কোনোরূপ ছলনার স্থান নেই। বহুকালাবধি প্রচলিত ধমীয় আচার, সংস্কার ও পূজা পার্বণ সম্পর্কে তাঁর মন বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছে। একথা সকলকে না জানানো পর্যন্ত তাঁর স্বস্তি নেই। যে সত্যের সন্ধান তিনি পেয়েছেন, সেই সত্যের স্বাদ তিনি দিতে চান অন্যকে। এই সত্য সাধনা যেন পৃথক এক ধর্ম, এর প্রচার প্রয়োজন। এবং তারও আগে প্রয়োজন এক ধর্মীয় দল স্থাপনের। দেশের মানুষকে খৃষ্টানী থেকে দূরে সরিয়ে আনার জন্য এই নব ধর্মের প্রচার ছাড়া গত্যন্তর নেই।

এ ব্যাপারেই দ্বিধায় দুলছিলেন তিনি। বেলগাছিয়া ভিলা থেকে অকস্মাৎ চলে এসে বারান্দায় একলা বসে থেকে তাঁর বারংবার মনে হতে লাগলো, বৃথা সময় চলে যাচ্ছে। তাঁর পিতার বাহ্য আড়ম্বর ও জাঁকজমকের বিরুদ্ধে তাঁর একটা প্ৰতিবাদ রাখা দরকার। জীবনের উদ্দেশ্য নয় পার্থিব জগতে সবার উর্ধের্ব ওঠা, জীবনের উদ্দেশ্য সত্যের প্রতিষ্ঠা।

জ্যোৎস্নময় আকাশের দিকে চেয়ে তিনি প্রেরণা চাইলেন, তাঁর মনে বল এলো, তিনি উঠে দাঁড়িয়ে তৎক্ষণাৎ মনে মনে একটি শপথ নিয়ে নিলেন।

৭ই পৌষ দেবেন্দ্র তাঁর কুড়িজন বন্ধুর সঙ্গে এক নতুন ধর্মে দীক্ষা নিলেন। ব্ৰাহ্মসমাজের যে নিভৃত কুঠুরীতে বেদ পাঠ হতো, সেই কুঠুরী ঢেকে ফেলা হলো পদ দিয়ে, মধ্যে একটি বেদী, তার ওপরে বসলেন বৃদ্ধ রামচন্দ্ৰ বিদ্যাবাগীশ। সেদিন বৃহস্পতিবার, দুপুর তিনটের সময় দেবেন্দ্র অফিস ছেড়ে চলে এসেছেন। বিদ্যাবাগীশকে তিনি বললেন, হে আচার্য, বিশুদ্ধ ব্ৰাহ্ম ধর্মব্রত গ্রহণ করিবার জন্য আমরা সকলে আপনার নিকট উপনীত হইয়াছি।…যাহাতে আমরা অদ্বিতীয় পরম ব্ৰহ্মের উপাসনা করিতে পারি, যাহাতে সৎকর্মে আমাদের প্রবৃত্তি হয় এবং পাপ মোহে মুগ্ধ না হই, এরূপ উপদেশ দিয়া আমাদের সকলকে মুক্তির পথে উন্মুখ করুন।

বিদ্যাবাগীশের চক্ষে অশ্রু এসে গেল। বহুদিন পর তাঁর স্বপ্ন সফল হতে চলেছে।

বয়েস অনুসারে প্রথমে শ্ৰীধর ভট্টাচার্য, পরে শ্যামাচরণ ভট্টাচার্য এগিয়ে গিয়ে বেদীর সামনে প্রতিজ্ঞা পাঠ করে ব্ৰাহ্মধর্ম গ্ৰহণ করলেন। তৃতীয় ব্ৰাহ্ম হলেন দেবেন্দ্রনাথ। তারপর তাঁর ভাই গিরীন্দ্রনাথ এবং অক্ষয়কুমার দত্ত ও অন্যান্যরা। দীক্ষান্তে নবীন ব্ৰাহ্মীরা প্রত্যেকে পরস্পরকে আলিঙ্গন করলেন। এক সামাজিক বিপ্লব ঘটতে চলেছে যে, সেই সচেতনতা থেকে তাঁদের শরীরে রোমাঞ্চ হতে লাগলো।

দেবেন্দ্র সকলকে বললেন, পূর্বে ব্ৰাহ্মসমাজ ছিল। এখন ব্ৰাহ্মধর্ম হইল। ব্ৰহ্ম ব্যতীত ধর্ম থাকিতে পারে না এবং ধর্ম ব্যতীতও ব্ৰহ্ম লাভ হয় না।

এইভাবে রামমোহনের আদর্শ থেকে কিছু বিচ্যুত হয়ে বিদ্যাবাগীশ ও দেবেন্দ্ৰ সূচনা করলেন এক পৃথক ধর্মের। রামমোহন চেয়েছিলেন সর্বধর্মের মধ্য থেকে সংস্কারমুক্ত একেশ্বরবাদী মানুষগুলিকে এক জায়গায় এনে জড়ো করতে, সেইজন্যই তিনি পৃথক নাম দিয়ে কোনো ধর্ম প্রচার করতে চাননি। আর দেবেন্দ্ৰ স্থাপন করলেন, শুধু উচ্চবর্ণের হিন্দু ভদ্র সমাজের জন্য এক বিদ্রোহী ধর্মের। অবশ্য রামমোহনের মতটি ছিল একটি তত্ত্ব মাত্র, আর দেবেন্দ্রর অধ্যক্ষতায় নবপ্রতিষ্ঠিত ধর্মটি বাস্তব পথ নিল অচিরেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *