জুয়াখেলার উৎস সন্ধানে
পাঠক মহাশয়! আজকে সগর্বে স্বীকার করবেন, যেমনটি আমরাও করি, যে, ভারতবর্ষে জন্ম নিয়ে অতি শৈশবকাল থেকেই আমরা বেদ-উপনিষদের নির্গলিতাৰ্থ উপলব্ধি করতে পেরেছি। পাঠক এও স্বীকার করবেন যে, সেই শৈশবেই পিতৃ-পিতামহক্রমে অসংখ্য সদুপদেশ লাভ করেও জীবনে চলার পথে ততোধিকবার সেই সব সদুপদেশের বিরুদ্ধাচরণ করেছি, এবং তাও পিতৃপিতামহক্রমেই। অতএব শুধু নামেমাত্র অসৎ এই প্রবন্ধটি লিখবার পথে ধর্মের কোনো অতিক্রম যদি ঘটে, তাহলে মনে রাখতে হবে–একটা ঐতিহ্যময় সমাজ সচলভাবে গড়ে উঠতে ভালো-মন্দ দুই-ই লাগে এবং ঐতিহ্য মানে শুধু ভালো থাকার ইতিহাস নয়, যা ছিলাম–তারই যথাগত ইতিহাস। সেই ইতিহাসের মধ্যেও আমার প্রবন্ধের পরিসরটুকু যে শুধু মন্দাংশ, তাও আমি বলতে পারব না। তবে এটুকু বলতে পারি–এ আমাদের জীবনাংশ বটেই। কাজেই আসল কথায় আসি।
মহারাজ পরীক্ষিৎ তখন হস্তিনাপুরের রাজা। পাণ্ডবেরা স্বর্গারোহণ করেছেন, ভগবান কৃষ্ণও যথাসাধ্য যথামতি ভূভারহরণ করে ধর্ম এবং জ্ঞানকে সঙ্গে করে স্বধামে চলে গেছেন। এমনই কোনো এক সময়ে পরীক্ষিৎ একটি দুঃসংবাদ পেলেন। তিনি শুনলেন–তাঁর সাম্রাজ্যচক্রে কলি, অধর্মের প্রতিমূর্তি কলি, প্রবেশ করেছে। খবর শুনেই তিনি ধনুক-বাণখানি হাতে করে সদলবলে রওনা হলেন কলিকে দমন করতে। পথে যেতে যেতে ধর্মরূপী এক ষাঁড়কে দেখতে পেলেন, যার তিনখানি ঠ্যাঙই ভেঙে গেছে। অর্থাৎ চতুষ্পদ ধর্মের একপাদমাত্র অবশিষ্ট আছে। একখানি পায়ে সেই ধর্মের ষাঁড় কীভাবে পথ চলছিলেন জানি না, কিন্তু ভাগবত পুরাণ লিখেছে, তিনি চলছিলেন–পাদেনৈকেন চরণ। যাহোক সেই একপাওয়ালা ষাঁড়ের সঙ্গে বিবৎসা মায়ের মতো পৃথিবীর সুখ-দুঃখের কথা শুনে পরীক্ষিতের এই বোধ আরও তীব্র হল যে কলিকে এখুনি মারা দরকার। পরীক্ষিৎ খঙ্গ তুললেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কলি তার পায়ে লুটিয়ে পড়ল। পাণ্ডবকুলের একমাত্র বংশধর হয়ে কি শরণাগতকে বধ করা চলে! তিনি কলিকে বললেন–বেরিয়ে যাও আমার রাজ্য থেকে। যেখানে যজ্ঞনিপুণ ব্রাহ্মণেরা সবসময় যজ্ঞ করে যজ্ঞেশ্বর বিষ্ণুর সংবাহন করছেন ব্রহ্মাবৰ্ত্তেযত্র যজন্তিযজ্ঞৈ যজ্ঞৈশ্বরং যজ্ঞ বিতান বিজ্ঞাঃ, যেখানে থাকতে গেলে ধর্ম আর সত্যই একমাত্র সম্বল–সেই ব্রহ্মবর্তে তোমার স্থান হবে না। তুমি বেরিয়ে যাও আমার রাজ্য থেকে।
বিপন্ন কলি বলল–আমি যাব কোথায়? যেখানেই যাব সেখানেই তো আপনি খঙ্গ- হাতে ছুটবেন, কারণ সব তো আপনারই রাজ্য। পাঠক মনে রাখাবেন, তখন পৃথিবী বলতে ভারতবর্ষকেই বোঝাতে এবং কলি যেহেতু আধুনিক পৃথিবীর অন্য মুক্তাঞ্চলগুলির কথা জানতেন না, তাই তিনি পরীক্ষিৎকে বলতে বাধ্য হলেন–আমাকে আপনি যে জায়গায় রাখবেন, সেইখানেই আমি থাকব। শরণাগতপালক পরীক্ষিৎ কলিকে অভয় দিয়ে বললেন–ঠিক চারটি জায়গায় তোমার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা আমি করতে পারি–একটা হল দাবা-পাশার আড্ডা, পানশালা, গণিকালয় আর বৃথা প্রাণিহত্যার জায়গাগুলি। কলি ভাবল–আমার যা পরিবার তাতে এত অল্প জায়গায় কুলোবে কেন! অনেক কাকুতি-মিনতি করে সে আরও একটু জায়গা চাইল পরীক্ষিতের কাছে। উদারচেতা পরীক্ষিৎ এবারে কলিকে সুবৰ্ণ ভিক্ষা দিলেন। পাঠকের একটু হতচকিত লাগছে ঠিকই এবং আমরাও হয়তো ভাবতে শুরু করেছি যে, সোনার দোকানগুলির ওপর পরীক্ষিতের এই সর্বশেষ সংশোধনীটির কোনো প্রভাব পড়ে থাকতে পারে হয়তো; কিন্তু ভাগবত পুরাণ বলেছে যে, পরীক্ষিতের ওই সর্বশেষ প্রত্যাদেশ বলে দাবা-পাশা, পানশালা–এগুলোর সঙ্গে টাকাপয়সার সম্পর্কটা পাকা হয়ে গেল।
ঋগবেদের একজন ঋষি–তার নাম কবষ। কবষমুনি জাতিতে শূদ্র ছিলেন। তিনি পূর্বে একবার ঋষিদের যজ্ঞস্থলীতে উপস্থিত হয়েছিলেন বলে ঋষিরা তাঁকে যা-তা বলে প্রায় ঠেঙিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারপরে নিদারুণ তপস্যা করে তিনি মুনিত্ব লাভ করেন। এই কবষমুনি দাবা-পাশা আর জুয়াখেলা নিয়ে ঋবেদের এক সম্পূর্ণ সূক্ত গেঁথেছেন এবং সে সূক্তগুলি জুয়াড়িদের আত্মকথা। ঋগবেদের ঋষির মুখে অক্ষক্রীড়ার অনুপুঙ্খ বর্ণনা শুনে মনে হবে, জুয়াখেলা সম্বন্ধে ঋষির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল। স্বয়ং ঐতরেয় ব্রাহ্মণই আমাদের সঙ্গে একমত। ঐতরেয় বলেছে-মুনি তার পূর্বাশ্রমে নিজেই ছিলেন পাকা জুয়াড়ি। নিরুক্তকার যাস্ক তো আরও পরিষ্কার করে বলেছেন যে, এই কবষমুনি জুয়াখেলায় সর্বস্ব খুইয়ে ধ্যানমন্ত্রে অক্ষক্রীড়া সম্বন্ধে যা জেনেছিলেন তাই জানিয়েছেন তার। অক্ষসূক্তেঋষেঃ অপরিদুনস্য এতদার্ফং বেদয়ন্তে।
ঋষি বলেছেন বড়ো বড়ো পাশার ঘুঁটিগুলো যখন ছকের ওপর ইধার-উধার পড়তে আরম্ভ করে, তখন আমার যে কী মাতোয়ারা লাগে কী বলব–বেপা মা বৃহতো মাদয়ন্তি। মূজবান পাহাড়ে জন্মানো সোমলতার স্বাদ যেমন চমৎকার, তেমনি বিভীতক কাঠের তৈরি পাশার যুঁটিগুলোও আমাকে একইরকম আনন্দ দেয়। আমার বউটি ছিল দারুণ সুন্দরী। (প্রথম প্রথম যখন জুয়াখেলা ধরলাম) তখনও আমার বউ আমার ওপর কোনো বিরাগ দেখায়নি। বরঞ্চ জুয়া খেলি বলে আমি যদি লজ্জা পাই, তাই নিজের লজ্জাও সে চেপে রাখতন মা মিমেথ ন জিহীল এষা–ভারী বুদ্ধিমতী। (প্রথম প্রথম) আমাকে এবং আমার (আল্ডার) বন্ধুদেরও যথেষ্ট যত্ন-আত্তি করত–শিবা সখিভ্য উত মহ্যমাসীৎ। কিন্তু শুধু পাশাখেলার খাতিরেই আমার অনুব্রতা গৃহিণীকে আমি পরিত্যাগ করেছি।
এ পর্যন্ত কবষমুনি যা বলেছেন, তাতে বেশ বোঝা যায় সেই কোন যুগে দাবা-পাশাকে কেন্দ্র করে জুয়া জিনিসটা মানুষের কীরকম প্রিয় ছিল। জুয়াড়ি যখন স্ববশে থাকে, যখন সে নিজের বুদ্ধির অন্তরে প্রবেশ করে, তখন সে বুঝতে পারে–পাশা খেললে নিজের স্ত্রী পর্যন্ত তাকে ত্যাগ করে, শাশুড়িও তাকে অকথ্য গালাগালি দেয়। যদি কারও কাছে সে কিছু চায়, তো দেবারও লোক নেই। কেউ যেমন পয়সা দিয়ে বুড়ো ঘোড়া কেনে না, তেমনি জুয়াড়িকেও কেউ ভালোবাসে নানাহং বিন্দামি কিতবস্য ভোগম।
জুয়াড়ি জানে যে, সে তার পরিণীতা স্ত্রীর কাছে অন্যায় করেছে এবং সেইজন্যেই তার শাশুড়ি তাকে গালাগালি দেয়। সে জানে–কেউ তাকে পয়সা দেবে না, কিন্তু ওই যে বিভীতক কাঠের ঘুঁটিগুলি–সেগুলি যেন নিশিডাকের মতো তাকে টেনে নিয়ে যায় জুয়ার আড্ডায়। কবষমুনির অনুভব-ঋদ্ধ একটি ঋমন্ত্রে দেখিজুয়াড়ির বাপ-মা-ভাই বিপদের সময় লজ্জায় বলে একে আমরা চিনি না, একে বেঁধে নিয়ে যাও–পিতা মাতা ভ্রাতর এনমাহু/ ন জানীমো নয়ত বদ্ধমেন। ঋকবেদের ঋষি জানতেন যে, জুয়াড়ির চোখ সব সময় থাকে অন্যের টাকার থলির ওপর। সেই লোভের ফল হয় এই যে, অতিরিক্ত টাকার নেশায় তার ব্যক্তিজীবন যায় হারিয়ে। লজ্জায় অবহেলায় তার রূপবতী স্ত্রী আশ্রয় খোঁজে অন্য মানুষের ভালোবাসায়, অন্যেরাও সুযোগ বুঝে অরক্ষিতার চরিত্র হনন করে–অন্যে জায়াং পরিশন্তি। একদিকে ঘরবাড়ি দাম্পত্য জীবন, অন্যদিকে পাশাখেলার দুর্বার আকর্ষণ–এই দুয়ের দ্বৈরথে জুয়াড়ির মনে সুমতি-কুমতির দ্বন্দ্ব চলে ঠিকই; কিন্তু সে যেই শুনতে পায় পিঙ্গল পাশা-ঘুঁটির দান পড়ল ছকের ওপর, সঙ্গীসাথিরা সব হইহই করে উঠল–তখন আর সে থাকতে পারে না, ব্যভিচারিণী রমণীর মতো সে বেরিয়ে পড়ে তাড়নায় নিষ্কৃতং জারিণীব।
অন্তত আড়াই থেকে তিন হাজার বছর আগে ঋগবেদের ঋষি যে এক জুয়াড়ির মনস্তত্ত্ব নিয়ে এত মাথা ঘামিয়েছিলেন, তা কে জানত। ঋষি বলেছেন জুয়াড়ি সব সময় ভাবে আমি জিতব–জেষ্যামীতিকিন্তু পাশার দানগুলি যখন প্রতিপক্ষের সৌভাগ্য বয়ে আনে বিতিরন্তি কামং প্রতিদীনে–তখন সে যেন বাণের মতো, ছুরির মতো বুকে বেঁধে। আর যে জয়ী হয় তার যেন পুত্রলাভ হল, যেন সে মধুমাখা খাবার পেয়েছে মুখের কাছেমধ্বা সম্পৃক্তঃ কিতবস্য বর্ণা। পাশার ঘুঁটিগুলোর হাত নেই, কিন্তু যাদের হাত আছে সেই খিলাড়িদের ওপর বিনা হাতেই সে প্রভুত্ব করে। ঘুঁটিগুলো দেখতে কী সুন্দর, স্পর্শ করলে কী ঠান্ডা, কিন্তু সুরলোকের আগুন গায়ে মাখিয়ে ঘুঁটিগুলো যেন বসে আছে ছকের ওপর–মনকে শুধু দহনই করে–হৃদয়ং নিদহন্তি। স্বপ্নের দানটি জিতবে বলে মলমূত্র বন্ধ করে জুয়াড়ি বসে থাকে, তার ছেলে কোথায় গেছে–সেই ভেবে তার মা হয়ে ওঠে ব্যাকুল আর জুয়াড়ি! সকালবেলায় সে পাশার ঘুঁটিওয়ালা ঘোড়ার রথে দিগভ্রমণে বেরিয়েছিল, সন্ধ্যার অন্ধকারে উত্তমর্ণের ভয়ে সেই এখন গা ঢাকা দিয়েছে। তবু এখনও তার কিছু ধার চাই, তাকে যে জিততে হবে–ঋধ্যা বিভ্যদ ধনমিচ্ছমানোহন্যেষামস্তমুপনমেতি।
কবষমুনির আত্মকথা এই যে অক্ষসূক্ত-এর প্রত্যেক ঋক্ নিয়ে বিচার হয়েছে অনেক। কেউ বলেন অক্ষক্রীড়া ছেড়ে কৃষিকর্মের জন্যেই এই মন্ত্রবর্ণ, কেননা এই সূক্তের তেরো নম্বর ঋকে জুয়া ছেড়ে কৃষিকর্ম করতে বলা হয়েছে। আবার শৌনকের মতো অতি প্রাচীন বোদ্ধা বলেছেন–জুয়াখেলায় জেতবার জন্যই এই মন্ত্রের বিনিয়োগ। তিনি জুয়াড়িদের উপদেশ দিয়েছেন বিভীতক কাঠের তৈরি অন্তত তিনটি ঘুঁটি গন্ধেপুষ্পে তিনদিন ফেলে রাখতে হবে খোলা হাওয়ায়। তারপর জুয়া খেলতে যাবার আগের দিন রাত্রে ওই তিনটি ঘুঁটি হাতে নিয়ে, জোড়াপায়ে দাঁড়িয়ে কবষমুনির অসুক্তের প্রথম পরিচ্ছেদটি পাঠ করবে। তারপরের দিন কাকভোরে উঠে আবার ওই মন্ত্রগুলি পাঠ করে লম্বা দেবে জুয়ার আড্ডায় ব্যস্ জেতা কে আটকায়।
শৌনকের এই ঋগ বিধান আজকের জুয়াড়িরা মনে রাখেননি, বা ঠিকমতো প্রয়োগও করেননি আর আজকের পণ্ডিতেরাও নানা কিসিমের ব্যাখ্যা করে এই মন্ত্রের শক্তিও রহিত করে দিয়েছেন। এখনকার সমাজ-ইতিহাসবেত্তারা আবার এই অক্ষসূক্তের মধ্যে শুধুই মনরে কৃষি-কাজ জান না’–এইরকম একটা সুর শুনতে পান। কিন্তু এ ব্যাপারে অতি প্রাচীন বৃহদেবতাই বোধহয় সবচেয়ে বিজ্ঞানসম্মত কথাটি বলেছে। এই গ্রন্থের মতে, অক্ষসূক্তের ত্রয়োদশ ঋটি অবশ্যই কৃষিপ্রশংসায় বিনিযুক্ত–এয়োদশী কৃষিং স্তৌতি, কিন্তু বেশিরভাগ ঋকই জুয়াড়িদের জয়লাভের মন্ত্র।
জুয়া নিয়ে পণ্ডিতদের কচকচি ভালো লাগে না। আমরা বরং শৌনক কিংবা বৃহদেবতার পথ ধরে সিদ্ধান্ত করতে পারি যে খোদ ঋগবেদের আমলে অক্ষক্রীড়া শুধু বিনোদনের জিনিস ছিল না, এর সঙ্গে বাজি ধরার ব্যাপারটাও ছিল। স্বয়ং মুনিরাও যজ্ঞস্থানে বসে যজ্ঞের সভ্যাগ্নি স্থাপনের অঙ্গ হিসেবে পাশা খেলতেন এবং তাতে বাজি থাকত একটি গোর। রাজসূয় যজ্ঞের মতো যজ্ঞে রাজার হাতে মুনিরা দিতেন পাঁচটি পাশার ঘুঁটি–চতুর্দিক এবং অন্তরীক্ষ জয়ের প্রতীক হিসেবে। একটি ঋকে বলা হয়েছে–দেবতারা মানুষকে যে ধনদান করেন অথবা তার বিত্ত হরণ করেন–এ দুটিই হল পাশাখেলায় দান জেতা কিংবা হারার মতো। বেশ বোঝা যায় পাশাখেলার সঙ্গে বাজি ধরা এবং টাকাপয়সার যোগ ছিল সেই বেদের আমল থেকেই। বস্তুতপক্ষে পাশাখেলার বিভিন্ন দিক নিয়ে বৈদিক যুগেই যে চিত্র পাওয়া যায়, এমনটি বোধহয় কোথাও নয়। তবু দ্যূতক্রীড়াকে যদি সম্পূর্ণ করে একটি জায়গায় পেতে হয়, তাহলে ইতিহাস, পুরাণ, কাব্য–সবারই সাহায্য লাগবে।
প্রথমেই বলি, অক্ষক্রীড়া বা দূতক্রীড়া–এই শব্দগুলি জুয়াখেলার সাধারণ নাম। বাস্তবিকপক্ষে এই খেলা কী করে সম্পন্ন হত তাই নিয়ে বহু বিচার-চৰ্চা আছে এবং যুগে যুগে সে খেলার পরিবর্তনও ঘটছে। বৈদিক যুগে যে বিভীতকের ঘুঁটি দিয়ে পাশার দান দেওয়া হত সেই বিভীতক আসলে একধরনের গাছ, যার ফলের নাম বিভীতক, ঠিক যেমন আপেল গাছের ফলের নাম আপেল। এই বিভীতক আসলে বহেড়া বা বয়ড়া, এই ফলের কোনোদিকই সমান নয় বলে, এর এক এক দিকে যে সংখ্যা লেখা থাকবে, তাও সম্ভব নয়। এখনকার পণ্ডিতেরা মনে করেন এ খেলা ছিল জোড়-বিজোড়ের খেলা। এ বিষয়ে আর একটু প্রবেশের জন্য দুটি শব্দ প্রথমেই জানা দরকার–দুরোদর’ এবং’গ্লহ’। দুরোদর’ শব্দটি পরবর্তী কালের কাব্যরসিকেরা ব্যবহার করেছেন সাধারণ পাশাখেলার অর্থেই, যেমন ভারবি ‘দুরোদর-ছদ্মজিং সমীহতে। কিন্তু এখনকার পণ্ডিতেরা দুরোদর’মানে করেছেন–জুয়াড়ির যতগুলি ঘুঁটি আছে, তার সমূহ-সংখ্যাটি। এই ঘুঁটিগুলি একটি পাত্রে রাখা হত তাকে বলা হত ‘অক্ষাবাপন’। তার দান ফেলবার আগে জোড় না বিজোড়–সেই সম্বন্ধে দ্যুতকরের ডাকটিই হল ‘গ্লহ’ যাকে পরবর্তী সংস্কৃতে বলি ‘গ্রহ’।
খেলাটি দাঁড়াত এইরকম : একজন হাঁক দিয়ে তার গ্রহটি বলল, তারপর ‘অক্ষবাপন’ থেকে ঘুঁটি নিয়ে ‘অধিদেবন’ কিংবা ইরিণ’ নামক স্থলে, মানে একটুকরো কাপড়ের ওপর কিংবা মাটিতেই দান ফেলল। তার পূর্বকথা মতো, ধরুন সে যদি জোড়দান বলে থাকে, সেই গ্রহ অনুসারে যদি জোড়ই দান পড়ে তবে সে জিতল। যদি তা না হয় তবে তার প্রতিপক্ষের পালা। পূর্বে উল্লিখিত ঋগবেদের অক্ষসূক্তে ত্রিপঞ্চাশৎ’ মানে তিপ্পান্নখানা ঘুঁটি নিয়ে খেলার কথা আছে, কিন্তু ওই অর্থটা সায়নের, যা আজকের পণ্ডিতেরা মানেন না। তারা বলেন ত্রিপঞ্চাশৎ’ মানে একশো পঞ্চাশ, হয়তো তাই হবে কেননা রাজসূয় যজ্ঞের রাজকীয় খেলাতে হাজারখানা কী একশোখানা ঘুঁটি লাগত, অগ্ন্যাধেয় যাগেও কমসে কম একশোখানা। এই ধরনের যে-কোনো খেলাতেই যে প্রচুর পরিমাণে ঘুঁটি লাগত তার প্রমাণ আছে অন্যত্রও। মহাভারতে বিদুর যখন যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলার জন্যে ডাকতে গেছেন তখন বিদুর বললেনধৃতরাষ্ট্র গাদা গাদা ঘুঁটি সাজিয়ে বসে আছেন তোমার জন্যদুরোদরা বিহিতা যে তু রাজন্ মহাত্মনা ধৃতরাষ্ট্রেণ রাজ্ঞা।
এই শ্লোকে নীলকণ্ঠ ‘দুরোদরাঃ’ মানে করেছেন পাশা-খেলোয়াড়েরা–দৃতকরাঃ। আধুনিক পণ্ডিতেরা বলেন নীলকণ্ঠ ভুল করেছেন। কোষকারেরা বলেছেন ‘দুরোদর’ শব্দটি যখন পুংলিঙ্গ হবে, তখন মনে হবে দূতকর, নীলকণ্ঠও সরল বিশ্বাসে সেই মানে ধরেছেন। কিন্তু কোষকার অমর কিংবা নীলকণ্ঠের সময়ে দুরোদর’ শব্দটির আসল অর্থ হারিয়ে গেছে–”দুরোদর’, মানে আসলে সেই বহুসংখ্যক ঘুঁটির সংখ্যা। এই কথাটা পরিষ্কার হয়ে যাবে মহাভারতের বিরাট পুরুষ কৃষ্ণের কথা থেকে তিনি পাণ্ডবদের বনবাসে দুঃখ করে বলেছেন–ইস, আমি যদি অনাহূত হয়েও কৌরবদের সভায় যেতাম, তাহলে এই অন্যায়টি হতে পারত না। যদি ভালো কথায় কাজ না হতন চেৎ স মম রাজেন্দ্র গৃহীয়াৎ মধুরং বচঃ–তাহলে ধ্বংস করে দিতাম সেই দুরোদরগুলিকে–তাংশ্চ হন্যাৎ দুরোদরান্। এখানে দুরোদর’ বলতে আর একটা অর্থও আসে–মানে যে ঘুঁটিগুলোর উদরের মধ্যে পোরা ছিল শকুনিমামার ধাতুপিণ্ডের সঞ্চয়, যাতে করে তার দান উলটে উলটে পড়ে, এবং তার অভীপ্সিত পূরণ করে। সত্যি কথা বলতে কী মূল মহাভারতে এই সব দান-ওলটানোর কথা নেই, তাতে, ঘুঁটির ওপর চিহ্নিত সংখ্যাতত্ত্বের প্রশ্নও এসে পড়ে। শকুনির মতে তার আসল ক্ষমতা হল তার জোড়-বিজোড়ের ডাকটি, যাকে তিনি গর্ব করে বলেছেন, সৈনিক হিসেবে। ওইটিই আমার ধনুক–গ্রহান্ ধনুংষি মে বিদ্ধি, আর অক্ষগুলি হল আমার শরশান্ অক্ষাংশ্চ ভারত। এখানে অক্ষ’ মানে যে সেই ‘দুরোদর’ পাশার ঘুঁটি যা শরের মতো সংখ্যায় অনেক থাকে, তা বোঝা যাবে অন্য এক সময়ে–অর্জুনের আত্মশ্লাঘায়। কর্ণকে মারবার আগে শকুনির কথাগুলিই ফিরিয়ে দিয়েছেন অর্জুন এবং এখানে ‘অক্ষ’ শব্দটির বদলে দুরোদর’শব্দটি ব্যবহার করে তিনি আমাদের সিদ্ধান্ত পাকা করে দিয়েছেন। অর্জুন বললেন–আজকে শকুনি আমার শগুলিকেই ‘গহ’ বলে বুঝতে পারবে আর আমার গাণ্ডীবটি দেখলেই বুঝতে পারবে ‘দুরোদর’ কাকে বলে–অদ্যাসৌ সৌবলঃকৃষ্ণ গ্রাহাজানাতু বৈশরাণ/দুরোদরঞ্চ গাণ্ডীবং…।
শকুনি-অর্জুনের আস্ফালন থাক–পাশাখেলায় কপালই সব–এ কথাটি চিরকালের গ্র্যান্ডমাস্টার শকুনিই যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন। যুধিষ্ঠির শকুনিকে বেশ খারাপ করেই বলেছিলেন–দ্যাখো, শকুনি তুমি অন্যায়ভাবে আমাকে পরাজিত করার চেষ্টা কোর না। শকুনি বললেন–ওগো পৃথা মায়ের সুবোধ ছেলে! যাঁরা গণনা জানেন, ধূর্ততার রীতিও ভালোরকম জানেন এবং ধূর্ততা করতে গেলে যে আলস্যহীনতা, তাও যাঁদের আছে, পাশার ঘুঁটিগুলো ছাড়তে হবে কী করে–সে বিষয়েও যাঁরা সুচতুর, তাঁদের তো সত্যিই পাশাখেলায় হার নেই।
শকুনি যে কথাগুলি বললেন, চিত্তচাঞ্চল্যহেতু যুধিষ্ঠিরের মাথায় তা ঢোকেনি, তিনিও সরলভাবে বিধিশ্চ বলবান্ রাজন’বলে খেলতে বসলেন, কিন্তু শকুনির কথার মধ্যেই, পাশায় তিনি কি করে জিতবেন, তার ইঙ্গিত ছিল। পাশাখেলায় ছল করা একেবারেই বিশ্বজনীন। শকুনি তিনটি কথা বলেছিলেন–যিনি গণনায় ওস্তাদ–যো বেত্তি সংখ্যাং অর্থাৎ দান দেওয়ার পর ঘুঁটিগুলি যত তাড়াতাড়ি গুণে ফেলা যায় ততই ভালো। কেননা তাড়াতাড়ি গুণে, সে যদি হারের কথা বুঝতে পারে তবেই ধূর্ততার রীতিপদ্ধতি কাজে লাগবে-নিকৃতৌ বিধিজ্ঞঃ। এই ধূর্ততার রীতিতে আলস্যহীনতা এক বিরাট গুণ–এবং এই আলস্যহীনতার দরকার হবে তখনই, যখন সেই ধূর্ত তার দানের ফলটি বুঝে ফেলেছে–চেষ্টাস্বখিন্নঃ কিতবোহজাসু। খেয়াল করে দেখবেন যুধিষ্ঠির পণ ধরার পর শকুনির চাল ফেলতেও দেরি হয়নি এবং চাল দেওয়ার প্রায় অব্যবহিত পরের মুহূর্তেই শকুনি–এই আমি জিতলাম–জিতমিত্যেব–এই বলেই, পরের পণটি ধরতে বলেছেন যুধিষ্ঠিরকে। এই যে ক্ষিপ্রতা–এইটেই শকুনির অক্ষক্রীড়ায় সবচেয়ে বড়ো কুট। এই ক্ষিপ্রতার কথাটাই যুধিষ্ঠিরের দিকে চ্যালেঞ্জের মতো ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, অর্থাৎ কিনা তোমার যদি এই গুণগুলি থাকে যুধিষ্ঠির, তাহলে তো আমার ধূর্ততা তুমি ধরেই ফেলবে। কিন্তু সারা মহাভারত পড়ে যাকে মনে হয়, ক্ষত্রিয় না হয়ে ব্রাহ্মণ হলেই যাঁর ভালো হত, যাঁকে নিজের স্ত্রী পর্যন্ত বলেন–যারা শঠের সঙ্গে শাঠ্য করতে পারে না, তারা মাথায় জটা লাগিয়ে থাকুক গিয়ে বনেজটাধরঃ সন্ জুহুধীহ পাব, সেই যুধিষ্ঠিরের পক্ষে পাকা জুয়াড়ির মতো খেলা ছিল অসম্ভব, শকুনির আলস্যহীন ক্ষিপ্রতা তিনি ধরতেই পারেননি। এখন এই ক্ষিপ্রতার ব্যাপারটা একটু বলি।
প্রথমেই আসে দান ফেলেই ঘুটি গোনার ফাঁকি, এই কঁকিতে অনেকগুলি ঘুঁটির দান দিয়ে ক্ষিপ্রহাতে গুণে নিয়ে একটু এদিক-ওদিক করে জোড়-দানকে বিজোড় বলে প্রতিপন্ন করা যায়। পাঠক যদি শকুনিকে ছেড়ে লাভা-দগ্ধ পম্পেই শহরে প্রবেশ করেন তাহলে দেখবেন উনআশি খ্রিস্টাব্দে এই শহরের অনেক কিছু পুড়ে গেলেও একটি পানশালায় টাঙানো দুখানি চিত্র পাওয়া গেছে। চিত্রটিতে দুই অক্ষবীর দুখানি টুল নিয়ে মুখোমুখি বসে আছে। আর তাদের মাঝখানে আছে খেলার একটি ‘বোর্ড’ যাকে বেদ বলেছে ‘অধিদেবন’, শকুনি বলেছেন ‘আস্তর’ আর অর্জুন বলেছেন। মণ্ডল। বামপাশের লোকটি একটি হলদে রঙের আধার থেকে ঘুঁটি ফেলছে, যে আধারটিকে হয়তো আমরা বৈদিক ভাষায় দুরোদরে’র আধার ‘অক্ষাবাপন’ বলব। প্রথম লোকটি দান ফেলার পর পরমানন্দে বলছে–বেরিয়ে গেছি, বেরিয়ে গেছি– ‘Exit। প্রতিপক্ষ তখন মুখখানি শক্ত করে বলল–কোথায়, Non tria, dvas est, সংস্কৃত ভাষায় যার রূপান্তর হবেন ত্রয়ম্, দ্বয়ম্ অস্তি এতৎ’, অর্থাৎ মোটেই তিন হয়নি, তোমার হয়েছে দুই। এখানেও এই পম্পেই শহরের জুয়াড়ি দুটি অনেকগুলি ঘুঁটি নিয়েই খেলছিল এবং সংখ্যা-গণনের ধোঁকা দিয়ে একজন আরেকজনকে কাবু করতে চাইছিল। দ্বিতীয় চিত্রটিতে দুইজনের হাতাহাতি মারামারি আরম্ভ হয়ে গেছে এবং পানশালার মালিক তাদের দুজনকে ধরেই বলছে–বেরিয়ে যাও এখান থেকে–Itis foras rixsatis.
ঝগড়া এবং পানশালার মালিকের কথায় পরে আসব, তার আগে বলি গণনার যে এই ক্ষিপ্রতা তাতে কাজ না হলে অন্যপথ ধরতে হয়, এবং এইরকমই কোনো পথই শকুনি ধরেছিলেন বলে মনে হয়। তবে তারও আগে আর একটি ঘটনার উল্লেখ করব।
ঘটনাটি আছে জাতকে। জাতক গল্পমালা বুদ্ধের জন্ম-জন্মান্তরের কাহিনি। এক জন্মে, যখন রাজা ব্রহ্মদত্তের রাজত্ব চলছে তখন বুদ্ধ জন্মেছিলেন এক বড়ো মানুষের ঘরে। যুবক বয়সেই তিনি জুয়াড়ি হয়ে। উঠলেন। একবার তিনি অন্য এক জুয়াড়ির সঙ্গে পাশা খেলছেন কিন্তু সে জুয়াড়ি ছিল জুয়াচোর। খেলার সময় সে যখন দেখত বিপদে পড়েছে, সে বলত–এ দানটি হবে না, একটি ঘুঁটি পাওয়া যাচ্ছে না। প্রথমে বুদ্ধ ভেবেছিলেন দান ফেলার সময় হয়তো একটি ঘুঁটি এদিক-এদিক চলে যাচ্ছে, এমনটি হতেই পারে। কিন্তু সে জুয়াড়ি দান ফেলার পর গুণে গেঁথে যখনই বুঝত বিপদ, তখনই একটি ঘুঁটি সে টপ করে গিলে ফেলত। বুদ্ধ এ চালাকি ধরে ফেললেন, তারপর তিনি ঘুঁটিগুলিকে বিষ মাখিয়ে বেশ করে শুকিয়ে পাশা খেলতে এলেন। জুয়াড়ি নিজের কৌশল মতো ঘুঁটি গিলে ফেলল এবং বিষের যন্ত্রণায় মূৰ্ছিত হল। শেষ পর্যন্ত বুদ্ধ তাকে লতাপাতার আয়ুর্বেদিক ঔষধ খাইয়ে বমি করালেন এবং বাঁচিয়ে তুললেন।
এই গল্প থেকে বেশ বোঝা যায় ক্ষিপ্রতা থাকলে একজন পাকা জুয়াড়ি কী করতে পারে। শকুনি হয়তো ঘুঁটি গিলতেন না কিন্তু যুধিষ্ঠিরকে তিনি যে উপদেশটি করেছিলেন তাতে তার যে হাতসাফাই-এর অভ্যেস ছিল–সেকথা বুঝতে দেরি হয় না। সবচেয়ে বড় কথা জুয়া খেলতে বসে জুয়াচুরি কোনো নতুন ঘটনা নয়।
মহাভারত গ্র্যান্ড-মাস্টার শকুনি যেভাবেই জিতুন, তার খেলার এবং প্রত্যেকটি দানের যা গতিপ্রকৃতি–তাতে বোঝা যায় ওই খেলার মধ্যে বৈচিত্র্য বেশি ছিল না, কেননা প্রত্যেকটি খেলাই হয়েছে খুব তাড়াতাড়ি। মহাভারতের বিভিন্ন পাশার আড্ডা থেকে মনে হয় বিভিন্ন রকমের পাশা খেলা তখনই চালু হয়ে গেছে। আর্যদের আসার আগে মহেঞ্জোদরো-হরপ্পায় আধুনিক লুডো খেলার ছক্কার মতো কতকগুলি কিউবিক্যাল অর্থাৎ চতুষ্কোণ ঘুঁটি পাওয়া গেছে। এগুলি পোড়ামাটির তৈরি এবং এর প্রত্যেক দিকে এক, দুই, তিন থেকে ছয় পর্যন্ত সংখ্যা বিন্দুচিহ্নে অঙ্কিত। এখনকার ছক্কায় যেমন বিন্দুগুলি এমনভাবে চিহ্নিত, যাতে সামনের দিকের বিন্দুসংখ্যার সঙ্গে তার উলটোপিঠের সংখ্যা যোগ করলে, ফল দাঁড়াবে সাত। তার মানে একের উলটোপিঠে ছয়, দুয়ের উলটোপিঠে পাঁচ এবং তিনের উলটোপিঠে চার। মহেঞ্জোদরো-হরপ্পার ছক্কাগুলিতে কিন্তু উলটো-সোজার সংখ্যাগুলি এইরকম ১:২; ৩:৪; ৫:৬। শুধুমাত্র ব্রাহ্মণাবাদ থেকে যে ছক্কাখানি পাওয়া গেছে সেটি একেবারে আধুনিক যুগের মতো, অর্থাৎ এর উলটো-সোজার যোগফল সাত।
দান ফেলার ছক্কাটি পাওয়া গেল। এবারে প্রসঙ্গ আসে পাশাখেলার ছক বা ‘বোর্ড’ ধরনের কোনোকিছুর হদিশ পাওয়া যায় কিনা? বৈদিক যুগে যাকে ‘অধিদেবন’ কিংবা ইরিণ’ বলা হত সে নিছক দান ফেলার জায়গা, সাধারণ সমতল ভূমির মধ্যে একটু অবতল ধরনের, যা নেহাতই স্বকৃত’। কিন্তু মজা হল আর্যেতাঁর সিন্ধুসভ্যতার আমলে একটি ইষ্টকখণ্ড আমরা পেয়েছি, যার মধ্যে তিন-তিন ছকের একটি নকশা আছে। আবার বৌদ্ধশাস্ত্র দীঘনিকায়ের অন্তর্গত ব্ৰহ্মগালসূত্তে—’অটঠপদ’ এবং দসপদ’ বলে দুটি শব্দ পাওয়া যায় যার সংস্কৃত রূপান্তর অষ্টাপদ এবং দশপদ–মানে আট-আট অথবা দশ-দশ ছকের নকশা। এই গ্রন্থটিতে বলা হয়েছে মুনি আর ব্রাহ্মণেরা অষ্টাপদ আর দশপদের খেলায় অহেতুক সময় নষ্ট করতেন। অষ্টাপদ, মানে আট-আট ছকের খেলা, মহাভারত এবং হরিবংশেও উল্লিখিত হয়েছে। আমি সবিশেষ সন্দেহ করি, কেননা সিন্ধুসভ্যতা এবং ব্রাহ্মণ্যধর্মবিরোধী বৌদ্ধগ্রন্থের নিরিখে এই সন্দেহ আরও জোরদার হয়, যে এই সূক্ষ্ম এবং সুচিন্তিত ‘বোর্ড-গেমে’র ধরন অনার্যদের কাছ থেকে আর্যরা শিখেছেন। একটি ছক্কা ধরনের জিনিস, একটি আট-আট ছকদুই-ই পাওয়া গেছে, এবার কতকগুলি ঘুঁটি পাওয়া গেলেই হয়। পাঠক! শুনে পুলকিত হবেন আধুনিক দাবা-খেলা থেকে আমরা আর খুব বেশি দূরে নেই।
ব্যাকরণমতে যুধিষ্ঠির শব্দটি ভাঙলে পরে মানে দাঁড়ায়, যিনি শত যুদ্ধের মধ্যেও মাথাটি স্থির বা ঠান্ডা রাখতে পারেন। কিন্তু এই ধর্মের সন্তান যে পাশার ঘুঁটি দেখলে একেবারেই স্থির থাকতে পারতেন না তার প্রমাণ অনেক আছে। তখনকার দিনের নিয়মমতো এক রাজা যদি অন্যজনকে পাশা-খেলায় আহ্বান করতেন, অন্যজনের পক্ষে সেখানে পিছু হঠা ছিল ‘প্রেস্টিজে’র ব্যাপার। দুর্যোধনের আহ্বানে তাই যুধিষ্ঠিরকে সাড়া দিতেই হয়েছিল। মনে মনে সব জুয়াড়িরই ধারণা থাকে–আমিই জিতব, কিন্তু এই ধারণা থাকলেও যুধিষ্ঠিরের ক্ষেত্রে তার আশা ফলবতী হয়নি। কিন্তু এমন একটা খেলা যেখানে ধনসম্পত্তি বউ-ভাই সব খুইয়ে পরদত্ত লঙুঠি সম্বল করে বনে যেতে হয়, সেখানে তো এই প্রতিজ্ঞাই মনে আসে, অন্তত আমি হলে তো আসতই, যে আর জীবনে পাশার ঘুটি ছোঁব না। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের নেশা আমার থেকেও বেশি, বিশেষ করে একটা জিনিস না পারলে নেশাটা বোধহয় আরও বাড়ে। তাই বারো বছর বনবাসের পর যুধিষ্ঠিরের হাতে যখন পাশার ঘুঁটির সব গন্ধ উবে গেছে, তখন এক বছর ছদ্মবেশে অজ্ঞাতবাসের সময় হল। কে কী ছদ্মবেশ নেবেন তাই ঠিক হচ্ছে, তখন যুধিষ্ঠির সবার মাঝে বলে বসলেন–আমি বিরাট রাজার সভাসদ সাজব। আমার নাম হবে বেশ কঙ্ক। বৈদূর্য মণির মতো নীল যার রং, সোনার মতো রং, আবার কালো কালো, লাল লাল পাশার ঘুঁটিগুলি চালিয়ে চালিয়ে আমি বিরাট রাজার মনোরঞ্জন করব–বৈদূৰ্য্যা কাঞ্চনা দাস্তান্ ফলৈ জ্যোতীরসৈঃ সহ। কৃষ্ণাক্ষান্ লোহিতাক্ষাংশ্চ নির্বস্যামি মনোরমা৷৷
এই খেলার নেশা যুধিষ্ঠিরের এমনই যে তিনি নিজের বক্তব্য বলে ভাইদের মতামতের জন্য আর অপেক্ষা করলেন না। তিনি বললেন–আমি যা করব–তা বলেছি, এবার ভীম! তুমি বলো। আমরা জানি বারো বছর পাশা না খেলে যুধিষ্ঠিরের মনের অবস্থা এমন হয়েছিল যে লাল, নীল, হলুদ আর কালো রঙের পাশার ঘুঁটিগুলির মধ্যে তখন বৈদূর্যমণি আর সোনার রং প্রতিফলিত হচ্ছিল। এই রঙের নেশা যুধিষ্ঠিরের যাবার নয়। তা না যাক, তাঁর কর্ম তিনি করুন, আমাদের লাভ এই, ওপরের ওই শ্লোকটির মধ্যে আমরা চার কিসিমের ঘুঁটি পেয়েছি আর-একটি শব্দ পেয়েছি ‘নির্বতস্যামি’ যার অর্থ নীলকণ্ঠ করেছেন চালয়িষ্যামি’। তাহলে কি শারি চালিয়ে খেলার নিয়ম জানতেন যুধিষ্ঠির, সেটি কি অষ্টাপদ ছকে চতুরঙ্গ খেলা। যুধিষ্ঠির যে চার-রঙের ঘুঁটির উল্লেখ করেছেন–সেগুলি হাতি, ঘোড়া, নৌকা আর রাজার চতুরঙ্গ-বাহিনী নয়তো। হয়তো বা তাই, হয়তো বা তা নয়। কিন্তু আট-আট ছকে শারি চালিয়ে খেলা আমরা শিখে গেছি খুব কম দিনের মধ্যেই। ভারহুতের ভিত্তিপ্রদেশে একটি ছয়-ছয় ছকের নকশা আছে আর অন্ধ্রপ্রদেশের নাগার্জুনকোণ্ডের ভিত্তিপ্রদেশে আট-আট ছকের ছড়াছড়ি। মহাভারতে পরিষ্কার না থাকলেও হরিবংশে তো অষ্টাপদ নকশার একখানি ‘গেমবোর্ডে’রই উল্লেখ পাই। নিঃসন্দেহে এই খেলায় লাগত একটি ছক্কার মতো জিনিস, যার দান পড়লে চতুর্বর্ণের শারি চলত আট-আট ছকে। হরিবংশে দেখি কৃষ্ণের দাদা বলরাম অক্ষক্রীড়া করছেন কৃষ্ণের শ্যালক রুক্মীর সাথে। রুক্মিণীর বিয়ে নিয়ে কিছু গন্ডগোল হওয়ায় কৃষ্ণের এই শ্যালকটি ভয়ংকর ক্ষেপে ছিলেন যাদবদের ওপর। মহাভারত বলেছে, রুক্মীর মেজাজও ছিল খুব খাট্টা এবং গোঁয়ার গোছের। আর বলরামও কম যান না। দিনের অধিকাংশ সময়ই তিনি মদ্যপান করতেন এবং মদিরাস্বাদে তার চক্ষুদুটি হয়ে যেত পাটলবর্ণ। নিশ্চয়ই সেইরকম একটা ভারসাম্যহীন অবস্থাতেই তিনি রুক্মীর সঙ্গে অক্ষক্রীড়া করতে বসেছিলেন। খেলার প্রথমে দশ হাজার মোহর পণ রেখে বলদেবই দান চেলেছিলেন-রুক্মিণা সহ সম্পাতে বলদেবো গ্লহং দদৌ। কিন্তু খেলায় তিনি হারলেন, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ দানেও তাই। হরিবংশ বলেছেবলরাম পাশাখেলায় তত দড় ছিলেন না–অবিদ্যো দুর্বলঃ শ্রীমান্। সভার সকলে হাসতে লাগল, কলিঙ্গের রাজা তো, যাকে বলে একেবারে দাঁত দেখিয়ে হাসতে থাকলেনদন্তা সন্দৰ্শয় হৃষ্টঃ। শেষে দশ হাজার কোটি সোনার মোহর বাজি ধরে বলরাম এবার রুক্মীকে বললেন দান চালতে সঙ্গে এও বললেন–এইটে তুমি নাও এবং কালো আর লাল ঘুঁটিগুলি তুমি চালবে–এনংসম্পরিগৃহ্নীষ পাতয়াক্ষান্নরাধিপ/ কৃষ্ণাক্ষাল্লোহিতাক্ষাংশ্চ…। এই শ্লোকে ‘এনং’–এইটে নাও’ বাতে নিশ্চয় সেই ছক্কা ধরনের জিনিসটা বোঝাচ্ছে, যার সংখ্যা অনুসারে রুক্মীর লাল কালো যুঁটিগুলি চালার কথা। রুক্মী চাললেন এবং শারি চালিয়ে দানও দিলেন। এইবার বলরামের পালা, তিনি দান ফেললেন চার’, তাতেই রুক্মীর হার নিশ্চিত হয়ে গেল–চাতুরক্ষে তু নিবৃত্তে নির্জিতঃ স নরাধিপঃ। বলরামের শারি চালানোর কথা আর হরিবংশ বলেনি, কেননা ততক্ষণে অক্ষ শৌণ্ডদের কথা চালাচালি আরম্ভ হয়ে গেছে। কিন্তু বলরাম যে আট-আট ছকে চতুরঙ্গ খেলছিলেন তার প্রমাণ হল, যখন দু-পক্ষের কথা কাটাকাটি তুঙ্গে উঠল। এবং বলরামের জয় কেউ স্বীকার করল না, তখন উপহাসকারী রুক্মীর মাথায় বলরাম যে একটি মোক্ষম বাড়ি কষালেন, সে বাড়িটি ছিল একখানি দাবার বোর্ডের। বোর্ডটি ছিল একটি আট-আট ছকের অষ্টাপদজঘান অষ্টাপদেনৈব প্রমথ্য যদুনন্দনঃ।
দাবার ‘বোর্ডে’র আঘাতে রুক্মী তো মারা গেলেন কিন্তু বলরামের চাতুরক্ষে তু নিবৃত্তে’ অর্থাৎ চার ফেলে ‘বোর্ড’ জেতার ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করতে হয়। মনে রাখা দরকার, ছক্কার মতো জিনিসটায় যে দান দেওয়া হত তার কতকগুলি নাম ছিল, সেই নামগুলি মিলে যাবে আমাদের চার যুগের নামের সঙ্গে। পাঠক জানেন সত্য যুগের এক নাম কৃত যুগ, এই কৃত’ দানই হল সর্বশ্রেষ্ঠ চাল। অন্য দানগুলির নাম ত্রেতা, দ্বাপর এবং কলি। কলিদানের মান এক, দ্বাপরে দুই, ত্রেতায় তিন এবং কৃতে চার। কৃত’ দান মানেই জিৎ এমনকী ঋগবেদের বহু জায়গায় কৃত’ মানেই জয়। আর কলিদান মানেই হার, মহাভারতের টীকায় নীলকণ্ঠ বলেছেন কলিপাতে জয়ো নাস্তি, কলির সংখ্যায় দান পড়লে কোনোদিন জয় হবে না। কলিপ্রবিষ্ট নলরাজা যে ন্যূতক্রীড়া করেছিলেন, তাঁরও সর্বনাশ হয়েছিল এই কলিদানে। বেদের আমল থেকেই এই কৃতদানের জয়-জয়কার আর কলিদানের হাহাকার শুনতে পাওয়া যাবে।
.
অক্ষক্রীড়ার ক্ষেত্রে যদিও কৃতদানই সব, তবু ত্রেতা, কিংবা দ্বাপর বলতে কিছু কিছু জয় বোঝাত। নীলকণ্ঠ বলেছেন কলি ছাড়া যদি দ্বাপর অথবা ত্রেতা দান পড়ে তাহলে উত্তরোত্তর জয় বোঝাত–দ্বাপরাদিপাতে উত্তরোত্তরবৃদ্ধ্যা জয়োহস্তি। মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ দাবা-পাশা খেলতেন কি না জানি না তবে মহাভারতের অক্ষশৌণ্ডেরা ‘দ্বাপর-দানে মোটেই খুশি হতেন না। পাঠকের মনে পড়বে, পাণ্ডবেরা যখন অজ্ঞাতবাসে তখন তাদের ঠিকানা বার করবার জন্য কৌরবেরা ‘গো-গ্রহণের অছিলায় বিরাট-নগর আক্রমণ করেছিলেন। কুমার উত্তর যখন অর্জুনকে রথে নিয়ে কৌরবদের দিকে ধাবিত হল, তখন ভীষ্ম-দ্রোণ ইত্যাদি কুলবৃদ্ধেরা অসীম মমতায়–এ নিশ্চয়ই আমাদের অর্জুনই হবে–এইরকম কথাবার্তা বলতে থাকলেন। তাতে দুর্যোধন কিঞ্চিৎ অসহিষ্ণু হলেন, ফলত কর্ণ এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিলেন। তার উত্তরে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা একটু রূঢ় করেই অর্জুনের ক্ষমতাকীর্তন করতে থাকলেন। তিনি বললেন অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সবাই ভয় পায়, তার চেয়ে এখন বরং তোমার মহাপ্রাজ্ঞ মাতুল শকুনি যুদ্ধ করুন। তবে হ্যাঁ বাপু, মনে রেখো, অর্জুনের গাণ্ডীব কিন্তু পাশার ঘুঁটি ছোঁড়ে না, সে গাণ্ডীবে কৃত’ দানও আসে না, দ্বাপর দানও নয়, সে ছোঁড়ে শুধু কাটা কাটা বাণনাক্ষাত্ ক্ষিপতি গাণ্ডীবং ন কৃতং দ্বাপরং ন চ। অর্থাৎ কি না পাশাখেলার শ্রেষ্ঠ দান কৃত সম্বন্ধেও অর্জুনের যে ভাব আবার অপেক্ষাকৃত খারাপ দান দ্বাপর সম্বন্ধেও সেই ভাব।
সারা মহাভারত গেল, সভাপর্বের কত কিসিমের পাশাখেলা গেল, সে সব জায়গায় টীকাকার নীলকণ্ঠ কিছুই বলেননি, কিন্তু অর্জুনের গাণ্ডীব থেকে যে, পাশার দান পড়ে না–এইটা বোঝাতেই নীলকণ্ঠ পাশাখেলার পদ্ধতি সম্পর্কে অনেকটাই বলে ফেলেছেন। হতে পারে সে পদ্ধতিতে তার নিজের সময়ের ছাপ পড়েছে, কারণ তিনিও কম প্রাচীন নন। আবার এও হতে পারে, সে বেশ প্রাচীন কালের কথা, যার মধ্যে অতি প্রাচীন অক্ষ-পদ্ধতির শেষ চিহ্নটুকু রয়ে গেছে। নীলকণ্ঠ বলেছেন
যে জিনিসটার এক এক পাশে এক, দুই, তিন, চার–এই অঙ্কগুলি চিহ্নিত থাকে তাকে বলে পাশ। তার এক ফোঁটায় কলি, দুই ফোঁটায় দ্বাপর, তিনে ত্রেতা আর চারে কৃত। এইরকমের অক্ষক্রীড়ায় নিজের পাঁচটা দীনার আর পরপক্ষে পাঁচটা দীনার স্থাপন করে খেলা আরম্ভ হয়। পাশ-প্রক্ষেপে যদি এক ফোঁটার কলিদানটি ওপরে দেখা যায় তাহলে নিজের একটি দীনারমাত্র জয় করা হয়–স্বীয়েষু এক এব জিততা ভবতি। যদি দান পড়ে দ্বাপর, তাহলে পরপক্ষের দুইটি দীনার এবং নিজের একটি জয় করা হয়। যদি ত্রেতা পড়ে তাহলে অপরের তিনটি এবং নিজের তিনটি দীনার জিত হয়। আর সেই চতুরঙ্ক চিহ্নিত কৃতদানটি যদি উদারভাগ্য নিয়ে উদয় হয় তাহলে নিজের সব কটি এবং প্রতিদ্বন্দ্বীরও সব কটি দীনার নিজের ভাগে আসে। আমাদের হরিবংশের বলরাম ফেলেছিলেন এই চতুরক্ষ’ কৃত দান। আর শকুনিমামার এই দান ফেলার ভাগ্য ছিল এমন যে তাকে কৃতহস্ত বলেই সম্বোধন করা যায় আর ‘ভাগ্য যদি কৃপণ হয়ে আসে তাহলেই যুধিষ্ঠিরের মতো কলিহস্ত’ হতে হবে।
নীলকণ্ঠের বর্ণনার ধরন থেকে যুধিষ্ঠির কিংবা শকুনির দূতযুদ্ধের একটা আঁচ পাওয়া যায় বটে, কিন্তু বিরাট রাজার ঘরে যে পাশাজালে আবদ্ধ হয়েছিলেন যুধিষ্ঠির, যে পাশা বলরাম খেলেছিলেন রুক্মীর সঙ্গে, সেটি আমাদের চতুরঙ্গ’ খেলার পিতৃপুরুষ। আর সি বেল সাহেবের ‘বোর্ড, এন্ড টেবল গেমস’ বলে একখানা বই আছে। তিনি সেখানে ‘চেস্ গ্রুপ’ বিভাগের আরম্ভেই লিখেছেন–
‘In ancient India a race-game called Ashtapada was played on a board of sixty-four squares…About the fifth century A.D. the Ashtapada, board was used for a new game Shaturanga…’
বেল সাহেবের মত যে একেবারে ভিত্তিহীন নয় তার প্রমাণ হল খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যেই হরিবংশ রচিত হয়ে গেছিল আর হরিবংশেই তো বলরাম অষ্টাপদ বোর্ডের বাড়ি কষিয়েছিলেন কৃষ্ণের দুর্বিনীত শালার মাথায়। এই অষ্টাপদ ছকে শারি চালিয়ে খেলা যে আমাদের অনেক আগেই জানা ছিল, তার আরও একটা প্রমাণ আছে–মহাবৈয়াকরণ পাণিনির সূত্রে। পাণিনি সেই পঞ্চম খ্রিস্টপূর্বাব্দের মানুষ। পাণিনি তো সূত্র করেই খালাস; কাজেই সূত্রগত শব্দগুলির কী অর্থ হবে না হবে, তা বলে দিয়েছেন পাণিনির অনুযায়ী বৈয়াকরণেরা। তারা যেহেতু পাণিনি ব্যাকরণের নিজস্ব ধারা অনুসারে সবকিছু লিখেছেন, তাই তাদের মতের একটা বিরাট মূল্যও আছে। পাণিনি দুটি শব্দের উল্লেখ করেছেন–”অয়’ এবং অনয়। অয়’ বলতে বোঝায়–যে বস্তুটি ডানদিক থেকে বাঁদিকে যাবে। আর অনয়’ মানে, যেটি বাঁদিক থেকে ডানদিকে যাবে। এই শব্দদুটি যুক্ত করলে দাঁড়াবে অয়ানয়’–ঠিক এই শব্দটির ব্যাখ্যায় মহাভাষ্যকার পতঞ্জলি একেবারে আধুনিক দাবা খেলার একটি সূক্ষ্ম চরিত্র তুলেছেন। অয়ানয়’ মানে এমন একটা অবস্থা যখন পাশার ঘুটি ডান-বাঁ করে এমন জায়গায় আসে যেখান থেকে আর নড়তে-চড়তে পারে না এবং সেই জায়গায় অন্য কেউ আক্রমণও করতে পারে না–প্রদক্ষিণপ্রসব্যগামিনাং শারাণাং যস্মিন্ পরৈঃ পদানাম্ অসমাবেশঃ সঃ অয়ানয়ঃ।
মহাভাষ্যের প্রদীপটীকায় এই পঙক্তিটি পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে একজন দাবাড়ুর উদাহরণ দিয়ে। প্রদীপ বলেছে দুজন দাবাড়ুর খেলায় প্রথম দাবাড়ুর চাল দেখে যখন দ্বিতীয় দাবাড়ুর ঘুঁটির শারি ডানদিক থেকে বাঁদিকে চলে সেইটা হল ‘অয়ঃ আর ঘুঁটির শারি বাঁদিক থেকে ডানদিকে চললে অনয়। আর যে ঘরে ঘুটি থাকলে পরপক্ষের ঘুঁটির শারি আক্রমণ করতে পারে না সেই জায়গাটিই হল অয়ানয়’ দ্বিতীয় দৃতকারসম্বন্ধিভিঃ শারৈঃ পদানাং স্থানানাং গৃহাপরপর্যায়াণা অনাক্রমণ অনধ্যাসন ইত্যর্থঃ।
এইখানে প্রদীপকার ‘দ্যুতব্যবহার’ নামে একটি প্রাচীন গ্রন্থ থেকে একটি শ্লোক উদ্ধার করে বলেছেন–ঘুঁটির শার যদি অন্য ঘুঁটির দ্বারা সুরক্ষিত থাকে তাহলে শত্রুপক্ষের ঘুঁটি তাকে আক্রমণ করতে পারে না কিন্তু ঘুঁটি যদি অসহায় থাকে তবে শত্রুর ঘুঁটির শার তাকে আক্রমণ করেসসহায়স্য শারস্য পরৈ নাক্রম্যতে পদম্। অসহায়স্তু শারেণ পরকীয়েন বাধ্যতে।
মহাভাষ্যকার পতঞ্জলির জন্ম একশো খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি। সেই সময়েই যখন শার চালিয়ে ঘুঁটি চালানোর উল্লেখ পাচ্ছি, তাহলে নিশ্চিত যে আধুনিক দাবার প্রথম সংস্করণ বেরিয়েছিল এই ভারতবর্ষেই। ব্যাকরণের ঝুলি থেকে আর একটি পঙক্তি উদ্ধার করলে হয়তো পাঠকের বিরক্তি উৎপাদন হবে তবু সেটি না বললে দাবা-খেলার উৎস সন্ধান ব্যাহত হবে। পাণিনি বলেছেন, পরিপূর্বক নী-ধাতুর সঙ্গে ঘ প্রত্যয় করলে শব্দটির মানে দাঁড়াবে অক্ষক্রীড়া। এই উপসর্গযুক্ত ধাতুটির একটি ব্যবহারিক উদাহরণও দিয়েছেন পতঞ্জলি-পরিণায়েন শারান্ হন্তি। তাঁর মতে পরিণায় মানে–সবদিক থেকেই যে ঘুঁটিটিকে এগিয়ে আনা যায় সমস্তান্। নয়ন। কাজেই ঘুঁটি চালিয়ে নিয়ে এসে পরপক্ষের ঘুঁটি খেয়ে ফেলা বা তাকে অকেজো করে দেওয়া–সেইটে হল–পরিণায়েন শারা হন্তি।
বেশ বোঝা যায়–এ হল দাবার চাল, হয়তো তার সঙ্গে ছক্কার মতো একটা জিনিসও ব্যবহার করা হত, যার ফোঁটা অনুসারে ঘুঁটিগুলি চলত শারে শারে। এ এল ব্যাশম বলেছেন অষ্টাপদ পাশাখেলায় রাজার সঙ্গে হাতি, ঘোড়া, রথ এবং নৌকার চতুরঙ্গ বাহিনী শারি শারি চলত আট-আট ছকে। কাজেই এই “শারীক্রীড়ার অনেকটাই জানা ছিল প্রাচীন ভারতীয় মানুষের। তার মতে পরবর্তীকালে এই চতুরঙ্গ খেলা পাচার হয়ে যায় পারস্যে। আবার পারস্য যখন আরবিদের কাছে যুদ্ধে হেরে গেল, তখন এই ভারতবর্ষীয় খেলাটি পারস্যের হাত ঘুরে সারা মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ল। চতুরঙ্গের আপভ্রংশিক পরিবর্তন ঘটল শতরঞ্জে।
প্রাচীন ভারতবর্ষে পাশা-দাবার জনপ্রিয়তা এত বেশি ছিল যে সমাজের একটি বিরাট অংশের মধ্যে এই খেলা এক অদ্ভুত উন্মাদনা তৈরি করত। একদিকে যেমন রাজারাজড়া থেকে আরম্ভ করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত এই খেলায় অংশ নিতেন, অন্যদিকে নীতিশাস্ত্র এবং ধর্মশাস্ত্রকারেরা এই খেলা বন্ধ করার জন্য সবরকমভাবে চেষ্টা করেছেন। একদিকে আপস্তম্ব ধর্মসূত্র বলছে রাজা একটি গৃহনির্মাণ করাবেন, যেখানে শুধু পাশা খেলাই হবে, অন্যদিকে ধর্মশাস্ত্রকারেরা বলছেন–সেই পাপস্থানে কোনো ভদ্রলোক যাতে না যায়। পণ্ডিতেরা বলেন যে পাশাখেলার জন্যে ঘর তৈরি। করা–এসব অনেক পরের কথা। কিন্তু আমরা জানি পুরোদস্তুর ঘর না। থাকলেও পাশার-আজ্ঞা বিশেষ বিশেষ জায়গায় ছিলই। বেদের মধ্যে যে সভাবিন’বলে একটি শব্দ পাওয়া যায় তার মানে সায়ন করেছেন–জুয়াঘরের মালিক। সেকালে অনেকেই এই ব্যবসা করতেন। আপস্তম্ব ধর্মসূত্রে তো এমন বর্ণনা আছে যাতে বোঝা যায় জুয়ার আড্ডায় মালিক একেবারে ঘরের মাঝখানটিতে বেশ একটা উঁচু জায়গায় বসতেন এবং জল দিয়ে পরিষ্কার করে পাশার ঘুঁটিগুলি রাখতেন সারে সারে। পরবর্তীকালের পাশাঘর আরও সুসজ্জিত এবং সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। হরিবংশে সেই যেখানটা বলরাম রুক্মীর সঙ্গে পাশা খেলতে বসেছিলেন, সেটি ছিল এক সোনার থামওয়ালা ফুলে সাজানো বাড়ি। দিকে দিকে তাতে ছেটানো হয়েছিল চন্দনগন্ধী জল–তে শুভাং কাঞ্চনস্তম্ভাং কুসুমৈৰ্ভূষিতাজিরা। সভামাবিবিশুহৃষ্টাঃ সিক্তাং চন্দনবারিণা। এখানে সভা মানেই পাশা ঘর।
আপস্তম্ব ধর্মসূত্রের পাশা-সাজানো ঘর, বলরামের পাশার সভা–এ সবই কিন্তু আমাদের মনুমহারাজের দু-চোখের বিষ। মনু জানেন–পাশাখেলা মানেই জুয়াখেলা। বন্ধু-বন্ধু মিলে সুহৃদ্যুত-ফুত–মনু বিশ্বাস করেন না। তাঁর মতে পুরুষ মানুষের মেয়েবন্ধু মানেই যেমন কাম, তেমনি সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে পাশাখেলা-বাজিধরা–শেষে জুয়াখেলায় শেষ হয়। রাজাদের উদ্দেশ্যে তর্জনী তুলে মনু বলেছেন–খবরদার পাশা ছোঁবে না, আর গৃহস্থদের বলেছেন–পাশাড়ে জুয়াড়ি যদি কোনোদিন শ্রাদ্ধবাড়িতেও শোক জানাতে আসে, তো তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে। পরবর্তী ধর্মশাস্ত্রকারেরা সবাই মনুর মতেই মত দিয়েছেন। নারদস্মৃতি আবার অনেকটা আধুনিক রাজনৈতিক নেতার মতো বলেছেযারা অসৎ উপায়ে পাশা খেলে তারা চুরি করে পয়সা উপায় করে ব্যাজেনোপার্জিত যচ্চ।
কিন্তু এত নিষেধ এত শাস্ত্রবাক্য সত্ত্বেও পাশাখেলা এবং তার সঙ্গে বাজিরাও রয়েই গেল। রয়ে গেল রাজারাজড়ার মধ্যে, সৈনিকরদের মধ্যে, পাড়ার যত ছেলে এবং বুড়োসবার মধ্যে। তখনকার দিনের মহাকাব্য, কাব্য ইতিহাস, যা কিছু সব কিছুই পড়লে এই কথাই মনে হয় যে সমাজের উর্ধ্বে এবং নিম্নস্তরের অনেক মানুষেরই সাধারণ নেশা ছিল দাবা-পাশার খেলা। বাৎস্যায়নের কামসূত্রে দেখি যে, কোনো শিক্ষিত নগরজনেরই পাশাখেলার এলেম এবং অভ্যাস দুই-ই ছিল। গণিকাদের তো এ খেলা শিখতে হতই, নাগরিকারাও বাদ যেতেন না। কাদম্বরীর সখীদের সঙ্গে রাজপুত্ৰ চন্দ্ৰাপীড়ের অক্ষক্রীড়াবাণভট্টের কবিকল্পনা নয়, সামাজিক ঘটনা। তবু দাবা-পাশার আসল মর্ম এই নাগরক-নাগরিকাদের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না। অক্ষক্রীড়া জমে ওঠে বাজি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে। বৈদিক আমল থেকে আজ পর্যন্ত বাজির ওপরেই সর্বনাশা দাবা-পাশা টিকে আছে। কাব্যসভার বাজিকর মৃচ্ছকটিকের লেখক শূদ্রকের অনুভব এখানে সবচেয়ে মূল্যবান। শূদ্রক বলেছেন–দ্যুতং হি নাম পুরুষস্য অসিংহাসনং রাজ্য–দাবা-পাশা হল আসলে সিংহাসনহীন রাজ্যপাট। এই রাজ্যপাটের নিয়ম আলাদা, অনুভব আলাদা, ভালোবাসাও আলাদা। মৃচ্ছকটিকে সংবাহক যখন দশ মোহর হেরে দূতসভা থেকে পালিয়েছিল তখন দূতসভার মালিক এবং প্রতিদ্বন্দ্বী মাথুর দুজনেই তাকে তাড়া করেছিল। সে কোথাও আশ্রয় পায়নি। এই অবস্থায় যে তাকে বাঁচাতে এসেছিল–সেও কিন্তু জুয়াড়ি। সারাজীবনের দাবা-পাশার অভিজ্ঞতায় তার শেষ সিদ্ধান্ত হল–আমি যে টাকা কামিয়েছিলাম–তাও এই দাবা-পাশার দৌলতেই, বন্ধু পেয়েছিলাম, ঘর বাঁধবার ঘরণী পেয়েছিলাম–তাও এই দাবা-পাশার দৌলতেই ভোগ করেছি প্রচুর, দানও করেছি প্রচুর–সেও কিন্তু দাবা-পাশার জন্যেই। কিন্তু আজকে যে ধন-মান, জায়া-জীবন সব খুইয়ে বসে আছি, তারও কারণ এই দাবা-পাশাই–দ্রব্যং লব্ধং তনৈব দারা মিত্রং দ্যুতেনৈব। দত্তং ভুক্তং দূতেনৈব সর্বং নষ্টং দ্যুতেনৈব। সারাজীবন পাশা খেলে চিরকালের গ্র্যান্ডমাস্টার শকুনি তাই সিদ্ধান্ত করেছেন দাবা-পাশা বড়ো আনন্দের জিনিস বাপু, কিন্তু এ খেলার সর্বনাশ করে দিয়েছে বাজি ধরার ডাক–অক্ষগ্লহঃ সোহভিভবেৎ পরং নঃ তেনৈব দোষো ভবতীহ পার্থ। কিন্তু বাজি ছাড়া দাবা-পাশা আবার হয় নাকি, না জমে?