হঠাৎ করে জুলিয়াস নিশোর শরীর খুব খারাপ হয়ে পড়েছে। পুরোনো সব অসুখ নতুন করে দেখা দিতে শুরু করেছে। শ্বাসকষ্ট তার একটি। কাল রাতে খুব কষ্ট হল। এত বাতাস পৃথিবীতে, অথচ তিনি তাঁর ফুসফুস ভরাবার জন্যে যথেষ্ট বাতাস যেন পাচ্ছেন। না। আশেপাশে কেউ নেই যে ডেকে বলবেন পাশে এসে বস। হাত রাখ আমার বুকে।
শেষরাতের দিকে তাঁর মনে হল মৃত্যু এগিয়ে আসছে। তিনি মৃত্যুর পদধ্বনি শুনলেন। নিজেকে তিনি সাহসী মানুষ বলেই এতদিন জেনে এসেছেন। কাল সে-ভুল। ভাঙল। কাল মনে হল, তিনি সাহসী নন। মৃত্যুকে সহজভাবে নিতে পারছেন না। ভয় লাগছে। তীব্র ভয়, যা মানুষকে অভিভূত করে দেয়। মাওয়া সকালে খাবার নিয়ে এসে ভীত স্বরে বলল, আপনার শরীর বেশ খারাপ মনে হচ্ছে।
নিশো দুর্বল ভঙ্গিতে হাসলেন।
রাতে ভালো ঘুম হয় নি?
না।
রাতের খাবারও মনে হয় খান নি?
না, খাই নি।
মাওয়া চিন্তিত বোধ করল। এই লোকটিকে বিনা চিকিৎসায় থাকতে দেওয়া যায় না। অথচ ডাক্তার আনা মানেই বাইরের একজনকে জানানো নিশো বেঁচে আছেন।
ভালে কফি এনেছি, খাবেন?
না।
একটু খান, ভালো লাগবে।
মাওয়া কাপে কফি ঢালল। নিশো বললেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হচ্ছে প্রতীক্ষা করা। মনে কর, একটি অচেনা স্টেশনে তুমি অপেক্ষা করছ ট্রেনের জন্যে। ট্রেন আসছে না। কখন আসবে তুমি জান না। নাও আসতে পারে, কিংবা কয়েক মিনিটের মধ্যে এসে পড়তে পারে। কেমন লাগবে তখন মাওয়া?
মাওয়া জবাব দিল না।
আমার ঠিক সে-রকম লাগছে।
কফি নিন।
নিশো কফির পেয়ালা হাতে নিলেন, কিন্তু চুমুক দিলেন না। হালকা গলায় বললেন, অনেক দিন পর কাল রাতে একটা কবিতা লিখলাম। দীর্ঘ কবিতা। কবিতা তোমার কেমন লাগে?
ভালো লাগে না। সাহিত্যে আমার কোনো উৎসাহ নেই।
আমার ইচ্ছা করছে কবিতাটা কাউকে শোনাই। তুমি শুনবে?
মাওয়া জবাব দিল না। চিন্তিত মুখে তাকিয়ে রইল। নিশো হাত বাড়িয়ে কবিতার খাতা নিলেন। মাওয়া লক্ষ করল, খাতা নেবার মতো সামান্য কাজেও তিনি ক্লান্ত হয়েছেন। খাতাটি নেওয়ার সময় তাঁর হাত সামান্য কাঁপছিল।
নিশোভরাট গলায় পড়লেন–
জোছনার ছাদ ভেঙে পাখিরা যাচ্ছে উড়ে যাক বাতাসে, বারুদ গন্ধ থাক অনুভবে।
কবিতাটি দীর্ঘ। সেখানে বারবার বারুদের গন্ধের কথা আছে। মাওয়া কিছুই বুঝল না, বোঝার চেষ্টাও করল না।
কেমন লাগল?
ভালো।
মাওয়া, আমি সম্ভবত একমাত্ৰ কবি, যে কখনো প্রেমের কবিতা লেখে নি। প্রেমের মতো একটি বড় ব্যাপারকে আমি অগ্রাহ্য করেছি।
আপনি শুয়ে থাকুন। বেশি কথা বলাটা ঠিক হবে না।
এখন কেন যেন শুধু প্রেমের কবিতা লিখতে ইচ্ছা হচ্ছে। কয়েক দিন ধরেই ভাবছি, একটি দীর্ঘ প্রেমের কবিতা লিখব। প্রথম লাইনটিও ভেবে রেখেছি—আমার ভোরের ট্রেন। মা বললেন—ঘুমো, তোকে ডেকে দেব ফজরের আগে। লাইনটি। কেমন?
ভালো।
ছেলেটি শুয়ে থাকবে, কিন্তু ঘুমুতে পারবে না। পাশের বাড়ির কিশোরী মেয়েটির কথা শুধু ভাববে।
আপনি শুয়ে থাকুন, আমি সন্ধ্যাবেলা একবার আসব। চেষ্টা করব একজন ডাক্তার নিয়ে আসতে।
সেই ডাক্তার এক জন মৃত মানুষকে বসে থাকতে দেখে অবাক হবে না তো?
মাওয়া কিছু বলল না। নিশো বললেন, আমরা খুব-একটা খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। এক জন জীবিত মানুষকে মৃত বানিয়ে রেখেছি। জেনারেল ডোফা যথেষ্ট বুদ্ধিমান, কিন্তু এই একটি কাঁচা কাজ সে করেছে।
মাওয়া কিয়ে রইল।
ঘটনাটি প্রকাশ হবে। তুমি নিজেই একদিন বলবে। তুমি না-বললেও কেউ-না- কেউ বলবে–বলবে না?
হয়তো বলবে।
একজন মানুষকে মেরে ফেলা এক কথা, কিন্তু একজন জীবিত মানুষকে মৃত বলে ঘোষণা দেওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা।
আপনি বিশ্বাস করুন, আমি সন্ধ্যাবেলা আসব।
আমার মনে হয় না তুমি সন্ধ্যাবেলা আসবে। তুমি হচ্ছ একজন রাজনীতিবিদ, যারা কথা দেয় কিন্তু কথা রাখে না। তুমি অনেক বার বলেছিলে রাতে আমার মুখের ওপর এই বাতিটি জ্বালিয়ে রাখবে না, কিন্তু বাতি ঠিকই জ্বলছে।
মাওয়া ঘর ছেড়ে চলে গেল। সন্ধ্যাবেলা সে ঠিকই এল না, তবে প্রথম বারের মতো মুখের ওপরের বাতি নিভে গেল। অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক। ভয়ানক অন্ধকার। নিশোর মনে হল, বাতি থাকলেই যেন ভালো হত।