ভবানীপুর মোহিনী মুখুজ্জে রোডে কে-একটি যুবক গল্প বলছে।
পৌষের সন্ধ্যা। কথককে ঘিরে শ্রোতা-শ্রোত্রীর ভিড়। শীতের সঙ্গে-সঙ্গে গল্পও জমে উঠেছে নিটোল হয়ে।
তীক্ষ্ণ একটি মুহূর্তের চুড়ায় গল্প কখন উঠে এসেছে অজান্তে। দোদুল্যমান মুহূর্ত। ঘরের বাতাস স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে।
হঠাৎ বন্ধ হল গল্প-বলা।
তারপর? তারপর কি হল? অস্থির আগ্রহে সবাই ছেকে ধরল কথককে।
তারপর? একটু হাসল নাকি যুবক? বললে, বাকিটা কাল শুনতে পাবে। সময় নেই, লাস্ট ট্রাম চলে গেল বোধ হয়।
পরদিন গল্পের বাকিটা আমরাও শুনতে পেলাম। ইডেন হিন্দু হসটেলের বাথরুমে দরজা বন্ধ করে কার্বলিক এসিড খেয়ে কথক বিজয় সেনগুপ্ত আত্মহত্যা করেছে।
দেখতে গিয়েছিলাম তাকে। দীর্ঘ দেহ সংকুচিত করে মেঝের উপর শুয়ে আছে বিজয়। ঠোঁট দুটি নীল।
চারদিকে গুঞ্জন উঠল যুবসমাজে, সাহিত্যিক সমাজে। কেউ সহানুভূতি দেখাল, কেউ করলে তিরস্কার। কেউ বললে, এম-এর পড়া-খরচ চলছিল না; কেউ টিপ্পনি কেটে বললে, এম-এর নয় হে, প্রেমের। কেউ বললে, বিকৃতমস্তিষ্ক; কেউ বললে, কাপুরুষ।
যে যাই বলুক, তার মৃত সুন্দর মুখে শুধু একটি গল্প-শেষ-করার শান্তি। আবার কোথায় আরেকটি গল্প আরম্ভ করার আয়োজন।
তারপর? এই মহাজিজ্ঞাসার কে উত্তর দেবে? শুধু প্রাণ থেকে প্রাণে অধ্যায় থেকে অধ্যায়ে, এই তারপরের ইসারা। শুধু একটি ক্রমায়ত উপন্যাস।
বিজয়ের বেলায় অনেকেই তো অনেক মন্তব্য করেছিলে, কিন্তু সুকুমারের বেলায় কি বললে? তাকে কে হত্যা করল? কে তাকে অকালে তাড়িয়ে দিলে সংসার থেকে?
এম-এস-সি আর ল পড়ত সুকুমার। খরচের দায়ে এম-এস-সি চালাতে পারল না—শুধু আইন নিয়ে থাকল। কিন্তু শুধু নিজের পড়া-খরচ চালালেই তো চলবে না-সংসার চালাতে হবে। দেশের বাড়িতে বিধবা মা আর দুটি বোন তার মুখের দিকে চেয়ে। বড় বোনটিকে পাত্রস্থ করা দরকার। কিন্তু ঘুরে ঘুরে সে হা-ক্লান্ত, বিনাপণে বর নেই বাংলা দেশে।
একমাত্র রোজগার ছাত্র-পড়ানো—আর কালে-ভদ্রে পূজার কাগজে গল্প লিখে দুপাঁচ টাকা দর্শনী। আর সে দু-পাচ টাকা আদায় করতে আড়াই মাস ধন্না দেওয়া। সকালে যাও, শুনবে কৈলাসবাবু তো তিনটের সময় আসেন; আর যদি তিনটের সময় যাও, শুনবে, কৈলাসবাবু তো ঘুরে গিয়েছেন সকালবেলা। সুতরাং যদি লিখে রোজগার করতে চাও তো সাহিত্যে নয়, মুহুরি হয়ে কোর্টের বারান্দায় বসে দরখাস্তের মুসাবিদা করো।
তাই একমাত্র উপায় টিউশানি। সকালে সন্ধ্যায় অলিতে গলিতে শুধু ছাত্রের অন্নছত্র। পাঁচ থেকে পনেরো—যেখানে যা পাওয়া যায়। তুচ্ছ উঞ্ছবৃত্তি। সে ক্লেশ কহতব্য নয়, মুদ্রার মানদণ্ডে মান নেই, শুধু দণ্ডটাই অখণ্ড। স্বাস্থ্য পড়ল ভেঙে, দিব্যবৰ্ণ পাংশুবর্ণ হয়ে গেল। সুকুমার অসুখে পড়ল।
শেষ দিকে প্রমথ চৌধুরীর বাড়িতে গৃহশিক্ষকের কাজ করত। নামে চাকরি, থাকত একেবারে ঘরের ছেলের মত। কিন্তু শুধু নিজে আরামে থেকে তার সুখ কই? স্নেহ-সেবার বিছানায় পড়ে থাকলে তার চলবে কেন? তার মা-বোনেরা কি ভাববে?
টাকার ধান্দায় ঘোরে সামর্থ্য কই শরীরে? ডাক্তার যা বললেন, রোগও রাজকীয়—সাধ্য হলে চেঞ্জে যাওয়া দরকার এখুনি। কিন্তু সুকুমারের মত ছেলের পক্ষে দেশের বাড়িতে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর চেঞ্জ কোথায়? সেখানে মায়ের বুক ভরবে সত্যি, কিন্তু পেট ভরবে কি দিয়ে?
মাসখানেক কোন খবর নেই। বোধ হয় মঙ্গলময়ী মায়ের স্পর্শে নিরাময় হয়ে গেছে। কিন্তু হঠাৎ একদিন চিঠি এল কল্লোল-আপিসে, সে দুমকায় যাচ্ছে তার এক কাকার ওখানে। দেশের মাটিতে তার অসুখের কোনো সুরাহা হয়নি।
দুখানা কাঠির ওপর নড়বড়ে একটি মাথা আর তার গভীর দুই কোটরে জ্বলন্ত দুটো চক্ষু। এই তখন সুকুমার। কষিতকাঞ্চন দেহ তন্তুসার হয়ে গেছে। কাঁপছে হাওয়া-লাগা প্রদীপের শিষের মত। আড়াল করে না দাঁড়ালে এখুনি হয়ত নিবে যাবে।
কিন্তু এই শরীরে দুমকায় যাবে কি করে? হ্যাঁ, যাব, মা-বোনের চোখের সামনে নিষ্ক্রিয়ের মত তিল তিল করে ক্ষয় হয়ে যেতে পারব না। তাদের চোখের আড়ালে যেতে পারলে তারা ভাবতে পারবেন দিনে-দিনে আমি ভালো হয়ে উঠছি। আর ভালো হয়ে উঠেই আবার লেগেছি জীবিকার্জনের সংগ্রামে।
এ রুগীর পক্ষে দুমকার পথ তো সাধ্যাতীত। কারুর নিশ্চয় যেতে হয় সঙ্গে, অন্তত পৌঁছে দিয়ে আসতে হয়। কিন্তু যাবে কে?
গোকুলের বেলায় পবিত্র, সুকুমারের বেলায় নৃপেন। আরেকজন আদর্শ-প্রেরিত বন্ধু। ওটা তখনো সেই যুগ যে-যুগে প্রায় প্রেমেরই সমান-সমান বন্ধুতার দাম ছিল—সেই একই বিরহোৎকণ্ঠ বন্ধুতা। যে একক্রিয় সে তো শুধু মিত্র, যে সমপ্রাণ সে সখা, যে সদৈবানুমত সে সুহৃৎ–কিন্তু যে অত্যাগসহন, অর্থাৎ দুইজনের মধ্যে অন্যের ত্যাগ যার অসহনীয়, সেই বন্ধু। ছিল সেই অধীর অকপট আসক্তি। এমন টান যার জন্যে প্রাণ পর্যন্ত দেওয়া যায়।
আর এ তো শুধু বন্ধু নয়, মরণের পথে একলা এক পর্যটক।
দেওঘর পর্যন্ত কোনো রকমে আসা গেল। সুকুমারের প্রাণটুকু গলার কাছে ধুকধুক করছে—সাধ্য নেই দুমকার বাস নেয়। নৃপেন বললে, ভয় নেই, আমি তোকে কোলে করে নিয়ে যাব।
কিন্তু বাস-এ তে উঠতে হবে। এত প্রচণ্ড ভিড়, পিন ফোঁটাবার জায়গা নেই। আর এমন অবস্থাও নেই যে ফাঁকা বাস-এর জন্যে বসে থাকা চলে। প্রায় জোরজার করেই উঠে পড়ল নৃপেন। বসবেন কোথায় মশাই? জায়গা কই? মাঝখানে মেঝের উপর একটা বস্তা ছিল। নৃপেন বললে, কেন, এই বস্তার উপর বসব। আপনারা তো দুজন দেখছি, উনি তবে বসবেন কোথায়? ভয় নেই, বেশি জায়গা নেব না, উনি আমার কোলের উপর বসবেন।
অনেক হালকা আর ছোট হয়ে গিয়েছিল সুকুমার। আর নৃপেন তাকে সত্যি-সত্যি কোলে নিয়ে বসল, বুকের উপর মাথাটা শুইয়ে দিলে। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে সারা গা। দুই বোজা চোখে কোন হারানো পথের স্বপ্ন। আর মন? মন চলেছে নিজ নিকেতনে।
দুমকায় এসে ঢালা বিছানা নিলে সুকুমার। সেই তার শেষশয্যা।
একদিন নৃপেনকে বললে, সত্যি করে বল তো, কোনো দিন কাউকে ভালোবেসেছিস?
নৃপেন কথাটার পাশ কাটিয়ে গেল : কে জানে।
কে জানে নয়! সত্যি করে বল, কোনোনি কাউকে অন্তরের সঙ্গে একান্ত করে ভালোবেসেছিস পাগলের মত? স্ত্রীর কথা ভাবিনে! কোন মেয়ের কথা বলছি না।
তবে কি সেই অব্যক্তমূর্তির কথা? নৃপেন স্তব্ধ হয়ে রইল।
আচ্ছা, বল, অন্নজলের জন্যে যে প্রেম, তার চেয়ে বেশি প্রবল বেশি বিশুদ্ধ প্রেম কি কিছু আছে আর পৃথিবীতে? সেই অল্পজলের প্রেমে সর্বস্বান্ত হয়েছিল কখনো? শরীরে ক্ষুধা-তৃষ্ণা স্বাস্থ্য-আয়ু সব বিলিয়ে দিয়েছিল তার জন্যে?
নৃপেনের মুখে কথা নেই। সুকুমারের ইসারায় মুখের কাছে বাটি এনে ধরল। রক্তে ভরে গেল বাটিটা।
ক্লান্তির ভাব কাটিয়ে উঠে সুকুমার বললে, জানালার পর্দাটা সরিয়ে দে। এখনো অন্ধকার হয়নি। আকাশটা একটু দেখি।
নৃপেনের মুখের ম্লানভাব বুঝি চোখে পড়ল সুকুমারের। যেন সান্ত্বনা দিচ্ছে এমনি সুরে বললে, কোনো দুঃখ করিস না। অন্ধকার কেটে যাবে। আলোয় ঝলমল করে উঠবে আকাশ। আবার আলোঝলমল নীল আকাশের তলে আমি বেঁড়াব তোর সঙ্গে। তুই এখানে আর আমি কোথায়! তবু আমরা এক আকাশের নিচে। এই আকাশের শেষ কই।
সবই কি শূন্য? কোথাও কি কিছু ধরবার নেই, দাঁড়াবার নেই? আকাশের অভিমুখে উত্থিত হল সেই চিরন্তন জিজ্ঞাসা।
কিম আকাশং অনাকাশং ন কিঞ্চিৎ কিঞ্চিদেব কিং। এমন কি কিছুই নেই আকাশ হয়েও আকাশ নয়, যা কিছু না হয়েও কিছু?
সুকুমারের মৃত্যুতে প্রমথ চৌধুরী একটা চিঠি লিখেছিলেন দীনেশদাকে। সেটা এখানে তুলে দিচ্ছি।
কল্যাণীয়েষু
আজ ঘুম থেকে উঠে তোমার পোষ্টকার্ডে সুকুমারের অকালমৃত্যুর খবর পেয়ে মন বড় খারাপ হয়ে গেল। কিছুদিন থেকে তার শরীরের অবস্থা যে রকম দেখছিলুম তাতেই তার জীবনের বিষয়ে হতাশ হয়েছিলুম।
আমার সাধ্যমত তার রোগের প্রতিকার করবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তার ফল কিছু হল না। নৃপেন যে তার সঙ্গে দুমকা গিয়েছিল তাতে সে প্রকৃত বন্ধুর মতই কাজ করেছে। নৃপেনের এই ব্যবহারে আমি তার উপরে যারপরনাই সন্তুষ্ট হয়েছি।
এই সংবাদ পেয়ে একটি কথা আমার ভিতর বড় বেশি করে জাগছে।
সুকুমারের এ বয়সে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হল শুধু তার অবস্থার দোষে। এ দেশে কত ভদ্রসন্তান যে এরকম অবস্থায় কায়ক্লেশে বেঁচে আছে মনে করলে ভয় হয়।
প্রমথনাথ চৌধুরী
একজন যায়, আরেকজন আসে। যে যায় সেও নিশ্চয় কোথাও গিয়ে উপস্থিত হয়। আর যে আসে, সেও হয়তো কত অজানিত দেশ ঘুরে কত অপরিচয়ের আকাশ অতিক্রম করে একেবারে হৃদয়ের কাছটিতে এসে দাঁড়ায় :
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন—
হঠাৎ কল্লোলে একটা কবিতা এসে পড়ল—নীলিমা। ঠিক এক টুকরো নীল আকাশের সারল্যের মত। মন অপরিমিত খুশি হয়ে উঠল। লেখক অচেনা, কিন্তু ঠিকানাটা কাছেই, বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিট। বলা-কওয়া নেই, সটান একদিন গিয়ে দরজায় হানা দিলাম।
এই জীবনানন্দ দাশগুপ্ত!
শুধু মনে মনে সম্ভাষণ করে তৃপ্তি পাচ্ছিলাম না। একেবারে সশরীরে এসে আবির্ভূত হলাম। আপনার নিবিড়-গভীর কবি মন প্রসন্ন নীলিমার মত প্রসারিত করে দিয়েছেন। ভাবলাম আপনার হৃদয়ের সেই প্রসন্নতার স্বাদ নিই।
ভীরু হাসি হেসে জীবনানন্দ আমার হাত ধরল। টেনে নিয়ে গেল তার ঘরের মধ্যে। একেবারে তার হৃদয়ের মাঝখানে।
লোকটি যতই গুপ্ত হোক পদবীর গুপ্ত তখনো বর্জন করেনি। আর যতই সে জীবনানন্দ হোক তার কবিতায় আসলে একটি জীবনাধিক বেদনার প্রহেলিকা।
বরিশাল, সর্বানন্দ ভবন থেকে আমাকে-লেখা তার একটা চিঠি এখানে তুলে দিচ্ছি :
প্রিয়বরেষু
আপনার চিঠিখানা পেয়ে খুব খুশী হলাম। আষাঢ় এসে ফিরে যাচ্ছে, কিন্তু বর্ষণের কোনো লক্ষণই দেখছিনে। মাঝে মাঝে নিতান্ত নীলোৎপলপত্রকান্তিভিঃ ক্কচিং প্রভিন্নাঞ্জনরাশিসন্নিভৈঃ মেঘমালা দূর দিগন্ত ভরে ফেলে চোখের চাতককে দুদণ্ডের তৃপ্তি দিয়ে যাচ্ছে। তারপরেই আবার আকাশের cerulean vacancy, ডাক-পাখীর চীৎকার, গাঙচিল-শালিখের পাখার ঝটপট, মৌমাছির গুঞ্জরণ-উদাস অলস নিরালা দুপুরটাকে আরো নিবিড়ভাবে জমিয়ে তুলচে।
চারদিকে সবুজ বন, মাথার উপর শফেদা মেঘের সারি, বাজপাখীর চকর আর কান্না। মনে হচ্ছে যেন মরুভূমির সবজিবাগের ভেতর বসে আছি, দূরে-দূরে তাতার দস্যুর হুল্লোড়। আমার তুরানী প্রিয়াকে কখন যে কোথায় হারিয়ে ফেলেছি!…হঠাৎ কোত্থেকে কত কি তাগিদ এসে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় একেবারে বেসামাল বিশমাল্লার ভিড়ে! সারাটা দিন–অনেকখানি রাত-জোয়ারভাটায় হাবুডুবু!
গেল ফাল্গুনমাসে সেই যে আপনার ছোট্ট চিঠিখানা পেয়েছিলুম সেকথা প্রায়ই আমার মনে পড়ে। তখন থেকেই বুঝেছি বিধাতার কৃপা আমার ওপর আছে। আমি সারাটা জীবন এমনতর জিনিসই চেয়েছিলাম। চট করে যে মিলে যাবে সে রকম ভরসা বড় একটা ছিল না। কিন্তু সুরুতেই পেয়ে গেলুম। ছাড়চিনে; এ জিনিসটাকে স্মৃতির মণিমঞ্জুষার ভেতরেই আটকে রাখবার মত উদাসী আমি নই। বেদান্তের দেশে জমে ও কায়াকে ছায়া বলা তো দূরের কথা, ছায়ার ভেতরই আমি কায়াকে ফুটিয়ে তুলতে চাই।
স্পষ্ট হদিস পাচ্চি আমার এই টিমটিমে কবি-জীবনটি দপ করেই নিভে যাবে; যাক গে—আফশোষ কিসের? আপনাদের নব-নব-সৃষ্টির রোশনায়ের ভেতর আলো খুঁজে পাব তো-আপনাদের সঙ্গে সঙ্গে চলবার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হব না তো। সেই তো সমস্ত। আমার হাতে যে বাঁশী ভেঙে যাচ্চে,–গেছে, বন্ধুর মুখে তা অনাহত বেজে চলেছে, —আমার মেহেরাবে বাতি নিবে গেল, বন্ধুর অনির্বাণ প্রদীপে পথ দেখে চলুম,-এর চেয়ে তৃপ্তির জিনিস আর কি থাকতে পারে।
চার দিকেই বে-দরদীর ভিড়। আমরা যে কটি সমানধৰ্ম্মা আছি, একটা নিরেট অচ্ছেদ্য মিলন-সূত্র দিয়ে আমাদের গ্রথিত করে রাখতে চাই। আমাদের তেমন পয়সাকড়ি নেই বলে জীবনের creature comforts জিনিসটি হয়তো চিরদিনই আমাদের এড়িয়ে যাবে; কিন্তু একসঙ্গে চলার আনন্দ থেকে আমরা যেন বঞ্চিত না হই—সে পথ যতই পর্ণমলিন, আতপক্লিষ্ট, বাত্যাহত হোক না কেন।
আরো নানারকম আলাপ কলকাতায় গিয়ে হবে। কেমন পড়ছেন? First class নেওয়া চাই। কলকাতায় গিয়ে নতুন ঠিকানা আপনাকে সময়মত জানাব। আমার প্রতিসম্ভাষণ গ্রহণ করুন। ইতি
আপনার জীবনানন্দ দাশগুপ্ত
বরিশাল থেকে ফিরে এসে জীবনানন্দ ডেরা নিলে প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংয়ে, হারিসন রোডে, কল্লোলের নাগালের মধ্যে। একা-এক ঘর, প্রায়ই যেতাম তার কাছে। কোনো-কোনো দিন মনে এমন একটা সুর আসে যখন হৈ-হল্লা, জনতা-জটলা ভালো লাগে না। সে সব দিন পটুয়াটোলা লেনে না ঢুকে পাশ কাটিয়ে রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট দিয়ে জীবনানন্দের মেসে এসে হাজির হতাম। পেতাম একটি অস্পর্শশীতল সান্নিধ্য, সমস্ত কথার মধ্যে একটি অন্তরতম নীরবতা। তুচ্ছ চপলতার ঊর্ধ্বে বা একটি গভীর ধ্যানসংযোগ। সে যেন এই সংগ্রামসংকুল সংসারের জন্যে নয়, সে সংসারপলাতক। জোর করে তাকে দু-একদিন কল্লোলআপিসে টেনে নিয়ে গেছি, কিন্তু একটুও আরাম পায়নি, সুর মেলাতে পারেনি সেই সপ্তস্বরে। যেখানে অনাহত ধ্বনি ও অলিখিত রং, জীবনানন্দের আড্ডা সেইখানে।
তীব্র আলো, স্পষ্ট বাক্য বা প্রখর রাগরঞ্জন-এ সবের মধ্যে সে নেই। সে ধূসরতার কবি, চিরপ্রদোষদেশের সে বাসিন্দা। সেই যে আমাকে সে লিখেছিল, আমি ছায়ার মধ্যে কায়া খুঁজে বেঁড়াই, সেই হয়ত তার কাব্যলোকের আসল চাবিকাঠি। যা সত্তা তাই তার কাছে অবস্তু, আর যা অবস্তু তাই তার অনুভূতিতে আশ্চর্য অস্তিত্বময়। যা অনুক্ত তাই অনির্বচনীয় আর যা শব্দম্পৰ্শম্প তাই নীনির্জন, নির্বাণনিশ্চল। বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ নতুন স্বাদ নিয়ে এসেছে, নতুন দ্যোতনা। নতুন মনন, নতুন চৈতন্য। ধোয়াটের জলে ভেসে-আসা ভরাটের মাটি নয়, সে একটি নতুন নিঃসঙ্গ নদী।
সিটি কলেজে লেকচারারের কাজ করত জীবনানন্দ। কবিতায় শস্যশীর্ষে স্তনশ্যামমুখ কল্পনা করেছিল বলে শুনেছি সে কর্তৃপক্ষের কোপে পড়ে। অশ্লীলতার অপবাদে তার চাকরিটি কেড়ে নেয়। যতদুর দেখতে পাই অশ্লীলতার হাড়িকাঠে জীবনানন্দই প্রথম বলি।
নখাগ্র পর্যন্ত যে কবি, সাংসারিক অর্থে সে হয়তে। কৃতকাম নয়। এবং তারই জন্যে আশা, সর্বকল্যাণকারিণী কবিতা তাকে বঞ্চনা করবে না।
ইডেন গার্ডেনে একজিবিশনের ্তাঁবু ছেড়ে শিশিরকুমার ভাদুড়ি এই সময় মনোমোহনে সীত অভিনয় করছেন, আর সমস্ত কলকাতা বসন্ত-প্রলাপে অশোক-পলাশের মত আনন্দ-উত্তাল হয়ে উঠেছে। কামমোহিত ক্রৌঞ্চমিথুনের একটিকে বাণবিদ্ধ করার দরুন বাল্মীকির কণ্ঠে যে বেদনা উৎসারিত হয়েছিল, শিশিরকুমার তাকে তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে বাণীময় করে তুললেন। সমস্ত কলকাতাশহর ভেঙে পড়ল মনোমোহনে। শুধু অভিনয় দেখে লোকের তৃপ্তি নেই। রাম নয়, তারা শিশিরকুমারকে দেখবে, নরবেশে কে সে দেবতার দেহধারী, তার জয়ধ্বনি করবে, পারে তো পা স্পর্শ করে প্রণাম করবে তাকে।
সে সব দিনের সীতা জাতীয় মহাঘটনা। দ্বিজেন্দ্রলালের সীতায় হস্তক্ষেপ করল প্রতিপক্ষ, কুছ পরোয়া নেই, যোগেশ চৌধুরীকে দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া হল নতুন বই। রচনা তো গৌণ, আসল হচ্ছে অভিনয়, দেবতার দুঃখকে মানুষের আয়তনে নিয়ে আসা, কিংবা মানুষের দুঃখকে দেবত্বমণ্ডিত করা। শিশিরকুমারের সে কি ললিতগম্ভীর রূপ, কণ্ঠস্বরে সে কি সুধাতরঙ্গ! কতবার যে সীতা দেখেছি তার লেখাজোখা নেই। দেখেছি অথচ মনে হয়নি দেখা হয়েছে। মনে ভাবছি, জন কিটসের মত অতৃপ্ত চোখে তাকিয়ে আছি সেই গ্রীসিয়ান আর্নের দিকে আর বলছি : A thing of Beauty is a joy for ever.
কিন্তু কেবলই কি দু-তিন টাকার ভাঙা সিটে বসে হাততালি দেব, একটিবারও কি যেতে পারব না তার সাজঘরে, তার অন্তরঙ্গতার রংমহলে? যাবে যে, অধিকার কি তোমার? তার অগণন ভক্তের মধ্যে তুমি তো নগণ্যতম। নিজেকে শিল্পী, সৃষ্টিকর্তা বলতে চাও? বলতে চাও, সেই অধিকার? তোমার শিল্পবিদ্যা কি আছে তা তো জানি, কিন্তু দেখছি বটে তোমার আস্পর্ধাটাকে। তোমাকে কে গ্রাহ করে? কে তোমার তত্ত্ব নেয়?
সব মানি, কিন্তু এত বড় শিল্পাদিত্যের আশীর্বাদ পাব না এটাই বা কেমনতর?
তেরোশ বত্রিশ সালের ফাল্গুনে বিজলী দীনেশরঞ্জনের হাতে আসে। তার আগে সাবিত্রীপ্রসন্নের আমলেই নৃপেন বিজলীতে নাট্যসমালোচনা লিখত। সে সব সমালোচনা মামুলি হিজিবিজি নয়, নয় সেটা ব্যবসাদারি চোখের কটাক্ষপাত। সেটা একটা আলাদা কারুকর্ম। নৃপেন তার আবেগ-গম্ভীর ভাষায় সীতার প্রশস্তিরচনা করলে সমালোচনাকে নিয়ে গেল কবিতার পর্যায়ে।
সে সব আলোচনা বিদগ্ধজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার মত। বলা বাহুল্য, শিশিরকুমারেরও চোখ পড়ল, কিন্তু তার চোখ পড়ল লেখার উপর তত নয়, যত লেখকের উপর। নৃপেনকে তিনি বুকে করে ধরে নিয়ে এলেন।
কিন্তু শুধু শুদ্ধাভক্তির কবিতাকে কি তিনি মূল্য দেবেন? চালু কাগজের প্রশংসাপ্রচারে কিছু না-হয় টিকিট বিক্রির সম্ভাবনা আছে, কিন্তু কবিতা? কেই বা পড়ে, কেই বা অর্থ-অনর্থ নিয়ে মাথা ঘামায়? পত্রিকার পৃষ্ঠায় ফাঁক বোজাবার জন্যেই তো কবিতার সৃষ্টি। অর্থাৎ পদের দিকে থাকে বলেই তার আরেক নাম পদ্য।
জানি সবই, তবু সেদিন শিশিরকুমার তার অভিনয়ে যে লোককালাতীত বেদনার ব্যঞ্জনা আনলেন তাকেই বা প্রকাশ না করে থাকতে পারি কই? সোজামুজি শিশিরকুমারের উপর এক কবিতা লিখে বসলাম। আর একটু সাফ-সুতরো জায়গা করে ছাপালাম বিজলীতে।
দীর্ঘ দুই বাহু মেলি আর্তকণ্ঠে ডাক দিলে : সীতা, সীতা, সীতা–
পলাতকা গোধূলি প্রিয়ারে,
বিরহের অস্তাচলে তীর্থযাত্রী চলে গেল ধরিত্রী-দুহিতা
অন্তহীন মৌন অন্ধকারে।
যে কান্না কেঁদেছে যক্ষ কলকণ্ঠা শিপ্রা-রে-বেত্রবতী-তীরে
তারে তুমি দিয়াছ যে ভাষা;
নিখিলের সঙ্গীহীন যত দুঃখী খুঁজে ফেরে বৃথা প্রেয়সীরে
তব কণ্ঠে তাদের পিপাসা।
এ বিশ্বের মর্মব্যথা উচ্ছ্বসিছে ওই তব উদার ক্রন্দনে,
ঘুচে গেছে কালের বন্ধন;
তারে ডাকো—ডাকো তারে—যে প্রেয়সী যুগে-যুগে চঞ্চল চরণে
ফেলে যায় ব্যর্থ আলিঙ্গন।
বেদনার বেদমন্ত্রে বিরহের স্বর্গলোক করিলে সৃজন
আদি নাই, নাহি তার সীমা;
তুমি শুধু নট নহ, তুমি কবি, চক্ষে তব প্রত্যুষ স্বপন
চিত্তে তব ধ্যানীর মহিমা।।
শিশিরকুমারের সানন্দ ডাক এসে পৌঁছুল সস্নেহ সম্ভাষণ। ভাগ্যের দক্ষিণমুখ দেখতে পেলাম মনে হল। দীনেশরঞ্জনের সঙ্গে সটান চলে গেলাম তার সাজঘরে। প্রণাম করলাম।
নিজেই আবৃত্তি করলেন কবিতাটা। যে অর্থ হয়তো নিজের মনেও অলক্ষিত ছিল তাই যেন আরোপিত হল সেই অপূর্ব কণ্ঠস্বরের ঔদার্যে। বললেন, আমাকে ওটা একটু লিখে-টিখে দাও, আমি বাঁধিয়ে টাঙিয়ে রেখে দিই এখানে।
দীনেশরঞ্জন তার চিত্রীর তুলি দিয়ে কবিতাটা লিখে দিলেন, ধারেধারে কিছু ছবিরও আভাস দিয়ে দিলেন হয়তো। সোনার জলে কাজকরা ফ্রেমে বাঁধিয়ে উপহার দিলাম শিশিরকুমারকে। তিনি তার ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখলেন।
একটি স্বজনবৎসল উদার শিল্পমনের পরিচয় পেয়ে মন যেন প্রসার লাভ করল।