১৪. জায়গায় জায়গায় রক্ত জমে

অনেকক্ষণ পর সে যখন উঠল, তখন তার মুখটা আঘাতে জায়গায় জায়গায় রক্ত জমে ভীষণ হয়ে উঠেছে। তবু সেই আঘাত আর চোখের জলই তাকে একটু স্বস্তি দিয়েছে।

বাড়ি ফেরার পথে লখাইয়ের কাছে গেল সে। লখাই বাড়িতেই ছিল। সব কথা পবন তাকে বলল।

তাতে পবনের চেয়ে লখাইগের অবস্থা বিশেষ ভালো হলো না। তারও তেমনই রুদ্ধ রাগ ফুঁসে উঠল বুকের মধ্যে। পর মুহূর্তেই মনে পড়ল শ্যামের কথা, বিষ নেই, তার কুলোপানা চার। তারা বিষ হারিয়ে ঢোঁড়া হয়েছে। সুকৌশলে তাদের সমস্ত বিষ হরণ করেছে কোম্পানি বাহাদুর। সে বিষের কল করেছে তারা কোর্টকাছারি। পয়সা থাকলে সেখানে আজ এ অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করা যেত। আর তা ছাড়া, যে উপায় আছে, সে উপায়ে এর প্রতিশোধ হবে যেদিন ঢোঁড়ার দল তার সে বিষ সংগ্রহ করতে পারবে।

পবন বলল, সবই গেছে লখাই, বাকি ছিল এটুকু। সেটুকুও হয়ে গেল। আর রয়েছে তারা। এবার ওকে নে এখানে থেকে চলে যাব।

লখাই জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

পবন বলল, শুনেছি, তেলেনিপাড়ার চটকলে কাজ করতে গেলে দুবেলা দুমুঠো খেতে পাওয়া যায়। সেখানে জমিদার-মহাজনের চশমখোরি নেই, কাজ করে যা খুশি তাই কর, বলবার নেই কেউ।

লখাইয়ের সমস্ত মুখ কালো হয়ে উঠল। তুমি কোম্পানির কলে খাটতে যাবে?

পবনের সারামুখে ব্যঙ্গহাসিতে ভরে উঠল। বলল, মান-অপমানের কথা বলে কী লাভ লখাই ভাই? খাটো-পাও, পেছন টানের বালাই নেই, আমি সেখানেই যাব।

বলে সে চলে গেল। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল লখাই।

তারপর তার চোখের সামনে ভেসে উঠল গাড়ুলিয়ার মুরলীদাসের আখড়া, স্যামসাহেবের নীলকুঠির উপর উঠেছে মস্ত চটকলের ইমারত। মুহূর্তে সে ইমারত রেলগাড়ির মতো গর্জন করতে করতে ছুটে আসছে। ক্রমাগত শ্যামনগর পেরিয়ে, আতপুর দিয়ে এই সেনপাড়ার উপর। সমস্ত বাধা ঠেলে গুঁড়িয়ে দানবীর গতিতে এগিয়ে আসছে। কেউ তাকে ঠেকাতে পারল না। সে ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে, গ্রাম জনপদ উচ্ছেদ করে, খেতবাগান ধ্বংস করে। না না, সে সর্বগ্রাসী রাহুকে। তুমি ঠেকাতে পারবে না।

.

কতক্ষণ লখাইয়ের এরকম আচ্ছন্ন অবস্থায় কাটল বলা যায় না। কাঞ্চনের বমির বেগে ওয়াক পারার শব্দে সম্বিত ফিরল তার। সে শুনতে পেল কালীবউ বলছে, ও কিছু নয়, নে এই নেবুপাতা কটা চটকে শোঁক, কমে যাবে।

জবাবে শুনল কাঞ্চন বলছে, কিছু শুঁকতে ঢুকতে পারব না বাপু আমি, কিছু ভাল লাগছে না আমার।

লখাই ঢুকল বাড়ির ভিতরে, তাকে দেখেই কাঞ্চন মুখ নামাল একটু হেসে।

লখাই দেখল কাঞ্চীবউয়ের কাঞ্চনবর্ণ যেন কেমন তাপদগ্ধ তামাটে হয়ে উঠেছে, চোখের কোল বসা, ক্লান্তিভরা মুখ।

কালী লেবুপাতা কটা লখাইয়ের হাতে দিয়ে বলল, নেও বাপু, দুজনে যা করতে হয় করো, এখন আর আমাকে মুখ ঝাল্টা দিলে কী হবে, তখন মনে ছেল না?

বলে সে হাসি গোপন করে চলে গেল।

লখাই লেবুপাতা চটকে কাঞ্চনের নাকের কাছে ধরল। কাঞ্চন হাত দিয়ে সরিয়ে বলল, ওতে আমার কিছু হবে না।

কিন্তু লখাই সে কথা ছেড়ে বলল, তা হলে সত্যি সত্যি এল?

কাঞ্চন বলল, না, মিছিমিছি।

লখাইয়ের গলায় সোহাগ ফুটল এক বিচিত্র আনন্দ ও উৎকণ্ঠায়। বলল, তোমার শরীর কিন্তু বড় খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

তা শরীর কি চেরকালই এক রকম থাকবে? বলে হঠাৎ মুখভরা করে বলল, আমাকে তুমি রেখে এসসা বাপের বাড়িতে। কত দিন যাইনি।

বেশ, চলো। কালীবউঠানের আপত্তি না থাকলেই হল।

কালী ঘর থেকে বলে উঠল, আমার আবার আপত্তি কী? কাঞ্চী যখন আসেনি, একলা সমসার চালাইনি আমি? একটা ননদও ছেল না, শাশুড়ীও না।

বলতে বলতে হঠাৎ কালী বাইরে কাঞ্চন লখাইয়ের কাছে এসে কেঁদে উঠল। সেদিনে আর এদিনে কত ফারাক। ভাবলে আমার বুকটার মধ্যে যে কী হয়। ….একশো বিঘে জমি ছেল, দুজোড়া বলদ, পাঁচ-পাঁচটা দুধের গাই। আমার কী না ছেল।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *