১৪. গানের আসর বসেছে

গানের আসর বসেছে। মঞ্চ তৈরি হয়েছে। রইসুদ্দিনের বাংলাঘরের দর্মার বেড়া সরিয়ে তৈরী হয়েছে মঞ্চ। চারদিক খোলা, উপরে টিনের ছাদ। দুটা হ্যাজাক বাতি উপর থেকে ঝুলছে। চাটাই পেতে গায়কদের ও বাজনাদারদের বসার ব্যবস্থা। যাত্রার মঞ্চের মত মঞ্চ–চারদিকেই দর্শক।

দর্শকদের বসার কোন ব্যবস্থা নেই। যে যেখানে পেরেছে বসেছে। শাহানা ও মিতুর জন্যে চেয়ার এসেছে। সেই চেয়ার পাতা হয়েছে বাঁশের চাটাইয়ের উপর। প্রচুর লোক সমাগম হয়েছে। শুধু শাহানাদের চারপাশ খালি। এদের আশেপাশে কেউ বসছে না। মঞ্চের দক্ষিণ দিকের একটা অংশ মেয়েদের জন্যে আলাদা করা। সেখানে গাদাগাদি ভিড়। এই ছোট্ট গ্রামে এত মানুষ আছে শাহনা ভাবেনি। রীতিমত জনসমুদ্র। মাইক নেই–সবাই কি শুনতে পারবে? দুবোন কৌতূহলী চোখে চারদিক দেখছে–তাদের পায়ের কাছে পুষ্প। আনন্দ ও উৎসাহে সে ঝলমল করছে। পুষ্প ধারাবর্ণনা দিয়ে যাচ্ছে।

ঐ যে বুড়া লোকটা দেখতাছেন আপা–উনার নাম পরাণ। পরাণ ঢোলী–পিথিমীর মইধ্যে শ্রেষ্ঠ।

শাহনা হাসিমুখে বলল–শিল্পীদের মধ্যে পিথিমীর শ্রেষ্ঠ আর কে কে আছে?

করিম সাব আছে–ঐ যে মোটাগাটা। বেহালা বাজায়। বেহালার ওস্তাদ কারিগর।

নীতু বলল–একটা লোক যে ঘুমাচ্ছে ও কে?

আমরার গেরামেরই–তাল দেয়। মন্দিরা দিয়া তাল দেয়।

সে ঘুমাচ্ছে কেন? ঘুমাইতাছে না আপা, চোখ বন্ধ কইরা আছে।

কেন? চোখ বন্ধ করে আছে কেন?

শইলডা মনে হয় ভাল না আপা।

মাঠে শরীর খারাপ নিয়ে গান করতে এসেছে কেন?

শাহানা বলল, চুপ কর তো নীতু–তুই বড় পেঁচাতে পারিস। চুপ করে গান নে।

গান তো শুরু হয়নি যে শুনব।

পুষ্প উৎসাহের সঙ্গে বলল, অক্ষন শুরু হইব। আপা, পরথম হইব বন্দনা তারপর গান। আমার কুসুম বুবু আসছে। ঐ দেহেন একলা একলা বইস্যা আছে–।

নীতু বলল, আমাদের কাছে এসে বসতে বল।

বইল্যা লাভ নাই, আসব না।

শাহানা তাকাল। কুসুমের সঙ্গে আগে দুবার দেখা হলেও এখনকার আলোআধারীতে তাকে চেনা যাচ্ছে না। অন্য রকম লাগছে।

নীতু বলল, মেয়েটা কি মিষ্টি দেখেছ আপা?

শাহানা হাসতে হাসতে বলল, পিথীমীর শ্রেষ্ঠ মিষ্টি।

নীতু খিলখিল করে হাসছে। পুষ্পও হাসছে। কুসুম হাসির শব্দে সচকিত হয়ে ওদের দিকে তাকাল। তারপরই উঠে গিয়ে ভিড়ের ভেতর মিশে গেল। আজ সে খুব সেজেছে। চোখে কাজল দিয়েছে। পায়ে আলতা দিয়েছে। লম্বা চুলে সুন্দর বেণী। পুষ্প বলল, হারমনি বাজাইব যে লোকটা তার নাম কুদ্স। হে তিনটা বিয়া করছে।

নীতু বলল, কেন?

শাহানা বলল, চুপ কর তো নীতু, ও তিনটা বিয়ে করেছে কেন সেটা পুষ্প কি করে বলবে?

লোকটাকে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করব আপা?

তুই বড্ড যন্ত্রণা করিস নীতু।

নীতু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ অতিরিক্ত রকম উৎসাহের সঙ্গে বলল, আপা দেখ দেখ। আমাদের গায়ক মতি মিয়াকে দেখ। দেখছ?

হুঁ।

পুষ্প বলল, মতিভাই গানের দল করছে।

নীতু বলল, গানের দল করলে এরকম বিশ্রী রঙের পাঞ্জাবি পরতে হবে? পাঞ্জাবিটার দিকে তাকালে বমি এসে যায় না?

বমি না আসলেও চোখ কট কট করে। পিথিমীর নিকৃষ্ট হলুদ রঙ।

আপা, ভদ্রলোক আমাদের দিকে আসছেন। সর্বনাশ হয়েছে! হয়ত তোমাকে সভাপতি হবার জন্যে অনুরোধ করবেন।

গ্রামের অনুষ্ঠানে সভাপতি-টতি হবার নিয়ম নেই।

তাহলে আসছেন কেন?

পুষ্প বলল, আফনাদের জইন্যে পান আনতাছে।

নীতু অবাক হয়ে বলল, পান আনবে কেন? আমরা তো পান খাই না। নাকি গানের আসরে এলে পান খেতে হয়?

মতি কঁসার বাটিতে বানানো খিলিপান এনে অতি বিনয়ের সঙ্গে শাহানার সামনে টেবিলে রাখল। শাহানা সঙ্গে সঙ্গে এক খিলি পান তুলে নিল।

নীতু বলল, আপনি এই কুৎসিত পাঞ্জাবিটা কেন পরেছেন? কটকটা হলুদ রঙের পাঞ্জাবি কেউ পরে? ও কি, চোখে কাজল দিয়েছেন নাকি?

মতি বিব্রত গলায় বলল, গাওয়ার দিন সাজসজ্জা করা আমার ওস্তাদের আদেশ।

নীতু গম্ভীর গলায় বলল, আপনার ওস্তাদকে বলবেন তার আদেশ মানার জন্যে আপনাকে ভূতের মত লাগছে। আর কাজলও তো ঠিকমত দিতে পারেননি–এক চোখে বেশি এক চোখে কম…

শাহানা নীতুকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আপনাদের অনুষ্ঠান কখন শুরু হবে?

আফনের দাদাজান আইলেই শুরু হইব। উনি এই অঞ্চলের পরধান। উনারে ছাড়া শুরু করণ যায় না।

উনি আসবেন না। শুরু করে দিন। অনুষ্ঠান চলবে কতক্ষণ?

সারারাত ধইরা চলব।

সে কি?

গেরাম দেশের আসরের এইটাই নিয়ম। মসজিদে ফজরের আজান হইব–গাওনা শেষ।

শাহানা বলল, নীতু তো কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়বে। তারচেয়েও বড় কথা, আকাশের অবস্থা দেখেছেন–বৃষ্টি নামবে। দেরি না করে শুরু করে দিন।

অনুষ্ঠান শুরু হল বাজনা দিয়ে। মূল বাদক পরাণ। সে ঢোলে বোল তুলল। মনে হচ্ছে সে বাজিয়ে ঠিক আরাম পাচ্ছে না–নড়াচড়া করছে–ঢোলের জায়গা বদল করছে। কখনও রাখছে বাপাশে, কখনও সরিয়ে নিয়ে আসছে ডানপাশে। সেলের সঙ্গে যুক্ত হল–খঞ্জনী, তার সঙ্গে বাঁশি। পরাণ ঢোলী তাপরেও স্বস্তি পাচ্ছে না–বার বার কেমন যেন অসহায় দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। সম্ভবত তার কোন সমস্যা হচ্ছে।

আবদুল করিম ভুরু কুঁচকে পান চিবাচ্ছিল। বেহালা তার কোলের উপর রাখা। থু করে মুখের পান ফেলে দিয়ে বেহালা কাঁধে তুলে নিল। বেহালার ছড় কপালে ছুঁইয়ে দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। তারপরই হঠাৎ যেন একটা ঝড় বয়ে গেল। পরাণ ঢোলীর অস্বস্তি দূর হল। খঞ্জনীবাদক শীরদাঁড়া সোজা বসল, বাঁশিওয়ালা তার বাঁশি বদলে নতুন বাঁশি নিল।

নীতু বলল, আপা, এরা কি অদ্ভুত বাজনা বাজাচ্ছে দেখেছ?

শাহানা চুপ করে রইল–বাজনা না, একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। যে ঝড়ের উদ্দেশ্য মনের উপর চাপা পড়ে থাকা ধুলা-ময়লা-আর্বজনা উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া। সব ঝড়ের সঙ্গেই বৃষ্টি থাকে, বৃষ্টি মানেই কান্না। বাজনার এই ঝড়েও কান্না আছে। গভীর, গোপন কিন্তু তীব্র কান্না। সেই কান্নার দায়িত্ব নিয়েছে–বেহালা ও বাঁশি। ঢোল হচ্ছে ঝড়, বেহালা হচ্ছে বৃষ্টি।

পরাণ ঢোলী বসে ঢোল বাজাচ্ছিল। হ্যাচকা টানে সে ঢোল কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার সঙ্গে উঠে দাঁড়াল বেহালাবাদক আবদুল করিম।

নীতু উত্তেজনায় অস্থির হয়ে বলল–আপা, দেখ কি অদ্ভুত করে ওরা নাচছে। শাহানা আশ্চর্য বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। নৃত্যের উত্তেজনা, ঢোলের তাল, বেহালার তীব্র সুরের ছোঁয়া লেগেছে দর্শকের মনে। চারদিকে বাজনার শব্দ ছাড়া সুনসান নীরবতা। কেউ মনে হয় নিঃশ্বাস ফেলছে না।

নীতু ফিস ফিস করে বলল, আমারো নাচতে ইচ্ছা করছে আপা।

শাহানা ভাবছে, এই বাজনা তার কাছে যত সুন্দর লাগছে আসলেই কি তা তত সুন্দর, নাকি বিশেষ এই পরিবেশ তাকে অভিভূত করছে? নিস্তব্ধ গ্রাম, মেঘে ভরা আকাশ–দূরের হাওড় সবকিছুই বাজনায় অংশগ্রহণ করছে বলেই কি এমন লাগছে?

যতই সময় যাচ্ছে বাজনা ততই উদ্দাম হচ্ছে–ঢোলবাদক তার ঢোলকে বিশেষ একদিকে মোড় নেওয়ানোর চেষ্টা করছেন। বেহালাবাদক এবং বংশিবাদকের বিস্মিত দৃষ্টি বলে দিচ্ছে ঢোলে কিছু একটা হচ্ছে যা ধরাবাধা নিয়মের বাইরে…। তারা বিপুল উৎসাহে নতুন করে শুরু করল–। শাহানা তার শরীরে এক ধরনের কাঁপন অনুভব করল। শরীরের ভেতরে যে শরীর আছে সেই শরীরে কিছু একটা হচ্ছে।

 

গান শুরু হল মাঝরাতে। ততক্ষণে নীতু ঘুমিয়ে পড়েছে। সে ঘুমুচ্ছে শাহানার কোলে মাথা রেখে। আকাশে মেঘ আরো বাড়ছে। গুড় গুড় শব্দ হচ্ছে। যেকোন মুহূর্তে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে।

মতি আকাশের দিকে উদ্বিগ্ন চোখে একবার তাকিয়েই গান ধরল–

মরিলে কান্দিও না আমার দায়
ও যাদুধন।
মরিলে কান্দিও না আমার দায়…

ও আমার প্রিয়জন আমার মৃত্যুতে তুমি কেঁদো না। তুমি বরং কাফন পরাবার আগে আগে সুন্দর করে সাজিয়ে দিও। গান শুরু হল খালি গলায়। তার সঙ্গে যুক্ত হলো হারমোনিয়াম, বেহালা ও বাঁশি। অপূর্ব গলা–ভরাট, মিষ্টি, বিষাদ মাখা। কিছুক্ষণ আগের উদ্দাম বাজনার স্মৃতি গাতক মতি মিয়া উড়িয়ে নিয়ে গেল। তীব এক বিষাদ মতি মিয়া ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই বিষাদ পৃথিবীর বিষাদ নয়। এই বিষাদ অন্য কোন ভুবনের।

শাহানা স্পষ্ট চোখের সামনে দেখতে পেল মানুষটি মরে পড়ে আছে–তার অতি প্রিয়জন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সেই কান্না ছাপিয়ে গান হচ্ছে–

মরিলে কান্দিও না আমার দায়
ও যাদুধন।
মরিলে কান্দিও না আমার দায়…

সাধারণ একজন গ্রাম্য গায়ক–সাধারণ সুর অথচ কি অসাধারণ ভঙ্গিতেই না সে জীবনের নশ্বরতার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। মনের গভীরে ছড়িয়ে দিচ্ছে নগ্ন হাহাকার। শাহানার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে লাগল। কেউ কি তাকে দেখছে? দেখুক। তার নিজেরও গায়কের সঙ্গে কেঁদে কেঁদে গাইতে ইচ্ছা করছে–

মরিলে কান্দিও না আমার দায়
ও যাদুধন।
মরিলে কান্দিও না আমার দায়…।।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *