১৪. কাফ্রীদের দেশে

চৌদ্দ

মারাকুশ থেকে ফেজ অবধি সফর করলাম আমাদের সুলতানের পারিষদবর্গের সঙ্গে। সেখান থেকেই সুলতানের কাছে বিদায় নিয়ে কাফ্রীদের দেশে (Negrolands) রওয়ানা হয়ে পৌঁছলাম সিজিলমাসা শহরে। শহরটি চমৎকার। প্রচুর সুস্বাদু খেজুর পাওয়া যায় এখানে ১। এখানকার খেজুরের প্রাচুর্যের তুলনা চলে বার খেজুরের সঙ্গে কিন্তু এখানকার খেজুর অপেক্ষাকৃত উত্তম এবং ইরার নামক যে খেজুর আছে দুনিয়ার কোথাও তেমন খেজুর পাওয়া যায় না। এখানে আমি সুপণ্ডিত আবু মোহাম্মদ আল বুশরীর সঙ্গে বসবাস করলাম। এ আল-বুশরীর ভাইয়ের সঙ্গেই চীনের কাজান শহরে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। কি আশ্চর্যজনকভাবে তারা দু’জন দু’জায়গায় পড়ে আছেন। তিনি আমাকে যথেষ্ট সমাদর করেছিলেন।

সিজিলমাসায় আমি কয়েকটি উট খরিদ করলাম। সেগুলির জন্য চার মাসের উপযোগী খাদ্যও খরিদ করে নিলাম। তারপর ৭৫২ হিজরীর ১লা মোহরম (১৮ই ফেব্রুয়ারী, ১৩৫২) আবার এক কাফেলার সঙ্গে পথে বেরিয়ে পড়লাম। অন্যান্য লোক ছাড়া এ কাফেলায় সিজিসমাসের কয়েকজন সওদাগর ছিলেন। পঁচিশ দিন পথ চলার পর তাগাঁজা নামক নগণ্য একটি গ্রামে এসে আমরা পৌঁছলাম। এ গ্রামের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য এই যে, এখানকার মসজিদ ও ঘরগুলি লবণের পাথর (Blocks of salt) দিয়ে তৈরী, ছাদ তৈরী উটের চামড়া দিয়ে। সেখানে গাছপালা নেই, আছে বালি আর বালি। বালির মধ্যে রয়েছে লবণের একটি খনি। খনি খনন করতে গিয়ে তারা লবণের স্থল খণ্ডগুলি এভাবে পায় যেনো যন্ত্রের সাহায্যে চৌকোণাকার করে কেউ একটির পর একটি খণ্ড মাটির নীচে খনির ভিতর সাজিয়ে রেখেছে। একটি উট এ রকম দু’টি খণ্ড (Slab) মাত্র বহন করতে পারে। মাসুফা উপজাতীয় ক্রীতদাসরা ছাড়া তাগাঁজায় আর কেউ বাস করে না। তারা খনি খননের কাজ করে এবং জীবন ধারণ করে দারা ৩ ও সিজিলমাসা থেকে আমদানী করা খেজুর, উটের গোশত ও কাফ্রী দেশের জোয়ার (Millet) খেয়ে। নিজেদের দেশ থেকে কাফ্রীরা এখানে এসে লবণ নিয়ে যায়। ইবালানে এক বোঝা লবণের দাম আট থেকে দশ মিকাল (Mithqals)। সে পরিমাণ লবণই মাল্লী শহরে। বিক্রি হয় বিশ থেকে ত্রিশ মিঙ্কালে–এমন কি সময় বিশেষে চল্লিশ মিত্কাল অবধি দাম ওঠে। সোনা রূপার বিনিময়ে যেমন অন্যান্য দেশে জিনিষ কেনাবেচা হয় কাফ্রীরা তেমনি লবণের বিনিময়ে কেনাবেচা করে। লবণের বড় খণ্ডগুলিকে তারা টুকরো করে কেটে তার সাহায্যে কেনাবেচার কাজ চালায়। তাগাঁজা নগণ্য শহর হলেও ব্যবসায়ে এখানে যা লাভ হয় তার পরিমাণ শত শত মণ স্বর্ণরেণুর ৪ সমান।

আমরা সেখানে কষ্টেসৃষ্টে দশ দিন কাটালাম। কারণ, সেখানকার পানি যেমন লোনা, মাছির উৎপাত তেমনি অত্যধিক। তাগাঁজা ছাড়িয়েই যে মরুভূমি আছে তা পার। হবার জন্য তাগাঁজা হতেই পানি সরবরাহ করা হয়। মরুভূমি পার হতে দশ রাত্রি কেটে যায় কিন্তু পথে ক্কচিৎ কোথাও পানি পাওয়া যায়। সৌভাগ্যবশতঃ বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট নহর থেকেই আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পেয়েছিলাম। একদিন দুটি টিলার মধ্যবর্তী স্থানে আমরা মিষ্টি পানির এক নহর পেয়ে গেলাম। তাতে তৃষ্ণা নিবারণ তো হলই, পরে কাপড়-চোপড়ও ধুয়ে নিলাম। এখানকার মরুভূমিতে ব্যাঙের ছাতা গজায় প্রচুর কিন্তু তা জেঁকে ছেয়ে থাকে। কাজেই লোকে পারদযুক্ত (Mercury) একপ্রকার তারের হার গলায় ঝুলিয়ে রাখে। পারদে জোক মরে যায়। আমরা তখন পথ চলছিলাম কাফেলা ছেড়ে অনেকটা অগ্রসর হয়ে। পথে যেখানেই আমরা পশু চারণের উপযোগী জায়গা পেয়েছি সেখানেই পশুগুলিকে ঘাস খেতে ছেড়ে দিয়েছি। আমরা ঠিক এভাবেই চলছিলাম কিন্তু অবশেষে আমাদের দলের একজন লোক মরুভূমির মধ্যে হারিয়ে গেল। তারপর থেকে আমি আর কাফেলা ছেড়ে বেশী এগিয়েও যাইনি, পিছিয়েও পড়িনি। যেতে-যেতে আমরা আরেকটি কাফেলার দেখা পেলাম পথে। সে কাফেলার লোকেরা বলছিল তাদের একটি দলও কাফেলা থেকে পৃথক হয়ে পড়েছে। বালির মধ্যে জন্মে এমনি একটি ঝোঁপের আড়ালে সে দলের একজনকে আমরা পেলাম মৃতাবস্থায়। লোকটির কাপড় চোপড় পরাই রয়েছে, হাতে রয়েছে একটি চাবুক। এ জায়গা থেকে মাত্র এক মাইল দূরেই পানি পাওয়া যায়।

অতঃপর আমরা সারাহলা এসে পৌঁছলাম। এ জায়গার মাটীর নীচে পানি পাওয়া যায়। এখানে এসেই কাফেলা বিশ্রামের জন্য তিন দিন অবস্থান করে। সে সময় তারা তাদের মোশকগুলি মেরামত করে পানি ভতি করে নেয় এবং মরুভূমির হাওয়ার কবল থেকে রেহাই পাবার জন্য সারা গায়ে চট জড়িয়ে সেলাই করে নেয়। এখান থেকেই তাশিফ(Takshif) পাঠানো হয়। মাসুফা উপজাতীয় এমন লোককে তাশিক বলা হয়, কাফেলার দ্বারা নিযুক্ত যে লোক আগেই সংবাদ নিয়ে ইবালাতান পৌঁছে। কাফেলার যাত্রীরা তাশিফের সাহায্যে ইবালাতানে বন্ধু-বান্ধুবের কাছে চিঠিপত্র পাঠায় যার ফলে সে সব বন্ধুবান্ধব আগন্তকদের জন্য আগেই আহার-বাসস্থানের ব্যবস্থা করে রাখতে পারে। বন্ধুবান্ধুবেরা তখন চার রাত্রির পথ এগিয়ে আসে কাফেলার যাত্রীদের জন্য পানি বহন করে। ইবালতানে বন্ধুবান্ধব বলতে যার কেউ নেই সে সাহায্য চেয়ে পত্র লিখে সেখানকার কোনো নামকরা সওদাগরকে। তিনিই তখন তার সেবাযত্বের ভার গ্রহণ করেন। অনেক সময় এমন ঘটনাও ঘটে যে তাশিফ মরুভূমির পথেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। তার ফলে, ইবালানের কেউই আর কাফেলার আগমন সংবাদ পায় না। তখন কাফেলার অনেকেই অথবা সবাই মৃত্যু বরণ করতে বাধ্য হয়। এই মরুভূমিতে ভূতের প্রভাব আছে। তাকশিফকে একা পেলে তারা খেলাচ্ছলে তাশিফের মানসিক বিকৃতি ঘটায়। তার ফলে পথ হারিয়ে সে মৃত্যু বরণ করে। কারণ, মরু হাওয়ার দ্বারা ইতস্তত তাড়িত বালি ছাড়া সেখানে কোনো দিকে কোনো পথের চিহ্নই চোখে পড়ে না। এইমাত্র তুমি দেখতে পাবে এক জায়গায় বালির পাহাড় জমে আছে আরেটু পরেই সে পাহাড় জমবে আরেক জায়গায়। যারা সে পথে বহুবার যাওয়া আসা করেছে এবং যাদের উপস্থিত বুদ্ধি যথেষ্ট তারাই শুধু গাইডের কাজ করতে পারে। অতি বিস্ময়ের সঙ্গে আমি লক্ষ্য করছিলাম, আমাদের চালক বা গাইড ছিল এক চোক কানা, আরেক চোখে অসুক। কিন্তু তা হলেও সব পথই তার ভালভাবে জানা ছিল। আমরা এক শত সোনার মিকাল মজুরী দিয়ে তাশিফ নিয়োগ করেছিলাম। সে ছিল মাসুফার বাসিন্দা। তাসারাহ্লা থেকে যাত্রার সপ্তম দিন রাত্রে আমাদের যারা এগিয়ে নিতে এসেছে তাদের দ্বারা প্রজ্জ্বলিত আগুন আমাদের চোখে পড়ল, আমরা আনন্দে উফুল্ল হয়ে উঠলাম।

এভাবে সিজিলমাসা থেকে যাত্রা করে দু’মাসের একদিন বাকি থাকতে আমরা ইবাদাতা (ওয়ালাতা) এসে পৌঁছলাম।৬ ইবালাতান প্রদেশটি কাফ্রীদেশের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত। এখানে সুলতানের প্রতিনিধি ছিলেন ফারবা হোসেন নামে একটি ব্যক্তি। সেখানকার ভাষায় ‘ফারবা’ শব্দের অর্থই প্রতিনিধি বা ডেপুটি। সেখানে পৌঁছবার পরে আমাদের সঙ্গী সওদাগরেরা একটা ভোলা ময়দানে কৃষ্ণকায় লোকদের পাহারায় মালবিও রেখে ফারবার সঙ্গে দেখা করতে গেল। একটি খিলানের নীচে গালিচা বিছিয়ে তিনি বসেছিলেন। তার সামনে রয়েছে বর্শা ও তীরধারী রক্ষীর দল, পিছনে দণ্ডায়মান মাসুফাঁদের প্রধান ব্যক্তি। ফারবা যখন কথা বলছিলেন সওদাগররা তখন দণ্ডায়মান অবস্থায় ছিল। যদিও তারা খুব কাছেই ছিল তবু ফারবা তাদের প্রতি তাচ্ছিল্য দেখাবার জন্য কথা বলছিলেন একজন দোভাষীর মাধ্যমে। তাদের এ অভদ্রতা দেখে এবং শ্বেতকায়দের প্রতি ঘৃণার ভাব লক্ষ্য করে ঠিক তখনই আমার অনুতাপ হয়েছিল এদেশ সফরে এসেছি বলে।

ইব্‌নে বাদ্দা নামক সালার (সালি, রাবাট) একজন গণ্যমান্য লোকের সঙ্গে আমি দেখা করতে গেলাম। আমি তাকে পত্র দিয়েছিলাম আমার জন্য একটি বাড়ী ভাড়া করবার অনুরোধ জানিয়ে। তিনি সে অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। অতঃপর ইবাদাতানের মাসা জু নামক মুশরিফ’ বা পরিদর্শক (Inspector) আমাদের কাফেলার সবাইকে তার আতিথ্য গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ করলেন। সে আমন্ত্রণে যোগ দিতে প্রথমে আমি নারাজ ছিলাম কিন্তু সঙ্গীদের সানুনয় অনুরোধ এড়াতে না পেরে তাদের সঙ্গে যেতে হল। প্রকাণ্ড একটি পাত্রের আকারে কাটা একটি লাউয়ের খোলের অর্ধাংশে আমাদের খাবার পরিবেশন করা হল সামান্য মধু আর দুধ মিশ্রিত জোয়ার চুর্ণ(Pounded millet)। অতিথিরা তাই পান করে ফিরে এল। আমি তাদের বললাম,”এ জন্যই কৃষ্ণকায় ব্যক্তি বুঝি আমাদের দাওয়াত করেছিল?”

জবাবে তারা বললো “হাঁ, এবং তাদের মতে এই সবচেয়ে উচ্চ ধরণের অতিথি সঙ্কার।”

এ ব্যাপারের পরে আমার ধারণা হল, এর বেশী এসব লোকের কাছে আশা করেও কোনো লাভ নেই। আমি মন স্থির করে ফেললাম, ইবালাতান থেকে যে হজযাত্রীর কাফেলা রওয়ানা হচ্ছে তাদের সঙ্গী হয়ে মরক্কোয় ফিরে যাবো। পরে অবশ্য আমি ভাবলাম মালীতে এদের রাজার রাজধানী দেখে গেলেই ভাল হবে।

এমনি করে ইবালানে আমার প্রায় পঞ্চাশ দিন কেটে গেল। এখানকার বাসিন্দারা আমাকে সম্মান ও সমাদর দেখিয়েছে। ইবালাতান ভয়ানক গরম জায়গা। ঘোট ঘোট কয়েকটি খেজুর গাছ এখানকার গৌরবের বস্তু। খেজুর গাছের ছায়ায় এখানে তরমুজের চাষ করা হয়। এখানে মাটী খনন করে পানি পাওয়া যায়। ছাগল, ভেড়ার গোশত ইবালাতনে প্রচুর পাওয়া যায়। এখানকার অধিবাসীদের অধিকাংশই মাসুফা” উপজাতীয় সম্প্রদায়ভুক্ত। মিশরের দামী কাপড় দিয়ে তারা নিজেদের পোষাক পরিচ্ছদ তৈরী করে। এদের নারীরা অতুলনীয় সৌন্দর্যের অধিকারী এবং পুরুষের চেয়ে নারীই সম্মান পায় বেশী।

এদের চালচলন ও বিধি-ব্যবস্থা বাস্তবিকই কিছুটা অসাধারণ। এখানকার পুরুষদের মনে কোনো ব্যাপারেই কোনো ঈর্ষা-দ্বেষ দেখা যায় না। এদের কেউ-ই পৈত্রিক উত্তরাধিকার দাবী করে না, পক্ষান্তরে মাতুলের উত্তরাধিকার দাবী করে। এদেশের লোকের উত্তরাধিকারী তার ভাগ্নেরা, নিজের ছেলেরা নয়। এ রকম প্রথা হিন্দুস্তানের মালাবার ছাড়া দুনিয়ার আর কোথাও আমি দেখিনি। কিন্তু সেখানকার লোকেরা বিধর্মী আর এরা মুসলমান, নির্ধারিত সময় নামাজ পড়ে, হাদিস চর্চা করে ও কোরান মুখস্থ করে। কিন্তু তা সত্বেও স্ত্রীলোকেরা এখানে পুরুষদের সামনে যেতে লজ্জা। সঙ্কোচ করে না বা ঘোমটা দেয় না, যদিও নামাজ আদায় করতে কখনও কসুর করে না। কেউ যদি ইচ্ছা করে তবে তাদের বিয়ে করতে পারে কিন্তু স্বামীর সঙ্গে তারা। বিদেশে চলে যেতে রাজী হয় না। কেউ রাজী হলেও তার পরিবারের অন্যান্য সবাই তাকে ছেড়ে দিতে রাজী নয়।

সেখানকার মেয়েদের নিজ পরিবারের বাইরেও পুরুষ বন্ধু বা সঙ্গী থাকতে কোন বাধা নেই। পুরুষদের বেলায়ও ঠিক তেমনি, নিজ পরিবারের বাইরে বান্ধবী’ বা সখী থাকা দোষণীয় নয়। একজন পুরুষ হয়তো নিজের গৃহে ফিরে দেখতে পেল তার স্ত্রী নিজের কোন বন্ধুর বা সঙ্গীর মনোরঞ্জন করছে তখন সে তাতে কোনই আপত্তিই উত্থাপন করে না। একদিন আমি ইবালতানে কাজীর বাড়ি গিয়ে তার অনুমতি ক্রমে গৃহে প্রবেশ করে দেখলাম, সেখানে রয়েছে একজন অসামান্য সুন্দরী তরুণী। আমি তাকে দেখেই অপ্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম কিন্তু তাতে তরুণী লজ্জিত না হয়ে বরং আমাকে ড্রিপ করে হেসে উঠল এবং কাজী আমাকে বললেন, আপনি বেরিয়ে যাচ্ছেন কেন? এতো আমার সঙ্গিনী। একজন ধর্মতত্ত্বজ্ঞ অধিকন্তু তীর্থযাত্রীর এ আচরণ দেখে আমি স্তম্ভিত হলাম। শুনেছি কাজী নাকি তার বান্ধবী সহ সেবার হজযাত্রায় যাবার জন্য সুলতানের অনুমতি চেয়েছিলেন। সেই বান্ধবী এ তরুণীই কিনা আমি জানি না কিন্তু সুলতান তার আবেদন মঞ্জুর করেননি।

ইবালাতান থেকে মালী যেতে দ্রুত চলেও চব্বিশ দিন লাগে। মালী যেতে মনস্থ করে মাসুফা থেকে একজন পরিচালক নিযুক্ত করে তিনজন সঙ্গীসহ যাত্রা করলাম। এ পথটি নিরাপদ বলে কাফেলা বা দল বেঁধে চলবার দরকার নেই। পথে অনেকগুলো বিশাল পরিধি বিশিষ্ট পুরাতন গাছ দেখতে পেলাম। সে সব গাছের এক একটির ছায়ায়। পূর্ণ একটি কাফেলা আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে। এমন গাছও রয়েছে যার কোন শাখা বা পত্র নেই তবু তার কাণ্ডের ছায়াই একজন লোকের আশ্রয়ের জন্য যথেষ্ট। এসব গাছের কতকগুলোর ভেতরে অংশ পচে যাওয়ায় সেখানে বৃষ্টির পানি জমা হয়ে থাকে। তার ফলে কুপের কাজ চলে যায় এবং লোকে সে পানি পানও করে। কতকগুলো গাছে মৌমাছি ও মধু রয়েছে। লোকে তা সংগ্রহ করে নেয়। আমি বিস্মিত হলাম একজন তাতাঁকে এমনি একটি গাছের ফোকরে নিজের তাঁত বসিয়ে তাত চালাচ্ছে দেখে।

এ অঞ্চলে পথ চলতে গিয়ে পথিকদের কোন রকম খাদ্য ও সোনারূপা বা টাকা কড়ি সঙ্গে রাখবার দরকার হয় না। তারা সঙ্গে রাখে লবণ, কাঁচের তৈরী গহনা যাকে সাধারণতঃ পুতি বলা হয় এবং কিছু সুগন্ধি দ্রব্য। এসব নিয়ে কোনো গ্রামে হাজির হলেই কৃষ্ণকায়া নারীরা আসে তাদের জোয়ার, দুধ, মুরগী, মণ্ডে পরিণত পদ্ম ফল, চাউল, ফুনী ৮ (শর্ষের মত দেখতে এক প্রকার শস্য যা দিয়ে লাবসী তৈরী হয়) এবং ছাতু নিয়ে। মোসাফেররা যা খুশী তখন কিনতে পারে। কিন্তু তাদের চাউল খেয়ে বিদেশীদের অসুখ হয়। চাউলের চেয়ে ফুনী বরং ভাল। ইবালাতান ত্যাগ করার দশ দিন পর জাগারি ১ নামক একটি বড় গ্রামে আমরা হাজির হলাম। সেখানে ওযাজারাতা১০ নামে পরিচিত কাফ্রী ব্যবসায়ীরা এবং তাদের সঙ্গে খারিজী১১ সম্প্রদায়ের এক শ্রেণীর লোকেরা বাস করে। এ গ্রাম থেকেই ইবালাতানে জোয়ার আমদানী করা হয়। জাগারি থেকে আমরা বিখ্যাত নদী নীলনদের তীরে এসে পৌঁছলাম। নীলনদের তীরেই কারসাখু১২ শহর। কারসাখু থেকে নীলনদ বয়ে গেছে কাবারা এবং সেখান থেকে জাঘা১৩। কাবারাও জাঘার সুলতানরা মালীর সুলতানের বশ্যতা স্বীকার করতেন। জাঘার অধিবাসীরা বহুকাল হতেই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। বিদ্যাচর্চার প্রতি তাদের যথেষ্ট আগ্রহ ও অনুরাগ দেখা যায়। এখান থেকে নীলনদ। নিম্নদিকে তাবুতু ও গগ (Gogo) ছাড়িয়ে গেছে। এ দুটি জায়গার বর্ণনা পরে দেওয়া হবে। গগা থেকে নীলনদ এসেছে মুলি ১৪ শহরে। মুলি লিমিসদের ১৫ দেশ এবং মালী রাজ্যের সীমান্ত প্রদেশ। সেখান থেকে নীলনদ বয়ে গেছে কাফ্রীদের অন্যতম বৃহৎ শহর যুফী (Yufi)। কাফ্ৰী শাসনকর্তাদের মধ্যে যুকীর শাসনকর্তা একজন খ্যাতনামা১৬ ব্যক্তি। কোনো শ্বেত লোক সে দেশে প্রবেশ করতে পারে না। কারণ সেখানে যাবার আগেই অধিবাসীরা তাকে হত্যা করবে। যুফী থেকে নীলনদ নেমে গেছে নুবাদের (Nubians) দেশে। মুবারা খৃষ্টধর্মাবলম্বী। নুবার পরে দানকুলা (Dongola) তাদের প্রধান শহর ১৭। দানকুলার সুলতানের নাম ইব্‌নে কাজউদ্দিন। মিশরের সুলতান আল-মালিক আন্-নাসিরের ১৮ সময় তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। অতঃপর নীলনদ এসেছে জানাদিল (the cataracts)। এখানেই কাফ্রী মুলুক শেষ হয়ে মিশরের আসওয়ান প্রদেশ আরম্ভ।

নীলনদের এদিকটায় একদিন পাড়ের অতি নিকটে আমি একটি কুমীর দেখতে পেয়েছিলাম। কুমীরটা ঠিক একটা নৌকার মত দেখাচ্ছিল। একদিন আমার ব্যক্তিগত প্রয়োজন মিটাতে নদীর পাড়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখলাম একজন কৃষ্ণকায় নদী ও আমার মধ্যবর্তী স্থানে দাঁড়িয়ে আছে। তার মধ্যে আদব ও শ্লীলতার এ অভাব দেখে আমি বিস্মিত হলাম এবং একজনের কাছে তা প্রকাশ করলাম। সে বলল, আপনার এবং কুমীরের মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে কুমীরের হাত থেকে আপনাকে রক্ষা করাই ছিল তার উদ্দেশ্য।

অতঃপর আমরা কারসাধু থেকে রওয়ানা হয়ে মালীর দশ মাইল দূরে সানসারা নদীর তীরে এলাম। অনুমতি ছাড়া সেখানে কারও শহরে যাবার নিয়ম নেই। আমি আগেই সেখানকার শ্বেতকায়দের অনুরোধ করে চিঠি লিখেছিলাম আমার জন্য একখানা ঘর ভাড়া করে রাখতে। কাজেই এ নদীর পারে এসে বিনা বাধায়ই আমি খেয়া পার হয়ে গেলাম। এভাবে কাফ্রীদের ১৯ রাজধানী মালীতে এসে পৌঁছলাম।

শ্বেতকায়দের মহল্লায় গিয়ে মোহাম্মদ ইব্‌নে-আল-ফকির কথা জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম আমার জন্য একখানা ঘর ভাড়া করা হয়েছে। আমি সেখানে গিয়ে উঠলাম। তার জামাতা এসে আমাকে মোমবাতি ও খাবার দিয়ে গেল। পরের দিন আরও কয়েকজন গণ্যমান্য লোক সঙ্গে নিয়ে ইব্‌নে-আল-ফকি নিজে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। মালীর কাজী আবদুর রহমান এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গেও আমার দেখা হল। তিনি সচ্চরিত্র একজন কাফ্রী হাজী। সেখানকার দোভাষী দূঘার সঙ্গেও আমার আলাপ হল। কাফ্রীদের মধ্যে তিনি একজন খ্যাতনামা ব্যক্তি। এঁরা সবাই আমাকে অতিথি হিসাবে খাদ্য পরিবেশন করেন এবং অনুগ্রহ প্রদর্শন করেন। খোদা যেন তাদের মঙ্গল করেন। এখানে আগমনের দশদিন পরে আলু জাতীয় বস্তু দিয়ে তৈরী এক ধরনের লাবসী খেলাম। এ লাবসী এদের সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য। আমাদের দলের ছয়জনের সবাই অসুস্থ হয়ে পড়লাম এবং একজন এন্তেকাল করল। আমিও ফজরের নামাজ পড়তে গিয়েই সেখানেই অজ্ঞান হয়ে গেলাম। এ রোগের প্রতিষেধক কিছু আছে কিনা একজন মিশরীয়কে তা জিজ্ঞেস করায় সে আমাকে গাছ গাছড়ার শিকড় দিয়ে তৈরী ‘বেদার নামক এক রকম জিনিষ এনে দিল। তার সঙ্গে মৌরী ও চিনি পানিতে মিশিয়ে খেতেই আমার বমি হয়েই গেল। তার ফলে যা খেয়েছিলাম তার সবই বেরিয়ে গেল এবং সেই সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে পিত্তরসও বেরিয়ে গেল। খোদা আমাকে মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করলেন কিন্তু দু’মাস আমাকে অসুস্থ থাকতে হল।

মালীর সুলতানের নাম মানসা সুলায়মান। সুলায়মান ২১ তার আসল নাম এবং মাসা অর্থ সুলতান। তিনি একজন কৃপণ প্রকৃতির রাজা। তার কাছে কেউ কোনো মুল্যবান পারিতোষিক পাবার আশাও করতে পারে না। আমি অসুস্থ থাকায় এ দু’মাস তার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। অবশেষে তিনি আমাদের খলিফা মরোক্কোর ভূতপূর্ব। সুলতান আবুল হাসানের স্মৃতি উদ্যাপনোপলক্ষে এক ভোজসভার আয়োজন করলেন। সেনাপতি, চিকিৎসক কাজী, ইমাম প্রভৃতি সবাই তাতে নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তাদের সঙ্গে আমিও ভোজসভায় যোগদান করলাম। সেখানে কোরাণ শরীফ পাঠের পর খলিফা আবুল হাসান ও মান্সা সুলায়মানের জন্য মোনাজাত করা হল। অনুষ্ঠান শেষ হতেই আমি মান্সা সুলায়মানের কাছে এগিয়ে গিয়ে তাঁকে সালাম করলাম। কাজী, ইমাম ও ইব্‌নে-আল-ফকি তাকে আমার পরিচয় দিতে তিনি তাদের ভাষায় উত্তর দিলেন। তাঁরা আমাকে বললেন, “সুলতান খোদাকে ধন্যবাদ দিতে বলছেন।”

আমি বললাম, “সকল অবস্থার ভেতরেই তার প্রশংসা করি এবং তাকে ধন্যবাদ জানাই ২২।

আমি সেখান থেকে ফিরে আসার পর সুলতান আমাকে মেহমান হিসাবে খাদ্য পাঠালেন। প্রথমে তা পাঠানো হয়েছিলো কাজীর গৃহে। কাজী নিজের লোক দিয়ে সে। সব পাঠালেন ইব্‌নে-আল-ফকির গৃহে। ইব্‌নে-আল্-ফকি নগ্নপদেই তাড়াতাড়ি আমার গৃহে প্রবেশ করে বললেন”উঠে দাঁড়ান, এই যে আপনার জন্য সুলতানের দেওয়া, পারিতোষিক এসেছে।”

আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং পারিতোষিক বলাতে ভাবলাম, নিশ্চয়ই সুলতান আমাকে সম্মানসূচক পরিচ্ছদ ও অর্থ পাঠিয়েছেন। কিন্তু দেখলাম তিনি পাঠিয়েছেন তিন খান। রুটি, পিঠা, ও তেলে ভাজা এক টুকরো গরুর গোশত এবং এক পাত্র টক দৈ। এ সামান্য বস্তু উপলক্ষে করে এতটা ঘটা তারা করতে পারে দেখে আমি সশব্দে হেসে উঠলাম।

এ ঘটনার পর দু’মাস আমি আর কিছুই পেলাম না। তারপর শুরু হল রমজান মাস। ইত্যবসরে আমি প্রায়ই সুলতানের প্রাসাদে যেতে আরম্ভ করেছি। সেখানে গিয়ে সুলতানকে সালাম দিয়ে কাজী ও ইমামের পাশে বসে থাকতাম। তখন দোভাষী দুঘর আমাকে একদিন বললেন,”সুলতানের সঙ্গে নিজে কথা বলুন। আমি পরে আপনার তরফ থেকে তাকে আপনার প্রয়োজনের কথা বুঝিয়ে বলব।”

রমজানের প্রথম দিকে সুলতান যখন এক দরবারের আয়োজন করলেন, আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম,”আমি দুনিয়ার অনেক দেশ সফর করেছি এবং সেখানকার সুলতানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। অজি চার মাস হতে চলেছে আমি এখানে এসেছি কিন্তু আজ অবধি হুজুর আমাকে কোনো পারিতোষিক বা অন্য কিছুই দেননি। আপনার সম্বন্ধে আমি অপর সুলতানদের কাছে কি বলব?”

সুলতান বললেন, “আমি আপনাকে দেখিনি বা কেউ আপনার কথা আমাকে জানায়ওনি।”

তখন কাজীও ইব্‌নে-আল-ফাঁকি দাঁড়িয়ে বললেন, “ইনি হুজুরকে আগেই একদিন সালাম জানিয়েছেন এবং হুজুর তাকে খাবার পাঠিয়েছেন।”

এ কথার পর তিনি আমার বাসের জন্য একখানা ঘর এবং দৈনিক ব্যয়নির্বাহের জন্য কিছু অর্থ বরাদ্দ করে দিলেন। পরে ২৭ শে রমজানের রাত্রে তিনি কাজী, ইমাম ও শাস্ত্ৰজ্ঞেদের মধ্যে কিছু অর্থ বিতরণ করলেন ২৩। একে তারা জাকাত(ভিক্ষা) বলে। তাঁদের কিছু অংশ ৩৩.৩৩ মিস্কাল আমাকেও দেওয়া হল। এবং মালী ত্যাগের সময় তিনি আমাকে এক শ’ স্বর্ণমিসকাল উপঢৌকন দিয়েছিলেন।

কোনো কোনো সময় সুলতানের নিজের প্রাসাদের চত্বরে দরবারের আয়োজন হয়। সেখানে একটি গাছের নীচে তিন ধাপওয়ালা একটি বেদী আছে। এরা বেদীকে বলে পেম্‌পি ২৪। বেদীটি রেশমী কাপড়ে মোড়া গদীযুক্ত। উপরে রয়েছে চাঁদোয়ার মত রেশমী ছাতা, তার উপরে সোনার তৈরী একটি পাখী। পাখীটির আকার একটি বাজপাখীর সমান। হাতে একটি ধনুক, পিটে ঝুলানো তুণ নিয়ে সুলতান বেরিয়ে আসেন প্রাসাদের এক কোণের একটি দরজা খুলে। তার মাথায় একটি টুপি সোনালী ফিতায় বাঁধা। ফিতার অগ্রভাগের আকার ছুরির মত এবং লম্বায় এক বিঘতের বেশী। ইউরোপের তৈরী এক প্রকার কাপড়ের নাম মুতানফাস। লালরঙের মখমলসদৃশ্য সেই কাপড়ে তৈরী আঙরখো সুলতানের সাধারণ পোষাক। সুলতানের আগে-আগে আসে। তার বাদকদল। তাদের হাতে সোনা ও রূপার দোতারা বাদ্যযন্ত্র বা গীটার। সুলতানের। পশ্চাতে থাকে তিন শ’ সশস্ত্র ক্রীতদাস। অতি আরাম আয়াসে ধীর পদক্ষেপে সুলতান। হেঁটে আসতে থাকেন, হাঁটতে-হাঁটতে সময়-সময় থেমেও যান। বেদী অবধি পৌঁছে তিনি চারদিক তাকিয়ে দেখেন, তারপর মসজিদের ইমাম যেমন করে মিম্বারে উঠে দাঁড়ান তেমনি করে তিনিও বেদীতে ওঠেন। সুলতান আসন গ্রহণ করতেই জয়ঢাক, নাকড়া ও শিঙা বেজে ওঠে। তিনজন ক্রীতদাস দৌড়ে যায় রাজার অমাত্য ও সেনানায়কদের ডেকে আনতে। তারা তখন এসে আসন গ্রহণ করেন। অতঃপর আনা হয় জিন্ ও লাগাম লাগানো দু’টি ঘোড়া এবং সে সঙ্গে দুটি ছাগল। তারা মনে করে এগুলো কোনো কিছুর কুদৃষ্টি থেকে তাদের রক্ষা করবে। তখন দোভাষী দুঘা এসে প্রবেশদ্বারে দাঁড়ায় এবং বাকি সবাই থাকে গাছের নীচে।

কাফ্রীরা সবাই তাদের রাজার খুব অনুগত। রাজার কাছে আচারে ব্যবহারে তারা নিজেদের তুচ্ছাতিতুচ্ছ মনে করে। ‘মানসা সুলায়মান কি’২৫ বলে তারা সুলতানের নামে শপথ গ্রহণ করে। দরবারে বসে তিনি কাউকে সমন দিলে সে ব্যক্তি গায়ের জামা ও পাগড়ী খুলে ছেঁড়া জামা পরিধান করে মাথায় একটি ময়লা গোল টুপি দিয়ে পাজামা ও অন্যান্য পোশাক হাঁটু অধিক তুলে দরবারে প্রবেশ করে। তারপর সে অগ্রসর হয় নিজকে অত্যন্ত হেয় অপরাধী মনে করে। এবং কনুইয়ের সাহায্যে মাটীতে শক্ত ঘা দিয়ে সুলতান যা বলেন তা শুনবার জন্য পিঠ বাঁকিয়ে মাথা নত করে দাঁড়ায়। যদি কেউ রাজাকে কিছু বলে তার জবাব পায় তাহলে পিঠের কাপড় উন্মোচন করে পিঠ ও মাথার উপর দিয়ে ধুলি নিক্ষেপ করতে থাকে ঠিক যেমন করে কোনো জ্ঞানার্থী তার গাত্রে পানি সিঞ্চন করে। তবু তারা কেননা যে অন্ধ হয় না তাই ভেবে আমি অবাক হয়ে যেতাম। দরবারের সময় সুলতান যদি কোনো মন্তব্য করেন তবে উপস্থিত শ্রোতারা মাথার পাগড়ী নামিয়ে রেখে নিঃশব্দে তা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করে। সময়-সময় তাদের। একজন সুলতানের সামনে উঠে দাঁড়ায় এবং সুলতানের জন্য সে কি করেছে তা প্রকাশ। করে। সে বলে, “অমুক দিন আমি এ কাজ করেছি অথবা আমি অমুক দিন অমুককে হত্যা করেছি। এ বিষয় যারা জ্ঞাত থাকে তারা তখন তার কথা সমর্থন করে তীর ছুঁড়বার মত করে তার নিজের ধনুকের ছিলো টানে। তখন সুলতান যদি বলেন যে সত্য কথাই বলেছে অথবা যদি তাকে তিনি ধন্যবাদ দেন তবে সে পিঠের কাপড় সরিয়ে পিঠে ও মাথায় ধূলা ছড়াতে থাকে। এই তাদের দ্র ব্যবহার।

ইব্‌নে জুজাই বলেন, “শুনেছি হাজী মুসা-আল-ওয়ানজারাতি(ম্যানডিংগো) যখন মাসা সুলায়মানের দূত হিসাবে খলিফা আবুল হাসানের দরবারে এসেছিলেন তখন তার একজন সঙ্গী এক টুকরি খুলিও সঙ্গে এনেছিল। আমাদের খলিফা যখনই কোনো ভাল কথা বলতেন তখনই দূত তাঁর নিজের দেশের রীতি অনুযায়ী সেই ধূলা গায়ে নিক্ষেপ করতেন।”

আমি মালীতে থাকাকালে দুবার কোরবানী ও একবার ঈদুল ফেতর দেখেছি। এ সব উৎসবের দিনে জহরের নামাজের পর সুলতান গিয়ে পেমপিতে আসন গ্রহণ করেন। তখন যুদ্ধের সাজসজ্জা বহনকারীরা সুদৃশ্য অস্ত্রপাতি যথা, সোনা ও রূপার তৈরী তুণ, সোনার কারুকার্য খচিত তরবারী, তরবারীর সোনালী খাপ, রূপার বর্শা, স্ফটিকের রাজদণ্ড প্রভৃতি সেখানে এনে হাজির করে। ঘোড়ার জি-রিকাবের মত এক রকম রৌপ্য অলঙ্কার হাতে দিয়ে চারজন আমীর সুলতানের পেছনে দাঁড়িয়ে মাছি তাড়ান। সেনাপতি, কাজী ও ইমাম এসে তাদের নির্দিষ্ট আসনে বসেন। দোভাষী দুঘা আসেন তাঁর চার বিবি ও বাদীদের নিয়ে। বাঁদী-বালিকাদের সংখ্যা প্রায় শতেক। তাদের পরিচ্ছদ অতি মনোরম। মাথায় স্বর্ণ ও রৌপ্য খচিত ফিতা। ফিতায় ঝুলানো সোনা ও রূপার বল। দুঘার আসন হিসাবে সেখানে একখানা চেয়ার রাখা হয়। নলদ্বারা তৈরী এবং নিম্নদিকে লাউয়ের খেলায় লাগানো একটি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে দোভাষী সুলতানের সাহসিকতাও বীরত্বসূচক একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। মেয়েরা তার সঙ্গে গান করে এবং ধনুক নিয়ে খেলা করে। তাদের সঙ্গে থাকে মাথার শাফা টুপি ও লাল রংএর উলেন খেলকা পরিহিত প্রায় ত্রিশ জন যুবক। কাঁধ থেকে ঝুলানো জয়ঢাক বাজায় সে সব যুবকেরা। তারপরে আসে তাঁর শিষ্য বালক দল। তারা খেলা করে এবং সিন্ধুর অধিবাসীদের মত শূন্যে চাকা ঘুরায়। এ খেলায় তাদের তৎপরতা ও উৎসাহ প্রশংসনীয়। তাদের তরবারী খেলাও চাতুর্যপূর্ণ। দুঘা নিজেও ভাল তরবারী খেলতে পারেন। অতঃপর সুলতান দোভাষীকে পুরস্কার দিতে হুকুম করেন। দু’শ মিশকাল মূল্যের স্বর্ণরেণু পূর্ণ একটি তোেড়া তাঁকে পুরস্কার দেওয়া হয়। এবং তা উপস্থিত সকলের সম্মুখে ঘোষণা করা হয়। তখন সেনা-নায়করা উঠে তাদের ধনুকে টঙ্কার দিয়ে সুলতানকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে। পরের দিন তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ পদমর্যাদানুযায়ী এক একটি উপহার দেন দোভাষীকে। প্রতি শুক্রবার আসরের নামাজের। পরে দুঘা উপরোল্লিত অনুষ্ঠানের পুনরাবৃত্তি করেন।

ভোজের দিনে দুঘার অনুষ্ঠানের পরে আসেন কবিরা। গ্রাস নামক গায়কপাখীর অনুকরণে পালকের দ্বারা তৈরী বেশবাসে সজ্জিত হয়ে তারা প্রবেশ করেন। দেখতে। যাতে ব্রাস পাখীর মাথার মতই দেখায় সেজন্যে লাল চক্ষু বিশিষ্ট একটি কাঠের মাথা কবিদের মাথায় বসানো হয়। তারা এই হাস্যকর পোশাকে সজ্জিত হয়ে সুলতানের। সামনে দাঁড়িয়ে নিজ-নিজ কবিতা আবৃত্তি করেন। শুনেছি তাদের সে কবিতা বহুলাংশে খোতবার মত। কবিতায় তারা বলেন, “যে পেপি আজ আপনি দখল করে আছেন সেখানে অমুক-অমুক রাজা এক সময়ে আসন গ্রহণ করেছেন এবং অমুক-অমুক সকাজ করে গেছেন। আপনিও সেরূপ সৎকাজ করুণ যাতে মৃত্যুর পরেও আপনার সুনাম বজায় থাকে।” কবিতা আবৃত্তির পর প্রধান কবি পেপির সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে প্রথমে ডান কাঁধে ও পরে বাঁ-কাঁধে নিজের মাথা রাখেন। এ সময়ে কবি নিজের ভাষায় সারাক্ষণই কথা বলতে থাকেন। পরে আবার পেমৃপি থেকে নেমে আসেন। তাদের এ রীতি ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনেরও পূর্ব থেকে চলে আসছে এবং আজও অবধি তা বজায় আছে।২৬

মানসা সুলায়মানকে তার লোভের জন্য কাফ্রীরা সবাই না-পছন্দ করত। তার। পূর্ববর্তী সুলতান ছিলেন মান্সা মাঘা এবং তারও পূর্বে রাজত্ব করে গেছেন মানসা মূসা। তিনি ছিলেন দয়ালু ও ন্যায়পরায়ন শাসক। শ্বেতকায় লোকদের তিনি ভালবাসতেন। এবং পারিতোষিক দিতেন২৭। ইনিই আবু ইসহাক আস-সাহিলিকে একদিনে চার হাজার মিকাল দান করেছিলেন। আমি বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পেরেছি, তিনি একদিন মাদরিক ইব্‌নে ফাঁককুসকে হাজার মিকাল দান করেছিলেন। মাদরিক ইব্‌নে। ফাকুসের পিতামহই মা মূসার পিতামহকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা দেন।

কাফ্রীরা কতকগুলি প্রশংসনীয় গুণের অধিকারী। কদাচিৎ তাদের অবিচারী হতে দেখা যায়। অবিচারের প্রতি তাদের যেমন ঘৃণা এমন ঘৃণা অন্য কোনো জাতির মধ্যে কমই দেখা যায়। তাদের কেউ সামান্য অবিচারের দোষে দোষী হলেও সুলতান তাকে কখনো ক্ষমা করেন না। তাদের দেশে মানুষের জন্য পূর্ণ নিরাপত্তা বিরাজমান। বিদেশী সফরকারী বা দেশের অধিবাসী–কারও পক্ষেই দস্যুতঙ্কর বা অত্যাচারীর ভয়ে ভীত হওয়ার কারণ নেই। কোনো শ্বেতকায় তাদের দেশে মারা গেলে তার পরিত্যক্ত অপরিমেয় হলেও তারা তা বাজেয়াপ্ত করে না। বরং মৃতব্যক্তির প্রকৃত ওয়ারিশ না পাওয়া পর্যন্ত সে সম্পত্তি তারা বিশ্বাসী কোনো শ্বেতকায় ব্যক্তির হেফাজতে গচ্ছিত। রাখে। যথাসময়ে নামাজ আদায় করা সম্বন্ধে তারা বিশেষ সতর্ক। বিশেষ করে তারা। জামাতে নামাজ আদায় করতে সচেষ্ট থাকে এবং ছেলেমেয়েদের সেরূপ শিক্ষাই দিয়ে থাকে। শুক্রবার মসজিদে যেতে বিলম্ব করলে সে মসজিদের কোথাও ভিড়ের জন্য। দাঁড়াবার জায়গা পায় না। এজন্য সেখানকার রীতি হলো, জায়নামাজসহ আগেই ছেলে বা বালকভৃত্যকে মসজিদে পাঠিয়ে দেওয়া। সে গিয়ে ভাল একটি জায়গায় জায়নামাজ বিছিয়ে রাখে এবং মনিব না-আসা অবধি সেখানে অপেক্ষা করে। খেজুর গাছের মত এক রকম গাছের পাতা দিয়ে তারা নামাজের মাদুর তৈরী করে নেয়। সে গাছ খেজুর গাছের মত হলেও তাতে কোনো ফল হয় না।

তাদের আরও একটি প্রশংসনীয় কাজ হলো, শুক্রবার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সাদা পোশাক পরিধান করা। যদি কোনো ব্যক্তি ছেঁড়া একটি কামিজ ছাড়া আর কিছুই না। থাকে তবুও সেটি সযত্নে ধৌত করে সে শুক্রবার জুমার নামাজে যোগদান করবে। এ ছাড়া কোরাণ শরীফ কণ্ঠস্থ করার প্রতিও তাদের যথেষ্ট আগ্রহ। এ-কাজে ছেলেমেয়েদের মধ্যে কোনো শৈথিল্য দেখলে তারা তাদের বেঁধে রাখে এবং কোরাণের পড়া কণ্ঠৰ না করা পর্যন্ত মুক্তি দেয় না। এক পর্বের দিনে আমি কাজির সঙ্গে দেখা করতে তাঁর বাড়ীতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম তিনি তার ছেলেমেয়েদের বেঁধে রেখেছেন। কাজী সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, “এদের কি আজ ছেড়ে দেবেন না?”

তিনি বললেন, “কোরাণের পড়া মুখস্থ না-করা অবধি ওদের ছাড়া হবে না।”

তাদের ভেতর কতকগুলি কুরীতিও প্রচলিত আছে। চাকরাণী বাদী বা যুবতী মেয়েরা কোনো রকম বস্ত্র পরিধান বা করেই অবাধে উলঙ্গ অবস্থায় সকলের সামনে আনাগোনা করে। মেয়েরা সুলতানের সামনে যেতেও কোনো রকম আচ্ছাদন ব্যবহারের প্রয়োজন বোধ করে না। এমন কি সুলতানের কন্যারাও উলঙ্গ থাকে। তারপর রয়েছে মাথায় ও গায়ে ধূলা ছড়িয়ে সম্মান প্রদর্শনের রীতি এবং উপরে বর্ণিত কবির জন্সার হাস্যকর অনুষ্টান। তাদের ভেতর অনেকেরই আরেকটি দুষণীয় অভ্যাস হলো গলিত মাংস এবং কুকুর ও গাধার মাংস ভক্ষণ।

আমি মালীতে পৌঁছে ৭৫৩ হিজরীর ১৪ই জমাদিয়ল আউয়াল মাসে (২৮শে জুন, ১৩৫২ খৃষ্টাব্দ) এবং মালী ত্যাগ করি পরের বছরের ২২শে মহরম (২৭শে ফেব্রুয়ারী, ১৩৫৩)। আমার সঙ্গী ছিলেন আবুবকর ইব্‌নে ইয়াকুব। আমরা মিমার পথে চলতে লাগলাম। আমার একটি উট ছিল। আমি সেই উটে সওয়ার হয়ে যাচ্ছিলাম। কারণ ঘোড়ার মূল্য এখানে খুব বেশী। প্রতিটির মূল্য প্রায় একশ মিশকাল! আমরা প্রশস্ত একটি খালের ধারে এসে পৌঁছলাম। নীলনদ থেকে এ খালটি বয়ে এসেছে। নৌকা ছাড়া এ খাল পার হওয়া যায় না। এখানে মশার উৎপাত খুব বেশী। রাত্রে ছাড়া কেউ পথ চলতে পারে না। এখানে পৌঁছার পর বিশালকায় ষোলটি জন্তু নজরে পড়ল সে গুলিকে হাতী মনে করে আমি বিস্মিত হলাম। কারণ সে দেশে হাতী যথেষ্ট দেখা যায়। পরে দেখতে পেলাম, জগুলি সব খালে গিয়ে নামল। তখন আমার সঙ্গী আবুবকরকে জিজ্ঞেস করলাম, “এগুলি আবার কি রকম জীব?”

তিনি বললেন,”এগুলি হিপোপোটেমাস, ডাঙ্গায় চড়ে বেড়াতে এসেছে।” হিপোপোটেমাস আকারে ঘোড়ার চেয়ে বড় কিন্তু তাদের কেশরও আছে লেজও আছে। এমন কি তাদের মাথাও ঘোড়ার মাথার মতই, শুধু পা হাতীর পায়ের মত। হিপোপোটেমাস আরেকবার দেখেছিলাম নীলনদ দিয়ে তাবাতু থেকে গাওগাও যাবার পথে। নদীতে সাঁতার কাটতে-কাটতে সেগুলি এক একবার মাথা তুলে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ছিল। নৌকার সোকেরা নদীর কিনার ঘেসে চলছিল, তাদের ভয় পাছে বা হিপোপোটেমাস তাদের নৌকাই ডুবিয়ে দেয়।

তাদের আরও একটি প্রশংসনীয় কাজ হলো, শুক্রবার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সাদা। পোশাক পরিধান করা। যদি কোনো ব্যক্তির ছেঁড়া একটি কামিজ ছাড়া আর কিছুই না থাকে তবুও সেটি সযতে ধৌত করে সে শুক্রবার জুমার নামাজে যযাগদান করবে। এ ছাড়া কোরাণ শরীফ কণ্ঠস্থ করার প্রতিও তাদের যথেষ্ট আগ্রহ। এ-কাজে ছেলেমেয়েদের মধ্যে কোনো শৈথিল্য দেখলে তারা তাদের বেঁধে রাখে এবং কোরাণের পড়া কণ্ঠস্ব না করা পর্যন্ত মুক্তি দেয় না। এক পর্বের দিনে আমি কাজির সঙ্গে দেখা করতে তাঁর বাড়ীতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম তিনি তার ছেলেমেয়েদের বেঁধে রেখেছেন। কাজী সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, “এদের কি আজ ছেড়ে দেবেন না?”

তিনি বললেন, “কোরাণের পড়া মুখস্থ না-করা অবধি ওদের ছাড়া হবে না।”

তাদের ভেতর কতকগুলি কুরীতিও প্রচলিত আছে। চাকরাণী বাদী বা যুবতী মেয়েরা কোনো রকম বস্ত্র পরিধান বা করেই অবাধে উলঙ্গ অবস্থায় সকলের সামনে আনাগোনা করে। মেয়েরা সুলতানের সামনে যেতেও কোনো রকম আচ্ছাদন ব্যবহারের প্রয়োজন বোধ করে না। এমন কি সুলতানের কন্যারাও উলঙ্গ থাকে। তারপর রয়েছে মাথায় ও গায়ে ধূলা ছড়িয়ে সম্মান প্রদর্শনের রীতি এবং উপরে বর্ণিত কবির জলসার হাস্যকর অনুষ্ঠান। তাদের ভেতর অনেকেরই আরেকটি দুষণীয় অভ্যাস হলো গলিত মাংস এবং কুকুর ও গাধার মাংস ভক্ষণ।

আমি মালীতে পৌঁছে ৭৫৩ হিজরীর ১৪ই জমাদিয়ল আউয়াল মাসে (২৮শে জুন, ১৩৫২ খৃষ্টাব্দ) এবং মালী ত্যাগ করি পরের বছরের ২২শে মহম (২৭শে ফেব্রুয়ারী, ১৩৫৩)। আমার সঙ্গী ছিলেন আবুবকর ইব্‌নে ইয়াকুব। আমরা মিমার পথে চলতে লাগলাম। আমার একটি উট ছিল। আমি সেই উটে সওয়ার হয়ে যাচ্ছিলাম। কারণ। ঘোড়ার মূল্য এখানে খুব বেশী। প্রতিটির মূল্য প্রায় একশ মিশকাল! আমরা প্রশস্ত একটি খালের ধারে এসে পৌঁছলাম। নীলনদ থেকে এ খালটি বয়ে এসেছে। নৌকা ছাড়া এ খাল পার হওয়া যায় না। এখানে মশার উৎপাত খুব বেশী। রাত্রে ছাড়া কেউ। পথ চলতে পারে না। এখানে পৌঁছার পর বিশালকায় ষোলটি জন্তু নজরে পড়ল সে গুলিকে হাতী মনে করে আমি বিস্মিত হলাম। কারণ সে দেশে হাতী যথেষ্ট দেখা যায়। পরে দেখতে পেলাম, জন্তগুলি সব খালে গিয়ে নামল। তখন আমার সঙ্গী আবুবকরকে জিজ্ঞেস করলাম, “এগুলি আবার কি রকম জীব?”

তিনি বললেন,”এগুলি হিপোপোটেমাস, ডাঙ্গায় চড়ে বেড়াতে এসেছে।” হিপোপোটেমাস আকারে ঘোড়ার চেয়ে বড় কিন্তু তাদের কেশরও আছে লেজও আছে। এমন কি তাদের মাথাও ঘোড়ার মাথার মতই, শুধু পা হাতীর পায়ের মত। হিপোপোটেমাস আরেকবার দেখেছিলাম নীলনদ দিয়ে তামাকতু থেকে গাওগাও যাবার পথে। নদীতে সাঁতার কাটতে-কাটতে সেগুলি এক একবার মাথা তুলে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ছিল। নৌকার লোকেরা নদীর কিনার ঘেসে চলছিল, তাদের ভয় পাছে বা হিপোপোটেমাস তাদের নৌকাই ডুবিয়ে দেয়।

এদেশের লোকের হিপোপোটেমাস শিকারের কৌশলটি চমৎকার। এ কাজে শক্ত দড়ি লাগানো বর্শা তারা ব্যবহার করে। বর্শা নিক্ষেপ করলে তা যদি জন্তুটার পায়ে বা ঘাড়ে লাগে তবে এপিট-ওপিঠ হয়ে যায়। তারপর তারা সেই জন্তুটাকে দড়ির সাহায্যে টেনে ডাঙ্গায় তোলে। তারা তখন সেটাকে মেরে তার মাংস ভক্ষণ করে। নদীর তীরে হিপোপোটেমাসের বহু পরিমাণ হাড়গোড় পড়ে থাকতে দেখা যায়।

এ নদীর ধারেই বড় একটি গ্রামে এসে আমরা উঠলাম। গ্রামের মোড়ল ফারবা মাঘা নামে একজন কাফ্রী হাজী। তিনি একজন সৎ লোক। ইনি সুলতান মানসা মুসার সঙ্গে হজ করেছেন। ফারবা মাঘার কাছে শুনলাম, একবার সুলতান মানসা মুসা যখন এ খালের ধারে এসেছিলেন তখন তার সঙ্গে একজন শ্বেতকায় কাজী ছিলেন। এ কাজী চার হাজার মিশকাল নিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছিলেন। সুলতান তা জানতে পেরে ভয়ানক রেগে যান এবং সেই শ্বেতকায় কাজীকে নরখাদক জংলীদের দেশে নির্বাসিত করেন। কাজী চার বছর তাদের মধ্যে বেঁচে ছিলেন। পরে সুলতান তাকে আনিয়ে তার দেশে পাঠিয়ে দেন। লোকটি শ্বেতকায় ছিলেন বলেই জংলীরা তার মাংস ভক্ষণ করেনি। জংলীদের ধারণা, শ্বেতকায় লোকদের মাংস হজম হয় না, কারণ তাদের মাংস ‘পরিপক্ক’ নয়। পক্ষান্তরে তাদের মতে কৃষ্ণকায় লোকদের মাংস পরিপক।

নরখাদক এ কাফ্রীদের একটি দল একবার এসেছিল সুলতান মানসা সুলায়মানের সঙ্গে দেখা করতে। সঙ্গে তাদের আমীরও ছিল। এরা কানে বড় বড় আংটী ব্যবহার। করে। আংটীর ভেতরকার পরিধি হবে প্রায় এক বিঘত। গাত্রাবরণ হিসাবে ব্যবহার করে আঙরাখা। তাদের দেশে একটা স্বর্ণখনি আছে। সুলতান সসম্মানে তাদের অভ্যর্থনা জানালেন। একটি নিগ্রো বালিকাকে তাদের হাতে দিয়ে অতিথি সকার করলেন। তারা সেই বালিকাকে হত্যা করে তার মাংস ভক্ষণ করল। তারপর সুলতানকে ধন্যবাদ জানাতে এল সেই বালিকার রক্ত মুখে ও হাতে মেখে। শুনেছি সুলতানের দরবারে এলে। এই তাদের প্রচলিত অনুষ্ঠান। এদের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে একজন আমাকে বলেছে। নারীদেহের বক্ষ ও হাতের মাংস এদের কাছে সবচেয়ে পছন্দসই।

খালের পারে অবস্থিত এ গ্রামটি ছাড়িয়ে আমরা কুরি মানসা শহরে এসে পৌঁছলাম। এখানে পৌঁছতেই আমার বাহন উটটি গেল মরে। উটের রাখাল এসে আমাকে এ খবর দিল। আমি মৃত উটটিকে দেখতে গিয়ে দেখি ইতিমধ্যে কাফ্রীরা তা যথারীতি খেয়ে ফেলেছে। আমি তখন আরেকটি উট কিনবার জন্য দুটি ছেলেকে পাঠালাম জাখারি। উট কিনে ফিরে আসবার অপেক্ষায় কুরি মানায় দু দিন থাকতে হলো।

সেখান থেকে মিমা শহরের বাইরে কয়েকটি কুপের পাশে এসে আমরা আস্তানা ফেললাম। সেখান থেকে এলাম তামবাতু। নদীর ধার থেকে তামবাকতুর দুরত্ব চার মাইল। এখানকার অধিকাংশ অধিবাসী মাসুফা সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা মুখে ঘোমটা ব্যবহার করে। এদের শাসনকর্তার নাম ফারবা মুসা। তিনি যখন একজন মাসুফাঁকে একটি দলের আমীরের পদে নিয়োগ করলেন আমি ঠিক তখন তাঁর কাছেই উপস্থিত ছিলাম। তিনি তাকে রংকরা কাপড়ের আঙরাখা, পাগড়ীও পায়জামা উপহার দিয়ে। একটি ঢালের উপর বসতে আদেশ করলেন। তার দলের সরদাররা তখন তাকে মাথায় তুলে নিল। গারনাটার (গ্রানাডার) প্রতিভাবান কবি আবু ইসহাক আস্-সাহিলীর কবর এ শহরে অবস্থিত। এ কবি নিজের দেশে আততুবায়জিন (ছোট রঞ্জন পাত্র) নামে পরিচিত।৩১

তামবাকতু থেকে এক-কাঠের তৈরী একটি ছোট নৌকায় চড়ে নীল নদের পথে নিম্ন দিকে রওয়ানা হলাম। পথে প্রতি রাত্রে আমরা তীরবর্তী গ্রামে গিয়ে লবণ, মসলা ও পুঁতির পরিবর্তে মাংস মাখন প্রভৃতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সগ্রহ করে নিতাম। এমনি করে এমন একটি জায়গায় পৌঁছলাম যার নামটি আজ আমার স্মরণে নেই। সেখানকার শাসনকর্তা একজন চমৎকার লোক। তাঁর নাম ছিল হাজী ফারবা সুলায়মান। তিনি ছিলেন তাঁর সাহস ও শক্তির জন্য প্রসিদ্ধ। তাঁর ধনুকটি কেউ ব্যবহার করতে সাহস পেত না। তার মত বিশাল ও দীর্ঘকায় তোক আমি আর কোথাও চোখে দেখিনি। এ শহরে থাকতে একদিন আমার কিছু ভুট্টার প্রয়োজন হওয়ায় শাসনকর্তার কাছে গিয়ে। তাকে সালাম করলাম। সেদিন ছিল ফাতেহা দোয়াজ দাহাম। তিনি আমার হাত ধরে আমাকে তার দরবারে নিয়ে গেলেন। সেখানে আমাদের খেতে দেওয়া হল ডাকনু নামে এক প্রকার পানীয়। ভুট্টার ছাতু পানি দিয়ে গুলে মধু বা দুধ মিশিয়ে তৈরী সে পানীয়। শুধু পানি পান করে তারা অসুস্থ হয় বলে পানির পরিবর্তে এ জিনিষই পান করে। ভুট্টার অভাবে তারা পানির সঙ্গে মধু বা দুধ মিশিয়ে নেয়। তারপর এলো একটি কাঁচা তরমুজ। তার কিছুটা নিয়ে আমরা সদ্ব্যবহার করলাম। গায়ে পায়ে তথনও পরিপূর্ণতা লাভ করেনি এমন একটি বাচ্চা ছেলেকে কাছে ডেকে ফারবা সুলায়মান আমাকে বললেন, “অতিথি হিসাবে আপনাকে উপহার দিলাম। ছেলেটির ওপর নজর রাখবেন যেনো কখনো পালিয়ে না যায়।”

সেই ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে আমি চলে আসছিলাম। তিনি বললেন “একটু অপেক্ষা করুন, খেয়ে যাবেন।”

তখন তার একজন বাদী এসে হাজির হল সেখানে। দামেস্কের এক আরব বালিকা এই বাদী। আমার সঙ্গে সে আরবীতে কথা বলছিল এমন সময় সুলতানের বাড়ীর ভেতরে কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। সুলতান বালিকাকে বাড়ীর ভেতর পাঠালেন কান্নার কারণ জানতে। সে ফিরে এসে খবর দিল এইমাত্র সুলতানের একটি কন্যা মারা গেছে। তাই শুনে তিনি বললেন, “কান্না আমি পছন্দ করিনে। আসুন আমরা নদীর পাড়ে যাই।”

তিনি নীলনদের তীরে তাঁর আরও যে সব বাড়ী রয়েছে সেখানে যাওয়ার কথা বলছিলেন। একটা ঘোড়া আনানো হলে তিনি আমাকে ঘোড়ায় আরোহণ করতে বললেন। কিন্তু আমি বললাম, “আপনি হেঁটে গেলে আমি ঘোড়ায় চড়ে যেতে পারিনা।”

অতঃপর উভয়েই আমরা হেঁটে নদীর ধারে তার বাড়ীতে গিয়ে আহার করলাম। আহারের পর বিদায় নিয়ে চলে এলাম। কৃষ্ণকায় কাফ্রীদের ভেতর তার মত দয়ালু ও সৎ লোক আমি আর কোথাও পাইনি। তার দেওয়া সেই বালকটি আজও আমার সঙ্গে আছে।

সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে গগগা এসে পৌঁছলাম। নীলনদের তীরে কাফ্রী দেশের সবচেয়ে সুন্দর ও বড় শহর গগো(Gogo)। প্রচুর চাউল, দুধ ও মাছ এখানে পাওয়া যায়। এখানে ইনানী নামক এক প্রকার শসা পাওয়া যায় যার তুলনা কোথাও নাই। এখানকার অধিবাসীরা কড়ির সাহায্যে কেনাবেচা করে এবং মালীতেও ৩৩ অনুরূপ ব্যবস্থা প্রচলিত। প্রায় একমাস কাল সেখানে কাটিয়ে গাদামাসের একদল সওদাগরের সঙ্গে স্থলপথে আমরা তাগাদ্দার দিকে চলতে থাকি। তাদের দলের চালক ও নেতা ছিলেন উচিন নামে একজন হাজী। তাদের ভাষায় উচিন বলে নেকড়ে বাঘকে। আমার সঙ্গে আমার বাহন স্বরূপ একটি উট ছিল। আরেকটি মাদী উট ছিল আমার জিনিষপত্র বহনের জন্য। কিন্তু এক মঞ্জিল পার হয়ে যাবার পর মোটবাহী উটটি আর অগ্রসর হতে পারছিল না। তখন হাজী উচিন উটের পিঠের মালপত্র নামিয়ে সঙ্গীদের মধ্যে কিছু-কিছু করে ভাগ করে দিলেন। এবং তারাই তা ভাগাভাগি করে বইতে লাগল। দলের ভেতর তাদালার একজন মাগরাবিন ছিল। সে কিছুতেই তার অংশের বোঝা বহন করতে রাজী হল না। আমার সঙ্গী বালকটি একদিন তৃষ্ণার্ত হয়ে তার কাছে পানি চেয়েছিল, তাও সে দেয়নি।

অতঃপর আমরা বর্বর বার্দামাদের দেশে প্রবেশ করলাম। নিরাপত্তার জামিন ছাড়া। তাদের দেশে কেউ সফর করতে পারে না। এখানে পুরুষের চেয়ে কোনো নারীর জামিনের মূল্য অধিক। নিখুঁত সৌন্দর্যে ও দেহ সৌষ্ঠবে এখানকার নারীরা সর্বশ্রেষ্ঠ। তাদের গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল ফর্সা এবং তারা যথেষ্ট দৃঢ়কায়। তাদের সঙ্গে তুলনা চলতে পারে। এমন সবলকায় নারী আমি দুনিয়ার ৩৪ কোথাও দেখিনি। এখানে এসে অত্যধিক গরমে ও পিত্তাধিক্যে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। তখন পথ চলার গতি বাড়িয়ে আমরা তাগাদ্দা এসে পৌঁছলাম। তাগাদ্দার ঘরবাড়ী লাল পাথরে তৈরী। তাম্রখনির পাশ দিয়ে এখানে পানি আসে বলে পানির স্বাদ ও রং বিকৃত। সামান্য পরিমাণ গম ছাড়া আর কোনো খাদ্যশস্য এখানে জন্মে না। গম যা জন্মে তা দিয়ে ব্যবসায়ীদের ও বহিরাগতদের খাদ্যের প্রয়োজন মিটে। ব্যবসায় ছাড়া অধিবাসীদের আর কোনো পেশা নেই। প্রত্যেক বছর তারা মিশর গিয়ে সেখানকার সব রকম সুক্ষ্ম বস্ত্র ও অন্যান্য ব্যবহার্য দ্রব্য। আমদানী করে। তারা বিলাসিতা ও আরাম আয়াসে বাস করে এবং নিজেদের দাসদাসীর সংখ্যা নিয়ে একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। মালী ও ইবালতানের অধিবাসীরাও তাই করে। তারা শিক্ষিতা কোনো বাদীকে কখনো বিক্রি করতে রাজী হয় না, বিক্রি করলেও অত্যন্ত উচ্চ মূল্য হাঁকে৩৫।

তাগাদ্দায় পৌঁছে আমি একজন শিক্ষিতা বাদী কিনতে চাইলাম কিন্তু কোথাও তা পেলাম না। পরে কাজী তার বন্ধুর একটি বাদীকে আমার কাছে পাঠালেন। আমি পঁচিশ মিশকাল দিয়ে তাকে খরিদ করলাম। পরে তার মনিব তাকে বিক্রি করে খুব অনুতপ্ত হ’ল এবং তাকে ফিরিয়ে নিতে চাইল। কাজেই আমি বললাম, “আরেকটি বাদী কোথায় পেতে পারি জানালে আমি একে ফেরত দিতে পারি।”

সে তখন ‘আলী আগিলের একটি বাদীর কথা বলল। এ আলী আগিলই তাদালার সেই মাগরাবিন যে আমার মালপত্র বহন করতে রাজী হয়নি এবং আমার ভৃত্যকে পানি খেতে দেয়নি। কাজেই আমি এ বাঁদীটিকে কিনে প্রথমটি ফেরত দিলাম। এ বাণীটি প্রথমটির চেয়ে ভাল ছিল। পরে মাগরাবিনও তার বাদী বিক্রি করে যথেষ্ট অনুতপ্ত হল ও তাকে ফেরত চাইল। এজন্য সে যথেষ্ট পীড়াপীড়ি করতে লাগল কিন্তু তার দূর্ব্যবহারে প্রতিশোধের জন্য আমি তার প্রস্তাব মেনে নিতে কিছুতেই রাজী হচ্ছিলাম না। অবশেষে সে বাদীর দুঃখে পাগল হয়ে যাবে অথবা মরে যাবে এমন অবস্থা হওয়ায় তার সঙ্গে কেনাবেচা বাতিল করতে হল।

তাম্রখনিটি তাগাদ্দা শহরের বাইরে। তারা খনি থেকে তামা তুলে এনে বাড়ীতে শোধন করে। এ কাজ তাদের গোলাম ও বাদীরাই করে। শশাধিত লাল তামা দিয়ে তারা। অনুমান দেড় বিঘত লম্বা তার তৈরী করে। এ সব তাল হালকাও হয় ভারীও হয়। এক স্বর্ণ মিশকালের পরিবর্তে চার শ ভারী তাল বিক্রি হয়। হালকা তাল হলে ছয় বা সাতশ’ পাওয়া যায় এক মিশকালে। তামার তালের সাহায্যে তাদের বেচা কেনাও চলে। হালকা তাল দিয়ে তারা কিনে মাংস ও জ্বালানী কাঠ এবং ভারী তাল দিয়ে বাদী, গোলাম, ভুট্টা মাখন ও গম।

তাগাদ্দা থেকে তামা রপ্তানী হয় বর্বর দেশের অন্তর্গত কুবার শহরে, জাঘাই৩৬ ও বারনু দেশে। তাগাদ্দা থেকে বারনুর দূরত্ব চল্লিশ দিনের পথ। বারনুর বাসিন্দারা মুসলমান। ইদ্রিস নামে তাদের একজন রাজা আছেন। তিনি প্রজাদের সামনে কখনো দেখা দেন না। এবং পর্দার আড়ালে থেকে ছাড়া তাদের সঙ্গে কখনও কথা ৩৭ বলেন না। এ দেশেই উৎকৃষ্ট বাদী, খোঁজা পুরুষ এবং জাফরাণী রঙে রং করা কাপড় পাওয়া। যায়। তাগাদ্দার তামা অন্যান্য দেশ ছাড়াও জাওজাওয়া এবং মুয়াবতাঁবুনদের দেশে রফতানী হয়।

তাগাদ্দায় থাকা কালে আমি সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছা করলাম। তিনিও বর্বর সম্প্রদায় ভূক্ত। তাঁর নাম আইজার। তিনি তখন যেখানে ছিলেন শহর থেকে সেখানে যেতে একদিন লাগে। কাজেই একজন চালক নিযুক্ত করে আমি একদিন রওয়ানা হলাম। আমার আগমন সংবাদ পেয়ে তিনি জাজিম বিহীন এক ঘোড়ায় চড়ে দেখা করতে এলেন। ঘোড়ায় জাজিম ব্যবহারের রেওয়াজ তাদের দেশে নেই। জাজিমের পরিবর্তে রয়েছে জাজিমের উপরে দেবার চাকচিক্যময় একটুকরা কাপড়। সুলতানের গায়ে আলখেল্প, পরিধানে পায়জামা, মাথায় পাগড়ী–সবই নীল রঙের। সঙ্গে ছিল তার ভাগনেয়রা। ভাগনেয়রাই তার রাজত্বের উত্তরাধিকারী। তিনি এগিয়ে আসতে আমি উঠে গিয়ে তার করমর্দন করলাম। আমার আগমনের কারণ ও কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলে আমি সবিস্তারে তাকে সব বললাম। তিনি ইয়ানিতিবুননের একটি তাবুতে আমার বাসস্থান নির্দেশ করলেন। এরা আমাদের দেশের বুসকানদের ৩৯ সমতুল্য। আমার আহারের জন্য তিনি পাঠালেন রোস্ট করা একটি ভেড়া এবং কাঠের একটি পাত্রে গোদুগ্ধ। আমাদের তাবুর কাছেই ছিল সুলতানের মাতা ও তার ভগ্নীর তাবু। তারা আমাদের সঙ্গে দেখা করে সালাম করে গেলেন। মাগরিবের নামাজের পরে তাদের গাভী দোহনের সময়। সুলতানের বাবা সে সময়ে আমাদের দুধ পাঠাতেন। তারা দুধ পান করে সন্ধ্যার পরে এবং ভোরে। খাদ্যশস্যের কিছুই তারা খায় না এবং খেতে জানেও না। তাদের সঙ্গে আমি ছয়দিন ছিলাম। প্রতিদিনই দুটি করে রোস্ট করা ভেড়া–একটি সকালে, একটি সন্ধ্যায় সুলতানের নিকট থেকে আমি পেয়েছি। তা ছাড়া তিনি আমাকে একটি মাদী উট এবং দশ মিশকাল মূল্যের স্বর্ণ দান করেছিলেন। পরে। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাগাদ্দা ফিরে এলাম।

তাগাদ্দায় ফিরে আসার পরেই আমাদের খলিফার এক আদেশ পত্র নিয়ে এক দূত এসে হাজির। তিনি আমাকে তার রাজধানীতে ফিরে যেতে আদেশ করেছেন। আমি তার আদেশপত্রটি চুম্বন করে আদেশ পালনে যত্নবান হলাম। সওয়ারের উপযোগী দুটি উট ৩৭মিশকালে খরিদ করে আমি তাবাত যাত্রার আয়োজন করলাম। সত্তর দিনের উপযোগী খাদ্য সঙ্গে নিলাম কারণ তাগাদ্দা ও তাবাতের মধ্যে কোথাও খাদ্যশস্য পাওয়া যায় না। কাপড়ের টুকরার বিনিময়ে মাংস, দুধ এবং মাখন পাওয়া যায়।

বিশাল একটি কাফেলার সঙ্গে আমি তাগাদ্দা ত্যাগ করলাম ৭৫৪ হিজরীর ১১ই শাবান বৃহস্পতিবার মোতাবেক ১১ই সেপ্টেম্বর ১৩৫৩ খৃস্টাব্দে। আমাদের এ কাফেলায় ক্রীতদাসী ছিল ছয়শ। আমরা প্রথমে কাহির এসে পৌঁছলাম। সেখানে গোচারণ ভূমি প্রচুর। কাহির থেকে এসে জনহীন এক মরুভূমিতে পড়লাম। তিনদিনের পথ বিস্তৃত এই মরুর কোথাও পানি নেই। তারপরে আরেকটি মরুভূমির ভেতর দিয়ে আমরা পনর দিন পথ চললাম। এ মরুভূমিটি জনহীন হলেও এর স্থানে-স্থানে পানি পাওয়া যায়। পনর দিন পর আমরা যেখানে পৌঁছলাম সেখানেই মিরগামী ঘাট নামক সড়ক তাবাক সড়ককে অতিক্রম করেছে। এ অঞ্চলের স্থানে স্থানে ভূগর্ভে পানির ধারা প্রবাহিত হয়। সে ধারা লৌহের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় বলে এ পানির মধ্যে একখণ্ড বস্ত্র ডুবালে তা কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করে।

এ স্থানটি ত্যাগ করে দশ দিন পথ চলার পর আমরা হাগৃগারদের দেশে পৌঁছি। এরা অসভ্য শ্রেণীর লোক এবং মুখে আবরণ ব্যবহার করে। আমরা একবার তাদের এক সর্দারের কবলে পড়েছিলাম। সে আমাদের কাফেলা আটক করে রাখে। পরে মুক্তিমূল্য স্বরূপ কয়েকটি বস্ত্রখণ্ড ও অন্যান্য জিনিষ দিয়ে আমরা রেহাই পাই। আমরা যখন এদের দেশে পৌঁছি তখন রমজান মাস চলছে। রমজান মাসে তারা কোনো কাফেলার উপর হামলা করে না। এ সময়ে পথে ঘাটে জিনিস পত্র ফেলে রাখলেও তাদের দস্যুরা অবধি সে সব জিনিষ স্পর্শ করে না। এ পথের ধারে সমস্ত অসভ্য জাতির মধ্যেই এ রীতিটি প্রচলিত। এক মাস আমরা হাগগারদের দেশের ভেতর দিয়ে চলেছি। অঞ্চলটি গাছপালাহীন প্রস্তরময় এবং রাস্তাঘাটও খারাপ। ঈদ-উল-ফেতরের দিনে আমরা যেখানে পৌঁছি সেখানকার লোকেরাও অসভ্য এবং তারাও মুখাবরণ ব্যবহার করে।

অতঃপর আমরা আবাতের প্রসিদ্ধ গ্রাম বুদা পৌঁছি। এখানকার জমি বালুকাময় ও লবণাক্ত। এখানে প্রচুর খেজুর পাওয়া যায় কিন্তু তা সুস্বাদু নয়। তবু স্থানীয় লোকেরা। সিজিলমাসার খেজুরের চেয়েও এখানকার খেজুর বেশী পছন্দ করে। এখানে কোনো রকম ফসল, মাখন বা জলপাইর তেল পাওয়া যায় না। পশ্চিম অঞ্চলের দেশ থেকে এসব জিনিস এখানে আমদানী হয়। খেজুর ও পঙ্গপাল এখানকার অধিবাসীদের খাদ্য। এখানে যথেষ্ট পঙ্গপাল দেখা যায়। খেজুরের মতই এরা পঙ্গপাল সগ্রহ করে রাখে খাদ্য হিসাবে ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য। ঠাণ্ডায় পঙ্গপাল উড়ে পালাতে পারে না বলে তারা সূর্যোদয়ের আগে পঙ্গপাল ধরতে যায়।

বুদায় কয়েকদিন কাটিয়ে আরেকটি কাফেলার সঙ্গে জেলকদ মাসের মাঝামাঝি সিজিলমাসায় গিয়ে পৌঁছি। সেখান থেকে জেলহজ্ব মাসের ২রা তারিখে (২৯শে ডিসেম্বর) আমি অসহ্য শীতের মধ্যে তুষারাবৃত পথে রওয়ানা হই। জীবনে বুখারা, সমরকন্দ ও খোরাসানে অনেকবারই তুষারাচ্ছন্ন বন্ধুর পথ দেখেছি, তুকাদের দেশেও সে সব দেখেছি কিন্তু উন্মে জুনায়বার পথের মত খারাপ পথ কোথাও দেখিনি। ঈদ-উল ফেতর পর্বের পূর্বক্ষণে আমি দার-আত-তামা এসে পৌঁছি। রমজানের পরে ভোজনোৎসবের দিনটি আমার সেখানেই কাটে। সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে আমি আমাদের খলিফার রাজধানী ফেজ এসে পৌঁছি। এখানে আমির-উল-মমামেনি রে দস্ত মুবারক চুম্বনের ও তাকে দর্শনের সুযোগ ও সৌভাগ্যলাভ করি। আল্লাহ তার শক্তি বৃদ্ধি। করুণ এই আমার কামনা। দীর্ঘ সফরের পর আমি তার স্নেহচ্ছায়ায় এসে আশ্রয় গ্রহণ করলাম। তিনি আমার প্রতি যে অপরিসীম অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন সেজন্য পরম করুনাময় আল্লাহ তার মঙ্গল করুন এবং তাকে দীর্ঘজীবি করুন যাতে তিনি মুসলমানদের কল্যাণ করে যেতে পারেন।

এখানেই A Donation to those interested in the curiosities of the cities and Marvels of the Ways শীর্ষক সফরনামা শেষ হয়েছে। এ সফরনামার তলিখন সমাধা হয় ৭৫৬ হিজরীর ৩রা জেলহজ্ব (৯ই ডিসেম্বর ১৩৫৫)। আমি আল্লার প্রশংসা ঘোষণা করছি এবং তাঁর প্রিয় যারা তাদের শান্তি কামনা করছি।

ইব্‌নে জুযাই বলছেন, “শেখ আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইব্‌নে বতুতার বর্ণিত ও আমার দ্বারা সংক্ষেপিত বর্ণনা এখানেই শেষ হল। বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা সহজেই স্বীকার করবেন যে শেখ ইব্‌নে বতুতা তার যুগের একমাত্র সফরকারী। কেউ যদি বলেন যে তিনি ছিলেন মুসলিমদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম সফরকারী তবে তিনি অতিশয়োক্তি করলেন বলা যায় না।”

-সমাপ্ত-

***

টিকা

পরিচ্ছেদ ১৪

১। আট এবং মোল শতাব্দীর মাঝখানে আটলা পর্বতের দক্ষিণে অবস্থিত সিজিলমাসা ছিল একটি প্রধান বাণিজ্যি ঘাঁটি। পুরানো শহরের ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে ওয়াদি জিজের পাঁচ মাইল ব্যাপি স্থানের উপরে আধুনিক টাফিলেতের নিকটে।

২। তগহাজার নিমক-খনি তাওদেনির উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। নিমকের জন্য এ স্থানটি নিগ্রো সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি।

৩। ওয়াদি দ্রা এন্টি-আট্রাসের ঢালুকে পরিত করে। মাসুফা নামটি মনে হয় সে সময়ে সাহাজাকে দেওয়া হয়েছে-এটা ল্যামৃতুনা সহ স্মরণাতীত কাল থেকে পশ্চিম সাহারার প্রধান। বংশ ছিল। ইব্‌নে বতুতার বিবরণ অনুসারে মাসুফা তাগৃহাজা থেকে তিমবুক পর্যন্ত এবং পূর্বদিকে এয়ার এবং হোগার পর্যন্ত সমস্ত সাহারা অধিকার করেছিল।

৪। গ্রন্থে যে বাক্যাংশটি ব্যবহার করা হয়েছে (এটাকে ক্যন্টারস্ এক্যান্টার বলা যেতে পারে) সেটাকে গ্রহণ করা হয়েছে কোরাণ থেকে। সেখানে এর মানে হচ্ছে “অকথিত সম্পদ।”

৫। সারাল সম্ভবতঃ ইদ্রিসির তাইসার। এটা আজাওয়াদ মরুভূমিতে অবস্থিত (কুলি, ১৪-১৫)।

৬। আইওয়ালাতান হচ্ছে ওয়ালাতার বহুবচন। লিও আফ্রিকানা অনুসারে স্থানটি গঠিত হয়েছে তিনখানা গ্রাম নিয়ে। আধুনিক ম্যাপে ওয়ালা নামে দুটি স্থান দেখা যায়। ইব্‌নে বতুতার ওয়ালাতান হচ্ছে দক্ষিণেরটি–১৭:০২ উত্তরে, ৬:৪৪ পশ্চিমে। তেরো শতাব্দীতে ট্রান্স সাহারান বাণিজ্য পথের দক্ষিণ টারমিনাস রূপে এটা ঘানার স্থান দখল করেছিল (নিম্নে ২১ টীকা দ্রষ্টব্য)। এটা তৈরি হয়েছিল (হাটম্যান, Mit. Sem. Or. Stud. XV৩. ১৬২ অনুসারে) পুরাতন বার্বার শহর আওদাঘাশতের স্থানে।

৭। বাওবাব গাছ (Adansonia digitata) খুব স্বল্পকাল মধ্যে বৃহৎ ব্যাস লাভ করে থাকে এবং লোকে তার খুঁড়িতে খোড়ল পুড়ে নিয়ে পানি রাখে। সেজন্য যেখানে ইন্দারা নেই সেখানে এ সব গাছ থাকার জন্য জন-বসতী সম্ভব হয়। এ উদ্দেশ্যে আঠারো শতকে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে এ গাছ পূর্ব সুদানে (কর্ডোফান) আমদানী করা হয়। কিন্তু ইব্‌নে বতুতার বর্ণনায় দেখা যায় কৃত্রিম ফোকড় তৈরি করার কাজ তখনো সেখানে প্রচলিত হয়নি।

৮। কুসকুসু (ফরাসী ভাষায় কাউস-কাউস) হচ্ছে উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার একটি সাধারণ ফসল জাতীয় খাদ্য-মোটাভাবে পেষা ময়দা সিদ্ধ করে তৈরি হয় এবং মিঠা চাটনি সহযোগে খাওয়া হয়।

৯। জাঘাতি প্রথম সনাক্ত করেন দেলফসে দিওরার সঙ্গে। লিপার্ট এটাকে বার্থ তিউর সংঘা নামে পরিচিত গ্রামের সঙ্গে অভিন্ন বলে দেখিয়েছেন। স্থানটি বা-সিকুননু বা বাকিকুতেনুর দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত (বার্থের ভ্রমণ, ইংল্যান্ডে সম্পাদিত, ১৮৫৭-৭, ৫,৪৮১; Mit sen. Or. St. III৩, ১৯৮-৯)।

১০। ওয়াংগারা (ওয়ানকুর, ওয়েবুর হচ্ছে একটি নাম। এটা পিউলস্ (ফুলানি) এবং সংহে সন্নিকে বলে অভিহিত লোকদের দিয়েছেন (পর্তুগীজগণ এদের বলেছেন সারাকুলে), এবং বিস্তৃতভাবে সনিকে এবং ম্যালিনকে উভয় জাতিকে বুঝায়। এভাবে এটা আধুনিক প্রচলিত শব্দ ম্যাডে কিম্বা ম্যানডিংসোর সমতুল্য হয়েছে। এটা প্রকৃতপক্ষে ম্যালিকের নাম। ম্যালিকে এবং সনিকে একই পরিবারের অন্তর্গত। পরবর্তীটি উত্তর অঞ্চলের এবং পূর্বোক্তটি মধ্যবর্তী গুপের (দেলাফুঁসে, এইচ, এস, এন, ১ম খণ্ড, ১১৪–৫, ১২২-৭)।

১১। ইবাদাইত হচ্ছে ইসলামের প্রথম শতাব্দীর একটি বিশেষ গোড়া সম্প্রদায় এরা বিরোধী বা খারিজি নামে পরিচিত। একমাত্র সম্প্রদায়গুলি দেখা যায় ওমান, জাঞ্জিবার, দক্ষিণ, আজেরিয়ার মজার জেলায়, ঘার দাইয়া প্রভৃতি স্থানে। এরা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ কৃতীবান বলে বিখ্যাত। কিন্তু পুরনো মতের মুসলিম সাধারন থেকে তারা বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করেন বা জনসাধারণই তাদের থেকে আলাদা থাকে। অথবা গ্রন্থের এ স্থানে যে সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেটা হয়তো মুজাবাইট সওদাগরদের একটি ঘাটি ছিল (M.S. O.S., Log, Cit. ও এখানে দ্রষ্টব্য)।

১২। কারসাধুকে দেলাফুঁসে কারা-সাখু বলে ধরে নিয়েছেন, অর্থাৎ কান্নারা বাজার, “কঙ্গোকুর বর্তমান স্থানের নিকটে এবং এর সম্মুখে। নাইজারের বাম তীরে এবং কারার কয়েক মাইল উত্তরে।”

১৩। গ্রন্থের এ অংশে উল্লেখিত কাবারা তিমবুকতুর নিকবর্তী সেই নামের সুপরিচিত বন্দর বোধ হয় নয়। দেলাফসে এটাকে জাফারাবার (দিয়াফারাবে) একটি নাম বলে মনে করেন।

জাঘা কিম্বা জাঘে, অধিক শুদ্ধভাবে বলা হয় জাকা বা জাগা (দিয়াগা) এটা বলা হয় তারুর রাজ্যের আদিম রাজধানীর নামানুসারে। এটা ছিল একটি বৃহৎ জেলা। এর অবস্থিতি নাইজারের উত্তর-পশ্চিম শাখার তীরে এবং জাফারাবার উত্তরে অর্ধেক দিনের সফর। এগারো শতকের প্রথম দিকে সুদানে ইসলাম প্রচারের ভিত্তিস্থল হচ্ছে এই তারুর (মারকুয়াট, বেনিন্ স্যামসাং, ভূমিকা, ১৫০-১, ১৫৪, ২৪১)।

১৪। মূলী খুব সম্ভব সেই জেলাটি পরে যাকে বলা হতো মুরি, নিয়ামের কাছে নাইজার নদীর বাম দিকে অবস্থিত। এর বিপরীত তীরে অবস্থিত কুমবুরি) সম্ভবতঃ ইব্‌নে বতুতার কানবানি)।

১৫। ইব্‌নে বতুতার লিমিউনকে দেলাফুঁসে এবং মারকোয়ার্ট কেবে (কিবা) জেলার অধিবাসীদের নাম বলে গ্রহণ করেছেন। কুলির মতের সমর্থনে অনেক কিছু বলবার আছে। যেমন অন্য সব আরবী ভৌগলিকের উল্লেখিত সামলামের সঙ্গে লিমিসদের সামঞ্জস্য রয়েছে। ভৌগলিক বারী এদের বলতেন দাদম এবং এদের স্থান নির্দেশ করেছেন গাওগাওর নিম্নে নাইজারের তীরে। শেষোক্ত শব্দটির অর্থ আদমশোর-এ কোনো সুনির্দিষ্ট উপজাতির নাম নয়। ফুলবে ভাষায় এটা হয়েছিল নিয়াম-নিয়াম (ফুলবের নিয়াম=খাওয়া), এটাই বিচিত্রভাবে আরবী রূপে পেয়েছে নাম-নাম এবং ইয়াম-ইয়াম শব্দে। এই শব্দটি আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে উভয় আকারে প্রচলিত ছিল। ইব্‌নে বতুতা শুনেছেন “লিমিসূদের দেশের ইউফি থেকে সোফালায় স্বর্ণচূর্ণ আনা হতো” (পরবর্তী টীকা দ্রষ্টব্য) সোফালা থেকে ইউফি এক মাসের পথ। এই আন্তমহাদেশীয় বাণিজ্য সম্পর্কে নিম্নের ৩৩ টীকা দ্রষ্টব্য। নিয়াম-নিয়াম শব্দটি অবশেষে বেইজিয়ান কঙ্গোর একটি আদমখোর উপজাতির নামরূপে বৈশিষ্ট্যপ্রাপ্ত হয়েছিল। ইতিমধ্যে এটা ভূমধ্যসাগরীয় কে-কাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। একজন আলবেনিয়ান অশ্বপালকের কাছে এ, ডব্লিউ হ্যাঁজাক শুনছেন, সে দেখতে পেয়েছে একটি সম্পূর্ণ নতুন ধরণের রক্তশোষক জীব-সেটার নাম নিয়ামূ-নিয়াম সোই। (১) এই জীবটি যকৃৎ খেতে খুব ভালোবাসে, (২) এর দাঁত গাধার দাঁতের মতো, (৩) বৃহৎ পা” (কুলি, ১১২ f.; হার্টম্যান; in M.S.0.S. XV৩ ১৭২; হ্যাঁজ্বলাক্, লোটার্স অন্ রিলিজন এন্ড ফোলুর, ৯)।

১৬। নিউপের সঙ্গে কুলির (৯৩ পৃঃ) ইউফির যে একই স্থানে বলে নির্ধারণ যার অবস্থিত জেব্বা এবং লোকোজার মধ্যবর্তী নাইজারের বাম তীরে সেটা পরবর্তী সমস্ত লোকে স্বীকার করেছেন।

১৭। নাইজারকে লাইনের সঙ্গে যুক্ত করে (সম্ভবতঃ বাহার আল-গাঁজালের দিক দিয়ে) ইব্‌নে বতুতা অন্ততঃ দুইটি প্রচলিত ভুল মতের স্বল্প ভ্রমাত্মকটি গ্রহণ করেছেন-এ ভুল মত। প্রচলিত ছিল মুঙ্গো পার্ক আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বে। লিও আফ্রিকানাস এবং আরো অনেক প্রাথমিক ভৌগলিকগণ ইদ্রিসির অনুসরণে মনে করতেন নাইজার পশ্চিম দিকে প্রবাহিত এবং সোনেগাল নদীর সঙ্গে এটাকে অভেদরূপে গ্রহণ করেছিলেন।

১৮। ১২৭২ এবং ১৩২৩ শতকের মাঝখানে মিশরের সুলতানগণ অনেকবার ক্রিশ্চান রাজ্য নুবিয়া আক্রমণ করেছিলেন। এ সব অভিযান মিশরের সুবিধার পক্ষে কোনো কিছু সাফল্যজনক ছিল না। এতে করে নুবিয়ান রাজ্য শীঘ্রই ভেঙ্গে পড়ে। এবং চৌদ্দ শতাব্দীর প্রথম দিকে আরব উপজাতি কাজ বা কাজ-আদ-দৌলার হাতে ডঙ্গোলা পতিত হয়–এরা পূর্বে ছিল আস্ওয়ানের উত্তরাধিকারী আমির। ইব্‌নে বতুতা যাকে ইব্‌নে কাজ, আদ-দীন নামে অভিহিত করেছে-তিনি যদিও নিজে নব-দীক্ষিত নন-তথাপি তাকে নৃবিয়ার প্রথম মুসলিম নরপতি বলে গণনা করা যায়। (মারকোয়ার্ট, ২৫২-৪)।

১৯। মাল্পি নামটি হচ্ছে ম্যাডে বা ম্যান্ডিংয়ের ফুলানি উচ্চারণ। এটা কোনো শহরের নাম। নয়, একটি শাসক উপজাতির নাম। এর অবস্থিতি স্থান অনেক দিন থেকে তর্কের বিষয় হয়ে রয়েছে। কুলি (৮১-২পৃঃ) এর স্থান দিয়েছিলেন সেগুর নিকটে বিন্নি নামে কথিত একটি গ্রামে “সামির উপর দিকে সাত মাইল” এবং সানসারা নদীকে নাইজারের একটি বাড়ী বলে গ্রহণ করেছিলেন। দেলাফোসে (এইচ, এস, এ ২য় খণ্ড, ১৮১) এ মতটি গ্রহণ করেন যে মাল্পির অবস্থান ছিল নাইজারের বাম তীরের একটি স্থানে, এটা নিয়ামিনার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং মরিবুগুর দক্ষিণ-দক্ষিণ-পশ্চিমে কনিনা এবং কন্ডু গ্রামের সমস্তরে।…সুতরাং নিয়ামিনা থেকে কুলিকোবরা যাওয়ার বর্তমান পথের কিছুটা পশ্চিমে মাল্পি অবস্থিত। মাল্পির দশ মাইল উত্তরে অবস্থিত যে নদীটিকে ইব্‌নে বতুতা সানসারা নাম দিয়েছেন বার্থ দেখেছেন সে নামটা এখনো প্রয়োগ করা হয় সেই ক্ষুদ্র নদীটিকে যেটা নিয়ামিনার নিম্নদিকে নাইজারের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। মারকোয়ার্ট (১০৫, ১৯১) কুলির মতটাই গ্রহণীয় মনে করেন, কিন্তু মাল্পিক স্থান নির্দেশ করেন নদীর কিছুটা নিম্নদিকে সিল্লে (সিলে) থেকে একদিনের পথ উপরে এবং এটাকে কুঘা এবং জুগার সঙ্গে অভেদ বলে মনে করেন। এটা হচ্ছে পর্তুগীজদের কুইওকাইয়া।

[এই লেখা এবং ম্যাপ তৈরি করতে গিয়ে দেখা গেল যে এম, ভাইডাল এবং এ গেইলার্ড নির্দিষ্টরূপে বললেন যে মাল্পির নাম ছিল নিয়ানি আর এর উপস্থিতি ছিল বতর্মান নিয়ানি গ্রামের নিকটে সাকারানি নদীর বাম তীরে বালাদুগুর কিছুটা উত্তরে এবং জেলিবার (দাইলিবা) দক্ষিণে। এটা একই সাম্রাজ্যের অন্যতম রাজধানী” অর্থাৎ এর অবস্থান হচ্ছে ১১:২২ উত্তরে, ৮:১৮ পশ্চিমে, ম্যাপে নির্দেশিত স্থানের প্রায় ১৫০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে। আল ‘ওমারিব মাসালিক আল-আবৃসার গ্রন্থের অনুবাদ দেমমবাইন্স, ৫২ পৃঃ ২ টীকা দ্রষ্টব্য।]

২০। দেলাফোসে বছেন “দুঘা হচ্ছে বানমালা এবং ম্যালিকেঁদের মধ্যে এক প্রকার শকুনের নাম এবং দৈত্যের নামও বটে। অনেক সময় মানুষকেও এ নাম দেওয়া হয়।”

২১। নিম্নলিখিত বিষয়টি হচ্ছে প্রথম যুগের নিগ্রো সাম্রাজ্যের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ।

প্রাথমিক সুদানী সাম্রাজ্য ছিল ঘাণার সাম্রাজ্য (প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল পরবর্তী সোনিনকে শাসকদের পদবী)। কোনো একটি শ্বেতকায় প্রবাসী দল চতুর্থ শতাব্দীর দিকে এই সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। মনে হয় একাধিক বার এর রাজধানীর স্থান বদল হয়েছে। নয় থেকে এগারো শতাব্দী পর্যন্ত কুবির সোনোনকেগণ ছিলেন ঘানা সাম্রাজ্যের প্রভু ১০৭৬ খ্রীষ্টাব্দে মরক্কোর আমরভিদ কর্তৃক সাম্রাজ্যটি ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত। এর ধ্বংসাবশেষের উপর স্থাপিত হয়েছিল কিছু সংখ্যক ক্ষুদ্র রাজ্য। এদের একটি ছিল কতের সোনিকে রাজত্ব-এর রাজধানী ছিল সসসাতে (সান-সাণ্ডিংয়ের পশ্চিমে)। ১২০৩ খ্রীস্টাব্দে এই ক্যান্টের সোনিকে রাজত্ব কর্তৃক ঘন পুনর্দখল করা হয়েছিল এবং সোনিনকে সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল। ওয়াটার প্রতিষ্ঠার কারণও ছিল এটা। ঘানার মুসলিম অধিবাসীগণ কাফের শাসকের অধীনে বাস করতে অস্বীকার করেন-তাই তারা ওয়ালটা বিরার পানির কিনারে নিজেদের জন্য নতুন বাসস্থান প্রতিষ্ঠা করেন। (টীকা ৬ দ্রষ্টব্য)। বিজয়ী সুমানগুরু ম্যালিনকের ১৩৫ খ্রীষ্টাব্দের যুদ্ধে নিহত হন। এর নরপতি সুজাতা বা মারি-জাতা সোনিনকে সাম্রাজ্য সংযুক্ত করে নেন। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। (৩২৯ পৃঃ দ্রষ্টব্য), এবং মাল্লিতে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। তিনি ১২৪০ খ্রীস্টাব্দে ঘানা দখল করেন এবং সেটা ধ্বংস করে দেন। ১২৩৫ খ্রীস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়। বংশ পরম্পরা সূত্রে পরবর্তী খ্যাতিবান ম্রাট হন মুসা (ইব্‌নে বতুতার মানসা মুসা)। এর রাজত্বকালে (১৩০৭ ৩২) মাল্পি সাম্রাজ্য সবচেয়ে ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। মুসা ছিলেন সুনজাতার এক বোনের নাছেলে। তার ছেলে এবং উত্তরাধিকারী মা মাঘানের রাজত্ব কালে একটি সংক্ষিপ্ত সংকোচন ঘটেছিল, কিন্তু মুসার ভাই সুলেমানের রাজত্বকালে (১৩৩৬–৫৯) মাল্লি তার বিপুল ক্ষমতা এবং সম্মান পুনরুদ্ধার করেছিলেন। তার মৃত্যুর পরে অবনতি দেখা দেয় এবং সেটা তীব্রতর হয় গৃহযুদ্ধের দ্বারা। সঘে রাজত্বের (টীকা ৩২ দ্রষ্টব্য) উঘান কাল পর্যন্ত নাইজার রাজত্বগুলির মধ্যে মাল্পি রাজ্য যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল এবং ১৬৭০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত তার অস্তিত্ব বজায় ছিল।

২২। “সমস্ত অবস্থায়” কথাটার সংযোজন হচ্ছে একটি মৃদু ইঙ্গিত যে ব্যাপারটা তত ভালো নয় যতটা আশা করা গিয়েছিল।

২৩। সাতাশে রমজানের পূর্বরাত্রি লাইলাতল কারে ক্ষমতার রাত্রি” বলে কোরাণে উল্লেখিত। এরূপ বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে যে এ রাতে বেহেশতের সব দুয়ার খোলা থাকে এবং ভক্তের প্রার্থনা সাদরে গৃহীত হয়ে থাকে।

২৪। ম্যানডিংগোতে বেবে মানে হচ্ছে “মঞ্চ”। আল-ওমারি’ বেবের বর্ণনা করেছেন, একটি আইভরি বেঞ্চ রূপে।-এটা হস্তিদন্তের খিলানে আচ্ছাদিত।

২৫। অর্থাৎ “স্রাট সুলেমান” ম্যাণ্ডিগোতে “প্রভুত্ব করেছেন”।

২৬। দেলাফোসে বছেন ইব্‌নে বতুতা যে সব প্রচলিত রীতির বর্ণনা করেছেন এটা তারি মতো একটি রীতি। সুদানের অধিকাংশ দেশে এ রীতিটি বর্তমান কাল পর্যন্ত প্রচলিত রয়েছে।

২৭। উপরের ২১ টীকা দ্রষ্টব্য। ২৮। নিচের ৩১ টীকা দ্রষ্টব্য।

২৯। কিউরি মান্সার স্থান দেলাফোসে নির্দেশ করেছেন বর্তমান কোরি এবং মাসামানা গ্রামের নিকটে, স্যাস্যানণ্ডিংয়ের উত্তর-পূর্বে এবং ইব্‌নে বতুতার পূর্বেকার বিরাম স্থান কারসাধু থেকে বেশী দূরে নয় (টীকা ১২ দ্রষ্টব্য)।

৩০। মিমা মনে হয় সে জেলার একটি প্রধান শহর উপরে যেটাকে ইব্‌নে বতুতা জাঘা নামে উল্লেখ করেছেন (টীকা ১৩ দ্রষ্টব্য)। পরবর্তীকালে এ নামটি হ্রদের উপরের অঞ্চল সম্বন্ধে প্রয়োগ করা হতো (সবতঃহ্রদ অঞ্চলসহ)। স্থানটি আধুনিক ম্যাসিনার অংশ বিশেষের সঙ্গে যুক্ত। বার্থের মত অনুসারে মিমার অবস্থান জায়গাটি এখনো বর্তমান-যদিও সেটা পরিত্যক্ত। এটা লিয়ারের কয়েক মাইল পশ্চিমে (Travels Engl. ed. v; 487)।

৩১। ১৩২৫ খ্রীস্টাব্দে গাও জয় করার পর মাসা মুসা (তুমবাতুকে যুক্ত করে নিয়েছিলেন। ইয়াটেঙ্গার মোসির (উর্ধতর ভা) আক্রমণে ১৩৩৩ সালে শহরটি লুঠ হয় এবং পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং সুলেমানের সিংহাসন আরোহণের স্বল্পকাল পরে সেটা পুনরায় নির্মিত করা হয়। হজ্বের সময় মানসা মুসার সঙ্গে কবি আস্-সাহিলির সাক্ষাৎ হয় মক্কাতে-সুলতান তাকে তার সঙ্গে সুদানে ফিরে যেতে সম্মত করেন। তিনি ছিলেন গাও এবং তুকুতুর। মসজিদের নির্মাতা। ১৩৪৬ সালে তুমবাত্তুতে তার মৃত্যু হয়।

৩২। গাও বা গাওগাও (মূল নাম কুঘার একটি রূপান্তর) কেবল পশ্চিম থেকে নিমকের রাস্তার এবং উত্তর থেকে ট্রান্স-সাহারান পথের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ঘাঁটি ছিল না- বরঞ্চ আন্ত মহাদেশীয় পথের ঘাঁটিও ছিল। এগারো শতাব্দীর প্রথম দিকে এটা সংঘে (সংঘয়) রাজ্যের রাজধানী হয়। এটা তখনি ঘটে যখন প্রথম সংঘে রাজত্ব ইসলামে দীক্ষিত হয়। এর উৎপত্তি বলা হয় বাবার থেকে। ১৩২৫ খ্রীস্টাব্দে মানসা মুসা সোংঘে রাজ্যকে মাল্লি সঙ্গে সংযুক্ত করে নেন। কিন্তু ১৩৩৫ খ্রীস্টাব্দে রাজবংশটি পুনরায় স্থাপিত হয় (সোন্নি পদবী নিয়ে), যদিও সেটা তখনো অন্ততঃ নামে মাত্র মল্লির অধীন ছিল–অবশ্য মূল বার্বার বংশের শেষ নরপতি সেমি আলির রাজত্বকাল শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত (১৪৬৫-৯২)। ইনি মাল্পির বদৌলতে তার রাজ্য বিস্তৃত করেন। তার উত্তরাধিকারী হন তার সোনিনকে সেনাপতি মোহাম্মদ (১৪৯৩-১৫২৯)। ইনি ছিলেন আকিয়া রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা এবং এর প্রভাবে সোংঘে উন্নীত হয় ক্ষমতার শীর্ষ স্থানে। অতঃপর মরোক্কানদের আক্রমণে সোংঘে সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে এবং রাজবংশ লুপ্ত হয়। এরা ১৫৯১ খ্রীষ্টাব্দে গাও তিমবুতু দখল করেন।

৩৩। মাল্পি সাম্রাজ্যে নিমকের পাশাপাশি কড়ির বিনিময় হচ্ছে ১৪ টীকায় উল্লেখিত আফ্রিকা মহাদেশ ব্যাপী অবস্থিত সেকালের বাণিজ্য সম্পর্কের চূড়ান্ত প্রমাণ যেহেতু কড়ি কেবল নিরক্ষবৃত্ত এবং মোজামবিকের মাঝখানে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে পাওয়া যায় (Grande Encyclopedie s.v. Cauri)। ইব্‌নে বতুতার সময়ে সওদাগরগণ উত্তর থেকে কড়ি আমদানি করতেন (আল্-এমারি ৭৫-৭৬)।

৩৪। বারদামা উপজাতির বিশেষ করে তাদের মেয়েদের বর্ণনার সঙ্গে বার্থের তাগ হামা উপজাতির বর্ণনার ঘনিষ্ট মিল দেখা যায়। তাগ-হামগণ বাস করতো এয়ারের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে।

৩৫। তাগাদ্দা বা তাকাদ্দা ছিল সে সময়ে তুয়ারেগ দেশের বৃহত্তর শহর। এর বার্বার সুলতান নামে মাত্র মাল্পি ম্রাটের অধীন ছিলেন। ইনি সম্ভবতঃ মাসুফার (সানজাহা) প্রধান শাসক বলে পরিগণিত হতেন। তাগাদ্দার অবস্থান স্থান এখনো অনির্দিষ্ট। বার্থের নির্ধারণের উপর ভিত্তি করে এটাকে আগাদিসের ৯৭ মাইল পশ্চিম উত্তর-পশ্চিমে তেগিন্দা এ তিসেমৃত। বলে গ্রহণ করা হয়। বার্থ বছেন, এর আশেপাশে যদিও তামার অস্তিত্ব কোথাও দেখা যায় না, তথাপি এখানকার খনি থেকে এক প্রকার লাল নিমক পাওয়া যায়। গওতিয়ার এবং চাডিও (Missions au Sahara; ২য় খন্ড, ২৫৭) আওগাটা পর্বতশ্রেণীর (২৯১৫ উঃ ১৪০ প)ঃ অন্তর্গত তেমেগ্রাউন ছাড়া সাহারায় তামার অভাব উল্লেখ করেছেন–এবং বলেছেন এয়ার এবং আহাগারে যে সব তামা ব্যবহৃত হয় সেগুলি আসে ইউরোপ থেকে। তেগিদ্দায় তামার অভাব সম্বন্ধে এফ, আর, রড, ও বলেছেন। তিনি মনে করেন ইনে বতুতার তাগাদ্দার খোঁজ নিতে হবে “আগদেসের দক্ষিণে বেশ খানিকটা দূরে (পিপল আর দি ডেইল, ৪৫২-৬)। পরবর্তীজনের মত অনুসারে তেগিদা শব্দের অর্থ “পানি সংগ্রহ করে রাখার ক্ষুদ্র গহ্বর–এ নামটি বিভিন্ন স্থান সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়ে থাকে (cf. এইচ, এস, এন, ২য় খণ্ড, ১৯৩; মারকোয়ার্ট, ৯৮)। কিন্তু তাগাদ্দায় তাখনির অস্তিত্ব আল-ওমারি কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে মান্সা। মুসার তথ্যের উপরে (দেয়বাইসের অনুবাদ, ১ম খণ্ড,৮০-৮১)।

৩৬। কবার হচ্ছে গোবির বর্তমান সকোতরের উত্তর দিকের দেশ-দক্ষিণে তাগাদ্দার দ্বারা সীমায়িত। এখানে মবুতুর দক্ষিণ-পশ্চিম জেলার জন্য জাঘের অবস্থান কিনা, অথবা ক্যালেম এবং ওয়াদাই পরিবেষ্টিত মধ্য অঞ্চলের জন্য কি না যা অস্পষ্টভাবে জাঘাওয়া বলে পরিচিত, সেটা অনিশ্চিত।

৩৭। এখানে নাইজেরিয়ার বর্ণ অপেক্ষা অবস্থান ক্যানেমের জন্য। এ সময়ে ক্যানেম সাম্রাজ্য মধ্য সাহারা অতিক্রম করে উত্তর দিকে ফেজান এবং পূর্ব দিকে দার ফুর এবং উত্তর নাইজেরিয়ার ভিতরে বিস্তৃত হয়েছিল। এই ইদ্রিস (১৩৫৩-৭৬)। একে ষোড়শ শতাব্দীর বর্ণর প্রসিদ্ধ ইদ্রোসার সঙ্গে জড়িত করা ঠিক হবে না) হচ্ছেন ইব্রাহিম নিকেলের ছেলে। ইনি দক্ষিণ আরবীয় বংশজাত বলে দাবী করেন। ১৩০৭-৩৭ খ্রীস্টাব্দে পর্যন্ত ক্যানেমের সুলতান ছিলেন। রাজকার্যের ঐন্দ্রজালিক গুণাবলীর বিশ্বাস হেতু নরপতির এই গোপন অধিবাস (বার্থ ১ম খন্ড, ৬৩৮–৯; মিক, উত্তর নাইজেরিয়া, ১ম খণ্ড, ২৫৪)।

৩৮। জাওজওয়া অনেক স্থলে ককো বা কুকু বলে উচ্চারিত। এটা হচ্ছে লিও আফ্রিকানসের গাওগাও। স্থানটি হয় ওয়াদাইর ফিট্রে হ্রদের তীরের ফিরি কানেমের দক্ষিণ-পূর্ব অথবা এটা হচ্ছে বর্ণোর কুকু (মারকোয়ার্ট ৯৫, ff; Hartmann in M. S. ০. S. XV, 176 ff.) মুওয়াতাঁবুন কিম্বা মুর্তাবৃনের কোনো সন্ধান বের করতে আমি সক্ষম হইনি।

৩৯। মরক্কোর রাজার ওয়াফান বা রক্ষিদল ছিল স্থায়ী সৈন্য বাহিনীর কেন্দ্রস্থল। উপজাতীয় সৈন্য থেকে এরা ছিল ছিন্ন প্রকারের (মাসলিক আল–আসবার দেমবাইসের অনুবাদ, ইণ্ডেস্ এস, ডি,। দেমমবাইনের একটি পাণ্ডুলিপিতে ইয়ানতিবৃনের স্থানে ইনাতিউন পাঠ করা হয় (এ গ্রন্থেরই ২১০, n. টীকা ২ দ্রষ্টব্য)।

৪০। কাহির হচ্ছে এয়ারের রূপান্তরিত নাম। এ নামটি দেওয়া হয়েছে ইন্ আজাওয়া কিম্বা আসিওর দক্ষিণে অবস্থিত স্বল্প লোক বসতিপূর্ণ পাহাড়ের-দেশ। নিম্নে এটা সেখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে যেখানে তুয়া এবং মিশরগামী রাস্তা বিভক্ত হয়েছে। এটা আশ্চর্য যে ইব্‌নে বতুতা কাহিরকে প্রধান পর্বত তিন দিনের পথের ফারাক বলে ধরেছেন।

৪১। হ্যাগার বা হোগার হচ্ছে মধ্য সাহারার পর্বত অধিবাসী বার্বার (তুয়ারেগ) উপজাতি। এটা হচ্ছে পুরাকালীন আটলাস পর্বতশ্রেণী-এখন এর অধিবাসীগণের নামানুকরণে আহাগার নামে পরিচিত।

৪২। বুদা তুয়াত উপত্যাকার ২৮ উত্তরে, ০:৩০ পূর্বে উত্তরের শেষ সীমান্তে অবস্থিত। এ জেলাটির বিবরণ এবং ইতিহাসে বিবৃত করেছেন গাওতিয়ার এবং চাদিয়ো মিশনৃস্ সাহারা গ্রন্থে (প্যাসির, ১৯০৮) প্রথম খণ্ড, ২৫০। আরবীয় ভৌগলিকদের মত, অনুসারে মারাকুশের অধিবাসীগণও পঙ্গপাল আহার করতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *