১৪. কাজ
কাজকে সুখের কারণ রূপে স্থাপন করা উচিত না দুঃখের কারণরূপে, মনে হয় তা বিবেচনা করা হচ্ছে একটা সন্দেহজনক প্ৰশ্নরূপে। এমন অনেক কাজ আছে যা খুবই ক্লান্তিকর এবং অতিরিক্ত কাজ করা সব সময়েই খুব কষ্টকর। কিন্তু আমি মনে করি অধিকাংশ লোকের কাছে কাজটা যদি অতিরিক্ত না হয়, সেই কাজ সবচেয়ে নীরস হলে অলসতার চেয়ে কম দুঃখের। কাজের সবরকম শ্রেণী আছে। কাজের প্রকৃতি এবং কর্মীর দক্ষতা অনুযায়ী সেসব শ্রেণীর একপ্রান্তে যেমন থাকে একঘেয়েমির হাত থেকে মুক্তি, অন্যপ্রান্তে থাকে গভীরতম আনন্দ। অধিকাংশ লোক যেসব কাজ করে তার উল্লেখযোগ্য অংশই শুধু কাজ বলেই তা আকর্ষণীয় তা নয়। তবু এমন কাজেরও কয়েকটি বড় সুবিধার দিক রয়েছে। কাজে শুরুতে কী করা উচিত তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন বোধ না করেই দিনের অনেকটা সময় কাজ করা যায়। অধিকাংশ লোকই যখন তারা নিজের পছন্দ অনুযায়ী কাজে সময় কাটাবার স্বাধীনতা পায়, তখন কোন কাজে তারা প্রচুর আনন্দ পাবে তা চিন্তা করতে পারে না এবং যখন একটা কিছু ঠিক করে, তখন ভাবে অন্য কাজটা করলে হয়তো বেশি আনন্দের হত। অবসর সময় কীভাবে বুদ্ধিমত্তার সাথে কাটানো যায় সেটা স্থির করাই হচ্ছে সভ্যতার শেষ কাজ এবং এখন পর্যন্ত কম লোকই সেই স্তরে পৌঁছাতে পেরেছে। তাছাড়া, পছন্দ করার কাজটাও তো ক্লান্তিকর। অসাধারণ উদ্যোগী ছাড়া, অন্যদের উপদেশ দেওয়া যদি খুব বেশি অসন্তোষজনক না হয়, তা হলে দিনের প্রতিটি ঘণ্টা কী করতে হবে তা বলে দেওয়া হয় তাহলে ভালই লাগে। অধিকাংশ কর্মহীন ধনীরা অবর্ণনীয় রকমের একঘেয়েমিতে ভোগে, যা থেকে মুক্তির জন্যে অনেক কঠিন মূল্য তাদের দিতে হয়। কখনো তারা মুক্তি খোঁজে আফ্রিকায় পশু শিকার করে, কখনও আকাশযানে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে। কিন্তু এ ধরনের উত্তেজনাময় কাজের সংখ্যা সীমিত, বিশেষ করে যখন যৌবন অতিক্রান্ত হয়। সে জন্যে যেসব ধনীব্যক্তি বুদ্ধিমান তারা যদি গরীব হতেন তখন যেমন পরিশ্রমের কাজ করতেন, প্রায় তেমন পরিশ্রম করেন। আর ধনী মহিলারা এমন সব অসংখ্য নগণ্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, যার মাটি-কাঁপাননা গুরুত্ব বিষয়ে তাদের ধারণাকে কেউ বদলাতে পারবে না।
সুতরাং বিরক্তির প্রতিষেধক হিসাবে প্রথম এবং প্রধান স্থান হল কাজের। কারণ প্রয়োজনীয় অথচ নীরস কাজ করতে গিয়ে যে বিরক্তি জাগে তা কোনও কাজ না থাকার বিরক্তির তুলনায় কিছুই নয়। কাজের এই সুবিধার সাথে আরো একটা সুবিধা যুক্ত আছে তা হল ছুটির দিন যখন আসে তা অনেক বেশি আনন্দময় হয়ে ওঠে। যদি অবশ্য এমন কঠিন কাজ কোনও মানুষকে করতে না হয়, যা তার জীবনীশক্তি নষ্ট করে দেয়, তাহলে সে অলস লোকের কাজের চেয়ে ছুটির সময়ে তৃপ্তির স্বাদ পেতে অনেক বেশি উদ্দীপনা খুঁজে পাবে।
পারিশ্রমিক পাওয়া অধিকাংশ কাজের এবং বিনা পারিশ্রমিকের কিছু কাজের দ্বিতীয় সুবিধা এই যে, তা উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্যে সাফল্য এবং সম্ভাবনা এনে দেয়। অধিকাংশ কাজের সাফল্য পরিমাপ করা হয় উপার্জন দিয়ে এবং যতদিন আমাদের ধনতান্ত্রিক সমাজ থাকবে তাকে লঙ্ঘন করা যাবে না। একমাত্র শ্রেষ্ঠ কাজের ক্ষেত্রেই এই পরিমাপ প্রয়োগ করা হয় না। মানুষের উপার্জন বাড়ানোর ইচ্ছা যতটুকু সাফল্যের ইচ্ছাও ততটুকু কারণ অতিরিক্ত উপার্জনেই শুধু অতিরিক্ত আরাম পাওয়া যাবে। কাজ যত নীরসই হোক তাতে যদি সুনাম প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তা সহ্য করাও যায়– তা সেই প্রতিষ্ঠা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ুক অথবা নিজের সমাজ-চক্রের মধ্যেই থাকুক। উদ্দেশ্যের অবিচ্ছিন্নতাই হচ্ছে আগামী দিনের সুখের প্রয়োজনীয় উপকরণের মধ্যে একটি এবং প্রায় অধিকাংশ লোকের জীবনে তা আসে কাজের ভিতর দিয়ে। এই বিষয়ে সেসব রমণীদের গৃহকর্মে ব্যস্ত থাকতে হয়, তারা পুরুষদের তুলনায় অথবা যেসব রমণী বাইরে কাজ করে তাদের চেয়ে কম ভাগ্যবতী। যে নারী সংসারের কাজ করে তার জন্যে কোনও পারিশ্রমিক পায় না। তার নিজের অবস্থা ভাল করার কোনও উপায় নেই, স্বামী শুধু তাকে স্বীকার করে নেয় (সে কী করে তা প্রায় দেখেই না)। কিন্তু গৃহকর্মের জন্যে তার কোনও মূল্য নেই, যদি অন্য কোনও গুণ থাকে তবে সে তার মূল্য পায়। যেসব রমণী অবশ্য যথেষ্ট স্বচ্ছল তাদের বেলায় তা প্রযোজ্য নয়। তারা সুন্দরভাবে ঘর সাজাতে পারে, সুন্দর বাগান করতে পারে এবং ক্রমে। প্রতিবেশীদের ঈর্ষার পাত্রী হয়। কিন্তু তাদের সংখ্যা বড় কম। অধিকাংশ রমণীর পক্ষেই গৃহকর্ম সেই পরিমাণ তৃপ্তি দেয় না, যা পুরুষদের এবং পেশাজীবী নারীদের অন্যসব কাজ দেয়। সময় কাটাবার এবং যত অল্পই হোক, উচ্চাকাঙ্ক্ষা সার্থক করে তোলার জন্যে কিছু পথ খুলে দেওয়ার মূল্য কাজের মধ্যেই বেশি পাওয়া যাবে এবং যার কাজ বিরক্তিকর, তাকেও কর্মহীনের তুলনায় বেশি তৃপ্তি দেবে। কিন্তু কাজ যখন আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে তখন তা শুধুমাত্র একঘেয়েমি থেকে মুক্তির চেয়ে অনেক ওপরের স্তরের তৃপ্তি দিতে পারে। আমি যেসব কাজের আকর্ষণ কোমল, তা থেকে শুরু করে একজন মহান ব্যক্তির সম্পূর্ণ শক্তি নিয়োজিত করে রাখার মতো উপযুক্ত কাজ দিয়ে এই সাজানোটা শেষ করব।
দুটি প্রধান উপকরণ কাজকে আকর্ষণীয় করে : প্রথম, দক্ষতার প্রয়োগ এবং দুই. নির্মাণ।
অসাধারণ দক্ষতার অধিকারী প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের দক্ষতা প্রয়োগ করতে ভালবাসে যতক্ষণ পর্যন্ত না তা সহজ হয়ে আসে অথবা যতক্ষণ পর্যন্ত না সে নিজের দক্ষতার আরও উন্নতি করতে পারে। শৈশবের প্রথম থেকেই কাজের প্রেরণা শুরু হয়। যে বালক মাথায় ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারে, সে পায়ের ওপর দাঁড়াতে অনিচ্ছুক হয়। একটা বড় কাজে যে আনন্দ পাওয়া যায়, দক্ষতার খেলা থেকেও তা লাভ করা যায়। একজন আইনজীবী বা একজন রাজনীতিকের কাজের মধ্যে যে আনন্দ পাওয়া যায় তা তাসের ব্রীজ খেলা থেকে পাওয়া আনন্দের সমতুল্য। অবশ্য এখানে শুধু দক্ষতার প্রয়োগ নয়, দক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে দেওয়ার আনন্দও আছে। কিন্তু যেখানে এই প্রতিযোগিতার উপাদানটি অনুপস্থিত সেখানেও কঠিন কৃতিত্ব প্রদর্শন করা সম্ভব। যে ব্যক্তি আকাশে বিমান নিয়ে নানারকম কৌশল দেখাতে পারে এবং তাতে যে গভীর আনন্দ পায় তার জন্যেই জীবনের ঝুঁকি নিতে পারে। আমি কল্পনা করতে পারি একজন দক্ষ শল্যচিকিৎসক যে অবস্থায় কাজ করেন তা বেদনাদায়ক হলেও তিনি তার নিখুঁত সূক্ষ্ম অস্ত্রোপচারের পর তৃপ্তি লাভ করেন। একই রূপ আনন্দ তীক্ষ্ণতার কিছু কম হলেও সাধারণ মানের কাজ থেকেও পাওয়া যায়। আমি প্লাম্বার কারিগরের কথা শুনেছি যে তার কাজ থেকে আনন্দ পায়, যদিও এমন কারো সাথে দেখা হওয়ার সুযোগ আমার হয় নি। নৈপুণ্যের সব কাজই আনন্দজনক হতে পারে যদি অবশ্য সেই নৈপুণ্য প্রয়োজনে পরিবর্তনশীল হয় অথবা তাতে সেই সুযোগ থাকে যার সীমা বেঁধে দেওয়া নেই। এইসব শর্ত যদি অনুপস্থিত থাকে তা হলে যে ব্যক্তি নৈপুণ্যের উচ্চতম ধাপে পৌঁছেছে তার কাছে কাজ আর আকর্ষণীয় থাকবে না। যে ব্যক্তি তিন মাইলের দৌড়ে প্রতিযোগিতা করে, যখন এই পেশায় যোগ দেওয়ার বয়স পার হয়ে যাবে তখন আর এই প্রতিযোগিতায় আনন্দ পাবে না। সৌভাগ্যের কথা, অনেক কাজ আছে যার নতুন অবস্থায় নতুন রকম নৈপুণ্যের প্রয়োজন হয় এবং যে ব্যক্তি কর্মরত তার পক্ষে মধ্য বয়সে ক্রমে ক্রমে উন্নতির ধাপে উঠে যাওয়া সম্ভব হয়। কিছু দক্ষতার কাজ আছে যেমন রাজনীতি, তাতে সফল হওয়ার উপযুক্ত বয়স হল ষাট থেকে সত্তর, তার কারণ হচ্ছে এ ধরনের কাজে অন্য লোক সম্পর্কে ব্যাপক অভিজ্ঞতা অতি প্রয়োজনীয়। এইজন্যে সত্তর বছর বয়সের সকল রাজনীতিক সম বয়সের অন্যান্য লোকের চেয়ে বেশি সুখী। এই বিষয়ে তাদের একমাত্র প্রতিযোগী হচ্ছে বড়বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা।
উৎকৃষ্ট কাজের আরো একটি উপকরণ আছে যা সুখের উৎসরূপে দক্ষতা প্রয়োগের চেয়েও বেশি মূল্যবান, তা হচ্ছে সৃষ্টি করার কাজ। কিছু কাজে অবশ্যই, তবে অধিকাংশ কাজেই নয়, কিছু নির্মাণ করা যায় এবং কাজের শেষে যা কৃতিত্বের স্তম্ভরূপে থেকে যায়। কাজের গুণগত মানে কোনটি সৃষ্টি আর কোনটি ধ্বংস তা আলাদা করা যায়। সৃষ্টির কাজে প্রথমদিকে অবস্থাটি কিছু বিশৃঙ্খল থাকলে, কাজ শেষ হওয়ার পর লক্ষ্যটা বাঝা যায়। ধ্বংসের কাজে এর বিপরীতটাই ঠিক। এর প্রথম দিকে থাকে লক্ষ্য এবং শেষের দিকে হয়ে পড়ে বিশৃঙ্খল। সুতরাং বলা যায় ধ্বংসকারীর লক্ষ্যই হচ্ছে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করা, যার ভিতর কোন উদ্দেশ্য ফুটে উঠবে না। কোনও দালান নির্মাণ করা বা ভেঙ্গে ফেলার কাজে এটি সবচেয়ে স্পষ্ট এবং এই গুণমান আক্ষরিক অর্থে প্রয়োগ করা যায়। দালান নির্মাণে পূর্বে রচিত পরিকল্পনার বাস্তবায়িত করতে হয়। কিন্তু সেটি ভেঙ্গে ফেলতে হলে তার সব উপকরণ কীভাবে থাকবে তা নিয়ে কেউ সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, পরবর্তী নির্মাণের জন্যে অনেক ক্ষেত্রেই প্রাথমিক বিনষ্টি প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে এটি সম্পূর্ণ কাজের একটি অংশমাত্র, আলাদা নয়। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় পরবর্তী নির্মাণের কথা মনে না রেখেই লোকে প্রথমে ধ্বংসের কাজ শুরু করে। দেখা যায় এই কথাটা সে এই বিশ্বাসে নিজের কাছেও গোপন রাখে যে, নতুন নির্মাণের জন্যেই সে সব কিছু ভেঙে পরিষ্কার করছে। কিন্তু এটা যদি ছলনা হয়, তবে তার সেই ছলনার মুখোশ খুলে ফেলা সাধারণত অসম্ভব নয়, শুধু তাকে প্রশ্ন করতে হয়, এর পরবর্তী নির্মাণের কাজটা কী। এই বিষয়ে এটা পরিষ্কার হবে যে, উত্তরে সে স্পষ্ট কিছু বলতে পারছে না এবং বলার মতো উৎসাহও নেই তার। অথচ প্রাথমিক ধ্বংসের কাজে সে খুব নির্দিষ্টভাবে এবং উদ্দীপনার সাথে সব বলেছিল। অনেক বিপ্লবী, যুদ্ধবাদী এবং হিংসার দূতদের সম্পর্কে একথা বলা যায়, তবে কর্মপ্রেরণার উৎস হল ঘৃণা করে তাদের ধ্বংস করা। কিন্তু তারপর কী হবে সে বিষয়ে তাদের কোনও ধারণা নেই। আমি একথা অস্বীকার করতে পারি না যে সৃষ্টির মতো ধ্বংসের মধ্যেও আনন্দ আছে। এই আনন্দ ভয়ংকর এবং কোনও কোনও মুহূর্তে আরো তীব্র, কিন্তু তাতে কোনও গভীরতা নেই কারণ ধ্বংসের যা পরিণাম তার মধ্যে তৃপ্তির স্থান থাকে না। আপনি আপনার শত্রুকে হত্যা করলেন, তখন সে মারা গেল আপনার সব কাজ শেষ এবং বিজয় থেকে যে তৃপ্তি পেলেন তা অতি দ্রুত মিলিয়ে যাবে। অন্যপক্ষে নির্মাণের কাজ যখন সমাপ্ত হয়, তখন তা নিয়ে ভাবতেও আনন্দ। তা ছাড়া পরে আর কিছুই করার প্রয়োজন হবে না এমন পূর্ণাঙ্গভাবে তা কখনও শেষ হয় না। সবচেয়ে তৃপ্তিজনক উদ্দেশ্য তাই, যা একের পর এক সাফল্যের পথ খুলে দেয় যা কখনও থামে না। এতে কোনও সন্দেহ নেই যে ধ্বংসের তুলনায় নির্মাণই সুখের বড় উৎস। আরো বিশুদ্ধভাবে বলা যায়, যারা সৃষ্টির কাজে যে আনন্দ পায়, আর ধ্বংসের কাজে যারা আনন্দ পায়, তাদের কোনও তুলনা চলে না। কারণ মনে একবার ঘৃণা জাগলে নির্মাণকাজে অন্য লোক যে আনন্দ পায়, তেমন আনন্দ সহজলভ্য নয়।
একথাও বলা যায়, গুরুত্বপূর্ণ কোনও রকম নির্মাণ কাজের সুযোগ পেলে ঘৃণার অভ্যাস যত সহজে দূর করা যায়, অন্য কিছুতে তা সম্ভব নয়।
বড় কোনও সৃষ্টিধর্মী কাজের সাফল্যে যে তৃপ্তি পাওয়া যায় তা জীবনে প্রাপ্তব্য সেরা আনন্দসমুহের মধ্যে অন্যতম। যদিও দুর্ভাগ্যবশত এই শ্রেষ্ঠ আনন্দ শুধু বিশেষভাবে দক্ষ লোকদের জন্যেই উন্মুক্ত। গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাফল্য থেকে যে আনন্দ তা থেকে কোনও মানুষকে কেউ বঞ্চিত করতে পারে না, যদি না দেখা যায় শেষ পর্যন্ত যে তার কাজই ছিল বিশেষভাবে খারাপ। এই তৃপ্তির অনেক প্রকারভেদ আছে। যে লোকটি একটি সেচ প্রকল্পের সাহায্যে তার পতিত জমিকে একটি গোলাপের মতো প্রস্ফুটিত করে তুলেছে সে তাকে অত্যন্ত স্পষ্ট স্পর্শনযোগ্য রূপেই উপভোগ করবে। কোনও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ হতে পারে। যে অল্প কজন রাষ্ট্রনায়ক বিশৃঙ্খল পরিবেশকে নতুন শৃঙ্খলায় রূপায়নে জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের কাজও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এঁদের মধ্যে এ যুগে লেনিন একটি মহৎ উদাহরণ। শিল্পী এবং বিজ্ঞানীরা সবচেয়ে প্রত্যক্ষ উদাহরণ। শেক্সপীয়র তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলেছেন : যতদিন মানুষের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস থাকবে, চোখে থাকবে দৃষ্টি, ততদিন এইগুলি বেঁচে থাকবে। এবং এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে এই ভাবনা তাঁকে দুর্ভাগ্যে সান্ত্বনা জুগিয়েছিল। তাঁর সনেটের ভিতর দিয়ে তিনি বলেছেন তার বন্ধুর সম্বন্ধে ভাবনা তাঁকে জীবনের সাথে আপোস করে চলতে সক্ষম করে তুলেছে। কিন্তু যেসব সনেট তিনি বন্ধুর উদ্দেশ্যে রচনা করেছিলেন সেসব যে তার বন্ধুর চেয়ে তাঁর এই উদ্দেশ্যপূরণে বেশি কার্যকর হয়েছিল, এমন একটি সন্দেহ আমার রয়ে গেছে। বড় শিল্পী এবং বড় বিজ্ঞানসেবকরা যে কাজ করেন তা নিজেই আনন্দপূর্ণ। যতক্ষণ তারা এই কাজ করবেন ততক্ষণ তারা যোগ্য লোকের কাছ থেকে শ্রদ্ধা পেয়ে যাবেন। এতে তারা সর্বাপেক্ষা মৌলিক ধরনের ক্ষমতার অধিকারী হন, যে ক্ষমতা হচ্ছে মানুষের চিন্তা এবং চেতনার ওপর প্রভাব। নিজেদের সম্পর্কে ভাল চিন্তা করার সবচেয়ে শক্তিশালী কারণ তাদের রয়েছে। মনে হয় এইসব সুন্দর ঘটনার মিলন যে কোনও ব্যক্তিকে সুখী করার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু তবু এরকম ঘটে না। উদাহরণস্বরূপ মাইকেল এঞ্জেলোর নাম করা যেতে পারে। তিনি খুব অসুখী মানুষ ছিলেন এবং বলতেন (না, আমি নিশ্চিত, তিনি সত্যি বলতেন না) যে, যদি তাকে তার দরিদ্র আত্মীয়দের ঋণ পরিশোধ করতে না হত, তাহলে তিনি ছবি আঁকার কষ্টটা আর সহ্য করতেন না। সবসময়ে না হলেও, অধিকাংশ সময়েই মহৎ শিল্পসৃষ্টির ক্ষমতার সাথে মেজাজগত একটা অশান্তির যোগ থাকে এবং তা এতই প্রবল যে, শিল্পী তাঁর কাজ থেকে আনন্দ খুঁজে না পেলে বাধ্য হয়ে তাকে আত্মহত্যার পথে যেতে হয়। তাই আমরা মনে করতে পারি না যে মহৎ সৃষ্টি হলেই তা মানুষকে সুখী করবে, আমরা শুধু বলতে পারি এটি তাকে কম অসুখী করবে। বিজ্ঞানসেবীরা কিন্তু শিল্পীদের তুলনায় মেজাজগতভাবে অনেক কম সুখী এবং সাধারণভাবে যারা বিজ্ঞান নিয়ে মহৎ কাজ করেন তারা সুখী মানুষ। মূলত এই সুখ তারা লাভ করেন তাঁদের কাজ থেকে।
বর্তমানে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সুখহীনতার একটা কারণ হল, বিশেষ করে যাদের সাহিত্যে দক্ষতা আছে, তাদের অনেকেই স্বাধীনভাবে নিজেদের মেধাকে কাজে লাগানোর সুযোগ পান না। তারা শিক্ষাদীক্ষাহীন লোকদের দ্বারা পরিচালিত বৃহৎ সব সংস্থায় কর্মীরূপে কাজ করেন। সেসব পরিচালকদের নির্দেশে তাদের এমন সব জিনিস লিখতে হয়, যা তারা নিজেদের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে মনে করেন। যদি ইংল্যান্ড অথবা আমেরিকার সাংবাদিকদের কাছে অনুসন্ধান করা যায়, তাঁরা যে পত্রিকায় কাজ করেন তার নীতিমালায় তাদের বিশ্বাস রয়েছে কিনা, তাহলে জানা যাবে খুব কম সংখ্যক সাংবাদিকই মালিকদের নীতিতে বিশ্বাসী। বাকি অন্য সকলে শুধুমাত্র জীবিকার প্রয়োজনে নিজেরা যে নীতিকে ক্ষতিকর মনে করে তার কাছেই তাদের দক্ষতা বিক্রি করে দেয়। এই ধরনের কাজে কখনও আসল তৃপ্তি থাকে না এবং কাজের সাথে আপোস করতে গিয়ে তাদের মন এমন বিষময় হয়ে ওঠে যে, সেই মন আর কোনও কিছু থেকেই আন্তরিকভাবে কোনও তৃপ্তি খুঁজে নিতে পারে না। এরকম কাজ যাদের দায়ে পড়ে করতে হয় তাদের আমি নিন্দা করতে পারি না, কারণ এর যা বিকল্প তা হল অনাহার, যা আরো ভয়ানক। কিন্তু আমি মনে করি যেখানে কোনও ব্যক্তির সৃজনি প্রতিভার পক্ষে তৃপ্তিকর কাজ করা সম্ভব এবং সম্পূর্ণ অনাহারও এড়ানো যায়, সেখানে তাকে এই পরামর্শ দেওয়া চলে, সেখানে উচ্চ সাম্মানিক হলেও তা বর্জন করে নিজের সুখ এবং তৃপ্তিদায়ক কাজকে অগ্রাধিকার দিয়ে গ্রহণ করা উচিত। আত্মসম্মানকে বিসর্জন দিয়ে যথার্থ সুখ লাভ করা সম্ভবই নয় বলতে হবে। যে লোক নিজের কাজের জন্যে সংকুচিত সে খুব কমই আত্মসম্মান লাভ করে।
সৃষ্টিশীল কাজের তৃপ্তি, এখন অল্প কিছুসংখ্যক লোকের বিশেষ সুবিধা হলেও অনেক লোকের পক্ষে এই বিশেষ সুবিধা পাওয়া সম্ভব নয়। যে লোক নিজেই নিজের কাজের নিয়ন্তা সে এটা অনুভব করতে পারে। অথবা যে লোকের কাছে তার কাজ প্রয়োজনীয় মনে হবে এবং সেই কাজে যথেষ্ট দক্ষতা প্রয়োজন, সেও তা অনুভব করতে পারবে। মনের মতো সন্তানকে গড়ে তোলা একটি কঠিন সৃষ্টিমূলক কাজ। যা গভীর তৃপ্তি দিতে পারে। যে মা এটি সম্ভব করতে পেরেছে সে অবশ্যই অনুভব করতে পারবে যে তার পরিশ্রমের ফলে পৃথিবী এমন কিছু মূল্যবান জিনিস পেয়েছে যা অন্যভাবে পাওয়া যেত না।
জীবনকে সামগ্রিকরূপে দেখার প্রবণতার মধ্যে মানুষে-মানুষে বিস্তর পার্থক্য। কিছু লোকের পক্ষে এরকম দেখা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার এবং কিছু কাজ তৃপ্তির সাথে করতে পারলেও তা তাদের সুখের জন্যে প্রয়োজনীয়। আবার কিছু লোকের কাছে জীবন হল পরপর ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন ঘটনার সমাবেশ, তাদের নির্দিষ্ট কোনও গুগতি নেই, পরস্পরের মধ্যে কোনও ঐক্যসূত্রও নেই। আমার মনে হয়, প্রথমে যাদের কথা বললাম তারা অন্যদের তুলনায় বেশি সুখলাভ করতে সক্ষম, কারণ তারাই ক্রমশ সেইরকম অবস্থা তৈরী করে নেবে যা থেকে তারা আনন্দ এবং আত্মসম্মান পেতে পারবে। অপরদিকে অন্যেরা, একবার এদিক, আরেকবার ওদিক করে বিশৃঙ্খল ঘটনার আবর্তে ঘুরপাক খাবে। কখনো কোনও বন্দরে গিয়ে পৌঁছাবে না। জীবনকে সামগ্রিকভাবে দেখার অভ্যাস হল, জ্ঞান এবং বিশুদ্ধ নৈতিকতা– এই দুয়েরই অপরিহার্য অঙ্গ এবং আর যা প্রাধান্য পাওয়া উচিত, তা হল শিক্ষা। সঙ্গতিপূর্ণ উদ্দেশ্য জীবনকে সুখী করার জন্যে যথেষ্ট নয়। সুখী জীবনের জন্যে তাই হল অপরিহার্য অঙ্গ। আর সঙ্গতিপূর্ণ উদ্দেশ্য প্রধানত কাজের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।