১৪. কলকাতার মন্দির মসজিদ গির্জা

কলকাতার মন্দির মসজিদ গির্জা

কলকাতা শহরে সকল ধর্মসম্প্রদায়ের লোক বাস করেন, আর্মেনিয়ান ইহুদি পার্সি বৌদ্ধ জৈব হিন্দু মুসলমান খ্রীস্টান। এশিয়ার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত প্রচীন শহরগুলির মধ্যে কলকাতা অন্যতম। সেই কারণে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোকজনের বিচিত্র সমাবেশ কলকাতা শহরে যেমন হয়েছে, তেমন আর ভারতের অন্য কোনো ব্রিটিশ আমলের শহরে হয় নি, বোম্বাই মাদ্রাজ দিল্লী কোথাও না। বাংলার আধুনিক যুগের রাজধানী কলকাতার ঐতিহাসিক চরিত্র ভারতের আর কোনো সমকালীন শহরের নেই। যেমন ভারতের অধিকাংশ শহরেই হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ও প্রধান। কলকাতা শহরেও তাই। কিন্তু কলকাতার হিন্দু প্রাধান্যের বৈশিষ্ট্য তার ‘বাঙালিত্ব’ যদিও অবাঙালি হিন্দুর সংখ্যা কলকাতাতে যথেষ্ট। বোম্বাই মাদ্রাজ দিল্লী প্রভৃতি শহরেও হিন্দুরা প্রধান, কিন্তু তার সঙ্গে কলকাতার হিন্দু প্রাধান্যের মৌল পার্থক্য হল এই বাঙালিত্বে। বাঙালি হিন্দুর ধর্মানুষ্ঠান উৎসবপার্বণ দেব-দেবালয়-প্রীতির বৈচিত্র্য-বৈশিষ্ট্য কোনো অবাঙালি হিন্দুর নেই। যেমন বাঙালির মিষ্টান্নের বৈচিত্র্য, তেমনি বাঙালির দেবদেবীর ও উৎসবপার্বণের বৈচিত্র্য। তাই কলকাতা শহরে দেব-দেবালয়ের এবং উৎসব পার্বণের এমন আশ্চর্য বৈচিত্র্য দেখা যায়, যা বাঙালি হিন্দুর বিশিষ্ট ধর্মজীবনের প্রকাশ। কলকাতা শহরের বহু দেব-দেবীর মন্দিরে বাঙালি হিন্দুর ধর্মজীবনের এই বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ হয়েছে। তার সঙ্গে ক্যাথলিক প্রটেস্ট্যান্ট ও অন্যান্য খ্রীস্টান উপসম্প্রদায়, শিয়াসুন্নী মুসলমান উপসম্প্রদায়, এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়, অর্থাৎ গির্জা মসজিদ ইত্যাদি মিলিত হয়ে কলকাতার ধর্মীয় স্থাপত্যকে সমৃদ্ধ এবং সাংস্কৃতিক জীবনকে উৎসব উচ্ছ্বাসবহুল করেছে।

কলকাতার মন্দির

কলকাতা শহরে মন্দিরের সংখ্যা কত, শহরতলি অঞ্চল নিয়ে, তা সঠিক বলা কঠিন, এমন কি গণনা করাও সহজ নয়। কিছুদিন আগে সংবাদপত্রের একটি খবর থেকে জানা যায়, ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ সাল, এই পাঁচ বছরের মধ্যে কর্পোরেশনের জমি বে-আইনীভাবে দখল করে কলকাতায় ২৩৫টি মন্দির তৈরি করা হয়েছে (দি স্টেটসম্যান, ১৫মে ১৯৭০)। হঠাৎ ষাটের দশকের শেষার্ধে শহর কলকাতায় দেবভক্তির প্রাবল্যবশত অথবা অন্য কি কারণে এই মন্দির নির্মাণের জোয়ার এসেছিল তা সমাজবিজ্ঞানীর অনুসন্ধানের বিষয়। তার আগে বিশ শতকে কি হারে কলকাতায় মন্দির নির্মিত হয়েছে তার কোনো হিসেব কর্পোরেশন দেন নি অথবা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি। অনুমান করা যায়, ১৯০০ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে অন্তত পাঁচশত মন্দির কলকাতায় গড়ে উঠেছে। বিশ শতকের আগে উনিশ ও আঠার শতকে যে সমস্ত মন্দির গড়া হয়েছে তার সংখ্যাও কয়েক শত এবং সেগুলিকে বয়সের দিক থেকে ‘প্রাচীন’ বলা যাতে পারে। এই সমস্ত মন্দিরের মধ্যে অধিকাংশই ঠাকুরবাড়ি নামে পরিচিত। ‘ঠাকুরবাড়ি’কে মন্দির বা দেবালয় না বলে, দেবপ্রাসাদ বলাই সংগত। ঠাকুরবাড়িগুলি ঠাকুরের মালিক যাঁরা তাঁদের প্রাসাদোপম বাসভবনের মডেলে নির্মিত। অর্থাৎ যাঁর যেরকম বসবাসের বাড়ি তাঁর সেইরকম ঠাকুরবাড়ি, এবং যাঁর যেরকম জীবনযাপনের স্টাইল বা রীতি, তাঁর ঠাকুরবাড়িতেও ঠাকুরের জন্য সেইরকম ব্যবস্থা। অনেক ঠাকুর বাড়িতে দেখেছি, গ্রীষ্মকালে ঠাকুর যে মহলে থাকেন, শীতকালে সেই মহল ছেড়ে অন্য মহলে যান। শীতকালের মহলে উৎকৃষ্ট তুলো-পালকের লেপ, কাশ্মীরী শাল-আলোয়ানের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এবং গ্রীষ্মকালের মহলে আগে টানাপাখা ছিল, এখন বৈদ্যুতিক ফ্যানের সুব্যবস্থা। ভক্তের life-style ভক্তির ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আরাধ্য দেবদেবীর উপরে আরোপিত হয়। শুধু কলকাতা শহরে নয়, বাংলার গ্রামাঞ্চলে বড় বড় রাজামহারাজা ও জমিদারদের ঠাকুরবাড়িতে এই একই দৃশ্য দেখা যায়। বলা বাহুল্য, এই সমস্ত ভাগ্যবান দেবদেবী যাঁরা প্রসাদোপম ঠাকুরবাড়িতে বাস করেন, প্রাতরাশ থেকে মধ্যাহ্নভোজে নৈশভোজে বহুবিচিত্র ভোগাদি সেবা করেন, তাঁরা প্রায় সকলেই ‘বৈষ্ণব’ দেবতামণ্ডলীভুক্ত। তাঁদের উৎসবপার্বণের (যেমন দোলযাত্রা রাসযাত্রা ইত্যাদি) সমারোহের বৈচিত্র্যও মালিকভক্তদের বিবাহ শ্রাদ্ধ ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আড়ম্বরের অনুরূপ। স্বভাবতই এই দেব-দেবীরা কদাচিৎ শৈব বা শাক্তমণ্ডলীভুক্ত, কারণ যেমন শিব তেমনি কালী বা যে কোনো শক্তি দেবী মাটির কাছে মানুষের সঙ্গে থাকতে ভালবাসেন এবং তাঁদের দেবালয় বা মন্দির অথবা উৎসবপার্বণ কোনোটাতেই বিলাসবহুল বৈচিত্র্য প্রকাশের সুযোগ নেই। শিব সামান্য বেলপাতা গঙ্গাজলেই সন্তুষ্ট, কালীও জবাফুল এবং কয়েকটি পাঁঠাবলিতেই খুশি। অতএব কলকাতা শহরের মন্দিরের মধ্যে যেমন ‘ঠাকুরবাড়ি’র প্রাধান্য, তেমনি ঠাকুরের মধ্যে বৈষ্ণব দেবদেবীর প্রাধান্য এবং তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিরংকুশ। তার কারণ তাঁদের প্রতিষ্ঠাতা সেবক ভক্তবৃন্দ সকলেই প্রায় ব্রিটিশ আমলের নব্যধনিক হিন্দু রাজামহারাজা। সারাজীবন তাঁদের ধনসম্পত্তি অর্জন-সঞ্চয়ের জন্য যে ন্যায়নীতি বহির্ভুত কৌশলাদি অনেক সময় তাঁরা গ্রহণ করেছেন, তার একটা মানসিক গুরুভার আছে। এই গুরুভার হালকা করার জন্য তাঁদের দেবভক্তি প্রধানত দেবালয় নির্মাণে এবং উৎসব-পার্বণের বিলাসিতার খাতে চালিত হয়েছে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে মানসিক রেচন (catharsis) বলা যায়।

ঠাকুরবাড়ির সংখ্যা উত্তর-কলকাতায় বেশি, কারণ কলকাতার প্রাচীন ধনিক বাঙালি পরিবার অধিকাংশই উত্তর-কলকাতাবাসী। বড়বাজার বাগবাজার শোভাবাজার শ্যামবাজার থেকে বৌবাজারের মধ্যে বড় বড় ঠাকুরবাড়িগুলি প্রতিষ্ঠিত। বড়বাজার অঞ্চলে প্রাচীন বাঙালি তন্তুবণিক শেঠ-বসাকদের (বৈষ্ণবচরণ শেঠ, যাদবেন্দু শেঠ, শোভারাম বসাক প্রভৃতি) মধ্যে অনেকে বড় বড় ঠাকুরবাড়ি ও গঙ্গার ঘাট নির্মাণ করেছিলেন। শোভাবাজারের রাজাদের ঠাকুরবাড়ি, বাগবাজারের ঐতিহাসিক মদনমোহনের (বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুরের রাজাদের কাছ থেকে বন্ধকসূত্রে প্রাপ্ত বলে কথিত) ঠাকুরবাড়ি, ভূকৈলাস-খিদিরপুরে ঘোষালদের ঠাকুরবাড়ি, রাজেন্দ্র মল্লিক, বলাইচাঁদ দত্ত, মাণিকলাল দত্ত প্রভৃতির ঠাকুরবাড়ি উল্লেখযোগ্য। কেউকেউ কলকাতার সীমানার বাইরে কাছাকাছি অঞ্চলে ঠাকুরবাড়ি স্থাপন করেছিলেন। যেমন ধনকুবের মতিলাল শীল ঠাকুরবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর জীবদ্দশায় বেলঘরিয়ায়, এবং তাঁর ট্রাস্টিরা বেহালায়। এই সমস্ত ঠাকুরবাড়িতে অধিষ্ঠিত বিগ্রহের নামের একটি ছোট তালিকা করা যায়। যেমন :

গোবিন্দজীউ লক্ষ্মীজনার্দনজীউ

গোপীনাথজীউ গোপাললালজীউ

রাধাগোবিন্দজীউ রাধাকান্তজীউ

রাধা-মদনমোহন জীউ রাধারমণজীউ ইত্যাদি।

দেববিগ্রহাদির নামের শেষে ‘জীউ’ বা ‘জী’ শব্দ-যোগ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বাংলার দেবতারা ‘জীউ’ বলে সম্বোধিত বন্দিত বা পূজিত হয়েছেন কোনকালে, ইতিহাসে তার কোনো নজীর নেই। হিন্দু আমলেও নেই, মুসলমান আমালেও নেই। তাহলে ইংরেজ আমলে বাঙালি নব্যধনিকরা দেবতাদের নামের সঙ্গে জীউ বা জী শব্দ যোগ করতে অনুপ্রাণিত হলেন কেন, সেটা অবশ্যই অনুসন্ধানের বিষয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে দেবতারা কলকাতা শহরে জীউ-জী-রূপে বন্দিত হতে থাকেন। বাংলার বিশুদ্ধ বৈষ্ণব দেবতাদের এই আর্যাবর্তী-করণের কারণ কি, যার সূত্রপাত মনে হয় কলকাতা শহর থেকেই হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষ করে রাঢ় অঞ্চলের, ধনুকের মতো বাঁকানো (শুকনাসাকৃতি) চারচালা মাটির ঘরের অনুকরণে তৈরি, উপরে আর একটি ছোট চারচালা চূড়াবিশিষ্ট আটচালা ইটের মন্দির বাংলা দেশে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। কলকাতা শহরেও এই আটচালা ইটের মন্দিরের সংখ্যা সর্বাধিক। কিন্তু প্রাচীন মন্দিরের নিদর্শন কলকাতায় নেই বললেই হয়, যে কয়েকটি আছে তাদের আধুনিক রূপায়ণে মন্দির-স্থাপত্যের বঙ্গীয় ঐতিহ্য সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। ডেভিড ম্যাককাচন ঠিকই বলেছেন, ‘Architecturally, the temples of Calcutta are disappointing’। কিন্তু এই বিকৃতি ও অবনতির কারণ হিসাবে বর্গিদের হাঙ্গামা, সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ইত্যাদির কথা তিনি যে উল্লেখ করেছেন, তা আংশিক সত্য মাত্র, সম্পূর্ণ সত্য নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে নির্মিত বঙ্গীয় রীতির সুন্দর মন্দির পশ্চিমবঙ্গে অনেক আছে। পোড়ামাটির মূর্তি দিয়ে মন্দিরের বহিরঙ্গ অলংকরণের কাজ যাঁরা করতেন, সেই সূত্রধর শিল্পীরা তখনও পর্যন্ত তাঁদের কুলগত বৃত্তি ছেড়ে সকলে ভিন্ন বৃত্তি অবলম্বন করেন নি। তারও প্রমাণ যথেষ্ট আছে। কলকাতার নব্যধনিক রাজা-মহারাজারা এবং বড় বড় বাবুমহাশয়রা ইচ্ছা করলে বাংলার সূত্রধরদের সাহায্যে ভাল ভাল বঙ্গীয় রীতির মন্দির, অন্তত অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে, এমনকি উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দু’তিন দশকের মধ্যে নির্মাণ করাতে পারতেন। কিন্তু তা তাঁরা করেন নি। তার অন্যতম কারণ, তাঁদের নতুন আভিজাত্যবোধ নব্যপ্রভু ইংরেজদের সেবায়, আচার-আচরণ অনুকরণে পরিপুষ্ট। দুর্গোৎসবে রাসোৎসবে বিবাহোৎসবে ইংরেজ অতিথিদের ইংরেজি স্টাইলের খানাপিনায় আপ্যায়ন করে যাঁরা আভিজাত্য প্রকাশ করতেন, তাঁরা কলকাতায় ইংরেজদের খ্রীস্টভজনালয় গির্জার জমকাল স্থাপত্যরূপ দেখে কতকটা তারই অনুকরণে দেবালয় গড়তে প্রাণিত হয়েছিলেন, এবং হওয়া স্বাভাবিক। ঐতিহ্যানুগত বঙ্গীয় রীতির মন্দিরে গৃহদেবতাকে প্রতিষ্ঠা করে ভজনপুজনে তাঁদের ইংরেজকৃপালব্ধ আভিজাত্যবোধ ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তাই চকমেলান বড় বড় হলঘরযুক্ত ঠাকুরবাড়ি তাঁরা গড়েছেন, নাচঘরের মতো হলঘর (যেমন বাগবাজারের মদনমোহনের), অথবা চোরবাগানে রাজেন্দ্র মল্লিকের গির্জাসদৃশ তীক্ষ্ন উন্নত শিখরবিশিষ্ট জগন্নাথের ঠাকুরবাড়ি। তীক্ষ্ন চূড়াবিশিষ্ট দেবালয় কলকাতায় অনেক আছে। এগুলিকে গির্জার টাওয়ারের বিসদৃশ অনুকরণ বলা চলে।

বাংলারীতির সাধারণ আটচালা মন্দির কলকাতায় অনেক আছে বটে, তবে বেশি প্রাচীন মন্দির নেই, এবং চারচালা দোচালা জোড়বাংলা পঞ্চরত্ন নবরত্ন প্রভৃতি বিবিধ মন্দিরের সংখ্যা খুবই কম। নবরত্ন মন্দিরের মধ্যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে নির্মিত, চিৎপুরের গোবিন্দরাম মিত্রের মন্দির অন্যতম। কলকাতার ‘ব্ল্যাক জমিদার’ গোবিন্দরামের এই মন্দিরকে ইংরেজরা ‘ব্ল্যাক প্যাগোডা’ বলতেন। অধুনালুপ্ত এই নবরত্ন মন্দির চিত্রকর ড্যানিয়েল অংকিত প্রাচীন কলকাতার চিত্রে দেখা যায় (১)। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত বেশ সুঠাম আটচালা মন্দির যে ক্লাইভ স্ট্রীট অঞ্চলেও ছিল, তা কলকাতার প্রাচীন দৃশ্যচিত্রে দেখা যায়। জোড়বাংলা অথবা একরত্ন (আলগোছটুঙ্গি) মন্দির কলকাতায় দেখা যায় না। একটি দোচালা (লম্বা বাংলা দোচালা ঘরের মতো) শিবমন্দির বাগবাজারের চিৎপুর ব্রিজের কাছে আছে, কিন্তু খুবই ছোট এবং আকারে দোচালা মাত্র। পঞ্চরত্ন ও নবরত্ন মন্দির কলকাতায় কয়েকটি মাত্র আছে, পরে তার পরিচয় দেওয়া হয়েছে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে নির্মিত অধিকাংশ আটচালা মন্দির হয় লুপ্ত, নাহয় নিমতলার আনন্দময়ীর মন্দিরের মতো সমতলছাদ, সাধারণ চাঁদনির আকারের দেবগৃহে রূপান্তরিত। ১৮০৩ আর ১৮০৬ সালে নির্মিত ঠনঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরী কালী ও শিব মন্দিরের মধ্যে বর্তমানে শিবমন্দিরের মূলরূপটি এখনও দেখা যায়, কিন্তু কালী আধুনিক কক্ষে অধিষ্ঠিত। বৌবাজারে ফিরিঙ্গি কালী মন্দিরের অবস্থাও অনুরূপ, আধুনিক ঘরদালানের মস্তক বিদীর্ণ করে মন্দিরের চূড়া ঠেলে বেরিয়েছে মনে হয়। বর্তমান কালের আটচালা মন্দিরের মধ্যে (যদিও বাইরে ইট বা পোড়ামাটির অলংকরণ দেখা যায় না) সবচেয়ে প্রাচীন, এবং আয়তনে বৃহত্তম (২৫১/২ × ৪৫ ফুট + ৯০ ফুট উঁচু) হল কালীঘাটের কালী মন্দির। কলকাতার প্রাচীন জমিদারবংশ সাবর্ণ চৌধুরী পরিবারের সন্দোষ রায় উনিশ শতকের গোড়া থেকে এই মন্দির নির্মাণ আরম্ভ করেন, ১৮০৯ সালে তাঁর পুত্র নির্মাণ শেষ করেন। সাবর্ণ চৌধুরী পরিবারের বিভিন্ন শাখা বর্তমানে বড়িশা হালিশহর নিমতা প্রভৃতি অঞ্চলে বাস করেন। কালীঘাটের মন্দিরের চেয়ে কালী অনেক প্রাচীন, কারণ প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে পঞ্চদশ শতাব্দীতেও এই কালীতীর্থের উল্লেখ আছে। কালীর দেবোত্তর সম্পত্তি এবং পূজারী-সেবায়েতদের বিবরণাদিসহ সমীক্ষা সম্প্রতি ভারত-সরকারের নৃতত্ত্ববিভাগ করেছেন (এই অধ্যায়ের শেষে গ্রন্থনির্দেশ দ্রষ্টব্য)। এখানে তার আলোচনা প্রাসঙ্গিক নয়। কালীমন্দিরের পরিপার্শ্বে প্রায় দশটি ছোট আটচালা শিবমন্দির আছে এবং আশপাশে সমতলছাদ চাঁদনি মন্দিরও আছে অনেক।

কলকাতার অধিকাংশ আটচালা মন্দির শিবমন্দির এবং আকারে ছোট, সংখ্যায় আনুমানিক তিন শতাধিক হবে। মাঝারি ও বড় আটচালা মন্দির (অবশ্য কারুকার্য শূন্য) প্রায় কুড়িটার মতো আছে। এগুলির মধ্যে নিমতলা ঘাট স্ট্রীটের শেষদিকে ১৭৯৪ সালে (১৭১৬ শকাব্দে) হাটখোলার মদন দত্তের দুই পুত্র প্রতিষ্ঠিত দুর্গেশ্বর শিবমন্দির (২৩”৪’’ × ২৮”৪’’ + ৫০ ফুট উঁচু)* নন্দরাম স্ট্রীটের রামেশ্বর শিবমন্দির (১৮৫৪ সালে নন্দরাম সেন নির্মিত), ৩৮ × ৩১ ফুট, চিৎপুরের সর্বমঙ্গলা মন্দির, বাগমারীর শিবমন্দির, ঠনঠনিয়ার শিবমন্দির প্রাচীন। দক্ষিণ কলকাতায় টালিগঞ্জ অঞ্চলে বড় পুরনো আটচালা মন্দির আছে কয়েকটি। এই অঞ্চলে সাবর্ণ চৌধুরীদের মতো বাওয়ালীর (দক্ষিণ ২৪ পরগণায় বজবজের কাছে বাওয়ালী গ্রাম, প্রাচীন নাম সন্তোষপুর) মণ্ডলরা (টালিগঞ্জ রেলওয়ে ব্রিজের কাছে ‘বাওয়ালী মণ্ডল রোড’ নামে রাস্তা আছে। মন্দির নির্মাণে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন দেখা যায়। টালিগঞ্জ স্টুডিওর কাছে এগারটি আটচালা শিবমন্দির আছে, চারটির প্রতিষ্ঠাতা সীতারাম ঘোষ, একটির বলরাম ঘোষ (২২”৬’’ × ২০”৩’’) এবং বাকি ছ’টির সাবর্ণ চৌধুরীরা। টালির নালার পশ্চিম দিকে সাবর্ণ চৌধুরীদের প্রতিষ্ঠিত করুণাময়ী কালী মন্দিরের সঙ্গে দ্বাদশটি আটচালা শিবমন্দির আছে, আকারে ছোট (প্রায় ১৪’’ × ১২’’)। এছাড়া, বড়িশায় সাবর্ণ চৌধুরীদের বসত বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে অনেক আটচালা শিবমন্দির আছে, পঞ্চরত্নও আছে, কয়েকটির বহিরঙ্গে এখনও চুনকামের ফাঁকে ফাঁকে পোড়ামাটির মূর্তি দেখা যায় (১৯৭৪-এও দেখেছি)। প্রাচীন বড় আটচালা শিবমন্দিরের মধ্যে কালীঘাটের প্রায় মাইলখানেক দক্ষিণে (৭৮ নং টালিগঞ্জ রোডে) আদিগঙ্গার পূর্বপাড়ে ১৮২৮ সালে বাওয়ালীর উদয়নারায়ণ মণ্ডল প্রতিষ্ঠিত রাধামোহন মন্দির (আটচালা) উল্লেখ্য এখানে আরও দ্বাদশটি আটচালা শিবমন্দির এবং একটি চারচালা দোলমঞ্চ আছে। রাধামোহন মন্দিরের উত্তরে ৯৩ নং টালিগঞ্জ রোডে, ১৮৪৫ সালে বাওয়ালীর বিহারীলাল মণ্ডল প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি মন্দির নিয়ে একটি ‘মন্দির-মণ্ডল’ গঠিত। তার মধ্যে একটি গোপালজীর নবরত্ন মন্দির, পাশে দুটি ছোট পঞ্চরত্ন মন্দির তৎসহ দশটি আটচালা শিবমন্দির। মন্দিরের বাইরের দরজায় দু’পাশে সংস্কৃত ও বাংলা লিপি আছে। একটি বাংলা লিপি হল (পঞ্চানন রায়, ১৩৮১) :

সকলের চরণে আমার নিবেদন।

দেবালয়ে যাইবে না করি আরোহণ।।

নিষেধ বিধি কহি কিছু সবার অগ্রভাগে।

গাড়ি পালকি ঘোড়া গজাদি নিষেধ আগে।।

পাদুকা পাদেতে আর শিরে ছত্র ধরে।

না যাইবে গঙ্গাস্নানে দেবের মন্দিরে।।

এই মন্দির-মণ্ডলের কাছেই প্রায় সমসাময়িক কালের, একটি বড় আটচালা লক্ষ্মী-নারায়ণ মন্দির (২০.৫ফুটX২০.৫ফুট) আছে। প্রাচীন আটচালা মন্দিরের মধ্যে খিদিরপুরে ভূকৈলাস রাজবাড়ির শিবগঙ্গাজলাশয়ের উত্তর দিকের ঘাটের দুই পাশের দুটি বৃহৎ শিবমন্দিরেরও উল্লেখ করা উচিত। ১৭০২ শকাব্দে (১৭৮০ সালে) মন্দির দুটি স্থাপিত। মন্দিরের মধ্যে, নিমতলার দুর্গেশ্বর শিবলিঙ্গের মতো, বৃহৎ দুটি শিবলিঙ্গ (প্রায় আট ফুট উঁচু) স্থাপিত, এবং দুর্গেশ্বরের মতোই এই শিবলিঙ্গের (রক্তকমলেশ্বর) মাথায় সিঁড়ির উপর উঠে জল ঢালতে হয়, নিচে দাঁড়িয়ে হাতে নাগাল পাওয়া যায় না।

নবরত্ন মন্দিরের মধ্যে কলকাতার উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে স্থাপিত দুটি মন্দির সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য। দু’টি মন্দিরের নির্মাণকালের মধ্যে ব্যবধান প্রায় পঞ্চাশ বছরের হলেও উভয়ের অন্যান্য সাদৃশ্য লক্ষণীয়। একটি উত্তর প্রান্তের দক্ষিণেশ্বরের নবরত্ন কালীমন্দির। আর-একটি দক্ষিণপ্রান্তের টালিগঞ্জের রাধানাথের নবরত্ন মন্দির। টালিগঞ্জের (১নং মণ্ডল টেম্পল লেন) নবরত্ন মন্দির ১৭৩১ শকাব্দে (১৮০৯ সালে) স্থাপিত, প্রতিষ্ঠাতা বাওয়ালীর রামনাথ মণ্ডল (পূর্তবিভাগের পুরাকীর্তির তালিকা অনুযায়ী)(২)। লোকপ্রবাদ যে এই নবরত্ন মন্দির বিশ্বকর্মা নির্মিত। এগার জন শিল্পী নাকি এই মন্দির নির্মাণে নিযুক্ত হন, এবং এই এগারজন যখন উপরে কাজ করতেন, তখন নিচে থেকে দেখলে মনে হতো বারজন, আবার নিচে কাজ করার সময় উপর থেকে দেখলে মনে হতো বারজন। রানী রাসমণি দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দির টালিগঞ্জের রামনাথ মণ্ডলের এই নবরত্ন মন্দিরের মডেলেই নির্মাণ করেছিলেন, উনিশ শতকের মধ্যভাগে। ডেভিড ম্যাককাচনও টালিগঞ্জ-দক্ষিণেশ্বরের এই নবরত্ন মন্দির দুটি সম্বন্ধে বলেছেন, ‘Their appearance and design are more or less the same’…।

ড্যানিয়েল, ড’য়িলি (Charles D’oyly) প্রমুখ বিদেশি শিল্পীদের প্রাচীন কলকাতার চিত্রে যে-সব মন্দির দেখা যায়, তাতে মনে হয়, শহরের বিভিন্ন স্থানে, যেমন স্ট্র্যাণ্ড রোডে, চিৎপুর অঞ্চলে, নবরত্ন মন্দির আরও কয়েকটি ছিল, কিন্তু সেগুলি নাগরিক উন্নয়নের ফলে লুপ্ত হয়ে গেছে। কেণ্ডারডাইন লেনে এখনও একটি প্রাচীন নবরত্ন ও দুটি পঞ্চরত্ন মন্দির দেখা যায়। এই মন্দির তিনটি ত্রিলোকরাম পাকড়াশী ১৭৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন। এর চাইতে একটি বড় নবরত্ন আছে শ্যামপুকুর থানার পাশে। এটি ভবতারিণী কালী মন্দির, ১৮৮৮ সালে দয়াময়ী দেবী স্থাপন করেন। কলকাতার ব্ল্যাক-জমিদার কুমোরটুলির গোবিন্দরাম মিত্রের বিখ্যাত নবরত্ন মন্দিরের কথা আগে বলেছি। গোবিন্দরাম আরও অনেক মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, সেগুলির কোনো চিহ্ন আছে বলে মনে হয় না। স্টার্নডেল তাঁর An Historical Account of the Calcutta Collectorate গ্রন্থে (১৮৮৫) গোবিন্দরাম সম্বন্ধে লিখেছেন : ‘He spant vast sums of money during his lifetime in the erection of temples and the performance of poojahs and religious ceremonies on a scale of pomp and magnificence to which Calcutta has long been a stranger’ গোবিন্দরামের এই ধর্মানুরাগ যদি দু একটি মন্দির-স্থাপত্যে অক্ষয় হয়ে থাকত, তাহলে কলকাতা শহরে আমরা হয়ত কিছু ভাল মন্দির দেখার সুযোগ পেতাম। সম্ভবত লটারি কমিটির উন্নয়নকর্মের ফলে সেগুলি ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু ম্যাককাচন কুমোরটুলিতে বনমালী সরকার নির্মিত একটি আটচালা মন্দির খুঁজে পেয়েছেন (২/৫ কেবলকৃষ্ণ শূর স্ট্রীট), যে-মন্দিরটিকে তিনি কলকাতার প্রাচীনতম মন্দির বলে মনে করেন। কেবল বলমালী সরকার নির্মিত মন্দির বলে নয়, মন্দিরের গড়ন ও পোড়ামাটির কাজ দেখে তাঁর এই কথা মনে হয়েছে। আমাদের তা মনে হয় না। যে বনমালী সরকার ‘owned the finest native house of the day’ (স্টার্নডেল), তিনি এরকম একটি অতি সাধারণ মন্দির নির্মাণ করে শিবলিঙ্গের উপাসনায় উৎসর্গ করবেন বলে মনে হয় না(৩)। বর্তমানে এই মন্দিরের যে গড়ন দেখা যায় তাতে প্রাচীনতার চিহ্ন খুবই অস্পষ্ট, এবং সিমেণ্ট-প্লাস্টারের সংস্কারকর্মের ফলে কেবল যে আটচালার আকার বিকৃত তা নয়, মন্দিরের আসল গড়ন পর্যন্ত বিনষ্ট। মন্দিরের পোড়ামাটির মূর্তিচিত্র অবশ্যই প্রাচীন, বিশেষ করে বিভিন্ন ভঙ্গিতে যোগীর মূর্তিগুলি এবং তার সঙ্গে বিচিত্র নারীমূর্তির সহাবস্থান। বৈশিষ্ট্য হল যোগীমূর্তিগুলি, যা সাধারণত একটি মন্দিরের গাত্র অলংকরণে একত্রে এতগুলি দেখা যায় না। যোগীমূর্তির বিচিত্র সমাবেশ থেকে মনে হয়, এগুলির মধ্যে কোনো বিশেষ উপাসক-সম্প্রদায়ের ধর্মভাব প্রকাশ পেয়েছে। হয়ত কোনো শৈব যোগী সম্প্রদায়ের।

মানুষের মতো দেবতাদের মধ্যে একটি শ্রেণিভেদ লক্ষ্য করা যায় কলকাতা শহরে। উচ্চশ্রেণিভুক্ত অধিকাংশ দেবদেবী হলেন বৈষ্ণব। তাঁরা প্রাসাদতুল্য ঠাকুরবাড়িতে থাকেন, কেউ কেউ মন্দিরেও থাকেন। একথা আগে বলেছি। মধ্যশ্রেণির মধ্যে সর্বপ্রধান শিব, তারপর কালী। কালীঘাটের কালী, দক্ষিণেশ্বরের কালী, ঠনঠনের সিদ্ধেশ্বরী, চিৎপুরের সর্বমঙ্গলা, কাশীপুরের চিত্তেশ্বরী বা চিত্রেশ্বরী কয়েকটি ব্যতিক্রম মাত্র। সাধারণ শ্রেণির মধ্যে লোকদেবতাদের (folk deities) স্থান। তাঁদের রাজনীতির ভাষায় ‘প্রলেটারিয়েট’ বলা যায়। অবশ্য গ্রামের চাষীদের মতো গ্রামের লোকদেবতারা শহরে বেমানান, বিশেষ করে কলকাতার মতো মহাশহরে। তবু পঞ্চানন শীতলা মনসা ষষ্টী চণ্ডী প্রভৃতি লোকদেবতাদের কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে এখনও কিছু দেখা যায়, কেউ মন্দিরে অধিষ্ঠিত, কেউ বা সনাতন গাছতলায়। এঁরা সকলেই কলকাতার প্রাক-নাগরিক গ্রাম্য বাল্যজীবনের স্মৃতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন করছেন। এঁদের মধ্যে বেলগাছিয়ার ওলাইচণ্ডী অপেক্ষাকৃত ভাগ্যবান মনে হয় এইজন্য যে তিনি এমন একটি মন্দিরে অধিষ্ঠিত যা কলকাতা শহরে বিরল। মন্দিরটিকে বড়ই বলা চলে (১৬’’ × ১৪’’) এবং আটচালার বদলে বারচালার মন্দির। এখানে পঞ্চানদ মনসা শীতলা ষষ্ঠী প্রভৃতি লোকদেব-দেবীরাও আছেন। এরকম একটি বিশিষ্ট মন্দিরে অধিষ্ঠানের সম্মান, বেলগাছিয়ার ওলাইচণ্ডীর মতো, কলকাতার আর কোনো লোকদেবদেবী পেয়েছেন বলে জানা যায় না।

কলকাতার মসজিদ

হিন্দুদের মন্দিরের মতো কলকাতা শহরে মুসলমানদের মসজিদের সংখ্যাও কম নয়। প্রবীন ও অনুসন্ধানী মুসলমানরা বলেন, কমবেশি প্রায় ৫০০ (পাঁচশো) মসজিদ আছে কলকাতায়। কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চল পথঘাট অলিগলি পরিক্রমণ করলে মসজিদের এই আনুমানিক সংখ্যা বেশি বলে মনে হয় না। তবে কলকাতা শহরে গত কয়েক বছরের মধ্যে যত্রতত্র কর্পোরেশনের জায়গায় যেভাবে মন্দির গড়ে উঠেছে, মসজিদ সেইভাবে গড়ে ওঠে নি, ওঠা সম্ভবও নয়। হিন্দুদের দেবদেবী অনেক, উপাসক-সম্প্রদায়ও অনেক, মন্দিরের বৈচিত্র্যও অনেক। মুসলমানদের দেবতা এক অদ্বিতীয়, সম্প্রদায় কয়েকটি থাকলেও তা উপাস্য দেবতাকেন্দ্রিক নয় এবং মসজিদের মূল গড়নেরও বৈচিত্র্য নেই, কেবল মিনার গম্বুজের সংখ্যার, গৃহনির্মাণের উপাদানের অথবা ছোট-বড়-মাঝারি আকারের বৈচিত্র্য আছে।(৪) কলকাতার মসজিদ প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় মনে রাখা উচিত। কলকাতা যদিও বাংলা দেশের সর্বপ্রধান শহর, তা হলেও বাঙালি বা বাংলা ভাষাভাষি মুসলমানের সংখ্যা কলকাতায় অনেক কম। কলকাতায় হিন্দুরাই প্রধান, প্রায় শতকরা ৮৪ জন, এবং অবাঙালি হিন্দুদের সংখ্যা যথেষ্ট হলেও বাঙালি হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু কলকাতায় মুসলমানদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ১৪ জন হলেও (১৯৬১ সালের সেন্সাস), তার মধ্যে শতকরা প্রায় ৭০ জন অবাঙালি মুসলমান এবং হিন্দুস্থানী বা উর্দু ভাষাভাষি। বাকি ৩০ জনের মধ্যে ২০ জন প্রায় বাঙালি মুসলমান, এবং অন্যান্যরা রাজস্থানী গুজরাটি ও মালয়ালী মুসলমান। অর্থাৎ কলকাতার মুসলমানদের মধ্যে গড়ে পাঁচজনের মধ্যে একজন মাত্র বাংলা ভাষাভাষি বাঙালি মুসলমান।

এই জনবিন্যাসের ঐতিহাসিক কারণ অবশ্যই আছে। প্রথম কারণ : বাংলার মুসলমানরা প্রধানত গ্রাম্য চাষী বা অন্যান্য বৃত্তিজীবী। কলকাতার নাগরিক বিলাসিতা, ব্যবসাবাণিজ্যের মুনাফা অথবা কলকারখানার মজুরের কাজ, কোনোটাই তাঁদের শহরবাসী হতে তেমন আকর্ষণ করে নি। দ্বিতীয় কারণ : ইংরেজ আমলে জমিদার পত্তনিদার তালুকদার ইত্যাদির শ্রেণিস্তরে হিন্দুরাই ছিলেন প্রধান। তাঁরা গ্রাম ছেড়ে সহজেই শহরবাসী হয়েছিলেন, কিন্তু মুসলমানেরা তা সাধারণত হতে পারেন নি। কিন্তু উদীয়মান কলকাতা শহরের ব্যবসাবাণিজ্য ও নানাবিধ কাজকর্মের আকর্ষণ যে যথেষ্ট ছিল তা অস্বীকার করা যায় না। সেই আকর্ষণে প্রলুব্ধ হয়ে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে মুসলমানরা কলকাতা শহরে এসেছেন। তার সঙ্গে আরও দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা কলকাতা শহরে অবাঙালি মুসলমানদের সংখ্যাবৃদ্ধির সহায় হয়েছে। প্রথম ঘটনা, মহীশূরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে হায়দার আলির পুত্র টিপু সুলতানের পরাজয় ও মৃত্যু (১৭৯৯) এবং তাঁর বংশধরদের কলকাতায় বসবাস। দক্ষিণ কলকাতায় টালিগঞ্জের বিশাল অঞ্চল জুড়ে মুসলমানদের বসতি গড়ে উঠেছে, টিপু সুলতানের বংশধর প্রিন্স গোলাম মহম্মদ, আনওয়ার শাহ (এঁদের নামে রাস্তাও আছে) ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনদের প্রত্যক্ষ ও প্ররোক্ষ পোষকতায়। দক্ষিণ-পশ্চিম কলকাতায় মেটিয়াবুরুজ গার্ডেনরিচ প্রভৃতি অঞ্চলে মুসলমান প্রধান হয়েছে (অযোধ্যার) নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের মসনদচ্যুতি ও ক্ষমতালোপের পর তাঁকে কলকাতায় এই অঞ্চলে স্থানান্তরিত করার জন্য (১৮৫৬ সালে, ডালহৌসির আমলে)। নবাব সিরাজউদ্দৌলার কলকাতায় (১৭৫৬) ও পলাশির যুদ্ধে (১৭৫৭) পরাজয়ের পর নায়েব-দেওয়ান রেজা খাঁ ও তাঁর উত্তরাধিকারীদের কর্মকেন্দ্র কলকাতায় চিৎপুর অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয় (হেস্টিংসের আমলে)। চিৎপুরের নবাব বলে এঁরা পরিচিত। চিৎপুর অঞ্চলের মুসলমান-প্রাধান্য মুখ্যত মূর্শিদাবাদের ও চিৎপুরের নবাবদের পোষকতায় গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া নানারকমের ব্যবসাবাণিজ্যের আকর্ষণে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে মুসলমানরা কলকাতা শহরে এসেছেন। উনিশ শতক থেকেই তাঁদের কলকাতায় আসা শুরু হয়েছে-পাঞ্চাব রাজপুতানা গুজরাট বিহার উত্তরপ্রদেশ মাদ্রাজ প্রভৃতি প্রদেশ থেকে। প্রধানত তাঁদের বংশগত ব্যবসায়ে দক্ষতার জন্য (যেমন ঘোড়া, চামড়া, ফল, মাংস ওস্তাগরি, বাদ্যযন্ত্র, সানাই-নহবৎ-ব্যাণ্ড ইত্যাদি) এবং কতকগুলি পারিবারিক ও আফিসের কাজে কুশলতার জন্য (যেমন অরদালি, বাবুর্চি, খানসামা, দফতরী ইত্যাদি) তাঁরা কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। প্রাচীন নবাববংশের পোষকতা ও ব্যবসাবাণিজ্য ছাড়াও আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে পার্ক সার্কাস, কড়েয়া, বেকবাগান, ওয়েলেসলি, তপসিয়া, রাজাবাজার, নারকেলডাঙা প্রভৃতি মুসলমানপ্রধান হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। কারণটি হল, হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। কলকাতায় মুসলমানরা সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়, কাজেই আত্মরক্ষার্থে তাঁরা নির্বাচিত অঞ্চলে দলবদ্ধভাবে বসতি গড়ে তুলেছেন। এইদিক থেকে ১৯২৬ ও ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই সময়ের মধ্যে কলকাতার আঞ্চলিক মুসলমানপ্রধান বসতিগুলির চূড়ান্ত রূপায়ণ হয়(৫)। এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে চিৎপুরের বৃহত্তম নাখোদা মসজিদ (কচ্ছী মুসলমান স্থাপিত) ১৯২৬ সালের দাঙ্গার সময় স্থাপিত হয়। একজন অতিবৃদ্ধ মুসলমান যিনি মসজিদ নির্মাণে মিস্ত্রির কাজ করেছিলেন, তাঁর কাছে একদিন মসজিদে বসে ছাব্বিশের দাঙ্গার লোমহর্ষক কাহিনী শুনেছি। জ্যাকেরিয়া স্ট্রীটের জ্যাকেরিয়ার মতো নাখোদা মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা আবদার রহিম ওসমান গুজরাটি কচ্ছী (কচ্ছ, Kutch অঞ্চলের) মুসমলান। নাখোদা মসজিদের উত্তরে সিঁদুরিয়াপট্টির হাফিজ জালালউদ্দীনের মসজিদ এ-অঞ্চলের প্রাচীন মসজিদের মধ্যে অন্যতম।

কলকাতাবাসী প্রাচীন নবাব বংশের মধ্যে টিপু সুলতানের বংশধররা কলকাতায় প্রায় তেরটি বড় মসজিদ স্থাপন করেছেন। তার মধ্যে ধর্মতলার মসজিদ এবং টালিগঞ্জের মসজিদ প্রধান। অযোধ্যার নবাববংশ মেটিয়াবুরুজ গার্ডেনরিচ অঞ্চলে ইমামবাড়া(৬) ও মসজিদ কয়েকটি স্থাপন করেছেন। মুর্শিদাবাদের নবাববংশ উত্তর ও মধ্য কলকাতায় মসজিদ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেছেন একাধিক, তার মধ্যে চিৎপুরের গোলকুঠি ও মানিকতলার কারবালা উল্লেখ্য। টিপু সুলতানের পুত্র প্রিন্স গোলাম মহম্মদ ১৮৪২ সালে ধর্মতলার মসজিদ স্থাপন করেন। কলকাতার কেন্দ্রস্থলের এই মসজিদ ‘টিপু সুলতানের মসজিদ’ বলে কথিত। মসজিদের ইংরেজি লিপিতে উল্লেখ আছে :

‘The Musjid was erected during the Government of Lord Auckland, G.C. B, by the Prince Golam Mohomed, son of the late Tippoo Sultan, in gratitude to God and in commemoration of the Honorable Court of Directors, granting him the arrears of his stipend in 1840.’

ধর্মতলা মসজিদের পাশে একটি বড় পুকুর ছিল, ‘এসপ্ল্যানেড ট্যাঙ্ক’ বলত। এই পুকুরের জলে নতুন মসজিদের গম্বুজ ও মিনার প্রতিফলিত হতো। পুরাতন পিকচার-পোস্টকার্ডে মসজিদের এই ছবির তলায় জনৈক কবি পুকুর বুজিয়ে রাস্তা হবে শুনে দুঃখ করে লিখেছিলেন :

‘This is a Church where Mohamdans Pray,

It was once by a tank but it isn’t today

The tank’s disappearing, and getting quite small

In ten years or so ther’ll be no tank at all.”

১৮৪০-এর দশকেও ধর্মতলার মসজিদের গম্বুজ মিনার পুকুরের জলে প্রতিফলিত হতো। তখন গম্বুজ-মিনারের সংখ্যা আরও বেশি ছিল, পরে প্রবল ঝড়ে কয়েকটি ভেঙে গিয়েছে।

হিন্দুদের মতো বেশি না হলেও, মুসলমানদের মধ্যেও কয়েকটি উপ-সম্প্রদায় (sects) আছে। শিয়াসুন্নী প্রধান হলেও এঁদের মধ্যেও কয়েকটি ধর্মীয় বিভাগ আছে। যেমন ইমামি ইসমাইলি শিয়া, অথনা অশরি শিয়া দেহবন্দী সুন্নী, বারেলভি সুন্নী প্রভৃতি। কলকাতায় প্রায় ৫০০ মসজিদ আছে। তার মধ্যে কোন উপসম্প্রদায়ের অধীনে কতগুলি মসজিদ আছে, তার একটি সমীক্ষা সম্প্রতি করা হয়েছে (সিদ্দিকি ১৯৭৪) :

কোন উপসম্প্রদায়ের অধীনে কতগুলি মসজিদ

সুন্নী-মুসলমানরা (৭) কলকাতায় প্রধান এবং বারেলভি-সুন্নীরা প্রায় শতকরা ৯০ জন। কলকাতায় প্রায় পাঁচশতাধিক মসজিদের মধ্যে শতকরা ৯৫টি মসজিদ বারেলভি-সুন্নীদের। কলকাতায় মসজিদ-স্থাপত্যে বাংলার গৌড়-পাণ্ডুয়ার নিজস্ব রীতির (style) প্রভাব বিশেষ দেখা যায় না, বরং উত্তরপ্রদেশ ও গুজরাটের রীতির প্রতিফলন দেখা যায়। অবশ্য বাংলার বাইরের প্রাদেশিক স্থাপত্যরীতির প্রকৃত প্রতিফলন কলকাতার মসজিদে তেমন হয়নি, কারণ কলকাতার মসজিদ অধিকাংশই উনিশ শতকের মধ্যকাল থেকে নির্মিত এবং সাধারণত ছোট অথবা মাঝারি আকারের মসজিদই বেশি। কলকাতার অভিজাত ধনিক মুসলমান অধিকাংশই অবাঙালি। বাদশাহি আমলের মতো বড় বড় মসজিদ নির্মাণে অর্থ ব্যয় করে তাঁরা আভিজাত্য প্রকাশ করতে চান নি; ইসলামধর্মে মসজিদ মুসলমান সাধারণের সম্মিলিত উপাসনাগৃহ, বিলাসিতা অথবা আভিজাত্য প্রদর্শনের সুযোগ সেখানে বিশেষ নেই। তাই মসজিদ নির্মাণে মধ্যযুগের বাদশাহী মনোভাব আধুনিক যুগের ধনিক মুসলমানদের মধ্যে বিশেষ দেখা দেয় নি।

মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলকে ইমারতবিলাসী নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ, পুরনো লখনউ ছেড়ে এসে, ‘নয়া, লখনউয়ে’ পরিণত করেছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শী আবদুল হলীম ‘শরর’ নবাবের সঙ্গে মেটিয়াবুরুজে এসেছিলেন এবং সেকথা তিনি তাঁর ‘গুষিশ তা লখনউ’ (বাংলায় ‘পুরনো লখনউ’ নামে অনূদিত, ১৯৭৪) গ্রন্থে লিখে গিয়েছেন। তিনি লিখেছেন :

‘লখনউয়ে বাদশাহ ‘ক্যয়সর বাগ’, তার পাশে কয়েকটা ইমারত, পিতার ইমামবাড়ী ও সমাধি ভবন, শুধু এই কটিই তৈরি করেছিলেন। কিন্তু মেটিয়াবুরুজে চমৎকার সব ইমারতের একটা সুন্দর শহরই গড়ে তুলেছিলেন। নদী পরপারে, মেটিয়াবুরুজের ঠিক মুখোমুখি কলকাতার বিখ্যাত বোটানিক্যাল গার্ডেন। কিন্তু মেটিয়াবুরুজের ভূস্বর্গ ও তার বিচিত্র বস্তু-সম্ভারের সামনে সে গার্ডেন দাঁড়াতেই পারত না। এই সমস্ত বাড়ি, বাগান, কুঞ্জ ও সবুজ মাঠের চারদিকে ছিল উঁচু দেয়ালের ঘের।… মোদ্দা কথা, বাদশাহের অবস্থানের ফলে কলকাতার কাছে দ্বিতীয় লখনউ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আসল লখনউ ততোদিনে মৃত।…বাদশাহ ছিলেন শীয়া। তবু তার স্বভাবে গোঁড়ামি বা ধর্মীয় পক্ষপাত ছিল না। তিনি বরাবর বলতেন : আমার দুই নয়নের একটি শীয়া, অন্যটি সুন্নী।’

কিন্তু ওয়াজিদ আলি শাহর মৃত্যুর পর ব্রিটিশ গবর্ণমেন্টের মধ্যস্থতায় তাঁর সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়। উত্তরাধিকারীদের কারও প্রতি যাতে কোনো অন্যায় না হয় তার জন্য সমস্ত সম্পত্তি বাড়ি জমি সম্পদ বিক্রি করে দিয়ে নগদ টাকা সকলকে ভাগ করে দেওয়া হয়। লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পত্তি কড়ির দামে বিক্রি হয়ে যায়। বাদশাহ যে কৃত্রিম স্বর্গ গড়ে তুলেছিলেন মেটিয়াবুরুজে, তা দেখতে দেখতে পতনেবিনাশে নরক হয়ে গেল।’ ‘দ্বিতীয় লখনউ’ মেটিয়াবুরুজেরও মৃত্যু হল প্রথম লখনউয়ের মতো। মেটিয়াবুরুজের অধিকাংশ মুসলমানই বর্তমানে এই ইতিহাসের কিছুই জানেন না, কেবল প্রবীণ দুএকজন অওধের (অযোধ্যার) মুসলমান ছাড়া। ৩৪ নং গার্ডেনরিচ রোডে ইমামবাড়া আছে, তার মধ্যে ওয়াজিদ আলি শাহর সমাধি ও কিছু ঐতিহাসিক প্রাচীন চিত্রাদি আছে। অধিকাংশ মসজিদ, শিয়া ও সুন্নী উভয় উপসম্প্রদায়ের, বাদশাহের ইমারতগুলির মতো, কলকারখানার দাপটে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। বাস্তবিক মেটিয়াবুরুজ এখন নরকতুল্যই মনে হয়। মসজিদের বিলুপ্তির ফলে কেবল যে ধর্মীয় উপাসনাগৃহ নিশ্চিহ্ন হয়েছে তা নয়। মুসলমান ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি অধিকাংশই মসজিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল, কেবল মেটিয়াবুরুজে নয়, কলকাতার সর্বত্র মসজিদের সঙ্গে সেই বিদ্যালয়গুলিও আজ লুপ্ত। তার ফলে মুসলমান ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যাও দেখা দিয়েছে।

দরগা আস্তানা খান্কা। দরগা হল পীরের কবরস্থান, আস্তানা ও খানকা পীর-ফকিরের স্থান। কলকাতা শহরে প্রায় ১৩টি আস্তানা দরগা এবং ৬টি খানকা আছে (সিদ্দিকি, ১৯৭৪)। এগুলির ধর্মীয় গুরুত্ব মসজিদের চেয়ে কম নয়, কিন্তু মসজিদের সঙ্গে দরগা-আস্তানা-খানকার মূল পার্থক্য হল এই যে মসজিদে মুসলমান ছাড়া অন্য ধর্মীরা উপাসনায় যোগ দিতে পারে না। যেমন মন্দিরে হিন্দু ছাড়া এবং গির্জায় খ্রীস্টান ছাড়া কেউ পূজা-উপাসনা করতে পারেন না। কিন্তু মুসলমান পীর-ফকিরের দরগা-আস্তানায় হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলেরই সমাবেশ সম্ভব। বাংলার গ্রামাঞ্চলের মতো কলকাতার দরগা-আস্তানায় হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলে আসেন। দরগা-আস্তানা-খানকাগুলি কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে স্থাপিত (সিদ্দিকি, ১৯৭৪) :

দরগা হজরত মৌয়ালা আলি শাহ। মৌলালি, ধর্মতলা

আস্তানা খাজা মিসকিন আলি শাহ। বেনিয়াপুকুর

আস্তানা হজরত মেহর আলি শাহ। ২০ লোয়ার সার্কুলার রোড

আস্তানা (মজর) হজরত রুস্তম শাহ চিস্তি। খিদিরপুর গোরস্থান

আস্তানা হজরত জুমা পীর। রাজা কাটরা, বড়বাজার

আস্তানা রজব আলি শাহ। হেস্টিংস

আস্তানা লাট্টু শাহ চিস্তি। টালিগঞ্জ, বড় মসজিদের দক্ষিণে

আস্তানা শাহী সুফী আজান গাজি। বাগমারী গোরস্থান

দরগা বাবা হাসান রেজা শাহ ওয়ারেশী। গোবরা গোরস্থান

আস্তানা বাবা মহম্মদ শাহ ওয়ারেশী। তিলজলা

দরগা শাহ আমন আলি কাদেরী চিস্তি। খিদিরপুর

দরগা শাহ হুসেন বক্স কাদেরী চিস্তি। হুসেন শাহ রোড

দরগা পঞ্জা শাহ হুসেনী। কাশীপুর

খানকা শরীফ। তালতলা

খানকা শরীফ। ইউরোপীয়ান অ্যাসাইলাম লেন

দরবার শরীফ। মফিদুল ইসলাম লেন

খানকা ওয়ারেশীয়া। স্যাণ্ডাল স্ট্রীট

খানকা চিস্তি নিজামিয়া। মফিদুল ইসলাম লেন

খানকা মোজাদ্দিদিয়া নকসবন্দিয়া। মৌলনা মহম্মদ আলি রোড।

এছাড়া আরও কয়েকটি গাজী ও পীরের স্থান আছে কলকাতায়। যেমন চিৎপুরের ‘সোনা গাজী’ (‘সোনাগাছি’ বিকৃত নাম)। এই পীর ফকিরের দরগা-আস্তানাগুলি অধিকাংশই বেশ পুরাতন, যদিও প্রতিষ্ঠার সঠিক সন-তারিখের হদিশ বিশেষ পাওয়া যায় না।

কলকাতার গির্জা

বাস্টিড, কটন, ব্লেশিনডেন, ফার্মিঙ্গার প্রভৃতির প্রাচীন কলকাতার বিবরণ পুস্তকে (‘ইতিহাস’ নয়) কলকাতা শহরের মন্দির অথবা মসজিদের কোনো উল্লেখ পর্যন্ত নেই বলা চলে। নিউম্যান প্রকাশিত কলকাতার ‘হ্যাণ্ডবুকে’ (১৮৭৫) ২১টি গির্জার বিস্তারিত বিবরণ আছে, অথচ মন্দির সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে উল্লেখ করার মতো কোনো মন্দির কলকাতায় নেই। মসজিদের মধ্যে ধর্মতলার মসজিদের কথা আছে। কলকাতার প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ অনুরাগী রেভারেণ্ড ফার্মিঙ্গার, যিনি ‘ক্যালকাটা হিস্টোরিকাল সোসাইটি’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং ‘বেঙ্গল পাস্ট অ্যাণ্ড প্রেজেণ্ট’ পত্রিকার প্রবর্তক, তিনিও কলকাতার মন্দির ও মসজিদ নিয়ে অনুসন্ধান বা আলোচনা করেন নি। কলকাতার গির্জা নিয়ে অনেক আলোচনা ফার্মিঙ্গার করেছেন, কেবল তাঁর কলকাতার ‘হ্যাণ্ডবুকে’ নয়, ‘বেঙ্গল পাস্ট অ্যাণ্ড প্রেজেন্ট’ পত্রিকার প্রবন্ধে ও সম্পাদকীয় রচনায়। এখনে আমরা কলকাতার গির্জাগুলির বিস্তারিত বিবরণ দেব না, সেগুলি সহজলভ্য বলে নয়, আপাতত অনাবশ্যক বলে। কলকাতার প্রায় সমস্ত গির্জাই, বর্তমানে যা দেখা যায় উনিশ শতকের মধ্যে নির্মিত। ক্যাথলিক প্রটেস্ট্যাণ্ট অ্যাংলিকান ব্যাপটিস্ট প্রভৃতি প্রত্যেক খ্রীস্টীয় ধর্মসম্প্রদায়ের গির্জা কলকাতা শহরে আছে এবং সেগুলির নির্মাণকাল উনিশ শতকের মধ্যে বিস্তৃত। এক-একটি খ্রীস্টীয় গোষ্ঠীর গির্জার আধিক্যও বিশেষ অঞ্চলে লক্ষ্য করা যায়। যেমন বৌবাজার-সার্কুলার রোড অঞ্চলের মধ্যে রোমান ক্যথলিক ও ব্যাপটিস্ট মিশন গির্জার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। গির্জার আঞ্চলিক অবস্থান সম্বন্ধে একথা বললেও ভুল হয় না যে উত্তরে বৌবাজার এবং পুবে ও দক্ষিণে সার্কুলার রোড, এই সীমানার মধ্যেই কলকাতার শতকরা ৯৫টি গির্জা প্রতিষ্ঠিত। তার কারণ, এই সীমানার মধ্যেই ইংরেজ ও অন্যান্য খ্রীস্টানদের বসবাস, কাজকর্ম ইত্যাদি প্রধানত আবদ্ধ ছিল।

উনিশ শতকের আগে আঠার শতকে নির্মিত ও প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি প্রাচীন ঐতিহাসিক গির্জা কলকাতা শহরে আছে। সংক্ষেপে সেই গির্জা কয়েকটির বিবরণ দিয়ে, অন্যান্য গির্জার প্রতিষ্ঠা-কালসহ একটি তালিকা করে দেব। মনে হয়, কলকাতার গির্জা সম্বন্ধে অনুসন্ধিৎসা তাতেই নিবৃত্ত হবে।

আর্মেনিয়ান চার্চ, ১৭২৪। চীনাবাজারের ঘিঞ্জি দোকানপাটের মধ্যে অবস্থিত এই আর্মেনিয়ান গির্জাটিকে ‘the oldest place of Christian worship in Calcutta’ বলা হয় (Census of India, 1951, Calcutta City, Appendix IV, P.23)। কিন্তু কলকাতা শহরে খ্রীস্টীয় উপাসনার প্রাচীনতম আলয় এটি নয়। এর আগে অদ্ভুত দুটি খ্রীস্টান উপাসনালয় কলকাতায় স্থাপিত হয়েছিল, যার একটিরও অস্তিত্ব এখন নেই।

প্রতিষ্ঠাকালের দিক থেকে আর্মেনিয়ান গির্জাটিকে কলকাতার তৃতীয় খ্রীস্টান উপাসনালয় বলাই সংগত, যদিও বিদ্যমান গির্জাগৃহের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে প্রাচীন। ১৭২৪ সালে স্থাপিত হলেও এই গির্জার বিভিন্ন অংশ আঠার শতকের শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে গঠিত।

সেণ্ট জনস চার্চ, ১ ৭ ৮ ৭। সারা বাংলা প্রেসিডেন্সির ‘Paris Church’-এর মর্যাদার উত্তরাধিকারী সেন্ট জনস গির্জা, এবং ষষ্ঠ উত্তরাধিকারী। প্রথম হুগলীকুঠির ছোট গির্জা ১৭৭৯-৮০ সালের। দ্বিতীয়, পুরাতন কেল্লার মধ্যেকার উপাসনাগৃহ। তৃতীয়, ‘সেণ্ট অ্যানি’ গির্জা, ১৭০৯ সালে নির্মিত। রাইটার্স বিল্ডিং-এর পশ্চিম কোণে গির্জাটি ছিল, ১৭৫৬ সালে সিরাজের কলকাতা অভিযানকালে ধ্বংস হয়ে যায়। সাধারণের কাছ থেকে চাঁদা তুলে গির্জা তৈরি হয় এবং খ্রীস্টান উপাসনালয়ের মধ্যে এইটিকে প্রাচীনতম বলা যায়। চতুর্থ, ‘সেণ্ট’ অ্যানি’ গির্জা ধ্বংস হয়ে যাবার পর কিছুদিন পুরাতন পর্তুগিজ গির্জাটিকে প্যারিস চার্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু ১৭৬০ সালে পুনরায় পর্তুগিজদের সেটি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পঞ্চম, পুরাতন কেল্লার ভিতরে ছোট একটি সেন্ট জনস চ্যাপেল গড়া হয়, এবং জুলাই ১৭৬০ সাল থেকে ১৭৮৭ সালে বর্তমান সেন্ট জনস চার্চ তৈরি হওয়া পর্যন্ত এই চ্যাপেলই ছিল প্রেসিডেন্সি চার্চ। ওয়ারেন হেস্টিংস, কর্ণওয়ালিস, মিন্টো প্রত্যেকে সেণ্ট জনস-এর নানাবিধ উন্নয়নে সাহায্য করেন। কলকাতার পাঁচজন বিখ্যাত বিশপ-মিডলটন, হেবার, জেমস টার্নার ও উইলসন-এই গির্জাতেই বিশপের পদে অভিষিক্ত হন এবং তাঁদের প্রত্যেকের অভিষেকের চেয়ার গির্জার সম্পদ হিসেবে রক্ষিত আছে। এঁদের মধ্যে দুজনের (মিডলটন ও টার্নার) কবরও আছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, মিডলটন ছাড়া অন্য চারজন বিশপ, তাঁদের যাজকতাকালে (১৮২৬-৪৯) ৫ নং রাসেল স্ট্রীটে বাস করতেন। সেন্ট জন্স গির্জা সম্বন্ধে হাইড (Archdeacon Hyde) লিখেছেন :

St. John’s is a comprehensive monument of the history of the British in Bengal. Within or without her walls are memorials of an illustrious line of Indian worthies beginning with the Mausoleum of Job Charnock, the Father of Calcutta himself.

যোব চার্নকের সমাধিটিকে হাইড ‘perhaps the oldest structure of any kind now existing in Calcutta’ বলেছেন, যদিও আর্মেনিয়ান গির্জার প্রাঙ্গণে জনৈক Mrs. R. Sookeas-এর কবরের উপর ১৬৩০ খ্রীস্টাব্দে খোদিত আছে। চার্নকের সমাধি-ফলকে খোদিত ১৬৯২-৯৩ সাল, তাঁর কন্যা আয়ার (Eyre) ও ক্যাথারিনের (Catherine) ফলকে ১৬৯৬-৯৭ ও ১৭০০-০১। তা ছাড়া আছে সার্জেন উইলিয়াম হ্যামিল্টনের সমাধি (১৭১৭), দিল্লীর দরবারে যাঁর দৌত্য ও ডাক্তারীর জন্য ইংরেজদের রাজত্বলাভের অনেক সুবিধা হয়। ইতিহাসখ্যাত ভাইস-অ্যাডমিরাল চার্লস ওয়াটসনের সমাধিও (১৭৭৫) এইখানে আছে।

সেণ্ট জনস গির্জা যেখানে স্থাপিত সেখানে আগে ছিল কলকাতার সাহেবদের গোরস্থান। পার্ক স্ট্রীটের আগেকার এই গোরস্থান কলকাতার সবচেয়ে প্রাচীন গোরস্থান। পূর্বদিকে ছিল কোম্পানির বারুদখানা, মধ্যে ছিল প্রাচীন ও গভীর একটি পরিখা। তখন পার্ক স্ট্রীটের গোরস্থানের মতোই এই গোরস্থানের চেহারা ছিল। পরে গির্জা নির্মাণের সময় গোরস্থানের জীর্ণ সমাধিমন্দিরগুলি ভেঙে ফেলা হয় এবং খোদিত পাথরের ফলকগুলি গির্জা পাশের সমাধিস্থানে মাটিতে সাজিয়ে বিছিয়ে রাখা হয়। গির্জা প্রাঙ্গণে আজও সেই পুরাতন সমাধি-ফলকগুলি দেখা যায় এবং এমন ব্যক্তিদের সমাধি-ফলক এগুলি যাঁদের কর্মজীবনের সঙ্গে কলকাতার তথা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আদি-ইতিহাস জড়িত। বাস্টিড তাঁর Echoes from Old Calcutta-তে লিখেছেন :

The cemetry of St. John’s came in for the marked attention of the late Viceroy who had churchyard cleared and renovated, the graves restored, the turflaid etc. Further, it was satisfactorily arranged through Lord Curzon, with a view to its future care, that this graveyard, so closely and pathetically associated with our earliest Calcutta history, should be taken over as a public trust by the Bengal Government.

সেণ্ট জন্স গির্জা গ্রীক স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত। কিন্তু তার দীর্ঘ (১৭৪ ফুট) ক্রম-সূক্ষ্ম চূড়াটি (steeple) পাথরের। সেইজন্য কলকাতার জনসাধারণ এই গির্জাকে একদা ‘পাথর গির্জা’ বলত।

ওল্ডমিশন চার্চ, ১৭৭০। ১১ নং মিশন রো-তে এই গির্জা স্থাপিত। সেন্ট জনস-এর আগে নির্মিত। মিশন রো-তে প্রায় দুশো বৎসর আগে অর্থাৎ এই গির্জা স্থাপিত হবার পরেই, ওয়ারেন হেস্টিংসের কাউন্সিলের দু’জন সদস্য বাস করতেন-জেনারেল ক্লেভারিং (General Clavering) ও জেনারেল মনসন (General Monson)। মনসন বাস করতেন ১ নং মিশন রো-তে এবং ক্লেভারিং ৮ নং মিশন রো-তে। নম্বরগুলো এখনও আছে, কিন্তু বাড়ি বা তার পারিপার্শ্বের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মিশন রো থেকে মাত্র কয়েকশত গজ দূরে ওয়ারেন হেস্টিংসের ‘Town Residence’ ছিল, ঠিকানা ৭ নং হেস্টিংস স্ট্রীট। ফলক-চিহ্নিত এই বাড়িটি এখনও হেস্টিংস স্ট্রীটে দেখা যায়।

মিশন চার্চের প্রতিষ্ঠাতা কিয়ারন্যাণ্ডার (J. Z. Kiernander) একজন সুইডিশ মিশনারী, society for the Propagation of Christian Knowledge-এর নির্দেশে ভারতবর্ষে আসেন ১৭৩৯ সালে। পণ্ডিচেরির কয়েক মাইল দক্ষিণে কুড্ডালোরে প্রথমে তিনি খ্রীস্টীয় ধর্ম প্রচারের কাজ আরম্ভ করেন। এই অঞ্চলে যখন ইঙ্গ-ফরাসী সংঘর্ষ আরম্ভ হয়, তখন তিনি কলকাতায় চলে আসেন (১৭৫৮), ঠিক পলাশির যুদ্ধের পরে। শ্রীমতী উলি (Mrs. Woolley) নামে এক মহিলাকে তিনি, প্রথম স্ত্রী বিয়োগের পর, বিবাহ করে অনেক টাকা পান, প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা। এই সময় তাঁর এক ভাইয়ের সম্পত্তি টাকাকড়িও তিনি পান। প্রচুর টাকার মালিক হয়ে কিয়ারন্যাণ্ডার একটি গির্জা স্থাপনের সাধু সংকল্প করেন এবং ৬৭,০০০ টাকা খরচ করে মিশন রো-তে এই গির্জা স্থাপন করেন। কলকাতার ‘oldest Protestant Church’ এই মিশন চার্চের দ্বারোদ্ঘাটন হয় ১৭৭০ সালে, ডিসেম্বর মাসে।

১৮৪০-এর দশকে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে এই গির্জায়। কবি মধুসূদন দত্ত, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৪৩, ই ‘ওল্ড মিশন চার্চে’ খ্রীস্টধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। তখন তাঁর বয়স উনিশ বছর। গির্জার প্রধান ধর্মাচার্য আর্চডিকন ডিয়ালট্রি (Archdeacon Dealtry) জর্ডন নদীর পবিত্র বারি মধুসূদনের মাথায় সেচন করে, তাঁকে মাইকেল নাম দিয়ে দীক্ষা দেন। দীক্ষান্তে কিছুদিন তিনি গির্জার আর্চডিকন ও চ্যাপলেনের গৃহে অবস্থান করেন। এই সময় তিনি প্রিয় বন্ধু গৌরদাস বসাককে লেখেন :

‘O Gour! Doodeen Chardeenataya ato!!!

(ও গৌর, দুদিন চারদিনেতেই এত!!!)

Now, of you are really desirious to see me, come here, Old Church, Mission Row. You will say, you have no conveyance well, hire a Palkee, do I will pay. I will, I have plenty of money…

Come, brightest Gour Dass, on a hired palkee

And see thy anxious friend M.S.D.

মধুসূদন যেদিন খ্রীস্টধর্মে দীক্ষা নেন, সেদিন মিশন রো-তে গির্জার চারিদিকে উত্তেজিত জনতার দৃশ্য কল্পনা করা যায়, কারণ দীক্ষা গ্রহণের আগেই মধূসূদন বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে ফোর্ট উইলিয়ামে আশ্রয় নেন, এবং সেখান থেকে গির্জায় আসেন। শহরময় খবরটা আগেই রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল। জনতার উত্তেজনা-জনিত বিশৃংখলা প্রতিরোধের জন্য কর্তৃপক্ষ সেদিন গির্জার সামনে সশস্ত্র সৈনিক প্রহরী নিযুক্ত করেছিলেন।

উনিশ শতকের কয়েকটি গির্জা। এখানে কেবল উনিশ শতকের কয়েকটি গির্জার উল্লেখ করা হল, নাম, অঞ্চল ও প্রতিষ্ঠাকাল-সহ। বিবরণ কালানুক্রমিক নয়।

সেণ্টপলস ক্যাথিড্রাল ১৮৩৭-৪৭। সেণ্ট জনস চার্চ ১৮১৪ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি চার্চ ছিল। তারপর কলকাতা শহরকে বিশপের অধীন (Bishopric) করা হয়। তাতেও সেণ্ট জনস-এ উপাসনার চাহিদা মিটছিল না। সেইজন্য স্থির হয়, ১৮৩৯ সালে, চৌরঙ্গিতে সেণ্ট পলস ক্যাথিড্রাল নির্মাণ করা হবে। প্রায় সাত-আট বছর লাগে এই গির্জা নির্মাণ করতে। ১৮৪৭ সালে সেণ্ট পলস উপাসনার জন্য উন্মুক্ত হয়। Indo-Gathic স্থাপত্যরীতিতে সেন্ট পলস নির্মিত। ২৪৭ ফুট × ৮১ ফুট এবং বৃহৎ গির্জার চূড়াটি ২০১ ফুট। এত দীর্ঘ চূড়া কলকাতায় আর কোনো গির্জার নেই।

সেণ্ট জেমস চার্চ ১৮২০-২৩। পুরাতন সেণ্ট জেমস চার্চ স্থাপিত হয় বৈঠকখানায় নেবুতলা অঞ্চলে, প্রায় পাঁচ বিঘা জমির উপর। এই গির্জার দক্ষিণে বৈঠকখানায় প্রথম ‘কলকাতা মাদ্রাসা’ স্থাপিত হয়। কলকাতার প্রথম বিশপ মিডলটন গির্জার ভিত স্থাপন করেন ১৮২০ সালে বিশপ হেবার ১৮২৩ সালে দ্বারোন্মোচন করেন। ১৮৫৫ সালে গির্জাটি ভেঙে পড়ে যায়। এখানকার সেন্ট জেমস স্কয়ার আজও ‘সেন্ট জেমস গির্জা’র স্মৃতি বহন করছে। সার্কুলার রোডে নতুন সেণ্ট জেমস চার্চ পরে তৈরি হয়, ১৮৬৪ সালে।

অন্যান্য গির্জার মধ্যে উল্লেখ্য হল : সেন্ট টমাস চার্চ : পুরাতন Free School-এর সংলগ্ন ছিল। লেভি উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এই গির্জার ভিত স্থাপন করেন ১৮৩০ সালে, ১৮৩১ নভেম্বর মাসে গির্জা উন্মুক্ত হয়। সেন্ট পিটার্স চার্চ : ফোর্ট উইলিয়াম, ১৮৩৫। সেন্ট স্টিফেন্স চার্চ : খিদিরপুর, ১৮৪৬। সেন্ট অ্যানড জ চার্চ : লালদীঘি, ১৮১৮। ফ্রি চার্চ : ওয়েলেসলি, ১৮৪৮। ব্যাপটিস্ট চ্যাপেল : লালবাজার, ১৮০৯। ব্যাপটিস্ট চ্যাপেল : সার্কুলার রোড, ১৮১৯। ইউনিয়ন চ্যাপেল : ধর্মতলা, ১৮২১। ওয়েসলিয়ান চার্চ, সদর স্ট্রীট ১৮৬৬। রোমান ক্যাথলিক চার্চ : ধর্মতলা, ১৮৩২। সেণ্ট টমাস রোমান ক্যাথলিক চার্চ : মিডলটন রো ১৮৪১। এ ছাড়া হেদুয়ার কাছে আমহার্স্ট স্ট্রীটে, ওয়েলিংটনে, কালীঘাটে (গ্রীক চার্চ) আরও কয়েকটি গির্জা আছে।

হিন্দু মুসলমান খ্রীস্টানদের দেবালয় ছাড়াও ক্যানিং স্ট্রীটে ইহুদীদের New Synagogue, এজরা স্ট্রীটে পার্সীদের অগ্নিমন্দির (আগিয়ারি), সার্কুলার রোডের জৈন মন্দির, গোলদীঘি ও ঢাকুরিয়া লেকের বুদ্ধ মন্দির বিহার কলকাতায় সর্বধর্মের সহবাসের সাক্ষী। যদিও কলকাতাবাসীর প্রধান কাম্য অর্থ এবং চরিত্রের মূল উপাদান স্বার্থ, তথাপি যাবতীয় কর্মাকর্মের মানসিক প্রতিক্রিয়া থেকে মোক্ষলাভের নিশ্চিত উপায় যে শাস্ত্রবিধানসম্মত ধর্মানুষ্ঠান তা প্রত্যেকেই উপলব্ধি করেন। কলকাতাবাসীর এই উপলব্ধির ফলেই সকল ধর্মের উপাসকগণের আহ্বানে দেবতাগণের কলকাতায় আগমন, এবং এত বিচিত্র দেবালয়ের প্রতিষ্ঠা, তৎসহ বিচিত্র ধর্মানুষ্ঠান ও ধর্মোৎসব পালনের সমারোহ।

গ্রন্থনির্দেশ

কলকাতা শহর পরিক্রমা এবং সরেজমিনে অনুসন্ধানলব্ধ তথ্যই এই প্রবন্ধের প্রধান অবলম্বন। এ ছাড়া এই সমস্ত পুস্তক ও রচনা এই বিষয় প্রসঙ্গে উল্লেখ্য :

বাংলা

সুবর্ণবণিক কথা ও কীর্তি (তিনখণ্ড), ১৯৪২ : নরেন্দ্রনাথ লাহা। বসুক, অর্থাৎ বসাকাদি-উপাধি-বিশিষ্ট জাতির পরিচয় : মদনমোহন হালদার, কলিকাতা ১৮৯৫। কলিকাতা তন্তুবণিক জাতির ইতিহাস : নগেন্দ্রনাথ শেঠ, কলিকাতা ১৮৫০। দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন : দুর্গাচরণ রায় প্রণীত, কলিকাতা ১৩১৮। পুরাতনী : হরিহর শেঠ চন্দননগর, ১৩৩৫। বাংলার মন্দির : শ্রীপঞ্চানন রায়, বাসুদেবপুর (মেদিনীপুর), ১৩৮১। পুরনো লখনউ : আবদুল হলীম ‘শরর’, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, নয়াদিল্লী ১৯৭২।

ইংরেজি

Bengal past and Present; Newman’s Handbook to Calcutta 1875, 1882, 1892 : Calcutta Past and Present : P.C. Bagchi Calcutta 1939; Muslims of Calcutta : M. K. A. Siddiqui, Anthropological Survey of India, 1974 (প্রবন্ধের মধ্যে ‘সিদ্দিকি ১৯৭৪’ বলে উল্লেখিত। ডঃ সিদ্দিকির সঙ্গে কলকাতার মুসলমান ও মসজিদ বিষয়ে আলোচনা করেও উপকৃত হয়েছি।); ‘The Temples of Calcutta, David Mc Cutchion in Bengal Post and Present, January-June 1968; ‘Kali Temple at Kalighat the City of Calcutta’, Surajit Sinha, in Cultural Profile of Calcutta, ed, by S. Sinha, Indian Anthoropological Society, Calcutta 1972.

***

  1. কিন্তু গোবিন্দরামের নবরত্ন মন্দির সম্বন্ধে ‘দেবগণের মর্তে আগমন’ (১৭১৮ সং) গ্রন্থে উল্লেখ আছে : ‘চিৎপুর রোডের ধারে ইহার প্রতিষ্ঠিত নবরত্ন অদ্যাপি বর্তমান আছে।’
  2. দুর্গেশ্বর মন্দিরের লিপি; ‘অঙ্গে যধীশ ধরণীধর সিতরশ্মি। প্রখ্যাতশোকসমরে পিতৃরাজ্ঞয়ৈতৎ সংস্থাপিতং মদনমোহন দত্ত পুত্রৈদুর্গেশ্বরাখ্য শিবলিঙ্গ মভূৎ নুসৌধে।’ (পঞ্চানন রায়, ১৩৮১)
  3. মন্দিরের লিপি ‘শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণঃ শকাব্দাঃ ১৭১৮-শাকেহষ্টাদশ বাজিচন্দ্র গণিতে কুম্ভস্থিতে ভাস্করে। রাধাকান্দমুদে শুভাশয়ষুতে গঙ্গোপকণ্ঠস্থলে। আরব্ধং নবরত্নমেতদমলং তদ্রামনাথেনদা। সেনস্মিন্নযুগ্ম মৈত্র বিমিতে পূর্ণত্বমাগান্মধৌ। ইতি পুনশ্চ ১৭৩১ সংক্রান্ত্যাং পূর্ণত্ব মসাৎ। (পঞ্চানন রায়, ১৩৮১)। অর্থাৎ রামনাথ দাম (মণ্ডল) রাধাকান্তের জন্য গঙ্গাতীরে যে নবরত্ন ১৭১৮ শকের ফাল্গুন মাসে আরম্ভ করেন, তা ১৭২৯ শকের চৈত্রমাসে শেষ হয়, কিন্তু পূর্ণত্ব লাভ করে ১৭৩১ শকের শেষ সংক্রান্তিতে। ১১ থেকে ১৩ বছর সময় লেগেছিল এই নবরত্ন নির্মাণ করতে।
  4. ‘দেবগণের মর্ত্তে আগমন’ গ্রন্থে বনমালী সরকার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে : ”আদি বাস ভদ্রেশ্বর। আত্মারাম সরকার প্রথম কলিকাতায় আসিয়া বসবাস করেন। বনমালী পাটনা রেসিডেন্সির দেওয়ান ছিলেন; পরে ইনি ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কলিকাতার ডেপুটী ট্রেডারের পদ প্রাপ্ত হন। বিপুল অর্থ উপার্জন করিয়া ইনি কলিকাতা হুগলী প্রভৃতি স্থানে বিষয় খরিদ করেন। ইহার বাটী কুমারটুলির মধ্যে বৃহৎ। ইনি শ্যামসুন্দর ও শিব প্রতিষ্ঠা করেন। এই বংশের অন্য কেহ নেই। সমস্ত বিষয় বিগ্রহের সেবার্থ দান করিয়া গিয়াছেন’)।
  5. মুসলমানযুগের বিভিন্ন পর্বে মসজিদ-স্থাপত্যের অঞ্চলিক রীতিবৈশিষ্ট্য অবশ্যই আছে এবং বাংলার মসজিদেরও একটা নিজস্ব রীতি আছে। এখানে কলকাতা শহরের মসজিদের কথা বলা হয়েছে।
  6. এ বিষয়ে The Statesman পত্রিকার আলোচনা দ্রষ্টব্য (৩০ অক্টোবর, ১৯২৬)।
  7. ‘ইমামবাড়া’ শিয়ামুসলমানদের ধর্মগৃহ, হজরত মহম্মদের দৌহিত্রদ্বয় ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেনের স্মরণার্থে নির্মিত। মোহররমের সময় এখানে বিশেষ অনুষ্ঠান হয়।
  8. যাঁরা প্রথম চার খলিফাকে হজরত মহম্মদের বৈধ উত্তরাধিকারী জ্ঞান করেন তাঁরা ‘সুন্নী’, এবং যাঁরা কেবল চতুর্থ খলিফা হজরত আলীকে বৈধ উত্তরাধিকারী মনে করেন তাঁরা ‘শিয়া’। বারেলভি (উত্তরপ্রদেশের বেরিলি অঞ্চলের), দেওবন্দী (শাহারামপুর জেলায় দেওবন্দ অঞ্চলের) প্রভৃতি নাম আঞ্চলিক।
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *