কলকাতার বিচিত্র পেশা
…কিছুই যায় না ফেলা
বেলা একটা, বাইপাস লাগোয়া কলোনি বাজারের একপাশে বাবলুর ‘ব্রয়লার চিকেন শপ,’ দোকানের বাঁশের খুঁটিতে ঝোলানো স্লেটে চক দিয়ে লেখা— ‘গোটা— ৯০’, ‘কাটা— ১৬০’, বড় লোহার খাঁচায় গোটা চারেক মুরগি। পাশে একটা কালো রঙের ড্রাম। জবাই হওয়া মুরগিদের ধড়ফড় করতে থাকা শেষ দু’-এক মিনিটের ঠিকানা। আজ এবেলার মতো বিক্রি বাট্টা শেষ। ছুরি চাকু ধুয়ে খাঁচার ওপর রাখা কাঠের ক্যাশবাক্সটা খুলে হিসেব মেলাচ্ছিল বাবলু। এমন সময় সাইকেলের ‘ক্রিং ক্রিং’। ঘণ্টার শব্দে চোখ তুলে তাকাল। দোকানের সামনে সাইকেল বসা মন্টু। এক পা প্যাডেলে, এক পা মাটিতে। সাইকেলের পিছনে ক্যারিয়ারের দু’দিকে আংটা দিয়ে ঝোলানো নীল রঙের দুটো প্লাস্টিকের ড্রাম, “কীরে? এত দেরি করলি?” ঈষৎ বিরক্তিমাখা গলায় প্রশ্ন করলো বাবলু। “আর বোলো না, মণ্ডলদার দোকানে অ্যায়সান দেরি করিয়ে দিল…” বলতে বলতে সাইকেল স্ট্যান্ড করিয়ে নেমে এল মন্টু। “আজ কতটা হল?” “কত আর হবে? ওই দশ বারো কেজি মতো… বিক্রিবাট্টার যা অবস্থা।” নিরাসক্ত গলায় জবাব দিল বাবলু “কই দেখি,” বলে বাবলুর পাশ কাটিয়ে গিয়ে কালো ড্রামটার সামনে ঝুঁকে পড়ল মন্টু। ড্রামের একপাশে ডাঁই করে রাখা মুরগির বিষ্ঠা, নাড়িভুঁড়ি আর পালক। মন্টুর হাতে একটা বড় পলিপ্যাক। দ্রুতহাতে সমস্ত বর্জ্যটুকু পুরে ফেলল পলিপ্যাকটায়। পাশে রাখা ঝোলানো ওজনযন্ত্রটায় ঝুলিয়ে ওজন করে হাঁক ছাড়ল— “এগারো কেজি আটশো, বাবলুদা।” বলেই দোকান থেকে বেরিয়ে এসে পলিপ্যাকটা উপুড় করে দিল সাইকেলের ড্রামের মধ্যে। তারপর সাইকেলে বসে ফের হাঁক পড়ল—“আজ আসি বাবলুদা। সোমবার সব হিসেব-কিতেব কিলিয়ার (ক্লিয়ার) করে দেব।” “কাল একদম দেরি করবি না। তা হলে কিন্তু…।” বাবলুর কথায় হাসল মন্টু। “অ্যাকদম চিন্তা কোরো না। কাল ফাস (ফার্স্ট) তোমার একেনে, তারপর অন্য কথা…।” প্যাডেলে পায়ের চাপ। সাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে গেল মন্টু।
প্রিয় পাঠককুল, এতক্ষণ ধরে উপরোক্ত বর্ণনাটি পড়ে কিঞ্চিৎ ধন্ধে পড়ে গেছেন আশা করি। মুরগির বিষ্ঠা, নাড়িভুঁড়ি আর কাটা ছেঁড়া পালক দিয়ে মন্টু করবেটা কী? কৌতূহল নিরসনের জন্য জানাই, ‘জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা’ এই লাইনটা বোধ হয় মুরগির ক্ষেত্রেও সত্যি। মাংস ছাড়াও গিলে, মেটে, কলিজা, মাথা, গলা, ছাঁট সবকিছুই বিক্রি হয়ে যায় খাদ্য হিসেবে। এরপরেও যা পড়ে থাকে, সেই বিষ্ঠা, নাড়িভুঁড়ি আর পালক, আমাদের চোখে যা বর্জ্য এবং পরিত্যাজ্য— সেটাই অন্য কারও উদরপূর্তির উপকরণ। সায়েন্স সিটির উলটোদিকে বাইপাসের ধারে যে বাস রাস্তাটা বানতলা, ধামাখালি, ঘটকপুকুর হয়ে সোজা সুন্দরবনের দরজা সন্দেশখালি অবধি চলে গেছে— সেই রাস্তাটা ধরে মাইল পাঁচেক এগোলেই একধারে বিদ্যাধরী নদী, অন্যপাশে অজ পাড়াগাঁ। সারি সারি মাছের ভেড়ি। ভেড়িভরতি মাছ। রাক্ষুসে মাগুর (জায়ান্ট আফ্রিকান ক্যাটফিশ), নাইলোটিকা (ত্যালাপিয়ার জাতভাই), পাকু (আমাজন নদীর হিংস্র পিরানহার নিরীহ জ্ঞাতি)… আরও হরেকরকম প্রজাতি। প্রায় সবই হাইব্রিড। মন্টুরা সব এই ভেড়ি অঞ্চলের মানুষ। সেই কাকভোরে, সূর্যের আলো ঠিকঠাক ফোটার আগেই সাইকেলের পিছনে ড্রাম ঝুলিয়ে এরা বেরিয়ে পড়বে বাড়ি থেকে। চলে আসবে আমাদের এই শহরে। দোকান দোকান ঘুরে সংগ্রহ করবে মুরগির বর্জ্য। চাহিদা আর জোগান অনুযায়ী দাম কিলোপ্রতি পনেরো থেকে কুড়ি টাকার মধ্যে ওঠানামা করে। দোকানদারের সঙ্গে হপ্তা অথবা মাসকাবারি চুক্তি। সওদাপাতি সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। গ্রামে অপেক্ষারত ক্রেতার দল, ভেড়ির মালিকের লোকজন। মাল নামার সঙ্গে সঙ্গে খড়-কুচোনো মেশিনে পালক কুচিয়ে পুরীষমাখানো মণ্ড তৈরি করে ফেলে দেওয়া হবে জলে। মুহূর্তে তোলপাড় শুরু হয়ে যাবে ভেড়ির জল জুড়ে। ড্রামকে ড্রাম বর্জ্য নিমেষে চলে যাবে মাছের পেটে। আর মন্টুরা? ভারী ভারী ড্রাম সাইকেলের ক্যারিয়ারে ঝুলিয়ে মাইল মাইল পথ পাড়ি দেওয়ার হাড়ভাঙা ক্লান্তি নিয়ে ফিরে যাবে ঘরে। তারপর কোনওমতে নাকেমুখে কিছু গুঁজে গড়িয়ে পড়া বিছানায়। কাল ভোরে উঠে আবার অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে শহরে পৌঁছতে হবে যে।
শিশুখামার
রাস্তাঘাটে আসতে যেতে আপনাদেরও অনেকের হয়তো মাঝেমধ্যে চোখে পড়েছে দৃশ্যটা। এক মহিলা। পরনে ছেঁড়াফাটা মলিন শাড়ি। পাশে নোংরা চাদরের ওপর শোয়ানো একটা বছর দুয়েকের বাচ্চা। অঘোর ঘুমে অচৈতন্য। মুখের সামনে কাত হয়ে থাকা আধখালি জলমেশানো দুধের বোতল। অফিসপাড়া। ব্যস্ত পাড়া। ব্যস্ত জনপদ। ভিড়ভাড়াক্কার মধ্যে দিয়ে জলদি পা চালানো পথচারীদের অনেকেরই নজর চলে যাচ্ছে সেদিকে। একটাকা, দু’টাকা, পাঁচটাকার কয়েন ছুড়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ। পরক্ষণেই আরও দ্রুত পা চালাচ্ছেন গন্তব্যের দিকে। ভাল করে খেয়াল করলে দেখতে পেতেন সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার পথে ওই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। ঠায় একইভাবে বসে আছে মহিলা। বাচ্চাটা তখনও ঘুমিয়ে কাদা। সকালের মতোই থেকে থেকেই টুপটাপ পয়সা পড়ছে চাদরের ওপর। একটা বছর দুয়েকের বাচ্চা, নড়াচাড়া নেই, দুষ্টুমি নেই, কান্নাকাটি নেই, সকাল থেকে সন্ধে অবধি একটানা ঘুমে আচ্ছন্ন। ব্যাপারটা চূড়ান্ত অস্বাভাবিক হলেও সকাল বিকেল অফিস-বাড়ি-অফিস ব্যস্ত পথচারীদের খটকা লাগছে না প্রায় কারোরই। এই প্রতিবেদকের কিন্তু লেগেছিল। নানা কাজের চাপে খতিয়ে দেখার সুযোগ হয়নি সেভাবে। সুযোগটা এসে গেল হঠাৎই একদিন। সেটা নব্বই সালের গোড়ার কথা। একটা নামী সমীক্ষা সংস্থার সোশ্যাল রিসার্চ ডিভিশনে চাকরি করি তখন। একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টের দীর্ঘমেয়াদি বরাত পায় আমাদের সংস্থাটি। বিষয়— ‘চাইল্ড ট্র্যাফিকিং, অ্যাট্রোসিটি অ্যান্ড এক্সপ্লয়েটেশন।’ দেশের পূর্বাঞ্চলে সমীক্ষার ভার পড়েছিল আমার হাতে। কাজটা হাতে নিয়ে প্রথমেই সমীক্ষা চালাই উপরোক্ত বিষয়টির ওপর। দিনের পর দিন শহরের অলি গলি ঢুঁড়ে ফেলে যে তথ্য (নাকি দৃশ্য?) সামনে উঠে এসেছিল সেটা এককথায় চমকপ্রদ। ওই ঘুমিয়ে থাকা বাচ্চাটা আসলে একটা ব্যাবসা। আসলে বাচ্চাটা ঘুমোয় না। ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। কিন্তু কীভাবে? প্রশ্নের উত্তরটা পেতে জনাদশেক এরকম ভিখিরিকে খুঁজে বের করেছিলাম। জিজ্ঞাসাবাদ করে যা উঠে এসেছিল তা এককথায় হাড় হিম করে দেওয়ার মতো। মোটামুটি দুরকম পদ্ধতিতে এই ব্যাবসাটা চলে। এক— ফুটপাতের ধারে ঘুমন্ত শিশুটিকে শুইয়ে রেখে ভিক্ষে চাওয়া। দুই— ঘুমন্ত শিশুটিকে কোলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষে করা। ব্যাবসাটার নির্দিষ্ট কয়েকটা নিয়মকানুন আছে। কোনও ঘন বসতিপূর্ণ এলাকাকে কখনওই কাজের জায়গা হিসেবে বেছে নেবে না এরা যাতে পল্লীবাসীর মনে কৌতূহলের উদ্রেক হয় বা অবাঞ্ছিত প্রশ্নের সামনে পড়তে হতে পারে। সবচেয়ে পছন্দের এলাকা ব্যস্ত অফিসপাড়া এবং বড় বড় ধর্মস্থান যেখানে প্রচুর লোকসমাগম হয়। যেখানে বিশেষ প্রয়োজন অথবা উদ্দেশ্যে সদাব্যস্ত মানুষজনের মধ্যে ব্যাপারটা তলিয়ে দেখা বা এ নিয়ে চিন্তাভাবনার সময় এবং সুযোগ কোনওটাই নেই। অতঃপর ওই ভিক্ষুকদের মধ্যেই একজনকে বেছে নিয়েছিলাম বিশেষভাবে আমার মূল-উত্তরদাতা অর্থাৎ ‘কী ইনফরম্যান্ট’ হিসেবে। ইয়া তালড্যাঙা চেহারার লোকটা। প্রৌঢ়, একগাল দাড়ি। আদুল গা, সবসময় নিম্নাঙ্গে ছেঁড়া হেঁটো লুঙ্গি, কাঁধে নেতিয়ে পড়ে থাকা একটা বছর চার-পাঁচেকের বাচ্চাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াত রাস্তায় রাস্তায়। মুখে সর্বদা লেগে থাকা একটা মেকি করুণ হাসি, হঠাৎই এসে পথ আগলে দাঁড়িয়ে পড়ত কোনও ভ্রাম্যমাণ পথচারীর। গলায় কাতর আবেদন— “বাচ্চাটা তিনদিন খায়নি গো বাবু…।” হতচকিত পথচারী। কিঞ্চিৎ বিড়ম্বিতও। কোনওমতে মানিব্যাগ খুলে তাড়াতাড়ি যা পারে দিয়ে পা বাড়াত গন্তব্যস্থলের দিকে। সপ্তাহের বাকি ছ’দিন এই একই কায়দায় ভিক্ষে করলেও ফির জুম্মাবারে (শুক্রবার) দাঁড়িয়ে পড়ত কোনও সংখ্যালঘু এলাকার মসজিদের সামনে। জুম্মাবার। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। দুপুরের নামাজ সেরে বেরোনো পুণ্যার্থীরা উদার হস্তে দান করেন ওই দিনটায়। মসজিদের একপাশে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো ভিক্ষুকদের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ত লোকটা। রোজগারপাতি সবচেয়ে বেশি হত ওই জুম্মাবারেই। প্রায় টানা হপ্তা তিনেক অনুসরণ করে ধরতে পেরেছিলাম ব্যাপারটা। অতঃপর এক শুক্রবার লোকটার পিছু নিয়ে চড়ে বসেছিলাম সাউথ লাইনের ট্রেনে। বিনা টিকিটের যাত্রী হয়ে। কারণ লোকটা কোথায় যাবে জানা ছিল না। প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে একটা প্রায় নির্জন ছোট স্টেশন। সেখানে নেমে পড়ল লোকটা। পিছু পিছু এই অধম প্রতিবেদক। ট্রেন থেকে নামা সামান্য দু’-চারজন যাত্রী প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই বিলকুল শুনশান এলাকা। প্ল্যাটফর্মের একধারে একটা কাঠের বেঞ্চিতে বাচ্চাটাকে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল লোকটা। তারপর কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিতে লাগল ধীরে ধীরে। “মকবুল.. ও মকবুল… এবার ওঠ।” আস্তে আস্তে চোখজোড়া খুলল। মিনিট দুয়েক বাদে ঘোরলাগা চোখে উঠে বসল বাচ্চাটা। কাঁধের ঝোলা থেকে দুটো বিস্কুট বের করে বাচ্চাটাকে খেতে দিল লোকটা। আর একমুহূর্তও দেরি না করে ঝটিতি গিয়ে বসে পড়েছিলাম বেঞ্চিতে বুড়োর পাশে। হাতে একটা একশো টাকার নোট (তখনকার বাজারে অনেক টাকা) গুঁজে দিয়ে জানতে চেয়েছিলাম রহস্যটা। যা জেনেছিলাম সেটা পড়লেই পাঠক বুঝতে পারবেন কেন একটু আগে ‘হাড় হিম করে দেওয়া’ উপমাটা ব্যবহার করেছিলাম। বাচ্চাটা আসলে বুড়োর নিজের নয়। ভাড়া করা। এই দখিন লাইনের অগুনতি অজ পাড়াগাঁয়ে এরকম অজস্র হাড়হাভাতে, বেমতলব গরিবগুরবো পরিবার মুখিয়ে রয়েছে তাদের ঘরের বাচ্চাকে ভাড়া খাটানোর জন্য। কারণ একটাই—অপরিসীম দারিদ্র্য। নিজেরা বেশিরভাগই নিজে কাজটা করতে পারে না ঘুম পাড়ানোর কায়দাটা না জানার জন্য। সীমিত সংখ্যক মানুষেরই আয়ত্তে রয়েছে বিদ্যেটা। এই প্রৌঢ় তাদের মধ্যে একজন। ওর বয়ান অনুযায়ী নিশাদলের গাঁট (একধরনের বিষাক্ত মাদক গাছের শিকড়), আফিম, কামপোজ-হিপটোজেন-প্রক্সিভন-ম্যানডেক্সের মতো ঘুমপাড়ানি ওষুধ পরিমাণমতো মিশিয়ে তৈরি করা হয় মিশ্রণটা। জানতে হয় দুধের সঙ্গে কতটা পরিমাণে মিশিয়ে খাওয়ালে কতক্ষণ ঘুমোবে বাচ্চাটা আর কতক্ষণ বাদেই বা সে ঘুম ভাঙবে। পরিমাণে একচুল এদিক ওদিক, সামান্যতম অসতর্কতা, ঘুম পরিণত হবে কালঘুমে। এলাকার অনেক কোয়াক ডাক্তারও অনেক সময় সাহায্য করে থাকেন মিশ্রণটা বানাতে। বুড়োর মতে এক থেকে পাঁচ বছর বয়স অবধি কোনও বাচ্চাকে খাটানো যায় এই লাইনে। মেয়ের চেয়ে ছেলেই বেশি কাম্য। এক থেকে দেড় বছর বয়েসি বাচ্চার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বেশি ভাড়ার টাকার পরিমাণও। কারণ বয়স যত কম হবে ততই দয়ামায়ার উদ্রেক হবে মানুষের মনে। তবে একটানা এ ব্যাবসায় কখনওই খাটানো যায় না একটি শিশুকে। মোটামুটি ছ’মাস অন্তর অন্তত এক মাসের টানা বিশ্রাম প্রয়োজন অতি অবশ্যই। কিন্তু প্রৌঢ়র কথাতে তা আর হয় কই। ভয়ংকর গরিব সব পরিবার। চাহিদার তুলনায় বাচ্চার জোগান অনেক বেশি। অনেকটা সেই প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানের ভাষায়— “এ মহাভারত দাদা, এ মহাভারত/ মাছের মতোই আছে শিশুর আড়ৎ/ জ্বালানির মতো আছে শিশুর জোগান/ মহাভারতের কথা অমৃত সমান…।” সেই জোগানে একবার ছেদ পড়ে গেলেই অন্যের বাচ্চা এসে দখল নিয়ে নেবে জায়গাটার। এর মানে বহুদিন রোজগার থেকে বঞ্চিত থাকা। এদিকে পেটের মধ্যে দাউ দাউ খিদের আগুন। ফলে চরম বিপদের ঝুঁকি নিয়েও দরিদ্র অভিভাবকেরা তাদের শিশুটিকে ঘুমের হাটে ভাড়া খাটিয়ে যান। টানা বছরের পর বছর। কত টাকায় বাচ্চা ভাড়া পাওয়া যায়? ভাড়া চুকিয়ে কতটা লাভ থাকে হাতে? এর জন্য কাউকে পয়সা খাওয়াতে হয় কি? যারা ভাড়া দেন সেইসব পরিবারগুলোর কারও সঙ্গে একটু দেখা করা যাবে কি? প্রশ্ন করামাত্র শক্ত হয়ে গেছিল বুড়ো। “সেসব অনেক গভীর বেত্তান্ত বাবু… খামোখা শুধোয়ে বেপদ বাড়াবেন না। চল চল মকবুল। ইদিকে অনেকটা পথ যেতি হবে…।” বলতে বলতেই তাড়া লাগিয়েছিল বাচ্চাটাকে। পরমুহূর্তেই বাচ্চাটার হাত ধরে হেঁটে চলে গিয়েছিল হন হন করে। একবারও পিছনে না তাকিয়ে। ওদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে বেশ কিছুক্ষণ স্থাণুবৎ বসে ছিলাম প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতে। হঠাৎই ঘোর কেটে খেয়াল পড়েছিল আসার সময় টিকিট কাটা হয়নি। বেঞ্চি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত পায়ে হাঁটা লাগিয়েছিলাম টিকিট কাউন্টারের দিকে। এবার ফেরার পালা।
মাঝখানে এই আমরা আছি…
ধর্মতলা থেকে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে শ্যামবাজারের দিকে যেতে শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনের একটু আগে হাতের বাঁপাশে জটাধারী পেট্রল পাম্প। পেট্রল পাম্পের ঠিক গা ঘেঁষে সোনাগাছি লেন ধরে দু’-চার পা এগোলে ডানদিকে নীলমণি মিত্র স্ট্রিট। রাস্তার দু’ধারে গিজগিজ করছে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মী মেয়েরা। গলিতে ঢোকামাত্র কাস্টমারকে ঘিরে ধরবে একদল লোক। প্রায় সবার পরনে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি, ফতুয়া আর লুঙ্গি। অনেকটা ইউনিফর্মের মতো। ছিনে জোঁকের মতো পিছনে লেগে যাবে লোকগুলো, ক্রমাগত ফিসফিস করে যাবে কানের কাছে— “আইয়ে সাহাব, মেরা সাথ আইয়ে… অ্যায়সি চোখি চিজ (দুর্দান্ত জিনিস) দিখাউঙ্গা কি দিল খুশ হো যায়গি… একদম ফিল্ম হিরোইন কি তরহা…।” এই ঘ্যান ঘ্যান চলতেই থাকবে যতক্ষণ না কাস্টমার অতিষ্ঠ হয়ে ওদের মধ্যে কারও একজনের সঙ্গে আশপাশের কোনও একটা বাড়িতে ঢুকে পড়তে বাধ্য হয়। আসলে ওই লোকগুলো দালাল। সোনাগাছিতে যৌনকর্মীদের মোটামুটিভাবে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়। সাধারণত বাজারদর, সৌন্দর্য, ব্যবহার/ ছলাকলা এবং দৈহিক গঠনের ওপর নির্ভর করেই এই ক্যাটাগরির ব্যাপারটা নির্দিষ্ট করা হয়। সোনাগাছিতে, বিশেষ করে অবিনাশ কবিরাজ রো, নীলমণি মিত্র স্ট্রিট, ডালপট্টি, সোনাগাছি লেনে এরকম বেশ কিছু ‘এ’ ক্যাটাগরি বাড়ি রয়েছে। যেরকম ‘ড্রিম কুইন’, ‘নাইট লাভার্স’, ‘নন্দরানির ফ্ল্যাট’, ‘নীলকমল’, ‘শ্রীকমল’ ইত্যাদি। এলাকায় অনেকদিনের যাতায়াত বা বহু পুরনো খদ্দের না হলে দালালদের সাহায্য ছাড়া ওইসব বাড়িগুলোয় ঢোকা প্রায় অসম্ভব। ওরা কখনওই কাস্টমারের থেকে একটি পয়সাও চাইবে না। যে মেয়েটির ঘরে কাস্টমার ঢুকবে তার কাছ থেকে কুড়ি বা পঁচিশ পার্সেন্ট হারে কমিশন নিয়ে নেবে। ২০০৬-২০০৭, সোনাগাছিতে নিজস্ব এবং স্বশাসিত একটি সংস্থায় পাচার বিরোধী প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সেই সময় ওই এলাকায় নিয়মিত যাতায়াত করার সুবাদে দালালদের (স্থানীয় ভাষায় দাল্লা/ ভারুয়া) অনেকের সঙ্গেই বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। সেই ঘনিষ্ঠতার সূত্রেই জানতে পেরেছিলাম এদের কারও রোজগার দিনে সাড়ে সাতশো থেকে হাজার টাকার নীচে কখনওই নয়। ভাগ্য তেমন সুপ্রসন্ন থাকলে কখনও কখনও অঙ্কটা পাঁচ হাজারেও গিয়ে দাঁড়ায়। যা অনেক হাই প্রোফাইল কোম্পানি এক্সিকিউটিভকেও রীতিমতো লজ্জায় ফেলে দিতে পারে। এই দালালদের অধিকাংশই আদতে উত্তরপ্রদেশের মানুষ। এর পিছনেও একটা নির্দিষ্ট ইতিহাস আছে। উনিশ শতকের প্রায় পুরোটা শহরের নিষিদ্ধ পল্লীগুলোয় নব্য বাঙালি বাবুরা ছিলেন যৌনকর্মীদের মুখ্য পৃষ্ঠপোষক। শুধু লাম্পট্যই নয় তাদের রক্ষিতাদের নৃত্যগীত সহ বিভিন্ন ধরনের শিল্পকলায় পারদর্শিনী করে তোলাটাও ছিল বাবুদের বিনোদনের অন্যতম উদ্দেশ্য। সেই সময় সোনাগাছি নয়, পার্শ্ববর্তী রামবাগান এলাকাই ছিল শহরের সেরা যৌনপল্লি। উনিশ শতকের শেষে থেকে ধীরে ধীরে বাবু সভ্যতার পতন এবং মারোয়ারি শ্রেষ্ঠীদের উত্থানের হাত ধরে রামবাগান দ্রুত তার কৌলীন্য হারাতে থাকে আর একই সঙ্গে সোনাগাছিতে উত্তরপ্রদেশ মূলত আগ্রা থেকে একশ্রেণির যৌনকর্মীর আগমন ঘটে। এলাকায় এরা ‘আগ্রাওয়ালী’ বা ‘বেরিয়া’ নামে পরিচিত। এদের প্রায় সকলেই অসামান্য রূপসী এবং দেহসৌন্দর্যের অধিকারী। বর্তমানে সোনাগাছিতে এরাই সবচেয়ে ‘হাই প্রোফাইল’ যৌনকর্মী। এলাকার প্রায় সবক’টা ‘এ-ক্যাটাগরি’ বাড়ির সিংহভাগই এদের দখলে। এদের হাত ধরেই এই উত্তরপ্রদেশীয় দালালদের কলকাতা তথা সোনাগাছিতে পা রাখা। এলাকার অর্থনীতির একটা বড় অংশের নিয়ন্ত্রক এই উত্তরপ্রদেশীয় যৌনকর্মী এবং দালালেরা। এ ছাড়াও আরেকটি শ্রেণির উপস্থিতি সোনাগাছিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুপুরবেলা কখনও যদি ওই চত্বরে ঢুকে পড়েন নাকে ঝাপটা মারবেই বিভিন্ন বাড়ি থেকে ভেসে আসা মনকাড়া রান্নার গন্ধ। ঘরের পাশে, বারান্দার ধারে প্লাইউডের পার্টিশন ঘেরা একফালি জায়গায় রান্না চড়িয়েছেন একদল মানুষ। এদের সকলেরই আদি নিবাস ওড়িশা অথবা পূর্ব মেদিনীপুর। চাকর না বলে এককথায় এদের সোনাগাছি ‘অল পারপাস জব পারসোনেল’ বলা যেতে পারে। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে জল তোলা, বাসন মাজা, ঘর ঝাড়পোঁছ মায় খদ্দেরদের মদ-চাট-কোল্ড ড্রিংকস এনে দেওয়া, সমস্ত কাজ এরা সামলান অত্যন্ত দক্ষ হাতে। ফলে নিষিদ্ধ পল্লির মালকিন বা বাড়িওয়ালিদের এদের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যায় অনেকটাই। বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় বাড়িওয়ালিরা মাসিক একটা নির্দিষ্ট কমিশনের বিনিময়ে এই চাকরদের হাতে ব্যাবসার সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে রয়েছেন।
সোনাগাছির বাইরে আরও এক জায়গায় এই দালালদের অস্তিত্ব ছিল। আজ থেকে সাত-আট বছর আগেও যাদের ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, এলিয়ট রোড, সদর স্ট্রিট, বেড ফোর্ড লেন, মার্কুইস স্ট্রিট, রিপন স্ট্রিট… এইসব অঞ্চলে যাতায়াত ছিল, তাদের নিশ্চয়ই মনে থাকবে সন্ধের দিকে ওইসব এলাকা ধরে হেঁটে গেলে কানের কাছে ফিসফিস ডাক— “চলিয়ে স্যর… কলেজ গার্ল স্যার…।” পাশাপাশি হেঁটে চলা একটা লোক। গলায় ক্রমাগত কাটা রেকর্ডের মতো বেজে চলা নাছোড় আহ্বান। আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাজি হলেই কাস্টমারকে সঙ্গে নিয়ে সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ কোনও একটা বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে লোকটা। বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে “খোঃ” (খোল?) জাতীয় হাঁক পাড়বে একটা। ভেতর থেকে খুলে যাবে দরজাটা। একতলায় অথবা দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠে সামনেই একটা ড্রইং রুম মতো। সোফায় সার দিয়ে বসা মেয়েরা। কাস্টমারের অপেক্ষায়। কাউকে পছন্দ হলে সঙ্গে নিয়ে সেঁধিয়ে যাওয়া দুপাশের খোপ খোপ ঘরে। এক্ষেত্রেও ধান্দার নিয়মটা হুবহু সোনাগাছির মতোই, কাস্টমারের থেকে টাকা চাওয়ার প্রশ্নই নেই। মেয়েটিকে কাস্টমারের দেয় অর্থের থেকে পার্সেন্টেজ নিয়ে নেবে দালাল। তফাত শুধু একটাই সোনাগাছির দালালরা প্রায় সকলেই হিন্দু আর ফ্রি স্কুল স্ট্রিট অঞ্চলের দালালরা একশো শতাংশ বিহারি মুসলমান। কোনও অজ্ঞাত কারণে নব্বই দশকের শেষভাগ থেকে ওইসব অঞ্চলের ‘খালি কুঠি’গুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। বর্তমানে ওই চত্বরে আর একটিও এ ধরনের বাড়ি টিকে রয়েছে বলে এই অধম প্রতিবেদকের অন্তত জানা নেই। ফলে একমাত্র সোনাগাছি ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের আর অন্য কোনও নিষিদ্ধ পল্লিতে দালাল বা চাকরের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।
কালো পলিপ্যাক রহস্য
এই অভিজ্ঞতাটিও হয়েছিল সোনাগাছিতেই। সেই সকাল থেকে নিয়ে রাত অবধি চানাচুর, ঝালমুড়ি, ঘুগনি, আলুর দম, আখের রস, ছোলাভাজা, বাদাম, চানামশলা, আলুকাবলি, শাড়ি, জামাকাপড়, বেডশিট… কত ধরনের ফেরিওয়ালা যে আসে সোনাগাছিতে তার ইয়ত্তা নেই। এরই মধ্যে একদিন, দুপুরবেলার দিকে চোখে পড়েছিল লোকটাকে। সাইকেলের সামনে পিছনে ঝোলানো স্টেইনলেস স্টিল আর অ্যালুমিনিয়ামের থালাবাটি, হাঁড়িকুড়ি, আরও একাধিক বাসনপত্র। হাতে একটা ডুগডুগি। থেকে থেকে সেটা বাজিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। লোকটাকে দেখামাত্র বাড়িগুলোর দরজায় দাঁড়ানো মেয়েদের মধ্যে অনেকেই ছুটে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। ফিরেও এল কিছুক্ষণের মধ্যেই। সবার হাতে ঝোলানো একটা করে কালো পলিপ্যাক। দৌড়ে এসে ভিড় জমাল ফেরিওয়ালার সামনে। ধীরে সুস্থে সাইকেলটাকে স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে এক এক করে প্রত্যেকের হাত থেকে পলিপ্যাকগুলো নিয়ে ভেতরে হাত চালিয়ে ভালভাবে পরীক্ষা করে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করল লোকটা। তারপর ওজন অনুসারে মেয়েদের হাতে তুলে দিতে লাগল থালা, বাটি, গ্লাস, অন্যান্য বাসনকোসন। ওজন নিয়ে একটু আধটু বিতর্ক যে হচ্ছিল না তা নয়। তবে সবটাই মোটামুটি বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে। একটা পলিপ্যাকের সর্ব্বোচ্চ ওজন হয়েছিল সাড়ে সাতশো গ্রাম। বিনিময়ে সেই পলিপ্যাকের মালকিন পেয়েছিল ইয়া পেল্লায় সাইজের ছ’বাটির একটা টিফিন বক্স। কিন্তু পলিপ্যাকের মধ্যে আছেটা কী? তীব্র কৌতূহল জেগেছিল মনে। জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলাম— মাথার চুল। নকল চুল বা পরচুলা তৈরির কাজে লাগে। এক্সপোর্টও হয় নাকি অত্যন্ত চড়া দামে। তা বলে শুধু কালো পলিপ্যাকেই কেন? মেয়েদের প্রশ্ন করে যে উত্তরটা পেয়েছিলাম তা শুধু অভিনবই নয়, রীতিমতো চমকপ্রদ। কাটা চুল নাকি খোলা দেখাতে নেই। তাতে নাকি অমঙ্গল হয়। শোনার পর বিস্ময়ে ঝুলে যাওয়া চোয়াল বন্ধ হতে সময় লেগেছিল মিনিটখানেক।
ওজন জাদু
সামনে দাঁড়ানো নধর একটা খাসি। খাসিটার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে রয়েছেন বাহাল ভাই। একদৃষ্টে জরিপ করছেন খাসিটাকে। মিনিটখানেক বাদে নজর আন্দাজি সেরে নিয়ে খাসিটার বুকের মাঝখানে হাত ঢুকিয়ে সামনের পা দুটো জমি থেকে ইঞ্চিছয়েক ওপরে তুলে ফের নামিয়ে দিলেন মাটিতে। ঘুরে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন— “লগবগ (মোটামুটি) বাইশ কিলো গোস্ত হোগা, হাড্ডি চামড়া ছোড়কে।” পিছনে দাঁড়ানো দু’জন। খাসির ক্রেতা। “শুক্রিয়া বাহালভাই,” বলে ঘাড় নাড়ল আশ্বস্তভাবে।
প্রিয় পাঠককুল, আসুন এবার বাহালভাইয়ের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক। সত্তরের দশকের একদম গোড়ার দিকে লখনউ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন মানুষটি। পার্ক সার্কাস ট্রামডিপোর উলটোদিকে বেঙ্গল মিট শপ নামে ছোট একটা খাসির মাংসের দোকান দিয়েছিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই ফুলেফেঁপে ওঠে ব্যাবসা। সেই ছোট মাংসের দোকান থেকে ব্যাবসা বাড়তে বাড়তে পার্ক সার্কাস ট্রামডিপোর গায়ে বিখ্যাত মোগলাই খানার ঠিকানা জিশান হোটেলের মালিক আজ বাহালভাই। তবে মানুষটার এই প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে এতখানি ওপরে উঠে আসার গল্প শোনাবার জন্য এ লেখা লিখতে বসিনি আমি। এ সবের বাইরেও এক অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে বাহালভাইয়ের। যাকে প্রায় অলৌকিকত্বের পর্যায়ে ফেলা যেতে পারে। যে-কোনও খাসির সামনের পা জোড়া মাটি থেকে সামান্য ওপরে তুলে প্রাণীটির নিট মাংসের ওজন প্রায় নিরানব্বই ভাগ সঠিক বলে দিতে পারেন বাহালভাই। যার বর্ণনা একটু আগে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। পরবর্তীতে দাঁড়িপাল্লায় চাপিয়ে ওজন করলে মেরেকেটে বড়জোর পাঁচশো গ্রাম থেকে এককেজি এদিক ওদিক হবে। তার বাইরে কিছুতেই নয়। ওয়াটগঞ্জ, রাজাবাজারে খাসির হাটগুলোয় বাহালভাইয়ের মতো মানুষদের ওস্তাদ বা খলিফা নামে ডাকা হয়। সারা শহরে এ রকম খলিফা নাকি মাত্র পাঁচ-ছ’জন রয়েছেন। ফলে খাসির হাটে এই ওস্তাদ বা খলিফাদের চাহিদা প্রচণ্ড। বড় বড় ক্রেতা মহাজনরা চোখ বুজে নির্ভর করেন এদের ওপর। আর এই ভরসার কারণটা সহজেই অনুমেয়। একটা নির্দিষ্ট কমিশনের ভিত্তিতে এই কাজটা করে থাকেন খলিফারা। সেটা হল খাসিপিছু পাঁচশো থেকে এককেজি মাংসের দাম।
বাহালভাই। বৃষস্কন্ধ। ছ’ফিটের কাছাকাছি উচ্চতা। পালিশ করা হাতির দাঁতের মতো গায়ের রং। চোখের কোণে সুর্মা। অ্যাপোলোর মতো সুদর্শন। ঠোঁটের কোণে চাপা, ভারী মিঠে একটা হাসি সবসময়। ইদানীং ধর্মে কর্মে মন দেওয়ায় মাথায় ফেজ টুপি আর একগাল শ্বেতশুভ্র দাড়ি। শুনেছি ব্যাবসার ব্যস্ততার কারণে আজকাল আর খলিফার কাজটা সেভাবে করতে পারেন না। তবে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবের কোনও অনুষ্ঠানে জোরাজুরির ফলে এখনও দৌড়োতে হয় মাঝেমধ্যে। কারণ ওই অলৌকিক ওজন-জাদুটা যে আজও ভোলেননি বাহালভাই।
খ্যাপা খুঁজে ফেরে…
বউবাজার স্ট্রিট অধুনা বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় বারবার চোখে পড়েছে দৃশ্যটা। কয়েকজন মানুষ। ক্ষয়া ক্ষয়া চেহারা, মলিন পোশাক-আশাক। হাতে ছোট ছোট ঝাঁটা। ঝাঁট দিচ্ছে রাস্তার ওপর সার সার সোনার দোকানগুলোর মেঝে আর সামনের ফুটপাতে। কাজটা করছে খুব ধীরে ধীরে, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। প্রতিটি ইঞ্চিতে জমে থাকা ধুলো ঝাড়ু দিয়ে এনে জড়ো করছে একজায়গায়। তারপর সাবধানে কাঁচিয়ে তুলে নিচ্ছে হাতল লাগানো একটা চ্যাটালো পাত্রে যাতে এককণাও মাটিতে না পড়ে থাকে। কাজটা শেষ করে পাত্রটা নর্দমার ধারে চাপাকলের সামনে নিয়ে গিয়ে সমস্ত ধুলোটুকু ঢেলে দিচ্ছে একটা ছাঁকনিতে। অল্প অল্প জল ঢেলে ঢেলে ধুয়ে চলেছে বার বার। আঙুল দিয়ে খুঁটে খুঁটে সতর্ক চোখে খুঁজে চলেছে কিছু। খুঁজে পেলে দু’নখের ডগায় তুলে রেখে দিচ্ছে ছোট একটা কাপড়ের থলেতে। না পেলে ছাঁকনির ধুলোকাদা ঢেলে দিচ্ছে নর্দমায়।
প্রিয় পাঠক, যত সংক্ষেপে লাইনগুলো লিখলাম ব্যাপারটা আসলে কিন্তু মোটেই সেরকম নয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যায় এই গোটা প্রক্রিয়াটা সম্পূর্ণ হতে। কিন্তু কী খুঁজছে লোকগুলো? পাঠকদের অবগতির জন্য জানাই— সোনা। গয়না তৈরির সময় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সোনার কুচি, খালি চোখে যা দেখতে পাওয়া অসম্ভব, ছিটকে পড়ে মিশে যায় ধুলোয়। ধুলোকাদা ঘেঁটে সেই সোনাই খুঁজছে ওরা। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র অণুকণার মতো সোনার কুচিও ধরা পড়ে যাবে ওদের মাইক্রোস্কোপিক চোখে, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। সোনার দোকানদার অথবা কারিগররা ওদের ‘ঝড়ুয়া’ নামে চেনে। ওরা নিজেদের পরিচয় দেয় ‘সোনঝড়ুয়া’ নামে। সোনঝড়ুয়া গোষ্ঠী। এরা সবাই ঝাড়খণ্ড এবং বিহারের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে জীবিকার সন্ধানে এ শহরে চলে আসা হতদরিদ্র হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষ। এদের একমাত্র জীবিকা এই ধুলোকাদা ঘেঁটে সোনা খুঁজে বের করা। অর্থের বিনিময়ে সোনার দোকান আর সামনের ফুটপাতের ইজারা নেয় এরা। বিশেষ করে লগনশা (বিয়ের মরশুম), ধনতেরাস, পয়লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়ার মতো উৎসবের সময় সোনঝড়ুয়াদের ব্যস্ততা যায় বেড়ে। দোকানদাররাও মওকা বুঝে ইজারার টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে দেয় এইসময়টায়। ভাগ্য খুব ভালো থাকলে একজন সোনঝড়ুয়া ধুলোকাদা ঘেঁটে বছরে ভরিদুয়েকের মতো সোনা সংগ্রহ করতে পারে। যদিও সেটা কালেভদ্রে ঘটে। এদিকে সোনার মহাজনরা বাজারদরের চেয়ে অনেক কম দামে এদের থেকে সোনা কেনে অর্থাৎ চিরাচরিত সেই ঠকে যাওয়ার গল্পটা কিন্তু থেকেই যায় এই হতভাগ্য, হতদরিদ্র মানুষগুলোর জীবনে। এদের বড় একটা অংশ হাওড়া লাইনে উত্তরপাড়া, বালি রেলস্টেশনের গায়ে ছোট ছোট ঝুপড়ি বেঁধে সপরিবারে বাস করে। বিদ্যুত্হীন, জলহীন, অশিক্ষা আর দারিদ্রে ভরপুর পশুরও অধম জীবন। তবু কপালে থাপ্পড় মেরে মেনে নিতে হয়েছে সেটাকেই। কারণ কবিতার সেই খ্যাপার মতো পরশপাথর থুড়ি সোনা খুঁজে ফেরা ছাড়া আর কোনও জীবিকার সন্ধান যে জানা নেই মানুষগুলোর।
কালেকশন পার্টি
বড়বাজার এবং ডালহৌসি সংলগ্ন অফিসপাড়ায় দেখতে পাওয়া যাবে এঁদের। মূলত পুরনো ঘরানার মাড়োয়ারি ফার্ম ও গদিগুলোয় ঘোরাফেরা করেন এঁরা। বেশিরভাগই পুরনো কলকাতার ক্ষয়িষ্ণু বনেদি পরিবারের সন্তান। বাপ পিতেমোরা বুলবুলির লড়াই, বাঈ নাচ, রেসের মাঠে মুঠো মুঠো টাকা উড়িয়েছেন এক সময়। এখন ভগ্নপ্রায় বিশাল বাড়ি, জরাজীর্ণ। গাদাগুচ্ছের শরিক। মামলা মোকদ্দমা, কোর্ট কাছারি। নামে তালপুকুর কিন্তু ঘটি ডোবে না। মোটামুটি সকাল দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ চানটান সেরে, রুটি-আলুকুমড়োর ঘ্যাঁটের ব্রেকফাস্ট সাঁটিয়ে এঁরা বেরিয়ে পড়েন বাড়ি থেকে। এঁদের সবারই বয়স মোটামুটি ষাট থেকে পঁচাত্তরের কোঠায়। পরনে ধবধবে কাচা এবং পাটভাঙা বাংলা শার্ট, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, ধুতি অথবা পাজামা। ট্রামের সেকেন্ড ক্লাস অথবা বাসে চেপে পৌঁছে যান গন্তব্যস্থলে। ঢুঁ মারা শুরু করেন গদিগুলোয়। কোন গদিতে কবে যাবেন ডেট বাঁধা আছে। বাঁধা আছে আলাদা গদিও। মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী বিশেষ করে বয়স্কদের মধ্যে অনেকেরই দানধ্যানে বেশ মতিগতি আছে। এঁরাই এঁদের মূল টার্গেট গ্রুপ। টাকা চাওয়ার বাহানা হাজার রকম। মোটামুটি দশটা থেকে একটা অবধি গদি থেকে গদিতে ঘুরে ঘুরে টাকা সংগ্রহ করেন এঁরা। অতঃপর দ্বিপ্রাহরিক ফ্রি লাঞ্চ বড়বাজার অঞ্চলের কোনও মন্দির অথবা ধর্মস্থানে। এই অঞ্চলে বহু এরকম মন্দির রয়েছে যেখানে রোজই কোনও না কোনও ধর্মীয় সংস্থা বা ধনী গোষ্ঠীর তরফ থেকে ‘ভাণ্ডারা’-র (বিনামূল্যে প্রসাদ বিতরণ) আয়োজন করা হয়। কবে কোথায় কোন মন্দির বা ধর্মস্থানে ‘ভাণ্ডারা’ দেওয়া হবে এই কালেকশন পার্টিদের প্রত্যেকের সেটা নখদর্পণে। দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে ঘণ্টাখানেক জিরিয়ে নিয়ে ফের হানা দেওয়া শুরু হয় গদিতে গদিতে। চেয়েচিন্তে (ওদের নিজেদের ভাষায় কালেকশন) দিনের শেষে রোজগার হয় মন্দ না। মাসের শেষে উপার্জনকৃত অর্থের পরিমাণ পনেরো হাজার অবধি পৌঁছোয় অনেকের ক্ষেত্রে। রোজগারের অঙ্কটা নির্ভর করে বাকচাতুর্য অর্থাৎ গোদা বাংলায় দাতাকে পটিয়ে পাটিয়ে যতটা বেশি সম্ভব টাকা খিঁচে নেবার ওপর। এঁদেরই মধ্যে একজন, মিত্তিরদার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আজ থেকে বছর বিশেক আগে। উত্তর কলকাতার এক পড়তি বনেদি বাড়ির সন্তান। বয়স সত্তরের কোঠায়। দুধে আলতা গায়ের রং। নীলচে চোখের মণি। দুধসাদা ব্যাকব্রাশ চুল। উচ্চতা প্রায় ছ’ফুট। গলায় রুদ্রাক্ষ আর স্ফটিকের মালা। পরনে পাটভাঙা কনুই অবধি গোটানো ফুল হাতা বাংলা শার্ট আর ধুতি। হাতের আঙুলে গোটা চারেক পাথর বসানো আংটি। শার্টের ঝুলপকেটে ছোট একটা নোটখাতা। কবে, কোথায়, কোন ডোনার পার্টির কাছে যেতে হবে তার খতিয়ান। সেই সময় কাঁটায় কাঁটায় মেনে চলেন মিত্তিরদা। লোকমুখে শোনা দাতাদের কাছে মিত্তিরদার দাপট এতটাই ছিল যে কখনও চাহিদার তুলনায় অর্থের পরিমাণ কম হলে সেই দাতাকে অভিযোগ জানাতেন বেশ কড়া ভাষায়। সেই কড়া ভাষার একটি নমুনা এখানে তুলে দিচ্ছি। বয়ানটি মোটামুটি এইরকম— “তোমার বাপঠাকুরদারা অনেক ভাল যজমান ছিলেন। খোলা হাতে দক্ষিণা দিতেন। তোমরা আজকালকার ছেলেছোকরা, দানধ্যানের মর্মই বোঝো না।” প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা ভাল যে মিত্তিরদার মতো কালেকশন পার্টিরা সংগ্রহকৃত অর্থকে ‘দক্ষিণা’ আর দাতাদের ‘যজমান’ নামে ডাকেন। ওদের মুখেই শোনা সারা কলকাতা শহরে এরকম সংগ্রাহক প্রায় শ’চারেক রয়েছেন। তবে এঁদের প্রায় সবারই অভিযোগ, পুরনো ঘরানার অবাঙালি ব্যবসায়ীদের দানধ্যানে বেশ খোলা হাত ছিল কিন্তু তাদের লেখাপড়া জানা পরবর্তী প্রজন্ম এই দান খয়রাতির ব্যাপারটাকে আর মোটেই সেভাবে গুরুত্ব দিতে রাজি নয়। প্রায় বিশ বছর আগে শোনা এসব কথা। তাই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ‘কালেকশন পার্টি’-রা আজও এই শহরে টিকে আছেন কিনা জানা নেই।
তোমার শখ আমার বাঁচা
কখনও বিকেলের দিকে যদি কলকাতার কালীঘাট, টালিগঞ্জ, শ্যামবাজারের খালপাড়গুলোর দিকে যান, চোখে পড়লেও পড়তে পারে কিছু মানুষ, খালি গা, নিম্নাঙ্গে মালকোঁচা মারা লুঙ্গি, দু’হাতে খালের পাঁক তুলে বড় বড় মাটির চাড়িতে ভরছে। ব্যাপারটা কী? খাল সংস্কার হচ্ছে নাকি? এ ধরনের প্রশ্ন মনের কোণে উঁকিঝুঁকি মারার আগেই জানাই ব্যাপারটা আদৌ সেরকম নয়। ওই লোকগুলো আসলে কেঁচোশিকারি। আমাদের যাদের বাড়িতে অ্যাকোয়ারিয়ামে রঙিন মাছ পোষার শখ রয়েছে তাদের প্রায় সকলেরই জানা যে এক ধরনের অতি ক্ষুদ্রাকার কেঁচো এই ধরনের মাছের মূল খাদ্য। খালের পাঁক ঘেঁটে ঘেঁটে সেই কেঁচো সংগ্রহ করছে মানুষগুলো। আপাতদৃষ্টিতে নজর চালালে চাড়ির মধ্যে থকথকে কালো নোংরা পাঁক ছাড়া আর কিছুই নজরে আসবে না। সেই চাড়ি ভরতি পাঁক মাথায় করে বয়ে নিয়ে আসা হবে বাড়িতে। তারপর ঢেলে দেওয়া হবে ছড়ানো কোনও পাত্র বা এক ইটের দেওয়াল তোলা ঘেরাটোপে। ওপরে ঢেকে দেওয়া হবে কালো রঙের পলিথিনের চাদর। পাঁকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অযুত-কোটি নিশাচর কেঁচো রাত হয়ে গেছে ভেবে উঠে আসবে ওপরে। আড়াই-তিন ঘণ্টা বাদে চাদর সরিয়ে দক্ষ হাতে কাঁচিয়ে তুলে নেওয়া হবে কেঁচোগুলোকে। একটা লম্বাচওড়া সাদা কলাইকরা পাত্রে ঢেলে বারবার ধুয়ে পরিষ্কার করে নেওয়া হবে বাকি পাঁকটুকু। পড়ে থাকবে জমাটবাঁধা অযুত-কোটি রক্তলাল কেঁচো। বড় বড় পলিপ্যাকে ভরতি করে পৌঁছে দেওয়া হবে শহরের রঙিন মাছের দোকানগুলোয়। গৃহস্থের সাজানো ড্রয়িংরুমে গৃহশোভা বৃদ্ধির উপকরণ অ্যাকোয়েরিয়ামে লাল নীল মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হবার জন্য। মাছের দোকানদার অথবা গৃহস্থ কেউ খবরই রাখবে না তাদের ব্যাবসা অথবা শখের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে প্রতিদিন কত রকমের বিপদ আর রোগবালাইয়ের ঝুঁকি নিয়ে জলে নামে কেঁচো শিকারিরা। খালের পাঁক কালো নোংরা জলে হাজার রকমের বিষাক্ত জীবাণু। ফলে বারোমাস হাতে-পায়ে জলহাজা সহ একাধিক চর্মরোগে ভোগে মানুষগুলো। এ ছাড়া রক্তচোষা জোঁক, সাপ আর বিষাক্ত পোকামাকড়ের (ওয়াটার স্পাইডার, ওয়াটার বিটলস) কামড়ের বিপদ তো আছেই। সঙ্গে দোসর দিনরাত জল ঘাঁটার ফল— বারোমাসে সর্দিকাশি আর জ্বর। এদিকে বর্ষাকালে খালের জল যায় বেড়ে। গভীর জলে নেমে কেঁচো ধরার কাজটা আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে সে সময়টায়। এত হাড়ভাঙা পরিশ্রম, রোগবালাই আর বিপদের ঝুঁকি নিয়ে সারাদিন কাজ করার পরও হাতে লাভ থাকে অতি সামান্যই। ইদানীং সেই লাভেও থাবা বসিয়েছে ড্রাইফুডের বাড়বাড়ন্ত। দেশি-বিদেশি ড্রাইফুডে ভরতি রঙিন মাছের দোকান। সংরক্ষণের ঝামেলা নেই। গৃহস্থের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য। ফলে দারিদ্র্যসীমার অনেক নীচে বিচরণ করে এইসব প্রান্তিক মানুষগুলো। আনন্দ পালিত রোডের রেলব্রিজ সংলগ্ন বস্তি আর শিয়ালদা-পার্ক সার্কাস স্টেশনের মাঝখানে রেললাইনের ধারে ঝুপড়ি বেঁধে বাস করে এরা। ঘরে অপরিসীম দারিদ্র্য। তবু রোজ সকালে উঠে বেরোতেই হয় এই অসম্ভব পরিশ্রমসাধ্য, ঝুঁকিপূর্ণ আর বিপদসঙ্কুল জীবিকার সন্ধানে, কারণ দোকানদারের কাছে যা ব্যাবসা, গৃহস্থের কাছে যেটা শখ, ওদের কাছে সেটাই যে পেটের ভাত।
রাম-রথ
জানুয়ারি মাস। রাত সাড়ে দশটা। পৌনে এগারোটা মতো হবে। ইস্টার্ন বাইপাসের গায়ে অজয়নগর বাসস্টপে দাঁড়ানো দুটো ছেলে। বছর পঁচিশ-ছাব্বিশ। কথা বলছিল নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে। “কীরে, তোর রাম-রথ তো এখনও এল না।” প্রথম জন জিজ্ঞেস করল দ্বিতীয় জনকে। দ্বিতীয় ছেলেটা, ছিপছিপে স্মার্ট চেহারা, লেদার জ্যাকেটের বুকপকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সময় দেখল, “চিন্তা করিস না এসে যাবে।” জবাব দিল নিশ্চিন্ত গলায়। মিনিট পাঁচেক বাদে একটা স্কুটার, গতি কমিয়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল বাস স্টপ থেকে হাত দশেক দূরে। দ্রুত পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল ছেলে দুটো। স্কুটার আরোহী বেঁটেখাটো পেটা গড়ন। গলা অবধি জিপার টানা কালো জ্যাকেট। “কী বস, অ্যাতো দেরি হল ক্যানো?” জিজ্ঞেস করল দ্বিতীয় ছেলেটা। মাথা থেকে হেলমেটটা খুলল আরোহী, “আরে বোলো না, পাটুলির ওখানে শালা টায়ার ফাঁসল। রিপেয়ার করিয়ে আসতে আসতে…।” বলতে বলতে স্কুটারের সামনের ডিকিটা খুলে বের করে আনল চ্যাপটাপানা একটা রামের পাঁইট। প্রথম ছেলেটা দ্রুত আরোহীর হাত থেকে পাঁইটটা নিয়ে গুঁজে ফেলল কোমরে। তারপর হিপপকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে কয়েকটা নোট গুঁজে দিল আরোহীর হাতে। “আসি আরও তিন জায়গায় সাপ্লাই আছে। দরকারে ফোন কোরো।” স্কুটার স্টার্ট দিয়ে গড়িয়ার দিকে চলে গেল আরোহী। বাসস্টপের গায়ে স্ট্যান্ড করানো একটা হান্ড্রেড টুয়েন্টিফাইভ সি সি বাইক। ঝটপট বাইকে চেপে মোড় থেকে সন্তোষপুরের দিকে ঘুরে গেল ছেলে দুটো।
প্রিয় পাঠক, এতক্ষণ যে দৃশ্যক্রমের বর্ণনা দিলাম আপনাদের, সে ব্যাপারে একটু খোলসা করে বলি এবার। ওই স্কুটার চালক আসলে একজন ভ্রাম্যমাণ মদবিক্রেতা। পুরো ব্যাবসাটাই চলে কালোবাজারে। এরকম আরও অন্তত পনেরো-কুড়িজন মোবাইল ওয়াইন সেলার রয়েছে রুবি থেকে গড়িয়া, এই বাইপাস সংলগ্ন এলাকাটা জুড়ে। এ কাজে সবারই বাহন স্কুটার অথবা বাইক। নিপ, পাঁইট আর বোতলপিছু কুড়ি থেকে পঞ্চাশ টাকা বেশি পড়ে। রাত দশটার পর লাইসেন্সড মদের দোকানগুলো ঝাঁপ বন্ধ করার পর কারবারটা শুরু হয়। এই বিক্রেতা অথবা তাদের বাহনদের একাধিক কোডনেম রয়েছে ক্রেতামহলে। যেরকম ‘রাম-রথ’, ‘টান্টু মেল’, ‘বুজ এক্সপ্রেস’, ‘টাল্লাগাড়ি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ছুটিছাটা, উৎসব বিশেষত দুর্গাপুজো, দোল, দেওয়ালি, কালীপুজো, বড়দিন, থার্টি ফার্স্ট নাইট আর গান্ধি জয়ন্তীতে (ওইদিন মদের দোকান বন্ধ থাকে) চাহিদা তুঙ্গে ওঠে। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দামও যায় বেড়ে। পুরনো এবং পার্মানেন্ট কাস্টমারদের জন্য হোম ডেলিভারিরও সুবন্দোবস্ত রয়েছে। অধিক মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই…
শহর বাড়ছে। যাদবপুর, টালিগঞ্জ ছাড়িয়ে গড়িয়া টপকে বোড়াল হয়ে সেই কামালগাজি, নরেন্দ্রপুর, সোনারপুর, বারুইপুর… হাইরাইজ, স্কাইস্ক্র্যাপার, সারসার ফ্ল্যাটের জঙ্গল। নগরায়ণের বিষাক্ত থাবায় অবাধে বোজানো হচ্ছে মাইলের পর মাইল পুকুর, জলাভূমি, নির্বিচারে কাটা পড়ছে লক্ষ লক্ষ গাছ। চাষজমিকে পায়ের তলায় থেঁতলে মাথা তুলছে বহুতল। এর ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বিপদে পড়ছে সেখানকার মনুষ্যেতর বাসিন্দারা। সাপ, ব্যাঙ, মাছ, প্রজাপতি, কেঁচো, পাখি, ভাম, ভোঁদড়, শেয়াল… আরও কতশত প্রজাতি। কিন্তু ভিটেমাটি চাটি হয়ে যাবেটা কোথায়। ফলে মরছে, বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দলে দলে। এর মধ্যেই নাছোড় কেউ কেউ, এখনও তাদের সেই কবেকার, আদ্যিকালের ভিটে ছাড়তে নারাজ। তাই কংক্রিটের জঙ্গলে ফ্ল্যাটবাড়ির ভেন্টিলেটরে এখনও খড়কুটো জুটিয়ে এনে বাসা বাঁধছে চড়াই। ডিম, ছানাপোনা বিয়োচ্ছে। জল আর ঝোপঝাড়ের অভাবে পাকা রাস্তার ওপর এসে বসে থাকছে নিঃসঙ্গ কুনো ব্যাঙ। এখনও না কাটা পড়া জামগাছটার ডালে কচিৎ কদাচিৎ উঁকিঝুঁকি মারা হতাশ লক্ষ্মীপ্যাঁচা, রোগা রোগা কাঠবেড়ালী। খাবার নেই, তাই ফ্ল্যাটবাড়ির রান্নাঘরের জানলা গলে হানা দিচ্ছে ভাম। মাঝে মাঝে হঠাৎ চোখে পড়ে যাওয়া জোড়া শালিখ নেচে বেড়াচ্ছে ঝুল বারান্দার কার্নিশে। একগাদা আন্ডাবাচ্চা নিয়ে ভারী বিপদে পড়ে যাওয়া বেজি-মা। দিগ্ভ্রান্তের মতো ঘুরঘুর করছে এদিক ওদিক। বুঝতে পারছে না লুকোবে কোথায়। এদের মধ্যে আরও একদল রয়েছে যারা এই উচ্ছেদ হওয়াটাকে মেনে নিতে পারেনি কিছুতেই। সাপ। সুদৃশ্য ড্রইংরুমে সোফার নীচে, কাবার্ডের তলায়, বেডরুমে আলমারির পিছনে, বাথরুমে কমোড ফ্ল্যাশের ঢাকনার ওপর… সর্বত্র অবাধ বিচরণ এদের। লেজের ডগাটুকু চোখে পড়া মাত্র গেরস্থর তীব্র ভয়মিশ্রিত চিৎকার, চ্যাঁচামেচি… প্রবল আতঙ্ক! আর এই আতঙ্কই দরজা খুলে দিচ্ছে এক অদ্ভুত জীবিকার। সাপুড়ে বা বেদে। মূলত দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা বা বিহার-উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা এই যাযাবর শ্রেণির মানুষরা মাঝে মাঝেই এসে হানা দেয় এইসব সদ্য গজিয়ে ওঠা আবাসনগুলোয়। মুখে হাজার রকম বুলি— “ঘরে সাঁপ আছে গোওও… নাগের বাস (গন্ধ) পেতেছি, সাঁপ ধরাবে নাকি গোওওও…” অথবা “ঘর মে সাঁপোয়া ঘুঁস গৈলে। হাম বানজারা, সাঁপোয়া পাকড়বে…” ইত্যাদি ইত্যাদি। এই হানা দেওয়ার ব্যাপারটা ঘটে মূলত দুপুরের দিকে। সাধারণত ওই সময়টায় পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কেউ বাড়িতে থাকেন না। সাপুড়েদের ভয়মাখানো বুলিতে চরম সন্ত্রস্থ গৃহকর্ত্রী। ঘরের মধ্যে সাপ! দু’দিন আগে নাকি মিসেস বাসুর ফ্ল্যাটে দেখা গেছিল। লোকগুলো যা বলছে তাতে যদি আমার ঘরেও থাকে? এই ভয়ের রন্ধ্রপথে ঘরে ঢুকে পড়ে সাপুড়েরা। ঢুকেই সন্দেহজনক চোখে চারদিক দেখে নিয়ে নাকটাক শুঁকে শুরু হয় আরেকপ্রস্থ ভয় দেখানোর পালা। “ইয়া বড়কা কোবরা নাগ!… বহোত বিষনি (বিষাক্ত)! পাকড়নেমে বহোত তকলিফ হোগা… পাঁচশ রুপিয়া লাগেগা।” ভয়ে আধমরা গৃহকর্ত্রী। শুরু হয় কাতর গলায় অনুনয় বিনয়— “একটু কমসমে হয় না বাবা।” শেষ অবধি তিনশো কি চারশোয় রফা হয়। এইখানে পাঠকদের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি, দুয়েকটি ক্ষেত্রে এর সত্যতা থাকলেও সাপুড়েদের এই ভয় দেখানোর খেলাটা শতকরা নিরানব্বই ভাগ ক্ষেত্রেই মিথ্যে এবং লোকঠকানো। ঢোলা জামা বা পাঞ্জাবির আস্তিনের ফাঁকে লুকোনো থাকে বিষদাঁত ভাঙা চন্দ্রবোড়া, কালাচ, শাঁখামুঠি, গোখরো বা খরিশ কেউটে। নিদেনপক্ষে নির্বিষ ঢোঁড়া, হেলে, দাঁড়াশ, কালনাগিনী বা লাউডগা। নিখুঁত হাতসাফাইয়ের খেলায় সেগুলোকেই আস্তিনের ফাঁক থেকে বের করে এনে দেখানো হয় বাড়ির লোকজনকে। চরম আতঙ্কগ্রস্ত বাড়ির লোকজন। সাপুড়েদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিয়ে রক্ষা পান ভয় থেকে। এই একই রকম ঘটনা ঘটতে দেখেছিলাম সেই ছেলেবেলায় মামাবাড়িতে। তখন ক্লাস থ্রি কি ফোর। গরমের ছুটিতে মামাবাড়ি গেছি। ভবানীপুরে পুরনো পাড়া ছেড়ে বেহালার সরশুনায় নিজেদের বাড়িতে উঠে এসেছে মামারা। আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা। সরশুনা, চারদিকে গাছগাছালি, ঝোপঝাড়, পুকুর-ডোবা-নালা, মাঝে মাঝে ছিটেবেড়া আর টালির চালের উদ্বাস্তু কলোনি। ইতিউতি দু’-চারটে সদ্য নির্মীয়মাণ ইটের দাঁত বের করা সিমেন্টের প্রলেপহীন বাড়ি। নিঝুম ঘুঘুডাকা দুপুর আর রাত নামলেই ঘুরঘুট্টি অন্ধকার চারদিকে। সঙ্গে উপরি পাওনা হিসেবে ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ুইপাখির সাইজের ভ্যাম্পায়ার মশা। মনে আছে ঠিক এরকম একটা দুপুরে, মামারা সব অফিসে, বাড়িতে হানা দিয়েছিল সাপুড়ের দল। মামিদের ভুজুংভাজুং দিয়ে রান্নাঘরের সিঁড়ির তলায় কয়লা রাখার অন্ধকার খুপরিটা থেকে ধরে নিয়ে গেছিল হাত তিনেক লম্বা একটা দাঁড়াশ, সঙ্গে নগদ পাঁচটা টাকা। তখনকার বাজারে অঙ্কটা অনেক। ভয়ে দুর্গানাম (নাকি মনসা?) জপতে জপতে সাপুড়েদের টাকা মিটিয়ে স্বস্তির হাঁফ ছেড়েছিল মামিরা। আজ এতদিন বাদেও কথাটা মনে পড়লে মনে মনে হাসি আর এস ওয়াজেদ আলির ভাষায় ভাবি— ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।’
খাঁটি বেওসা
ফুটপাতের ধারে বিশেষ করে অফিসপাড়ায় চোখে পড়বে দৃশ্যটা। একটা বড় অ্যালুমিনিয়ামের বালতিতে গোঁজা খেজুরপাতা, বালতিভরতি মধু, ওপরে ভাসছে ভাঙা মৌচাকের টুকরো, মৌচাকের ওপর ইতিউতি উড়ে অথবা ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকটা মৌমাছি। পাশে বসা ফেরিওয়ালা। হাতে বালা, কানে মাকড়ি, গলায় রংবেরঙের পাথর বসানো হার। যাযাবর বানজারা টাইপের চেহারা। থেকে থেকে হাঁক পাড়ছে মধ্যমস্বরে। “মধু লে লো বাবু, আসলি জংলি মধু… জঙ্গল সে তোড়কে লায়া…।” মধু যে কতটা খাঁটি সেটা প্রমাণ করার জন্য একটা দশ টাকার নোটে মধু মাখিয়ে দেশলাই জ্বেলে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। নোটটা পুড়ছে না। খাঁটি মধু মাখানো কোনও জিনিস নাকি আগুনে পোড়ে না— দাবি করছে লোকটা। কথার জাগলারিতে আকৃষ্ট হয়ে ভিড় জমাচ্ছেন পথচারীরা। বিক্রিবাট্টাও হচ্ছে ভালই। খাঁটি মধু কিনে বাড়ি ফিরছেন পথচারীরা এবং অতি অবশ্যই ঠকছেন। কারণ ওই খাঁটি মধুর বারো আনাই ভেলি বা চিটেগুড়ের রস। দু’আনা লিকুইড গ্লুকোজ, ঘনভাব আনার জন্য, এক আনা নকল স্বাদগন্ধের এসেন্স আর বাকি একআনা সত্যিই খাঁটি মধু। আর মধুর বালতির ওপর মৌমাছি ওড়াটি কোনও ব্যাপারই না। শুধু মধু নয়, চিনির বস্তা বা ভেলিগুড়ের ঢেলার ওপরেও মৌমাছি ঘুরঘুর করে। যে-কোনও গুড়-বাতাসার দোকানে গেলেই ব্যাপারটা মালুম হবে। এদিকে নোট না পোড়ার রহস্যটা স্রেফ কেমিক্যালের কারসাজি। কিনে নিয়ে গিয়ে দু’দিন বাদেই ভুল ভাঙছে। এর অবশ্যম্ভাবী ফল— ঘরে গৃহিণীর গঞ্জনা, পুত্র-কন্যার পরিহাস। বেচারা মধ্যবিত্ত অফিসবাবু!
প্রায় এই একইরকম আর-এক ধরনের ব্যবসায়ীরা রয়েছেন শহরে। তবে এদের জন্য খাঁটি মধুর জায়গায় খাঁটি ঘি। যার প্রায় ষাট শতাংশ সস্তা বনস্পতি আর ক্ষতিকারক ভেজিটেবল অয়েল। সঙ্গে নকল স্বাদগন্ধের এসেন্স, যথারীতি, বাকি ব্যাবসার টেকনিকটা মধুর মতোই হুবহু এক। স্রেফ চিটিংবাজি আর বাকচাতুর্যকে মূলধন করে এই ‘খাঁটি’ বেওসাদাররা আজও দিব্যি করেকম্মে খেয়ে যাচ্ছেন আমাদের এ শহরে।
…কত রং বদলায়
শেয়ালদা প্রাচী সিনেমার উলটোদিকে এন আর এস হাসপাতালের গা ঘেঁষে যে সুড়ঙ্গপথটা (সাবওয়ে) সোজা শেয়ালদা স্টেশনের দিকে চলে গেছে সেটা ধরে কোনওদিন যদি হেঁটে যান, চোখে পড়বে সবজিওয়ালি মাসি আর হরেকরকম পসরা সাজিয়ে বসা ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাকের মাঝখানে হাতের বাঁদিকে বসে থাকা দু’-তিনজন। সামনে একটা স্টিলের প্লেটে ছোট ছোট রঙিন পাথর আর পাশে একটা বাটিতে সাদা পাউডার গোলা জল। পিছনে ফ্লাইওভারের দেয়ালে আঁকা কালীমূর্তির ছবি। তলায় ক্যাপশন— ‘এখানে ভাগ্য বিচার করে সঠিক পাথর দেওয়া হয়।’ কৌতূহলী পথচারীরা উঁকিঝুঁকি মারছেন। কেউ একটু বেশি আগ্রহ দেখালে তাকে হাতের ইশারায় বসতে বলা হচ্ছে। কালীমূর্তির ছবির নীচে বসে থাকা একজন, ফর্সামতন, বোধহয় দলটার পাণ্ডা, সম্ভাব্য খদ্দেরকে প্রশ্ন করছে নিচু গলায়— “কিনবেন তো?” খদ্দের রাজি হওয়ামাত্র আঁজলা পাতার মতো করে ডান হাত পাততে বলা হচ্ছে। স্টিলের প্লেট থেকে একটা করে পাথর তুলে খদ্দেরের হাতে রেখে একটা ছোট চামচে দিয়ে পাউডার-গোলা জল ঢালা হচ্ছে হাতে। পরমুহূর্তেই পাথরটা তুলে নিয়ে একটা অন্য পাথর বসানো হচ্ছে। ফের নতুন করে জল ঢালা হচ্ছে। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ প্রক্রিয়াটা চলার পর একটা পাথর বসিয়ে হাতে জল ঢালতেই আশ্চর্যজনকভাবে সাদা পাউডার গোলা জলের রং বদলে লাল হয়ে গেল। হতবাক খদ্দের! বিক্রেতার গলা চড়ছে। “দেখলেন তো কীরকম রং বদলে গেল। আপনার হাতের রেখার সঙ্গে মিলে গেলে তবেই জলের রং বদলাবে। নচেৎ কিছুতেই নয়। তার মানে আপনার দরকার গোমেদ। বাজারে আসল গোমেদ কিনতে গেলে ট্যাঁক থেকে হাজার টাকা খসে যাবে। এই পাথরটা গোমেদের বিকল্প। আপনার ভাগ্য ভাল তাই মাত্র দুশো টাকায় পেয়ে যাচ্ছেন।” চমকিত খদ্দের। মাত্র দুশো টাকায় গোমেদের বিকল্প! মানে তুঙ্গে বৃহস্পতি। আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম। মুহূর্তের মধ্যে পকেট থেকে বেরিয়ে আসা মানিব্যাগ। ঝটিতি হাতবদল হয়ে যাওয়া করকরে দু’খানা একশো টাকার নোট। কানের সামনে মুখ নিয়ে এসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস, “শনি অথবা মঙ্গলবারে পুজো দিয়ে রুপো বাঁধানো আংটিতে বসিয়ে ধারণ করবেন। ওইদিনটা টক খাবেন না।” ইত্যাদি ইত্যাদি। পুলকিত খদ্দের। ভাগ্যের রং বদলানোর আনন্দে মোড়কটা পকেটে পুরে পা বাড়াচ্ছেন গন্তব্যস্থলের দিকে।
ভাগ্যের রং কি সত্যিই বদলাল? আরে না মশাই। কিছুই বদলাল-টদলাল না। আসলে এই গোটা ব্যাপারটাই একটা ফক্কিকারির খেল। নির্ভেজাল চিটিংবাজি। দৈবটৈব কিস্যু নেই এর মধ্যে। প্লেটে রাখা ওই পাথরগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটায় হালকা করে ছোঁয়ানো রয়েছে পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট। কোন পাথরগুলোয় রাসায়নিক লাগানো রয়েছে সেটাও বিক্রেতার মুখস্থ। যে পাথরগুলোয় রাসায়নিক লাগানো নেই প্রথমে সেরকম কিছু পাথর হাতে বসিয়ে জল ঢালা হচ্ছে। খদ্দেরের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করার জল। অতপর মওকা বুঝে রাসায়নিক লাগানো পাথর প্রয়োগ করা হচ্ছে। রসায়নের নিয়ম অনুযায়ী পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট জলের সংস্পর্শে এলেই তা লাল অথবা গাঢ় গোলাপি রং ধারণ করে। খদ্দের ভাবেন ভাগ্যের রং বদলাচ্ছে। অজ্ঞানতা আর কুসংস্কারের কী মর্মান্তিক পরিহাস!
অল দ্যা গ্লিটারস ইজ নট…
রাস্তা দিয়ে চলেছেন। হঠাৎ চোখে পড়ল ফুটপাতের ধারে পলিথিন শিটের ওপর ছড়িয়ে রাখা ঝকঝকে সেলোফেন পেপারে মোড়া দামি দামি শাড়ি, ঢেলে বিক্রি হচ্ছে। একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিক্রেতা। বিক্রেতাকে ঘিরে বেশ কিছু লোক। শাড়ি বাছাবাছি করছে। কেনাকাটাও চলছে মন্দ না। আপনার কৌতূহল হল। গুটি গুটি পায়ে গিয়ে দাঁড়ালেন ক্রেতাদের ভিড়ের মাঝখানে। শুনতে পাবেন ফিসফাস, টুকরোটাকরা বার্তালাপ। ক্রেতারা নিচুগলায় কথা বলছেন নিজেদের মধ্যে— “আরে বাবা!… পিওর জরদৌসি… কী করে অত সস্তায় দিচ্ছে!” “সেটাই তো ভাবছি মশাই, এটা তো বালুচরি… বাজারে অন্তত পাঁচ হাজার… এখানে মাত্র দেড় হাজার চাইছে… জাস্ট ভাবা যায় না!” এককোণে দাঁড়ানো বিক্রেতা, জবাব দিচ্ছে কিছুটা দুখী দুখী বিষণ্ণ গলায়— “সবই কপাল স্যার, মহাজন ফেল মেরেছে। কোম্পানিতে লালবাতি জ্বলেছে। তাই বাধ্য হয়ে…।” শুনেটুনে আপনার কৌতূহল বাড়ল। এত লোক কিনছে। ভাবামাত্র উবু হয়ে বসে পড়লেন ফুটপাতে। বাছাবাছি করে কিনে ফেললেন একটা পাটোলা বা কাঞ্চিভরম। মাত্র হাজার টাকায়। তাড়াহুড়ো করে ভরে ফেললেন ব্যাগে। যুদ্ধজয়ের আনন্দে হাঁটা লাগালেন তড়িঘড়ি, বাড়ি ফেরার বাস ধরবেন বলে। কোন মহাজন ফেল মেরেছে? কোথায় অথবা কেন লালবাতি জ্বলেছে? এত দামি দামি শাড়ি হঠাৎ কেন এত সস্তায় দিচ্ছে? ভেবেও দেখলেন না একবার। আনন্দে প্রায় উড়তে উড়তে বাড়ি ফিরেই গিন্নির ‘স্টিং অপারেশনে’র সামনে সব ঘোটালার পরদা ফাঁস। পচা রদ্দি পাটফেঁসো শাড়ি। অতঃপর সারা সন্ধে একটানা সিরিয়াল ব্লাস্ট, প্রবল গঞ্জনা। গৃহিণী কর্তৃক বিশ্বের সবচেয়ে নির্বোধ মানুষের শিরোপা লাভ। এককথায় হিউমিলিয়েশনের একশেষ। ফলস্বরূপ বিনিদ্র রজনী। হাজার টাকার শোক। হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকা নাইট ল্যাম্পের আলোয় ঘুরন্ত পাখার দিকে। পরদিন চিরতা খাওয়া মুখে ফের যাত্রা কর্মস্থলের উদ্দেশে। মাঝখানে টুক করে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া ফুটপাতের ওই নির্দিষ্ট জায়গাটায়। কেউ নেই। সব ভোঁ ভোঁ।
মন খারাপ করবেন না। একা আপনি নন, আপনার আগে আরও অনেকে ওই একই দিনে প্রতারিত হয়েছেন একটি সংগঠিত প্রতারক চক্রের হাতে। প্রতারক চক্রই বলব কারণ আপনার চারপাশে ভিড় করে থাকা যাদেরকে আপনি খদ্দের বলে ভেবেছিলেন তাদের প্রায় সকলেই ওই প্রতারক চক্রের অংশ। শাড়ির অসাধারণত্ব আর অবিশ্বাস্য কম দামের কথা বলে এমনকী কিনে পর্যন্ত দেখিয়ে দিয়ে আপনাকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছিল তার জাল কেটে আদৌ বেরনো সম্ভব হয়নি আপনার পক্ষে। নকল খদ্দেরদের বাকচাতুর্যে সম্মোহিত হয়ে প্যাকেটটা খুলেও দেখেননি। আসলে এটাই এই প্রতারক চক্রের কায়দা বা কৌশল। ঝাঁ চকচকে সেলোফেনে মোড়া এবং নিপুণভাবে পাটপাট ভাঁজ করা শাড়ির পসরা সাজিয়ে এরা দাঁড়িয়ে পড়ে ফুটপাতে। নিজেরাই খদ্দের সেজে ব্যস্ত ‘কেনাকাটা’ করতে থাকে। দু’-একটা ‘ধুরুয়া’ (প্রতারকদের ভাষায়) ফাঁদে পা দেওয়ামাত্র কথার কারিকুরিতে ভুলিয়ে ভালিয়ে মালটা গছিয়ে দিয়েই পাততাড়ি গোটায় সেখান থেকে। ফের অন্য কোনওখানে দোকান লাগায়। সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকবার লক্ষ করেছি এদের এই লোক ঠকানো ব্যাবসার কলাকৌশল আর বারবার মনে পড়ে গেছে সেই বহুচর্চিত প্রবাদ বাক্যটা। ‘যা চকচক করে তাই সোনা নয়’। কথাটা এই ব্যাবসার ক্ষেত্রেও একশো শতাংশ সত্যি।
বৃহন্নলা বৃত্তান্ত
দৃশ্য ১: বছর দশেক আগে মুম্বাইয়ের ট্র্যাফিক সিগন্যালগুলোয় চোখে পড়েছিল দৃশ্যটা। ইদানীং কলকাতাতেও পড়ছে। হালফিলে শুরু হয়েছে ব্যাপারটা।
শহরের রাস্তায় গাড়ি ড্রাইভ করে কোথাও যাচ্ছেন। ট্র্যাফিক সিগনালে গাড়ি থামল। হঠাৎই জানলার কাচে ঠুক ঠুক। সামনে দাঁড়ানো একজন। পরনে ঝকমকে সস্তা শাড়ি অথবা সালোয়ার কামিজ। পুরুষালি মার্কা হাতে গাদাখানেক কাচের চুড়ি। বিটকেল ফ্যাটাক ফ্যাটাক শব্দে হাততালি দিচ্ছে। সঙ্গে হেঁড়ে খোনা গলার আবেদন— “কিছু দে রাজা…।” পকেটে হাত ঢোকালেন আপনি। দু’-পাঁচ টাকা যা পারলেন ধরিয়ে দিলেন। আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাতটা আলতো করে মাথায় ছুঁইয়েই ভিক্ষাপ্রার্থী দৌড়োল অন্য গাড়ির উদ্দেশে।
দৃশ্য ২: ভর দুপুরবেলা। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কেউ বাড়িতে নেই। এমন সময় দরজায় খনখনে হেঁড়ে গলার ডাক— “কার ছেলে হল গো?” সঙ্গে ফটাফট হাততালির আওয়াজ, দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়ানো কয়েকজন। ঢ্যাঙা পুরুষালি চেহারা। পরনে শাড়ি, উৎকট সাজগোজ। কাঁধে ঝোলানো ঢোল। অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি। দরজা খোলামাত্র নির্দেশ-মিশ্রিত কথাবার্তা। “কই গো, বাচ্চা দেখাও… ছেলে না মেয়ে? ছেলে হলে কিন্তু পাঁচ হাজার নেব।” অতঃপর অনুনয় বিনয়। দরাদরি। দরে না পোষালে কাঁচা গালিগালাজ। কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি। সমস্ত ব্যাপারটা একসময় ভয়ংকর ভীতিপ্রদর্শনের জায়গায় পৌঁছে যাওয়া। শেষ অবধি অনেক টেনে হিঁচড়ে চাহিদাকৃত অর্থের পরিমাণ কিছুটা কম হওয়া। সঙ্গে সিধে হিসেবে চাল-ডাল-তেল-প্রায় নতুন শাড়ি। ঢোলক বাজিয়ে হেঁড়ে গলার নাচাগানা— “বেলা গেল ও ললিতে কেষ্ট এল না…।” অবশেষে নবজাতককে আশীর্বাদ করে ঘর ছেড়ে বেরল দলটা। দরজা বন্ধ করে হাঁফ ছাড়লেন গৃহস্থ।
প্রিয় মহানাগরিক, আশা করি আপনারা প্রায় প্রত্যেকেই জীবনে কখনও না কখনও এ ধরনের দৃশ্যের সম্মুখীন হয়েছেন। এ দৃশ্যের মূল কুশীলবরা সকলেই বৃহন্নলা। যারা আমাদের সমাজে হিজড়ে, মওগা, ছক্কা, ডাবলডেকার… এরকম একাধিক নামে পরিচিত। সমাজের এককোণে ছোট ছোট গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে খুব সংঘবদ্ধ জীবনযাপন করেন এইসব প্রান্তিক শ্রেণির মানুষেরা। একেকটি গোষ্ঠীর গোষ্ঠীপতিকে ‘গুরু-মা’ বলে ডাকে গোষ্ঠীর অধীনস্থ হিজড়েরা। এদের বাসস্থান বা হিজড়ে বাড়িগুলোকে ‘খোল’ নামে ডাকা হয়। হিজড়েদের পেশা মূলত বাচ্চা নাচানো, বিয়ে শাদী, ছটপুজো বা অন্যান্য উৎসবে নাচাগানা, দূরপাল্লার ট্রেন, ট্র্যাফিক সিগন্যাল বা দোকানবাজারে ভিক্ষে করা। গুরু-মার কথাই প্রত্যেকটা খোলে হিজড়েদের কাছে আইন। কঠোর শৃঙ্খলার সাথে সেটা মেনে চলতে হয়। সারাদিনের উপার্জিত অর্থ এবং দানসামগ্রী এনে জমা করতে হয় গুরু-মার কাছে। এরপর গুরু-মার দায়িত্ব প্রত্যেককে তার ভাগ বুঝিয়ে দেওয়া। হিজড়ে সমাজে উপার্জন সংক্রান্ত একাধিক কোডভাষা রয়েছে। যেমন ‘ঝোলকি’ মানে রোজগার, ‘থাপ্পু’, ‘টেংরি’ বা ‘গজ’ মানে টাকা, ‘কোনকি’ মানে পয়সা, ‘বড়া কাগজ’— হাজার টাকা, ‘সবসে বড়া কাগজ’— এক লাখ টাকা ইত্যাদি ইত্যাদি। আগেই বলেছি হিজড়েদের মধ্যে কে কোন কাজ করবে সেটা ঠিক করার দায়িত্ব গুরু-মায়ের। হিজড়ে সমাজে সুন্দর এবং মেয়েলি গড়নের হিজড়েদের ‘নাগিন’ নামে ডাকা হয়। মূলত এই ‘নাগিন’রাই বাড়িতে বাচ্চানাচানো বা পুজোপার্বণ উৎসবে নাচার মতো সবচেয়ে সম্মানজনক কাজের জন্য নির্বাচিত হয়। এরপর ক্রমে ক্রমে ছলাকলা, সৌন্দর্য, বাকচাতুর্য অনুযায়ী বাকি কাজের শ্রেণিবিভাগ করা হয়। সবচেয়ে কর্কশ, কাঠখোট্টা আর কুৎসিত দর্শন হিজড়েদের জন্য পড়ে থাকে দোকান বাজারে ভিক্ষে করার কাজ। হিজড়ের সমাজে এরা ‘বিলা’, ‘জেনানা’ ‘জন হিজরা’… একাধিক নামে পরিচিত। এ ছাড়া বহুক্ষেত্রে গুরু-মা বা গোষ্ঠীপতিদের বিরুদ্ধে হিজড়েদের দিয়ে যৌনব্যাবসা, হিজড়ে নিলাম, শিশুপাচার, বর্ডারে চোরাচালান, বাড়িতে বাচ্চা নাচাতে গিয়ে নৃশংস জুলুম অথবা সেই বাড়ির অন্দরমহলের খবর ডাকাত গ্যাংগুলোর কাছে পৌঁছে দেওয়ার মতো মারাত্মক গুরুতর অভিযোগও উঠেছে অনেক সময়। তবে সেটা ব্যতিক্রম। নিয়ম কখনওই নয়। হিজড়েদের প্রত্যেকটি গোষ্ঠীর নির্দিষ্ট আলাদা কাজের এলাকা আছে। একদল কখনও অন্যদলের কাজের এলাকায় ঢুকবে না। এলাকা নিয়ে কখনও বিবাদ হলে এবং সাধারণ ভাবে মিটমাট না হলে কোনও নিরপেক্ষ গুরু-মার খোলে পঞ্চায়েত বসানো হয়। প্রতিটি গোষ্ঠীর গোষ্ঠীপতিরা সেই পঞ্চায়েতে আসেন। বিচারে যা ঠিক হবে সেটাকেই আইন বলে মেনে নিতে হবে বিবদমান দুই গোষ্ঠীর গুরু-মা ও তার অধীনস্থ শিষ্যা হিজড়েদের। কলকাতার খিদিরপুর, মেটিয়াবুরুজ, তালতলা, চেতলা, পার্ক সার্কাসের দারাপাড়া অঞ্চলে একাধিক হিজড়ে বাড়ি বা ‘খোল’ রয়েছে। তবে এখানে আমার আলোচনার বিষয় একান্তভাবেই হিজড়েদের পেশা সম্পর্কিত, তাদের সমগ্র জীবন চর্চা কখনওই নয়। তা ছাড়া সমগ্র হিজড়ে সমাজ এবং তাদের জীবনযাত্রা এতটাই জটিল আর রহস্যময়তায় ঢাকা যে গোটা একটা লাইব্রেরি বা আর্কাইভও এই বিরাট পরিসরকে ধারণ করবার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই আর কথা না বাড়িয়ে এখানেই দাঁড়ি টানলাম।