১৪. এক শ ডলারের নোটটা

এক শ ডলারের নোটটা

এক শ ডলারের নোটটা হাসান ভাঙিয়েছে। তার ভাগ্য ভালো ডলারের দাম হঠাৎ চড়ে যাওয়ায় তিন হাজার সাত শ টাকা পেয়েছে। এক শ টাকার নোটে পাঞ্জাবির পকেট ভর্তি। একটা হাত সব সময় পাঞ্জাবির পকেটে রাখতে হচ্ছে। সব সময় টাকা ছুঁয়ে থাকা।

হাসান আজ কিছু উপহার কিনবে। লিটনের স্ত্রীর জন্যে ভালো একটা শাড়ি। লিটনের জন্যে একটা পাঞ্জাবি, পায়জামা এবং একজোড়া স্যান্ডেল। লিটনের স্যান্ডেল দেখে সেদিন খুব মায়া লেগেছিল। উপহারের চেয়ে টাকাটা পেলে তাদের কাজে লাগত। সম্পূর্ণ নিঃস্ব অবস্থায় বিয়ে করার যন্ত্রণায় হাসানকে যেতে হয় নি। এটা কম কি?

তার জীবনে যা ঘটেছে মনে হয় ঠিকই ঘটেছে। তিতলীর ভালো বিয়ে হয়েছে। প্রথম কিছুদিন সে কষ্ট করবে। তারপর সেই কষ্ট গা সহা হয়ে যাবে। সব কষ্টই মানুষের একসময় শেষ হয়ে যায়। মানুষের কষ্ট গ্যাস বেলুনের মতো–উঁচুতে উঠতে থাকেএক সময় না এক সময় সেই বেলুন নেমে আসতে থাকে। বেলুন ভর্তি প্যাস থাকে ঠিকই তবে গ্যাসের বেলুনকে উড়িয়ে রাখার ক্ষমতা থাকে না।

হাসান সুন্দর একটা সিন্ধের শাড়ি কিনল। শাড়ি কেনার সময় তিতলীর কথা মনে পড়ল। কোন রঙটা তিতলীকে মানাবে ভেবে কেনা। শাড়ি পছন্দ করার একটা বুদ্ধিও তিতলী তাকে শিখিয়ে দিয়েছিল। সেই বুদ্ধিটাও খুব সুন্দর। দোকানদার অনেকগুলো শাড়ি মেলে ধরবে। তখন তুমি দেখবে কিছু কিছু শাড়ি তোমার হাত দিয়ে ছুয়ে দেখতে ইচ্ছে করবে। ওই শাড়িগুলোই শুধু কিনবে। তিতলী সব সময় মজার মজার কথা বলত। এখনো কি বলে?

লিটনকে তার মেসে পাওয়া গেল। কেরোসিনের চুলায় সে ভাত বসিয়েছে। একটা বাটিতে ডিম ফেটে রেখেছে। ভাত নেমে যাবার পর ডিম ভাজবে। লিটন হাসানকে দেখে লাফিয়ে উঠল–আরে তুই।

ভাবিকে দেখতে এসেছি, আমাকে নিয়ে চল।

লিটন হাসিমুখে বলল, আশ্চর্য কাণ্ড, আমি গত রাতে স্বপ্নে দেখেছি তুই এসেছিস। খুবই অদ্ভুত একটা স্বপ্ন। দেখি কী, আমি আর শম্পা কক্সবাজারে বেড়াতে গেছি। সন্ধ্যাবেলা সমুদ্রের পাড়ে হাঁটছি। হঠাৎ শম্পা চেচিয়ে বলল, ওই দেখ তোমার বন্ধু বসে আছে। আমি বললাম, তুমি তো তাকে কোনোদিন দেখ নি। চিনলে কী করে। শম্পা তখন এমন হাসতে শুরু করল যে হাসির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়িতে দেখি রাত তিনটা বাজে। তারপর আর ঘুম হয় নি। রাতে চা বানিয়ে খেলাম। সকালে দোকান থেকে পরোটা এনে খেয়েছি। এখন এগারটা বাজে, এর মধ্যে ক্ষিধে লেগে গেছে। ভাত বসিয়েছি।

নিজেই রান্না করে খাস?

হুঁ। খরচ বাঁচে। অবস্থা কাহিল রে দোস্ত।

তুই ভাত খেয়ে নে। আমি বসি।

তোকে একটা ডিম ভেজে দি খা।

না—আমি খাব না।

খা নারে দোস্ত। আমি গরিব মানুষ এর বেশি কী দেব। দাঁড়া আমি চট করে একটা ডিম নিয়ে আসি।

আমার জন্যে কিছু আনতে হবে না। তুই খেয়ে শেষ কর। তোর জন্য একটা পাঞ্জাবি এনেছি–গায়ে দিয়ে দেখ লাগে কি না।

আমার জন্যে পাঞ্জাবি কেন? আমি কী করলাম?

তুই বিয়ে করেছিস। ফকির অবস্থায় বিয়ে করে যে সাহস দেখিয়েছিস সেই সাহসের পুরস্কার।

মাই গড! স্যান্ডেলও কিনেছিস নাকি?

হ্যাঁ। তোর এখনকার স্যান্ডেল জোড়া দয়া করে আমার হাতে দে। আমি নিজে ডাক্টবিনে ফেলব।

এত দামি পাঞ্জাবি কিনেছিস? টাকা পেলি কোথায়? তোর কি চাকরি বাকরি কিছু হয়েছে?

না। শোন লিটন, তোদের উপহার দেয়ার জন্যে আমি কিছু টাকা বাজেট করেছিলাম। উপহার কেনার পর কিছু টাকা বেঁচে গেছে। এই টাকাটাও আমি দিতে চাই। কার কাছে দেব? তোর কাছে না তোর স্ত্রীর কাছে?

লিটন কথা বলছে না। তার ডিম ভাজা হয়ে গেছে–আগুনগরম ভাত সে কাপ কপ করে খাচ্ছে। অভাবের সময় মানুষের ক্ষিধে বেশি লাগে এটা বোধহয় ঠিক।

হাসান।

হুঁ।

তুই যে খুব অদ্ভুত একটা প্ৰাণী তা কি তুই জানিস?

না।

তোর বন্ধুবান্ধবরা সবাই কিন্তু এটা জানে।

জানলে তো ভালোই।

কত মানুষের দোয়া যে তোর ওপর আছে!

দোয়ায় তো কাজ হয় না।

তা হয় না। কাজ হলে আমার দোয়াতেই তোর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। ভালো চাকরি বাকরি করে সুখে ঘর-সংসার করতি।

আমি সুখেই আছি।

সুখে থাকলে তো ভালোই।

লিটন নতুন পয়জামা-পাঞ্জাবি পরল। স্যান্ডেল পরল। হাসিমুখে বলল, হাসান আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?

খুবই ভালো দেখাচ্ছে শুধু মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়িটায় সমস্যা করছে। ভালমতো শেভ কর।

নাপিতের দোকানে শেভ করব। শম্পা। আজ কী যে খুশি হবে–ওর খুশি খুশি মুখ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। গত চারদিন তার সঙ্গে দেখা হয় নি।

কেন?

খুবই লজ্জার ব্যাপার–তোকে বলতেও লজ্জা লাগছে।

লজ্জা লাগলে বলার দরকার নেই।

শোন। তোকে না বললে আর কাকে বলব, হয়েছে কী, শেষবার যখন শম্পার সঙ্গে দেখা হলো সে হঠাৎ খুব লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, তুমি আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবে? আমি বললাম, কত? সে বলল, পাঁচ শ টাকা দিলেই হবে। আমি বললাম আজ তো সঙ্গে নেই। পরের বার যখন আসব নিয়ে আসব। টাকার যোগাড় হয় নি যাওয়াও হয় নি। আজ তুই যখন বললি, উপহার কেনার পর কিছু টাকা বেঁচেছে তুই টাকাটা দিয়ে দিতে চাস তখন আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। তুই বোধহয় লক্ষ করিস নি। আমি সেই সময় ডিম ভাজা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পুরুষ মানুষের চোখের পানি কাউকে দেখাতে নেই।

 

শম্পা শাড়ি দেখে ছেলে মানুষের মতো খুশি হলো। কয়েকবার বলল, আশ্চর্য এত সুন্দর শাড়ি! এত সুন্দর রঙ!

লিটন বলল, যাও তো তুমি শাড়ি পরে আসা। আর এই খামটা রাখ।

খামে কী?

এক হাজার টাকা আছে। রেখে দাও–টুকটাক খরচ আছে না?

শম্পা খুবই লজ্জিতভাবে হাসানের দিকে তাকাচ্ছে। লিটন বলল, হাসান মিষ্টি এনেছে–মিষ্টি ভেতরে দিয়ে আস। বাচ্চারা খাক। আর শোন তুমি হাসানের সঙ্গে দুএকটা কথা বল। এমন মূর্তির মতো বসে আছ কেন?

শম্পা আরো লজ্জিত হয়ে বলল, আমি শাড়িটা পরে আসি। আর শোন তুমি এই চার দিন আস নি কেন?

মানুষের কাজকর্ম থাকে না?

শম্পা হাসানকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে লিটনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি গতকাল তোমার মেসে গিয়েছিলাম। তুমি ছিলে না। কেউ তোমাকে বলে নি?

কী আশ্চর্য! তুমি মেসে উপস্থিত হলে কোন আন্দাজে? তোমাকে না বলেছি আজেবাজে জায়গায় থাকি কখনো যাবে না।

কেন তুমি চারদিন আসলে না?

শম্পার চোখে পানি এসে গেছে। একটু আগে যে মেয়ে শাড়ি হাতে আনন্দে ঝলমল করছিল এখন সে প্রায় বাচ্চাদের মতোই শব্দ করে কাঁদছে। হাসান খুব অস্বস্তিতে পড়েছে। আবার তার খুব ভালোও লাগছে। তার মন বলছে লিটনের সব সমস্যার সামধান হবে। তাদের দুজনের সুন্দর সংসার হবে। সেই সংসারে চাঁদের মতো খোকাখুকু আসবে। ভালবাসার পবিত্র অশ্রু প্রকৃতি কখনো অবহেলা করে না।

লিটন বলল, শম্পা তুমি যাও তো শাড়িটা পরে আসা। আর শোন প্লেটে করে হাসানকে একটু মিষ্টি দাও। ওর মিষ্টিই ওকে খাইয়ে দি। বেলপাতায় বেলপূজা। হা হা হা।

শম্পা শাড়ি হাতে ভেতরে চলে গেল। লিটন বলল, হাসান আমার বউকে কেমন দেখলি?

সুন্দর খুব সুন্দর।

ছেলেমানুষ–বয়সও অবশ্য কম। জুন মাসে আঠার হবে। এই কদিন আসি নি কেঁদে কেটে কী সিন ক্রিয়েট করল দেখলি! তুই থাকায় রক্ষা নয়তো আরো হইচই করত।

লিটন তুই এক কাজ কর বউকে নিয়ে আজ সারাদিন ঘুরে বেড়া। কিছু টাকা তো আছে?

কোথায় ঘুরব?

জাদুঘর, চিড়িয়াখানা কিংবা এক কাজ করা–সদরঘাটে গিয়ে একটা নৌকা ভাড়া কর। বুড়িগঙ্গায় নৌকায় করে ঘুরবি। কিছু খাবারদাবার সঙ্গে নিবি, একটা ফ্লাস্কে করে চা।

নৌকা ভাড়া কত জনিস?

এটা হিসেবে ভাড়া। পঞ্চাশ টাকা করে ঘণ্টা। নৌকায় বসে দুজনে গল্পগুজব করবি।

মাঝি ব্যাটা তো সব শুনবে।

শুনুক, অসুবিধা কী?

তুইও চল আমাদের সাথে।

আরে না। আমি না। পুরো ব্যাপারটাই দুজনের।

শম্পার চুল কত লম্বা দেখেছিস?

হ্যাঁ, খুব লম্বা চুল।

সেদিন কী বলল শোন, ফট করে বলল, আমি যদি তার সঙ্গে কোনোদিন ঝগড়া করি। তাহলে সে চুল কেটে ফেলবে। যা সেনসেটিভ স্বভাব–কেটে ফেলবে তো বটেই। আমি খুব ভয়ে ভয়ে থাকি।

লিটন তৃপ্তির হাসি হাসছে। হাসান মুগ্ধ হয়ে লিটনের হাসি দেখছে। না। শম্পা মেয়েটা ভাগ্যবতী। সে তার এক জীবনে অসংখ্যবার স্বামীর সুন্দর হাসি দেখবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *