১৪. এক বৎসর চলিয়া গিয়াছে

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

এক বৎসর চলিয়া গিয়াছে। পুনরায় পূজার বিলম্ব অতি সামান্যই।

শনিবার। অনেক অফিস আজ বন্ধ হইবে, অনেকগুলি সম্মুখের মঙ্গলবারে বন্ধ। দোকানে দোকানে খুব ভিড়-ঘণ্টাখানেক পথ হাঁটিলে হ্যান্ডবিল হাত পাতিয়া লইতে লইতে বুড়িখানেক হইয়া উঠে। একটা নতুন স্বদেশী দেশলাইয়ের কারখানা পথে পথে জাঁকালো বিজ্ঞাপন মারিয়াহে।

আমড়াতলা গলির বিখ্যাত ধনী ব্যবসাদার নকুলেশ্বর শীলের প্রাসাদোপম সুবৃহৎ অট্টালিকার নিম্নতলেই ইহাদের আফিস। অনেকগুলি ঘর ও দুটা বড়ো হল কর্মচারীতে ভর্তি। দিনমানেও ঘরগুলির মধ্যে ভালো আলো যায় না বলিয়া বেলা চারটা না বাজিতেই ইলেকট্রিক আলো জ্বলিতেছে।

ছোকরা টাইপিস্ট নৃপেন সন্তর্পণে পর্দা ঠেলিয়া ম্যানেজারের ঘরে ঢুকিল। ম্যানেজার নকুলেশ্বর শীলের বড় জামাই দেবেন্দ্রবাবু। ভারি কড়া মেজাজের মানুষ। বয়স পঞ্চাশ ছাড়াইয়াছে, দোহারা ধরনের চেহারা। বেশ ফরসা, মাথায় টাক। এক কলমের খোঁচায় লোকের চাকরি খাইতে এমন পারদর্শী লোক খুব অল্পই দেখা যায়। দেবেন্দ্রবাবু বলিলেন—কি হে নৃপেন?

নৃপেন ভূমিকাস্বরুপ দুইখানা টাইপ-ছাপা কি কাগজ মঞ্জুর করাইবার ছলে তাহার টেবিলের উপর রাখিল।

সহি শেষ হইলে নৃপেন একটু উশখুশ করিয়া কপালের ঘাম মুছিয়া আরক্তমুখে বলিলআমি—এই—আজ বাড়ি যাব—একটু সকালে, চারটেতে গাড়ি কি না? সাড়ে তিনটেতে না গেলে–

–তুমি এই সেদিন তো বাড়ি গেলে মঙ্গলবারে। রোজ রোজ সকালে ছেড়ে দিতে গেলে অফিস চলবে কেমন করে? এখনও তো একখানা চিঠি টাইপ করো নি দেখছি—

এ আপিসে শনিবারে সকালে ছুটির নিয়ম নাই। সন্ধ্যা সাড়ে ছটার পূর্বে কোনদিন আপিসের ছুটি নাই। কি শনিবার কি অন্যদিন। কোনও পালপার্বণে ছুটি নাই, কেবল পূজার সময় এক সপ্তাহ, শ্যামাপূজায় একদিন ও সরস্বতী পূজায় একদিন। অবশ্য রবিকারগুলি বাদ। ইহাদের বন্দোবস্ত এইরূপচাকরি করিতে হয় করো, নতুবা যাও চলিয়া। এ ভয়ানক বেকার সমস্যার দিনে কর্মচারীগণ নবমীর পাঠার মতো কপিতে কাঁপিতে চাণক্য-শ্লোকের উপদেশ মতো চাকুরিকে পুরোভাগে বজায় ও ছুটিছাটা, অপমান অসুবিধাকে পশ্চাদ্দিকে নিক্ষেপ করত কায়ক্লেশে দিন অতিবাহিত করিয়া চলিয়াছেন।

নৃপেন কি বলিতে যাইতেছিল—দেবেনবাবু বাধা দিয়া বলিলেন-মল্লিক অ্যান্ড চৌধুরীদের মর্টগেজখানা টাইপ করেছিলে?

নৃপেন কাদ-কঁদ মুখে বলিল–আজ্ঞে, কই ওদের আপিস থেকে তো পাঠিয়ে দেয় নি এখনও?

পাঠিয়ে দেয় নি তো ফোন করো নি কেন? আজ সাতদিন থেকে বলছি কচি খোকা তো নও?…যা আমি না দেখব তাই হবে না?

নৃপেনের ছুটির কথা চাপা পড়িয়া গেল এবং সে বেচারি পুনরায় সাহস করিয়া সে-কথা উঠাইতেও পারিল না।

সন্ধ্যার অল্প পূর্বে ক্যাশ ও ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের কেরানীরা বাহির হইল—-অন্য অন্য কেরানীগণ আরও ঘণ্টাখানেক থাকিবে। অত্যন্ত কম বেতনের কেরানী বলিয়া কেহই তাহাদের মুখের দিকে চায় না, বা তাহারা নিজেরাও আপত্তি উঠাইতে ভয় পায়।

দেউড়িতে দারোয়ানেরা বসিয়া খৈনি খাইতেছে, ম্যানেজার ও সুপারিন্টেন্ডেন্টের যাতায়াতের সময় উঠিয়া দাঁড়াইয়া ফৌজের কায়দায় সেলাম করে, ইহাদিগকে পোঁছেও না।

ফুটপাথে পা দিয়া নৃপেন বলিল—দেখলেন অপূর্বাবু, ম্যানেজারবাবুর ব্যাপার? একদিন সাড়ে তিনটের সময় ছুটি চাইলাম, তা দিলে না—অন্য সব আপিস দেখুন গিয়ে, দুটোতে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তারা সব এতক্ষণে ট্রেনে যে যার বাড়ি পৌঁছে চা খাচ্ছে আর আমরা এই বেরুলাম—কি অত্যাচারটা বলুন দিকি?

প্রবোধ মুহুরি বলিল—অত্যাচার বলে মনে করো ভায়া, কাল থেকে এসো না, মিটে গেল। কেউ তো অত্যাচার পোয়াতে বলে নি। ওঃ, ক্ষিদে যা পেয়েছে ভায়া, একটা মানুষ পেলে ধরে খাই এমন অবস্থা। রোজ রোজ এমনিহার্টের রোগ জন্মে গেল ভায়া, শুধু না খেয়ে খেয়ে—

অপু হাসিয়া বলিল—দেখবেন প্রবোধ-দা, আমি পাশে আছি, এ যাত্রা আমাকে না হয় রেহাই দিন। ধরে খেতে হয় রাস্তার লোকের ওপর দিয়ে আজকের ক্ষিদেটা শান্ত করুন। আমি আজ তৈরি হয়ে আসি নি। দোহাই দাদা!

তাহার দুঃখের কথা লইয়া এরুপ ঠাট্টা করাতে প্রবোধ মুহরি খুব খুশি হইল না। বিরক্তমুখে বলিল—তোমাদের তো সব তাতেই হাসি আর ঠাট্টা, ছেলেছোকরার কাছে কি কোন কথা বলতে আছে—আমি যাই, তাই বলি! হাসি সোজা ভাই, কই দাও দিকি ম্যানেজারকে বলে পাঁচ টাকা মাইনে বাড়িয়ে?, তার বেলা

অপুকে হাঁটিতে হয় রোজ অনেকটা। তার বাসা শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের মধ্যে, গোলদিঘির কাছে। তেরো টাকা ভাড়াতে নিচু একতলা ঘর, ছোট রান্নাঘর। সামান্য বেতনে দু-জায়গায় সংসার চালানো অসম্ভব বলিয়া আজ বছরখানেক হইল সে অপর্ণাকে কলিকাতায় আনিয়া বাসা করিয়াছে। তবু এখানে চাকরিটি জুটিয়াছিল তাই রক্ষা!

শৈশবের স্বপ্ন এ ভাবেই প্রায় পর্যবসিত হয়। অনভিজ্ঞ তরুণ মনের উচ্ছ্বাস, উৎসাহমাধুর্যভরা বঙিন ভবিষ্যতের স্বপ্ন স্বপ্ন থাকিয়া যায়। যে ভাবে বড়ো সওদাগব হইবে, দেশে দেশে বাণিজ্যের কুঠি খুলিবে, তাহাকে হইতে হয় পাড়াগাঁয়েব হাতুড়ে ডাক্তার, যে ভাবে ওকালতি পাস করিয়া বাসবিহারী ঘোষ হইবে, তাহাকে হইতে হয় কয়লাব দোকানী, যাহার আশা থাকে সারা পৃথিবী ঘুরিয়া দেখিয়া বেড়াইবে, কি দ্বিতীয় কলম্বস হইবে, তাহাকে হইতে হয় চল্লিশ টাকা বেতনের স্কুলমাস্টাব।

শতকবা নিরানব্বই জনের বেলা যা হয়, অপুর বেলাও তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই। যথানিয়মে সংসার-যাত্রা, গৃহস্থালি, কেবানীগিরি, ভাড়া বাড়ি, মেলি ফুড ও অযেলক্লথ। তবে তাহার শেষোক্ত দুটিব এখনও আবশ্যক হয় নাই—এই যা।

অপর্ণা ঘরের দোরের কাছে বঁটি পাতিয়া কুটনা কুটিতেছে, স্বামীকে দেখিয়া বলিল–আজ এত সকাল সকাল যে! তারপর সে বঁটিখানা ও তরকারির চুপড়ি একপাশে সরাইয়া রাখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

অপু বলিল, খুব সকাল আব কই, সাতটা বেজেছে, তবে অন্যদিকের তুলনায় সকাল বটে। হ্যাঁ, তেলওয়ালা আর আসে নি তো?

এসেছিল একবার দুপুরে, বলে দিয়েছি বুধবাবে মাইনে হলে আসতে, তোমার আসবার দেরি হবে ভেবে এখনও আমি চায়ের জল চড়াই নি।

কলের কাছে অন্য ভাড়াটেদের ঝি-বৌয়েরা এ সময় থাকে বলিযা অপর্ণা স্বামীর হাত-মুখ ধুইবার জল বারান্দার কোণে তুলিয়া রাখে। অপু মুখ ধুইতে গিযা বলিল, রজনীগন্ধা গাছটা হেলে পড়েছে কেন বলো তো? একটু বেঁধে দিয়ো।

চা খাইতে বসিয়াছে, এমন সময়ে কলের কাছে কোন প্রৌঢ় কণ্ঠেব কর্কশ আওয়াজ শোনা গেল-তা হলে বাপু একশো টাকা বাড়িভাড়া দিয়ে সায়েবপাড়ায় থাকো গে। আজ আমার মাথা ধরেহে, কাল আমার ছেলের সর্দি লেগেছে-পালার দিন হলেই যত ছুতো। নাও না, সারা ওপরটাই তোমরা ভাড়া নাও না; দাও না পৰ্যষট্টি টাকা—আমরা না হয় আর কোথাও উঠে যাই, রোজ রোজ হাঙ্গামা কে সহি করে বাপু!

অপু বলিল—আবার বুঝি আজ বেধেছে গাঙ্গুলি-গিন্নির সঙ্গে?

অপর্ণা বলিল—নতুন করে বাধবে কি, বেধেই তো আছে। গাঙ্গুলি-গিন্নিরও মুখ বড়ো খারাপ, হালদারদের বৌটা ছেলেমানুষ, কোলের মেয়ে নিয়ে পেরে ওঠে না, সংসারে তো আর মানুষ নেই, তবুও আমি এক-একদিন গিয়ে বাটনা বেটে দিয়ে আসি।

সিঁড়ি ও বোয়াক ধুইবার পালা লইয়া উপরের ভাড়াটেদের মধ্যে এ রেষারেষি, দ্বন্দ্ব-অপু আসিয়া অবধি এই এক বৎসরের মধ্যে মিটিল না। সকলের অপেক্ষা তাহার খারাপ লাগে ইহাদের এই সংকীর্ণতা, অনুদারতা। কট কট করিয়া শক্ত কথা শুনাইয়া দেয়-বাঁচিয়া, বাঁচাইয়া কথা বলে না, কোন্ কথায় লোকের মনে আঘাত লাগে, সে কথা ভাবিয়াও দেখে না।

বাড়িটাতে হাওয়া খেলে না, বারান্দাটাতে বসিলে হয়তো একটু পাওয়া যায়, কিন্তু একটু দূরেই ঝাঝরি-ড্রেন, সেখানে সারা বাসার তরকারির খোসা, মাছের আঁশ, আবর্জনা, বাসি ভাত-তরকারি পচিতেছে, বর্ষার দিনে বাড়িময় ময়লা ও আধময়লা কাপড় শুকাইতেছে, এখানে তোবড়ানো টিনের বাক্স, ওখানে কয়লার ঝুড়ি। ছেলেমেয়েগুলা অপরিষ্কার, ময়লা পেনি বা ফ্রক পরা। অপুদের নিজেদের দিকটা ওরই মধ্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকিলে কি হয়, এই ছোট্ট বারান্দার টবে দু-চারটে রজনীগন্ধা, বিদ্যাপাতার গাছ রাখিলে কি হয়, এই এক বৎসর সেখানে আসিয়া অপু বুঝিয়াছে, জীবনের সকল সৌন্দর্য, পবিত্রতা, মাধুর্য এখানে পলে পলে নষ্ট করিয়া দেয়, এই আবহাওয়ার বিষাক্ত বাস্পে মনের আনন্দকে গলা টিপিয়া মারে। চোখে পীড়া দেয় যে অসুন্দর, তা ইহাদের অঙ্গের আভরণ। থাকিতে জানে না, বাস করিতে জানে না, শূকরপালের মতো খায় আর কাদায় গড়াগড়ি দিয়া মহা আনন্দে দিন কাটায়। এত কুশ্রী বেষ্টনীর মধ্যে দিন দিন যেন তার দম বন্ধ হইয়া আসিতেছে।

কিন্তু উপায় নাই, মনসাপোতায় থাকিলেও আর কুলায় না, অথচ তেরো টাকা ভাড়ায় এর চেয়ে ভালো ঘর শহরে কোথাও মেলে না। তবুও অপর্ণা এই আলো-হাওয়াবিহীন স্থানেও শ্রীছাদ আনিয়াছে, ঘরটা নিজের হাতে সাজাইয়াছে, বাক্স-পেটরাতে নিজের হাতে বোনা ঘেরাটোপ, জানলায় ছিটের পর্দা, বালিশ মশারি সব ধপ ধপ করিতেছে, দিনে দু-তিনবার ঘর ঝাঁট দেয়।

এই বাড়ির উপরের তলার ভাড়াটে গাঙ্গুলিদের একজন দেশস্থ আত্মীয় পীড়িত অবস্থায় এখানে আসিয়া দু-তিন মাস আছেন। আত্মীয়টি প্রৌঢ়, সঙ্গে তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে। দেখিয়া মনে হয় অতি দরিদ্র, বড়োলোক আত্মীয়ের আশ্রয়ে এখানে রোগ সারাইতে আসিয়াছেন ও চোরের মতো একপাশে পড়িয়া আছেন। বৌটি যেমন শান্ত তেমনি নিরীহ, ইতিপূর্বে কখনও কলিকাতায় আসে নাই—দিনরাত জুজুর মতো হইয়া আছে। সারাদিন সংসারের খাটুনি খাটে, সময় হইলেই রুগণ স্বামীর মুখের দিকে উদ্বিগ্নদৃষ্টিতে চাহিয়া বসিয়া থাকে। তাহার উপর গাঙ্গুলি বৌয়ের ঝংকার, বিরক্তি প্রদর্শন, মধুবৰ্ষণ তো আছেই। অত্যন্ত গরিব, অপু রোগী দেখিতে যাইবার ছলে মাঝে মাঝে বেদানা, আঙুর, লেবু দিয়া আসিয়াছে। সেদিনও বড়ো ছেলেটিকে জামা কিনিয়া দিয়াছে।

এদিকে তাহারও চলে না। এ সামান্য আয়ে সংসার চালানো একরুপ অসম্ভব। অপর্ণা অন্যদিকে ভালো গৃহিণী হইলেও পয়সা-কড়ির ব্যাপারটা ভালো বোঝে না—দুজনে মিলিয়া মহা আমোদে মাসের প্রথম দিকটা খুব খরচ করিয়া ফেলে—শেষের দিকে কষ্ট পায়।

কিন্তু সকলের অপেক্ষা কষ্টকর হইয়াছে আপিসের এই ভূতগত খাটুনি। ছুটি বলিয়া কোনও জিনিস নাই এখানে। ছোট ঘরটিতে টেবিলের সামনে ঘাড় খুঁজিয়া বসিয়া থাকা সকাল এগারোটা হইতে বৈকাল সাতটা পর্যন্ত। আজ দেড় বৎসর ধরিয়া এই চলিতেছে। এই দেড় বৎসরের মধ্যে সে শহরের বাহিরে কোথাও যায় নাই। আপিস আর বাসা, বাসা আর আপিস। শীলবাবুদের দমদমার বাগানবাড়িতে সে একবার গিয়াছিল, সেই হইতে তাহার মনের সাধ নিজের মনের মতো গাছপালায় সাজানো বাগানবাড়িতে বাস করা। আপিসে যখন কাজ থাকে না, তখন একখানা কাগজে কাল্পনিক বাগানবাড়ির নকশা আঁকে। বাড়িটা যেমন তেমন হউক, গাছপালার বৈচিত্র্যই থাকিবে বেশি। গেটের দুধারে দুটো চীনা বাঁশের ঝাড় থাকুক। রাঙা সুরকির পথের ধারে ধারে রজনীগন্ধা ল্যাভেন্ডার বাসের পাড় বানো বকুল ও কৃষ্ণচূড়ার ছায়া।

বাড়িতে ফিরিয়া চা ও খাবার খাইয়া স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করে-হ্যাঁ, তারপর কাটালি চাপার পারগোলাটা কোন দিকে হবে বলো তো?

অপর্ণা স্বামীকে এই দেড় বছরে খুব ভালো করিয়া বুঝিয়াছে। স্বামীর এইসব ছেলেমানুষিতে সেও সোৎসাহে যোগ দেয়। বলে,শুধু কাঁটালি চাঁপা? আর কি কি থাকবে, জানলার জাফরিতে কি উঠিয়ে দেব বলো তো?

যে আমড়াতলার গলির ভিতর দিয়া সে আপিস যায় তাহার মতো নোংরা স্থান আর আছে কিনা সন্দেহ। ঢুকিতেই পুঁটকি চিংড়ি মাছের আড়ত সারি সারি দশ-পনেরোটা। চড়া রৌদ্রের দিনে যেমন তেমন, বৃষ্টির দিনে কার সাধ্য সেখান দিয়া যায়? স্থানে স্থানে মাড়োয়ারিদের গরু ও ষাঁড় পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইয়া-পিচপিচে কাদা, গোবর, পচা আপেলের খোলা।

নিত্য দুবেলা আজ দেড় বৎসর এই পথে যাতায়াত।

তা ছাড়া রোজ বেলা এগারোটা হইতে সাতটা পর্যন্ত এই দারুণ বদ্ধতা! আপিসে অন্য যাহারা আছে, তাহাদের ইহাতে তত কষ্ট হয় না। তাহারা প্রবীণ, বহুকাল ধরিয়া তাহাদের খাকের কলম শীলবাবুদের সেরেস্তায় অক্ষয় হইয়া বিরাজ করিতেছে, তাহাদের গর্বও এইখানে। রোকড়-নবীশ রামধনবাবু বলেন-হেঁ হেঁ, কেউ পারবে না মশাই, আজ এক কলমে বাইশ বছর হল বাবুদের এখানে-কোন ব্যাটার ফু খাটবে না বলে দিয়োচার সালের ভূমিকম্প মনে আছে? তখন কর্তা বেঁচে, গদি থেকে বেরুচ্ছি, ওপর থেকে কর্তা হেঁকে বললেন, ওহে রামধন, পোস্তা থেকে ল্যাংড়া আমের দরটা জেনে এসো দিকি চট করে। বেরুতে যাবো মশাই-আর যেন মা বাসুকি একেবারে চৌদ্দ হাজার ফণা নাড়া দিয়ে উঠলেন—সে কি কাণ্ড মশাই? হেঁ হেঁ, আজকের লোক নই—

কষ্ট হয় অপুর ও ছোকরা টাইপিস্ট নৃপেনের। সে বেচারী উকি মারিয়া দেখিয়া আসে ম্যানেজার ঘরে বসিয়া আছে কিনা। অপুর কাছে টুলের উপর বসিয়া বলে, এখনও ম্যানেজার হাইকোর্ট থেকে ফেরেন নি বুঝি, অপূর্ববাবুছটা বাজে, ছুটি সেই সাতটায়

অপু বলে, ওকথা আর মনে করিয়ে দেবেন না, নৃপেনবাবু। বিকেল এত ভালোবাসি, সেই বিকেল দেখি নি যে আজ কত দিন। দেখুন তো বাইরে চেয়ে, এমন চমৎকার বিকেলটি, আর এই অন্ধকার ঘরে ইলেকট্রিক আলো জ্বেলে ঠায় বসে আছি সেই সকাল দশটা থেকে।

মাটির সঙ্গে যোগ অনেকদিনই তো হারাইয়াছে, সে সব বৈকাল তো এখন দূরের স্মৃতি মাত্র। কিন্তু কলিকাতা শহরের যে সাধারণ বৈকালগুলি তাও তো সে হারাইতেছে প্রতিদিন। বেলা পাঁচটা বাজিলে এক-একদিনে লুকাইয়া বাহিরে গিয়া দাঁড়াইয়া সম্মুখের বাড়ির উঁচু কার্নিশের উপর যে একটুখানি বৈকালের আকাশ চোখে পড়ে তারই দিকে বুভুক্ষুর দৃষ্টিতে চাহিয়া থাকে।

সামনেই উপরের ঘরে মেজবাবু বন্ধুবান্ধব লইয়া বিলিয়ার্ড খেলিতেছেন, মার্কারটা রেলিংয়ের ধারে দাঁড়াইয়া সিগারেট খাইয়া পুনরায় ঘরে ঢুকিল। মেজবাবুর বন্ধু নীলরতনবাবু একবার বারান্দায় আসিয়া কাহাকে হাঁক দিলেন। অপুর মনে হয় তাহার জীবনের সব বৈকালগুলি এরা পয়সা দিয়া কিনিয়া লইয়াছে, সবগুলি এখন ওদের জিম্মায়, তাহার নিজের আর কোন অধিকার নাই উহাতে।

প্রথম জীবনের সে-সব মাধুরীভরা মুহূর্তগুলি যৌবনের কলকোলাহলে কোথায় মিলাইয়া গেল? কোথায় সে নীল আকাশ, মাঠ, আমের বউলের গন্ধভরা জ্যোৎস্নারাত্রি? পাখি আর ডাকে না, ফুল আর ফোটে না, আকাশ আর সবুজ মাঠের সঙ্গে মেলে না-ঘেঁটুফুলের ঝোপে সদ্যফোটা ফুলের তেতো গন্ধ আর বাতাসকে তেতো করে না। জীবনে সে যে রোমান্সের স্বপ্ন দেখিয়াছিল— যে স্বপ্ন তাহাকে একদিন শত দুঃখের মধ্য দিয়া টানিয়া আনিয়াছে, তার সন্ধান তো কই এখনও মিলিল না? এ তো একরঙ্গা ছবির মতো বৈচিত্র্যহীন, কর্মব্যস্ত, একঘেয়ে জীবন-সারাদিন এখানে আপিসের বদ্ধজীবন, বোড়, খতিয়ান, মর্টগেজ, ইনকামট্যাক্সের কাগজের বোঝার মধ্যে পকেশ প্রবীণ ব্যুনো সংসারাভিজ্ঞ ব্যক্তিগণের সঙ্গে সপিনা ধরানোর প্রকৃষ্ট উপায় সম্বন্ধে পরামর্শ করা, অ্যাটর্নিদের নামে বড়ো বড়ো চিঠি মুশাবিদা করা-সন্ধ্যায় পায়রার খোপের মতো অপরিষ্কার নোংরা বাসাবাড়িতে ফিরিয়াই তখনই আবার ছেলে পড়াইতে ছোটা।

কেবল এক অপর্ণাই এই বদ্ধ জীবনের মধ্যে আনন্দ আনে। আপিস হইতে ফিরিলে সে যখন হাসিমুখে চা লইয়া কাছে দাঁড়ায়, কোনদিন হালুয়া, কোনদিন দু-চারখানা পরোটা, কোনদিন বা মুড়ি নারিকেল রেকাবিতে সাজাইয়া সামনে ধরে, তখন মনে হয় এ যদি না থাকিত! ভাগ্যে অপর্ণাকে সে পাইয়াছিল! এই ছোট্ট পায়রার খোপকে যে গৃহ বলিয়া মনে হয় সে শুধু অপর্ণা এখানে আছে বলিয়া, নতুবা চৌকি, টুল, বাসন-কোসন, জানালার পর্দা এসব সংসার নয়; অপর্ণা যখন বিশেষ ধরনের শাড়িটি পরিয়া ঘরের মধ্যে ঘোরাফেরা করে, অপু ভাবে, এ স্নেহনীড় শুধু ওরই চারিধারে ঘিরিয়া, ওরই মুখের হাসি বুকের স্নেহ যেন পরম আশ্রয়, নীড় রচনা সে ওরই ইন্দ্রজাল।

আপিসে সে নানা স্থানের ভ্রমণকাহিনী পড়ে, ডেস্কের মধ্যে পুরিয়া রাখে। পুরানো বইয়ের দোকান হইতে নানা দেশের ছবিওয়ালা বর্ণনাপূর্ণ বই কেনে—নানা দেশের রেলওয়ে বা স্টিমার কোম্পানি যে সব দেশে যাইতে সাধারণকে প্রলুব্ধ করিতেছে—কেহ বলিতেছে, হাওয়াই দ্বীপে এসো একবার—এখানকার নারিকেল কুঞ্জে, ওয়াকিকির বালুময় সমুদ্রবেলায় জ্যোৎস্নারাত্রে যদি তারাভিমুখী ঊর্মিমালার সংগীত না শুনিয়া মরো, তবে তোমার জীবন বৃথা।

এলো-পাশো দেখো নাই। দক্ষিণ কালিফোর্নিয়ার চুনাপাথরের পাহাড়ের ঢালুতে, শান্ত রাত্রির তারাভরা আকাশের তলে কম্বল বিছাইয়া একবারটি ঘুমাইয়া দেখিয়ো শীতের শেষে নুড়িভরা উঁচুনিচু প্রান্তরে কর্কশ ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে দু-এক ধরনের মাত্র বসন্তের ফুল প্রথম ফুটিতে শুরু করে, তখন সেখানকার সোডা-আলকালির পলিমাটি-পড়া রৌদ্রদীপ্ত মুক্ত তরুবলয়ের রহস্যময় রূপকিংবা ওয়ালোয়া হ্রদের তীবে উন্নত পাইন ও ডগলাস ফারেব ঘন অবণ্য, হ্রদের স্বচ্ছ বরফগলা জলে তুষারকিরী মাজামা আগ্নেয়গিরির প্রতিচ্ছায়াব কম্পন-উত্তর আমেরিকার ঘন, স্তব্ধ, নির্জন আরণ্যভূরি নিয়ত পরিবর্তনশীল দৃশ্যরাজি, কর্কশ বন্ধুর পর্বতমালা, গম্ভীরনিনাদী জলপ্রপাত, ফেনিল পাহাড়ি নদীতীরে বিচরণশীল বলগা হরিণের দল, ভালুক, পাহাড়ি ছাগল, ভেড়ার দল, উষ্ণপ্রস্রবণ, তুষারপ্রবাহ, পাহাড়ের ঢালুর গায়ে সিডার ও মেপল গাছের বনের মধ্যে বুনো ভ্যালেরিয়ান ও ভায়োলেট ফুলের বিচিত্র বর্ণসমাবেশ-দেখো নাই এসব? এসো এসো।

টাহিটি! টাহিটি! কোথায় কত দূরে, কোন্ জ্যোৎস্নালোকিত রহস্যময় কূলহীন স্বপ্নসমুদ্রের পারে, শুভরাত্রে গভীর জলের তলায় যেখানে মুক্তার জন্ম হয়, সাগরগুহায় প্রবালের দল ফুটিয়া থাকে, কানে শুধু দূরত সংগীতের মতো তাহাদের অপূর্ব আহ্বান ভাসিয়া আসে। আপিসের ডেস্কে বসিয়া এক-একদিন সে স্বপ্নে ভোর হইয়া থাকে—এই সবের স্বপ্নে। এই রকম নির্জন স্থানে, যেখানে লোকালয় নাই, ঘন নারিকেল কুঞ্জের মধ্যে ছোট কুটিরে, খোলা জানালা দিয়া দূরের নীল সমুদ্র চোখে পড়িবে—তার ওপারে মরকতশ্যাম ছোট ছোট দ্বীপ, বিচিত্র পক্ষীরাজি, অজানা দেশের অজানা আকাশের তলে তারার আলোয় উজ্জ্বল মাঠটা একটা রহস্যের বার্তা বহিয়া আনিবে কুটিরের ধারে ফুটিয়া থাকিবে ছোট ছোট বনফুল—শুধু সে আর অপর্ণা।

এই সব বড়লোকের টাকা আছে, কিন্তু জগৎকে দেখিবার, জীবনকে বুঝিবার পিপাসা কই এদের? এ সিমেন্ট বাঁধানো উঠান, চেয়ার, কোচ, মোটর—এ ভোগ নয়, এই শৌখিন বিলাসিতার মধ্যে জীবনের সবদিক আলো-বাতাসের বাতায়ন আটকাইয়া এ মরিয়া থাকাকে বলে ইহাকে জীবন? তাহার যদি টাকা থাকিত? কিছুও যদি থাকিত, সামান্য কিছু! অথচ ইহারা তো লাভ ক্ষতি ছাড়া আর কিছু শেখে নাই, বোঝেও না, জানে না, জীবনে আগ্রহও নাই কিছুতেই, ইহাদের নিন্দুক ভরা নোটের তাড়া।

এই আপিস-জীবনের বদ্ধতাকে অপু শান্তভাবে, নিরুপায়ের মতো দুর্বলের মতো মাথা শাতিয়া স্বীকার করিয়া লইতে পারে নাই। ইহার বিরুদ্ধে, এই মানসিক দারিদ্র্য ও সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে তার মনে একটা যুদ্ধ চলিতেছে অনবরত, সে হঠাৎ দমিবার পাত্র নয় বলিয়াই এখনও টিকিয়া আছেফেনোচ্ছল সুরার মতো জীবনের প্রাচুর্য ও মাদকতা তাহার সারা অঙ্গের শিরায় উপশিরায়-ব্যগ্র, আগ্রহভরা তরুণ জীবন বুকের রক্তে উন্মত্ততালে স্পন্দিত হইতেছে দিনরাত্রি—তাহার স্বপ্নকে আনন্দকে নিঃশ্বাস বন্ধ করিয়া মারিয়া ফেলা খুব সহজসাধ্য নয়।

কিন্তু এক এক সময় তাহারও সন্দেহ আসে। জীবন যে এই রকম হইবে, সূর্যোদয় হইতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রতি দণ্ড পল যে তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর বৈচিত্র্যহীন ঘটনায় ভরিয়া উঠিবে, তাহার কল্পনা তো তাহাকে এ আভাস দেয় নাই। তবে কেন এমন হয়! তাহাকে কাঁচা, অনভিজ্ঞ পাইয়া নিষ্ঠুর জীবন তাহাকে এতদিন কি প্রতারণাই করিয়া আসিয়াছে? ছেলেবেলায় মা যেমন নগ্ন দারিদ্র্যের রুপকে তাহার শৈশবচক্ষু হইতে বাঁচাইয়া রাখিতে চাহিত তেমনই!…

দেখিতে দেখিতে পূজা আসিয়া গেল। আজ দু-বৎসর এখানে সে চাকরি করিতেছে, পূজার পূর্বে প্রতিবারই সে ও নৃপেন টাইপিস্ট কোথাও না কোথাও যাইবার পরামর্শ আঁটিয়াছে, নক্শা আঁকিয়াছে, ভাড়া কষিয়াছে, কখনও পুরুলিয়া, কখনও পুরী—যাওয়া অবশ্য কোথাও হয় না। তবুও যাইবার কল্পনা করিয়াও মনটা খুশি হয়। মনকে বোঝায় এবার না হয় আগামী পূজায় নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই—কেহ বাধা দিতে পারিবে না।

শনিবার আপিস বন্ধ হইয়া গেল। অপুর আজকাল এমন হইয়াছে—বাড়ি ফিরিয়া অপর্ণার মুখ দেখিতে পারিলে যেন বাঁচে, কতক্ষণে সাতটা বাজিবে, ঘন ঘন ঘড়ির দিকে সতৃষ্ণ চোখে চায়। পাঁচটা বাজিয়া গেলে অকূল সময়-সমুদ্রে যেন থই পাওয়া যায়—আর মোটে ঘণ্টা দুই। ছটা—আর এক। হোক পায়রার খোপের মতো বাসা, অপর্ণা যেন সব দুঃখ ভুলাইয়া দেয়। তাহার কাছে গেলে আর কিছু মনে থাকে না।

অপর্ণা চা খাবার আনিল। এ সময়টা আধঘণ্টা সে স্বামীর কাছে থাকিতে পায়, গল্প করিতে পায়, আর সময় হয় না, এখনই আবার অপুকে ছেলে পড়াইতে বাহির হইতে হইবে। অপু এ-সময় তাহাকে সব দিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখিয়াছে, ফরসা লাল পাড় শাড়িটি পরা, চুলটি বাঁধা, পায়ে আলতা, কপালে সিঁদুরের টিপ-মূর্তিমতী গৃহলক্ষ্মীর মতো হাসিমুখে তাহার জন্য চা আনে, গল্প করে, রাত্রে কি রান্না হইবে রোজ জিজ্ঞাসা করে, সারাদিনের বাসার ঘটনা বলে। বলে, ফিরে এসো, দুজনে আজ মহারানী ঝিন্দন আর দিলীপ সিংহের কথাটা পড়ে শেষ করে ফেলব।

বার-দুই অপু তাহাকে সিনেমায় লইয়া গিয়াছে, ছবি কি করিয়া নড়ে অপর্ণা বুঝিতে পারে না, অবাক হইয়া দেখে, গল্পটাও ভালো বুঝিতে পারে না। বাড়ি আসিয়া অপু বুঝাইয়া বলে।

চায়ের বাটিতে চুমুক দিয়া অপু বলিল—এবার তো তোমায় নিয়ে যেতে লিখেছেন শ্বশুরমশায়, কিন্তু আপিসের ছুটির যা গতিকরাম এসে কেন নিয়ে যাক না? তার পর আমি কার্তিক মাসের দিকে না হয় দু-চারদিনের জন্য যাব? তাছাড়া যদি যেতেই হয় তবে এ সময় যত সকালে যেতে পারা যায়—এ সময়টা বাপ-মায়ের কাছে থাকা ভালো, ভেবে দেখলাম।

অপর্ণা লজ্জারমুখে বলিল—রাম ছেলেমানুষ, ও কি নিয়ে যেতে পারবে? তা ছাড়া মা তোমায় কতদিন দেখেন নি, দেখতে চেয়েছেন।

–তা বেশ চলল আমিই যাই। রামের হাতে ছেড়ে দিতে ভরসা হয় না, এ অবস্থায় একটু সাবধানে ওঠা-নামা করতে হবে কি না। দাও তোে ছাতাটা, ছেলে পড়িয়ে আসি। যাওয়া হয় তো চলল কালই যাই।-হ্যাঁ একটা সিগারেট দাও না?

–আবার সিগারেট! আটটা সিগারেট সকাল থেকে খেয়েছে—আর পাবে না—আবার পড়িয়ে এলে একটা পাবে।

–দাও দাও লক্ষ্মীটি-রাতে আর চাইব না—দাও একটি।

অপর্ণা ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া হাসিমুখে বলিল—আবার রাত্রে তুমি কি ছাড়বে আর একটা না নিয়ে? তেমন ছেলে তুমি কি না!…

বেশি সিগারেট খায় বলিয়া অপুই সিগারেটের টিন অপর্ণার জিম্মায় রাখিবার প্রস্তাব করিয়াছিল। অপর্ণার কড়াকাড়ি বন্দোবস্ত সব সময় খাটে না, অপু বরাদ্দ অনুয়ায়ী সিগারেট নিঃশেষ করিবার পর আরও চায়, পীড়াপীড়ি করে, অপর্ণাকে শেষকালে দিতেই হয়। তবে ঘরে সিগারেট না মিলিলে বাহিরে গিয়া সে পারতপক্ষে কেনে না—অপর্ণাকে প্রবঞ্চনা করিতে মনে বড় বাধে—কিন্তু সবদিন নয়, ছুটিছাটার দিন বাড়তি প্রাপ্য আদায় করিয়াও আরও দু-এক বাক্স কেনে, যদিও সে কথা অপর্ণাকে জানায় না।

ছেলে পড়াইয়া আসিয়া অপু দেখিল উপরের রুগণ ভদ্রলোকটির ছোট মেয়ে পিন্টু তাহাদের ঘরের এককোণে ভীত, পাংশু মুখে বসিয়া আছে। বাড়িসুদ্ধ হৈ-চৈ! অপর্ণা বলিল, ওগো এই পিন্টু গালিদের হোট খুকিকে নিয়ে গোলদিঘিতে বেড়াতে বেরিয়েছিল। ও-বুঝি চিনেবাদাম খেয়ে কলে জল খেতে গিয়েছে, আর ফিরে এসে দ্যাখে খুকি নেই, তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওর মা তো একেই জুজু হয়ে থাকে, আহা সে বেচারি তো নবমীর পাঠার মতো কাপছে আর মাথা কুটছে। আমি পিন্টুকে এখানে লুকিয়ে রেখে দিয়েছি, নইলে ওর মা ওকে আজ গুড়ো করে দেবে। আর গাঙ্গুলি-গিন্নি যে কি কাণ্ড করছে, জানোই তো তাকে, তুমিও একটু দেখো না গো!

গাঙ্গুলি-গিন্নী মরাকান্নার আওয়াজ করিতেছেন, কানে গেল।-ওগো আমি দুধ দিয়ে কি কালসাপ পুষেছিলাম গো! আমার এ কি সর্বনাশ হল গো মা; ওগো তাই আপদেরা বিদেয় হয় না আমার ঘাড় থেকে—এতদিনে মনোবাঞ্ছা-ইত্যাদি।

অপু তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া গেল, বলিল—পিন্টু খেয়েছে কিছু?

-খাবে কি? ও-কি ও-তে আছে? গাঙ্গুলি-গিন্নি দাতে পিষছে, আহা, ওর কোন দোষ নেই, ও কিছুতেই নিয়ে যাবে না, সেও ছাড়বে না, তাকে আগলে রাখা কি ওর কাজ।

সকলে মিলিয়া খুজিতে খুঁজিতে খুকিকে কলুটোলা থানায় পাওয়া গেল। সে পথ হারাইয়া ঘুরিতেছিল, বাড়ির নম্বর, বাস্তার নাম বলিতে পারে না, একজন কনস্টেবল এ অবস্থায় তাহাকে পাইয়া থানায় লইয়া গিয়াছিল।

বাড়ি আসিলে অপর্ণা বলিল-পাওয়া গিয়েছে ভালোই হল, আহা বৌটাকে আব মেয়েটাকে কি করেই গাঙ্গুলি-গিন্নি দাঁতে পিষছে গো! মানুষ মানুষকে এমনও বলতে পারে! কাল নাকি এখান থেকে বিদেয় হতে হবে—হুকুম হয়ে গিয়েছে।

অপু বলিল—কিছু দরকার নেই। কাল আমরা তো চলে যাচ্ছি, আমার তো আসতে এখনও চার-পাঁচদিন দেরি। ততদিন ওঁরা রুগি নিয়ে আমাদেব ঘরে এসে থাকুন, আমি এলেও অসুবিধে হবে না, আমি না হয় এই পাশেই বরদাবাবুদেব মেসে গিয়ে রাত্রে শোব। তুমি গিয়ে বলো বৌঠাকরুনকে। আমি বুঝি, অপর্ণা! আমার মা আমার বাবাকে নিয়ে কাশীতে আমার ছেলেবেলায় ওই রকম বিপদে পড়েছিলেন—তোমাকে সে সব কথা কখনও বলি নি, অপর্ণা। বাবা মারা গেলেন, হাতে একটা সিকি-পয়সা নেই আমাদের, সেখানে দু-একজন লোক কিছু কিছু সাহায্য করলে, হবিষ্যির খরচ জোটে না—মা-তে আমাতে রাত্রে শুধু অড়রের ডাল ভিজে খেয়ে কাটিয়েছি। আমি তখন ছেলেমানুষ, বছর দশেক মোটে বয়েস-গরিব হওয়ার কষ্ট যে কি, তা আমার বুঝতে বাকি নেইকাল সকালেই ওঁরা এখানে আসুন।

অপর্ণা যাইবার সময় পিন্টুর মা খুব কাঁদিল। এ বাড়িতে বিপদে-আপদে অপর্ণা যথেষ্ট করিয়াছে। রোগীর সেবা করিয়া ছেলেমেয়েকে দেখিতে সময় পাইত না, তাহাদের চুল বাঁধা, ডিপ পরানো, খাবার খাওয়ানো, সব নিজের ঘরে ডাকিয়া আনিয়া অপর্ণা করিত। পিন্টু তো মাসিমা বলিতে অজ্ঞান, সকলের কান্না থামে তো পিন্টুকে আর থামানো যায় না। বউয়ের বয়স অপর্ণর চেয়ে অনেক বেশি। সে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, চিঠি দিয়ো ভাই, দুটো দু-ঠাই ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলে আমি মায়ের পুজো দেব।

ঘরের চাবি পিন্টুর মায়ের কাছে রহিল।

রেলে ও স্টিমারে অনেক দিন পর চড়া। দুজনেই হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল। দুজনেই খুব খুশি। অপর্ণাও পল্লীগ্রামের মেয়ে, শহর তাহার ভালো লাগে না। অতটুকু ঘরে কোনদিন থাকে নাই, সকাল ও সন্ধ্যাবেলা যখন সব বাসাড়ে মিলিয়া একসঙ্গে কয়লার উনুনে আগুন দিত, ধোঁয়ায় অপর্ণার নিঃশ্বাস বন্ধ হইয়া আসিত, চোখ জ্বালা করিত, সে কি ভীষণ যন্ত্রণা। সে নদীর ধারের মুক্ত আলো বাতাসে প্রকাণ্ড বাড়িতে মানুষ হইয়াছে। এসব কষ্ট জীবনে এই প্রথম—এক একদিনে তাহার তো কান্না পাইত। কিন্তু এই দুই বৎসরে সে নিজের সুখ-সুবিধার কথা বড়ো একটা ভাবে নাই। অপুর উপর তাহার একটা অদ্ভুত স্নেহ গড়িয়া উঠিয়াছে, ছেলের উপর মায়ের স্নেহের মতো। অপুর কৌতুকপ্রিয়তা, ছেলেমানুষি খেয়াল, সংসারনভিজ্ঞতা, হাসিখুশি, এসব অপর্ণার মাতৃত্বকে অদ্ভুতভাবে জাগাইয়া তুলিয়াছে। তাহার উপর স্বামীর দুঃখময় জীবনের কথা, ছাত্রাবস্থায় দারিদ্র্য, অনাহারের সঙ্গে সংগ্রাম-সে সব শুনিয়াছে। সে-সব অপু বলে নাই, সে-সব বলিয়াছে প্রণব। বরং অপু নিজের অবস্থা অনেক বাড়াইয়া বলিয়াছিল—নিশ্চিন্দিপুরের নদীর ধারের পৈতৃক বৃহৎ দোতলা বাড়িটার কথাটা আরও দু-একবার না তুলিয়াছিল এমন নহে—নিজে কলেজ-হোস্টেলে ছিল এ কথাও বলিয়াছে। বুদ্ধিমতী অপর্ণার স্বামীকে চিনিতে বাকি নাই। কিন্তু স্বামীর কথা সে যে সর্বৈব মিথ্যা বলিয়া বুঝিয়াছে এ ভাব একদিনও দেখায় নাই। বরং সস্নেহে বলে—দ্যাখো, তোমাদের দেশের বাড়িটাতে যাবে যাবে বললে, একদিনও তত গেলে না ভালো বাড়িখানা-পুলুদার মুখে শুনেছি জমিজমাও বেশ আছে-একদিন গিয়ে বরং সব দেখে-শুনে এসো। না দেখলে কি ও-সব থাকে?…

অপু আমতা আমতা করিয়া বলে—তা যেতামই তো, কিন্তু বড়ো ম্যালেরিয়া। তাতেই তো সব ছাড়লাম কিনা? নইলে আজ অভাব কি?…

কিন্তু অসতর্ক মুহূর্তে দু-একটা বেফাস কথা মাঝে মাঝে বলিয়াও ফেলে, ভুলিয়া যায় আগে কি বলিয়াছিল কোন্ সময়ে। অপর্ণাও কখনও দেখায় নাই যে, এ সব কথার অসামঞ্জস্য সে বুঝিতে পারিয়াছে। না খাইয়া যে কষ্ট পায় অপর্ণার এ কথা জানা ছিল না। সচ্ছল ঘরের আদরে লালিতা মেয়ে, দুঃখ-কষ্টের সন্ধান সে জানে না। মনে মনে ভাবে, এখন হইতে স্বামীকে সে সুখে রাখিবে।

এটা একটা নেশার মতো তাহাকে পাইয়াছে। অল্পদিনেই সে আবিষ্কার করিয়া ফেলিল, অপু কি কি খাইতে ভালোবাসে। তালের ফুলুরি সে করিতে জানিত না, কিন্তু অপু খাইতে ভালোবাসে বলিয়া মনসাপোতায় নিরুপমার কাছে শিখিয়া লইযাছিল। •

এখানে সে কতদিন অপুকে কিছু না জানাইয়া বাজার হইতে তাল আনাইয়াছে, সব উপকরণ আনাইয়াছে। অপু হয়তো বর্ষার জলে ভিজিয়া আপিস হইতে বাসায় ফিরিয়া হাসিমুখে বলিত কোথায় গেলে অপর্ণা? এত সকালে রান্নাঘরে কি, দেখি? পরে উকি দিয়া দেখিয়া বলিত, তালের বড়া ভাজা হচ্ছে বুঝি! তুমি জানলে কি করে—বা রে!…

অপর্ণা উঠিয়া স্বামীর শুকনো কাপড়ের ব্যবস্থা করিয়া দিত, বলিত, এসো না, ওখানেই বসে খাবে, গরম গরম ভেজে দি অপুর বুকটা হাঁৎ করিয়া উঠিত। ঠিক এইভাবেই কথা বলিত মা। অপুর অদ্ভুত মনে হয়, মায়ের মততা স্নেহশীলা, সেবাপরায়ণা, সেইরকমই অন্তর্যামিনী। বার্ধক্যের কর্মক্লান্ত মা যেন ইহারই নবীন হাতে সকল ভার সঁপিয়া দিয়া চলিয়া গিয়াছেন। মেয়েদের দেখিবার চোখ তাহার নতুন করিয়া ফোটে, প্রত্যেককে দেখিয়া মনে হয়, এ কাহারও মা, কাহারও স্ত্রী, কাহারও বোন। জীবনে এই তিন রূপেই নারীকে পাইয়াছে, তাহাদের মঙ্গল হস্তের পরিবেশনে এই ছাব্বিশ বৎসরের জীবন পুষ্ট হইয়াছে, তাহাদের কি চিনিতে বাকি আছে তাহার?

স্টিমার ছাড়িয়া দুজনে নৌকায় চড়িল। অপর্ণার খুড়তুতো ভাই মুরারি উহাদের নামাইয়া লইতে আসিয়াছিল। সে-ও গল্প করিতে করিতে চলিল। অপর্ণা ঘোমটা দিয়া একপাশে সরিয়া বসিয়াছিল। হেমন্ত-অপরাহের সিন্ধু ছায়া নদীর বুকে নামিয়াছে, বাঁ দিকের তীরে সারি সারি গ্রাম, একখানা বড়ো হাঁড়ি-কলসি বোঝাই ভড় যশাইকাটির ঘাটে বাঁধা।

 

অপুর মনে একটা মুক্তির আনন্দ-আর মনেও হয় না যে জগতে শীলেদের আপিসের মতো ভয়ানক স্থান আছে। তাহার সহজ আনন্দ-প্রবণ মন আবার নাচিয়া উঠিল, চারিধারের এই শ্যামলতা, প্রসার, নদীজলের গন্ধের সঙ্গে তাহার যে নাড়ীর যোগ আছে।

কৌতুক দেখিবার জন্য অপর্ণাকে লক্ষ করিয়া হাসিমুখে বলিল—ওগো কলাবৌ, ঘোমটা খোলো, চেয়ে দ্যাখো, বাপের বাড়ির দ্যাশটা চেয়ে দ্যাখো গো

মুরারি হাসিমুখে অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া রহিল। অপর্ণা লজ্জায় আরও জড়সড় হইয়া বসিল। আরও খানিকটা আসিয়া মুরারি বলিল—তোমরা যাও, এইখানের হাটে যদি বড়ো মাছ পাওয়া যায়, জ্যাঠাইমা কিনতে বলে দিয়েছেন! এইটুকু হেঁটে যাব এখন।

মুরারি নামিয়া গেলে অপর্ণা বলিল—আচ্ছা তুমি কি? দাদার সামনে ওইরকম করে আমায়-তোমার সেই দুষ্টুমি এখনও গেল না? কি ভাবলে বলো তো দাদা-ছিঃ। পরে রাগের সুরে বলিল—দুই কোথাকার, তোমার সঙ্গে আমি আর কোথাও কখনও যাব না-কখখনো না, থেকো একলা বাসায়!

—বয়েই গেল! আমি তোমাকে মাথার দিব্যি দিয়ে সেধেছিলম কিনা! আমি নিজে মজা করে বেঁধে খাব!

—তাই খেয়ো। আহা-হা, কি রান্নার ছাঁদ, তবু যদি আমি না জানতাম! আলু ভাতে, বেগুন ভাতে, সাত রকম তরকারি সব ভাতে—কি রাঁধুনী!

—নিজের দিকে চেয়ে কথা বলল। প্রথম যেদিন খুলনার ঘাটে বেঁধেছিলে, মনে আছে সব আলুনি?

-ওমা আমার কি হবে! এত বড় মিথ্যেবাদী তুমি, সব আলুনি! ওমা আমি কোথায়—

–সব। বিলকুল। মায় পটলভাজা পর্যন্ত।

অপর্ণা রাগ করিতে গিয়া হাসিয়া ফেলিল, বলিল–তুমি ভাঙন মাছ খাও নি? আমাদের এ নোনা গাঙের ভাঙন মাছ ভারি মিষ্টি। কাল মাকে বলে তোমায় খাওযাব।

লজ্জা করবে না তার বেলায়? কি বলবে মাকেও মা, এই আমার–

অপর্ণা স্বামীর মুখে হাত চাপা দিয়া বলিল—চুপ।

ঠিক সন্ধ্যার সময় অপর্ণাদের ঘাটে নৌকা লাগিল। দুজনেরই মনে এক অপূর্ব ভাব। শটিবনের সুগন্ধভরা স্নিগ্ধ হেমন্ত-অপরাহু তার সবটা কারণ নয়, নদীতীরেব ঝুপসি হইয়া থাকা গোলগাছের সবুজ সাবিও নয়, কারণ—তাহাদের আনন্দ-প্রবণ অনাবিল যৌবন–ব্যগ্র, নবীন, আগ্রহভরা যৌবন।

 

জ্যোৎস্নারাত্রে উপরের ঘরে ফুলশয্যার সেই পালঙ্কে বাতি জ্বালিয়া বসিয়া পড়িতে পড়িতে সে অপর্ণার প্রতীক্ষায় থাকে। নারিকেলশাখায় দেবীপক্ষের বকের পালকের মতো শুভ্র চাঁদের আলো পড়ে, বাইরের রাত্রির দিকে চাহিয়া কত কথা মনে আসে, কত সব পুবাতন স্মৃতি কোথায় যেন এই ধরনের সব পুরানো দিনের কত জ্যোৎস্না ঝরা রাত। এ যেন সব আরব্য-উপন্যাসের কাহিনী সে ছিল কোন্ কুঁড়েঘরে, পেট পুরিয়া সব দিন খাইতেও পাইত না—সে আজ এত বড়ো প্রাচীন জমিদার ঘরের জামাই, অথচ আশ্চর্য এই যে, এইটাই মনে হইতেছে সত্য। পুরানো দিনের জীবনটা অবাস্তব, অস্পষ্ট, ধোঁয়া ধোঁয়া মনে হয়।

হেমন্তের রাত্রি। ঠাণ্ডা বেশ। কেমন একটা গন্ধ বাতাসে, অপুর মনে হয় কুয়াশার গন্ধ। অনেক রাত্রে অপর্ণা আসে। অপু বলে—এত রাত যে!–আমি কতক্ষণ জেগে বসে থাকি।

অপর্ণা হাসে। বলে—নিচে কাকাবাবুর শোবার ঘর। আমি সিঁড়ি দিয়ে এলে পায়ের শব্দ ওঁর কানে যায়—এই জন্য উনি ঘরে খিল না দিলে, আসতে পারি নে। ভারী লজ্জা করে।

অপু জানালার খড়খড়িটা সশব্দে বন্ধ করিয়া দিল। অপর্ণা লাজুক মুখে বলিল—এই শুরু হল বুঝি দুষ্টুমি? তুমি কী!কাকাবাবু এখনও ঘুমোন নি যে!…

অপু আবার খটাস্ করিয়া খড়খড়ি খুলিয়া অপেক্ষাকৃত উচ্চসুরে বলিল—অপর্ণা, এক গ্লাস জল আনতে ভুলে গেলে যে!…ও অপর্ণা-অপর্ণা?…

অপর্ণা লজ্জায় বালিশের মধ্যে মুখ খুঁজড়াইয়া পড়িয়া রহিল।

ভোর রাত্রেও দুজনে গল্প করিতেছিল।

সকালের আলো ফুটিল। অপর্ণা বলিল—তোমার কটায় স্টিমার?…সারারাত তো নিজেও ঘুমুলে না, আমাকেও ঘুমুতে দিলে না—এখন খানিকটা ঘুমিয়ে থাকো—আমি অনাদিকে পাঠিয়ে তুলে দেবখন বেলা হলে। গিয়েই চিঠি দিয়ো কিন্তু। জানালার পর্দাগুলো বোপর বাড়ি দিয়ো—আমি

গেলে আর সাবান কে দেবে? সস্নেহে স্বামীর গায়ে হাত বুলাইয়া বলিল-কি রকম রোগা হয়ে গিয়েছ—এখন তোমাকে কাছছাড়া করতে ইচ্ছে করে না কলকাতায় না মেলে দুধ, না মেলে কিছু। এখানে এ-সময়ে কিছুদিন থাকলে শরীরটা সারত। বোজ আপিস থেকে এসে মোহনভোগ খেয়োপিন্টুর মাকে বলে এসেছি—সে-ই করে দেবে। এখন তো খরচ কমল? বেশি ছেলে পড়ানোতে কাজ নেই। যাই তাহলে?

অপু বলিল—বোসো বোসো—এখনও কোথায় তেমন ফরসা হয়েছে?-কাকার উঠতে এখনও দেরি!

অপর্ণা বলিল—হ্যাঁ আর একটা কথা দ্যাখো, মনসাপোতার ঘরটা এবার খুঁচি দিয়ে রেখো। নইলে বর্ষার দিকে বড্ড খরচ পড়ে যাবে, কলকাতার বাসায় তো চিরদিন চলবে না—ওই হল আপন ঘরদোর। এবার মনসাপোতায় ফিরব, বাস না করলে খড়ের ঘর টেকে না। যাই এবার, কাকা এবার উঠবেন। যাই?

অপর্ণা চলিয়া গেলে অপুর মন খুঁত খুঁত করিতে লাগিল। এখনও বাড়ির কেহই উঠে নাইকেন সে অপর্ণাকে ছাড়িয়া দিল? কেন বলিল—যাও! তাহার সম্মতি না পাইলে অপর্ণা কখনই যাইত না।

কিন্তু অপর্ণা আর একবার আসিয়াছিল ঘণ্টাখানেক পরে, চা দেওয়া হইবে কিনা জিজ্ঞাসা করিতে—অপু তখন ঘুমাইতেছে। খোলা জানালা দিয়া মুখে রৌদ্র লাগিতেছে। অপর্ণা সন্তর্পণে জানালাটা বন্ধ করিয়া দিল। ঘুমন্ত অবস্থায় স্বামীকে এমন দেখায়!—এমন একটা মায়া হয় ওর ওপরে! সিঁড়ি দিয়া নামিবার সময় ভাবিল, মা সত্যিই বলে বটে, পটের মুখ-পটে আঁকা ঠাকুরদেবতার মতো মুখ—

চলিয়া আসিবার সময়ে কিন্তু অপর্ণার সঙ্গে দেখা হইল না। অপুর আগ্রহ ছিল, কিন্তু আত্মীয় কুটুম্ব পরিজনে বাড়ি সরগরম-কাহাকে যে বলে অপর্ণাকে একবার ডাকিয়াই দিতে? মুখচোরা অপু ইচ্ছাটা কাহাকেও জানাইতে পারিল না। নৌকায় উঠিয়া মুরারির ছোট ভাই বিশু বলিল—আসবার সময় দিদির সঙ্গে দেখা করে এলেন না কেন, জামাইবাবু? দিদি সিঁড়ির ঘরে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল, আপনি যখন চলে আসেন

কিন্তু নৌকা তখন জোর ভাটার টানে যশাইকাটির বাঁকের প্রায় কাছাকাছি আসিয়া পৌঁছিয়াছে।

 

এবার কলিকাতায় আসিয়া অনেকদিন পরে দেওয়ানপুরের বাল্যবন্ধু দেবব্রতের সঙ্গে দেখা হইল। সে আমেরিকা যাইতেছে। পরস্পরের দেখাসাক্ষাৎ না হওয়ায় কেহ কাহারও ঠিকানা জানিত না । অথচ দেবব্রত এখানেই কলেজে পড়িতেছিল, এবার বি.এসসি. পাস করিয়াছে।…অপুর কাছে ব্যাপারটা আশ্চর্য ঠেকিল, আনন্দ হইল, হিংসাও হইল। প্রতি শনিবারে বাড়ি না যাইয়া যে থাকিতে পারিত না, সেই ঘর-পাগল দেবব্রত আমেরিকা চলিয়া যাইতেছে!

মাস দুই-তিন বো কষ্টে কাটিল। আজ এক বছরের অভ্যাস-আপিস হইতে বাসায় ফিরিয়া অপর্ণার হাসিভরা মুখ দেখিয়া কর্মক্লান্ত মন শান্ত হইত। আজকাল এমন কষ্ট হয়। বাসায় না ফিরিয়াই সোজা ছেলে পড়াইতে যায় আজকাল, বাসায় মন লাগে না, খালি খালি ঠেকে।

লীলারা কেহ এখানে নাই। বর্ধমানের বিষয় লইয়া কি সব মামলা-মকদ্দমা চলিতেছে, অনেকদিন হইতে তাহারা সেখানে।

একদিন রবিবারে সে বেলুড় মঠ বেড়াইয়া আসিয়া অপর্ণাকে এক লম্বা চিঠি দিল, ভারি ভালো লাগিয়াছিল জায়গাটা, অপর্ণা এখানে আসিলে একদিন বেড়াইয়া আসিবে। এসব পত্রের উত্তর অপর্ণা খুব শীঘ্র দেয়, কিন্তু পত্ৰখানার কোন জবাব আসিল না—দু-দিন, চারদিন, সাতদিন হইয়া গেল। তাহার মন অস্থির হইয়া উঠিল—কি ব্যাপার? অপর্ণা হয়তো নাই, সে মারা গিয়াছে-ঠিক তাই। রাত্রে নানা রকম স্বপ্ন দেখে—অপর্ণা ছলছল চোখে বলিতেছে—তোমায় তো বলেছিলাম আমি বেশিদিন বাঁচব না, মনে নেই? …সেই মনসাপোতায় একদিন রাত্রে?-আমার মনে কে বলত। যাই—আবার আর জন্মে দেখা হবে।

পরদিন পড়িবে শনিবার। সে আপিসে গেল না, চাকুরির মায়া না করিয়াই সুটকেস গুছাইয়া বাহির হইয়া যাইতেছে এমন সময় শশুরবাড়ির পত্র পাইল। সকলেই ভালো আছে। যাক-বাঁচা গেল? উঃ, কি ভয়ানক দুর্ভাবনার মধ্যে ফেলিয়াছিল উহাবা! অপর্ণার উপর একটু অভিমানও হইল। কি কাণ্ড, মন ভালো না থাকিলে এমন সব অদ্ভুত কথাও মনে আসে। কয়দিন সে ক্রমাগত ভাবিয়াছে, ওগো মাঝি তরী হেথা গানটা কলিকাতায় আজকাল সবাই গায়। কিন্তু গানটার বর্ণনাব সঙ্গে তার শ্বশুরবাড়ির এত হুবহু মিল হয় কি করিয়া? গানটা কি তাহার বেলায় খাটিয়া যাইবে?

 

শনিবার আপিস হইতে ফিরিয়া দেখিল, মুরারি তাহার বাসায় বার-বারান্দায় চেয়াবখানাতে বসিয়া আছে। শ্যালককে দেখিয়া অপু খুশি হইল—হাসিমুখে বলিল, এ কি, বাস বে! সাক্ষাৎ বড়োকুটুম যে। কার মুখ দেখে না জানি যে আজ সকালে

মুরারি খামে-আঁটা একখানা চিঠি তাহার হাতে দিল—কোন কথা বলিল না। অপু পত্রখানা হাত বাড়াইয়া লইতে গিয়া দেখিল, মুরারির মুখ কেমন হইয়া গিয়াছে। সে যেন চোখের জল চাপিতে প্রাণপণ চেষ্টা করিতেছে।

অপুর বুকের ভেতরটা হঠাৎ যেন হিম হইয়া গেল। কেমন করিয়া আপনা-আপনি তাহার মুখ দিয়া বাহির হইল—অপর্ণা নেই?

মুরারি নিজেকে আর সামলাইতে পারিল না।

–কি হয়েছিল?

–কাল সকালে আটটার সময় প্রসব হল—সাড়ে নটার সময়–

—জ্ঞান ছিল?

—আগাগোড়া। ছোট কাকিমার কাছে চুপি চুপি নাকি বলেছিল ছেলে হওয়ার কথা তোমাকে তার করে জানাতে। তখন ভালোই ছিল। হঠাৎ নটার পর থেকে।

ইহার পরে অপু অনেক সময় ভাবিয়া আশ্চর্য হইত—সে তখন স্বাভাবিক সুরে অতগুলি প্রশ্ন একসঙ্গে করিয়াছিল কি করিয়া! মুরারি বাড়ি ফিরিয়া গল্প করিয়াছিল—অপূর্বকে কি করে খবরটা শোনাব, সারা রেল আর স্টিমারে শুধু তাই ভেবেছিলাম কিন্তু সেখানে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেলাম, আমায় বলতে হল না—ওই খবর টেনে বার করলে।

মুরারি চলিয়া গেলে সন্ধ্যার দিকে একবার অপুর মনে হইল, নবজাত পুত্রটি বাঁচিয়া আছে না নাই? সে কথা তো মুরারিকে জিজ্ঞাসা করা হয় নাই বা সে-ও কিছু বলে নাই। কে জানে, হয়তো নাই।

কথাটা ক্রমে বাসার সকলেই শুনিল। পরদিন যথারীতি আপিসে গিয়াহে, আপিস হতে ফিরিয়া হাতমুখ ধুইতেছে, উপরের ভাড়াটে বন্ধু সেন মহাশয় অপুদের ঘরের বারান্দাতে উঠিলেন।

অপু বলিল-এই যে সেন মশায়, আসুন, আসুন।

সেন মহাশয় জিহ্বা ও তালুর সাহায্যে একটা দুঃখসূচক শব্দ উচ্চারণ করিয়া টুলখানা টানিয়া হতাশভাবে বসিয়া পড়িলেন।

-আহা-হা, রূপে সরস্বতী গুণে লক্ষ্মী! কলের কাছে সেদিন মা আমার সাবান নিয়ে কাপড় ধুচ্ছেন, আমি সকাল সকাল স্নান করব বলে ওপরের জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি। বললামকে বৌমা! তা মা আমার একটু হাসলেন—বলি তা থাক, মায়ের কাপড় কাঁচা হয়ে যাক! স্নানটা না হয় নটার পরেই করা যাবে এখন—একদিন ইলিশ মাছের দুইমাছ বেঁধেছেন, অমনি তা বাটি করে ওপরে পাঠিয়ে দিয়েছেন—আহা কি নরম কথা, কি লক্ষ্মীশ্রী,—সবই শ্রীহরির ইচ্ছে! সবই তাঁর

তিনি উঠিয়া যাইবার পব আসিলেন গাঙ্গুলি-গৃহিণী। বয়সে প্রবীণা হইলেও ইনি কখনও অপুর সঙ্গে সাক্ষাৎভাবে কথাবার্তা বলেন নাই। আধ-ঘোমটা দিয়া তিনি দোরের আড়াল হইতে বলিতে লাগিলেন—আহা, জলজ্যান্ত বৌটা, এমন হবে তা তত কখনও জানি নি, ভাবি নিকাল আমায় আমার বড় ছেলে নবীন বলছে রাত্তিবে, যে, মা শুনেছ এইবকম, অপূর্ববাবুর স্ত্রী মারা গিয়েছেন এই মাত্তর খবর এল—তা বাবা আমি বিশ্বাস করি নি। আজ সকালে আবার বাঁটুল বললে—তা বলি, যাই জেনে আসি–আসব কি বাবা, দুই ছেলেব আপিসেব ভাত, বাঁটুলের আজকাল আবার দমদমার গুলির কারখানায় কাজ, দুটো নাকে-মুখে খুঁজেই দৌড়ায়, এখন আড়াই টাকা হপ্তা, সাহেব বলেছে বোশেখ মাস থেকে দেড় টাকা বাড়িয়ে দেবে। ওই এক ছেলে বেখে ওব মা মারা যায়, সেই থেকে আমারই কাছে—আহা তা ভেবো না বাবা—সবারই ও কষ্ট আছে,—তুমি পুরুষ মানুষ, তোমার ভাবনা কি বাবা? বলে

বজায় থাকুক চুড়ো-বাঁশি
মিলবে কত সেবাদাসী—

–একটা ছেড়ে দশটা বিয়ে করো না কেন?—তোমার বয়েসটাই বা কি এমন–

অপু ভাবিল —এরা লোক ভালো তাই এসে এসে বলছে। কিন্তু আমায় কেন একটু একা থাকতে দেয় না? কেউ না আসে ঘরে সেই আমার ভালো। এবা কি বুঝবে?

সন্ধ্যা হইয়া গেল। বাবান্দার যে কোণে ফুলেব টব সাজানো, দু-একটা মশা সেখানে বিন্ বিন করিতেছে। অন্যদিন সে সেই সময়ে আলো জ্বালে, স্টোভ জ্বালিয়া চা ও হালুয়া করে, আজ অন্ধকারের মধ্যে বারান্দার চেয়াবখানাতে বসিযাই রহিল, একমনে সে কি একটা ভাবিতেছিলগভীরভাবে ভাবিতেছিল।

ঘরের মধ্যেই দেশলাই জ্বালার শব্দে সে চমকিয়া উঠিল। বুকের ভিতরটা যেন কেমন করিয়া উঠিল—মুহূর্তের জন্য মনে হইল যেন অপর্ণা আছে। এখানে থাকিলে এই সময় সে স্টোভ ধরাইত, সন্ধ্যা দিত। ডাকিয়া বলিল—কে?

পিন্টু আসিয়া বলিল—ও কাকাবাবু-মা আপনাদেব কেরোসিনের তেলের বোতলটা কোথায় জিজ্ঞেস করলে

অপু বিস্ময়ের সুরে বলিল—ঘরে কে রে, পিন্টু? তোর মা?…ও! বউ-ঠাকরুন?—বলিতে বলিতে সে উঠিয়া দেখিল পিন্টুর মা মেজেতে স্টোভ মুছিতেছে।

বউ-ঠাকরুন, তা আপনি আবার কষ্ট করে কেন মিথ্যে—আমিই বরং ওটা

তেলের বোতলটা দিয়া সে আবার আসিয়া বারান্দাতে বসিল। পিন্টুর মা স্টোভ জ্বালিয়া চা ও খাবার তৈরি করিয়া পিন্টুর হাতে পাঠাইয়া দিল ও রাত্রি নয়টার পর নিজের ঘর হইতে ভাত বাড়িয়া আনিয়া অপুদের ঘরের মেজেতে খাইবার ঠাই করিয়া ভাতের থালা ঢাকা দিয়া রাখিয়া গেল।

পিন্টুর বাবা সারিয়া উঠিয়াহেন, তবে এখনও বড়ো দুর্বল, লাঠি ধরিয়া সকালে বিকালে একটু-আধটু গোলদিঘিতে বেড়াইতে যান, নিচের একঘর ভাড়াটে উঠিয়া যাওয়াতে সেই ঘরেই আজকাল ইহারা থাকেন। ডাক্তার বলিয়াছে, আর মাসখানেকের মধ্যে দেশে ফেরা চলিবে। পরদিন সকালেও পিন্টুর মা ভাত দিয়া গেল। বৈকালে আপিস হইতে আসিয়া কাপড় জামা না ছাড়িয়াই বাহিরে বারান্দাতে বসিয়াছে। বউটি স্টোভ ধরাইতে আসিল।

অপু উঠিয়া গিয়া বলিল-বোজ বোজ আপনাকে এ কষ্ট করতে হবে না, বউদি। আমি এই গোলদিঘির ধারের দোকান থেকে খেয়ে আসব চা।

বউদি বলিল—আপনি অত কুষ্ঠিত হচ্ছেন কেন ঠাকুরপো, আমার আর কি কষ্ট? টুলটা নিয়ে এসে এখানে বসুন, দেখুন চা তৈরি করি।

এই প্রথম পিন্টুর মা তাহার সহিত কথা কহিল। পিন্টু বলিল—কাকাবাবু আমাকে গোলদিঘিতে বেড়াতে নিয়ে যাবে? একটা ফুলের চারা তুলে আনব, এনে পুঁতে দেব।

বউটির বয়স ত্রিশের মধ্যে, পাতলা একহারা গড়ন, শ্যামবর্ণ, মাঝামাঝি দেখিতে, খুব ভালোও নয়, মন্দও নয়। অপু টুলটা দুয়ারের কাছে টানিয়া বসিল। বউটি চায়ের জল নামাইয়া বলিল—এক কাজ করি ঠাকুরপো, একেবারে চাট্টি ময়দা মেখে আপনাকে খানকতক লুচি ভেজে দি—কখানাই বা খান—একেবারে রাতের খাবারটা এই সঙ্গেই খাইয়ে দি—সারাদিন ক্ষিদেও তো পেয়েছে।

মেয়েটির নিঃসংকোচ ব্যবহারে তাহার নিজের সংকোচ ক্রমে চলিয়া যাইতেছিল। সে বলিল— বেশ করুন মন্দ কি। ওরে পিন্টু, ওই পেয়ালাটা নিয়ে আয়

-–থাক, থাক ঠাকুরপো, আমি ওকে আলাদা দিচ্ছি। কেটলিতে এখনও চা আছে—আপনি খান। আপনাদের বেলুনটা কোথায় ঠাকুবপো?

–সত্যি আপনি বড় কষ্ট করছেন, বউ-ঠাকরুন-আপনাকে এত কষ্ট দেওয়াটা

পিন্টুর মা বলিল—আপনি বার বার ওরকম বলছেন কেন? আপনারা আমার যা উপকার করেছেন, তা নিজের আত্মীয়ও করে না আজকাল। কে পরকে থাকবার জন্যে ঘর ছেড়ে দেয়? কিন্তু আমার সে বলবার মুখ তত দিলেন না ভগবান, কি কবি বলুন। আমি বুগী সামলে মেয়েকে যদি খাওয়াতে না পারি, তাই সে দুবেলা আপনি খেয়ে আপিসে গেলেই পিন্টুকে নিজে গিয়ে ডেকে এনে আপনার পাতে খাওয়াত। এক-একদিন

কথা শেষ না করিয়াই পিন্টুর মা হঠাৎ চুপ করিল। অপুর মনে হইল ইহার সঙ্গে অপর্ণার কথা কহিয়া সুখ আছে, এ বুঝিবে, অন্য কেহ বুঝিবে না।

সারাদিন অপু কাজকর্মে ভুলিয়া থাকিতে প্রাণপণ চেষ্টা করে, যখনই একটু মনে আসে অমনি একটা কিছু কাজ দিয়া সেটাকে চাপা দেয়। আগে সে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হইয়া বসিয়া কি ভাবিত, খাতাপত্রে গল্প কবিতা লিখিত কাজ ফাঁকি দিয়া অন্য বই পড়িত। কিন্তু অপর্ণার মৃত্যুর পর হইতে সে দশগুণ খাটিতে লাগিল, সকলের কাছে কাজের তাগাদা করিয়া বেড়ায়, সারাদিনের কাজ দু-ঘন্টায় করিয়া ফেলে, তাহার লেখা চিঠি টাইপ করিতে করিতে নৃপেন বিরক্ত হইয়া উঠিল।

পূর্ণিমা তিথিটা…অপর্ণা ছাদের আলিসার ধারে দাঁড়াইয়া, এই তো গত কোজাগরী পূর্ণিমার রাত্রিতে লক্ষ্মীর মতো মহিমময়ী, কি সুন্দর ডাগর চোখ দুটি, কি সুন্দর মুখশ্রী। অপুর মনে হইয়াছিল, ওর ঘাড় ফেরাইবার ভঙ্গিটা যেন রানীর মতো—এক এক সময় সম্রম আসে মনে। অপর্ণা হাসিয়া বলে আমার যে লজ্জা করে, নইলে সকালে তোমার খাবার করে দিতে ইচ্ছে করে, আমার হোট বোন লুচি ভাজতে জানে না,সেজ খুড়িমা ছেলে সামলে সময় পান না-মা থাকেন ভাড়ারে, তোমার খাবার কষ্ট হয়না? হঠাৎ অপুর মনে হয়—দূর ছাইকি লিখে যাচ্ছি মিছে-কি হবে আর এসবে?

কি বিরাট শূন্যতা কি যেন এক বিরাট ক্ষতি হইয়া গিয়াছে, জীবনে আর কখনও তাহা পূর্ণ হইবার নহে–কখনও না, কাহারও দ্বারা না–সম্মুখে বৃক্ষ নাই, লতা নাই, ফুলফল নাই—শুধু এক রুক্ষ, ধূসর বালুকাময় বহুবিস্তীর্ণ মরুভূমি!

মাসখানেক পরে পিন্টুর মা বলিল—কখনও ভাই দেখি নি, ঠাকুরপো। আপনাকে সেই ভাইয়ের মতো পেলুম, কিন্তু করতে পারলাম না কিছু দিদি বলে যদি মাঝে মাঝে আমাদের ওখানে যান—তবে জানব সত্যিই আমি ভাই পেয়েছি।

অপু সংসারের বহু দ্রব্য পিন্টুদের জিনিসপত্রের সঙ্গে বাধিয়া দিল—ডালা, কুলো, ধামা, বঁটি, চাকি, বেলুন। পিন্টুর মা কিছুতেই সে সব লইতে রাজি নয়—অপু বলিল, কি হবে বউদি, সংসার তো উঠে গেল, ওসব আর হবে কি, অন্য কাউকে বিলিয়ে দেওয়ার চেয়ে আপনারা নিয়ে যান, আমার মনে তৃপ্তি হবে তবুও।

মৃত্যুর পর কি হয় কেহই বলিতে পাবে না? দু-একজনকে জিজ্ঞাসাও করিল—ওসব কথা ভাবিয়া তো তাহাদের ঘুম নাই। মেসে বরদাবাবুর উপর তাহার শ্রদ্ধা ছিল, তাহার কাছেও একদিন কথাটা পাড়িল। বরদাবাবু তাহাকে মামুলি সান্ত্বনাব কথা বলিয়া কর্তব্য সমাপন করিলেন। একদিন পল ও ভার্জিনিয়ার গল্প পড়িতে পড়িতে দেখিল মৃত্যুর পর ভার্জিনিয়া প্রণয়ী পলকে দেখা দিয়াছিল-হতাশ মন একটুকু সূত্রকেই ব্যগ্র আগ্রহে আঁকড়াইয়া ধবিতে ব্যস্ত হইয়া উঠিল। তবুও তত এতটুকু আলো!—সে আপিসে, মেসে, বাসায় যেসব লোকের সঙ্গে কারবার করে—তাহারা নিতান্ত মামুলি ধরনের সাংসারিক জীব-অপুর প্রশ্ন শুনি তাহারা আড়ালে হাসে, চোখ টেপাটেপি কবে-কবুণার হাসি হাসে। এইটাই অপু বরদাস্ত করিতে পারে না আদৌ। একদিন একজন সন্ন্যাসীর সন্ধান পাইয়া দরমাহাটার এক গলিতে তাহার কাছে সকালের দিকে গেল। লোকের খুব ভিড়, কেহ দর্শনপ্রার্থী, কেহ ঔষধ লইতে আসিয়াছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিবার পর অপুর ডাক পড়িল। সন্ন্যাসী গেরুয়াধারী নহেন, সাদা ধুতি পরনে, গায়ে হাত-কাটা বেনিয়ান, জলচৌকিব উপব আসন পাতিয়া বসিয়া আছেন। অপুর প্রশ্ন শুনিয়া গম্ভীরভাবে বলিলেন–আপনার স্ত্রী কতদিন মারা গেছেন? মাস দুই?—তার পুনর্জন্ম হয়ে গিয়েছে।

অপু অবাক হইয়া জিজ্ঞাসা করিলকি করে আপনি—মানে—

সন্ন্যাসীজী বলিলেন-মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই হয়। এতদিন থাকে না—আপনাকে বলে দিচ্ছি, বিশ্বাস করতে হয় এসব কথা। ইংরিজি পড়ে আপনারা তো এ সব মানেন না। তাই হতে হবে।

অপুর একথা আদৌ বিশ্বাস হইল না। অপর্ণা, তাহার অপর্ণা, আর মাস আট-নয় পরে অন্য দেশে কোন গৃহস্থের ঘরে সব ভুলিয়া ঘোট খুকি হইয়া জন্মিবে?…এত স্নেহ, এত প্রেম, এত মমতা—এসব ভুয়োবাজি? অসম্ভব।…সারারাত কিন্তু এই চিন্তায় সে ছটফট করিতে লাগিলএকবার ভাবে, হয়তো সন্ন্যাসী ঠিকই বলিযাছেন—কিন্তু তাব মন সায় দেয় না, মন বলে, ও-কথাই নয়-মিথ্যা, মিথ্যা, মিথ্যা…স্বয়ং পিতামহ ব্রহ্মা আসিয়া বলিলেও সে-কথা বিশ্বাস করিবে না। দুঃখের মধ্যে হাসিও পাইল—ভাবিল অপর্ণার পুনর্জন্ম হয়ে গেছে, ওর কাছে টেলিগ্রাম এসেছে। হামবাগ কোথাকার—দ্যাখো না কাণ্ড!

এত ভয়ানক সঙ্গীহীনতার ভাব গত দশ-এগারো মাস তাহার হয় নাই। পিন্টুরা চলিয়া যাওয়ার পর বাসা ভালো লাগে না, অপর্ণার সঙ্গে বাসাটা এতখানি জােনন যে, আর সেখানে থাকা অসম্ভব হইয়া উঠিল। তদুপরি বিপদ, গাঙ্গুলি-গিন্নি তাহার কোন্ বোনঝির সঙ্গে তাহার বিবাহের যোগাযোগের জন্য একেবারে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন। তাহাকে একা একটু বসিতে দেখিলে সংসারের অসারত্ব, কথিত বোনঝিটির রূপগুণ, সম্মুখের মাঘ মাসে মেয়েটিকে একবার দেখিয়া আসিবার প্রস্তাব, নানা বাজে কথা।

নিজে রাঁধিয়া খাওয়ার ব্যবস্থা—অবশ্য ইতিপুর্বে সে বরাবরই রাঁধিয়া খাইয়া আসিয়াছে বটে, কিন্তু এবার যেন রাঁধিতে গিয়া কাহার উপর একটা সুতীব্র অভিমান। ঘরটাও বড়ো নির্জন, রাত্রিতে প্রাণ যেন হাঁপাইয়া উঠে। পাষাণভারের মতো দারুণ নির্জনতা সব সময় বুকের উপর চাপিয়া বসিয়া থাকে। এমন কি, শুধু ঘরে নয়, পথে-ঘাটে, আপিসেও তাই-মনে হয় জগতে কেহ কোথাও আপনার নাই।

তাহার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কে কোথায় চলিয়া গিয়াছে ঠিকানা নাই-প্রণবও নাই এখানে। মুখের আলাপী দু-চারজন বন্ধু আছে বটে কিন্তু ও-সব বে-দরদী লোকের সঙ্গ ভালো লাগে না। রবিবার ও ছুটির দিনগুলি তো আর কাটেই না-অপুর মনে পড়ে বৎসরখানেক পূর্বেও শনিবারের প্রত্যাশায় সে-সব আগ্রহভরা দিন গণনা—আর আজকাল? শনিবার যত নিকটে আসে তত ভয় বাড়ে।

বৌবাজারের এক গলির মধ্যে তাহার এক কলেজ বন্ধুর পেটেন্ট ঔষধের দোকান। অপর্ণার কথা ভুলিয়া থাকিবার জন্য সে মাঝে মাঝে সেখানে গিয়া বসে। এ রবিবার দিনটাও বেড়াইতে বেড়াইতে গেল। কারবারের অবস্থা খুব ভালো নয়। বন্ধুটি তাহাকে দেখিয়া বলিল—ও, তুমি আমার আজকাল হয়েছে ভাই-কে আসিল বলে চমকিয়ে চাই, কাননে ডাকিলে পাখি—সকাল থেকে হরদম পাওনাদার আসছে আর যাচ্ছে—আমি বলি বুঝি কোন্ পাওনাদার এলো, বোসো বোসো।

অপু বসিয়া বলিল—কাবুলীর টাকাটা শোধ দিয়েছ?

-কোথা থেকে দেব দাদা? সে এলেই পালাই, নয় তো মিথ্যে কথা বলি। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনের দেনার দরুন-ছোট আদালতে নালিশ করেছিল, পরশু এসে বাক্সপত্র আদালতের বেলিফ সীল করে গিয়েছে। তোমার কাছে বলতে কি, এবেলার বাজার খরচটা পর্যন্ত নেই–তার ওপর ভাই বাড়িতে সুখ নেই। আমি চাই একটু ঝগড়াঝাঁটি হোক, মান-অভিমান হোক—তা নয়, বৌটা হয়েছে এমন ভালো মানুষ সাত চড়ে রা নেই

অপু হাসিয়া উঠিয়া বলিল—বলল কি হে, সে তোমার ভালো লাগে না বুঝি?…

—রামোঃ—পাসে লাগে, ঘোর পাসে। আমি চাই একটু দুষ্টু হবে, একগুঁয়ে হবে—স্মার্ট হবে—তা নয় এত ভালো মানুষ, যা বলছি তাই করছে—সংসারের এই কষ্ট, হয়তো একবেলা খাওয়াই হল না—মুখে কথাটি নেই! কাপড় নেই—তাই সই, ডাইনে বললে তক্ষুনি ডাইনে, বাঁয়ে বললে বাঁয়ে-না, অসহ্য হয়ে পড়েছে।—বৈচিত্র্য নেই রে ভাই। পাশের বাসার বৌটা সেদিন কেমন স্বামীর উপর রাগ করে কাচের গ্লাস, হাতবাক্স দুমদাম করে আছাড় মেরে ভাঙলে, দেখে হিংসে হল, ভাবলুম হায় রে, আর আমার কি কপাল! না, হাসি না আমি তোমাকে সত্যি সত্যি প্রাণের কথা বলছি ভাই—এরকম পানসে ঘরকন্না আর আমার চলছে না-বিলিভ মি—অসম্ভব! ভালোমানুষ নিয়ে ধুয়ে খাব?…একটা দুষ্ট মেয়ের সন্ধান দিতে পারো?

–কেন আবার বিয়ে করবে নাকি?—একটাকে পারো না খেতে দিতে–তোমার দেখছি সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়

–না ভাই, এ সুখ আমার আর—জীবনটা এখন দেখছি একেবারে ব্যর্থ হল, মনের কোনও সাধ মিটল না।—এক এক সময় ভাবি ওর সঙ্গে আমার ঠিক মিলন হয়নি-মিলন যদি ঘটত তা হলে দ্বন্দ্বও হতবুঝলে না?…কে, টেপি?—এই আমার বড়ো মেয়ে—শোন, তোর মার কাছ থেকে দুটো পয়সা নিয়ে দু-পয়সার বেগুনি কিনে নিয়ে আয় তো আমাদের জন্যে, আর অমনি চায়ের কথা বলে দে

—আচ্ছা মরণের পর মানুষ কোথায় যায় জানো? বলতে পারো?

—ওসব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাই নি কখনও। পাওনাদার কি করে তাড়ানো যায় স্বলতে পারো? এখুনি কাবুলিওয়ালা একটা আসবে নেবুতলা থেকে। আঠারো টাকা ধার নিয়েছি, চার আনা টাকা পিছু সুদ হপ্তায়। দু হপ্তার সুদ বাকি, কি যে আজ তাকে বলি?-স্কাউলেটা এলো বলে দিতে পারো দুটো টাকা ভাই?

-এখন তো নেই কাছে, একটা আছে রেখে দাও। কাল সকালে আর একটা টাকা দিয়ে যাব এখন। এই যে টেপি, বেশ বেগুনি এনেছিস-না না, আমি খাব না, তোমরা খাও, আচ্ছা এই একখানা তুলে নিলাম, নিয়ে যা টেঁপি।

 

বন্ধুর দোকান হইতে বাহির হইয়া সে খানিকটা লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরিল। লীলা এখানে আছে? একবার দেখিয়া আসিবে? প্রায় একবৎসর লীলারা এখানে নাই, তাহার দাদামহাশয় মামলা করিয়া লীলার পৈতৃক সম্পত্তি কিছু উদ্ধার করিয়াছেন, আজকাল লীলা মায়ের সঙ্গে আবার বর্ধমানের বাড়িতেই ফিরিয়া গিয়াছে। থার্ড ইয়ারে ভর্তি হইয়া এক বৎসর পড়িয়াছিল—পরীক্ষা দেয় নাই, লেখাপড়া ছাড়িয়া দিয়াছে।

সন্ধ্যার কিছু পূর্বে ভবানীপুরে লীলাদের ওখানে গেল। রামলগন বেয়ারা তাহাকে চেনে, বৈঠকখানায় বসাইল, মিঃ লাহিড়ী এখানে নাই, রাঁচি গিয়াছেন। লীলা দিদিমণি? কেন, সেকথা কিছু বাবুর জানা নাই? দিদিমণির তো বিবাহ হইয়া গিয়াছে গত বৈশাখ মাসে। নাগপুরে জামাইবাবু বড়ো ইঞ্জিনিয়ার, বিলাতফেরত—একেবারে খাঁটি সাহেব, দেখিলে চিনিবার জো নাই। খুব বড়োলোকের ছেলে—এদের সমান বড়োলোক। কেন, বাবুর কাছে নিমন্ত্রণেব চিঠি যায় নাই?

অপু বিবর্ণমুখে বলিল-কই না, আমার কাছে, হ্যাঁ-না আর বসব না—আচ্ছা।

বাহিরে আসিয়া জগৎটা যেন অপুর কাছে একেবারে নির্জন, সঙ্গীহীন, বিস্বাদ ও বৈচিত্র্যহীন ঠেকিল। কেন এরকম মনে হইতেছে তাহার? লীলা বিবাহ করিবে ইহার মধ্যে অসম্ভব তো কিছু নাই। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তবে তাহাতে মন খারাপ করিবার কি আছে? ভালোই তো। জামাই ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষিত, অবস্থাপন্নলীলার উপযুক্ত বব জুটিয়াছে, ভালোই তো।

রাস্তা ছাড়িয়া ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সম্মুখের মাঠটাতে অর্ধ অন্ধকারের মধ্যে সে উদ্ভ্রান্তের মতো অনেকক্ষণ ঘুরিয়া বেড়াইল।

লীলার বিবাহ হইয়াছে, খুবই আনন্দের কথা, ভালো কথা। ভালোই তো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *