১৪. এক বর্ষায় গল্প শুরু করেছিলাম

এক বর্ষায় গল্প শুরু করেছিলাম। এখন আরেক বর্ষা। সেই মেঘকালো আকাশ, সেই বৃষ্টি। ঢাকার গাছগুলিতে নতুন পাতা। টোকাই ছেলেমেয়েগুলির হাতে কদম ফুলের গুচ্ছ। ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি থামছে, এরা ছুটে ছুটে যাচ্ছে ফুল নিবেন? ফুল? চাইরটা এক টাকা। চাইরটা এক টাকা।

এই এক বছরে কী কী পরিবর্তন হলো বলি—— নীলা ফুপুর বিয়ে হয়ে গেল। তিনি বরের সঙ্গে দেশের বাইরে (ইটালি, মিলান শহর) চলে গেছেন। ঢাকা এয়ারপোর্টে তিনি উঁচু হিল পরে বেকায়দায় পা ফেলেছিলেন। পা মচকে ফেললেন। হিল খুলে ফেলতে হলো। তিনি এক হাতে নতুন কেনা হিল জুতাজোড়া নিয়ে খালি পায়ে প্লেনে উঠলেন।

নীলা ফুপুর বরের নাম শামস-উল আলম। তিনি মিলানে এক চকলেট কারখানায় কাজ করেন। তার চেহারা হাবভাব চালচলন সবই বান্দরের মতো। তাঁকে প্রথম দেখে আমার মনে হয়েছিল— স্যুট পরা বান্দর। সাইজে ফুপুর চেয়েও ছোট। এক জায়গায় বসে থাকতে পারেন না। একদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারেন না। বেচারা বউ খুঁজতে দেশে এসেছিলেন। এক বন্ধুর সঙ্গে নাটকের শুটিং কীভাবে হয় দেখতে গেলেন। তখন ফুপুর শট হচ্ছিল। গ্রামের মেয়ে কলসি কাঁখে জল আনতে যাচ্ছেন। এই দৃশ্য দেখে ভদ্রলোক প্রেমে পড়ে গেলেন। অতি দ্রুত বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল। মা শুধু একবার বলেছিলেন, ছেলে তো সুন্দর না। চেহারায় হনুমান ভাব আছে। এতেই ফুপু কেঁদেকেটে অস্থির হয়েছেন। বিয়ে হলো খুব ধুমধাম করে। বরপক্ষ নীলা ফুপুকে দুই সেট গয়না দিল। একটা হীরার আংটি দিল। ফুপু আমাকে আংটি দেখিয়ে বললেন, অরিজিন্যাল হীরা, আমেরিকান ডায়মন্ড না। দাম কত বল তো?

জানি না। অনেক দাম।

বাংলাদেশী টাকায় ছাপ্পান্ন হাজার টাকা। এত দাম দিয়ে আংটি কেনার কোনো মানে হয়! টাকা থাকলেই খরচ করতে হবে? আমি ওর সঙ্গে রাগ করেছি। দেখি আংটিটা তোর আঙুলে পর। কেমন লাগে দেখি। আহা, পর না!

আমি কড়ে আঙুলে আংটি পরে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। ইটালি রওনা হবার দিন হঠাৎ ফুপুর তার ভাইজানের কথা মনে পড়ল। তাঁর প্লেন বিকাল তিনটায়, তিনি সকাল এগারোটায় আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, ভাইজানের জন্যে মন খারাপ লাগছে। উনার সঙ্গে দেখা করব। ব্যবস্থা করতে পারবি?

না। একদিনে ব্যবস্থা করা যাবে না।

গতরাতে ভাইজানকে স্বপ্নে দেখে মন এত খারাপ হয়েছে! কী স্বপ্নে দেখি জানিস? দেখি ভাইজান সুই-সুতা দিয়ে একটা কাঁথা সেলাই করছেন। আমি তাকে বললাম, এইসব মেয়েদের কাজ, তুমি করছ কেন? আমাকে দাও। ভাইজান আমার হাতে সুই-সুতা দিতে দিতে বললেন, তুই বিয়ে করলি, আমাকে দাওয়াত দিলি না কেন? আমি বললাম, দাওয়াত দিব কীভাবে? তুমি তো জেলে। তখন ভাইজান বললেন, দাওয়াত দিলে একদিনের ছুটি নিয়ে আসতাম। আমাদের জেলখানাটা ভালো। এখানে এরকম সিস্টেম আছে।

ফুপু কাঁদতে লাগলেন। তাকে আমি নাটকের অনেক দৃশ্যে কাঁদতে দেখেছি। বাস্তবের কোনো দৃশ্যে তিনি অনেকদিন পর কাঁদলেন। দৃশ্যটা এত সুন্দরভাবে করলেন যে, আমার চোখে পানি এসে গেল। তিনি ফোপাতে ফোপাতে বললেন–বুঝলি বাবলু, অল্প বয়সে আমাদের বাবা মারা গেল। বিরাট সংসার এসে পড়ল ভাইজানের ঘাড়ে। বেচারাকে কত ধান্ধাবাজি করে সংসার টানতে হলো!

ফুপু, কান্না বন্ধ করে গোছগাছ কর। একটার সময় তোমাদের রিপোর্টিং।

ফুপু কান্না বন্ধ করতে পারলেন না।

এয়ারপোর্টে একটা মজার ঘটনার উল্লেখ করতেই হয়। নতুন ফুপা কমপ্লিট স্যুট পরে তিড়িং-বিড়িং করছেন। হাতে সময় নেই, ইমিগ্রেশনে ঢুকে যাবেন! নীলা ফুপু বললেন, ও বাবলু, তোর ফুপাকে সালাম করলি না? পা ছুঁয়ে সালাম কর। দোয়া নে। আদব-কায়দা শিখিয়ে দিতে হবে— গাধা ছেলে!

আমি পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। ফুপা সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে রিস্টওয়াচ খুলে আমার হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বললেন, তোমার হাতে ঘড়ি নাই, এটা আগে খেয়াল করি নাই। ঘড়িটা রাখ— একশ দেড়শ টাকার সস্তার ডিজিটাল ঘড়ি না। সাতশ লিরা দিয়ে কিনেছি।

আমি না না করতে যাচ্ছি, নীলা ফুপু আরেকটা ধমক দিলেন— আদর করে তোর ফুপা একটা জিনিস দিচ্ছে, না না করছিস কেন? একটাই তো তোর ফুপা!

ফুপা ঘড়ি দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না, স্যুটের পকেট থেকে কলম বের করে আমার আমার বুকপকেটে দিয়ে দিলেন। দরাজ গলায় বললেন, পাস করার পর চিঠি দিও, তোমাকে ইটালি নিয়ে যাব। সেখানে সিটিজেনশিপের ব্যবস্থা করে দেয়ার দায়িত্ব আমার। যদি না পারি কান কেটে কুত্তাকে খাওয়ায়ে দিব। শামস উল আলম এককথার মানুষ।

ইমিগ্রেশনে ঢোকার আগে মেয়েরা শেষ কান্না কাঁদে। ফুপু সেই কান্না শুরু করলেন। ফুপা তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলতে লাগলেন কাঁদে না লক্ষ্মী, কাঁদে না। প্রতি বছর একবার দেশে আসবে। মাই ওয়ার্ড অব অনার। ফুপা নিজেও কাঁদতে লাগলেন।

কী সুন্দর দৃশ্য! আমি চোখের সামনে তাঁদের অতি সুন্দর সংসার দেখতে পাচ্ছি। নীলা ফুপুর কুৎসিত অতীতের ছায়া এই সংসারে কোনোদিনও পড়বে না। আমাদের বাংলা স্যার বলতেন–জটিল অন্ধকারে কী হয়? সামান্য জোনাকির আলোতেও অন্ধকার কাটে। ফুপু এবং ফুপার ভালোবাসায় তাদের সব অন্ধকার কেটে যাবে।

 

ভাইয়ার রেজাল্ট হয়েছে। তিনি যথারীতি ফাস্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছেন। এতেও তিনি সন্তুষ্ট না। একটা পেপারে না-কি কম নাম্বার পেয়েছেন। কেন কম পেয়েছেন এটা নিয়েই চিন্তিত। লেকচারার হিসেবে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন। এটা কোনো বড় কথা না। তার মতো ছেলে তো ইউনিভার্সিটির টিচার হবেই। বড় কথা হলো, মার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভাইয়া একটা গাড়ি কিনেছেন। মরিস মাইনর। গাড়ি এখনো রাস্তায় নামে নি। কারণ আমাদের ড্রাইভার নেই। ড্রাইভার খোঁজা হচ্ছে। ভাইয়া রোজই কারো না কারো ইন্টারভ্যু নিচ্ছেন। কাউকেই তার মনে ধরছে না। প্রতিদিন কিছু সময় তিনি গাড়ির পেছনে ব্যয় করেন। পালকের ঝাড়ন দিয়ে ধুলা ঝাড়েন। হোস পাইপে পানি দিয়ে গাড়ি ধোয়া হয়। একদিন তিনি গাড়ি কীভাবে চলে, ইঞ্জিন কীভাবে কাজ করে, স্পার্ক প্লাগ কী, এইসব নিয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। পেট্রোল ইঞ্জিনের সঙ্গে স্টিম ইঞ্জিনের তফাতটা কোথায়? রকেটের ইঞ্জিন কী? আমি সব জেনে গেলাম।

 

বড়খালার ভূত দেখা রোগের আরো উন্নতি হয়েছে। আগে ভূতগুলো থাকত খাটের নিচে, এখন তারা সাহসী হয়েছে। গভীর রাতে খালা যখন টিভি দেখেন তখন তারা খাটের নিচ থেকে বের হয়ে আসে, খালার সঙ্গে টিভি দেখে চুপচাপ টিভি দেখলে ঝামেলা ছিল না, কিন্তু তারা নিজেদের পছন্দের প্রোগ্রাম দেখতে চায়। খালা হয়তো নাটক দেখছেন, তারা ফস করে রিমোট টেনে অন্য চ্যানেল দিয়ে দিবে। ভূতরা খালার জীবন অস্থির করে তুলেছে।

ভাইয়ার পরামর্শে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট খালার চিকিৎসা করছেন। সাইকিয়াট্রিস্ট বলছেন খালার রোগের নাম ডিলুশান অব পারসেপশন। রোগটা তার শুরু হয়েছে খালু সাহেবের মৃত্যুর পর। কারণ খুঁজতে গিয়ে মজার একটা জিনিস বের হয়েছে, খালু সাহেব তার বিপুল বিষয়-সম্পত্তি, ব্যাংকের ক্যাশ টাকার অতি সামান্য অংশই খালাকে দিয়ে গেছেন। সবই জহির ভাইয়ের নামে। খালা এতদিন তা চেপে রেখেছেন। এই কাজটা খালু সাহেব কেন করেছেন তা বোঝা যাচ্ছে না। কারণ নিশ্চয়ই আছে। সব ঘটনার পেছনে কারণ থাকবে। ভাইয়া যেমন বলেন, প্রথমে Cause তারপর Effect।

এর মধ্যে আমি একবার বাসার কাউকে না বলে কুমিল্লা সেন্ট্রাল জেলে বাবাকে দেখে এসেছি। বাবাকে তারা ঢাকা থেকে কুমিল্লা পাঠিয়ে দিয়েছিল। বাবার সঙ্গে দেখা করার পুরো ব্যবস্থাটা করে দেয় ওসি সাহেবের ছেলে শামসুল। শামসুল সবসময় খেলাধুলা নিয়ে থাকলেও এসএসসি পরীক্ষায় খুব ভালো করে। জিপিএ ফাইভ পায়। শামসুলের কাছে শুনেছি তার বাবা ছেলের রেজাল্টের খবর শুনে মোনাজাতের ভঙ্গিতে দুই হাত তুলে বলেন, হে আল্লাহপাক, আমি আমার জীবনের সবচে ভালো সংবাদটা শুনে ফেলেছি। এখন আমার মৃত্যু হলেও কোনো আফসোস নাই।

শামসুল আবার এই অংশটা অভিনয় করে সবাইকে দেখায়। এত সুন্দর অভিনয়! শামসুল ক্রিকেট না খেলে অভিনয় করলে অনেক ভালো করত। জোকারি অভিনয়। সে সবচে ভালো অভিনয় করে পাগলের। নর্দমার পাশে দাঁড়িয়ে ছোট বাথরুম করার সময় পাগল কী করে সেই অভিনয়। এমনিতে পাগলদের লজ্জাবোধ নেই শুধু ছোট বাথরুম করার সময় পাগলরা নাকি লজ্জায় মরে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *