১৪. একটি চমৎকার দৃশ্য

ওসমান সাহেব দূর থেকে একটি চমৎকার দৃশ্য দেখলেন। গেটের বাইরে অপলা ও টগর।

অপালা হাসছে। অপলার কোলে হাসছে টগর।

তিনি মুগ্ধ চোখে তাকালেন। কিছু কিছু দৃশ্য মুহূর্তের মধ্যে মানুষকে অন্য রকম করে ফেলে। অন্ধকার দূর করে দেয়। মনের কোনো একটা স্যাঁতস্যাতে জায়গায় হঠাৎ খানিকটা আলো এসে পড়ে।

তার মন হাল্কা হয়ে গেল। দীর্ঘদিন তিনি কিছু লিখতে পারছেন না। একটি লাইনও নয়। না। লেখার মত কষ্টও যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। তিনি হাসলেন। একজনের কান্না অন্য জনকে স্পর্শ করে না। কিন্তু হাসি করে।

অপলা চেঁচাল–দুলাভাই। দুলাভাই। সে আজ এত উল্লসিত কেন? ওসমান সাহেব হাসতে হাসতে বুললেন, কি খবর অপলা?

আমাদের ভাল খবর। আপনার খবর কি? আমার কোনো খবর নেই। এত খুশি কেন? অপলা ঘাড় কাত করে বলল–খুব ভাল সময়ে এসেছেন। ভাল সময় কেন? ७ों दव्लब नां। অপলা হাসছে। টগর হাসছে। হাসছেন ওসমান সাহেব। রানু দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখল। এমন আনন্দিত হবার মত কি ঘটেছে? টগর বাবার কোলে যাবা জন্যে হাত বাড়িয়েছে। এটাও একটা নতুন দৃশ্য। টগর তার বাবা-মোর প্রতি আলাদা কোনো আবেগ দেখায় না।

ওসমান সাহেব ছেলেকে হাত বাড়িয়ে কোলে নিলেন। টগর বলল, আজ কি বুধবার? না। আজ বুধবার না। অন্য একবারে এসে দেখলাম কেমন লাগে। তুমি খুশি হয়েছ টগর?

হ্যাঁ।

বেশি খুশি? না অল্প খুশি?

টগর দাঁত বের করে হাসল। অপলা বলল চলুন উপরে যাই। ওসমান সাহেবের কেন জানি দোতলায় উঠতে ইচ্ছা হল না। তার মনে হল দোতলায় উঠলেই চমৎকার বিকালটা অন্য রকম হয়ে যাবে। রানু এসে কঠিন মুখে দু’একটা কথা জিজ্ঞেস করবে। আজ কারোর কঠিন মুখ দেখতে ইচ্ছা! করছে না।

তিনি বললেন–অপলা চল রাস্তার মোড়ে যাই। টগরকে চকলেট কিনে দেই। আজ ওর জন্যে কিছু আনা হয়নি।

বৃষ্টি আসবে তো দুলাভাই।

না। আসবে না।

কি করে বুঝলেন?

দেখছি না একটা বেড়াল হাঁটছে? বৃষ্টি আসার আগে বেড়ালরা কখনো ঘর থেকে বের হয় না। পশুপাখিরা প্রকৃতির ব্যাপারগুলি আগে আগে টের পায়।

সত্যি?

হ্যাঁ, সত্যি।

অপলা কি বলতে গিয়েও বল না। অপলা না হয়ে রানু হলে তীক্ষ্ণ স্বরে বলত, তুমি পৃথিবীর সব রহস্য জেনে বসে আছ? অপলা, রানু নয়। অপলা না হয়ে অন্য কোনো মেয়ে হলে বলত, ওমা আপনি এত কিছু কি ভাবে জানেন?

প্রতিটি মানুষ আলাদা, একজনের সঙ্গে অন্যজনের কোনো মিল নেই।

দুলাভাই।

বল।

টগরকে আমার কাছে দিন। আপনার কষ্ট হচ্ছে।

তোমার কষ্ট হচ্ছে না?

না, আমার অভ্যাস আছে।

মোড়ের দোকানটির কাছাকাছি আসতেই বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। অপলা অবাক হয়ে বলল–কি আশ্চর্য বৃষ্টি পড়ছে কেন? যেন বৃষ্টি পড়াটা উচিত নয়।

তিনি হেসে ফেললেন।

আপনি হাসছেন কেন? তুমি আমার কথাটা এমনভাবে বিশ্বাস করেছ দেখে হাসছি। লেখকদের কথা চট করে বিশ্বাস করতে নেই।

আপনি এত আস্তে আস্তে হাঁটছেন কেন? দৌড়ে গিয়ে ঐ বারান্দায় ওঠেন। টগর ভিজে যাচ্ছে যে।

তিনি সত্যি সত্যি দৌড়ালেন। তার গলা জড়িয়ে টগর খিলখিল করে হেসে উঠল। সে খুব মজা পেয়েছে। ওসমান সাহেব হালকা গলায় বললেন, এই বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকবে না। এক্ষুণি থেমে যাবে।

আপনার কোনো কথা আমি এখন আর বিশ্বাস করি না।

বিশ্বাস কর আর না কর বৃষ্টি থামবেই। যে বৃষ্টির ফোঁটা বড় হয় সে বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকে না।

আপনি এমনভাবে কথা বলেন যে মনে হয়। সত্যি কথা বলছেন।

একজন লেখকের গুণ হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্যভাবে কথা বলা।

ওসমান সাহেবের বৃষ্টির কথাগুলি মিলে গেল। চট করে বৃষ্টি থেমে গেল। দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলি মুহূর্তের মধ্যে নেমে গেল রাস্তায়। দারুণ ব্যস্ত সবাই। এ রকম একটা মেঘলা সন্ধ্যায় কারোরই তেমন কোন কাজ থাকার কথা নয়। অথচ সবাই এমন ব্যস্ত যেন এই মুহূর্তে ছুটে না গেলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে।

আপলা বলল, ইস, টগর ভিজে একেবারে কাই হয়ে গেছে। চকলেট নিয়ে চলুন তাড়াতাড়ি বাসায় যাই।

ভিজে কাই হয়ে গেছে একটা নতুন ধরনের এক্সপ্রেশন। আগে কখনো শোনা যায়নি। তিনি মনে মনে নোট করে ফেললেন। কখনো না কখনো ব্যবহার করা যাবে।

কিন্তু সত্যি কি ব্যবহার করা যাবে? কোন দিন তিনি লিখতে পারবেন কিছু? আজকাল তার মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কাল রাতে দীর্ঘ সময় লেখার টেবিলে বসেছিলেন। বসে থাকাই হয়েছে। অন্য সময় কাগজে আঁকা বুকি করেন। একটি দু’টি লাইনও লেখা হয়, কাল তাও হয়নি ঘুমুতে যাবার সময় মনে হয়েছে, এভাবে বেঁচে থাকার কোন অর্থ হয় না!

দুলাভাই কি ভাবছেন?

কিছু ভাবছি না।

চলুন ফিরে যাই। কি কিনবেন কিনে নেন। টগরেব ঠাণ্ড! লাগবে। দেখুন কাঁপছে।

টগর বলল, আমি যাব না। তিনি তাকালেন ছেলের দিকে। টগরের চোখ-মুখ উজ্জ্বল; তিনি বললেন, বাসায় যাবে না?

না।

না কেন? কোথায় যেতে চাও।

তোমার সঙ্গে যাব।

তিনি তাকালেন অপলার দিকে। সে আবাব বলল, বাসায় চলুন তো! আপা খুব রাগ করবে। নির্যাৎ ট্রগরেব ঠাণ্ডা লাগবে দেখুন ওরা দাঁত কিরা কিবা করছে!

রাস্তান্য নেমেই ওসমান সাহেবের মনে হল রানুর কাছে ফিরে যাবার কোনো অর্থ হয় না। রানুর কাছে না গিয়ে তিনি বরং রাস্তায় রাস্তায় হাঁটবেন। এককালে এ রকম কবতেন। বিয়ের পর রানুকে নিয়ে কিছুদিন হেঁটেছেন। রানু বিরক্ত হয়েছে। চোেখ-মুখ কুঁচকে বলেছে। এ কি বিশ্ৰী অভ্যাস। বিনা কারণে হাটছ কেন?

তোমার ভাল লাগছে না।

এর মধ্যে ভাল লাগার কি আছে?

রানুর স্বভাবই হচ্ছে প্রশ্ন দিয়ে প্রশ্নের জবাব দেয়া। শিশুদের স্বভাব। শিশুরাই প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করে। তার পেছনে থাকে শিশুর সরলতা। কাজেই তাদের প্রশ্ন শুনতে ভাল লাগে। বয়স্কদের বেলায় সেটা হয় না।

অপলা বলল এ রকম গম্ভীর হয়ে কি ভাবছেন?

কিছু ভাবছি না।

আচ্ছা দুলাভাই, আপনি কী রানু আপা সম্পর্কে কিছু শুনেছেন? তার বিয়ের প্রসঙ্গে কিছু?

তিনি কিছু বললেন না। অপলা অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, নিশ্চয়ই আপনার কানেও গিয়েছে

ওর বিয়ের কথা বলছ?

হ্যাঁ, আলম ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ের গুজব।

শুনেছি।

এটা ঠিক না। আমি আপাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।

ওসমান সাহেবের কোনো ভাবান্তর হল না। যেন তার কিছুই যায়-আসে না। অথচ তার খুশি হওয়া উচিত। উচিত নয় কি?

অপলা মৃদু স্বরে বলল আমার মনে হয। আপা একদিন না একদিন আপনার কাছে ফিরে যাবে।

তাহলে তুমি খুব খুশি হবে?

হ্যাঁ।

কেন বল তো?

অপলা এক মুহূর্তও না ভেবে বলল, আপনাকে আমার খুব ভাল লাগে দুলাভাই।

তিনি চমকে তাকালেন। অন্ধকার হয়ে আসছে। অপলার মুখ দেখা যাচ্ছে না। তাঁর খুব ইচ্ছে হল অপলার মুখের রেখাগুলি দেখতে। তিনি তার কোনো এক উপন্যাসে লিখেছিলেন একমাত্র কিশোরীরাই ভালবাসার কথা সরাসরি বলতে পারে। কোন বইতে বলেছিলেন? এমন নয় যে তিনি অসংখ্য উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু তবু কেমন যেন ঝামেলা হচ্ছে। কিছুই আজকাল আর মনে করতে পারেন না। সব জট পাকিয়ে যায়। সব কিছুই কী এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে?

রানুবারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। সে তার শাড়ি বদলেছে। সামান্য কিছু সাজগোজও কবেছে। কেন করেছে। সে নিজেও জানে না। ওদের আসতে দেখে সে ভেতরে চলে গেল।

ওসমান সাহেব গেটের সামনে এসে বললেন, অপলা, আজ আর ভেতরে যাব না।

কেন?

যেতে ইচ্ছে করছে না। অন্য একদিন আসব।

না না, এসব কি, চলুন। আপা অপেক্ষা করছে আপনার জন্যে।

আমার জন্যে অপেক্ষা করছে না। নাও, টগারকে কোলে নাও! ও ঘুমিয়ে পড়ছে।

অপলা টগরকে কোলে নিল।

ওর শরীর মনে হয় পুরোপুরি সারেনি। কেমন চটকরে ঘুমিয়ে পড়ল।

ও কোলে উঠলেই ঘুমিয়ে পড়ে।

তিনি বললেন, অপলা আমি যাচ্ছি। আপলা বিস্মিত হয়ে বলল, আপনার কী হয়েছে দুলাভাই?

কিছু হয়নি। আমি লিখতে পারছি না।

লিখতে না পারা কি খুব কষ্টের?

হ্যাঁ, খুব কষ্টের। আচ্ছা যাই।

দুলাভাই, প্লিজ আপনি রানু আপার সঙ্গে দেখা করে যান। আপনার পাযে পড়ি। আমার একটা কথা রাখুন।

তিনি বড়ই অবাক হলেন। মেয়েটির গলায় এত কাতরতা কেন?

আসুন দুলাভাই।

তিনি সিঁড়ি ভেঙে উঠতে শুরু করলেন। হঠাৎ তার বড় ক্লান্তি লাগল। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি কখনোই কিছু করতে পারেন না। মনের ওপর অসম্ভব চাপ পড়ে।

রানু বেশ সহজ স্বাভাবিকভাবেই কথা-টথা বলল। ওসমান সাহেব জানতে পারলেন সে শিগগিরই এ বাড়ি ছেড়ে দেবে। অফিসের কাছাকাছি একটি ফ্ল্যাট নেবে।

তুমি দেখো তো, তোমার চোখে কোন খালি বাড়ি পড়ে কি না। তুমি তো হেঁটেই বেড়াও। নাকি এখন আর হাঁট না?

হাঁটি। এখনো হাঁটি। বাড়ি চোখে পড়লে তোমাকে বলব।

তিনি উঠে পড়লেন। রানু সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে হঠাৎ করে বলল, মিলিকে একজন ভাল ডাক্তার-টোক্তার দেখানো উচিত। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন?

আমার মনে হয় ও অসুস্থ।

কি রকম অসুস্থ?

বুঝতে পারছি না। ওকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাও। ওর স্বামীর সঙ্গে কথা বল।

বলব।

তুমি তো যাও না। ওদের বাসায়। যাও একদিন। ওর স্বামীকে বুঝিয়ে বল।

ওসমান সাহেবের বেশ মন খারাপ হল। রিকশায় উঠে তিনি মিলির মেয়েটির জন্যে তিন অক্ষরের একটি নাম ভাবতে লাগলেন। যার শুরু হবে মা দিয়ে। এবং এমন একটি নাম যা আগে কেউ রাখেনি।

প্রথমেই যে নামটি মনে হল সেটা হচ্ছে ময়ূর। ময়ূর নাম কেউ কি আগে রেখেছে? পাখিদের নামে প্রচুর নাম আছে দোয়েল, ময়না কিন্তু ময়ুরের নাম কেউ রাখেনি। অথচ কি চমৎকার একটি পাখি। নাম রাখার ব্যাপারে খুব সূক্ষ্মভাবে হলেও কোন এক ধরনের সাইকোলজি কাজ করে। ফলের নামে আমরা রাখি আপেল, বেদানা, কমলা কিন্তু আম দিয়ে কারুর নাম নেই। এর কারণ কি? ওসমান সাহেব শব্দ করে হেসে উঠলেন। রিকশা-ওয়ালা চমকে পেছন ফিরে তোকাল। বোধ হয় তাকে পাগল ভাবছে। মিলির কাছে এখন আর যেতে ইচ্ছে করছে না। কাল যাওয়া যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *