এই জায়গাটা আলাদা করে ঘেরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে লক্ষ লক্ষ সেনা মারা গিয়েছিল তার কয়েকজন এখানে শুয়ে আছে।
ঘুরে ঘুরে দেখছিল সে। এ পথ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ ঢুকে পড়েছে এখানে। এখানে কারও প্রবেশানুমতি লাগে না।
বিরাট জায়গা জুড়ে এই সমাধিক্ষেত্র। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকালে মৃত্যুকে বড় পবিত্র মনে হয়। মনে হয়, এই যে ধবধবে সাদা সমাধিগুলি, এখানেই প্রকৃত শান্তি আছে। সমাধির তলায়। ওইখানে, সমাধির মধ্যে শুয়ে অনন্ত ঘুমে মানুষ অনন্তকাল সুস্বপ্ন দেখে। কারও কোথাও ছুটে যাবার নেই। কেউ কারওকে ছেড়ে যায় না। কেউ আর কষ্ট পায় না কারও জন্য। মৃতেরা কষ্ট পায় না। দেহান্তৰ্গত কষ্ট শুধু জীবিতের জন্য।
সে তো জীবন ছেড়ে মৃত্যুর কাছে চলে যাবে, স্থির করেছিল কবেই, কিন্তু যেতে পারছে না কেন?
সে দূর অবধি দেখে। সাদা সমাধিগুলোয় নানা ধরনের ফলক। ক্রশ বেশির ভাগ। এ ছাড়াও আছে পরি। আছে বই অথবা ছোট্ট ঘরের আদল। তার ওপর কালো দিয়ে সমাধিস্তোত্র লেখা।
অসামান্য পরিষ্কার, একটি বাড়তি পাতাও যেন পড়ে থাকছে না কোথাও। মালিরা কাজ করছেন আর সাদা-কালোর ফাঁকে, ঘাসের অফুরন্ত সবুজের ফাঁকে, তাঁদের হাতে ফুটে উঠছে অজস্র রঙিন ফুল।
মৃত্যুর জন্য এখানে কোথাও চিৎকৃত শোক নেই। শোক এখানে সংহত। সমাহিত। বিষাদের কালো রং শুধু সমাধিস্তোত্রে ফুটে উঠে মিলিয়ে গিয়েছে। মিশে গিয়েছে ঘাসে আর ফুলেদের ছোট ছোট গাছে।
বড় গাছ অল্পই এখানে। বৃক্ষ দু’একটা। তাই শোক ও বিষণ্ণতার গাঢ় ঘোর ঘনতর ছায়া হয়ে লুটিয়ে পড়েনি। স্তব্ধতা ভেঙে পাখিদের ডাক বেহিসাবি প্রায়। সব মিলিয়ে এখানে শোক ও বিষাদকে জয় করার শক্তি মূর্ত আছে। আর আছে বৈরাগ্য।
তবু সে নিজের ভেতর বিষাদ টের পায়। এই সমাধিগুলির উজ্জ্বলতার ভিতর, শান্তি প্রতিজ্ঞার ভিতর সে বিষণ্ণতা মেলে দিয়েঅত্যুলিপি পাঠ করতে থাকে।
তার কোনও গভীর শোক নেই। তার কোনও গভীর সন্তাপ নেই। তার কোনও গভীর যন্ত্রণা নেই। যে-জীবন সে যস্ট্রিম করে তেমন এই দেশ ভারতবর্ষে হাজার মানুষের জীবন। লক্ষ কোটি মানুষের জীবন। অতএব এই দরিদ্র দিনযাপনের জন্য তার কোনও গভীর লজ্জাও নেই। তবু, সব মিলে, তার শোক-সন্তাপ, তার লজ্জা-যন্ত্রণা আকাশপ্রমাণ। সে বড় কাতর। বড় দুঃখী। এই যে উদ্ভাসিত বৈরাগ্য—এর ভাগিদার সে হতে চায়, পারে না। সে তার শোক-তাপ নিয়ে একেবারে শেষ হয়ে যেতে চায়। সে মৃত্যু চায়। মৃত্যু! প্রিয় পবিত্র মৃত্যু। সে সুন্দরী মৃত্যুর কোলে মাঝ রাখবে একদিন। শীঘ্র। অতি শীঘ্র। আর জ্বলতে জ্বলতে শেষ হয়ে যাবে। ফুরিয়ে যাবে।
যে-জায়গায় সে এসে দাঁড়িয়েছে এখন, আলাদা করে ঘিরে দেওয়া, এখানে ঘুমিয়ে আছে সৈনিকেরা।.সার সার অজস্র ফলক। সমান উচ্চতার, অভিন্ন আকৃতির। এখানেও পাখিরা নিরন্তর গান শোনায় সৈনিকদের। আঠারো থেকে চল্লিশ—নানা বয়সের, নানা স্তরের সৈনিক। কে জানে, তাদের দেহ সম্পূর্ণ ফিরেছিল কি না। কে জানে, তাদের একটি মাত্র অঙ্গই হয়তো পেয়েছিল প্রিয়জনেরা আর সমাধিস্থ করেছিল। কে জানে, হয়তো বোমা পড়ে ছিন্নভিন্ন তালগোল দেহটিই পৌঁছেছিল যা কেউ দেখতেও সাহস করেনি।
বীর সৈনিকেরা সব। সে তো মরতে পারছে না মৃত্যুকেই একমাত্র সৎ ও শান্তিময়ী মনে করবার পরও।
ফুল এসে জড়িয়ে রেখেছে, ছোট ছোট ডালপালা আগলে রেখেছে সমাধিগুলি। সে ঘুরে ঘুরে দেখছে। ফাল্গুনের হাওয়া হাহাকার নিয়ে আছড়ে পড়ছে গায়ে। তার চুল উড়ছে। বসন্তে বড় কষ্ট হয়। বড় কষ্ট হয়। বসন্তে তারা গিয়েছিল মাইথন।
4753356 (Private) in Middleton,
York and Lancashire Regiment
Died on June 1945. Age 30.
Its heart to picture your face in
hiding and to think. We could not say Good Bye.
—হৃদয়ে আঁকা ছিল তোমার মুখ। তোমাকে ভেবেছিল সেই হৃদয়।
আমরা তাই কোনও বিদায় বলতে পারিনি।
এই বসন্তে, এই ঘোর বসন্তে তারা গিয়েছিল মাইথন। সে যেমন ভেবেছিল, তেমন ছিল না সে-জায়গা। যাবার সময় কল্যাণেশ্বরীর মন্দিরে থেমে পুজো দিয়েছিল সে। বলেছিল, এই মন্দিরে মানত করলে মনস্কামনা পূর্ণ হয়। সিদুরের টানা টিপ পরেছিল সে। আর শুভদীপ সেই সিঁদুর মুছে ফেলতে আদেশ করেছিল। তার মনে হয়েছিল, অতিথিশালায় এ-এক ভণ্ডামি হবে। সবাই মনে করবে তারা স্বামী-স্ত্রী।
সে এমনকী ভুল করেও কারওকে মনে করাতে চায়নি যে তারা স্বামীস্ত্রী। কিন্তু সে, ওইটুকু সময়, শুধু সিঁদুর পরার মধ্যে যে স্বামী-স্ত্রী হয়ে ওঠা—সেটুকু আঁকড়ে রাখতে চেয়েছিল। শুভদীপকে স্মরণ করেই সে এই সিঁদুর পরেছে। অতএব সে মুছতে চায়নি। শুভদীপ নিজে তার মনের আড়ালে রাখা অনিচ্ছার স্বার্থে রুমাল দিয়ে সিঁদুর মুছে দেয়। চন্দ্রাবলী কথা বলেনি তারপর অনেকক্ষণ। বড় উদাসী দেখাচ্ছিল তাকে। বড় দুঃখী। আর এই উদাস থাকাকে, দুঃখী থাকাকে সে সহ্য করতে পারছিল না। তার ক্রোধ জন্মাচ্ছিল। তখন, সেই বসন্তের সকালে রুক্ষ লালাভ মাটির ওপর শুয়ে থাকা রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে, বসন্তের লীলায়িত বায়ুতে সে কামগন্ধ পাচ্ছিল। প্রকৃতির কাম ধীরে ধীরে তারও মধ্যে সঞ্চারিত হয়। তখন সে ক্রোধাগ্নির সঙ্গে কামাগ্নির সংঘর্ষ ঘটিয়ে ফেলে এবং এ কাজ অত্যন্ত সহজ কারণ কামের পরেই ক্রোধের স্থান, অতএব সম্মিলিত আগুনে, কাম ও ক্রোধের সম্মিলিত অগ্নিস্রোতে উত্তপ্ত হয়ে যাওয়া হাত সে রাখে চন্দ্রাবলীর হাতে। চন্দ্রাবলী হাত সরিয়ে নেয় না। কিন্তু ঔদাস্য থেকে ফিরে আসে না কিছুতে। তখনও দুঃখের আবরণে ঢেকে মুখে।
যে প্রকৃতি জীবিতবৎ কামগন্ধী হয়ে তাকে উত্তেজিত করেছিল সেই প্রকৃতিকেই তার লাগে জড়পদার্থ এবং বস্তুতই প্রকৃতি প্রকৃতপক্ষে অসীম শক্তিধর জড়বস্তু এবং এই জড়বস্তুর প্রতি নিবিষ্ট হয়ে থাকা স্তব্ধ চন্দ্রাবলীকে সে ঘৃণা করে তখন, তাকে লাগে সহাতীত এবং এই ঘৃণার ও অসহিষ্ণুতার প্ররোচনায় সে চন্দ্রাবলীকে যন্ত্রণা দিতে চায়। যন্ত্রণায় বিদ্ধ করতে চায় এবং মহুলির কথা শুরু করে। )
Francis Cameron
Sergent Royal Engineer
Died on 13th August 1940. Age 40
Have mercy upon me O God!
According to thy loving kindness.
—আমাকে দয়া করো হে ঈশ্বর! তোমার প্রেমময় অসীম করুণায়।
পাখিটা শিস দিতে দিতে তার মাথা স্পর্শ করে উড়ে যায়। নরম করবীর ডালে বসে দোল খায়। দুপুরের রোদুর আলতো করে নেমে যাচ্ছে বিকেলের দিকে। বৃদ্ধ মানুষেরা হেঁটে আসছেন কবরের পর কবর পার হয়ে। ছোট ছেলেমেয়েরা ছুটে ছুটে আসছে। কেউ একটিও গাছের পাতা ছিড়ছে না। ফুল ছিড়ছে না। কবরে বসে হুটোপাটি লাগিয়ে দিচ্ছে না। সকলের মুখে কী আশ্চর্য প্রশান্তি। কী আশ্চর্য আনন্দ। তাকে কেউ কিছু জিজ্ঞাসাও করছে না। মালিরাও কাজ করে যাচ্ছে একমনে। এত বড় বাগান, তারা কাজ করবে সন্ধে পর্যন্ত।
পাখিটা শিস দিয়ে যায়। চন্দ্রাবলী সুর মেলাত এই শিসের সঙ্গে। স্বর মেলাত। চন্দ্রাবলী চন্দ্রাবলী। সে ভাবে—চন্দ্রাবলী চন্দ্রাবলী। সে চন্দ্রাবলীকে যন্ত্রণা দেবার জন্য মহুলির কথা তুলেছিল।
মহুলির প্রসঙ্গ এলেই চন্দ্রাবলী ক্লিষ্ট হয়ে যায়। তার সারা মুখ কষ্টে ভরে ওঠে। কিন্তু সে শুনতে আপত্তি করে না। করেনি কোনও দিন। কারণ সে উপযাচক হয়ে গিয়েছিল। উপযাচক হয়ে কবুল করেছিল শুভদীপকে ছাড়া বাঁচবে না বলে সে মহুলিকেও মেনে নেবে। অতএব মহুলিকে সে সারাক্ষণ মেনে নেয়। সারাক্ষণ মহুলির সঙ্গে সঙ্গে বাঁচৌ’আর শুভদীপ জানে বলেই, মহুলির দ্বারা চন্দ্রাবলী যন্ত্রণা পায় জানে বলেই, তার প্রসঙ্গ তোলে। চন্দ্রাবলীর কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রেমের আলাপের মতো বলে যায় কিছু দিন আগে মহুলির আহ্বানে সেগুলির বাড়িতে গিয়েছিল। সন্ধ্যায়। মহুলি একাই ছিল সেদিন। তার স্বামী গিয়েছিল বাণিজ্যিক ভ্রমণে। এবং একাকীত্বের কারণে মহুলির মন ভাল ছিল না। এবং মন ভাল করার জন্য শুভদীপকে বুকে টেনে নেয় সে। আস্তে আস্তে পোশাক খুলে স্তনে মুখ রাখতে দেয়। ওই নির্জনতায় শুভদীপ তখন অধিকতর চঞ্চল হয়ে ওঠে। সে তখন মহুলির ঢেলা ম্যাকসি পায়ের দিক থেকে তুলে দেয় ওপরের দিকে এবং আবিষ্কার করে, অভিভূত হয়ে আবিষ্কার করে–
- S. Scale
Royal Air Force
Died on 14th August 1945, Age 29
Life is all the sweeter that he lived
All he loved more sacred for his sake.
—যে-জীবন সে যাপন করেছে, সুন্দর সে-জীবন। যা কিছু সে ভালবেসেছিল, তারই জন্য সব পুণ্যময়।
স্নেহশীলা, মমতাময়ী বয়স্কা মহিলারাও একে একে এসে পড়ছেন এবার। এই বসন্তের বিকেলে চমকার সাজ-পোশাক তাঁদের। কোনও ব্যস্ততা নেই। সংসারের সকল কাজ সেরে তারা এসেছেন বৈকালিক বাতাস গায়ে মেখে নিতে।
আর শুভদীপ গন্ধ পাচ্ছে তখন। সেই আশ্চর্য গন্ধ। সুগন্ধ নয়। দুর্গন্ধও নয়। নয় মাদকতাময়। গভীর এই ঘ্রাণ।
সে দেখে। চারিদিক অবলোকন করে এবং তরুণ রমণীদের ইতস্তত দেখতে পায়। কেউ কারও সঙ্গে বিশ্রম্ভালাপ করছেন না। যে-যার নিজের মতো সমাধির পর সমাধি পেরিয়ে হেঁটে চলেছেন।
কত অসামান্য মানুষ সব, আর কী বিশাল এই সমাধিক্ষেত্র। এই সব নারী—তাঁরা প্রত্যেকেই সারাদিনের কাজের পর বসন্তের বাস-মেখেছেন গায়ে। এই অসামান্য গন্ধ—যা সে পেয়েছে আগেও–সে নিশ্চিত হয়—এ-কোনও নারীরই গন্ধ বলে। এমনকী মৃত্যু যে নারী, হতে পারে সেই নির্লোভ, নিরপেক্ষ, শান্ত নারীর এ গন্ধ। কিন্তু এখন সে বিশ্বাস করতে চায় এ গন্ধ এই সব রক্তময় মাংসবতী দেহ থেকে আগত এবং তখন, এই সব অপার্থিব গন্ধ ছাপিয়ে তার নাকে লাগে মন্থলির গায়ের গন্ধ। ম্যাকসি তুলতেই ঝাপটা লেগেছিল নাকে আর. আর…সে সবিস্ময় আবিষ্কার করেছিল কোনও অন্তর্বাস নেই। মহুলির কোনও অন্তর্বাস নেই।
সে তখন উন্মত্তের মতো কামড়ে ধরেছিল ঊরু আর হাত রেখেছিল যোনিতে। আর মহুলি তার মাথা চেপে ধরেছিল।
শুনতে শুনতে, এইসব শুনতে শুনতে চন্দ্রাবলী গাড়ির দেওয়ালে মাথা রেখেছিল। দৃষ্টি বাইরে। উদাস। গালের প্রতিটি রেখা যন্ত্রণাময়। চোখের প্রতিটি কাঁপন কষ্টে ভারী। সে, শুভদীপ, তখন উল্লসিত হচ্ছিল মনে মনে এবং অগ্রসরমাণ।
মহুলি তার মাথা চেপে ধরেছিল আর সে তখন চূড়ান্ত, সে তখন কাণ্ডজ্ঞানহীন, মহুলিকে বিছানায় শুইয়ে দেয়, শুইয়ে দেয় আর নিজেকে মুক্ত করে এবং… এবং মহুলি তাকে নিরস্ত করে। হাঁপাতে হাঁপাতে, উত্তেজিত থাকতে থাকতে নিরস্ত করে এই বলে যে সে এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ নেই।
নিরস্ত। নিরস্ত বলেছিল সে চন্দ্রাবলীকে। প্রকৃতপক্ষে নিরস্ত নয়, বরং নিষেধ। কর্কশ নিষেধ। আচমকাই উঠে বসে তাকে এক ধাক্কায় ছিটকে ফেলেছিল মহুলি, আর সে, যেমন করে মানুষ গায়ে পড়া টিকটিকিকে ছিটকে ফেলে দেয়, তেমনি চিৎ হয়ে পড়ে গিয়েছিল। টিকটিকির মতো তারও সাদা পেট উন্মুক্ত ছিল। মুহূর্তে তার সমস্ত কাম জল হয়ে যায়। লজ্জায় শিশ্ন নুয়ে পড়ে।
এই সব বলেনি সে। বলেনি। কেবল বলেছিল নিরস্ত। বলেছিল চূড়ান্ত হতাশায় মহুলি সেদিন মদ্যপান করতে চায়। আর সেদিন ছিল এক বৃহস্পতিবার। সুরা বিপণি বন্ধ থাকবার দিন। তখন মহুলি দ্রুত পোশাক পরে নেয়, এবং তাকে নিয়ে যায় অপরিচিত অন্ধকারে। নিজে আলোয় দাঁড়িয়ে থেকে তাকে ঠেলে দেয় তর্জনী তুলে এক নিবিষ্ট অন্ধকারে, যেখানে, বেআইনি মদ বিক্রি হয়।
14762720 (Private)
A. Right
Royal Army Service Corps
Died on lth July, 1945, Age 22
In memory of a dear son.
He heard the voice of Jesus say;
Come on to me and rest.
—আমাদের ছেলে। যিশু ওকে ডেকেছেন। বলছেন : এসো, আমার কাছে এসো, বিশ্রাম নাও।
বিকেল গড়িয়ে হলুদ আলোয় ধুয়ে দিচ্ছে পৃথিবী। বায়ুর সঙ্গে উড়ে আসছে ধুলোর গন্ধ এবং সেই আশ্চর্য গন্ধের রেশ। এত লোক অথচ কোনও শব্দ নেই। পাখিরাও সব শিস মেরে গেছে। কোনও শিশুকে এত নিঃশব্দে খেলা করতে দেখেনি সে। কোনও বৃদ্ধ আর বৃদ্ধাদের দেখেনি একটিও কথা বিনিময় না করে ভ্রমণ করতে এতক্ষণ। তরুণীরা এত উদাস–যেন কিছুতেই কিছু এসে যায় না তাদের। এই সমাধিস্থলের সম্মানে প্রত্যেকেইনীরর। নিরুৎসুক। একা-একা বায়ু বয়ে যায় আর গাছের পাতারা শুধু কাঁপে। মালিরা কাটা ঘাসের ঝুড়ি বোঝাই করে কোণের দিকে চলে যায়। আর সে, এতক্ষণ পর, কবরগুলির মধ্যে বিষণ্ণতা দেখতে পায়। নিজের বিষণ্ণতার সঙ্গে ওই সমস্ত সমাধির বিষণ্ণতাকে মিশিয়ে সে সামনের দিকে হেঁটে যায় অতি ধীরে। তার জুতোয় ঘাসের ওপর শব্দ ওঠে মশমশ। একটি ছোট্ট লাল ফুল তার পায়ের কাছে ঝরে পড়ে। সে মাড়িয়ে দেয় না, বরং তুলে পকেটে রেখে দেয়। এবং আবার তার নাকে সেই আশ্চর্য গন্ধের ঝাপট এসে লাগে। তার সব জট পাকিয়ে যায়। মদের গন্ধ, ফুলের গন্ধ, মহুলির গন্ধ।
সে অতএব চন্দ্রাবলীকে বলে যায়–সেদিনের কথা বলে যায়, যেদিন সে জীবনে প্রথম খরিদ করে মদ এবং বেআইনিভাবে।
চন্দ্রাবলী প্রকৃতির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তার দিকে তাকায়। এবং মন্তব্য করে। মন্তব্য করে যে সে ঠিক কাজ করেনি। তার উচিত হয়নি বেআইনিভাবে মদ কেনা। সে হাসে। হেসে চন্দ্রাবলীর মক্তব্য জানালা দিয়ে উড়িয়ে দেয়। উড়িয়ে দেয় এবং চুপ করে যায়। কী হল বলে না। তারপর কী হল বলে না। চন্দ্রাবলীও চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তার আপাত ঔদাস্যের অন্তরালে তীব্র ঔৎসুক্য পাক খায় এবং একসময় সে জানতে চেয়ে ফেলে। এরপর কী হল জানত চেয়ে ফেলে।
548366 Corporal
Royal Air Force
Died on 29 th June 1945, Age 27.
Passing time only depends on fondest memories in God’s keeping.
এইবার আসে সমর্থ পুরুষেরা। তরুণ, যুবক। অধিকাংশের পরিধান সৈনিকের পোশাক। সে আশ্চর্য হয়ে দেখে। সমাধিগুলি দেখে এবং সৈনিকদের। কাছাকাছি রয়েছে কোনও সৈনিকের আবাসন–এমনই ধারণা করে সে। বাচ্চারা কেউ কেউ তখন ছুটে গিয়েছে তরুণী মায়ের কাছে। কেউ ধরেছে দাদু-দিদিমার হাত। কোনও তরুণ পিতার কোমর ধরে ঝুলে পড়ল কেউ। সে নিশ্চিত হয় তখন। বৈকালিক ভ্রমণে আসে গোটা পরিবার। এবং এখানে, এই পবিত্র, শান্তিময় সমাধিক্ষেত্রে, নিঃশব্দে রচিত হয় মিলনক্ষেত্র। এমনকী বাচ্চারাও প্রকাশ করে না উচ্ছাস, শিষ্টতায়, যখন তারা বাবা-মায়ের সংলগ্ন।
রোদ্দুর এখন আলো হয়ে বিছিয়ে আছে শুধু। শুধু, সোনালি নরম আলো। দিবসাবসান সাদা সমাধিগুলির ওপর এঁকে দিচ্ছে সামান্য রঙের আলপনা। বড় যত্নে। বড় মমতায়। টুঁই-ট্টিট, টুঁই-ট্টিট শব্দে ডেকে যাচ্ছে পাখি। সমস্ত ক্লান্ত পাখিরবের কিচির-মিচির ছাপিয়ে সেই শব্দ মিষ্টি, করুণ এবং একটানা। সে পাখিটিকে খোঁজে। দেখতে পায় না। বুকের মধ্যে কী যেন এক ছটফটায়। ঘাসের ওপর বসে পড়ে সে। বহুক্ষণ ধরে ঘুরেছে। দাঁড়িয়ে আছে এত সময় মনে পড়েনি। সে যেমন একদিন অন্য এক সমাধিক্ষেত্রে ঢুকে পড়েছিল আর নিঃশব্দ সেই ঘন গাছে ঘেরা শান্তিস্থলের বাঁধানো পুকুরপারে শুয়ে পড়েছিল, এখানে তেমনটা সম্ভব হয় না। পুকুর নেই বলেই নয়। এই যে বিস্তীর্ণ সমান সবুজ ঘাস তার ওপর শয়ন সম্ভব। কিন্তু সম্ভবও নয়। শান্তির সঙ্গে, সুন্দরের সঙ্গে, আভিজাত্যের জটিল দুরত্ব এখানে রচিত আছে। এ জায়গা, মানুষকে দিয়ে শিষ্ট, পরিশীলিত আচরণ করিয়ে নেয় নিজেই। এই তফাত হল দেশ-গাঁয়ের বাড়ির সঙ্গে শহরের ফ্ল্যাটবাড়ির তফাত। সেখানে কাদা-পায়ে ঢুকে পড়া যায়, মাথায় তেল দিয়ে পুকুরে ডুবে সেরে ফেলা যায় স্নান। গামছায় পিঠ রগড়ে তুলে ফেলা যায় গায়ের ময়লা, কোনও কিছুই চোখে লাগে না, কোনও কিছু বেমানান ও অশিষ্ট বলে মনে হয় না। কিন্তু শহরের ফ্লাটে জুতোজোড়া আড়ালে রাখতে হয়। ধুলো ঢাকা পড়ে কার্পেটে। শহবত ও শিষ্টাচারের পরীক্ষা পদে পদে। সে ঘাসের গায়ে হাত বুলোয়। সমান করে ছাঁটা ঘাস।
চন্দ্রাবলী চেয়েছিল শহরের বৃহৎ ময়দানের ওপর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে যাবে একদিন। চেয়েছিল বড় বড় স্মৃতিসৌধের পাশের পথ দিয়ে এক্কাগাড়ি চেপে ঘুরবে সমস্ত সন্ধ্যা। দেখতে চেয়েছিল সে, খোলা মঞ্চে বসে ভীমসেন যোশী মিঞা-কি-মল্লার গাইছেন আর কালো মেঘে ভরে গিয়েছে আকাশ, আর ভীমসেন যোশী ভিজতে ভিজতে, তামাম দর্শককে ভিজিয়ে দিতে দিতে গাইছেন–ছোটি ছোটি বুন্দন বরসে মেহা। আর মধ্যরাত্রি পূর্ণ হচ্ছে তখন। অন্ধকার আকাশ মেঘে মেঘে আরও আরও অন্ধকার হয়ে নেমে আসছে কোলের কাছে।
আর মহুলি কী চেয়েছিল, মহুলি? তার মনে নেই, মহুলির কোনও চাওয়া মনে নেই।
একদিন সকালে, যে-সময় তাদের দু’জনের ছিল শুধু, মহুলির ও তার, সে সময় এক যুবক এসে যায়। বিভ্রান্ত। আরক্ত চোখ। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চুলে চিরুনি পড়েনি। আলুথালু বেশবাস। পরিকল্পনাহীন ঝোড়ো বাতাসের মতো সে ঢুকে পড়ে ঘরে এবং তার উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে মহুলির হাত চেপে অনুনয় করতে থাকে। কাতর অনুনয় করে যে মহুলি তাকে ছেড়ে চলে না যায়। মহুলির এতটুকু প্রেম সে ভিক্ষা করে তখন। মহুলির দয়া ভিক্ষা করে। আর মহুলি নির্মম অতি নির্মম তাকে চলে যেতে বলে তৎক্ষণাৎ। যুবকটি প্রলাপের মতো বলে যায় সব। তাদুেরু সোনালি সময়ের কথা। রক্তকরবীর মতো ফুটে থাকা প্রেম সেলে যায়। আর মহুলি শুভদীপকে দেখিয়ে দেয় তখন। বলে, সে আর কিছুক্ষণ বসার চেষ্টা করলেই শুভদীপ তাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দেবে। যুবকটি তখন যতটুকু প্রাণশক্তি ছিল তাই নিয়ে উঠে পড়ে। টলতে টলতে উঠে পড়ে। আর শুভদীপ অসহায় দেখতে থাকে তার বরত হয়ে যাওয়া। নিজের অজান্তে, অজ্ঞাতে ব্যবহৃত হয়ে যাওয়া। সে তখন কৈফিয়ত চায় এবং মহুলি চন্দ্রাবলী তোলে। ওই মোটা বেঁটে কালো কুচ্ছিত মেয়েটাকে তাদের সম্পর্কের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দেয়। তাকে পরিত্যাগ করুক শুভদীপ–এমন দাবি তোলে।
সে চন্দ্রাবলীকে যেমন বলেছিল, ভালবাসে মহুলিকে, তেমনি মহুলিকেও বলেছিল চন্দ্রাবলী সম্পর্কে কতখানি নির্মোহ সে, কতখানি নিপ্রেম। শরীর বলেনি। শুধু দায়বদ্ধতা। বাবা-মা নেই। স্বামী তাকে ছেড়ে দিয়েছে। একা, অসহায় এই দায়বদ্ধতা। মহুলি কি বিশ্বাস করেনি?
সে তখন নারাজ হয়ে যায়। চন্দ্রাবলীর প্রতি টানে হয়তো নয়। হয়তো আহত অহং-এ। এবং মহুলি সম্পর্ক অস্বীকার করে। ভালবাসা অস্বীকার করে। যদি চন্দ্রাবলী থাকে তবে সে নেই, জানিয়ে দেয় সাফ।
চন্দ্রাবলী পেরেছিল। মহুলি পারেনি। চন্দ্রাবলী নিয়েছিল। মহুলি নেয়নি। কেন নেবে। নেবার তো কথা নয়। কথা হল, মহুলির হাজার প্রেমিক ছিল। চন্দ্রাবলীর সে-ই ছিল শুধু।
তার কোনও তত্ত্বদর্শন নেই। সে তত্ত্বদর্শী নয়। একাধিক প্রেমিক থাকা ভাল কি মন্দ জানে না সে। শুধু আশ্চর্যের সহস্র উপকরণ মহুলিকে হারিয়ে তাকে দুঃখিত হতে দেয় না। সে বরং মহুলিকে প্রবঞ্চক ভাবে এবং মালবিকা সিনহার পাশে জুড়ে দেয়।
এই সব বলেনি সে। চন্দ্রাবলীকে বলেনি। শুধু বলেছিল অন্য সব। সব। বলেছিল, সেদিন থাকবার কথা ছিল মহুলির বাড়ি। থাকেনি সে। কিন্তু সম্পূর্ণ সত্য ছিল না এ বিবৃতি। সত্য এইটুকু যে সেদিন রাতে মহুলির বাড়িতে তার থাকবার কথা ছিল। কিন্তু মহুলি তাকে রাত্রি এগারোটায় রাস্তায় বার করে দেয়। বার করে দেয় কারণ তার একা-একা থাকবার বেগ পেয়েছিল। দু’পাত্র হুইস্কি খেয়ে তার দুঃখ কষ্টে তোলপাড় হৃদয় একা হতে চেয়ছিল অপূর্ব হিসেবে। আর শুভদীপ রাত্রি এগারোটায় পথে নেমেছিল। কী করবে, কোথায়, কী ভাবে যাবে! সে তখন ট্রামে চড়ে বসে। চেষ্টা করলে যেতে পারত বাড়ি। কিন্তু যায় না। ট্রামে চেপে চলে যায় শহরের বড় ইস্টিশনে। আর বসে বসে কাটিয়ে দেয় সারা রাত। আর ভোর ফুটলে তার ইচ্ছে করে প্রথমেই মহুলির কাছে যেতে। কেন-না আশঙ্কা করে সে। ভয় পায়, মদ্যপান করে, দুঃখেরঅভিঘাতে মহুলি কিছু ঘটিয়ে ফেলবে না তো! সে ভয় পায় আর.স্বেদবিন্দু ফোঁটা ফোঁটা নামে। সে, ক্লান্ত, নিদ্রাহীন মহুলির বাড়িতে চলে যায়। দেখে, মহুলি ঘুমিয়েছিল রাতে, আর ঘুমনোর আগে মশারি টাঙিয়েছিল।
Captain C.W. War
Royal Engineers
Died on llJuly, 1945, Age 36
He gave his today for our tomorrow.
—আমাদের আগামী সকাল, আজ তার মৃত্যু বিনিময়ে।
This Hindu soldier of the Indian Army is honoured here. Our Vagabate Namah Chinia Gudappa
Indian Pioneer Corps
Died on 16th August, 1945. Age 19
হিন্দু সৈনিক। খ্রিস্টীয়দের মধ্যে সমাধিস্থ একজন হিন্দু সৈনিকের দেহ। হিন্দু শব্দটি তার মস্তিষ্কে আঘাত করে। বৈকালিক ভ্রমণে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা কি সকলেই খ্রিস্টীয়? যদিও পোশাক দেখে চেনা যায় না কারওকেই। খ্রিস্টীয় পোশাকের ধাঁচ সারা পৃথিবীকে গ্রাস করে বসে আছে।
সে চারপাশে তাকায়। কারওকেই দেখতে পায় না আর। সন্ধ্যা এখনও নামেনি। তবু প্রত্যেকেই ঘরে ফিরে গেছেন। এমনকী বারও। সে ভাবে, এখন বাচ্চাদের খেলার সময় কম। তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে হয়। সে উঠে দাঁড়ায়। এই জায়গা ছেড়ে যেতে মন চায় না। কেউ কি তাকে চলে যেতে বলবে? সে প্রতীক্ষা করে। মালিরা কাজ করছি এখনও। সে ঘুরতে থাকে আবার। টুই-উিট, টুই-ট্রিট পাখিটি ডেকে চলেছে এখনও। অন্য পাখিরাও ঘরে ফিরবে এ বার। ঘরে ফেরার আগে পাখিরা সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে। দিনের আলো থাকতে থাকতে সব কাজ গুছিয়ে নিতে চায়।
সে, দিনের পর দিন ধরে বিয়ের বিরোধী থেকে গেলে এবং ঘর বাধার ইচ্ছা প্রাচীনধর্মী ও প্রগতির পরিপন্থী—ইত্যাদি ব্যাখ্যা দিলে একদিন চন্দ্রাবলী পাখিদের কথা বলেছিল। পশুদের কথা, এমনকী কীটপতঙ্গের কথাও। বলেছিল, ঘর বাঁধার ইচ্ছা মানুষের সহজাত প্রবণতা। সমস্ত প্রাণীর সহজাত প্রবণতা। সংঘবদ্ধ বসবাস মানুষ কামনা করে ভিতরকার তাগিদে। অন্তঃস্থ জিনবাহিত প্রেরণায়। সে বিশ্বাস করেনি। বিশ্বাস করেনি কারণ তলিয়ে দেখেনি। অথবা বিশ্বাস করেনি, বিশ্বাস করতে চায়নি বলেই।
5688369 (Private) Jhon Swither
Royal Army Service Corps
Died on 11th July, 1945. Age 20
We think of you in silence
No eyes can see us weep
For deep within our hearts
Your memory we keep
–নীরবে স্মরণ করি তোকে। তোর জন্য কখনও কাঁদিনি। বুকের গভীরতর ঘরে–সারাক্ষণ-সারাক্ষণ তুই।
শোকের কী আশ্চর্য সংহত প্রকাশ! কী অপরূপ সহন। শুভদীপ অভিভূত হয়ে যায়। নেশাগ্রস্তের মতো পড়তে থাকে একের পর এক।
পড়ে আর ভাবে। যারা এসেছিল সমাধিস্থ করার সময়, যারা ভেবে ভেবে স্তোত্র লিখিয়েছিল, তরল অশ্রুসমূহকে ঘনতর করে, করে বিন্দুবৎ, এই সব শব্দাবলি ভরে তুলেছিল কত অসামান্য শক্তিমান তারা, কেন তারা করেছিল এত? মৃতের সমাধি থেকে শোক নিয়ে কেন ফিরে গ্ৰিয়েছিল ঘরে? সে কি জীবনেরই টানে, নাকি সেই অমোঘ মৃত্যুর ডাক? মৃত্যুর কাছ থেকে মানুষ কি জীবনের দিকে ফেরে? ফেরা যায়? নাকি সব মৃত্যুময়। জন্ম মৃত্যুময়। এমনকী জন্মের আগে এক জন্ম প্রস্তাব—সেও মৃত্যুময় ঘোর। মৃত্যু-মৃত্যু-মৃত্যুময়। এ জগতে যা-কিছু সমস্তমৃত্যুমুখে ধায়। মৃত্যুই তৃপ্তিময়। মৃত্যুই মহান।
সে তখন মৃত্যু খোঁজে। মৃত্যু হাতড়ায় সন্ধে রাত্ৰিমুখে আপতিত হওয়ার আগেই সে ফলকে ফলকে খোঁজে মৃত্যুর পূর্ণ নামগান। তখন দুই হাতে দুইখানি সমাধিফলক-চন্দ্রাবলী সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে। ফলকে স্তোত্র লেখা শুধু। নাম নেই। কোনও নাম নেই। সে পড়ে নেয়। দ্রুত পড়ে নেয়।
His life is beautiful memory
His absence is silent grief
—সে ছিল, সুন্দর হয়ে ছিল। চলে গেছে। নিঃশব্দ কষ্ট একা একা।
Keep on beloved and take thy rest
Lay down thy head upon thy Saviour’s breast
—ঘুমোও। ঘুমিয়ে পড়ো তুমি। তোমার মাথা বুকের মধ্যে নিক। পরম কারুণিক।
সে ঈশ্বরকে মানে না, বলতে যায় এমন আর জলের ধারে নৌকা এসে লাগে। পিঠের কাছে এসে দাঁড়ায় পাহাড়। পাহাড়ে বৃক্ষ সব। বসন্তে হাওয়ার দোলায় মাতাল গাছপালা। তার গায়ের ওপর পাতা খসে পড়ে টুপটাপ। সে নৌকার দিকে দেখে। চন্দ্রাবলী উদাস বসে আছে। তার চুল উড়ছে, দোপাট্টা উড়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। তরুণ মাঝি হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সে দেখছে। পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট ছোট্ট বননিবাস। বাসস্থান তাদের। আর নৌকার নীচে জল। নৌকা ঘিরে জল। সবুজ জল। কী সুন্দর। মাইথনের বিপুল বিশাল জলাধার। এমন সবুজ কেন? গাছপালা তার সবুজ খানিক ঢেলে দিয়েছে জলে।
সে নৌকায় উঠে পড়ে। ডাঙায় বড় লোক। এই বসন্তের উৎসব কালে শীতের চড়ুইভাতি। বাস, ট্রাক, জিপ। জিপ, ট্রাক, ম্যাটাডর। আর গান। চড়া সুরের কান ফাটানো জগঝম্প গান। তারা দু’জন তাই নৌকা করে চলে যাচ্ছে দূরে। জলাধার কী বিশাল! মাঝে মাঝে ফুটে ওঠা নানা আকারের দ্বীপ। দ্বীপের ওপর কোথাও কোথাও টিলা। সবুজ গাছে ঢাকা। তরুণ মাঝি কথা বলছে। বর্ষায় কত জল হয় বলতে থাকছে ডুব যায় ওই দ্বীপ। দেখিয়ে দিচ্ছে সে। দূরে পাহাড়ের গায়ে চাঁদমারিন সি সির উঁদমারি আর তাঁবু। চন্দ্রাবলী কথা বলছে না। বননিবাসে ঢুকে সে চন্দ্রাবৃলীকে আঁকড়ে ধরেছিল। যৌনতায় আঁকড়ে ধরেছিল। চন্দ্রাবলী তখন সমস্ত যৌনতাই রাতের জন্য তুলে রাখতে চায়। তাকে নতুন অবকাশ আর না দিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে।
আসার পথে যে ক্রোধ, কিছুটা প্রশমিত হয় চন্দ্রাবলীকে যন্ত্রণা দিয়ে। সেই প্রশমন ভেঙে আবার উত্থিত হয় ক্রোধ তখন। না বলা চন্দ্রাবলীকে সাজে না। সে বরং চন্দ্রাবলীকে রমণ করে করুণা প্রকাশ করছে—এমনই তার মনে হয়। মহুলি তাকে দয়া দিত, সে চন্দ্রাবলীকে দয়া দেয়।
মহুলি তাদের সংস্থা ছেড়ে চলে গিয়েছে অন্য কোথাও। বলে যায়নি তাকে। সেদিন যদি সে চন্দ্রাবলীকে ত্যাগ করত, কিছুই হত না। হয়তো চন্দ্রাবলী আরও একবার ছুটে আসত ভোরবেলা। যেমন এসেছিল যুবকটি। মহুলির কাছে। আর ফেরত গিয়েছিল। সেও ফেরত দিয়ে দিত চন্দ্রাবলীকে। ফেরত। কারও কাছে দিত। তার কাছে তো চন্দ্রাবলীকে প্রত্যর্পণ করেনি কেউ, চন্দ্রাবলী স্বয়মাগতা। কোনও দায়বদ্ধতা ছিল না তার। তবুও পারল না সে। পারল না। মানুষ ভালবাসে পরস্পর, নিকটতম হয়, কোনও কিছুই আড়াল করে না। প্রাণের সঙ্গে প্রাণ মিশিয়ে এক থালায় ভাত খায়, একই গ্লাসে জল, তবুও, মনের বিচিত্র গতি কোন অলক্ষ্যে প্ররোচিত করে তাদের। কোনও মুহূর্তে বিরুদ্ধভাবে ফুঁসে উঠে পরস্পরকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করে। উভয়েই জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে কারণ ততক্ষণে জয়-পরাজয়ের সঙ্গে জড়িয়ে যায় আত্মসম্মান।
সেদিন মহুলির বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছিল সে। মহত্ত্ব দিয়ে জয়ী হয়েছিল। পিতৃ-মাতৃহীন, স্বামীপরিত্যক্তা চন্দ্রাবলীকে ত্যাগ করতে না চাওয়ার মধ্যে তার মহত্ত্ব ছিল আকাশ পরিমাণ।
হঠাৎ তখন কথা বলেছিল চন্দ্রাবলী। পার থেকে নৌকা তখন অনেকখানি দূরে। ছোট্ট ডিঙি জল কেটে কেটে চলেছিল, চন্দ্রাবলী তরুণ মাঝিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল। দূরে একটি ছোট্ট দ্বীপ। সেইখানে সে যেতে চায়। মাঝি সেই দিকে নৌকা বাইছিল। আর গভীর সবুজ জলের মধ্যে, খোলা আকাশের নীচে অপার নৈঃশব্দ্যের মধ্যে চলতে চলতে শুভদীপের সমস্ত কাম, সমস্ত ক্রোধ আপনা হতে প্রশমিত হয়ে গিয়েছিল। চন্দ্রাবলী তখন একটি জীবনবিমার কথা বলে। সে সম্প্রতি বিমা করিয়েছে জীবন। এবং বিমা করিয়েছে তার গানের ইস্কুল। কেন-না ইস্কুলে আছে ভাল কিছু হারমোনিয়াম, তানপুরা, তবলা। আছেএস্রাজ ও সরোদ। সব তার বাবার করা। সব সে বিমা করিয়েছে এবং জীবনবিমার উত্তরাধিকার .সে দিয়েছে শুভদীপকে। যদি হঠাৎ কিছু হয়ে যায় তার, যদি জলে পড়ে যায় হঠাৎ আর ডুবে যায়…শুভদীপ মুখ ফিরিয়ে নেয়। থামিয়ে দেয় চন্দ্রাবলীকে। এই গভীর প্রকৃতির মাঝে তার জীবনবিমা ভাল লাগে না। চন্দ্রাবলী কথা বন্ধ করে না। যদিও শুভদীপকে সে যথাসাধ্য মান্য করে। কিন্তু আজ সে ব্যতিক্রম। শুভদীপের বারণ সত্ত্বেও সে কথা বলে যায়। পরের দিন দোলপূর্ণিমা, মনে করে দেয়। তাদের পরিচয়ের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি।
তখন ঝাকুনি লাগে নৌকায়। নৌকা পারে ভিড়েছে।
J.C. Leegwood
Royal Army Service Corps
Died on 17th August 1945. Age 31.
The Call was short
The shock severe
To part with one
We love so dear
—শেষের আহ্বান। শোকে নিমজ্জন। বিচ্ছেদ সইছে না। থাকে তীব্র ভালবাসি।
বুদ্বুদের মতো ভেসে ওঠা ছোট্ট একখানি দ্বীপ। বুনো কুল ও শেয়ালকাটার ঝোপ। গোলাকৃতি। মাঝবরাবর কচ্ছপের পিঠের মতো উঁচু।
তরুণ মাঝি একটি বুনোকুলের গাছের সঙ্গে নৌকা বেঁধে নেয়। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে তখন। সূর্য দিগন্তগামী। লাল রং গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। তাদের দ্বীপে নামিয়ে দিয়ে আধঘণ্টা থাকতে পারার আশ্বসুদৈয় সে। চন্দ্রাবলী একটি নির্ভার, লঘু বালিকার মতো লাফিয়ে নামে দ্বীপে এবং মম্ভব্য করে, আয়তনে তার গানের ইস্কুলের সমান। শুভদীপ চারপাশ সন্তর্পণে দেখে নেয়। জল আর জল, দ্বীপ আর দ্বীপ্তা অনেক দূরে পার। ঢালু জমি বেয়ে ওপরে ওঠে তারা। শেয়ালকাটায় হাত ছড়ে যায়। মাকড়সার জাল লেগে যায় মুখে। কুলগাছের কাঁটায় চন্দ্রাবলীর দোপাট্টা আটকে যায়। তারা সাপ, বিছে, পোকা-মাকড়ের ভয় ডিঙিয়ে যে-দিকে মাঝি আর নৌকা আছে, তার উল্টোদিকে চলে যায়। জল ছুঁয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে দু’জনে। সূর্যও টকটকে লাল বেশ ধরে জল ছুঁয়ে ঠিক তাদের মুখোমুখি এসে পঁড়িয়ে থাকে। তাদের গায়ে বসন্তের সর্যাস্তরাগ মাখামাখি হয়ে যায়। চন্দ্রাবলী শুভদীপের দিকে অপলক তাকায়। শুভদীপকে তার লাগে অপরূপ। অগ্নিবর্ণ। রূপ ঠিকরোনো পুরুষ। শুভদীপও চন্দ্রাবলীতে চোখ রাখে। চন্দ্রাবলীকে তার মনে হয় উঁচু খোল থেকে বের হয়ে আসা একখণ্ড মাংসল শামুক।
আর শামুক তখন রূপ ঠিকরানো পুরুষের বুকে মাথা রাখে। সূর্য অল্প ডুব দেয়। আরও লাল হয়ে ওঠে। জড়িয়ে ধরে শামুক আর মুখ তোলে। হাত বাড়িয়ে পুরুষের মুখ টেনে নেয় মুখে। সূর্য তরতর করে অনেকখানি ডুবে যায়। লাল রঙে লালের ছোপ বাড়ে।
জিভের সঙ্গে জিভ জড়িয়ে যায়, শরীর জড়ায় শরীরে। বুনো কুল ও শেয়ালকাটার ঝোপে আঁধার লাগে। দূরবর্তী দ্বীপগুলির মাথায় গাছে গাছে তমসাবৃতা। সূর্য এখন রক্তের মতো লাল। নাক অবধি ডুবিয়ে, শুধু চোখ চেয়ে আছে সে। তার একফালি আলো এসে পড়েছে চন্দ্রাবলীর মুখে। সেখানে প্রেম, বিহুলতা, সমর্পণ, কামনা এবং প্রার্থনা টুকরো টুকরো হয়ে লেগে আছে জড়োয়া গয়নায় মণিমুক্তোর মতো। রোদুরের শেষ ফালিটুকু পড়ে ঝলমল করে উঠছে সেই সব। আর চন্দ্রাবলী বলছে, এই যে এই নির্জনতম দ্বীপ, তাদের একার দ্বীপ, তালসারির সমুদ্রপারের মতো একার—এই যে সূর্যকে সাক্ষী রেখে ঘনিষ্ঠতা, চুম্বন, জড়িয়ে থাকা, একেই কি বিবাহ বলে না?, সমাজের অনুষ্ঠানের মূল্য কি এর চেয়েও বেশি? আজকের পরেও কি বিবাহিত হয়ে রইল না?
শুনতে শুনতে সূর্য ডুবে যায়।