এরপর চার বৎসর-জীবন দত্তের জীবনের বোধ করি উদয়লগ্ন।
নতুন জন্মান্তর। অথবা নতুন জন্মলাভের তপস্যা।
রঙলাল ডাক্তার মধ্যে মধ্যে রহস্য করতেন। একবার বলেছিলেন—তাই তো হে জীবন, মনে বড় আক্ষেপ হচ্ছে। মনে হচ্ছে বিবাহ একটা করলাম না কেন?
এ ধরনের কথা হত রাত্রে। বারান্দায় বসে নিয়মিত পরিমাণ ব্রান্ডি খেতেন আর চুরুট টানতেন। জীবন দত্ত থাকে তার সঙ্গে গল্প করতেন, নইলে বই পড়তেন, কোনো কোনো দিন মনা হাড়িকে ডেকে তার সঙ্গেই গল্প করতেন। তিনি গল্প বলতেন না, গল্প বলত মনা, তিনি শুনতেন। ভূতের গল্প, তিনি শুনতেন আর মধ্যে মধ্যে অট্টহাস্যে ফেটে পড়তেন।
জীবন দত্তকে তার খাতাপত্র দিয়েছিলেন দত্ত সে-সবগুলি পড়তেন নিজের বাড়িতে, যথারীতি কবিরাজি পদ্ধতিতে চিকিৎসাও করে বেড়াতেন, দু-চার দিন অন্তর সকালের কাজ সেরে খাওয়াদাওয়া করে চলে যেতেন রঙলাল ডাক্তারের ওখানে। যা বুঝতে পারতেন না বুঝিয়ে। নিতেন। যে অংশটুকু পড়ছেন তাই বলে যেতেন, ডাক্তার শুনতেন। এই অবস্থাতেই কোনো কোনো দিন আসমৃত্যু রোগীর বাড়ির অবিলম্ব আহ্বান জানিয়ে ডাক আসত; ডাক্তার বিবরণ শুনে কোনোটাতে যেতেন না; যেটাতে যেতেন–জীবন দত্ত সঙ্গে যেতেন। গুরু যেতেন। পালকিতে, জীবন দত্ত যেতেন হেঁটে। সবল সুস্থ দেহ আটত্রিশ ইঞ্চি বুকের ছাতি, ওজনে। দু মনের ওপর, বিরাট মুগুরভাজা শক্ত শরীর-জীবন দত্ত জোয়ান হাতির মতই ভারী পা ফেলে সমানে বেহারাদের সঙ্গে চলে যেতেন।
কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই জীবন দেখলেন এ বিদ্যা আয়ত্ত করা তার বুঝি সাধ্যাতীত। তিনি পিছিয়ে গেলেন। গুরু-শিষ্যের মধ্যে গুরুর মনে বিরক্তির সুর বেজে উঠল। কদিন থেকেই রঙলাল ডাক্তার জীবন দত্তকে তাঁর সেই কাচের ঘরে মড়া কাটার জন্য বলছিলেন। জীবন দত্ত প্রথম দিন মড়া কেটেছিলেন কিন্তু তার প্রতিক্রিয়ায় রাত্রে খাওয়ার পর বমি করে ফেলেছিলেন। তারপর দিন পাঁচেক আর গুরুগৃহের দিকে পা বাড়ান নাই। ছদিনের দিন ভেবেছিলেন—সেই পচা মড়াটা নিশ্চয় ডাক্তার ফেলে দিয়েছেন। সেদিন যাওয়া মাত্র তিরস্কার করেছিলেন গুরু। এবং মনাকে হুকুম করেছিলেন আর একটা নিয়ে আয় মনা।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মনা একটা বছর পাঁচেকের মেয়ের শব এনে হাজির করেছিল। এ অঞ্চলে হিন্দুরাও পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শব দাহ করে না, মাটিতে পুঁতে দেয়। সেদিন জীবন দত্ত হাতজোড় করে বলেছিলেন-ও আমি পারব না। ওই শিশুর দেহের উপরঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিলেন তিনি। বলেছিলেন বিশ্বাস করুন, আমার মেয়েটা ঠিক এমনি দেখতে। ঠিক এমনি। এমনি চুল, এমিন গড়ন!
রঙলাল ডাক্তার তার দিকে যে চোখ তুলেছিলেন সে চোখ উগ্রতায় বিস্ফারিত। কিন্তু দেখতে দেখতে কোমল হয়ে এসেছিল। বলেছিলেন আচ্ছা থাক। তুমি বাঙলোয় গিয়ে বোসো—এটাকে আমি ডিসেকশন করে যাই। মনে হচ্ছে—অত্যন্ত হঠাৎ মৃত্যু হয়েছে। রোগের কোনো চিহ্ন নেই।
সত্যই মেয়েটি দেখতে অনেকটা জীবন ডাক্তারের প্রথম সন্তান সুষমার মত। আতরবউয়ের তখন দুটি সন্তান হয়েছে, বড়টি মেয়ে সুষমা, তারপর ছেলে বনবিহারী।
জীবন দত্ত কাচের ঘর থেকে বেরিয়ে আর অপেক্ষা করেন নাই, বাড়ি চলে এসেছিলেন। গুরুর মনে বিরক্তির সুর বেজে উঠেছিল এই কারণে।
কয়েক দিন পর জীবন দত্ত যেতেই গুরু সেই কথাই বলেছিলেন, বোসো। কয়েকটি কথা বলব তোমাকে। জীবন শঙ্কিত হয়ে বসে ছিলেন। ডাক্তার চুরুট টেনে চলেছিলেন। কিছুক্ষণ পর চুরুটটা নামিয়ে রেখে বলেছিলেন–জীবন, তোমাকে যেমনটি গড়ে তুলব ভেবেছিলাম তা হল না। তোমার মধ্যে সে শক্তি নাই। তা ছাড়া ইংরেজি ভাল না জানলে এ শাস্ত্রে গভীর ব্যুৎপত্তি লাভও অসম্ভব। ভেবেছিলাম-আমি তোমার সে অভাব পূরণ করে দেব। কিন্তু সেও দেখছি সহজ নয়। আমার বিরক্তি লাগে এবং তোমার পক্ষেও এ বিদ্যার শিক্ষা-পদ্ধতির একটা বড় অংশ অত্যন্ত অরুচিকর। সে অরুচি কাটানো তোমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
ডাক্তার চুপ করে গেলেন।
আবার বলেছিলেন—তোমার বাবা তোমার ধাতুকে পুড়িয়ে পিটিয়ে শক্ত করে গড়ে গিয়েছেন—তাকে নতুন করে না গালিয়ে আর নতুন কিছু করা যাবে না। তলোয়ার আর খঙ্গ দুটোই অস্ত্ৰ, কিন্তু প্রভেদ আছে। তলোয়ার দিয়ে মহিষ বলি হয় না, আর খাড়া দিয়ে এ যুগের যুদ্ধ হয় না। বুঝেছ?
ঠিক এই মুহূর্তেই এল একটি ডাক। এ অঞ্চলের একটি নামকরা বাড়ি থেকে ডাক। বাড়িটির সঙ্গে রঙলাল ডাক্তারের প্রথম চিকিৎসার কাল থেকেই কারবার চলে আসছে। তারও চেয়ে যেন কিছু বেশি। একটি প্রীতির সম্পর্কও বোধ করি আছে। এ দেশের সাধারণ মানুষ সম্পর্কে রঙলাল ডাক্তারের একটা অবজ্ঞা আছে। কিন্তু এ বাড়ি সম্পর্কে ঠিক অবজ্ঞা নাই। বাড়ির গৃহিণীর কঠিন অসুখ। মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে রোগ মারাত্মক হয়ে উঠেছে। মহিলাটি আগে। থেকেই অম্বলের ব্যাধির রোগিণী। তিনি আজই ঘণ্টা দুয়েক আগে পায়ে হোঁচট লেগে বাড়ির উঠানে পড়ে গিয়েছিলেন। তারপর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই এই অবস্থা। ধনুকের মত বেঁকে যাচ্ছেন। নিষ্ঠুর যন্ত্রণা। কথাও প্রায় বলতে পারছেন না। চোয়াল পড়ে গিয়েছে।
রঙলাল ডাক্তার বিস্মিত হলেন, কতক্ষণ আগে পড়ে গেছেন বলছ?
–এই ঘণ্টা দুয়েক।
–মাত্র দু ঘণ্টা?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
–তাই তো। এত শিগগির? মনা, বেহারাদের ডাক।
জীবন ডাক্তারও নীরবে গুরুর অনুসরণ করছিলেন।
রঙলাল ডাক্তার প্রথমটা লক্ষ্য করেন নাই; মধ্যপথে জীবনকে দেখেছিলেন, বলেছিলেন, তুমিও আসছ? এটা বোধহয় ইচ্ছা ছিল না তার। সম্পর্ক চুকিয়ে দেওয়ার জন্যই কথা শুরু করেছিলেন। কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই এই ডাকটি এসে পড়েছিল।
আজও স্পষ্ট মনে পড়ছে সে ছবি।
বর্ধিষ্ণু ঘর, রাঢ় অঞ্চলের মনোরম মাটির কোঠা অর্থাৎ দোতলা, প্রশস্ত, পাকা মেঝে, চুনকাম করা দেয়াল। উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল—সে আমলের শৌখিন শেড-দেওয়া চব্বিশবাতি টেবিলল্যাম্প।
অনেকগুলি লোক আত্মীয়স্বজন–দূরে বসে রয়েছে।
একটি বিছানায় রোগিণী ছিলায়-টান-দেওয়া ধনুকের মত বাঁকা অবস্থায় পড়ে আছেন। এর ওপরেও কেউ যেন টান দিচ্ছে; অদৃশ্য কেউ যেন মেরুদণ্ডে হটু লাগিয়ে সবল বাহুর আকর্ষণে টঙ্কার দিয়ে টানছে। রোগিণীর ওষ্ঠাধর দৃঢ়বদ্ধ। চোয়াল পড়ে গিয়েছিল এ কথা সত্য, কিন্তু তবু জীবন দত্ত বুঝতে পারলেন—অপরিসীম ধৈর্যের সঙ্গে ওই ক্ষীণকায়া মেয়েটি এই মর্মান্তিক যন্ত্ৰণা সহ্য করে চলেছেন। শুধু ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে যন্ত্রণার পরিচয় বেরিয়ে আসছে। তার সঙ্গে একটু শব্দ। সেইটুকুকে আর চাপতে পারছেন না ভদ্রমহিলা।
রঙলাল ডাক্তারও স্থির দৃষ্টিতে রাগিণীকে দেখছিলেন। বোধহয় পাঁচ মিনিট পর বললেন– আজই হোঁচট লেগে দু ঘণ্টার মধ্যে এমন হয়েছে?
–হ্যাঁ, দু ঘণ্টাও ঠিক হবে না।
ভ্রূ কুঁচকে উঠল রঙলাল ডাক্তারের-কই কোথায় হোঁচট লেগেছে? রক্ত পড়েছে?
–ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে। রক্তপাত হয় নি।
রঙলাল ডাক্তার পায়ের বুড়ো আঙুলে হাত দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ঘরখানাই যেন শিউরে উঠল; নিষ্ঠুরতম যন্ত্রণায় রোগিণী ভাষাহীন একটা অবরুদ্ধ আর্তনাদ করে উঠলেন। জীবন তখনও অবাক বিস্ময়ে রোগিণীকে দেখছিলেন-কী অপরিসীম ধৈর্য! চোখের দৃষ্টিতে সে যন্ত্রণার পরিচয় ফুটে উঠেছে। চোয়াল পড়ে গেছে, কণ্ঠ দিয়ে আৰ্তস্বর বের হচ্ছে, তাকে প্রাণপণে সংযত করবার চেষ্টা করছেন তিনি। এত যন্ত্রণাতেও জ্ঞান পূর্ণমাত্রায় রয়েছে।
ক্ষত কোথাও হয় নি, রক্তপাতের চিহ্ন নাই; বেঁকে যাচ্ছেন অসহ্য যন্ত্রণায়; শুধু তাই নয়–শরীরের কোনো স্থানে পাখির পালকের স্পর্শেও অসহ্য যন্ত্রণায় থরথর করে কেঁপে উঠছেন। কণ্ঠ দিয়ে অবাধ্য আৰ্তম্বর বের হচ্ছে।
নাড়ি দেখলেন রঙলাল। রোগিণী আবার যন্ত্রণাকাতর অস্ফুট শব্দ করে উঠলেন। স্নায়ু শিরাগুলি এমনই কঠিন টানটান হয়ে উঠেছে যে, সামান্য স্পর্শেই ছিঁড়ে যাবার মত যন্ত্রণায় অধীর করে তুলছে।
রঙলাল ডাক্তার ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন। গম্ভীর মুখে বললেন–দেখ তো জীবন, তোমার নাড়িজ্ঞানে তুমি কী পাচ্ছ?
সরে দাঁড়ালেন তিনি।
সন্তৰ্পণে এসে বসলেন জীবন দত্ত। আশঙ্কায় একবার বুকটা কেঁপে উঠল। শুক্রাচার্যের তুল্য। রঙলাল ডাক্তার, তার কাছে আজ পরীক্ষা দিতে হবে। নাড়ি অনুভবের অবকাশ তিনি পান নাই। যেটুকু পেয়েছেন তার মধ্যে নাড়ির স্পন্দন আছে কি নাই তাও বুঝতে পারেন নাই। রঙলাল ডাক্তার রোগীর মণিবন্ধ মোটা আঙুলে টিপে ধরে নাড়ি পরীক্ষা করেন। স্পন্দনের সংখ্যা গুনে দেখেন। মধ্যে মধ্যে তাতে ছেদ পড়ছে কি না দেখেন। এর বেশি কিছু না। বেশি কিছু বুঝতে চেষ্টা করেন না।
রোগিণীর হাতখানি বিছানার উপরে যেমনভাবে ছিল—তেমনিভাবেই রইল; জীবন দত্ত শুধু মণিবন্ধের উপর আঙুলের স্পর্শ স্থাপন করলেন। চোখ বন্ধ করে পারিপার্শ্বিকের ওপর যবনিকা টেনে দিলেন। প্রায়-রিক্ত-পত্ৰ অশ্বত্থ গাছের একটি সরু ডালে একটিমাত্র পাতা, অতি ক্ষীণ বাতাসের প্রবাহে দৃষ্টির অগোচর কম্পনে কাঁপছে; সেই কম্পন অনুভব করতে হবে; অথচ। অসতর্ক রূঢ় স্পর্শ হলেই পাতাটি ভেঙে ঝরে যাবে। অতিসূক্ষ্ম স্পর্শানুভূতিকে প্ৰবুদ্ধ করে তিনি বসলেন। ধ্যানস্থ হওয়ার মত।
তাঁর বাবা বলতেন—শক্তির ধর্মই হল ব্যবহারে সে সূক্ষ্ম এবং তীক্ষ্ণ হয়। অনুভূতি হল পরম সূক্ষ্ম শক্তি। আবার স্কুল করলে সে গদা হয়ে ওঠে।
ক্ষীণ ও অতি ক্ষীণ স্পন্দন তিনি অনুভব করলেন। কখনও কখনও যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
কানে এল রঙলাল ডাক্তারের কণ্ঠস্বর–পাচ্ছ?
অতি সন্তৰ্পণে ঘাড় নেড়ে জীবন দত্ত জানালেন–পাচ্ছি। যেন ঘাড় নাড়ার সঙ্গে হাত না। নড়ে ওঠে। দেহ-চাঞ্চল্যে মনের সূক্ষ্ম কোনো কম্পন-তরঙ্গের আঘাত না লাগে।
–কিছু বুঝতে পারছ? দেখ, ভাল করে দেখ!
জীবন এবার কোনো ইঙ্গিত জানালেন না। তিনি ধ্যানযোগকে গভীর এবং গাঢ় করে তুলতে চেষ্টা করলেন। জ্ঞান ও বুদ্ধির প্রদীপের শিখাকে উজ্জ্বলতর করে তুলে ধরে রোগের অন্তরাত্মাকে প্রত্যক্ষ করতে হবে।
কতক্ষণ অনুভব করেছিলেন নাড়ি তার নিজের ঠিক হিসাব ছিল না।
অনুভব করলেন নাড়ি যত ক্ষীণই হয়ে থাক এ নাড়ি অসাধ্য নয়। উচ্চ স্থান থেকে পড়ে গেলে বা ভগ্ন অস্থি সংযোজনকালে, অতিসারে, অজীর্ণ রোগে, বাতরোগে এমন হয়। কিন্তু অসাধ্য নয়। এখানে দুটি কারণ একসঙ্গে জুটেছে। অকস্মাৎ একটা নদীর বন্যার সঙ্গে আর একটা নদীর জল মিশে দেহখানাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। অজীর্ণ রোগে জীৰ্ণদেহে পড়ে যাওয়ার আঘাতের ফলে এমন হয়েছে। আঘাতটা শুধু হেতু হয়েছে, এখন প্রয়োজন কুপিত বায়ুর প্রভাবে শরীরের স্নায়ু-শিরাগুলির সংকোচন দূর করা।
–কী দেখলে? রঙলাল ডাক্তার প্রশ্ন করলেন এবং ব্যগ্রতার সঙ্গেই করলেন।
–আজ্ঞে? সবিনয়েই জীবন বলেছিলেন নাড়ি দেখে তো একেবারে অসাধ্য মনে হচ্ছে না। তিনি নিজের নির্ণয়ের কথা বলে বলেছিলেন ধনুষ্টঙ্কার নয়।
রঙলাল ডাক্তার ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলেছিলেন-হাঁ, টিটেনাস তো নয়ই এবং তুমি যা বলছ তাই খুব সম্ভব ঠিক। তুমি বলছ অসাধ্য নয়। জীবনের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন কিন্তু সাধ্য হবে কী করে? চোয়াল পড়ে গেছে—ওষুধ যাবে না। শরীরের কোথাও হাত দেবার উপায় নেই, মালিশ করা যাবে না। সাধ্য হবে কিসে?
ঘাড় নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে এলেন রঙলাল ডাক্তার।
বাইরে একান্তে জীবন বলেছিল—আপনি ওষুধ দিন, চামচ বা ঝিনুকে করে ফোঁটা ফোঁটা। করে মুখে দেওয়া হোক। আর—আপনি অনুমতি করলে আমি একটা মুষ্টিযোগের ব্যবস্থা করি। তাতে ওই বায়ুপ্রকোপের প্রভাব ধীরে ধীরে কমে আসবে। স্নায়ু শিরার টানভাবটা কমে আসবে। চোয়ালও খুলবে বোধহয়।
—মুষ্টিযোগ?
—আমাদের বংশের সংগ্রহ করা মুষ্টিযোগ। আমার পিতামহ পেয়েছিলেন এক সন্ন্যাসী চিকিৎসকের কাছে। তালগাছের কচি মাজপাতা, যা এখনও বাইরের আলোবাতাস পায় নি, তাই গরম জলে সিদ্ধ করে সেই জলের ভাপ–
দিতে পার, দেখতে পার। আমার কাছে ও মরার শামিল। রোগীর আত্মীয়দের বলেছিলেন–ওষুধ দিয়ে যাচ্ছি। জীবন রইল। আশা আমি করছি না। জীবন আশা ছাড়ে নি; ও দেখুক। এ অবস্থা যদি কাটে, চোয়ালটা ছাড়ে—আমাকে খবর দিয়ে। জীবন একটা মুষ্টিযোগ দেবে। ঠিকমত সব হয় যেন। বুঝলে?
সমস্ত রাত্রি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন জীবন ডাক্তার।
গরম জলের ভাপ দেওয়ার তত্ত্বাবধান করলেন। রাত্রি বারটার পর অসহনীয় যন্ত্রণা কমল। জীবন নাড়ি দেখলেন। মুখ প্রফুল্ল হল। প্রশ্ন করলেন এবার একটু দেখুন তো গায়ে সেক নিতে পারেন কি না?
নিজেই জল-নিঙড়ানো গরম কাপড়ের টুকরোটা সন্তৰ্পণে রোগিণীর হাতের উপর রাখলেন। লক্ষ্য করলেন–দেহে কম্পন ওঠে কি না। উঠল না। প্রশ্ন করলেন—পারবেন সহ্য করতে? কষ্ট হবে জানি, কিন্তু সহ্য করতে হবে।
অসাধারণ রোগিণী। মূর্তিমতী ধরিত্রীর মত সহনশক্তি। সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন তিনি। উৎসাহিত হলেন জীবন। নিজেই বসলেন সেঁক দিতে। ওষুধ চলছিল ফোঁটা ফোটা। ঘণ্টাখানেক পরে রোগিণীর অবস্থা লক্ষ্য করে বললেন–একটু বেশি বেশি দিয়ে দেখুন তো! মুখে ফোঁটা ফোটা ওষুধ দিচ্ছিলেন আর একটি মহিলা। নীরবে চলছিল জীবন-মৃত্যুর যুদ্ধ।
ক্রমে রাত্রি তৃতীয় প্রহর শেষ হল। জীবন ডাক্তার এবার লক্ষ্য করলেন প্রচণ্ড শক্তিতে গুণ দিয়ে বাঁকানো ধনুকের দণ্ডের মত দেহখানি ধীরে ধীরে সোজা হচ্ছে, সন্তৰ্পণে সভয়ে রোগিণী সোজা হতে চাচ্ছেন, যেন ধীরে ধীরে গুণ শিথিল করে দিচ্ছে কেউ।
জীবন মৃদুস্বরে বলল—দেখুন তো মা, হাঁ করতে পারেন কি না?
পারলেন, স্বল্প হলেও তার মধ্যে জিহ্বা সঞ্চালিত করবার স্থান পেলেন, চাপা উচ্চারণে। বললেন–পারছি।
এবার পূর্ণ এক দাগ ওষুধ খাইয়ে সেঁকের ভার রোগিণীর ছেলের উপর দিয়ে বললেন– বাইরের বারান্দায় আমার বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিন। একটু বিশ্রাম করব। আমার বিশ্বাস সূর্য উদয় হলেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন উনি আর ভয় নাই।
প্রায় নিশ্চিন্ত হয়েই বললেন– জীবন দত্ত। বায়ুর কাল চলে গিয়েছে; এবার কাল হয়েছে। অনুকূল। ঝড় থেমেছে; অনুকূল মৃদু বাতাসে নৌকার মতই জীবনতরী এবার পৃথিবীর কূলে এসে। ভিড়বে।
তাই হয়েছিল। সেদিনের আনন্দ তাঁর জীবনের শ্ৰেষ্ঠ আনন্দ।
গুরু রঙলাল ডাক্তারকে বিস্মিত করতে পেরেছিলেন তিনি।
বেলা তখন আটটা। রঙলাল ডাক্তার রোগী দেখছিলেন। এ সময় তিনি ফিজ নিতেন না। রোগী দেখতে দেখতেই তিনি উৎসুক দৃষ্টিতে জীবনের দিকে তাকালেন।
কান থেকে স্টেথোসকোপটা খুলে প্রশ্ন করলেন, বাঁচাতে পেরেছ?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। বিপদটা আপাতত কেটে গিয়েছে।
–বাঃ! আজ এইখানে থাক। বিশ্রাম কর। দুপুরবেলা নিজে রোগিণীকে দেখে এসে খুশি হয়ে বলেছিলেন, এর ক্রেডিট বার আনা তোমার জীবন। আমার ওষুধে কিছু ছিল না। যা ছিল তার পাওনা সিকির বেশি নয়। মেয়েটির এখন কলিকের চিকিৎসার প্রয়োজন। আমি বলেছি কবরেজি মতে চিকিৎসা করাতে। তুমি ব্যবস্থা কর।
সেইদিন রঙলাল ডাক্তার রাত্রে ব্রান্ডির রঙিন আমেজের মধ্যে মৃদু হেসে ওই কথাটা বলেছিলেন। বলেছিলেন, আক্ষেপ হচ্ছে হে জীবন—একটা বিয়ে করি নি কেন? তারপর হো-হো করে হেসে উঠেছিলেন।
হাসি থামিয়ে আবার বলেছিলেন–কেন বললাম জান? স্নে
স্নেহে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন জীবন। অভিভূত ভাবেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন-আজ্ঞে?
—তুমি আমাকে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের সঙ্গে তুলনা কর সেটা আমি শুনেছি। আমি তাতে রাগ করি না। শুক্রাচার্য বিরাট পুরুষ। হোক এক চোখ কানা। হাসতে লাগলেন আবার। তারপর বললেন– আজ আমার ইচ্ছে হচ্ছে তোমাকে কচের সঙ্গে তুলনা করতে।
হা-হা করে হাসতে লাগলেন—বিয়ে করলে একটা দেবযানী পেতাম হে।