১৪. আহাদ আলী রাজাকার

১৪. আহাদ আলী রাজাকার

কোনোরকম অনুষ্ঠান ছাড়াই একদিন স্কুলের পুরানো সাইনবোর্ড নামিয়ে নতুন একটা সাইনবোর্ড লাগানো হলো, সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লেখা ‘শহীদ রায়হান উচ্চ বিদ্যালয়’। রায়হান পাশের গ্রামের ছেলে, একাত্তরে কলেজে পড়ত, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হতেই সে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। ট্রেনিং নিয়ে আর এখানেই ফিরে এসেছে, এখানে মিলিটারির সাথে সামনাসামনি যুদ্ধ করে মারা গেছে, তখন তার বয়স বিশ বছরও হয়নি। হেডমাস্টার অনেক খোঁজাখুঁজি করে রায়হানের একটা ছবি জোগাড় করেছেন, দেখে মনে হয় বাচ্চা একটা ছেলে, মুখ টিপে হাসছে! ছবিটা বড় করানোর কারণে সেটা বেশ ঝাঁপসা হয়ে গেছে, সেই ছবিটাই বাঁধাই করে হেডমাস্টারের অফিসে রাখা হয়েছে।

প্রতিদিন যখন স্কুলে আসে তখন অনেক দূর থেকে রাশার মুখে হাসি ফুটে ওঠে, রাজাকার আহাদ আলীর নামটা তাকে আর কোনোদিন বলতে হবে না, এটা চিন্তা করেই রাশার মনটা ভরে ওঠে। তার সবচেয়ে বেশি জানতে ইচ্ছে করে আহাদ আলী রাজাকারটা এখন কী করছে। লোকজনের কাছে কানাঘুষা শুনেছে যে সে নাকি মামলা করবে, করলে করুক। রাশার কোনো মাথা ব্যথা নেই।

কয়েকদিন পর তারা যখন সবাই নৌকা করে ফিরে আসছে তখন মতি বলল, “রাশা আপু। তোমার মনে হয় একটু সাবধান থাকা দরকার।”

রাশা অবাক হয়ে বলল, “আমার সাবধান থাকা দরকার? কেন?”

“আহাদ আলী রাজাকার খুবই ডেঞ্জারাস। তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারে।”

“আমার কী ক্ষতি করবে?”

“সেইটা জানি না। কিন্তু তোমার সাবধান থাকা দরকার।”

মতি কম কথা বলে, কাজেই সে যদি রাশাকে সাবধান থাকতে বলে তাহলে সেটা খুবই গুরুতর কথা। রাশা জিজ্ঞেস করল, “কোনো কিছু কি হয়েছে?”

“বলতে পারো হয়েছে।”

“কী হয়েছে?”

“সেইদিন আমরা স্কুলে যাচ্ছি তখন একটা মানুষ আমাকে ডেকে নিল, ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, এইখানে রাশা কোন মেয়েটা।”

“তুই কী বললি?”

“আমি বলেছি আমি চিনি না।”

জয়নব বলল, “বেশ করেছিস। কোনো কথা বলার দরকার নাই।”

“আমি তো বলি না, কিন্তু কেউ না কেউ তো বলে দিবে।”

“তা ঠিক।”

মতি বলল, “রাশা আপু, তুমি কখনো একা বের হবে না।”

রাশা বলল, “আমি একা আর কোথায় যাই। সবসময়েই তো একসাথেই থাকি।”

জয়নব বলল, “হ্যাঁ এখন থেকে আরো বেশি একসাথে থাকতে হবে।”

নৌকা চালিয়ে ওরা নদী থেকে বিলে ঢুকল, মোটামুটি নির্জন বিল, অনেক দূরে দূরে একটা-দুইটা জেলে নৌকা মাছ ধরছে। এ ছাড়া কোথাও কোনো জনমানুষ নেই। রাশার দেখে বিশ্বাসই হয় না যে শীতকালে প্রায় পুরো বিলটাই শুকিয়ে যাবে, এখন যেখানে পানি, তখন সেখানে হবে ধানক্ষেত।

.

রাশা কয়েকদিন পর লক্ষ করল তারা সবাই যখন স্কুল থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটে নৌকা ঘাটে যাচ্ছে তখন একজন মানুষ তাদের পিছনে পিছনে হাঁটতে লাগল। তারা যখন নৌকায় উঠে রওনা দিয়েছে তখন তার সাথে আরো দুজন লোক এসে যোগ দিল, তারপর তারা তিনজন তাদের নৌকার দিকে তাকিয়ে রইল। লোকগুলোর কী উদ্দেশ্য কে জানে কিন্তু রাশার পুরো ব্যাপারটাকেই কেমন যেন রহস্যময় মনে হয়, কেমন যেন সন্দেহজনক মনে হয়। তার বুকের ভেতর কেমন যেন একধরনের দুশ্চিন্তা এসে ভর করে।

শুধু যে রাস্তায় তাদের পিছু পিছু অপরিচিত মানুষ হাঁটে তা নয়, স্কুলের ভেতরেও মাঝে মাঝে অপরিচিত মানুষ এসে ক্লাসের ভেতর উঁকি দিতে লাগল। মানুষগুলো কী করতে চায় কে জানে। রাশা কাউকে ঠিক করে বলতেও পারছিল না, কী করবে বুঝতে পারছিল না। একবার ভাবল হেডমাস্টারকে জানাবে, কিন্তু তাকে জানিয়ে কী লাভ? সালাম নানাকে জানিয়ে রাখলে হয়, কিন্তু রাশা তার পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত, সালাম নানার সাথে দেখা করারই সময় পাচ্ছিল না।

.

সেদিন সবাই দল বেঁধে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আসছে, রাশা চোখের কোনা দিয়ে লক্ষ করে দেখার চেষ্টা করল, কেউ তাদের পিছু নিয়েছে কিনা, কাউকে দেখল না। তখন সে গলা নামিয়ে বলল, “আমাদের সমস্যাটা কী জানিস?”

জয়নব জিজ্ঞেস করল, “কী?”

“আমরা প্রত্যেক দিন একইভাবে যাই আর আসি। তাই কেউ যদি আমাদের ধরতে চায় তাহলে সে জানে তাকে ঠিক কী করতে হবে। কোথায় আমাদের ধরতে হবে।”

“তাহলে আমাদের কী করতে হবে?”

“একেক দিন একেক দিক থেকে স্কুলে আসতে হবে। আবার একেক দিন একেক পথ দিয়ে স্কুল থেকে বাড়িতে যেতে হবে।”

মতি বলল, “তুমি চিন্তা করো না রাশা আপু। আমি সবসময় তোমার সাথে থাকব। কেউ তোমারে কিছু করতে পারবে না। আমার জান থাকতে কেউ তোমার গায়ে হাত দিতে পারবে না।”

রাশা হেসে বলল, “তুই কী করবি?”

“আমি জানে মেরে ফেলব?”

জিতু বলল, “রাশাপু আমিও থাকব তোমার সাথে। আমিও জানে মেরে ফেলব?”

রাশা হি হি করে হেসে বলল, “তোদের মতো দুইজন বডিগার্ড থাকলে আমার আর চিন্তা কিসের?”

কথা বলতে বলতে তারা নৌকাটায় উঠেছে। যে যার জায়গায় বসার পর মতি লগি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নৌকাটাকে নদীর পানিতে নিয়ে এসেছে। তারপর বৈঠা বেয়ে সাবধানে নদীটা পার হয়েছে। নদীর কিনারা ধরে এগিয়ে গিয়ে ছোট খালটা দিয়ে বিলে ঢুকেছে। বিলের পানি ধীরে ধীরে কমে আসছে, জায়গায় জায়গায় শুকনো মাটি বের হয়েছে, সেখানে সাদা ধবধবে কাশফুল। বাতাসে কাশফুলগুলো মাথা নাড়ছে দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।

অন্যান্য দিনের মতোই বিলটা নির্জন, শুধু অনেক দূরে একটা ট্রলার; তার ইঞ্জিনের শব্দ এত দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে। বিলের ভেতর এসে রাশা মতির কাছ থেকে বৈঠাটা নিয়ে পিছনে বসেছে। বৈঠাটাকে হালের মতো করে ধরেছে, মতি আর জিতু তখন মোটামুটি প্রতিযোগিতা করে বৈঠা বাইছে, নৌকাটা তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। বেশ খানিকদূর এগিয়ে যাবার পর তারা লক্ষ করল ট্রলারটা বিশাল বিল পাড়ি দিয়ে ঠিক তাদের দিকেই আসছে, এতক্ষণে সেটা অনেক কাছে চলে এসেছে। ট্রলারের

ইঞ্জিনের বিকট শব্দটা এখন রীতিমতো কানে লাগছে।

মতি বলল, “এই ট্রলারটা কই যায়?”

 “ জিতু বলল, “মনে হয় নদীতে।”

“আসছে কোথা থেকে?”

“কে জানে, কোথা থেকে আসছে।”

পুরো বিলে আর কোথাও কেউ নেই শুধু তাদের নৌকাটা আর এই ট্রলার, তাই তারা কৌতূহলী হয়ে ট্রলারটার দিকে তাকিয়ে রইল।

ট্রলারের ইঞ্জিনটা হঠাৎ আরো জোরে গর্জন করে উঠে, রাশা লক্ষ করল সেটা এখন সোজাসুজি তাদের দিকে ছুটে আসছে। রাশা চিন্তিত মুখে বলল, “ট্রলারটা আমাদের দিকে কেন আসছে?”

জয়নব বলল, “বুঝতে পারছি না।”

মতি হাতে একটা লগি তুলে নিয়ে বলল, “নিশানা ভালো মনে হচ্ছে না। মনে হয় খারাপ মতলব আছে।”

রাশার বুকটা ধক করে উঠল, ট্রলারটা কী করতে চাইছে? ঠিক এরকম সময় রাশা দেখল দুজন মানুষ ট্রলারের ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা অনেকবার মানুষগুলোকে দেখেছে, এই মানুষগুলো অনেক দিন থেকে তাদের পিছনে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়িয়েছে।

মতি বলল, “রাশা আপু, তুমি ভয় পেয়ো না। আমি আছি।”

রাশা মতির দিকে তাকাল, শুকনা কাঠির মতো কালো দড়ি পাকানো শরীর, দুজন জোয়ান মানুষের সাথে সে কী করবে? রাশা বলল, “নৌকাটাকে বিলের কিনারে নিয়ে যাই। ঐ কাশবনের কাছে শুকনায়।“

“ঠিক আছে।”

রাশা নৌকাটাকে ঘুরিয়ে নিল। মতি আর জিতু প্রাণপণে বৈঠা চালিয়ে নৌকাটাকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। তখন তারা আতঙ্কিত হয়ে দেখে ট্রলারটাও একটু ঘুরে সোজা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এখন আর তাদের মনে কোনো সন্দেহ নেই এই ট্রলারটা তাদেরকে ধরার জন্যেই এসেছে। দেখতে দেখতে সেটা তাদের ওপর ওঠে এলো। কী করবে বুঝে উঠার আগেই ট্রলারটা তাদের নৌকাকে একপাশ থেকে ধাক্কা দিল, সাথে সাথে নৌকায় যারা ছিল তারা বিলের পানিতে ছিটকে পড়ল! ট্রলারের বিকট গর্জন তার সাথে সবার চিৎকার মুহূর্তের মাঝে পুরো পরিবেশটা নারকীয় হয়ে ওঠে।

ট্রলারটা থামল না, নৌকাটাকে ধাক্কা দিয়ে সোজা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পিছনে নৌকায় যারা আছে তাদের কার কী হয়েছে জানার জন্যে কোনো কৌতূহল নেই। বিলের পানির ভেতর থেকে প্রথমে জয়নব, তারপর মতি ভেসে উঠল। জিতুও একটু পরে সাঁতার কেটে তাদের কাছে এলো। সাথে আরো দুজন ছিল তারাও পানি থেকে ভেসে উঠেছে, কিন্তু রাশা নেই। জয়নব আতঙ্কিত হয়ে ডাকল, “রাশা, রাশা!”

কেউ উত্তর দিল না। মতি তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল, “রাশা আপু! রাশা আপু!”

এবারেও কেউ উত্তর দিল না।

বিলের পানিতে ভেসে থাকতে থাকতে সবাই এদিক-সেদিক তাকায়, কোথাও রাশার চিহ্ন নেই।

জয়নব ভাঙা গলায় বলল, “কোথায় গেল রাশা? কোথায়?”

.

ঠিক সেই মুহূর্তে একটা মানুষ রাশাকে ট্রলারের পাটাতনে চেপে ধরে রেখেছে। তার হাতে গরু জবাই করার একটা ছুরি, ট্রলারের ইঞ্জিনের বিকট আওয়াজ ছাপিয়ে সে চিৎকার করে রাশাকে বলল, “এই মেয়ে, তুই যদি উল্টাপাল্টা কিছু করিস, এই ছুরি দিয়ে জবাই করে দেব।”

রাশা উল্টাপাল্টা কিছু করার চেষ্টা করল না, মানুষটার চেহারা, চোখের দৃষ্টি, কথা বলার ভঙ্গি সবকিছুই আশ্চর্য রকম নিষ্ঠুর। রাশা বুঝতে পারে সত্যি সত্যি একজন মানুষকে জবাই করা তার জন্যে বিন্দুমাত্র কঠিন ব্যাপার না।

মানুষটা বলল, “তোরে এখনই জবাই করে বিলের মাঝে পুঁতে ফেলা উচিত ছিল। হুজুর তোরে নিজের চোখে একবার দেখতে চাচ্ছেন তাই নিয়ে যাচ্ছি। খবরদার কোনো তেড়িবেড়ি করবি না।”

রাশার কাছে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে থাকে। হুজুর মানে নিশ্চয়ই রাজাকার আহাদ আলী। এই মানুষগুলো তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে অহাদ আলীর কাছে। ট্রলারটা দিয়ে যখন নৌকাটাকে ধাক্কা দিয়েছে তখন অন্য সবার সাথে সেও পানিতে ছিটকে পড়েছে, সাঁতার দিয়ে পানিতে ভেসে উঠার আগেই সে টের পেল লোহার মতো শক্ত দুটো হাত তাকে ধরে ফেলেছে, রাশা চিৎকার করার চেষ্টা করল, কিন্তু ইঞ্জিনের বিকট আওয়াজে সেটা চাপা পড়ে গেল। কিছু বোঝার আগে তাকে হ্যাঁচকা টানে তুলে ট্রলারের পাটাতনে চেপে ধরেছে। কয়েক সেকেন্ডের মাঝে সবকিছু ঘটে গেছে, রাশা কিছু বুঝে ওঠারও সময় পেল না।

রাশাকে এত জোরে পাটাতনে চেপে ধরে রেখেছে যে রাশার মনে হলো তার শরীরের হাড়গোড় ভেঙে যাবে, তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু এই মুহূর্তে রাশা সেগুলো ভালো করে বুঝতেও পারছিল না যে ভয়ঙ্কর একটা বিপদের মাঝে পড়েছে, সেটা তার সমস্ত চিস্তা করার ক্ষমতাকে শেষ করে দিয়েছে। তার মনে হচ্ছে সে একটা ঘোরের মাঝে আছে, মনে হচ্ছে চারপাশে যা ঘটছে তার সবকিছু বুঝি একটা দুঃস্বপ্ন। মনে হচ্ছে এক্ষুণি সে জেগে উঠবে তখন দেখবে এই সবকিছু আসলে মিথ্যা আসলে কিছুই হয়নি।

কিন্তু রাশা জানে এটা দুঃস্বপ্ন না। রাশা জানে যা ঘটছে তার সবকিছু সত্যি। রাশা জানে এখান থেকে বেঁচে ফিরে আসাটা হবে একটা অলৌকিক ঘটনা।

.

এভাবে কতক্ষণ কেটেছে ঠিক জানে না, হঠাৎ একসময় রাশা শুনতে পেল ট্রলারের ইঞ্জিনটার শব্দ কমে এলো। তাকে যেখানে আনার কথা মনে হয় তাকে সেখানে নিয়ে এসেছে। ট্রলারটার গতিও কমতে কমতে একসময় পুরোপুরি থেমে গেল। রাশা শুনতে পেল, যে মানুষটা তাকে চেপে ধরে রেখেছে সে কাউকে বলছে, “পাড়ে লাগাস না। এখানেই থামা।”

“এখানেই থামাব?”

“হ্যাঁ, পাড়ে লাগালেই কেউ না কেউ দেখে ফেলবে, আর একটা ঝামেলা হবে।”

“ঠিক আছে, একটা লগি মেরে ট্রলারটা রাখি।”

রাশা টের পেল ট্রলারটাকে নদীর মাঝখানে কোথাও থামিয়ে লগি দিয়ে আটকে ফেলা হলো।

অন্য মানুষটা জিজ্ঞেস করল, “হুজুর কখন আসবেন?”

যে মানুষটা রাশাকে চেপে ধরে রেখেছে সে বলল, “হুজুর আসবেন না। অন্ধকার হলে আমরা নিয়ে যাব।”

“এতক্ষণ এই ছেমড়িকে কী করব?”

“বেন্ধে রেখে দেব। এর তড়পানি বড় বেশি, কখন কী করে তার ঠিক নাই।”

লোকটা রাশার চুলের খুঁটি ধরে টেনে তুলল। গরু জবাই করার চাকুটা তার নাকের সামনে দিয়ে একবার ঘুরিয়ে এনে বলল, “একটু তেড়িবেড়ি করবি তো জবাই করে ফেলব। বুঝেছিস?”

রাশা কোনো কথা বলল না। মানুষটা তখন কোথা থেকে একটা ময়লা গামছা এনে তার মুখটা বেঁধে ফেলল, যেন সে চিৎকার করতে না পারে। তারপর আরেকটা গামছা দিয়ে হাতটা পিছনে নিয়ে ট্রলারের বেঞ্চের পায়ার সাথে শক্ত করে বেঁধে ফেলল। বাঁধনটা পরীক্ষা করে মুখে সন্তুষ্টির একটা শব্দ করে বলল, “এখন ঠিক হয়েছে। চুপ করে বসে থাক।”

রাশার কিছু করার ছিল না, তাকে চুপ করে বসেই থাকতে হলো। ভয়ঙ্কর একধরনের আতঙ্কে তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে, সে কী করবে বুঝতে পারছে না। চোখ বন্ধ করে সে মনে মনে বলল, “হে খোদা! বাঁচাও তুমি। আমাকে বাঁচাও। তুমি ছাড়া আর কেউ আমাকে এখন বাঁচাতে পারবে না। কেউ না।”

.

ঠিক এই সময় জয়নব, মতি, জিতু আর অন্যেরা সালাম নানার কাছে গিয়ে হাজির হয়েছে। জয়নব হাউমাউ করে কাঁদছে, গুছিয়ে কথাও বলতে পারছে না। মতি আর জিতুও একসাথে কথা বলতে চাইছে–সালাম নানা কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। একটু অধৈর্য হয়ে বললেন, “তোমাদের ভেতর যে কোনো একজন কথা বলো। যে কোনো একজন।”

তখন মতি বলল, “রাশা আপুকে ধরে নিয়ে গেছে!”

সালাম নানা চমকে উঠলেন, “কে ধরে নিয়ে গেছে?”

“একটা ট্রলার এসে আমাদের নৌকাটাকে ধাক্কা দিয়েছে, আমরা সবাই তখন পানিতে পড়ে গেছি। পানি থেকে উঠে দেখি রাশা আপু নাই।”

“হয়তো রাশা ব্যথা পেয়েছে, ডুবে গেছে।”

জিতু বলল, “ডুবে নাই। আমরা পুরো জায়গাটা খুঁজে দেখেছি, রাশা আপু নাই। তার ব্যাগটাও পেয়েছি।”

মতি বলল, “ট্রলারের মাঝে যে দুইটা লোক ছিল তারা সবসময় আমাদের পিছে পিছে হাঁটত। রাশা আপু কোনজন আমাদের সেটা জিজ্ঞেস করত।”

সালাম নানা আতঙ্কিত গলায় বললেন, “সর্বনাশ!”

জয়নব হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “এখন কী হবে? রাশার এখন কী হবে?”

সালাম নানা ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “পুলিশকে খবর দিতে হবে। ট্রলারটাকে খুঁজে বের করতে হবে। কোনদিকে গিয়েছে?”

“উত্তর দিকে। মনে হয় মাতাখালি নদীর দিকে।”

“মাতাখালি! সর্বনাশ!”

জয়নব কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করল, “কেন? সর্বনাশ কেন?”

সালাম নানা বললেন, “মাতাখালি নদীর পাড়েই তো আহাদ আলী রাজাকারের বাড়ি।

.

রাশা বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে দেখল, হাতটাকে ছুটিয়ে আনা যায় কিনা–পারল না। এত শক্ত করে বেঁধেছে যে কোনোভাবেই সেটা দিলে করা সম্ভব হলো না। তার মনে হতে লাগল বুঝি হাতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। হাতটাকে একটু পরপর নেড়ে সে রক্ত চলাচল চালু রাখছে। মুখের মাঝে ময়লা গামছাটা দিয়ে বেঁধেছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে বাতাসের অভাবে বুঝি বুকটা ফেটে যাবে। যা তৃষ্ণা পেয়েছে সেটা বলার মতো নয় মনে হচ্ছে এক ফোঁটা পানির জন্যে সে তার জীবনটা দিয়ে দিতে পারবে।

ট্রলারের ছাদে মানুষ দুজন বসে আছে, মাঝে মাঝে নিচে এসে দেখে যাচ্ছে সবকিছু ঠিক আছে কিনা। তাদের টুকরো টুকরো কথাবার্তা রাশা নিচে বসে শুনতে পাচ্ছে। হঠাৎ শুনল একজন উত্তেজিত গলায় বলল, “আরে! আরে! হুজুর নিজেই দেখি চলে আসছেন!”

অন্যজন বলল, “অন্ধকার হওয়ার পর ছেমড়িটাকে হুজুরের কাছে নেওয়ার কথা ছিল না?”

“তাই তো কথা ছিল। দেখি ব্যাপারটা কী?”

রাশা একটু পরে শুনতে পেল একটা নৌকা এসে ট্রলারের গায়ে লাগল, তারপর নৌকা থেকে একজন ট্রলারে উঠল। একজন বলল, “হুজুর, আপনি নিজেই চলে এসেছেন? অন্ধকার হলে আমরাই তো ছেমড়িটাকে নিয়ে যেতাম।”

রাশা শুনতে পেল মোটা একজন বলল, “নাহ, মনে হয় দেরি করা ঠিক হবে না। খবর পেয়েছি এই ছেমড়ির পরিচিত লোকজন সন্দেহ করছে তাকে এইখানে আনা হয়েছে। পুলিশ-টুলিশ এসে যদি ছেমড়িকে এখানে পেয়ে যায় ঝামেলা হবে!”

“পুলিশে আমাদের লোক আছে না হুজুর?”

“আছে বলেই তো খবরটা পেয়েছি। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে ফেলতে হবে।”

“ঠিক আছে।”

“কই? ছেমড়ি কই?”

“এই যে হুজুর এদিকে। ট্রলারের বেঞ্চে বেঁধে রেখেছি।” রাশা দেখল একজন বুড়ো মানুষ ট্রলারের ভেতরে ঢুকেছে। তার লম্বা পাকা দাড়ি, মাথায় গোল টুপি। একটা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরে আছে। এই বুড়ো মানুষটা নিশ্চয়ই আহাদ আলী রাজাকার। রাশা মানুষটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

দাড়িওয়ালা মানুষটা এগিয়ে এসে রাশার দিকে ঝুঁকে তাকাল, বলল, “এইটাই সেই ছেমড়ি?”

“জি হুজুর।”

“মুখের গামছাটা খোল দেখি, চেহারাটা দেখি।”

একজন এসে মুখের বাঁধন খুলে দিল, রাশা অনেকক্ষণ পর বুক ভরে নিশ্বাস নিল, তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। সে একবার ঢোক গিলে বলল, “আমি একটু পানি খাব।”

আহাদ আলী বলল, “কী বললি?”

“আমি বলেছি, আমি একটু পানি খাব।”

আহাদ আলী হঠাৎ দুলে দুলে হাসতে শুরু করে। লোক দুজন একটু অবাক হয়ে আহাদ আলীর দিকে তাকায়, সে ঠিক কী জন্য হাসছে তারা বুঝতে পারছে না। আহাদ আলী বলল, “এর নানাও আমারে বলেছিল, আমি একটু পানি খাব। এতদিন পর তার নাতনিও আমাকে বলে, আমি একটু পানি খাব।”

রাশা মানুষটার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “আপনি আমার নানাকে মেরেছেন?”

ঘরের ভেতরে হঠাৎ সবাই চুপ করে গেল। রাশা আবার জিজ্ঞেস করল, “মেরেছেন?”

আহাদ আলীর মুখটা হঠাৎ কেমন জানি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে, সে হিংস্র গলায় বলে, “হ্যাঁ মেরেছি। মেরে ঐ মাদার গাছের তলায় পুঁতেছি। তো কী হয়েছে? তুই কী করবি?”

রাশার বুকটা হঠাৎ ধক করে উঠে। এই মানুষটা তার সামনে অবলীলায় স্বীকার করল যে সে নানাকে মেরেছে–এই কথাটা তাকে জানাতে মানুষটা আর ভয় পাচ্ছে না। তার একটাই অর্থ, মানুষগুলো আসলে এখন তাকেও মেরে ফেলবে। কাজেই এখন তাকে যা ইচ্ছে তাই বলা যায়। এই কথাগুলো বাইরে কোথাও প্রকাশ হবে না। রাশা হঠাৎ ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল। সে জিব দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “আমি একটু পানি খাব।”

আহাদ আলীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা মুখ খিঁচিয়ে বলল, “তোরে পানি খাওয়ানোর জন্যেই আনছি! এই যে গাঙ দেখছিস, একটু পরে তুই এই পানি খাবি। মুখ দিয়ে খাবি, নাক দিয়ে খাবি! পানি খেয়ে তুই গাঙের নিচে শুয়ে থাকবি।”

অন্য লোকটা বলল, “তোর নানা ছিল ইন্ডিয়ার দালাল! গাদ্দার। তার সাথে তোর দেখা হবে। তুই আর তোর নানা জয়বাংলা জয়বাংলা করে লেফট-রাইট করবি। বুঝেছিস?”

রাশা বলল, “আমি একটু পানি খাব।”

লোকটা মুখ খিঁচিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আহাদ আলী বলল, “দে! একটু পানি দে। শেষ সময়ে একটু শখ করেছে, খেতে দে।”

“হুজুর, গাঙে এত পানি আছে, খেয়ে শেষ করতে পারবে না।”

“থাক থাক। নৌকায় বোতলে পানি আছে, পানি খেতে দে।”

লোকটা একটু বিরক্ত হয়েই নৌকা থেকে পানির বোতলটা আনতে গেল। একটু পর লোকটা একটা প্লাস্টিকের বোতল নিয়ে এলো, তার নিচে অল্প একটু পানি। সে পানির বোতলটী খুবই তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে রাশার দিকে ছুঁড়ে দেয়। রাশা বলল, “আমার হাতটা খুলে দিতে হবে।”

মানুষটা একেবারে মারের ভঙ্গিতে এগিয়ে গিয়ে বলল, “আর কী কী করতে হবে?”

রাশা বলল, “আমার হাত খুলে না দিলে পানি খাব কেমন করে?”

আহাদ আলী বলল, “খুলে দে হাত।”

“যদি অন্য কিছু করে?”

“তোরা দুইজন দামড়া জোয়ান এইখানে আছিস এই পুঁচকে মেয়ে করবেটা কী?”

“এরে বিশ্বাস নাই। এর মতো ত্যাঁদড় মেয়ের কথা আমি আমার বাপের জন্মে শুনি নাই?”

“ত্যাঁদড়ামি এক্ষুণি শেষ হবে! খুলে দে।”

মানুষটা একটু বিরক্ত হয়ে রাশার হাতের বাঁধন খুলে দিল। রাশা তার হাত দুটো সামনে এনে তাকায়, একেবারে নীল হয়ে গেছে। সে আঙুলগুলো খুলল, তারপর বন্ধ করল। হাতের মাঝে রক্ত চলাচল শুরু হয়েছে, আঙুলগুলোতে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠছে। রাশা এবারে নিচে থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই মানুষ দুজন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, “কী করিস? কী করিস তুই?”

রাশা বলল, “আমি একটু বেঞ্চের ওপর ঠিক করে বসব।”

একজন ভেংচে উঠে বলল, “ওরে আমার শাহজাদি! তার বেঞ্চের ওপর বসতে হবে। নিচে থেকে উঠবি না খবরদার।”

রাশা আর ওঠার চেষ্টা করল না। পাটাতনে বসে পানির বোতলটা হাতে নিয়ে তার ছিপি খুলে সে মুখে বোতলটা লাগিয়ে ঢকঢক করে পানিটা খেল। তার মনে হলো তার বুকটা যেন একটা জ্বলন্ত চুলোর মতো হয়ে। আছে, পুরো পানিটা সেটা যেন মুহূর্তে শুষে নিল। পানির শেষ বিন্দুটা খেয়ে সে খালি বোতলটা নিচে নামিয়ে রাখে আর ঠিক তখন তার মাথায় বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা চিন্তা খেলে যায়। এদের হাত থেকে ছাড়া পাবার একটা সুযোগ এসেছে অত্যন্ত কঠিন কিন্তু তবু একটা সুযোগ। হাতে ধরে রাখা এই এক লিটারের খালি প্লাস্টিকের বোতলটাই হচ্ছে সেই সুযোগ। তার শেষ সুযোগ। তার জীবন বাঁচানোর সুযোগ। রাশা তার বুক থেকে একটা নিশ্বাস খুব সাবধানে বের করে দিল।

রাশা মুহূর্তের মাঝে পরিকল্পনাটা ঠিক করে ফেলে। প্লাস্টিকের বোতলটার তলাটা আলাদা করতে হবে। কাজটা কঠিন কিন্তু অসম্ভব না। মানুষগুলোর মনে কোনো সন্দেহ না জাগিয়ে কাজটা করতে হবে। রাশা বোতলটা হাতে ধরে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে নাড়তে থাকে। একজন মানুষ নার্ভাস হলে যেরকম করে অনেকটা সেরকম। মানুষগুলোকে ব্যস্ত রাখার জন্য কোনো একটা বিষয় নিয়ে কথা বলারও দরকার। রাশা কী বলবে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “আপনারা আমাকে কেন ধরে এনেছেন?”

আহাদ আলী বেঞ্চের এক মাথায় বসে বলল, “সেইটা তুই এখনো বুঝিসনি? আমি তোরে টেলিভিশনে কথা বলতে দেখেছি, তুই কী বলেছিস আমি শুনেছি!” আহাদ আলী হিংস্র গলায় বলল, “আমার নাম উচ্চারণ করতে তোর ঘেন্না লাগে? আমি তোকে দেখাব ঘেন্না কেমন করে লাগতে হয়। শুধু তুই না তোর চৌদ্দ গুষ্টি দেখবে কেমন করে ঘেন্না করতে হয়।” আহাদ আলী হঠাৎ জঘন্য ভাষায় গালাগাল করতে থাকে। একজন বয়স্ক মানুষের মুখ থেকে যে এরকম অশ্লীল শব্দ বের হতে পারে নিজের কানে না শুনলে সে বিশ্বাস করতে পারত না।

রাশা ভয় পাবার ভঙ্গি করে। পা দুটো গুটিয়ে আনে, দাঁত দিয়ে নখ কাটে তারপর প্লাস্টিকের বোতলের নিচের অংশটা টিপে ভঁজ করে সেটা নাড়াচাড়া করতে থাকে, নার্ভাস ভঙ্গিতে দাঁত দিয়ে কামড়ানোর চেষ্টা করে এবং শেষ পর্যন্ত প্লাস্টিকের একটা অংশ দাঁত দিয়ে কেটে ফেলে। রাশার বুকের ভেতর থেকে স্বস্তির নিশ্বাস বের হয়ে আসে। সে বেঁচে থাকতে পারবে কি পারবে না সেটা নির্ভর করছে এই প্লাস্টিকের বোতলটার ওপর। এর তলাটা আলাদা করতে পারবে কি পারবে না তার ওপর। প্লাস্টিকের বোতলে যেখানে একটু কেটেছে সেখানে আঙুলটা ঢুকিয়ে টানতে থাকে। প্লাস্টিকের ধারালো কাটা অংশে তার আঙুল কেটে যেতে চায় কিন্তু সে থামল না–টেনে আলগা করতেই লাগল।

আহাদ আলী একসময় থামল, রাশা তখন আবার জিজ্ঞেস করল, “আমাকে এখন কী করবেন?”

আহাদ আলী উত্তর দেবার আগেই একজন হা হা করে হেসে উঠল, “ছেমড়ি? তুই এখনো বুঝিস নাই তোরে কী করব? তুই কী ভেবেছিস তোরে দুলহা বানিয়ে কারো সাথে শাদি দিব? না। তোরে পানিতে ডুবিয়ে মারব! বুঝেছিস?”

রাশা মাথা নেড়ে বোঝাল, সে বুঝেছে। হাত দিয়ে টেনে প্লাস্টিকের বেতিলের তলাটা সে প্রায় আলগা করে ফেলেছে, এখন সে তার শেষ অংশটুকুর জন্যে প্রস্তুত হয়েছে। মানুষ দুটো যখন একটু অসতর্ক থাকবে ঠিক তক্ষুণি তাকে লাফ দিয়ে উঠে একলাফে জানালা থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়তে হবে। একটা মাত্র সুযোগ পাবে সে। তার জীবনের শেষ সুযোগ। এই সুযোগটা যদি সে নিতে না পারে কেউ আর তাকে রক্ষা করতে পারবে না!

রাশা বিড়বিড় করে মনে মনে বলল, “হে খোদা! তুমি আমাকে রক্ষা করো খোদা। আমি তোমার কাছে আর কোনোদিন কিছু চাইব না! শুধু তুমি আমাকে একটা সাহায্য করো–শুধু একটুখানি।”

রাশা মানুষ দুটির দিকে তাকিয়েছিল, একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলছে, একটু অসতর্ক, রাশ ঠিক সেই মুহূর্তটাকে বেছে নিল। প্লাস্টিকের বোতলটা ধরে সে উঠে দাঁড়ায় তারপর বিড়ালের মতো লাফিয়ে জানালার ভেতর দিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মানুষগুলো ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়, এক মুহূর্ত লাগে তাদের বুঝতে কী হচ্ছে। শেষ মুহূর্তে দুজন ছুটে এসে তাকে ধরার চেষ্টা করল, তার পা প্রায় ধরেই ফেলেছিল কিন্তু হ্যাঁচকা টানে শেষ মুহূর্তে রাশা নিজেকে মুক্ত করে নেয়।

রাশা হাত-পা নেড়ে তীরের দিকে সাঁতরাতে থাকে–মাথা তুলে একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে সে ডুবসাঁতার দেয়ার জন্যে ডুবে গেল।

আহাদ আলী অশালীন একটা গালি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মানুষ দুজন একজন আরেকজনের দিকে তাকিয় বলল, “এই ছেমড়ি দেখি যন্ত্রণার একশেষ!”

আহাদ আলী বলল, “দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মেয়েটাকে ধর।”

মানুষটা বলল, “হুজুর আমার আর ধরা লাগবে না। এই পানিতে যাবে কোথায়? ভেসে উঠুক আমি ধরছি।”

অন্য মানুষটা বলল, “এই মেয়ে পানির মাঝে আমার থেকে জোরে সাঁতার দিবে? খালি মাথাটা বের করুক।”

রাশা যেদিকে সঁতরে গেছে সবাই সেদিকে তাকিয়ে থাকে, নিশ্বাস নেবার জন্যে তাকে মাথা বের করতে হবে তখনই তারা তাকে ধরার জন্যে অন্য দুজন পানিতে নামবে।

মানুষ দুজন শার্ট খুলে খালি গা হয়ে নিল। লুঙ্গিটাকে মালকোচা মেরে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে দুজনেই তৈরি। কোনদিকে যাবে সেটা ঠিক করার জন্যে তারা পানির দিকে তাকিয়ে আছে। নিশ্বাস নেবার জন্যে রাশা মাথা বের করা মাত্রই তারা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

রাশা নিশ্বাস নেবার জন্যে মাথা বের করল না। মানুষগুলো অবাক হয়ে দেখল এক মিনিট দুই মিনিট করে পাঁচ মিনিট পার হয়ে গেল কিন্তু রাশা পানি থেকে মাথা বের করল না। মানুষগুলো একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল, বলল, “কই গেছে মেয়েটা?”

আহাদ আলী বলল, “ডুবে গেছে নাকি?”

“ডোবার কথা না। যেই মানুষ সাঁতার জানে সে ডুবে না।”

আহাদ আলী খেঁকিয়ে উঠল, “তাহলে গেছে কই?”

“সেইটাই তো তাজ্জব। মানুষ আর যেটাই করুক নিশ্বাস না নিয়ে তো বেঁচে থাকতে পারে না। এই ছেমড়ির তো নিশ্বাস নেবার জন্য মাথা বের করতে হবে।”

তারা পানির দিকে ইতিউতি করে তাকায়, চারিদিকে পানি, কোথাও রাশা নেই। সে একবারও নিশ্বাস নেবার জন্যে মাথা বের করেনি। মেয়েটা ম্যাজিকের মতো অদৃশ্য হয়ে গেছে। হঠাৎ করে মানুষগুলো একধরনের অস্বস্তি বোধ করতে থাকে।

.

রাশা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রথমে সোজা তীরের দিকে এগিয়ে গেল, খানিকদূর এগিয়ে সে মাথা উঁচু করে বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আবার ডুব দেয়। এবারে সে ডানদিকে ঘুরে গেল, নদীর স্রোতটা যেদিকে। ডুব সাঁতার দিয়ে সরে যেতে থাকে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, যতদূর সম্ভব। যখন তার নিশ্বাস শেষ হয়ে আসে তখন প্লাস্টিকের বোতলটা মুখে লাগিয়ে চিৎ হয়ে একটু উপরে উঠে আসে। বোতলটার উপরের অংশটা পানির একটু উপর ওঠা মাত্রই সে পানিটুকু টেনে সরিয়ে খালি করে নেয়। বাতাসের জন্যে তার বুকটা তখন হাহাকার করছে কিন্তু তবুও সে তাড়াহুড়া করল না। পুরো বোতলটা খালি হবার পর সে বাতাস টেনে নেয়, বুক ভরে একবার নিশ্বাস নেয়। তারপর আবার সে ডুবে গেল, ভুবসাঁতার দিয়ে সে আবার সরে যেতে থাকে-যতদূর সম্ভব। যখন আবার তার নিশ্বাস শেষ হয়ে এলো আবার সে বুক ভরে নিশ্বাস নেয়। তারপর সে ডুবসাঁতার দিয়ে আবার সরে যেতে থাকে।

ট্রলারের উপর আহাদ আলী দুজনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, চারিদিকে তারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, কোথাও রাশার চিহ্ন নাই। আহাদ আলী মুখ খিঁচিয়ে বলল, “সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে কী দেখছিস? পানিতে নাম– খুঁজে বের কর মেয়েটাকে।”

“কিন্তু গেল কই?”

“আমাকে জিজ্ঞেস করবি না গেল কই? খুঁজে বের কর।”

মানুষ দুজন তখন পানিতে নামল, কেমন করে খুঁজবে বুঝতে পারছিল না, তবু ডুবে ডুবে এদিক-সেদিক গেল, বৃথাই খোঁজার চেষ্টা করল। ঘণ্টাখানেক খুঁজে যখন হাল ছেড়ে দিয়ে নদী থেকে উঠে এসেছে তখন আহাদ আলী লক্ষ করল দূরে পুলিশের একটা স্পিডবোট দেখা যাচ্ছে। সে একটা নিশ্বাস ফেলল, সবকিছু কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেছে। মেয়েটা বেঁচে থাকলে মহাসমস্যা। ডুবে যদি মরে গিয়ে থাকে, আর এক-দুই দিন পর যদি লাশ ভেসে ওঠে সেটাও সমস্যা। কথা ছিল মেয়েটাকে বিলের পানিতে ফেলে আসবে যেন কেউ সন্দেহ করতে না পারে।

স্পিডবোটে পুলিশের সাথে সালাম নানা ছিলেন, মতি আর জিতুও ছিল। স্পিডবোট থেকে নেমে পুলিশ যখন চারিদিকে খুঁজতে থাকে তখন মতি আর জিতু নদীর তীরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকতে থাকল, “রাশা আপু! রাশা আপু! তুমি কোথায়। কেউ তাদের ডাকের উত্তর দিল না। দুজন তখন নদীর তীর ধরে ছুটতে থাকে আর চিৎকার করে ডাকতে থাকে, “রাশা আপু! রা-শা-আ-পু!”

রাশা সারা শরীর পানিতে ডুবিয়ে কচুরিপানার মাঝে তার মাথাটা একটুখানি বের করে শুয়েছিল, মতি আর জিতুর গলার স্বর শুনে সে সোজা হয়ে বসল। গলার স্বরটা যখন আরো একটু স্পষ্ট হলো তখন সে পানি থেকে বের হয়ে এলো, তার সমস্ত শরীরে কাদা, পানিতে ডুবে থেকে তার চোখ লাল, মুখ রক্তশূন্য। মতি আর জিতু রাশাকে ডাকতে ডাকতে ছুটে যেতে যেতে হঠাৎ করে রাশাকে দেখতে পায়, তখন তারা চিৎকার করে নদীর তীরে নেমে এসে তাকে জাপটে ধরে ফেলল! মতি রাশাকে শক্ত করে ধরে বলল, “রাশা আপু! রাশা আপু তুমি বেঁচে আছ? তুমি বেঁচে আছ রাশা আপু?”

রাশা খকখক করে একবার কাশল, তারপর বলল, “হ্যাঁ মতি। খোদা আমাকে বঁচিয়ে দিয়েছে।”

“আর তোমাকে কেউ মারতে পারবে না!” মতি রাশাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কেউ পারবে না। কেউ পারবে না।” তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। মতি এর আগে কখনো কাঁদেনি কেমন করে কাঁদতে হয় সে জানে না।

.

আহাদ আলীর উঠানে একটা চেয়ারে আহাদ আলী কঠিন মুখে বসে আছে। তার সামনে একজন পুলিশ অফিসার, আহাদ আলী মিছিমিছি তাকে সন্দেহ করার জন্যে সেই পুলিশ অফিসারকে ধমকাধমকি করছিল। ঠিক এরকম সময় মতি আর জিতুর হাত ধরে রাশা সেখানে হাজির হলো। সারা শরীরে কাদা, তাকে ঠিক চেনা যাচ্ছে না, তারপরেও আহাদ আলী তাকে চিনতে পারল এবং ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। তার দুই পাশে তার দুজন সাগরেদ দাঁড়িয়ে ছিল। তারা হঠাৎ করে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না, পুলিশের লোকজন দৌড়ে তাদের ধরে ফেলল।

সালাম নানা ক্রাচে ভর দিয়ে রাশার কাছে ছুটে গেলেন, তাকে ধরে বললেন, “রাশা! তুমি ঠিক আছ?”

রাশা মাথা নেড়ে বলল, “না, নানা। নাকে-মুখে পানি ঢুকে গেছে।” সে খুকখুক করে কেশে বলল, “নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে মরে যাব।”

“না, তুমি মরবে না। তুমি এখন পর্যন্ত যখন বেঁচে আছ, আমরা তোমাকে মরতে দিব না?”

হঠাৎ করে রাশার মনে হলো তার পায়ে কোনো জোর নেই, সে পড়ে যাচ্ছিল, সালাম নানা তখন তাকে ধরে ফেললেন। রাশা ফিসফিস করে বলল, “যদি আমি মরে যাই, আপনাকে একটা জিনিস বলে রাখি!” রাশা আঙুল দিয়ে আহাদ আলীকে দেখিয়ে বলল, “এই যে রাজাকারটাকে দেখছেন–সে আমাকে বলেছে, সে আমার নানাকে মেরেছে! মেরে তার ডেডবডি একটা মাদার গাছের নিচে পুঁতে রেখেছে।”

রাশা আবার খকখক করে কাশল, তার কাশির সাথে ময়লা ঘোলা পানি বের হয়ে আসে। হঠাৎ করে তার মাথা ঘুরে আসে, সে সালাম নানার কোলে অচেতন হয়ে পড়ল।

সালাম নানা চিৎকার করে বললেন, “স্পিডবোট! কুইক। মেয়েটাকে এক্ষুণি হাসপাতালে নিতে হবে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *