১৪. আমিন সাহেব শোভেল নিয়ে বেরুলেন

সকালবেলা একটি পার্কা গায়ে দিয়ে আমিন সাহেব শোভেল নিয়ে বেরুলেন। বরফে ড্রাইভওয়ে ঢাকা পড়েছে। পরিষ্কার না করলে গাড়ি বের করা যাবে না। অসম্ভব ঠাণ্ডা পড়েছে। চোখ জ্বালা করছে। কনকনে হাওয়া। নাক-মুখ সমস্তই ঢাকা, তবু সেই হাওয়া কী করে যেন শরীরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। অল্পক্ষণ শোভেল চালাবার পর তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। বয়স হয়েছে। এখন আর আগের মতো পরিশ্রম করতে পারেন না। দিন ফুরিয়ে আসছে। ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। চলে যাবার সময় হয়ে এল। এবারের যাত্রা অনেক দূরে। গন্তব্যও জানা নেই। আমিন সাহেব ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। রুনকি থাকলে এতটা পরিশ্রম হত না। নিমেষের মধ্যে বরফ কেটে গাড়ি বের করে ফেলত। তারপর ছোটাছুটি শুরু করত বরফের উপর। তুষার বল বানিয়ে চেঁচাত—মারব তোমার গায়ে বাবা? দেখবে আমার হাতের টিপ? মেয়েটা একেবারে ছেলেমানুষ রয়ে গেল।

না, কথাটা ঠিক হল না। রুনকি এখন আর ছেলেমানুষ নয়। আমিন সাহেব বিশ্রাম নেবার জন্যে গ্যারাজের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। তখনই চোখে পড়ল, রাহেলা দোতলার বারান্দায় একটা সাদা চাদর গায়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠাণ্ডায় এমন পাতলা একটা চাদর গায়ে দিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে? নিউমোনিয়া বাধাবে নাকি? রাহেলা উপর থেকে ডাকলেন, চা খেয়ে যাও।

চা খেয়ে আমিন সাহেবের মনে হল তাঁর শরীর ভালো লাগছে না। নিঃশ্বাস নিতে একটু যেন কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না। রাহেলা বললেন, আজকের এই দিনটি একটি বিশেষ দিন। তোমার মনে আছে?

না।

আজ রুনকির জন্মদিন।

আমিন সাহেব বড়োই অবাক হলেন। এত বড়ো একটা ব্যাপার তিনি ভুলেই বসে আছেন। উফ, কী ঝামেলাই না হয়েছিল। বরফে চারদিক ঢাকা। বেশির ভাগ ফ্লাস্তিাঘাটই বন্ধ। এর মধ্যে রাহেলার ব্যথা শুরু হল! এ্যাম্বুলেন্সে খবর দিলেই হত, তা না, তিনি গাড়ি নিয়ে বের হলেন। ফিফটিস্থ স্ট্রীট থেকে উঠিয়ে নিলেন নিশানাথ বাবুকে। কী দুরবস্থা ভদ্রলোকের। ব্যাপার-ট্যাপার দেখে আনিস বলল সেই ঠাণ্ডাতেও তাঁর কপাল দিয়ে টপ-টপ করে ঘােম পড়ছে। রাহেলা এক বার বললেন, আমার মনে হচ্ছে গাড়িতেই কিছু একটা হয়ে যাবে। নিশানাথ বাবু বললেন, মা কালীর নাম নেন, চেঁচামেচি করবেন না। রাহেলা ধমকে উঠলেন, মা কালীর নাম নেব কেন, মা কালী আমার কে? এই সময় গাড়ি স্কিড করে খাদে পড়ে গেল। উহ, কী ভয়াবহ সময়ই না গিয়েছে!

আমিন সাহেব বললেন, আমাকে আরেক কাপ চা দাও।

তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? তুমি ঘামছ।

না, শরীর ঠিক আছে।

রাহেলা বললেন, আমি রুনকির জন্মদিন উপলক্ষে ছোট্ট একটা কেকের অর্ডার দিতে চাই।

আমিন সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন। রাহেলা চোখ নিচু করে বললেন, আমি, তুমি আর নিশানাথ বাবু!

বেশ তো।

রাহেলা মৃদু স্বরে বললেন, রুনকির প্রতি আমি অবিচার করেছি।

আমিন সাহেব জবাব দিলেন না। রাহেলা বললেন, নিজেদের মতো ওকে আমরা বড়ো করেছি। ক্যাম্পিং-এ যেতে দিই নি। ডেট করতে দিইনি।

বাদ দাও ওসব।

আমেরিকায় থাকব, অথচ বাংলাদেশী সাজাব–সেটা হয় নাকি বল?

আমিন সাহেব জবাব দিলেন না। রাহেলা বললেন, কাল রাত্রে আমি রুনকিকে স্বপ্নে দেখেছি। যেন ছোটখালার বাসায় ওকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছি। ছোটখালা বলছেন-রাহেলা তোর মেয়ে তো পরিষ্কার বাংলা বলছে। আর তুই বললি-ও বাংলা জানে না। ছোটখালাকে মনে আছে তোমার?

না।

আমাদের বিয়েতে তোমাকে মুক্তা বসান আংটি দিয়েছিলেন। সেই আংটি তোমার হাতে বড়ো হয়েছে শুনে ছোটখালা দুঃখে কেঁদে ফেলেছিলেন।

মনে পড়েছে। খুব মোটাসোটা মহিলা, তাই না?

হ্যাঁ। কী যে ভালোবাসতেন আমাকে! এখন তাঁর শুনেছি খুব দুঃসময়। ছেলেদের সংসারে থাকেন। ছেলেরা দু চক্ষে দেখতে পারে না। অসুখবিসুখে চিকিৎসা করায় না। আমি ছোটখালার নামে কিছু টাকা পাঠাতে চাই।

বেশ তো!

ভালো এ্যামাউন্টের টাকা। ছোটখালা নিশ্চয়ই খুব খুশি হবেন।

তা হবেন।

আমি পাঁচ শ ডলার পাঠাতে চাই।

আমিন সাহেব বললেন, আমি একটা ব্যাঙ্ক ড্রাফট করে আনব।

রাহেলার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল।

কাঁদছ কেন?

কই, কাঁদছি না তো। রাহেলা মৃদু স্বরে বলল, তোমাকে একটা কথা বলি নি। গত মাসে রুনকি এসেছিল।

আমিন সাহেব তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন। রাহেলা বলল, রুনকির বাচ্চা হবে।

ও বলেছে তোমাকে?

হ্যাঁ।

টম কি আছে এখনো তার সঙ্গে?

আছে।

রুনকি কী জন্যে এসেছিল?

ওর বাচ্চার জন্যে দুটি নাম চায়। একটি ছেলের নাম, অন্যটি মেয়ের।

আমিন সাহেব দীর্ঘ সময় চুপ থেকে বললেন, মেয়ে হলে ওর নাম রাখব বিপাশা।

বিপাশা?

হ্যাঁ, পাঞ্জাবের একটা নদীর নাম। পাঞ্জাবে ওরা বলে বিয়াস।

তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে, তুমি খুব ঘামছ।

আমিন সাহেব ক্লান্ত স্বরে বললেন, আমার শরীরটা খারাপ লাগছে।

গাড়ি বের করার দরকার নেই। তুমি শুয়ে থাক। আর নিশানাথ বাবুকে টেলিফোন করে দাও, সন্ধ্যাবেলা যেন আসেন আমাদের এখানে, খাবেন।

আমিন সাহেব নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। তাঁর শরীর বেশ খারাপ লাগছে। এই বয়সে বরফ না কাটাই ভালো। বড়ো বেশি চাপ পড়ে। শরীর দুর্বল হয়েছে, এখন আর আগের মতো চাপ সহ্য করতে পারেন না। পরীক্ষা করলে হয়তো দেখা যাবে সুগার আছে।

নিশানাথ বাবুকে টেলিফোন করবার আগে কী মনে করে যেন দরজা বন্ধ করে দিলেন। নিশানাথ বাবুঘরেই ছিলেন।

নিশানাথ বাবু, আমি আমিন।

বুঝতে পারছি। আপনার কি শরীর খারাপ? এভাবে কথা বলছেন কেন?

আমার শরীর ভালো না। আপনাকে একটি জরুরী ব্যাপারে টেলিফোন করছি।

বলুন।

আপনি তো জানেন, আমার এই বাড়ি এবং টাকা-পয়সা সব আমি আমার মেয়ের নামে উইল করে রেখেছি। আপনি এক জন উইটনেস।

আমি জানি।

নিশানাথ বাবু, নানান কারণে আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমার মনের মিল হয় নি!

এই বয়সে সেটা তোলার কোনো যুক্তি নেই, আমিন সাহেব।

আমিন সাহেব খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে থেমে থেমে বললেন, আমি আমার স্ত্রীর উপর একটা বড়ো অন্যায় করেছি নিশানাথ বাবু। আজ আমি যদি মারা যাই, সে পথের ভিখিরি হবে।

আমিন সাহেব, আপনার শরীর কি বেশি খারাপ?

হ্যাঁ। আপনি কি একটু আসবেন, আমি নতুন করে উইল করতে চাই।

আমি এক্ষুণি আসছি। সব কাগজপত্র নিয়ে আসব।

নিশানাথ বাবু।

বলুন।

আজ রুনকির জন্মদিন।

আমি জানি। সকালেই মনে হয়েছে।

আমিন সাহেব শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, আরেকটি কথা জিজ্ঞেস করি আপনাকে, আনিস ছেলেটিকে কেমন মনে হয় আপনার?

খুব ভালো ছেলে। অত্যন্ত রিলায়েবল।

 

আমিন সাহেব টেলিফোন করলেন আনিসকে। আনিস বেশ অবাক হল। আমিন সাহেব তাকে কখনো টেলিফোন করেন নি আগে।

আনিস, তুমি আমাকে চিনতে পারছ? আমি আমিন।

চিনতে পারছি। কী ব্যাপার বলুন তো?

আমার মেয়েটির দিকে তুমি লক্ষ রাখবে।

আনিস অবাক হয়ে বলল, আপনার কি শরীর খারাপ?

হ্যাঁ।

কী হয়েছে?

আমি বুঝতে পারছি না, কিন্তু মনে হচ্ছে সময় শেষ হয়ে আসছে। তুমি আমার মেয়েটির খোঁজ-খবর রাখবে। প্লীজ।

আমি আসছি। এক্ষুণি।

 

আমিন সাহেব দরজা খুলতেই দেখলেন রাহেলা দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। রাহেলার চোখে-মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। রাহেলা বললেন, তোমার কী হয়েছে?

আমিন সাহেব বললেন, রাহেলা, আমি মারা যাচ্ছি।

রাহেলা আমিন সাহেবের হাত ধরে ইজিচেয়ারে শুইয়ে দিলেন।

তোমার উপর খুব অবিচার করেছি রাহেলা।

রাহেলা দ্রুত আমিন সাহেবের শার্টের বোতাম খুলে ফেললেন। তার হোত কাঁপছে। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। আমিন সাহেব প্রচণ্ড ঘামছেন!

রাহেলা, তুমি রাগ করো না! একটা বড়ো অন্যায় করা হয়েছে।

রাহেলা দীর্ঘ দিন আগে মারা যাওয়া তার মা-কে ডাক ছেড়ে ডাকতে লাগলেন–আম্মা ও আম্মা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *