১৪. আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে ভারতীয় কৃষির তুলনামূলক অবস্থান

চতুর্দশ অধ্যায়

আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে ভারতীয় কৃষির তুলনামূলক অবস্থান

বিশ্বের মোট কৃষিজমির শতকরা ১১ ভাগ রয়েছে ভারতে। এইদিক থেকে বিশ্বে ভারতের স্থান দ্বিতীয়, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ঠিক পিছনে। আর গ্রামীণ জনসংখ্যার অনুপাতে ভারতের স্থান প্রথম, বিশ্বের মোট গ্রামবাসী জনগণের শতকরা ২৫.৬ ভাগের বাস ভারতে। বিশ্বের মোট উৎপাদিত খাদ্যশস্যের শতকরা ১০.২ ভাগ উৎপাদিত হয় ভারতে এবং গম ও ধানের ক্ষেত্রে হিসাবটি যথাক্রমে শতকরা ১১.৭ ভাগ ও শতকরা ২১.১৫ ভাগ। মোট খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে ভারতের স্থান বিশ্বে তৃতীয়, চিন ও আমেরিকার ঠিক পরেই। গম ও ধান উৎপাদনে ভারত আছে দ্বিতীয় স্থানে, চিনের ঠিক পরে। শুধুমাত্র ডাল উৎপাদনেই ভারতের স্থান বিশ্বে প্রথম, বিশ্বের শতকরা ২২.৫ ভাগ এ দেশে উৎপাদিত হয়। তেমনই চিনাবাদাম ও আখ উৎপাদন, উভয় ক্ষেত্রেই ভারতের স্থান বিশ্বে দ্বিতীয়, কিন্তু পাট ও পাটের মতো দড়ির উৎপাদনে ভারতের স্থান প্রথম। ভারত একাই বিশ্বের মোট পাটের শতকরা ৫৪ ভাগ উৎপাদন করে থাকে। যদিও ভারত তুলাচাষে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে আছে, চিনের স্থান ভারতের ঠিক আগে, ভারত একাই মোট উৎপাদিত তুলার শতকরা ২৬.২ ভাগ উৎপাদন করে। চা উৎপাদনে ভারত দ্বিতীয়, কফি উৎপাদনে ষষ্ঠ। অর্থাৎ কৃষিপণ্য উৎপাদনে ভারত পৃথিবীর অগ্রণী দেশ। এমনকী শাকসবজি, ফলমূল, আলু-পিঁয়াজ উৎপাদনেও ভারত আছে দ্বিতীয় স্থানে, চিনের ঠিক পরেই। ভারতের এই অবস্থানের পিছনে রয়েছে ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদ। এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিশ্বের মোট কৃষিজমির বড় অংশ রয়েছে ভারতে। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে, এইসব বিভিন্ন ফসলের আওতায় থাকা কর্ষণযোগ্য মোট কৃষি-জমির বিশাল অংশ ভারতে থাকলেও জমির উৎপাদিকা শক্তির বিচারে ভারত বিভিন্ন দেশের থেকে অনেকটাই পিছনে রয়েছে। চিন যেখানে প্রতি হেক্টরে ধান উৎপাদন করে ৬৮৯১ কেজি, ভারত প্রতি হেক্টরে ধান উৎপাদন করে মাত্র ৩৬০৮ কেজি। যদিও ডাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভারতের স্থান প্রথম, কিন্তু ভারতে প্রতি হেক্টর জমিতে ডাল উৎপাদনের হার চিন, মিয়ানমার, ইথিওপিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, আমেরিকা— এই প্রতিটি দেশের অর্ধেকেরও কম। সব ফসলের ক্ষেত্রেই পৃথিবীতে হেক্টর-প্রতি গড় উৎপাদনের পরিমাণ ভারতের তুলনায় অনেক বেশি। অথচ সার ব্যবহারের তথ্য নিয়ে অনুসন্ধান করে আমরা দেখব, ভারতে প্রতি হেক্টর চাষের জমিতে সার ব্যবহারের গড় অনেক দেশের থেকে যথেষ্ট বেশি। নীচের সারণি থেকে বিভিন্ন দেশের কৃষি-জমিতে হেক্টর-পিছু সারের ব্যবহার ও বিভিন্ন ফসল চাষে নিযুক্ত হেক্টর-প্রতি জমিতে ভারত অনেক উন্নত দেশের তুলনায় বেশি সার প্রয়োগ করে। অথচ ভারতে বিভিন্ন শস্যে হেক্টর-প্রতি উৎপাদনক্ষমতা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। অর্থাৎ ভারতে সম্ভবত প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত সার ব্যবহার হয়ে থাকে।

সারণি ১৪.১ হেক্টর-পিছু সারের ব্যবহার ও হেক্টর-প্রতি উৎপাদনশীলতা (সার: কেজি। উৎপাদনশীলতা: কেজি/হেক্টর)

সারণি ১৪.১ হেক্টর-পিছু সারের ব্যবহার ও হেক্টর-প্রতি উৎপাদনশীলতা (সার: কেজি। উৎপাদনশীলতা: কেজি/হেক্টর)

Source: Agricultural Statistics at a Glance 2017

দেখা যাচ্ছে, ভারতে হেক্টর-পিছু সারের ব্যবহার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি, অথচ ভারতে কোনও একটি শস্যের ক্ষেত্রেও জমির হেক্টর-পিছু উৎপাদন অন্যান্য দেশগুলির সঙ্গে তুলনীয় নয়। ভারত এখানে উল্লিখিত সব দেশের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি, বিভিন্ন ফসল চাষের আওতায় থাকা মোট জমি বা মোট উৎপাদনের দিক থেকে ভারত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় দ্বিতীয় অথবা প্রথম স্থানে রয়েছে। আমরা যে-দেশগুলির সঙ্গে ভারতের উৎপাদনশীলতার তুলনা করেছি তারা মোট উৎপাদনের দিক থেকে অথবা বিশ্বের মোট উৎপাদনে তাদের অংশের দিক থেকে ভারতের কাছাকাছি আছে। এইসব দেশে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদনশীলতা ভারতের তুলনায় অনেক বেশি, যদিও বিশ্বের মোট উৎপাদনে অবদানের নিরিখে এদের অধিকাংশই ভারতের থেকে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। আমরা দেখেছি, সার বা জমির উৎপাদিকা শক্তিবর্ধক উপকরণ প্রয়োগে ভারত মোটেই পিছিয়ে নেই। চাষের জমির উৎপাদিকা শক্তির হ্রাস-বৃদ্ধি আরও যে-দু’টি উপাদানের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল, সেগুলি হল মাটির স্বাভাবিক গুণ ও নিয়মিত সেচের সুবিধা। কৃষিতে হেক্টর-পিছু বিভিন্ন উপকরণের ব্যবহার ও এই বিষয়ে পৃথিবীর কৃষিতে উন্নত রফতানিকারী দেশগুলির তুলনায় ভারতের অবস্থান সম্পর্কে পরে আলোচনা করব, তার আগে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যক্ষেত্রে ভারতের তুলনামূলক অবস্থান নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি।

ভারত বর্তমানে আন্তর্জাতিক স্তরে একটি ব্রিক জোটের অন্তর্বর্তী দেশ এবং বিশ্বের প্রধান ‘উদীয়মান জাতীয় অর্থনীতি’গুলির একটি। রফতানকারী দেশ হিসেবে বর্তমানে বিশ্বে ভারতের অবস্থান ১৮তম স্থানে। ভারতের মোট রফতানির মূল্য তার অভ্যন্তরীণ জাতীয় উৎপাদনের শতকরা ১৩.৭ ভাগ। ভারতে গত ১৫ বছরে বহির্বাণিজ্যে অনেকটা বাণিজ্য-ঘাটতি জমা হয়েছে। ২০০৩–’০৪ সালে বাণিজ্যে ৩৪০ মিলিয়ন ডলার বাণিজ্য-উদ্বৃত্ত ছিল। সেখান থেকে ধীরে ধীরে বাণিজ্য-ঘাটতি দেখা যায় ও তা বাড়তে থাকে। ফলে ভারত এখন ৮৮.১ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য-ঘাটতির দেশ। অবশ্য কোনও কোনও অর্থনীতিবিদ এই বাণিজ্য ঘাটতিকে উন্নয়নের আবশ্যিক শর্ত বলে মনে করেন। বর্তমানে ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ মাথাপিছু উৎপাদনের পরিমাণ বছরে ৬৫৭০ ডলার, বিশ্বের ৮৯টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ৭২তম।

সারণি ১৪.২ ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের কৃষিক্ষেত্রের তুলনা

সারণি ১৪.২ ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের কৃষিক্ষেত্রের তুলনা

সারি ২ ও ৩-এর সংখ্যাগুলি ২০১৭ সালের।

উৎস: World Development Indicators, World bank

সারি ৩ ও ৪-এর সংখ্যাগুলি ২০১৬ সালের।

উৎস: World Bank

ভারতের প্রধান পাঁচটি রফতানি পণ্যের মধ্যে চাল ও কাঁচা চিনির স্থান যথাক্রমে তৃতীয় ও পঞ্চম। বিশ্বে চালের বাৎসরিক মোট রফতানির শতকরা ২৬.৭ ভাগ রফতানি করে ভারত। বিশ্বে চাল রফতানির বাজারে ভারতের সবচেয়ে কাছের প্রতিযোগী হল তাইল্যান্ড, বিশ্বের চালের বাজারে সে দেশের অবদান শতকরা ২১.৯ ভাগ। সম্প্রতি ইরান বাসমতি চাল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ফলে চালের রফতানিক্ষেত্রে ভারত আরও সুবিধাজনক অবস্থায় চলে যাবে, কারণ ইরান পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় চাল আমদানিকারি দেশ। ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম চিনি রফতানিকারী দেশ। বিশ্বের বাৎসরিক ২৫ বিলিয়ন ডলার চিনির বাজারে ভারতের অবদান শতকরা ৫.৯ ভাগ। ব্রাজিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চিনি রফতানিকারী দেশ। বিশ্বের চিনির বাজারে ব্রাজিলের অবদান শতকরা ৪২.৪ ভাগ।

সারণি ১৪.৩ বিশ্ববাণিজ্যে ভারতের ভূমিকা

সারণি ১৪.৩ বিশ্ববাণিজ্যে ভারতের ভূমিকা

তথ্যসূত্র: World Bank

২০১৩ সালের পর বিশ্বের মোট রফতানি পণ্যে ভারতের অংশ বেড়েছিল এবং ২০১৩ থেকেই সেবা ও পণ্য উভয় মিলিয়ে ভারতের অংশ বেড়েছে।

১৯১৭ সালে পৃথিবীর মোট রফতানিতে ভারতের অংশ ছিল শতকরা ১.৬৮ ভাগ। এবং মোট আমদানিতে ভারতের অংশ ছিল শতকরা ২.৪৮ ভাগ। ২০১৬ সালে ভারতের মোট রফতানির শতকরা ১২ ভাগ ছিল কৃষিজাত পণ্য, এবং শতকরা ৭০.৫ ভাগ ছিল অ-কৃষিজাত পণ্য। আমদানির ক্ষেত্রে কৃষিজাত পণ্যের ভাগ ছিল শতকরা ৮.১ ভাগ ও অ-কৃষিজাত পণ্যের ভাগ ছিল ৫১.৭ ভাগ। ভারতের রফতানির প্রধান গন্তব্য ছিল ইউরোপীয় দেশগুলি, চিন ও সংযুক্ত আরবশাহির দেশ এবং ভারতের আমদানির প্রধান উৎস ছিল চিন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব। ২০১০ সাল থেকে ’১৭ সালের মধ্যে ভারতের রফতানি ও আমদানি উভয়ই প্রতি বছর গড়ে শতকরা ১৫ ও ১৬ ভাগ হারে হ্রাস পায়।

নীচের সারণিতে আমদানি ও রফতানি পণ্যের বিশ্ববাজারে কয়েকটি প্রধান দেশের উল্লেখ করা হয়েছে ও এদের সঙ্গে বাণিজ্যে ভারতের শতকরা অংশ জানানো হয়েছে। আমরা ২০০৫–২০০৯ পর্যন্ত আমদানি/রফতানির গড় মূল্য ও পরিমাণের উল্লেখ করেছি। দেখা যাচ্ছে, ২০০৫–২০০৯ অবধি ভারতের রফতানি বাণিজ্যের প্রধান গন্তব্য ছিল সৌদি আরব, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনাম। আমদানি বাণিজ্যের প্রধান উৎস ছিল মিয়ানমার, আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রাজিল, শ্রীলঙ্কা।

সারণি ১৪.৪ বহির্বাণিজ্যে ভারতের স্থান

সারণি ১৪.৪ বহির্বাণিজ্যে ভারতের স্থান

A. Caglianin and A.Rush,Economic Development and Agriculture n India, Reserve Bank of Australia, Bulletin June Quarter, 2011

তথ্যসূত্র

১. BRICS (Brazil, Russia, India, China, South Africa)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *