১৪. আনফরগিভেবল কার্সেস
পরের দুটো দিন খুব সাদামাটা কাটল। তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি।
নেভিলে মিশ্রিত নির্যাস বানাতে গিয়ে পোসান) দুটো কলড্রন ভাঙল। প্রফেসর স্নেইপ রেগে গিয়ে নেভিলকে শাস্তিস্বরূপ আটক করে রাখলেন। কেউ আইন ভাঙলে, দুমী করলে আটক শাস্তি দেন। নেভিলে ওই রকম শাস্তি মোটেই আশা করেনি।
রন, হ্যারিকে বলল–স্নেইপের রেগে থাকার আসল কারণ জান? হারমিওন তখন নেভিলকে ওর আঙুল থেকে জাদুমন্ত্রে ব্যাঙের ছাতা সাফ কিভাবে করতে হয় তা দেখাচ্ছিল।
–অবশ্যই, হ্যারি বলল–মুডি
সকলেই জানে স্নেইপ সত্য সত্যই ডার্ক আর্ট-এর কাজ পছন্দ করে। চার চারটে বছর চেষ্টা করেও পায়নি। এই বার নিয়ে পাঁচ বছরের দিকে পা বাড়াল। আগে যেসব ডার্ক আর্টের শিক্ষক এসেছিলেন স্নেইপের কাউকে পছন্দ হয়নি। আর সেটা প্রকাশও করেছেন। কিন্তু মুডির সঙ্গে তার অস্বাভাবিক ধরনের তীব্র বৈরীতা। হ্যারি অনেকবার লক্ষ্য করেছে–দুজনে দেখা হলেও, কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না। বিশেষত মুডির ম্যাজিক্যাল অথবা স্বাভাবিক চোখ কোনটাই নয়। (মুডির একটা চোখ স্বাভাবিক অন্যটি জাদুতে ভরা। সেটা খুলতে পারেন, ধুতে পারেন আবার মাথার পিছনে কি হচ্ছে না হচ্ছে দেখতে পারেন। প্রয়োজন হলে ম্যাজিক্যাল চোখ খুলে গ্লাসের জলে ধুয়ে নেন। সেই চোখ দেখলে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক)
হ্যারি চিন্তিতভাবে বলল–স্নেইপ কি মুডিকে ভয় পায়।
–ভেবে দেখ ম্যাজিকের প্রভাবে মুডি স্নেইপকে শিংওয়ালা ব্যাঙ বানিয়ে দিয়েছেন, রন বলল–ওর চোখ কুয়াশায় আবৃত্ত… আর অন্ধকার ঘরে ঘুরছে স্রেফ একা একা।
গ্রিফিন্ডরের চতুর্থ বছরের ছেলেরা মুডির প্রথম শিক্ষা যথাসময়ে শেষ করার জন্য সময়ের চেয়ে অনেক আগে এসেছে। বেল বাজার আগে ঘরের সামনে লাইন করে দাঁড়িয়েছে।
সব শেষে এসেছে হারমিওন। রনকে বলল–লাইব্রেরিতে ছিলাম।
রন বলল–লাইনে দাঁড়াও। সামনের বেঞ্চে বসার চেষ্টা করতে হবে।
ওরা সামনের বেঞ্চে বসা ম্যানেজ করে ডাক ফোর্সেস : অ্যা গাইড টু সেলফ প্রোটেকশনের একটা কপি সামনে রাখল।
একটু পর শুনতে পেল মুডির কাঠের পায়ের শব্দ। মুডি ঠিক সময়মত ক্লাস নিতে আসছেন।
সকল সময়ের মতো এখনও অসম্ভব গম্ভীর হয়ে ক্লাসরুমে ঢুকলেন। পরনে তার বিরাট আলখেল্লা। তার শেষ প্রান্ত থেকে শুধু কাঠের পা দেখা যাচ্ছে।
–বই রেখে দাও, মুডি সব ছাত্রছাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়ে বসতে বসতে বললেন।
ছাত্রছাত্রীরা ঝটপট বই ব্যাগে রেখে দিল।
মুডি হাজিরা খাতা দেখে রোল কল শুরু করলেন। মুখ সেই একই রকম ভয়ার্ত। মাথার বড় চুলগুলো মুখে ঝুলে পড়ছে। সেগুলো এক হাতে সরিয়ে দিচ্ছেন।
শেষ নামটি উপস্থিত বলার সঙ্গে সঙ্গে মুডি বললেন, খুব ভাল।… ফট শব্দ করে খাতাটা বন্ধ করলেন।
–আমার কাছে আজকের এই ক্লাস সম্বন্ধে একটি চিঠি আছে। দিয়েছেন প্রফেসর সুপিন।… হ্যাঁ তোমরা বোগার্টস, রেড ক্যাপস, হিংকীপাংকস, গ্রিন্ডিলোস কাপপাস ও ওয়েরওলভসের লেখা পড়েছ ও মোটামুটি কেমন করে ডার্ক প্রাণীদের কুপোকাৎ করতে হয় জেনেছ।
ক্লাসে গুঞ্জন শোনান গেল।… কিন্তু আমার স্নেহের ছাত্রছাত্রীরা অভিশাপ সম্বন্ধে মনে হয় বেশ পিছিয়ে আছ।… তাহলে জাদুকরদের করণীয় কি তোমাদের জানা দরকার। এই একটি বছর তোমাদের আমি ডার্কদের কেমন করে মোকাবিলা করতে হয় শেখাব।
রন বলল–ঠিক বুঝতে পারলাম না, আপনি কি এরপর থাকবেন না?
রনকে ভাল করে দেখার জন্য মুডির ম্যাজিক্যাল চোখ বন্ বন্ করে ঘুরতে লাগল। রন একটু যেন ভীত হল। কিন্তু পরমুহূর্তে মুডি হাসলেন। জীবনে এই প্রথম মুডিকে হাসতে দেখল হ্যারি! মুডির হাসার জন্য মুখটা সামান্য বাঁকা চোরা হল।
তাহলেও মুডি হেসেছেন… ব্যাপারটা সকলের ভাল লাগল। রনেরও আরও বেশি।
মুডি রনকে বললেন–বোধকরি তুমি আর্থার উইসলির পুত্র? তোমার পিতা কিছুদিন আগে বড়ই বিপাক থেকে রক্ষা করেছিলেন। হ্যাঁ, আমি এখানে এক বছর থাকবো। শেষকালে ডাম্বলডোর আমাকে অবসর নেবার পর এই পড়ানোর কাজটা দিলেন এরপর আমি এক নীরব অবসরে চলে যাব। কথাটা বলে অদ্ভুতভাবে হাসলেন আর নিজেই হাততালি দিলেন।
–তো সোজা আমরা এখন আসি অভিশাপ প্রসঙ্গে। অভিশাপ জেনে রাখবে নানা রূপে, নানাভাবে আমাদের ওপর অর্পিত হয়। আমি তোমাদের অভিশাপের উল্টো অভিশাপ শেখাব। তোমাদের অবশ্য একটু বুঝতে সময় লাগবে কারণ তোমরা ছেলে মানুষ। তবে প্রফেসর ডাম্বলডোরের তোমাদের সাহস, বুদ্ধি ও শক্তি সম্বন্ধে যথেষ্ট আশাবাদী।… স্নায়ুর শক্তি সম্বন্ধে বিশেষ করে যদি কোনও অসৎ ও দুষ্টু প্রকৃতির অসাধু জাদুকর তোমাদের ওপর অভিশাপ প্রয়োগ করে তা তোমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাই তোমাদের ওদের হাত থেকে বাঁচতে গেলে যত শিগগির পার উল্টো অভিশাপ শিখতে হবে। সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে। আমি যখন কথা বলব তখন মিস ব্রাউন অন্য কাজ করা চলবে না। একটা কথা তোমরা কী জান কোন অভিশাপটা জাদুকরদের আইনে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয়?
রন, হারমিওন ছাড়াও অনেকের মাথা নড়ে উঠল। চোখটা লেভেন্ডরের দিকে থাকলেও মুডি রনের কাছে যেন জবাবটা চাইলেন।
–আমার বাবার মুখে শুনেছি ইমপেরিয়স কার্সরা ওই রকম গোছের কিছু।
–হাঃ হাঃ চমৎকার, চমৎকার তুমি ছেলে… ঠিক বলেছ। তোমার বাবা তো জানবেই। এক সময় ইমপেরিয়াস কার্স করে মন্ত্রণালয়কে বড়ই বিপদে ফেলেছিল। কথাটা বলে মুডি দাঁড়ালেন। একটা পা কাঠের তাই সামান্য টলে টলে পড়লেন।… তারপর ডেস্কের ভেতর থেকে একটা কাঁচের জার বার করলেন। সকলেই দেখলো জারের মধ্যে তিনটে বড় বড় মাকড়সা ঝুলছে ও উপরে ওঠার চেষ্টা করছে। হারমিওন রনের মুখের দিকে তাকাল। রনের মাকড়সাকে বড় ভয় হারমিওন জানে।
মুডি ঢাকনা খুলে একটা মাকড়সা ধরলেন। সেটা হাতের তালুতে রাখলেন। এমনভাবে রাখলেন সব ছাত্র–ছাত্রীরা দেখতে পায়।… তারপর মুডি তার দণ্ডটা ওর চারপাশে ঘুরিয়ে বললেন ইমপেরিও! তখন মাকড়সটা লাফ দিয়ে একটা সিঙ্কের ফুলের ওপর পড়ে এধার–ওধার করতে লাগল। অনেকটা ট্রাপিজ খেলার মত। তারপর সুতোটা ছিঁড়ে ডেস্কে লাফিয়ে পড়ল। তারপর চর্কিবাজির মত বন বন করে ঘুরতে লাগল। মুডি দণ্ডটা ওর গায়ে ঠেকাতেই মাকড়সা পিছনের দুটো ল্যাকল্যাকে পা দিয়ে দণ্ডটা চেপে ধরে তুর্কী নাচন করতে লাগল।
মুডি ছাড়া সকলেই মাকড়সার কাণ্ড কারখানা দেখে হো: হো: করে হেসে উঠল।
–দেখে খুব মজার মনে হচ্ছে তাই না? মুডি হুংকার দিলেন।… তোমাদের মধ্যে একজনকে ধরে মাকড়সার মত নাচাই তো কেমন লাগবে?
সকলের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।
–সম্পূর্ণ আয়ত্ত্বাধীন, মুডি ধীরে ধীরে বললেন–মাকড়সা বারবার উঠবার চেষ্টা করে বিফল হয়ে গড়াগড়ি দিতে লাগল।
–আমি ওদের জানালার বাইরে ফেলে দিতে পারি, অবশ্যই এক সময় নিজেরাই যাবে… এখন যা চাই তা করতে পারি, এমনকি তোমাদের গলাতেও প্রবেশ করাতে পারি।
রন কথাটা শুনে আঁতকে উঠে গলা চেপে ধরল।
তোমরা জেনে রেখ বহু বছর আগে অনেক জাদুকর–জাদুকরি ছিল… ওদের আয়ত্ত্বে রাখতে হত ইম্পেরিয়াস অভিশাপের সাহায্যে, মুডি বললেন–হ্যারি জানে যখন ভোল্ডেমর্ট সম্পূর্ণভাবে সর্বশক্তিমান ছিল–তখনকার কথা। মন্ত্রণালয় জানতে চেষ্টা করেছিল কারা বাধ্য হয়ে করেছিল… আবার নিজ ইচ্ছায় করেছিল।
–ওই ইম্পেরিয়াস অভিশাপের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়। আজ আমি তোমাদের সেই শক্তি প্রয়োগ শেখাতে শুরু করব। তার জন্য চাই সত্যিকারের চরিত্র শক্তি যা সকলে অর্জন করতে পারে না। যদি তোমরা না পার তাহলে এড়িয়ে চলাই ভাল। কেন ভাল তা আগেই বলেছি। সকলের পক্ষে লড়াই সম্ভব নয়। এছাড়া আরও কিছু অভিশাপ আছে, সেগুলোর নাম কে বলতে পারে? তার স্বর শুনে সকলেই তটস্থ হয়ে গেল।
মুডি মাকড়সা হাত দিয়ে তুলে জারের মধ্যে রাখলেন।
এসব ক্ষেত্রে হারমিওনই হাত তুলে থকে। কিন্তু এবার হারমিওনের সাথে নেভিলকেও হাত তুলতে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল, হ্যারি। নেভিলের তাহলে প্রশ্ন করার সাহস আছে। নেভিলের প্রিয় সাবজেক্ট হার্বোলজি। সাধারণত হার্বোলজি ক্লাসেই সে স্বাচ্ছন্দবোধ করে।
–হ্যাঁ বল, বল কী বলতে চাও। মুডির চোখ নেভিলের দিকে ঘুরল।
নেভিল মিন মিন করে বলল–আমি একটির কথা জানি সেটি হলো, ক্রসিয়াটাস অভিশাপ।
মুডি গভীরভাবে নেভিলের মুখের দিকে তাকিয়ে এখন দুই চোখে তাকালেন।
–তোমার নাম তো লং বটম, তাই না? ওর ম্যাজিক্যাল চোখ হাজিরা খাতার দিকে নিবন্ধ হল।
নেভিল ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল। কিন্তু মুডি ক্রসিয়াটাস অভিশাপ সম্বন্ধে কোনও প্রশ্ন করলেন না। তারপর অল্প সময় স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে দ্বিতীয় মাকড়সাটি জার থেকে বার করলেন। ডেস্কের ওপর রাখলেন। মাকড়সাটা মরার মত পড়ে রইল। মনে হয় লড়তে ভয় পাচ্ছে।
–মুডি বলল–ক্রসিয়াটাস অভিশাপ, মনে হয় তোমাদের আরও বেশি জানা দরকার। দণ্ডটা মাকড়সার গায়ে চুঁইয়ে বললেন, এ এঙ্গরজিও!
মাকড়সাটা ফুলতে শুরু করল। এমন ফুলে উঠল যে বড় বিষাক্ত মাকড়সার চেয়েও ওর পেট বড় হয়ে গেল। রন এই দৃশ্যটির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে তার বসার চেয়ারটি একটু পেছনে নিয়ে গেল।
মুডি আবার দণ্ড তুলে বললেন–ক্রুসিও!
তৎক্ষণাৎ মাকড়সার পাগুলো পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল। তারপরই গড়াগড়ি দিতে দিতে ভীষণভাবে ছটফট করতে লাগল। তার কোনও সাড়াশব্দ নেই, কিন্তু হ্যারি একদম নিশ্চিত সে যদিও বলার শক্তি পায় তাহলে বেদম চেঁচাবে। মুডি তখনও তার দণ্ড ওর দেহ থেকে সরিয়ে নেয়নি।…. মাকড়সাটা আরও বেশি ছটফট করতে লাগল…. মারাত্মকভাবে।
বন্ধ করুন–হারমিওন উচ্চ–তীক্ষ স্বরে বলল।
হ্যারি দেখল হারমিওনকে! হারমিওন মাকড়সা দেখছে না, দেখছে নেভিলের অবস্থা! ওর হাত কাঁপছে, হাঁটু কাঁপছে, চোখ–মুখ কাগজের মত সাদা হয়ে গেছে। চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
হারমিওনের তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনে মুডি হাত তুললেন। মাকড়সার পা শিথিল হয়ে গেল। কিন্তু ওর কাঁপাকাঁপি থামল না।
রিডিউসিও–মুডি বলতেই মাকড়সা আবার আগের মতো হয়ে গেল। মুডি ওকে জারের মধ্যে রেখে দিলেন। বললেন, ক্রসিয়াটাস অভিশাপ বা কার্স করে কাউকে আঘাত করা যায়, ছুরি–কাঁচির দরকার হয় না।
হারমিওন আবার দাঁড়াল। হ্যারি তখন ভ্যাবাচাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
–কোনো জিজ্ঞাসা আছে? মুডি ওর দিকে তাকিয়ে বললেন।
–আভাদা কেডাভারা হারমিওন খুব আস্তে বলল।
–আহ, মুডির মুখে হাসি–হ্যাঁ আভাদা কেডাভারা…. হচ্ছে কার্স বিনষ্ট করার কার্স।
তৃতীয় মাকড়সা জাবের তলদেশে অস্থিরভাবে ছোটাছুটি করতে লাগল। মুডি মাকড়সাটাকে আঙ্গুল দিয়ে ধরে টেবিলে রাখল। আঙ্গুল ছাড়াবার আপ্রাণ চেষ্টা করল কিন্তু পারলো না।
মুডি হাত তুলল, হ্যারি হঠাৎ ভয়ে শিউরে উঠল।
আভাদা কেডাভারা, মুডি গর্জন করে উঠল।
আভাডা কেডাভারা জাদুমন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে সারা আকাশ–বাতাস সবুজ হয়ে গেল–ঝড়ের শব্দ… কোনও এক অদৃশ্য শক্তি বাতাস দিয়ে সবকিছু ভেঙে চুরে তচনছ করার জন্য যেন প্রস্তুত।… মাকড়সা হঠাৎ উল্টে গিয়ে ছটফট করতে লাগল। সন্দেহ নেই মৃত। মেয়েরা ভয় পেয়ে কান্নাকাটি শুরু করল, রন চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে পিছু হটল।
মৃত মাকড়সাটা মাটিতে ফেলে দিল।
–ভাল লক্ষণ নয়, মুডি শান্ত কণ্ঠে বললেন–খুব সুখকরও নয়। এর কোন প্রতিরোধ কার্সও নেই। একজনই মাত্র ওই কার্স থেকে জীবিত আছে, সে আমার সামনে বসে রয়েছে। কথাটা শুনে হ্যারির মুখ লাল হলো। সে অনুভব করলো সকলেই তারদিকে তাকিয়ে আছে।
তো, এমনভাবেই ওর বাবা-মার মৃত্যু হয়েছে… ঠিক ওই মৃত মাকড়সার মত। ওরাও কী নিষ্কলঙ্ক নির্দোষ, তিনি অরক্ষিত ছিলেন? ওরা কী এ রকম সবুজ আলো… দেহ থেকে প্রাণ বেরিয়ে যাবার আগে মৃত্যুর পদধ্বনি শুনেছিলেন?
হ্যারি গত তিন বছর ধরে সারা দিনরাত ওর বাবা-মার নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা ভেবে চলেছে… সেদিন সেই ভয়ঙ্কর রাতে কি ঘটেছিল? ওয়ার্মটেল কেমন করে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ভোল্ডেমর্টকে ওর বাবা-মার ঠিকানা কে দিয়েছিল? কে তাদের কটেজে এসে খোঁজ নিয়েছিল? হ্যারির বাবাকে সর্বপ্রথমে কেমন করে ভোভেমট হত্যা করেছিল। জেমস পটার কেমন করে হ্যারিকে বাঁচানোর প্রয়াস করেছিলেন, যখন তিনি তার স্ত্রীকে বলেছিলেন হ্যারিকে সরিয়ে নিয়ে যেতে। তারপর জেমসকে হত্যার পর ও লিলি পটারের দিকে এগিয়েছিল… বলেছিল ও হ্যারিকে হত্যা করবে। লিলি বলেছিল, হ্যারিকে হত্যা না করে যেন তাকে হত্যা করা হয়… প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিল একমাত্র সন্তানের। কিন্তু নির ভোল্ডেমর্ট লিলির কথা শোনেনি… লিলিকে হত্যা করেছিল, হ্যারির ওপর জাদুদণ্ড ঘুরাবার আগে।
ডেমেন্টরদের সঙ্গে গত বছর লড়াইয়ের সময়ও তার মা-বাবার কণ্ঠস্বর শুনেছিল–ডেমেন্টরদের ওই রকম পৈশাচিক শক্তি।… তাদের প্রতিপক্ষদের সবকিছু ভুলিয়ে… দুর্বল করে… নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য হত্যা করা।
মুডি আবার শুরু করলেন–যেন বহুদূর থেকে… হ্যারির তো তাই মনে হল… মুডির কথা শুনতে লাগল।
–ম্যাজিকের প্রতিরোধ শক্তি না থাকলে আভাদা কেডাভারা প্রয়োগ করা যায়-এখন তোমরা তোমাদের নিজ নিজ দও বার করতে পার। আমার দিকে তাক করতে পার… ওই মন্ত্রটি বল, আমি মনে করি… প্রয়োগ করলে শুধুমাত্র আমার নাক দিয়ে সামান্য রক্তক্ষরণ হবে, আর কিছুই হবে না। অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না। আমি কিন্তু তোমাদের সেই জাদুমন্ত্র ও তার প্রয়োগ আজ শেখাতে আসিনি।
-এখন বল, যদি তাকে প্রতিহত করার কোনও কার্স যদি না থাকে, তাহলে আমি কী দেখালাম?… কারণ তোমাদের জানা দরকার! তোমাদের জানতে হবে ভয়ঙ্কর শক্তি সম্পর্কে।
তোমাদের থাকতে হবে সর্বক্ষণ সতর্কতার মধ্যে! মুডি হুংকার দিয়ে বললেন, তার চিৎকারে সবাই তটস্থ হয়ে উঠল।
-এখন এই তিনটি কার্স আভাদা কেডাভারা, ইমপেরিয়াস এবং ক্রসিয়াটাস, এগুলো ক্ষমাহীন কার্স! কোনও মানুষকে অকারণে এই তিনটের মধ্যে কোনও একটি প্রয়োগ করলে আজকাবানে যাবজ্জীবন কারাবাস। এই সত্যটা তোমাদের ভুললে চলবে না। তাই তোমাদের সেই প্রতিহত করার ক্ষমতা শেখাব। তার জন্য প্রস্তুতি দরকার, তোমাদের অস্ত্র দরকার… তাই তোমাদের সদাই অনুশীলন করতে হবে, অহর্নিশ… সীমাহীন সতর্কতা।
নাও এখন তোমরা যে যার লেখার কলম বার করে এই কথাগুলো লিখে নাও।
হ্যারি ও হারমিওনের কাছে ক্লাসটা তেমন জমলো না। মনে হল একটা ম্যাজিক শো দেখল। খুবই মজাদার।
হ্যারি ও রনকে হারমিওন বলল–আমাদের যেতে হবে, তাড়াতাড়ি চল।
রন জিজ্ঞেস করলো–কোথায়, লাইব্রেরিতে? সেখানে মোটেই যাব না।
হারমিওন সাইড প্যাসেজ দেখিয়ে বলল–না, না সেখানে নয়, নেভিলের কাছে যাব।
নেভিল, প্যাসেজের মাঝপথে পাথরের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখনও ওর মুখে ভয়ের ছাপ। বড় বড় চোখ… যে ভয়ার্ত চোখে মুডির ক্রসিয়াটাস কার্স দেখেছিল।
হারমিওন খুব আস্তে আস্তে বলল–নেভিল!
নেভিল হতভম্বের মত চারদিক তাকাল।–ও, হ্যালো। ওর গলার স্বর স্বাভাবিক নয়–দারুণ লেসন তাই নয়? এরপর একটু থেমে নেভিল আবার বললো, ভাবছি ডিনারের কথা। দারুণ ক্ষিধে পেয়েছে, তোমাদের পায়নি?
হারমিওন নরম সুরে বলল–নেভিল তোমার শরীর ভাল আছে তো?
নেভিল বলল–ও হ্যাঁ, খুব ভাল আছি। দারুণ ডিনার… মানে আজকের লেসন… এখন কি খেতে যাবে?
রন হ্যারির দিকে থতমত হয়ে তাকাল।
–নেভিলের কী হয়েছে…?
ঠিক সে সময় খট খট শব্দ শুনতে পেল। দেখতে পেল মুডি নেভিলের দিকে সস্নেহে তাকিয়ে বললেন–সব ঠিক আছে। চল আমার ঘরে… এক সঙ্গে বসে চা পাওয়া যাক।
নেভিল মুডির সঙ্গে চা খাওয়ার প্রস্তাবে আরও যেন ভয় পেয়ে গেল। ও কথাটা শুনে শুধু বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল।
মুডি তারপর ওর ম্যাজিক্যাল চোখ দিয়ে হ্যারির দিকে তাকিয়ে বললেন তুমি? কেমন আছ হ্যারি?
–হ্যাঁ।
মুডির নীল চোখ কোটরের মধ্যে সামান্য কেঁপে উঠল।…. বললেন–সমগ্র ব্যাপারটা তোমাদের ভাল না লাগলেও, তোমাদের স্বার্থে জানা দরকার। ভান করে লাভ নেই, বাস্তবকে মেনে নিয়েছে আমাদের চলতে হবে। চল লংবটম। আমি তোমাকে কিছু মজার বই দেব।
নেভিল মুডির একটা হাত ধরে চলে গেল।
রন আর হ্যারি মুডির ভয়ঙ্কর প্র্যাকটিক্যাল আর লেসন সম্বন্ধে কথাবার্তা বলতে লাগল। তার ধার দিয়েও গেল না হারমিওন।
রন হ্যারিকে বলল–তার চেয়ে চল প্রফেসর ট্রেলারের কাছে। আজ রাতে একটা প্রেডিকসন দেখাবেন বলেছেন। বললেন, সময় লাগবে।
ওরা গ্রিফিন্ডের টাওয়ারের দিকে চলল। হ্যারির মাথায় ডিনারের কথা সারাক্ষণ বললেও হঠাৎ মুডির অক্ষমনীয় কার্সের কথা বলল।
–আচ্ছা ডাম্বলডোর আর মুডির মধ্যে সমস্যা হবে না তো?
–কেন?
-এই আমাদের মানে মিনিস্ট্রি যদি জানতে পারে উনি আমাদের কার্স দেখিয়েছেন? হ্যারি বলল।
ওরা তখন কমনরুমে ঢোকার জন্য মোটা মহিলার পেট্রেটের সামনে দাঁড়িয়েছে।
–হতে পারে। তবে ডাম্বলডোর সব কাজ বুঝেসুঝে করেন। কিন্তু মুডি বেপরোয়া। তাই পদে পদে বিপদে পড়েন।
ওরা গ্রিফিন্ডর টাওয়ারে দেখল খুব ভিড়। হল একটু ফাঁকা হলে যাবে এই ভেবে নিজেদের ডরমেটরিতে গেল। গিয়ে দেখল, নেভিল ওর বিছানায় চুপচাপ শুয়ে রয়েছে। চোখ দুটো লাল।
হ্যারি ওর পাশে বসে বলল–নেভিল তোমার শরীর ভাল আছে তো?
–হা হ্যাঁ খুব ভাল আছে। একটা বই দেখিয়ে নেভিল বলল–প্রফেসর মুডি বইটা পড়তে বলেছেন। ম্যাজিক্যাল মেডিটারেনিয়ন ওয়াটার প্ল্যান্টস অ্যান্ড দেয়ার প্রপার্টিজ। প্রফেসর স্পাউট প্রফেসর মুডিকে বলেছেন, আমি মোটামুটি হারবলজিতে ভাল। একটা সুপ্ত গর্বের ভাব তার মুখে ছড়ালো।
নেভিলকে কখনো কোনো শিক্ষক পড়া শোনার বিষয়ে প্রশংসা করেনি। প্রফেসরস্প্রাউট এই প্রশংসা করে খুব ভাল কাজ করেছেন, এ ধরনের প্রশংসা প্রফেসর লুপিন ছাত্রদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য করে থাকেন।
হ্যারি, রন আনফগিং দ্যা ফিউচারের কপি নিয়ে কমনরুমে চলে গেল। একটা খালি টেবিল পেয়ে সেখানে যেয়ে বসলো। সেখানে বসে আগামী মাসের ভবিষ্যদ্বাণী সম্বন্ধে পড়াশুনা করতে লাগল। এক ঘণ্টার পরও ওদের প্রোগ্রেস তেমন হল না। টেবিলটা ভরে গেল ছেঁড়া পার্চমেন্ট… আর অঙ্কের নানা সিম্বলস ইত্যাদিতে।…. মাঝে মাঝে ওদের প্রফেসর ট্রেলারের ওপর দারুণ রাগ হয়।
কাটাকুটি, অঙ্কের হিসাব করতে করতে রন বলল–আগামী সোমবার দেখছি আমার কাশি হবে… মার্স আর জুপিটরের কাছাকাছি অবস্থানের জন্য। রন হ্যারির দিকে তাকাল।
জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে দুই বন্ধুতে নানা কথাবার্তা বলল। গ্রহের প্রভাবে নানা ভবিষ্যদ্বাণীচিন্তা। একটু একটু করে কমনরুম ফাঁকা হতে লাগল। তারা সব গুতে চলে গেল। কুকস্যাংক একটা শূন্য চেয়ারে বসে ওদের দিকে প্যাট প্যাট করে তাকিয়ে রইল। হারমিওন বোঝে না কেন ওরা মূল্যবান সময় উল্টোপাল্টা কাজ করে নষ্ট করছে।
হ্যারি রন তখনও কমনরুমে, ওদের সামনে কুকস্যাংক চেয়ারে বসে আছে, ওর প্রতীক্ষা হারমিওনের আগমনের… ঘর নিস্তব্ধ। জানালাটা বন্ধ… চাঁদের আলো জানালার কাঁচ ভেদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে।
–হেডউইগ! হ্যারি বলতে গেলে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে জানালার কাছে গেল।… এক ধাক্কায় জানালার কাঁচের পারা খুলে ফেলল।
হেডউইগ খোলা জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে যারির টেবিলের ছড়ানো ছিটানো পার্চমেন্টের ওপর বসল। পার্চমেন্টে হ্যারির দুর্ভাগ্যপূর্ণ বা বিপজ্জনক ভবিষ্যতের গণনা ছিল।
-এসে গেছে! হ্যারি চিৎকার করে বলল।
রন হেডউইগের এক পায়ে বাধা ধিক থিকে নোংরা পার্চমেন্ট দেখে বলল নিশ্চয়ই তোমার চিঠির জবাব এনেছে।
হ্যারি চটপট হেডউইথের পা থেকে কাগজটা খুলে নিল। হেডউইগ হ্যারির হাঁটুর ওপর বসে করুণ সুরে ডাকতে লাগল।
হারমিওন রুদ্ধশ্বাসে বলল–হেডউইগ কী বলছে? হ্যারি চটপট চিঠিটা খুলল। ছোট চিঠি। লেখা দেখে মনে হয় তাড়াহুড়ো করে লেখা!
হ্যারি,
আমাকে এক্ষুণি উত্তরাঞ্চলে যেতে হবে। তোমার কপালের কাটাদাগের ব্যথা জ্বালা–যন্ত্রণার খবর নানা গুজব হয়ে
আমার কানে এসেছে। যদি পুনরায় ওই যন্ত্রণা অনুভব কর তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাম্বলডোরকে জানাবে। খবর পেয়েছি ম্যাড–আই চাকুরি থেকে অবসর নেবার
পরও ওকে তোমাদের স্কুলে শিক্ষকতায় জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তার মানে ও আগাম সঙ্কেত জানাতে
পারবে, যদি অন্য কেউ এ
কাজটি না করে থাকে।
আমি শিগগিরই তোমার সঙ্গে দেখা করব।
রন ও হারমিওনকে আমার শুভেচ্ছা,
ভালবাসা জানিও। হ্যারি, সাবধানে থাকবে… চোখ সর্বদা
খুলে রাখবে।
সিরিয়স
চিঠিটা পড়ার পর রন ও হারমিওনের মুখের দিকে তাকাল হ্যারি। ওরাও ওর দিকে তাকিয়েছিল।
সিরিয়স তাহলে উত্তরাঞ্চলে যাচ্ছেন? সে কি ফেরত আসছে? হারমিওন নিচুস্বরে বলল।
রন বিভ্রান্ত, হ্যারি কি ব্যাপার বলত?
হ্যারি নিজের কপালে নিজেই আঘাত করতেই হেডউইগ ওর হাঁটুর উপর থেকে নেমে গেল।
হ্যারি অসম্ভব রেগে বলল–ব্যাপারটা মনে হয় সিরিয়সকে লেখা ঠিক হয়নি।
রন একটু আশ্চর্য হয়ে বলল–কেন, এই কথা বলছ?
হ্যারি সজোরে টেবিলে চাপড় দিতেই হেড উইগ রনের চেয়ারে বসল।–মনে হয় ভেবেছেন আমি আসতে লিখেছিলাম। হয়তো ভাবছেন আমি দারুণ এক বিপদে পড়েছি। আমার তো কিছুই হয়নি, আমাকে সাহায্য করার কোনো কিছু নেই। এখানে এসে উনি কোনো বিপদে পড়ুক তা আমি চাই না।
হেডউইগ তখনও বিরক্ত করে চলেছে।
হ্যারি রেগে গিয়ে বলল–দাঁড়াও তোমাকে আউলারিতে রেখে আসছি। ওখানে তোমার খাবার আছে।
কাল সকালে দেখা হবে এই বলে হ্যারি ঘুমোতে গেল।