অস্তাচলের পথে
শরীর-স্বাস্থ্য যখন ভালো ছিল তখন স্বামী বিবেকানন্দর একটা মহৎ গুণ ছিল, তাকে কেউ সহজে রাগাতে পারতো না। হয়ত একটা লোক তার সামনে তার বিরুদ্ধে কথা বলছে কিন্তু নিন্দা করে দিল, নানারকম প্রশ্ন করতে আরম্ভ করল, স্বামীজি কিন্তু রাগা দূরের কথা, মুচকি হেসে তার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতেন। এই মন্তব্য স্বয়ং স্বামী অখণ্ডানন্দের, যাকে স্বামীজি রসিকতা করে গ্যাঞ্জেস বলে ডাকতেন।
এই স্বামীজিই গুরুতর অসুস্থ হলে কিন্তু শিশুর মতন হয়ে যেতেন। পরিব্রাজক জীবনে হৃষিকেশে তিনি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। একটু সুস্থ হয়ে তিনি খিচুড়ি খেতে চাইলেন। প্রিয় গুরুভাই রাখাল (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) খিচুড়ি রাঁধলেন, তিনি জানতেন প্রচণ্ড ঝাল না হলে স্বামীজীর পছন্দ হয় না, কিন্তু রোগের কথা ভেবে শেষ মুহূর্তে তিনি খিচুড়িতে একটু মিছরি দিয়ে দিলেন। ঝালখোর স্বামীজির খিচুড়ি মোটেই ভাল লাগছে না, এমন সময় খিচুড়ির মধ্যে একটা সুতো পেলেন। তখনকার দিনে মিছরিতে দু’ একটা সুতো থাকতো। খিচুড়িতে সুতো কেন? জানতে চাইছেন বিরক্ত স্বামীজি, সকলে বলল, এক ডেলা মিছরি ফেলেছে রাখাল। মহাবিরক্ত স্বামীজি এবার আক্রমণ করলেন গুরুভাইকে। “শালা রাখাল, এ তোর কাজ, তুই খিচুড়িতে মিষ্টি দিয়েছিস। দুঃ শালা। তোর একটা আক্কেল নেই।”
স্বামী বিবেকানন্দের প্রসন্ন মেজাজের অজস্র কাহিনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। স্বামী তুরীয়ানন্দ (হরি মহারাজ) ছিলেন প্রিয় গুরুভাই, স্বামীজির দেহাবসানের অল্প দিন পর তার সঙ্গে হরিদ্বারে এক সাধুর দেখা হয়। সাধুটি বলেন, “এত সাধুর সঙ্গে মিশেছি কিন্তু তার মতো সাধু কখনন দেখিনি। হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা করে দিত, আর হাসির সঙ্গে এমন কথা বলতেন যে একেবারে বৈরাগ্য যেন আবার জেগে উঠত। অমন ইয়ার সাধু জীবনে কখনো আর দেখিনি”।
বিশ্ববিজয়ের পর ফিরে এসে বেলুড়মঠ প্রতিষ্ঠার পরে সদাপ্রসন্ন এবং প্রাণবন্ত বিবেকানন্দের একটি ছবি এঁকে গিয়েছেন স্বামী তুরীয়ানন্দ। “নরেনের সব কাজ কি চটপট, পাগড়ী বাঁধবে তাও কি চটপট…অন্যলোক এক ঘণ্টায় যে কাজ করছে নরেন দু মিনিটে সে কাজ করে ফেলে এবং এক সঙ্গে পাঁচ ছয়টা কাজ করে। এই মানুষটির রেগে যাওয়া অবস্থার ছবিও এঁকেছেন স্বামী তুরীয়ানন্দ। “একদিন মঠ থেকে রেগে বেরিয়ে গেলেন। বললেন, তোরা সব ছোট লোক, তোদের সঙ্গে থাকতে অসহ্য। তোরা সব অনুষ্ঠান শাস্ত্রমত নিয়ে ঝগড়া করবি। কিন্তু শেষটা করলেন কি? সেই ছোটলোকদেরই সব দিয়ে গেলেন।”
আর একদিন ভারি চটে গিয়ে স্বামীজি বলছেন, “একাই যাত্রা করতে হলোবাজানো, গাওয়া সব একাই করতে হলো, কেউ কিছুই করলে না।” আমাদের তো গালাগালি দিচ্ছেনই–ঠাকুরের উপরেও ভারি অভিমান হয়েছে। তাকেও গাল দিচ্ছেন, “পাগলা বামুন, মুখর হাতে পড়ে জীবনটা বৃথা গেল।”
গুরুভাইরা তার সম্বন্ধে আরও সব আশ্চর্য কথা লিখে গিয়েছেন। সুস্থ অবস্থায় স্বামীজির শান্তভাবের। স্বামীজি তখন আমেরিকায়, আত্মার অজত্ব ও অমরত্ব উপদেশ দিতেন, আমি আত্মা, আমার জন্মও নেই মৃত্যুও নেই। আমার আবার ভয় কাকে?
কতকগুলো কাউ বয়’তাকে পরীক্ষা করবার জন্য তাদের মধ্যে বক্তৃতা দিতে নিমন্ত্রণ করে। স্বামীজি যখন বক্তৃতা দিচ্ছেন, সেই সময় তারা ডেডশটস (বেপরোয়া গুলি) তার কানের, মাথার নিকট দিয়ে চালাতে আরম্ভ করল, স্বামীজি কিন্তু নির্ভীক, অবিচলিত, তার বক্তৃতারও বিরাম নেই, তখন সেই কাউবয়রা আশ্চর্য হয়ে তার কাছে দৌড়ে গেল, আর বলতে লাগলো, ইনিই আমাদের হিরো।…
“স্বামীজি শেষদিন পর্যন্ত খেটে গিয়েছেন। দেখেছি, শেষ অসুখের সময় বুকে বালিশ দিয়ে হাঁপাচ্ছেন; কিন্তু এদিকে গর্জাচ্ছেন। বলছে, “ওঠো, জাগো, কি করছো?”
কিন্তু পাল্লা দিয়ে বেলুড়ে চলেছে বড় বড় মানুষদের মান অভিমানের পালা। স্বামীজির চোখে তখন ঘুম আসে না। নিদ্রাহীনতা রোগে রাতের পর রাত কেটে যায়। স্বামীজির প্রিয়তম শিষ্যদের মধ্যে স্বামী সদানন্দ, গুপ্ত মহারাজ নামে সবার কাছে পরিচিত। একসময় হাতরাস স্টেশনে রেলের কর্মী ছিলেন, কী করে এক অপরাহে তিনি অনাহারে থাকা রমতি সন্ন্যাসীকে নিজের কোয়ার্টারে ডেকে এনে সেবা করেছিলেন এবং যথা সময়ে বৈরাগ্যের দীক্ষা নিয়েছিলেন তা বিবেকানন্দপ্রেমীদের স্মরণে আছে। স্বামীজির মহানির্বাণের কাছাকাছি সময়ে গুপ্ত মহারাজ ছিলেন বেলুড়মঠে। তখন তার শরীর ভাঙনের পথে। একদিন কি কারণে স্বামীজি চটে লাল হয়ে নিজের ঘরে বসে আছেন। মেজাজ অত্যন্ত গরম। কার সাধ্যি সামনে এগোয়। খানা তৈরি করে কোমরে বাবুর্চির ভোয়ালে জড়িয়ে ঘরে খাবার নিয়ে সাধাসাধি, মহারাজ নরম হোন। গুস্সা ছোড় দিজিয়ে। টেমপারেচার তবু নামে না।–মেহেরবানি করুন, সব কুছ কসুর মাফ কিজিয়ে। যাঃ শালা, দূর হ, খাব না। সদানন্দ তখন দাঁত দেখালেন, তুমভি মিলিটারী, হামভী মিলিটারী, রেগে হাত নেড়ে মুখের উপর বলে তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলাম। যাঃ শালা। ভুখা রহো, হামারা ক্যা খারাপ! কিন্তু সবাই জানতো ওটা মুখের কথা, স্বামীজি অনাহারে বসে থাকবেন আর তার কাছের মানুষরা আহার করবেন এমন ঘটনা কোনোদিন ঘটেনি রামকৃষ্ণ সঙ্ঘে।
মঠে স্বামী বিবেকানন্দ নিজেই অনেকবার বলেছেন, যাঁরা তাঁর বিশেষ প্রিয় পাত্র তাদেরই তিনি বেশি বকাবকি করেন। কথাটা অতিরঞ্জিত নয়। কারণ সবচেয়ে তার রাগের সামনে পড়তেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও স্বামী সারদানন্দ। এই সারদানন্দকেই তিনি বিদেশে নিয়ে গিয়েছিলেন। অনেক দিন পরে দু’জনে দেখা হলো লন্ডনে। দু’জনেরই মধ্যে সীমাহীন ভালবাসা, কিন্তু শুনুন স্বামী সারদানন্দ কী বলছেন প্রত্যক্ষদর্শী মহেন্দ্রনাথকে।
“নরেনের হাপরে পড়ে প্রাণটা আমার গেল। কোথায় বাড়ি ছাড়লাম মাধুকরী করব, নিরিবিলিতে জপ ধ্যান করব। না এক হাপরে ফেলে দিল। না জানি ইংরাজি,না জানি কথাবার্তা কইতে, অথচ তাইশহচ্ছে–লেকচার কর, লেচার কর। আরে বাপু আমার পেটে কিছু আছে? আবার নরেন যা রাগী হয়েছে কোনদিন মেরে বসবে। তা চেষ্টা করব, দাঁড়িয়ে উঠে যা আসবে তাই একবার বলব; যদি হয়তো ভাল, না হয় চো চা মারব। একেবারে দেশে গিয়ে উঠব। সাধুগিরি করব, সে আমার ভাল। কি উপদ্রবেই না পড়েছি। কি ঝকমারির কাজ। এমন জানলে কি এখানে আসতাম? শুধু নরেনের অসুখ শুনেই এলাম।”
সেবার লন্ডনে স্বামীজি তাঁর ভাই মহিম ও সারদানন্দের আচমকা অসুখ-বিসুখ নিয়ে খুব বিব্রত হয়েছিলেন। একে তো পরের দয়ায়, পরের আশ্রয়ে থাকা। সহায় সম্বল প্রায় কিছুই নেই। তার ওপর সারদানন্দ ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে উৎসাহিত হচ্ছেন না। এই সময় আবার সারদানন্দের প্রবল ম্যালেরিয়া জ্বর। সারদানন্দের ধারণা, স্বামীজি যা নির্দেশ দিয়েছেন তা করাবেনই। জ্বরে হাঁসফাঁস করতে করতে তিনি পায়চারি করছেন এবং মহিমকে বললেন, “দেখ মহিম, নরেন তো ছাড়বে না। যেকোন প্রকারেই হোক লেকচার দেওয়াবেই। এবার লেকচার রিহার্সাল শুরু করলেন মহিমের সামনে, অনুরোধ করলেন তুমি কিন্তু হু দিও।”
মহিমেরও তখন জ্বর! চেয়ারে বসে অতিকষ্টে হু দিতে লাগলেন। এরপরে উভয়েই বিছানার ভিতর কম্বল মুড়ে শুয়ে পড়লেন, কিন্তু সারদানন্দ মাথা পর্যন্ত কম্বল ঢেকে লেকচার আওড়াতে লাগলেন। প্রায় পাঁচটার সময় স্বামীজি ঘরে এসে ঢুকে সারদানন্দকে লেকচার আওড়াতে শুনে হেসে ধমক দিয়েছেন, সারদানন্দ চিন্তামুক্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। পরের দিন সারদানন্দর জ্বর একটু কম, কিন্তু মহিম কাহিল, বেহুশ অবস্থায় একঘণ্টার উপর ছিলেন। বিব্রত বিবেকানন্দ বিদেশে বোধ হয় বাধ্য হয়ে বিশেষ শক্তি প্রয়োগ করলেন। ভাই লিখেছেন, স্বামীজি ঘরে ঢুকে যখন শুনলেন জ্বর নেই তখন বললেন, যা আর জ্বর আসবে না, আমি নীচে বসে উইলফোর্স দিচ্ছিলাম। সারদানন্দও ভালবাসায় মুগ্ধ, স্বামীজিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমার মনটা ভাল করে দাও, এটাকে উপরে তুলে দাও।”
এরপর সহাস্য স্বামীজির সেই বিখ্যাত ডায়ালগ : “দুঃশালা হোঁকা, উঠে বোস! শালার ম্যালেরিয়া জ্বর হয়েছে কিনা তাই গতিকে কি কচ্ছে দেখ! যা শালা তোকে লেকচার করতে হবে না, না হলে তোকে মারব লাথি আর এই চারতলার জানলা থেকে রাস্তায় ফেলে দোব। শালা তোকে ওয়ার্ক হাউসে খাটাব। জানিস না কত খরচ হয়েছে।”
শুধু সারদানন্দ নয়, নিজের ভাইয়ের সঙ্গেও স্পেশাল স্টাইলে কথা বলতেন স্বামীজি। লন্ডনে তিনি চেয়েছিলেন ব্যারিস্টারি না পড়ে ভাইও সারদানন্দ ও গুডউইনের সঙ্গে আমেরিকা পাড়ি দেয়। অনুগত ভক্ত ও ক্ষিপ্রলিপিকার গুডউইন যেমন স্বামীজি একটু ঘরের বাইরে গেছেন অমনি নকল করে মহিমকে বলতে লাগলেন, “মারব ঘুষি দাঁত ভেঙ্গে দেব, নাক ভেঙ্গে দেব। চ’ আমেরিকায়। তিনজনে মিলে যাব।”
এসবের মধ্যে রাগ যতটুকু আছে তার থেকে মজা অনেক বেশি। জীবনের প্রধান সময়টুকুই ছিলেন স্বামীজি মজার মানুষ। স্বামী অখণ্ডানন্দ তাই বারবার বলছেন, “তার রাগ একেবারেই ছিল না। তিনি ছিলেন অক্রোধপরমানন্দ।”
রাজপুতনার এক নাপিত স্বামী অখণ্ডানন্দকে বলেছিলেন, “মহারাজ, আপনাদের স্বামীজির তুলনা নেই। অমন ক্রোধ সংবরণ করতে কাউকে দেখিনি। পণ্ডিত তাঁকে বিচারে পরাস্ত করতে এসেছে, অপমানসূচক উত্তর দিচ্ছে আর তিনি মুচকি মুচকি হেসে তার উত্তর দিচ্ছেন। শেষে, যারা তার নিন্দা করতে এসেছিল তারাই তার গোলাম হয়ে গেল।”
রোগে জর্জরিত এই মানুষটিই শেষ জীবনে কি রকম অসহায় হয়ে উঠেছিলেন, কেমনভাবে তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে তার বিবরণ প্রিয়শিষ্য স্বামী শুদ্ধানন্দ ও স্বামী অচলানন্দ (স্বামীজির শেষ সন্ন্যাসী শিষ্য) কিছু কিছু রেখে দিয়েছেন। স্বামীজির প্রধান সমস্যা নিদ্রাহীনতা। একবার তিনি কনিষ্ঠতম শিষ্যকে বললেন, “বাবা, তুই আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারিস? তুই যা চাস, তোকে আমি তাই দেব।” তখন তার নিদ্রা হলেও শারীরিক গ্লানি যথেষ্ট। স্বামীজি বললেন অচলানন্দকে, “জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমি জীবনে কখনও চার ঘণ্টার বেশি ঘুমাইনি।” যখন তিনি একথা বলছেন তখন তার চোখে একেবারেই ঘুম নেই।
স্বামী অচলানন্দ বলেছেন, অসুস্থ স্বামীজি যখন উগ্রমূর্তি ধারণ করতেন তখনও তার মধ্যে একটা মাধুর্য থাকতো। আরও একটা বৈশিষ্ট্য, ক্রোধের পর মুহূর্তেই তার উগ্রভাব চলে যতো, আবার সেই প্রেমপূর্ণ মধুর ভাব আত্মপ্রকাশ করতো। কেউ বুঝতো না যে তিনি একটু আগেই রেগে গিয়েছিলেন।
উদাহরণ? সেবক কানাইয়ের ওপর খুব চটে গিয়েছেন, একটা ছড়ি নিয়ে তার পিছন পিছন ঘুরে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন। পরক্ষণেই ক্রোধের ভাব একেবারে চলে গেল। আর একবার বৃষ্টির সময় ব্রহ্মচারীরা বৃষ্টির পরিভ্রুত জল ধরছিল। কি একটা কারণে স্বামীজি দু’জন ব্রহ্মচারীকে খুব বকছিলেন। তাই দেখে তরুণ অচলানন্দ কঁপতে লাগলেন। তাঁর হাত থেকে বৃষ্টিজলের বোতলটি পড়ে গেল। মুহূর্তে স্বামীজির রাগ চলে গেল। তিনি বললেন, “বাবা, তুই নার্ভাস হয়ে পড়েছিস। যা, আমার ঘরে একটা ওষুধ আছে, খেয়ে শুয়ে পড়গে যা।” তাঁর প্রিয় স্বামী তুরীয়ানন্দকে একবার একটা চিঠি পোস্ট করতে দিলেন। হরি মহারাজ ঠিকানাটা দেখছেন। দেখে বললেন, “হরি ভাই, তোমাকে চিঠিটা ডাকে ফেলতে দিয়েছি, ঠিকানা পড়তে তো বলিনি। অন্যের চিঠির ঠিকানা তুমি কেন পড়, এ কাজ তোমার ঠিক নয়। ব্যাপারটা লুকনো কিছু নয়, স্বয়ং হরি মহারাজই বলে গিয়েছে।
কিন্তু মানুষের জন্যে স্বামীজির স্নেহের শেষ নেই। স্বামী অচলানন্দ বললেন, একটি বালক ফলের রস করতে গিয়ে একবার একটা সৌখিন কাঁচের গ্লাস ভেঙে ফেললো। সবাই তাকে বকাবকি করছে শুনে স্বামীজি বললেন, “ঠাকুরের কাছে আমরা গিয়েছিলাম, তিনি কত ভালবাসা দিয়ে আমাদের আপন করে নিয়েছিলেন, এরা ঘরবাড়ি ছেড়ে আমাদের এখানে এসেছে। এদের এরকম ভীষণ বকুনি দিলে চলবে কেন? এরা থাকতে পারবে কেন? গেলাস তো ঐভাবেই যাবে, গেলাসের তো আর কলেরা হবে না, থাইসিসও হবে না।”
শতাব্দীর ব্যবধানেও বেলুড় মঠের প্রাণপুরুষের শেষ দিকের সব ঘটনা আজও ধৈর্য সহকারে সংগৃহীত বা লিপিবদ্ধ হয়নি। অথচ স্বামীজির অন্ত্যলীলার বিস্তৃত ও বিশ্বাসযোগ্য ছবি আঁকতে গেলে এইসব ঘটনাগুলির গুরুত্ব অসীম। দু’একটি কাহিনি নিশ্চিন্তে পরিবেশন করাটা বোধ হয় অযৌক্তিক হবে না। স্বামী শুদ্ধানন্দ (মঠ মিশনের সভাপতি) ১৮৯৭ সালে আলমবাজার মঠে যোগ দিয়ে স্বামীজির কাছে মন্ত্রদীক্ষা গ্রহণ করেন।
স্বামীজির ইংরেজি গ্রন্থাবলীর এক বৃহদংশের সার্থক বঙ্গানুবাদক তিনি। তিনি বলছেন, একদিন মঠের বারান্দায় স্বামীজি বেদান্ত পড়াতে বসেছে, এমন সময় তাঁর গুরুভ্রাতা এসে সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারিগণকে বললেন, চল হে চল, আরতি করতে হবে চল। স্বামীজি বিরক্ত হয়ে বললেন, “এই যে বেদান্ত পড়া হচ্ছিল, এটা কি ঠাকুরের পূজা নয়? কেবল একখানা ছবির সামনে সলতে-পোড়া নাড়লে আর ঝদ পিটলেই মনে করছিস বুঝি ভগবানের যথার্থ আরাধনা হয়। তোরা অতি ক্ষুদ্রবুদ্ধি।”
এইরকম অস্বস্তিকর পরিবেশে বেদান্ত পাঠভঙ্গ ও আরতি হলো। আরতির পর কিন্তু স্বামীজির গুরুভ্রাতাকে দেখা গেল না। স্বামীজি ততক্ষণে ব্যাকুল হয়ে বলছেন “কোথায় গেল, সেকি আমার গালাগাল খেয়ে গঙ্গায় ঝাঁপ দিতে গেল?” বহুক্ষণ পরে ছাদ থেকে ধরে আনা হলো গুরুভাইকে, স্বামীজির ভাব ততক্ষণে বদলে গিয়েছে। তিনি কত আদর, কত যত্ন করতে লাগলেন।
বকাবকি করতেন, মান অভিমান হতো অসুস্থ শরীরে। কিন্তু যাকে যত ভালবাসতেন তাকে তত বকতেন এবং গাল দিতেন।
স্বামীজি একবার বেলুড়মঠে নিয়ম করেছিলেন যে, কেউ দিবানিদ্রা যেতে পারবে না। একদিন ঘুরে দেখেন স্বামী প্রেমানন্দ ঘুমোচ্ছেন। স্বামীজি তখনই এক শিষ্যকে নির্দেশ দিলেন, যা তাকে পা ধরে টেনে ফেলে দিতে। টানাটানিতে নিদ্রাভঙ্গ হয়ে প্রেমানন্দ বললেন, আরে থাম থাম করিস কি। ঐদিন সন্ধ্যায় ঠাকুরের আরতির পর স্বামী প্রেমানন্দ ঘরের সামনের বারান্দায় উত্তর দিক দিয়ে ঐ স্থানে প্রবেশ করলেন, তখন স্বামীজি পায়চারি করছিলেন। গুরুভাইকে দেখে স্বামীজি তার চরণযুগল জড়িয়ে দরবিগলিত নেত্রে বলতে লাগলেন, “আমি তোদের সঙ্গে কি অন্যায় অত্যাচার না করছি।” এই বলে তিনি বালকের ন্যায় ক্রন্দন করতে লাগলেন। স্বামী প্রেমানন্দ সেদিন যে বহুকষ্টে তাকে শান্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তা আমরা স্বামী চন্দ্রেশ্বরানন্দের স্মৃতিকথা থেকে জানতে পারি।
স্বামীজির কাছে ছাড় কেউই পেত না। আমেরিকা ফেরত স্বামী সারদানন্দ দেশে ফিরে সর্বদা ফিটফাট পরিষ্কার থাকতেন। একদিন হরি মহারাজের (স্বামী তুরীয়ানন্দ) মাদুরে জুতো পরে বসে আছেন। স্বামীজি যথাসময়ে ধমক দিলেন, “হারে সারদা ওরা (আমেরিকাবাসীরা) কি তোকে গ্রাস করেছে। কিছু কি শুকিয়ে দিয়েছিল যে একেবারে সব ব্যাপারে ওদের মতো হয়ে গেছিস?”
যার উপর স্বামীজি সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতেন, তার অবর্তমানে যাঁর ওপর স্বামীজি মঠের দায়িত্ব অর্পণ করে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন, সেই আবাল্যবান্ধব রাজা মহারাজ বা স্বামী ব্রহ্মানন্দের ব্যাপারটা শুনুন। তার সঙ্গে স্বামীজির চিকিৎসা সংবাদ। তার পা ফুলেছে। সমস্ত শরীরে জলসঞ্চার হয়েছে। গুরুভাইরা বড়ই চিন্তিত। স্বামীজি অবশেষে কবিরাজী ওষুধ খেতে রাজি হয়েছেন।
“শিষ্য : মহাশয়, এই দারুণ গ্রীষ্মকাল। তাতে আবার আপনি ঘণ্টায় চার-পাঁচ বার করে জলপান করেন। এ সময়ে জলবন্ধ করে ওষুধ খাওয়া আপনার পক্ষে অসহ্য হবে।
“স্বামীজি : তুই কি বলছিস? ঔষধ খাওয়ার দিন প্রাতে আর জলপান করব না’ বলে দৃঢ় সংকল্প করব। তারপর সাধ্যি কি জল আর কণ্ঠের নিচে নাবেন। তখন একুশ দিন জল আর নীচে নাবতে পারছেন না। শরীরটা তো মনেরই খোলস।”
শরীরের ওপর এই নিষ্ঠুর শাসন শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়েছিল, যদিও চিকিৎসায় কী সাফল্য এসেছিল তা সন্দেহজনক।
তবে সারাজীবন ধরে শরীরকে কত যন্ত্রণা যে সহ্য করতে হয়েছে তার শেষ নেই। স্বামীজি নিজেই বলেছেন, পরিব্রাজক জীবনে এক-আধদিন উপবাস করাতে তিনি উপেক্ষাই করেছেন। তবে কখনও তিনদিনের বেশি উপবাস করতে হয়নি। সেই সময় একবার বাঘে খেয়ে ফেলুক ভেবে বনে বসেছিলেন। বাঘ কিন্তু ফিরে চলে গেল দেখে দুঃখিত হয়ে বললেন, বাঘেও খেল না।”
অসুস্থ শরীরের কথায় ফিরে আসা যাক। ডায়াবেটিস, বিনিদ্রা, হার্টের ট্রাবল নিয়ে কলকাতায় ফিরে এসে তাকে বড় ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল।
যুগনায়ক বিবেকানন্দ গ্রন্থে স্বামী গম্ভীরানন্দের সংযোজন : এর কিছুদিন পরেই দেওঘরে স্বামীজির জীবন সংকটাপন্ন। “সময় সময় এত শ্বাসকষ্ট হইত যে মুখ-চোখ লাল হইয়া উঠিত এবং উপস্থিত সকলে মনে করিতেন, জীবন বা প্রাণবায়ু নির্গত হইয়া যাইবে। স্বামীজী বলিতেন, এই সময় একটি উঁচু তাকিয়ার উপর ভর দিয়া বসিয়া মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করিতেন।”
সমকালের অবজ্ঞা অপমান বিবেকানন্দকে স্পর্শ করতে পারেনি, কিন্তু তার শরীরের অবনতির পরে তার যত কিছু মান-অভিমান ও বকাবকি সব তার প্রিয় গুরুভাই ও শিষ্যদের প্রতি। তবে শুধু বকেননি, দিয়েছেনও নিজেকে উজাড় করে।
স্বামীজির রাগ যাঁদের উপর গিয়ে পড়ত তাদের অবস্থা কিরকম হত? স্বামী ব্রহ্মানন্দ একবার বলেছিলেন, “তার বকুনি সহ্য করতে না পেরে আমারই কতবার মনে হয়েছে মঠ ছেড়ে চলে যাই।”
শেষের সময় আর সুদূর নয়। স্বামী অখণ্ডান লিখেছেন, “স্বামীজি শেষটায় মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে হতাশ হয়ে জীবজন্তু নিয়ে থাকতেন। তার অনেক হাঁস, পায়রা, কুকুর বেড়াল, ভেড়া ইত্যাদি ছিল। দস্তুরমতো একটা চিড়িয়াখানা তৈরি করেছিলেন। নিজের সেবার টাকা থেকে তাদের জন্য দেড়শ টাকা খরচ করতেন। তাঁর হাঁসের মধ্যে চীনে, বম্বেটে, পাতিহাঁসও ছিল। কুকুরের নাম মেরি, টাইগার। ভেড়ার নাম মটরু। চীনে হাঁসের নাম যশোমতী রেখেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় স্বামীজির দেহরক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পশুপাখী সব মরে যায়। তিনি যাকে যা দিয়ে গিয়েছিলেন, তার একটিও বেশি দিন বাঁচেনি।” স্বামীজির দেহরক্ষার পরে খোকা মহারাজ (স্বামী সুবোধানন্দ) কয়েকটি পশুপাখি অখণ্ডানন্দকে দিয়েছিলেন। একটি বেড়াল স্বামীজির পায়রাটিকে লুকিয়ে খায়। স্বামী শঙ্করানন্দ সেই সময় আশ্রমে ছিলেন। তিনি বেড়ালটাকে এমন ঘুষি মেরেছিলেন যে, তার হাত থেঁতলে গিয়েছিল।
বড় চুপি চুপি এলো ৪ঠা জুলাই ১৯০২। স্বামীজির অসুস্থতা ছিল, কিন্তু কেউ বোঝেনি যে সময় সমাগত। প্রায় বিনা নোটিসেই তিনি চলে গেলেন। যাবার তিনদিন আগে আকারে-প্রকারে জানিয়ে দিয়ে গেলেন কোথায় তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে হবে।
পরহিতার্থে দধীচির আত্মত্যাগের গল্প বলতে বলতে স্বামী অখণ্ডানন্দ একবার স্বামীজির কথা টেনে এনেছিলেন। “কাজের জন্যই স্বামীজি এসে মঠ মিশন করে গেলেন, তা যদি না হবে তো যাবার দিনেও স্বামীজি এত কাজ করে গেলেন কেন? অনেকদিন থেকেই চিঠিতে লিখেছেন, ‘মা আমায় ডাকছেন, আমার কাজ ফুরিয়ে এসেছে’। কিন্তু কই, হাত পা গুটিয়ে তো বসে রইলেন না। বহুমূত্র অসুখ, পরিশ্রান্ত, কিন্তু সেদিনও দেড় মাইল বেড়িয়ে এলেন, ব্যাকরণের ক্লাশ করলেন, সাধুদের বকলেন কাজ-কর্ম না করার দরুন।…শেষে ধ্যানে বসলেন। যাওয়ার দিনেও যেন কাজের জোয়ার এসেছিল।”
দু’বছর ধরে মৃত্যু উপত্যকার উপর দিয়ে শারীরিক ও মানসিক যাত্রা করে স্বামী বিবেকানন্দ যেন শেষ পর্যন্ত উত্তীর্ণ হলেন। একমাত্র তিনিই লিখতে পারেন “অসীম একাকী আমি, কারণ মুক্ত আমি–ছিলাম মুক্ত, চিরদিন থাকব মুক্ত।…আঃ কি আনন্দ প্রতিদিন তাকে উপলব্ধি করছি! হাঁ, হাঁ, আমি মুক্ত, মুক্ত! আমি একা একা অদ্বিতীয়…হাঁ, এখন আমি খাঁটি বিবেকানন্দ হতে চলেছি।”