চতুর্দশ অধ্যায় – অর্থনৈতিক জীবনচর্যা : বাস্তবচিত্র ও প্রত্যাশা
সুলতানি রাজত্বকালের (১৩শ-১৫শ শতক) কৃষিজ এবং কৃষি বহির্ভূত উভয় ক্ষেত্রেরই অবস্থার যে পর্যালোচনা আমরা ইতিপূর্বেই করেছি তা ১৬শ ১৭শ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে আরও মজবুত হয়ে ওঠে। দেশে বহু নগর ও উপনগর গড়ে ওঠার মধ্যেই এই উন্নতির প্রতিফলন দেখা যায়। বেশিরভাগ প্রধান শহরেই বেশ কিছু বাজার থাকত, এবং তার ভিতর একটি হত প্রধান বাজার বা মাণ্ডি। ফ্রাইয়ার উদাহরণস্বরূপ বলছেন যে সুরাটে শুল্ক ভবন এবং টাকশালের মধ্যে একটি বাজারে যারা কাপড় বা বস্ত্রাদি ক্রয় বা বিক্রয় করতে আসতেন, তাদের ভিড় লেগে থাকত। আরও কিছুটা এগোলে বড়ো রাস্তার দুই পার্শ্বেই অনেক দোকান ছিল। তবে সুরাটের প্রধান বাজার ছিল শহরের ফটকগুলির বাইরে, আবার সবুজ ক্ষেত্র (ময়দানে) প্রবেশ পথেই ছিল ঘোড়া এবং গবাদি বাজার। এই প্রসঙ্গে মনে আসে যে আলাউদ্দিন খলজি দিল্লির সমস্ত বাজারেই মূল্য নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। শহরের বেশিরভাগ বাজার কেবল স্থানীয় খরিদ্দারদের পাইকারি ও খুচরা চাহিদা মেটাত শুধু তাই নয়, এগুলি আবার সকল প্রয়েজনীয় বস্তুর সঞ্চয়কেন্দ্রও ছিল। যেখান থেকে অন্যান্য কেন্দ্রের ব্যবসায়ীরা তাদের জিনিসপত্র সংগ্রহ করত। তাহলে দেখা যাচ্ছে এক শহরের সঙ্গে আর-এক শহরের মধ্যে এবং নগর ও উপনগরগুলির মধ্যে এক জটিল ব্যবসায়িক জাল তৈরি হয়েছিল।
অন্তর্দেশীয় বাণিজ্য
খাদ্য-শস্যের সরবরাহ দেশের অভ্যন্তরীণ শহরগুলির মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। খাদ্যদ্রব্য ছাড়াও গ্রামগুলি অনেক প্রয়োজনীয় কঁচা মাল, যথা তুলা, নীল, ইত্যাদি সরবরাহ করত শহরের উৎপাদন কেন্দ্রগুলিতে। এই সব ব্যবসা ছিল বানিয়া এবং বানজারাদের হাতে যারা এইসব খাদ্যশস্য কসবা বা বড়ো জনপদের, মান্ডিতে অর্থাৎ বাজারে পাঠিয়ে দিত। কয়েকটা গ্রামের মধ্যস্থলে অবস্থিত বড়ো গ্রাম বা কাটরাতেও মান্ডি থাকত। মান্ডিগুলিতে গ্রামবাসীরা তাদের উৎপন্ন দ্রব্য তো বিক্রি করতই, এ ছাড়া যে-সমস্ত বস্তু স্থানীয় ছোটো বাজারে পাওয়া যায়, যথা লবণ, গরম মশলা, লৌহ দ্রব্য ইত্যাদি ক্রয় করত। সুরদাস ইত্যাদি হিন্দি লেখকের লেখার মাধ্যমে আমরা গ্রাম্য জীবনের যে চিত্র পাই তাতে দেখি গ্রামের সমৃদ্ধতর শ্রেণির লোকজন নিত্য ব্যবহারের জিনিস ছাড়াও নানান বিলাসদ্রব্য ক্রয় করত যথা উঁচু মানের বস্ত্র, মণিরত্ন ইত্যাদি।
কোনো কোনো বস্তু বিশেষ করে একটি অঞ্চলেই প্রস্তুত হত, বিশেষ করে বিলাসদ্রব্যাদি। এর জন্য বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ বাণিজ্য হত। বানজারা নামে এক শ্রেণির বণিকদের বিশেষত্বই ছিল একসঙ্গে প্রচুর পরিমাণ বস্তুসামগ্রী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া। বানজারারা প্রকৃতপক্ষে একশ্রেণির আদিবাসী ছিল, যারা সপরিবারে হাজার হাজার ষণ্ডের পিঠে খাদ্যশস্য, ডাল, ঘি, নুন ইত্যাদি চাপিয়ে দূর-দূরান্তরে ভ্রমণ করত। তারা কখনো নিজেরাই এগুলো নিয়ে বাণিজ্য। করত, কখনো-বা বৃহৎ সওদাগরদের জন্যই তারা জিনিসপত্র নিয়ে যেত। অনেক সময় সৈন্যদলের খাদ্য সরবরাহের জন্য ৩০,০০০টি পর্যন্ত বলদের উপর মালপত্র চাপিয়ে প্রশাসনের নিযুক্ত প্রহরীর সুরক্ষায় সরবরাহ করা হত। অধিক মূল্যবান বস্তুসামগ্রী যথা বস্ত্রাদি, রেশম ইত্যাদিকে উট বা অশ্বতরের উপর চাপানো হত। কখনো-বা গাড়ি করেও নিয়ে যাওয়া হত। তবে অধিক পরিমাণের বস্তু পরিবহণ করার জন্য নদীবক্ষে জলযানে করে নিয়ে যাওয়ায় অনেক সস্তা হত। তখন নদীবক্ষে নৌকা বা জাহাজের চলন এবং সমুদ্র উপকূলে ব্যবসা বাণিজ্য বর্তমানের থেকেও সমৃদ্ধতর ছিল। জলপথ এবং উপকূলবর্তী বাণিজ্য পদ্ধতির মাধ্যমে বড়ো এবং ভারী বস্তুসামগ্রীর পরিবহণ বেশি করা হত। কেননা তুলনামূলকভাবে স্থলপথে এইসব বস্তুসামগ্রী স্থানান্তর করা হত আরও ব্যয়সাধ্য। এই সময় বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যেকার বাণিজ্যের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল খাদ্যদ্রব্য এবং নানাপ্রকার বস্তুসামগ্রী। বঙ্গদেশ থেকে চিনি চাল ছাড়া সূক্ষ্ম মসলিন এবং রেশমের বস্ত্র রপ্তানি করত। করমণ্ডল উপকূলও বস্ত্রশিল্পের একটি কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল এবং গুজরাটের সঙ্গে সমুদ্রের উপকূল বরাবর এবং দাক্ষিণাত্যের মধ্য দিয়েও এই বাণিজ্যপ্রবাহ সতেজে সঞ্চালিত হত। বৈদেশিক বস্তুসামগ্রীর প্রবেশদ্বার ছিল গুজরাট। এখান থেকে উত্তর-ভারতে সূক্ষ্ম বস্ত্র ও রেশমি বস্তু (পাটোলা) রপ্তানি হত। খাদ্যশস্য এবং রেশম আসত বঙ্গদেশ থেকে এবং মালাবার থেকে আসত বিদেশ থেকে আমদানি করা গোলমরিচ। উত্তর ভারত থেকে বিলাস বস্তু আমদানি করে নীল ও খাদ্যশস্য রপ্তানি করত। লাহোর ছিল হস্তশিল্পের এক উৎপাদন কেন্দ্র। তাছাড়া শাল, কার্পেট ইত্যাদি কাশ্মীরে উৎপন্ন বস্তুসামগ্রী এখান থেকে অন্যত্র প্রেরণ করা হত। পাঞ্জাব ও সিন্ধু নদীপথে তাদের বস্তুসামগ্রী পাঠাত। একদিকে কাবুল কান্দাহারের সঙ্গে আবার অপরদিকে দিল্লি ও আগ্রার সঙ্গে গুজরাটের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
বিলাস দ্রব্য এবং উপ-বিলাস দ্রব্যের একটি সুসংগঠিত বাণিজ্য জালিকা কার্যকরী ছিল, এবং আগ্রা ও বুরহামপুর উত্তর ভারতে যার দুটি গ্রন্থিবিন্দু রূপে অবস্থান করত। ১৮শ শতাব্দীতে আগ্রার গুরুত্ব হ্রাস হবার সঙ্গে বেনারস অন্যতম একটি গ্রন্থিবিন্দু রূপে আত্মপ্রকাশ করে। ঠিক যেমন দিল্লি ও আগ্রা যমুনা নদী দ্বারা পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল, তেমনি লাহোরেরও সুবিধা ছিল সিন্ধু নদীপথে জিনিসপত্র প্রেরণ করার। বঙ্গ থেকে উত্তর ভারতে রেশম এবং সূক্ষ্ম সূতি কাপড় এবং গুজরাট থেকে বিশেষ বস্তুসামগ্রী এবং সূক্ষ্ম সূতি বস্ত্র রফতানির বিষয় আমরা ইতিমধ্যে লক্ষ করেছি।
এ পর্যন্ত তাহলে দেখা গেল যে ভারতে বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে কেবল বিলাস বস্তুরই বাণিজ্য হত না। এই সমস্ত বস্তুর লেনদেন ব্যবস্থা যাতে সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, তার জন্য বড়ো বড়ো পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে স্থানীয় ও আঞ্চলিক স্তরে কর্মরত ব্যবসায়ীদের গোমস্তা ও দালালদের যোগসূত্র স্থাপন করে এক জটিল ও কার্যকরী শাখাজাল নির্মাণ করা হয়েছিল। যেসব ওলন্দাজ ও ইংরাজ ব্যবসায়ীরা ১৭শ শতকে গুজরাটে এসেছিলেন, তাদের মতে ভারতীয় বণিকরা ছিলেন সতর্ক (সপ্রতিভ) এবং কর্মঠ। ভিতরের, অর্থাৎ তখনও পর্যন্ত যেসব তত্ত্ব সকলের অবিদিত ছিল, সেই সব বাণিজ্যিক খবর জানবার জন্য তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলত এবং দেশের কোনো অংশে কোনো পণ্যদ্রব্যের চাহিদার খবর পাওয়া মাত্রই তা সত্বর পূরণ বা সরবরাহ করা হত।
অন্তর্দেশীয় বাণিজ্যের জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ এবং পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত রাজপথগুলি ব্যবহার করা হত। শের শাহের সময় থেকে শুরু করে পরবর্তী সব সম্রাটই এই পথগুলির উন্নতির চেষ্টা করে গেছেন। পরিবহণ ব্যবস্থা ছিল তৎকালীন ইউরোপীয় ব্যবস্থার সঙ্গে সন্তোষজনক ভাবে তুলনীয়। প্রধান রাজপথগুলিতে প্রতি আট দশ মাইল (১৩ থেকে ১৬ কি.মি) অন্তর অন্তর সরাই বা পান্থশালা নির্মাণ করা হয়েছিল। ট্যাভার্নিয়েরের মতে, স্থান থেকে স্থানান্তরে যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে ভ্রমণ। করার জন্য যেসব সুবিধা ফ্রান্স বা ইংল্যান্ডে উপলব্ধ ছিল, ভারতের ব্যবস্থাপনা তার থেকে কম আরামপ্রদ ছিল না। মালপত্র পরিবহণ করার জন্য মালবাহী বলদ বা ষাঁড়ে (বলদ?) টানা গাড়ি ব্যবহার করা হত, আর মানুষজন ঘোড়ায় চড়ে যাতায়াত করত। চারজন বা ছয়জন ভৃত্য-বাহিত একটি পালকি গাড়ি, অবশ্য বাহক বদল করে দিনে কুড়ি থেকে ত্রিশ মাইল (৩০ থেকে ৫০ কি.মি) পর্যন্ত লোকবহন করে নিয়ে যেতে পারত (অরিংটনের অভিমতে)। তবে সাধারণত একদিনে ৮ থেকে ১২ মাইল পথ অতিক্রম করা হত।
দেশে প্রচলিত আর্থিক সুব্যবস্থার জন্য পণ্যদ্রব্য পরিবহণ সুষ্ঠু হয়ে ওঠে, কেননা এই ব্যবস্থা দেশের এক অংশ থেকে অন্য অংশে অর্থ স্থানান্তরের বন্দোবস্ত ছিল। হুন্ডির মাধ্যমেই এই অর্থ স্থানান্তরিত করা যেত। হুন্ডি মানে এক ধরনের ঋণপত্র, যা হিসাব থেকে কিছুটা ছেড়ে দিয়ে কিছু সময়ের পরেও শোধ করা যেত। হুন্ডির মধ্যে অনেক সময় বিমার মূল্যও ধরা থাকত, অবশ্য পণ্যবস্তুর মূল্য, তার গন্তব্য, রাজপথ, নৃদী বা সমুদ্র কোথা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে ইত্যাদির উপর নির্ভর করে এই বিমার পরিমাণ স্থির করা হত। শরফ বা শ্রফ, যারা পেশাগতভাবে মুদ্রা পরিবর্তন করত বা টাকা ভাঙাত তারাই হুন্ডির বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিল। এইভাবে তারা আবার ব্যক্তিগত অধিকোষ (ব্যাংক) রূপেও কাজ করত। অভিজাতরা তাদের কাছে টাকা জমা রাখত যা আবার তারা ব্যবসায়ীদের হুন্ডির মাধ্যমে ধার দিত। এরা ধারে ক্রয়-বিক্রয়ের অবস্থা সৃষ্টি করত যার ফলে যে টাকা বাজারে বিনিযোগ হচ্ছে তার পরিমাণ বৃদ্ধি পেত। এরা বাণিজ্যের খাতে, বিশেষ করে দূরমাত্রিক এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করত। পণ্যবস্তু বা অর্থ উভয়েরই স্থানান্তরে প্রেরণের যে বিপদ, তা এর দ্বারা বহুলাংশে প্রকাশিত হত, কেননা বণিক তার গন্তব্য পৌঁছে এবং তার পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করেই তখন হুন্ডিকে ভাঙানো হত। এতে করে বাণিজ্যদ্রব্য এবং অর্থ উভয়েরই পরিবহণের বিপদ বহুলাংশে প্রশমিত হত। বিশেষ করে যখন বীরাজি। বোহরার মতো ধনী ব্যবসায়ীরা ভারতের বিভিন্ন স্থানে, যথা বুরহানপুর, গোলকুণ্ডা, আগ্রা এবং মালাবার উপকূলে, পশ্চিমে এশিয়ার পারস্য উপসাগরের উপকূলবর্তী। বন্দর নগরগুলিতে, লোহিত সাগরে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাঁদের দপ্তর খুলেছিলেন।
হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন এত ব্যাপক ছিল যে আহমেদাবাদ বাজারের বণিকেরা তাদের বেতনপত্র এবং অন্যান্য যা কিছু আর্থিক বাধ্যবাধকতা, সবই প্রায় হুন্ডির সাহায্যেই সম্পন্ন করতেন। এমনকি অভিজাতরাও তাদের সৈন্যদের বেতন মেটাবার জন্য হুন্ডির ব্যবহার করতেন।
বহির্বাণিজ্য বিদেশে সাগরপারে
১৫শ শতাব্দীর শেষ ভাগে পর্তুগিজদের ভারতে আগমনে পূর্বেকার এশীয় বাণিজ্যের বিশেষ করে বৈদেশিক বাণিজ্যের রূপরেখা আমরা ইতিমধ্যেই লক্ষ করেই। পর্তুগিজেরা যে জোর করে বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর তাদের প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছেন, এমনকি মশলাপাতি, ঘোড়া, অস্ত্রশস্ত্র, গরম মশলা ইত্যাদি বাণিজ্য থেকে সব (আরবীয়রা এবং সাধারণভাবে মুসলমান ব্যবসায়ীগণ) জাতীয় বণিকদের যথাসম্ভব বহিষ্কার করে নিজেদের একচেটিয়া অধিকার স্থাপন করার চেষ্টা করেছিল, তাও আমরা ইতিমধ্যেই লক্ষ করেছি। আমরা এও দেখেছি যে এই ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য ছিল সীমিত এবং ১৬শ শতাব্দীর মধ্যভাগে পর্তুগিজ এবং এশীয় বণিকদের মধ্যে মোটামুটি একটি বোঝাপড়া সম্ভব হয়েছিল। সমুদ্র বাণিজ্যের উপর পর্তুগিজদের আধিপত্য সম্বন্ধে অবহিত হয়ে ভারতীয় বণিকেরা তাদের জাহাজগুলির জন্য কোনো পর্তুগিজদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বন্দর থেকে শুল্ক কর প্রদান করে কারতাজ’ বা অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে বাধ্য হত। এই অনুমতিপত্র কিন্তু অবাধেই দেওয়া হত। ফরাসি ঐতিহাসিক ফার্নান্দ ব্ৰদেল উল্লেখ করেছেন যে পর্তুগিজরাই শুল্ক আধিকারিক হয়ে ওঠেন, এবং এই বাণিজ্য শুল্ক পর্তুগিজ উদ্যোগের একটি উৎস হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং পর্তুগিজরা ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠিত ধারার কোনো পরিবর্তন ঘটায়নি।
১৬শ থেকে ১৮শ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য নিশ্চিতভাবে বিস্তার লাভ করে। পণ্যদ্রব্য রপ্তানির আয়তন শুধু ওজনের নিরিখেই বেড়ে গিয়েছিল তা নয়, বাণিজ্য অনেক সম্পূর্ণ নতুন অঞ্চলে বিস্তৃত হয়। এর মধ্যে এমন স্থানও ছিল যেগুলিকে পূর্বে খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়নি। এর জন্য অবশ্য এই সময়কালে যে-সমস্ত বৈদেশিক সংস্থা ভারতে বাণিজ্যের জন্য এসেছিল। তাদেরও অবদান আছে। এদের মধ্যে ওলন্দাজ এবং ফরাসি এবং পরবর্তীকালে ইংরেজদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। অস্ট্রীয়ান, জর্মান এবং দিনেমারদের অবশ্য এই ব্যাপারে ভূমিকা ছিল সীমাবদ্ধ। এই সময়ে ব্যবসার পরিধি বর্ধিত হওয়ার আর-একটি কারণ হল এশিয়ায় অটোমান, সাফাভিদ এবং মুঘল এই তিনটি শক্তিশালী রাজশক্তির উত্থান। এ প্রসঙ্গে চীন দেশের মিং সাম্রাজ্যের কথাও বাদ দেওয়া যায় না। এইসব শক্তিশালী সাম্রাজ্যের সুশাসনে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য এবং উৎপাদনশিল্পের অনুকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়া ছাড়াও নগরায়ণ এবং নাগরিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অর্থ সরবরাহ ব্যবস্থা সৃষ্টির প্রকল্পগুলিও প্রভূত সাহায্য লাভ করে।
বিদেশি বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির ভুমিকা
১৭শ শতকের প্রারম্ভ ভারতে ওলন্দাজ ও ইংরেজ বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি এবং শতকের শেষ প্রান্তে ফরাসি বণিকদের আগমন বেশ কয়েকটি সত্যের দ্যোতক। প্রথমত, এশীয় বাণিজ্যিক পরিমণ্ডলে ভারতের গুরুত্বকে স্বীকার করে নেওয়া এবং এশীয় দ্রব্যবস্তুর উপর ইউরোপীয়দের ক্রমবর্ধমান আকর্ষণ। এই আকর্ষণ মূলত ছিল মশলাপাতি এবং তার থেকে সম্ভাব্য বিশাল লভ্যাংশের প্রতি। প্রথম থেকেই ওলন্দাজ এবং ইংরেজ পূর্বদেশীয় সংস্থাগুলির পরিকাঠামো পর্তুগিজদের থেকে ভিন্ন ছিল। এদের কোনোটিই রাজার একচেটিয়া সংস্থা ছিল বা সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণের দ্বারাও এগুলি বাধাপ্রাপ্ত হত না। এগুলি ছিল যুগ্ম মূলধন-বিশিষ্ট অথবা যুগ্ম বিনিয়োগ-ভিত্তিক সংস্থা। এগুলিকে বর্তমান কালের বহুজাতিক, বহু পণ্যভিত্তিক সংস্থাগুলির উত্তরসূরি বলা যেতে পারে। যেহেতু তাদের ব্যবসার পরিধি ছিল বিশ্বব্যাপী যার জন্য সারা বিশ্বে এদের সরবরাহ এবং বিপণনের ব্যবস্থা করা ছিল একটি স্বতঃসিদ্ধ বিষয়। এইভাবে তারা পর্তুগিজদের অপেক্ষা আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারত। তবে এর অর্থ এই নয় যে তারা দেশের প্রশাসনের থেকে সম্পূর্ণ ভাবেই দায়মুক্ত ছিল। উভয়েই দেশের অন্যান্য বাণিজ্যের অপেক্ষা একচেটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে আরও উপযুক্ত বিবেচিত হয় এবং সেই মর্মে তারা দেশের রাজাদের নিকট থেকে সনদও প্রাপ্ত হয়। এছাড়া এইসব সংস্থাগুলি তাদের প্রশাসনের থেকে নৌবহর-সংক্রান্ত সাহায্য আশা করত এবং সে সাহায্য তারা সর্বদাই পেয়ে থাকত। অবশ্য এইসব সম্মিলিত মালিকানার সংস্থাগুলির মালিকেরা তাদের দেশের সব প্রভাবশালী নাগরিক ছিলেন এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাঁদের বড়ো ভূমিকা ছিল। অর্থাৎ ওলন্দাজ ও ইংরেজ বণিকদের সঙ্গে পর্তুগিজ বণিকদের পার্থক্য মূলত আকৃতিতে ছিল, প্রকৃতিতে নয়। ফরাসি সংস্থাগুলি পর্তুগিজদের মতোই ছিল একচেটিয়া রাজসিক প্রতিষ্ঠান।
যেসব ইউরোপীয় সংস্থাগুলি ভারতে বাণিজ্য করত তাদের কার্যপদ্ধতি এবং ব্যবসায়িক লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে বহু সাদৃশ্য ছিল। তারা সকলেই একচেটিয়া বাণিজ্যে বিশ্বাস রাখত, এবং এই একাধিপত্য কায়েম করার জন্য নৌশক্তিকে কাজে লাগাতে তারা সর্বদাই প্রস্তুত ছিল। এই নৌশক্তির ব্যবহার করেই তারা স্থানীয় প্রশাসকের থেকে অনেক সুবিধা আদায় করে নিত যার ফলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অনেক অসুবিধায় পড়ত। অবাধে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাধীনতা এবং সকলকে সমান সুবিধা দেওয়ার যে নীতি এশিয়ায় প্রচলিত আছে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করার পরেই এই বিদেশি বণিকরা সেগুলি গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকার করে নেয়।
গরম মশলা, লবঙ্গ, জয়িত্রী, জায়ফল এবং গোলমরিচের বাণিজ্য নিজেদের আয়ত্তে আনার জন্য ওলন্দাজ ও ইংরেজ উভয় জাতির বণিকেরা প্রথমেই জাভা ও সুমাত্রায় নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দশকগুলি থেকেই ওলন্দাজ ও ইংরেজ বণিকেরা পূর্ব-ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জগুলিতে অনুসন্ধান চালাবার জন্য বাণিজ্যপোত প্রেরণ করতে শুরু করে। শ্লথগতি এবং ভারী পর্তুগিজ জাহাজের তুলনায় অনেক উন্নত শ্রেণির জাহাজ-সম্পন্ন ওলন্দাজরা শীঘ্রই জাভাতে তাদের বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করতে সক্ষম হয় এবং ১৬০৫ সালে তারা অ্যাম্বেনিয়া নামক পর্তুগিজ দুর্গটি অধিকার করে। তবে পর্তুগিজদের সম্পূর্ণ স্থানচ্যুত করতে তাদের আরও পঞ্চাশ বছর লেগে যায়। একথা উপলব্ধি করতে তাদের দেরি হয়নি পূর্ব-ভারতীয় দেশসমূহের সঙ্গে সফলভাবে বাণিজ্য করতে গেলে ভারতবর্ষকে বাদ দিয়ে তা সম্ভব নয়। তৎকালীন পূর্ব-ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের ওলন্দাজ-অধিকৃত অঞ্চলগুলির মুখ্য প্রশাসক হেন্ড্রিক ত্রুভার ১৬১২ সালে ঘোষণা করেন যে করমণ্ডলই মশলার দ্বীপ মালাক্কার বাম-হস্তস্বরূপ। এর কারণ করমণ্ডলে প্রস্তুত বস্ত্ৰসমূহ পূর্ব দ্বীপপুঞ্জে সবথেকে গ্রহণযোগ্য ছিল। এই গরম মশলার দ্বীপগুলিতে প্রচুর অর্থের সংস্থান ছিল না। তাই এই সব বস্ত্রাদি মশলার সঙ্গে বিনিময় হত। এই ওলন্দাজরাই প্রথমে করমণ্ডলে বসতি স্থাপন করার চেষ্টা করে। ১৬০৬ সালে তারা গোলকুণ্ডার শাসকের কাছ থেকে একটি ফরমান পায়, যাতে করে তাদের মসলিপট্টমে একটি কারখানা স্থাপন করে সুলভ মূল্যে বাণিজ্য করার অনুমতি দেওয়া হয়। পরে তারা বিজয়নগরের রাজা এবং কোনো-কোনো নায়কদের কাছ থেকে কৃষ্ণা ও গোদাবরী নদীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত পুলিকট-এ তাদের প্রধান কেন্দ্র স্থাপন করার অনুমতি লাভ করে। দ্বীপপুঞ্জগুলিতে জনপ্রিয় বেশিরভাগ সূতিবস্ত্রই এখানে প্রস্তুত হত।
ওলন্দাজদের গুজরাট পর্যন্ত বাণিজ্য বিস্তার করার প্রচেষ্টা পর্তুগিজদের নিকট থেকে কঠোর বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। এবং প্রথমত যেসব ভারতীয় ব্যবসায়ীগণ পর্তুগিজদের সঙ্গে একটি কার্যকরী বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন তারাও এই প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাননি। কিন্তু যখন পর্তুগিজরা সুরাটকে অবরোধ করার চেষ্টা করে তখন তাদের একাধিপত্য ভঙ্গ করার জন্য মুঘল শাসক এবং ভারতীয় বণিকেরা একযোগে ওলন্দাজদের অভ্যর্থনা করে নেন। সুরাট উপকূলের সন্নিকটে পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী ইংরেজদেরও একই কারণে সাদরে গ্রহণ করা হয়। ওলন্দাজরা ১৬১৭ সালের শুরুতে তাদের কারখানা খোলেন, ইংরেজরাও ১৬১৭ সালে সুরাটে একটি কারখানার উদ্বোধন করেন। কিন্তু জাহাঙ্গিরের দরবারে ১৬১৫ সালে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাজদূত স্যার টমাস রো ১৬১৮ সালে সুরাটে ইংরাজদের অবস্থান সুনিশ্চিত করার একটি ফরমান বা আদেশ জাহাঙ্গিরের কাছ থেকে অর্জন করেন।
বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তিগুলির মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং নৌশক্তির সংঘর্যের বিষয়ে আমাদের বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এই সবই ইউরোপীয় শক্তিগুলির প্রতিনিধিত্ব করত তাদের দেশে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি। ওলন্দাজেরা এশীয় বাণিজ্য ক্ষেত্র থেকে পর্তুগিজদের বিদায় দিয়ে উচ্চশ্রেণির মশলার বিপণনে নিজেদের একাধিপত্য সৃষ্টি করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। এর জন্য তাদের মালাক্কাকে নিজেদের আয়ত্তে আনা ছিল অবশ্য প্রয়োজনীয় এবং এই বিষয়ে তারা ১৬৪১ সালে সাফল্য অর্জন করে। ১৬৫৫-৫৬ সালে কলম্বো অধিকার করে এবং দীর্ঘস্থায়ী অবরোধের পর ১৬৫৯-৬৩ সালে মালাবার উপকূলের কোচিন অধিকার এনে তারা গরম মশলার বাণিজ্য সম্পূর্ণভাবে নিজেদের আয়ত্তে আনতে সফল হয়। পশ্চিম এশিয়ার বাণিজ্য ক্ষেত্রে অর্থাৎ পারস্য উপসাগর থেকে লোহিত সাগর পর্যন্ত ক্ষেত্রে পর্তুগিজদের নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটাবার জন্য ওলন্দাজেরা ১৬৬৩ সালে থেকে ১০ বছরের জন্য বাণিজ্যের মরশুমগুলিতে গোয়া অবরোধ করে রাখে। তবে মশলা বাণিজ্যের দীপপুঞ্জ থেকে পর্তুগিজদের বিতাড়ন করে, ওলন্দাজরা সেই সুযোগ যে ইংরেজদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চায়নি, তা অচিরেই ইংরেজরা বুঝতে পারে। ১৬২৩ সালে তথাকথিত অ্যামবইলা হত্যালীলায় দশজন ইংরেজকে অত্যাচার করে হত্যা করার পরেই পূর্ব ভারত দ্বীপপুঞ্জ ইংরেজদের অধিকার সমাপ্ত হয়। এই বিপদসংকেত পাওয়ার পরেই ইংরেজরা ভারতবর্ষ এবং পারস্য উপসাগর ও আরব সাগর অঞ্চলে বাণিজ্যের বিষয়ে মনোনিবেশ করতে বাধ্য হয়। ১৬২২ সালে একটি পারসিক যৌথবাহিনী হরমুজ থেকে পর্তুগিজদের বিতাড়িত করে। এই অঞ্চলের ব্যবসায়িক কেন্দ্র এর ফলে গমব্রুন ও বন্দর আববাসে স্থানান্তরিত হয়। এই সব ঘটনায় ভারতীয় বণিকেরা সরাসরি ভাবে উপকৃত হয়েছিল। কেমনা এই এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য করবার জন্য তাদের আর পর্তুগিজদের কাছ থেকে কারুকাজ কেনার প্রয়োজনীয়তা রইল না। পর্তুগিজরা গোয়া, দমন এবং দিউয়ে থেকে গেল বটে কিন্তু তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য যথেষ্ট ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এক নগণ্য অংশে পর্যবসিত হয়।
ওলন্দাজেরা তাদের মশলাপাতির বাণিজ্য থেকে বহিষ্কৃত করার পর ইংরেজরা। ইউরোপে নীল এবং ভারতীয় বস্ত্রাদি রপ্তানির ব্যবসা আরও বড়ো করে তুলতে সচেষ্ট হল। ইতিপূর্বে ইউরোপে পশমি কাপড় রং করার জন্য ‘ওয়াড ব্যবহার করা হত। কিন্তু এখন দেখা গেল যে নীল একটি উৎকৃষ্টতর রঞ্জক পদার্থ এবং এর মূল্যও কম। সর্বশ্রেষ্ঠ নীল গুজরাটের বায়ানিতে পাওয়া যেত। এবং করমণ্ডলের নীলও প্রচুর পরিমাণে রফতানি করা হত। তবে ১৮শ শতাব্দী থেকে পশ্চিম-ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের এবং আমেরিকার স্পেনীয় অংশ থেকে রফতানি করা আরও সস্তা নীলের সঙ্গে এই ভারতীয় নীলের তুমুল প্রতিযোগিতা শুরু হয়। প্রকৃতপক্ষে ১৯শ শতাব্দী পর্যন্ত এই উত্থান-পতন চলতেই থাকে।
ইংরেজরা ভারত থেকে ইউরোপে রফতানির জন্য প্রধানত বস্ত্রশিল্পের উপরই জোর দিতে থাকে। প্রথমের দিকে শ্বেতবস্ত্র এবং গুজরাটের রঙিন কাপড়ই (ক্যালিকো) ছিল সবথেকে জনপ্রিয়। সাদা বস্ত্র উত্তর আমেরিকা এবং লেভান্তে এবং পশ্চিম আফ্রিকার দাস ব্যবসায়ে ব্যবহৃত হত। কীর্তি চৌধুরীর মতে প্রাথমিক পর্যায়ে মূলত তাদের স্বল্পতর মূল্যের জন্য ভারতীয় সুতির কাপড় ইউরোপে এত জনপ্রিয় হয়, কারণ সেদেশে পশম-হীন যে বস্ত্র প্রস্তুত হত, তার মূল্য ছিল অনেক বেশি।শতকের চার ভাগের তিনভাগ অতিবাহিত হবার মধ্যেই ভারতীয় বস্ত্রসামগ্রীর জনপ্রিয়তা এতটাই প্রতিষ্ঠিত হয় যে বিলাসদ্রব্যের বাজারেও এই শ্রেণির বস্ত্রের বিপণন শুরু হয়ে যায়। ১৭শ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগের মধ্যেই ইংরেজ এবং ওলন্দাজদের রফতানি করা বস্ত্রের পরিমাণ নাটকীয় ভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৬৬৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ৭,৫০, ০০০ বস্তুসামগ্রী রফতানি করতে পেরেছিলেন। কিন্তু মাত্র দুই দশকের মধ্যেই এই সংখ্যা পনেরো লক্ষে পৌঁছে এই কোম্পানির বৈদেশিক বাণিজ্যের শতকরা ৮৩ ভাগ অধিকার করে নেয়। ১৬৮৪-৮৯-এ ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও ১১,২০,০০০ খণ্ড ভারতীয় বস্তুসামগ্রী বিক্রয় করেছিল, এই সময়ে এই বাণিজ্যের চরিত্রও পরিবর্তিত হয়ে যায়। প্রথমে গুজরাট সস্তা মানের সুতির সাদা ও ছাপা কাপড় রফতানি করত এবং এই বস্ত্র ইউরোপের নিম্ন আয়ের মানুষদের কাছে অবশ্যই পছন্দের ছিল। কিন্তু শৌখিনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মসলিন এবং করমণ্ডলের ছাপানো বস্ত্রের চাহিদা অভিজাত মহলের পরিধেয় হিসাবে যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। ১৬৪০ সালে মধ্যে করমণ্ডল থেকে রফতানি করা বস্ত্রের পরিমাণ গুজরাতের রফতানির সমান হয় এবং ১৪৪০ সালে মধ্যে গুজরাতের তিন গুণ হয়ে ওঠে। ওলন্দাজেরাও করমণ্ডল থেকে নীল এবং বস্ত্রাদি রফতানি করতে থাকে। কালক্রমে বঙ্গ এবং উড়িষ্যা থেকে নির্গমের পরিমাণ করমণ্ডলের উৎপন্ন বস্ত্রের রফতানির অঙ্ক অতিক্রম করে। ইউরোপে ভারতীয় বস্ত্রাদির বিপণনের উৰ্দ্ধগতির দরুন ফ্রান্স, জার্মানি এবং স্কটল্যান্ডে বস্ত্র শিল্প ও পশমশিল্প উভয়েই বিপন্ন হয়ে পড়ে।
১৭শ এবং ১৮শ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে ভারতীয় বস্ত্রের বিক্রির উপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করে, এমনকি ছাপা কাপড়ের আমদানি বন্ধ করেও বিশেষ কোনো ফল হয়নি। ১৭২০ সালের মধ্যে রঙিন কাপড়ের পরিবর্তে সাদা ভারতীয় সুতি বস্ত্রের আমদানির অঙ্ক বিশ লক্ষে পৌঁছায়। তবে সম্ভবত এইটিই ছিল সম্পৃক্তির অবস্থা, কারণ এরপর চাহিদা বিশেষ বাড়েনি। তবে একথা লক্ষণীয় যে ভারতীয় বস্ত্রদ্রব্যের আমদানিকে খর্ব করার উদ্দেশ্য নিয়েই নতুন যন্ত্রপাতি দিয়ে সুতো কাটা এবং বস্ত্রবয়ন শিল্পে আমূল পরিবর্তন আনার প্রথম প্রচেষ্টা করা হয় এবং এভাবেই ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়।
এ ছাড়া কাশিমবাজার থেকে কাঁচা রেশমের রফতানির কাজও ব্রিটিশরা সূচনা করে। পারস্য ছাড়াও ইটালি এবং ফ্রান্সের রেশমশিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামার জন্য ইংরেজরা এই ব্যবস্থা নেয়। ১৬৫০ সালের পর কাঁচা রেশমের রফতানি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ১৮শ শতাব্দীতে কার্পাস বস্ত্রের পর এটিই সর্বাপেক্ষা লাভজনক আমদানি শিল্প হয়ে ওঠে।
সোরা হচ্ছে আর-একটি পদার্থ যা এই সময়ে ইউরোপিয়ান কোম্পানিগুলির উদ্যোগে উন্নত গুণমান লাভ করে প্রচুর পরিমাণে রফতানি হতে থাকে। গোলা-বারুদ শিল্পে সেরা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত। বিশেষ করে ইউরোপীয় কামান বন্দুকে। আবার ইউরোপিয়ান জাহাজগুলির সঞ্চলন স্থির রাখার জন্যও সোরা ব্যবহার করা হত। সর্বশ্রেষ্ঠ গুণমানের যব ক্ষার বিহারে উৎপন্ন হত। তবে আজকের উত্তরপ্রদেশের পূর্বভাগে এবং গুজরাটেও সোরা উৎপন্ন হত।
সুতরাং ১৭শ শতাব্দী অবসানের পূর্বেই ইউরোপীয় বণিক সংস্থাগুলি দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ভারতীয় বিপণন ব্যবস্থার গভীরে প্রবেশ করেছিল। মুলতান এবং লাহোরে উৎপন্ন বস্তুগুলিকে সুবিধামূলক ভাবে নদীপথে সঞ্চালন করার জন্য ইংরেজেরা সিন্ধুনদীর মোহনায় অবস্থিত লাহরি বন্দরটিও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে দেখে।
১৬৮০ খ্রিস্টাব্দের পরে ইউরোপীয় বাণিজ্যিক বস্তুসামগ্রীর গুণগত, সংখ্যাগত এবং প্রকৃতিগত এক লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটে এবং সুতি কাপড়ের বস্ত্রাদি ও কাঁচা রেশম (সিল্ক) ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ৫০ শতাংশ অধিকার করে নেয়। এর কৃতিত্ব অবশ্য ব্রিটিশ ও ডাচ (ওলন্দাজ) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিরই প্রাপ্য। নাইলস স্টিনসগার্ড একেই একটি ‘এশিয়ান বাণিজ্যিক বিপ্লব আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে-সমস্ত সংস্থার উদ্যোগে এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে তারা কেউই প্রশাসনের একচেটিয়া অধিকারবর্তী নয়, এবং কোনো হিংসার প্রয়োগও তারা করেনি। পরন্তু । তারা বাজারের মজুতের অবস্থা অনুযায়ী যথাযথ নীতি অবলম্বন করে এবং বস্তু-সামগ্রী সরবরাহের সুচিন্তিত নীতি প্রয়োগ করেই এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। এর ফলেই বাজরের স্বচ্ছতা এবং তার ভবিষ্যৎ চরিত্র এরা উপলব্ধি করতে পেরেছে। এবং প্রচুর লাভও অর্জন করেছে। এ প্রসঙ্গে ওমপ্রকাশ বলছেন যে পরিবর্তনগুলি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এর সম্পর্কে স্টিনসগার্ড যা যা যুক্তি তাদের মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে চিন্তার অবকাশ আছে। যথা বহু বৃহৎ ভারতীয় এবং এশিয়ান বণিকগণও বড়ো বড়ো পণ্যাগার প্রতিষ্ঠা এবং বাজারের তাৎক্ষণিক এবং ভবিষ্যৎ চরিত্র নিরূপণ করার কার্যক্রম সচরাচর অনুসরণ করেই থাকতেন। ঠিক যেমন ইউরোপীয় বণিকেরা করেছেন বলে স্টিনসগার্ড উল্লেখ করেছেন। মূল্য নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ওলন্দাজ বণিকেরা স্থানীয় প্রশাসকদের সাহায্য নিয়ে মশলা দ্বীপ, মালাবার এবং শ্রীলঙ্কায়। একচেটিয়া ব্যবসা স্থাপন করে, উৎপাদক কর্মীদের অতি নূন এবং অন্যায্য মূল্য দিতেন। এই অংশটিকে অবশ্য একটি মুখ্য বাজার বলা যায় না। আসলে এটি ছিল পর্তুগিজদের (ডাচ) একটি পুনর্বণ্টন ভিত্তিক ব্যবসায়’ বা কর আদায় করার প্রক্রিয়া।
ওলন্দাজেরা আবার ইন্দোনেশিয়াতে গরম মশলা বাণিজ্যের ব্যাপারে অনুমতিপত্র পাস দেওয়ার ব্যবস্থা শুরু করেন এবং মালয় দেশে যাতে করে এশীয় প্রতিযোগীদের। এই একচেটিয়া ব্যবসায়ের ক্ষেত্র থেকে দূরে রাখা যায়। তারা আবার কার্যসিদ্ধির জন্য বলপ্রয়োগও করত। ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কোনো-কোনো বিচ্যুতি তারা সহ্য করে নিত, কেননা বণিকদের সঙ্গে খোলাখুলি সংঘর্ষে নামলে ভারতে ব্যবসা চালানোর ক্ষেত্রে তাদের অনেক ক্ষতি হতে পারে। এ জ্ঞান তাদের ছিল। এইজন্যই বহু ঐতিহাসিক নিয়ন্ত্রিত হিংসা পদটি অংশীদারী’ শব্দটি ব্যবহারের থেকে অধিক যুক্তিযুক্ত মনে করতেন।
ইংরেজ এবং ওলন্দাজরা যে এত দ্রুত ভারতীয় বিপণনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পেরেছিল তা তাদের সাংগঠনিক দক্ষতার জন্য নয় বা ভারতের শাসকদের সুনামের জন্যও নয়। এর মূল কারণ ছিল ভারতীয় অর্থনীতির উন্নত অবস্থা। দেশে সুসংবদ্ধ অর্থনীতি এবং ব্যবসায়িক ঋণের সুবন্দোবস্ত এবং উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থার জন্য ইউরোপীয় বণিকেরা দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সহজেই টাকাকড়ি এবং জিনিসপত্র পাঠাতে পারত এবং প্রয়োজন হলে ঋণগ্রহণও করতে পারত। কিন্তু তাদের মূল সমস্যা এই ছিল যে ইউরোপে তাদের রফতানি করা বস্ত্রের বিনিময় মূল্য হিসাবে তাদের মূলত সোনা ও রুপোই দিতে হত, কেননা ইউরোপীয় দেশগুলি যথেষ্ট পরিমাণে এবং সুবিধাজনক মূল্যে ইউরোপে প্রস্তুত জিনিসপত্র দিয়ে এই মূল্য পরিশোধ করতে পারত না। ওলন্দাজরা তাদের এশিয়া থেকে বাণিজ্যে প্রাপ্ত লভ্যাংশ দিয়ে বাণিজ্যের খরচ কিছুটা বহন করতে পারত। তারা ভারতে প্রস্তুত বস্ত্রসামগ্রী ইন্দোনেশিয়ায় বিক্রি করত সেখানকার গরম মশলার বিনিময়ে এবং সেই মশলা তারা ভারতে এবং ইউরোপে নিয়ে যেত। এই ব্যবসার উপর একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে, এবং ভারতীয় বণিকদের মশলা দ্বীপে বসতি স্থাপন করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ওলন্দাজরা সুরাটে প্রায় ১০০,০০০ পাউন্ড (মোটামুটি ৪৫ টন) বা ৪৫ টন মশলা বিক্রি করতে পারে। এর বিক্রয়মূল্য ছিল পূর্বেকার মূল্যের অনেক বেশি এবং ইউরোপের বিক্রয়মূল্য থেকে সামান্যই কম। ওলন্দাজরা ১৬৮৬ সাল পর্যন্ত জাপানে ভারতীয় কাঁচা রেশম বিক্রি করতে থাকে। পরে এই বস্তুর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলে পর তারা সেখানে ভারতীয় বস্ত্রাদি বিক্রয় শুরু করে। এর পরিবর্তে তারা। জাপান থেকে তামা এবং রুপো নিয়ে আসে।
১৭৪০ সাল পর্যন্ত তাদের বাণিজ্য নিশ্চিতভাবে ওলন্দাজদের থেকে নিকৃষ্টতর। হওয়ার জন্য ইংরেজরা তীব্র অভিযোগ জানাতে থাকে। ১৬৮৬ সালে সার জশুয়া । চাইল্ড এইভাবে মাদ্রাজ পরিষদকে লেখেন–”রাজস্ব ব্যতিরেকে ভারতে ইংরাজ জাতির অবস্থান নিশ্চিত এবং সুদৃঢ় করে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ভিত্তিভূমিতে প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। এ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেবল বণিক ব্যবসায়ী হয়েই এদেশে থাকব। খুশি হলেই ওলন্দাজেরা আমাদের বিতাড়িত করবে বা স্বদেশীয়রা সেইরকম সিদ্ধান্ত নিলেই আমাদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ওলন্দাজ এবং তৎপূর্বেকার পর্তুগিজদের মতো ইংরেজেরাও ব্যবসায়ের যেসব রীতিনীতি ভারতীয় এবং এশীয় বণিকেরা মেনে চলত এবং যার ফলে তারা সমগ্র দেশে অবাধে বাণিজ্য করতে পারত, সেগুলি স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিল না। প্রথমেই তারা তাদের বিপণন কেন্দ্র বা কারখানাগুলিকে কেল্লায় রূপান্তরিত করতে চেষ্টা করল, যাতে করে তারা শুধু স্বশাসনই উপভোেগ। করতে পারে না–পরন্তু সেই অঞ্চল বা দেশের শাসকদের বা অন্ততপক্ষে স্থানীয় প্রশাসকদের অগ্রাহ্য করতে পারে। এই মনোভাবের জন্য ১৬৩৩ সালে হুগলিতে শাহজাহানের সঙ্গে পর্তুগিজদের এবং ১৬৮৭ সালে ইংরেজদের সঙ্গে ঔরঙ্গজেবের সংঘর্ষ দেখা দেয়। কিন্তু ইংরেজ ও ফরাসিদের এ ছিল উচ্চাশার প্রথম পর্যায়। তারা দেশের অংশবিশেষ জয় করে নিতে চেয়েছিল। যাতে করে তাদের নিজেদের অধিকৃত অংশের রাজস্ব দিয়ে সম্পূর্ণ না হলেও উল্লেখযোগ্য ভাবে তাদের রফতানির খরচ মেটানো যেতে পারে। কিন্তু যখন মুঘল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়েছে এবং তাদের পরবর্তী রাজত্বগুলি নিজেদের মধ্যে দলাদলি ও ঝগড়াঝাটিতে মত্ত তখনই ইউরোপীয় সংস্থাগুলির এই আশা পূর্ণ হয়, এবং ইংরেজ এবং ফরাসি শক্তি দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেন।
মধ্য আমেরিকার খনি থেকে প্রাপ্ত প্রচুর পরিমাণ রুপো তাদের হাতে আসার পরেই ইউরোপীয়রা এশিয়ার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তাদের সঙ্গে বাণিজ্যের বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হয়। ফরাসি ঐতিহাসিক ফার্নান্ড ব্ৰদেলের যুক্তিতে নিজেদের হাতে এই রৌপ্যের নিয়ন্ত্রণ আসার পরেই ইউরোপীয়রা একটি শক্তিশালী গোষ্ঠীর স্বীকৃতি পায়। কিন্তু তার ধারণা ছিল যে এতদসত্ত্বেও তারা দূরপ্রাচ্যের অর্থনীতিকে কঠোর ভাবে কবজা করতে পারেনি। তবে আমেরিকান রুপোর সঙ্গে ইউরোপীয় এবং এশীয় অর্থনীতির এই সংযোগ স্থাপন ছিল ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির এক বিশেষ অবদান, এ ছিল বিশ্ব অর্থনীতির দিকে একটি পদক্ষেপ।
এই মার্কিনি রৌপ্যের প্লাবন বিশ্ব অর্থনীতিতে কী প্রভাব ফেলেছিল? ওয়লার স্টাইন-এর মতে, ‘যেহেতু এই অর্থসম্ভার ইউরোপে এসে পড়েছিল, তাই একে একটি প্রসারণশীল ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার এক মলিন, বহু ব্যবহৃত অর্থের দ্বারা নির্মিত ভিত্তিভূমি বলা যায়।’ তার মতে ভারতবর্ষে এ কেবল লোক-দেখানোর জন্যে বা আড়ম্বরের জন্যই ব্যবহৃত হত, যথা মন্দির, রাজপ্রাসাদ এবং এশীয় অভিজাত শ্রেণির ব্যক্তিদের বেশভূষার অলংকরণ’ অথবা জমিয়ে রাখা হত। তবে আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে যে এ ধারণা ভুল ছিল। কিছু সম্পদ জমিয়ে রাখা হবে বা লোক-দেখানো আড়ম্বর হিসাবে ব্যবহৃত হবে–এ এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু বেশিরভাগ ইউরোপীয় মুদ্রা বা রুপাকে গলিয়ে নতুন করে মুঘল মুদ্রায় রূপান্তরিত করা হয়। অর্থ সরবরাহের এই প্রাচুর্যের জন্য দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুদ্রার সংখ্যা। বৃদ্ধির প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হল। কৃষি করের এক বৃহৎ অংশ এখন মুদ্রার মাধ্যমে দেওয়া হতে লাগল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজস্ব অন্য মাধ্যমে দেওয়া হলেও গ্রামের বেনিয়ারা তাকে অর্থে রূপান্তর করে নিতে থাকেন। অর্থকোষ বা ব্যাংকের মালিক। শরফদের কাছে আরও অধিক পরিমাণে টঙ্কা জমা পড়ায় তা দিয়ে আরও বেশি হুন্ডি করতে লাগলেন। বস্ত্র দ্রব্যাদির ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাবার জন্য বস্ত্রশিল্পীদের এই উৎপাদন বৃদ্ধি বিশেষ সহায়ক ভূমিকা নেওয়ায় ব্যবসায়ীরাও উপকৃত হলেন।
ওমপ্রকাশ এই বলে শেষ করছেন–”উৎপাদকতা, আয় এবং কর্মসংস্থানের বৃদ্ধির সুবিধাগুলি কেবল মধ্যবর্তী বণিক শ্রেণিরাই যে উপভোগ করত, তা নয়। বস্ত্রশিল্পী, তন্তুবায় এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের কাছেই এর সুফল উপলব্ধ হত।
১৭৪০ সালে পরেই এই অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়। ইংরেজরা অন্যান্য পথে গিয়ে ভারতীয় বণিকদের সঙ্গে প্রবঞ্চনা শুরু করে। এমনকি বলপ্রয়োগ করে। কারুশিল্পী বা কারিগরদের তাদের উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্য হ্রাস করতে বাধ্য করে।
ভারত মহাসাগরের সামুদ্রিক বাণিজ্যে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের ভূমিকা
ভারতীয় বণিক সম্প্রদায় এবং ভারতীয় সমুদ্রপোতগুলি সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে সামুদ্রিক বাণিজ্য থেকে অপসারণের কারণ হিসাবে পূর্বতন ঐতিহাসিকদের কয়েকটি বিশ্বাস ছিল। যথা, বিভিন্ন ইউরোপীয় বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির তৎপরতা, ভারত মহাসাগরে তাদের একাধিপত্যের প্রতিষ্ঠা। এছাড়া ইউরোপীয়দের কুশলতা এবং সম্পদ আবার ভারতীয় শাসক সম্প্রদায়ের প্রাচ্যদেশ-সুলভ উদাসীনতা এবং ভারতীয় বণিকদের স্বার্থ রক্ষায় তাদের অমনোযোগিতা। তাদের এই বিশ্বাস ও যুক্তি কিন্তু আজকে প্রধানত পরিত্যক্ত হয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণার ফলে দেখা গেছে যে, ভারতীয় বণিকদের সামুদ্রিক ব্যবসা থেকে সরিয়ে দেওয়া দূরে থাক, ভারতের বিভিন্ন অংশে বিশেষত গুজরাট করমণ্ডল এবং বঙ্গদেশে সামগ্রিক বাণিজ্যের এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র ইউরোপীয়দের অধিকারে ছিল (অর্থাৎ এর বৃহদংশই ছিল ভারতীয়। বণিকদের করায়ত্ত) এবং একমাত্র এদেশে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবার পরেই ভারতীয় ব্যবসায় এবং সামুদ্রিক বাণিজ্যের অবনমন ঘটে এবং বণিকেরা বিদেশি সমুদ্রপোতগুলি নৌ-বাণিজ্যের অধিকার ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ভারতীয়। ব্যবসায়ীবৃন্দ এবং সুরাটের পতন ১৭০০-১৭৫০’ গ্রন্থে অশীন দাসগুপ্ত হিসাব করে দেখিয়েছেন যে ১৭শ শতাব্দীর শেষে সুরাটের বাৎসরিক ব্যবসার পরিমাণ ছিল ১৬০ লক্ষ টাকা, যার মধ্যে ইউরোপীয়দের অংশ ছিল কেবলমাত্র ২০ লক্ষ টাকা যা আটভাগের একভাগ মাত্র। তবে এ সমস্ত হিসাব থেকে কেবল একটি ধারণা মাত্র পাওয়া যায় যেহেতু ভারতীয় বাণিজ্য সম্বন্ধে কোনো যথাযথ পরিসংখ্যান নেই। ঐতিহাসিকদের তাই ইউরোপীয় পরিসংখ্যানের উপর নির্ভর করা ছাড়া বিশেষ কোনো উপায় থাকে না। এই ইউরোপীয় পরিসংখ্যানে তাদের নিজস্ব প্রতিনিধিদের ব্যক্তিগত ব্যবসার কোনো অঙ্ক থাকে না, যদিও তার পরিমাণ নেহাত কম ছিল না, আবার ভারতীয় বণিকদের পর্যাপ্ত পরিমাণের সামুদ্রিক বাণিজ্যেরও কোনো হিসাব পাই না।
আমরা ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন অংশে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের উদ্যোগী কুশলতা এবং সাংগঠনিক ক্ষমতার কথা উল্লেখ করেছি, কিন্তু যেসব ভারতীয় ব্যবসায়ী বৈদেশিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদের সম্বন্ধে বিশেষ কোনো খবরও পাওয়া যায় না। ভারতীয় বৈদেশিক বাণিজ্যকারীদের কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়। জাহাজের মালিক এবং পরিচালকগণই ছিল ভারতীয় সামুদ্রিক বাণিজ্যের মেরুদণ্ড-স্বরূপ যাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল উপকূল-দেশী এবং সুদূরপ্রসারী বাণিজ্য। জাহাজের মালিকদেরও আবার কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেত। একদিকে ছিলেন বিশাল। ব্যবসায়ীরা, এরা অনেকগুলি জাহাজ বা নৌবহরের মালিক ছিলেন। এই জাহাজগুলি একটি মূল বন্দরেই নোঙর করা থাকত। যথা সুরাট বা মসলিপট্টনম বা অনেক সময়ে দক্ষিণ এবং মধ্য করমণ্ডলে অথবা বঙ্গ এবং উড়িষ্যার ইত্যাদি প্রদেশের মতো সমষ্টিগতভাবে কয়েকটি বন্দরই এগুলির পোতাশ্রয় রূপে ব্যবহৃত হত। এই ধরনের ব্যবসায়ীদের উদাহরণস্বরূপ সুরাটের আবদুল গফফর মসলিপত্তমের কামাল-উদ-দীন এবং দক্ষিণ করমণ্ডলস্থিত পুলিকটের অস্ত্রাপ্পা চেট্টির নাম উল্লেখ করা যায়। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সর্বাধিক প্রতিপন্নসম্পন্ন বণিক ছিলেন আবদুল গফফর এবং এই সময়ে বাণিজ্যিক কাজকর্মও তুঙ্গে উঠেছিল। শোনা যায় তার ২০ টি জাহাজ ছিল এবং সেগুলি সম্মিলিতভাবে জাহাজের ওজন সহ ৫০০০ টন বাণিজ্য দ্রব্য বহন করতে পারত। অর্থাৎ তিনি সুরাটের যে-কোনো ইউরোপীয় সংস্থার সহজেই মোকাবিলা করতে পারতেন। ম্যানিলা থেকে মোচা পর্যন্ত তার ব্যবসায়ের পরিধি ছিল এবং তার জাহাজগুলির পরিচালকদের (নাখুদা) উপর তাঁর কঠোর দৃষ্টি ছিল। সুরাট থেকে যাত্রা শুরু করার সময় তারা পোত সঞ্চালন এবং ব্যবসায় সংক্রান্ত যা-যা নির্দেশ পেতেন তার থেকে তারা ঘুণাক্ষরেও থেকে বিচ্যুত হতেন না। মাথাপিছু পাঁচ থেকে দশটি জাহাজ-সম্পন্ন আরও আরও কয়েকজন সাগরপোতের মালিক সামুদ্রিক বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আবার একক মালিকানার কিছু জাহাজ নিয়মিত সমুদ্র যাত্রা করত। সচরাচর জাহাজের যৌথ মালিকানা বিশেষ দেখা যেত না এবং জাহাজের মালিকানা একটি বিশেষজ্ঞ-সুলভ কাজ বলে স্বীকৃত ছিল। এটি একটি সাধারণ ব্যবসা বা পেশা ছিল না। বেশিরভাগ জাহাজের মালিক মুসলিম কিন্তু এই ব্যবসাতে হিন্দুদের কোনো অনীহা ছিল না। বহুপোত বিশিষ্ট ব্যবসায়িক সংস্থাগুলি পরিবারের প্রধানের নিয়ন্ত্রণে কাজ করত এবং তারা দেশের কোনো প্রধান বন্দরে বাস করতেন। এই সমস্ত বণিকদের কাজে সাহায্য করতে বা তাদের জাহাজ চালানোর জন্য তাদের আত্মীয়রা তো সঙ্গে থাকতেন-ই, এছাড়া প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র এবং শহরগুলিতে তার নিজস্ব বেতনভুক কর্মচারী ও স্থায়ী প্রতিনিধিদের নিযুক্ত করতেন যাঁদের কাজ ছিল জাহাজগুলিতে রফতানিযোগ্য জিনিসপত্র সরবরাহ করা। আবার সাগরপারের যে-সমস্ত বন্দরে তাদের জাহাজ পসরা নিয়ে পৌঁছোত, সেখানেও মালিকের নিজস্ব মাইনে করা কর্মচারী ও পেশাদারি প্রতিনিধিরা ব্যবসায়ের কাজকর্ম সম্পন্ন করত এবং বাজারের চাহিদা-সংক্রান্ত খবরাখবর তার কাছে পৌঁছে দিত। এইভাবে ভারতীয় নৌব্যবসায়ীরা বন্দর আব্বাস, বসরা, মালাক্কা, আছে, বান্টাস ইত্যাদি বন্দরে তাদের নিজস্ব প্রতিনিধি রাখতেন। আবার যেসব বণিকেরা একটি মাত্র জাহাজের অধিকারী ছিলেন তারা প্রায়ই মালপত্র সমেত নিজেরাই থাকত এবং প্রতি বন্দরেই তাদের বিশেষ নজর দেওয়া হত। নাখুদা অর্থাৎ একাধারে জাহাজের ক্যাপ্টেন বা পরিচালক এবং ব্যবস্থাপকগণ নানা প্রকার সুবিধা ভোগ করতেন। আসলে এঁরা অনেকেই নিজেরাই সম্পন্ন ব্যবসায়ী ছিলেন, জাহাজে সমুদ্রযাত্রা-কালে এবং বন্দরেও এই খুদাগণ অনেক অধিকার উপভোগ করতেন।
আবার এইসব জাহাজ মালিকরা ব্যবসায়ীদের থেকে অনেক বৃহত্তর বাণিজ্যশক্তির অধিকারী আর-এক শ্রেণির নৌব্যবসায়ী ভারত থেকে সাগরপারের বিদেশি বন্দরগুলিতে বাণিজ্য করতেন। এঁদের নিজস্ব কোনো জাহাজ ছিল না, কিন্তু প্রয়োজনে অন্যদের থেকে জাহাজ ভাড়া নিয়ে এঁরা নিজেদের বা অন্যের হয়েও বাণিজ্য করতেন। এই সময়ে ভারতে বৈদেশিক নৌবাণিজ্যের অধিকাংশই এই শ্রেণির বণিকদের হাতে ছিল। নৌবাণিজ্যের অবকাশ বৃদ্ধির জন্য এদের নিরন্তর চাপেই নতুন নতুন জাহাজ নির্মাণ শুরু হয় যাদের মধ্যে ১০০০ টন মাল পরিবহণের উপযুক্ত বিশাল জাহাজও ছিল। আমরা শুনেছি যে সুরাটে সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশ। ১৬৫০ সালে মুঘল বাদশাহরা আদেশ দেন যে প্রতি বছরে ছয় থেকে আটখানি বেশ শক্তসমর্থ জাহাজ যেন অবশ্যই নির্মাণ করা হয়। ঔরঙ্গজেব যতদিন না তা বন্ধ করে দেন ততদিন এই পোত নির্মাণকার্য চলেছিল। যাই হোক, ১৭শ শতাব্দীর প্রারম্ভে সুরাটে ১১২টি সমুদ্রগামী জাহাজ ছিল।
তাছাড়া আরও একটি শ্রেণির নৌব্যবসায়ীগণ তখন ভারতবর্ষে সক্রিয় ছিলেন। যে সমস্ত বাদশাহ (সম্রাট), শাহজাদা (যুবরাজ), রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্য সম্পন্ন অধিকারিক ও সেনানায়কগণ এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের সদস্যবৃন্দ বাণিজ্যে উৎসাহী ছিলেন, তাদের নিয়েই এই তৃতীয় শ্রেণিটি গঠিত হয়েছিল বলা যায়। মুঘলরা ছাড়াও বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার শাসকগণ এবং ইক্কেরী, থাঞ্জাভুর, মাদুরাই ইত্যাদি দাক্ষিণাত্যের ক্ষুদ্র আয়তনের হিন্দু রাষ্ট্রসমূহ এঁরাও এই নৌবাণিজ্যে অংশগ্রহণ করেন। কালিকট, কোচিন, কানানোর, ত্রিবাঙ্কুর ইত্যাদি মালাবার উপকূলবর্তী রাজ্যগুলির শাসকেরাও পরম্পরাগত ভাবে বাণিজ্যে নিযুক্ত ছিলেন। তবে এরা বেশিরভাগই প্রতিষ্ঠিত বণিকদেরই তাদের বাণিজ্যে নিয়োগ করতেন। অনেক প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শাসকেরাও তাদের জাহাজ নিয়োগ করে ভারতীয় বন্দরগুলিতে বাণিজ্য করতে আসতেন। উদাহরণস্বরূপ আয়ুথিয়া, আরাকান, আছে, জোহোর, বানটাম ইত্যাদির নাম উল্লেখ করা যায়। আবার দুই দেশের শাসকেরা পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই জাহাজগুলি যাতে জিনিসপত্র বোঝাই করেই ফিরতে পারে সেইজন্য পণ্যদ্রব্যের ব্যবস্থা করতেন।
এই কয়টি প্রধান শ্রেণি ছাড়াও বন্দরগুলিতে এবং তার সংলগ্ন পশ্চাদভূমিতে বহুসংখ্যক বণিক কর্মরত ছিলেন। এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন পাইকারি ব্যবসায়ী যাঁরা বিশেষ করে জিনিসপত্রের আমদানি-রফতানির উপর নির্ভর কুরতেন। তারা জাহাজ থেকে একসঙ্গে প্রচুর সামগ্রী ক্রয় করে নিতেন, এমনকি কখনো-কখনো জাহাজের সমগ্র পণ্যের জন্যও চুক্তি করতেন। তারা এই সমস্ত বস্তুসামগ্রী নিজেদের গুদামেই রেখে দিতেন এবং সঠিক দাম পেলে ছোটো ছোটো অংশে সেইগুলি বাজারে বিক্রি করতেন। বন্দরের নিকটস্থ এলাকায় এই সমস্ত মালপত্র বিক্রির জন্য তাদের নিজেদের লোক (দালাল) থাকত। ইউরোপীয় বণিকদের আনা গরম মশলা, তামা, টিন, বড়ো বহরের কাপড় ইত্যাদি এঁরা পাইকারিভাবে কিনে নিতেন। যেমন সুরাটের বীরজি বোহরা মালাবার এবং কানারা থেকে প্রচুর গোলমরিচ আমদানি করতেন। সেই রকম সুরাটের আহমেদ চেলাবি ও দক্ষিণ করমণ্ডলের মলয় চেট্টি, কাশি ভিরান্না এবং সুনকা রাম ইত্যাদিরা বিশাল বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন। সম্পদ এবং ক্ষমতার নিরিখে এঁরা ইউরোপের যুবরাজ-প্রতিম ব্যবসায়ীদের সমকক্ষ ছিলেন। এ প্রসঙ্গে অন্যান্য যেসব শ্রেণির মানুষদের কথা আমরা আলোচনা করেছি তারা হলেন দালাল, মধ্যবর্তী ফড়িয়া মহাজন, শ্রফ ইত্যাদি।
যে সমস্ত ভারতীয় বণিকেরা আন্তর্জাতিক ব্যবসায় নিযুক্ত ছিলেন, হল্যান্ডের ঐতিহাসিক ভ্যান লিউর তাদের ফেরিওয়ালা বলতেন। কেননা তারা বিক্রি করার জন্য। এক বাজার থেকে আরেক দেশের বাজারে মালপত্র বয়ে নিয়ে বেড়াতেন। বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরই এই নামে ডাকা যায়, অনেক সময়ে যাঁরা ৫০০ জন পর্যন্ত একই জাহাজে তাদের বিক্রয় দ্রব্য নিয়ে যাতায়াত করতেন। সব ভারতীয় বণিকদেরই ফিরিওয়ালা বলা যায়, একথাও অনেকে বলেছেন। তাদের যুক্তি ছিল তারা যেসব শক্তি বা উৎসের উপর নির্ভরশীল। যার উপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। (অশীন দাশগুপ্ত) তাদের পণ্যাগার (গুদাম) সমূহ এবং প্রতিনিধিদের বা নিযুক্তদের সমন্বয়ে তারা বাজারে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলেও মন্তব্য করা হয় এবং মূল্য বৃদ্ধি বা হ্রাসে তাদের নিয়ন্ত্রণ অনেক ভালো ছিল। কিন্তু উপযুক্ত পণ্যাগার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল সব বড়োমাপের বৈদেশিক বাণিজ্যের মূল কথা। এবং বহু এশীয় বণিকদেরই এই ব্যবস্থা ছিল এবং বাজারের ভিতরের খবর সরবরাহের জন্য তাদের অনেক নিয়ন্ত্রণও ছিল। কিন্তু বাজার ছিল পরিবর্তনশীল এবং ইউরোপীয় সংস্থাগুলিও উৎপাদকদের উপর বাধ্যবাধকতা প্রয়োগ না করে দ্রব্যমূল্যকে স্থির রাখতে পারত না।
আমরা আগেই দেখেছি যে পর্তুগিজদের পদার্পণ সত্ত্বেও ভারতীয় পণ্যদ্রব্যের সংগঠনের বা কাঠামোর কোনো পরিবর্তন হয়নি। সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব টম পিরেস যেমন দেখিয়েছেন কাম্বের উপসাগর দুটি বাহু বিস্তার করেছে। একটি এডেনের দিকে এবং অপরটি মালাক্কার দিকে নির্দেশ করে। এই উক্তিটি ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় অবস্থান পরিস্ফুট হয় এবং পূর্ব-ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং অপরদিকে পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুজরাটের গুরুত্বও বোঝা যায়। পর্তুগিজেরা সমগ্র মশলার ব্যবসা নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে আসার এবং ভারতীয়, আরব, জাপানি ইত্যাদিদের এশীয় বাণিজ্যের থেকে বহিষ্কার করার যে প্রচেষ্টা করেছিল তা নিষ্ফল হয় এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুজরাটি বণিকদের কর্মব্যস্ততা অব্যাহত থাকে। লোহিত সাগরের মোহনায় এডেন বন্দর অধিকার করার পর্তুগিজদের চেষ্টা প্রতিহত হবার পর মালাবার, গোয়া, কাম্বে এবং আরব-অধিকৃত লোহিত সাগরের বন্দরগুলির সঙ্গে। বাণিজ্যে লিপ্ত থাকে। পূর্ব দ্বীপপুঞ্জে মশলা উৎপাদক দ্বীপগুলির সঙ্গে এবং মালাক্কা, শ্যাম (থাইল্যান্ড) ইত্যাদির সঙ্গে করমণ্ডলের ব্যবসা চলতে থাকে। কিন্তু মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের দৌরাত্ম্যে বঙ্গদেশের নৌবাণিজ্য বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
স্টিন গার্ডের পর্যবেক্ষণ অনুসারে আমরা যদি ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের ভারত মহাসাগরে বাণিজ্যিক অক্ষপথের দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে দেখা যাবে লক্ষণীয় ভাবে সেখানে ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রয়েছে। গুজরাট তখনও কেন্দ্রীয় অবস্থানে। বিরাজমান। তার হাত দুটি তখনও লোহিত সাগর এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে বিস্তৃত রয়েছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিক যুক্তি দিয়েছেন যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ওলন্দাজ-কর্তৃত্ব স্থাপন এবং উচ্চ মানের গরম মশলার বাজার নিয়ন্ত্রণে তাদের স্থির-প্রতিজ্ঞার জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে গুজরাটি বাণিজ্যের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণার ফলে এ তথ্য ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সুরাটে ওলন্দাজদের কারখানা এবং নূতন রাজকীয় গুজরাট বন্দরের প্রতিষ্ঠা এবং তাদের বস্ত্রশিল্প এবং নীলের ব্যবসায়ের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ওলন্দাজরা উপলব্ধি করলেন যে গুজরাটি বণিকদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজার থেকে বিতাড়িত করার জন্য তাদের উপর দ্রব্যমূল্যের দশ কি বিশ শতাংশ করতাজ বা শুল্ক ধার্য করে বা তাদের ব্যবসা থেকে সম্পূর্ণ বিতাড়ন করলে সুরাটের সমগ্র বাণিজ্যই ওলন্দাজদের হস্তচ্যুত হবে, যার মূল্য সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যের থেকে বৃহত্তর। সুতরাং সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে গুজরাট আবার হাত বাড়াল। কিন্তু এ হাত ছিল। বীতশক্তি, দুর্বল। ওলন্দাজরা কলম্বো ও কোচিন অধিকার করে নেওয়ার পর গোয় ও লোহিত সাগরে মালাবারি বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নাগাপটম, পুলিকট ইত্যাদি, করমণ্ডল উপকূলবর্তী বন্দরসমূহও আছে (উত্তর সুমাত্রা), আরাকান, বানটাম, বঙ্গদেশ, বার্মার মায়ানমারের অন্তর্গত পেগু, মালাক্কা, ম্যানিলা (ফিলিপাইনস) এবং মালয় উপদ্বীপে তাদের বাণিজ্য বিস্তার করে। শায়েস্তা খান চট্টগ্রাম এবং উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকে মগ এবং পর্তুগিজ জলদস্যুদের বিতাড়ন করার পরে বাংলাদেশের বাণিজ্যও আবার উজ্জীবিত হয় এবং আরাকান, বর্মা, শ্যাম এবং পারস্য উপসাগর এবং লোহিত সাগরের বন্দরগুলির সঙ্গে বঙ্গদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
তবে এই সময়ের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল পশ্চিম এশিয়ার বন্দরগুলির সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যের পরিবর্ধন। পর্তুগিজদের সঙ্গে সমঝোতা হবার পরে অবশ্য ভারতীয় বণিকদের পশ্চিম এশিয়ায় বাণিজ্য করার অনুমতিপত্র সহজেই দেওয়া হত, তবুও হরমুজে পর্তুগিজ আধিপত্যের জন্য ভারতীয়রা বসরা থেকে দূরেই থাকত। পর্তুগিজদের দুর্বল করে দেবার জন্য ইংরেজ ও ওলন্দাজ বণিকেরা বিনা দ্বিধায়। ভারতীয় পণ্যসামগ্রী তাদের জাহাজে বোঝাই করে পশ্চিম এশিয়ার বন্দরগুলিতে বহন করত। ১৬২২ খ্রিস্টাব্দে একটি ইঙ্গ-পারসিক যৌথ বাহিনী হরমুজ অধিকার করে নেওয়ার পরে উপসাগরীয় বাণিজ্য আরও সাবলীল হয়ে উঠল। হরমুজ থেকে বাণিজ্যের কেন্দ্র এখন গমরুনে স্থানান্তরিত হল এবং এর নামকরণ করা হল বন্দর আব্বাস।
ভারতীয় বণিকেরা তখন এডেনে নিজেদের ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছিল এবং এখান থেকে তারা লোহিত সাগর অঞ্চলে এবং মাসওয়া, মাগাদিসু ইত্যাদি পূর্ব আফ্রিকার বন্দরগুলিতে স্বচ্ছন্দে বাণিজ্য সম্পাদন করতে পারত। এই সময় বাণিজ্যিক কেন্দ্র এডেন থেকে স্থানান্তরিত হয়ে ইয়েমেন উপকূলে মোচাতে (অথবা মোখায়) স্থাপিত হল। ইরানের সাফাভিদগণ এবং অটোমান তুর্কি প্রশাসকেরা আরব দেশে, মিশর এবং ইরাকে রাজপথে পরিবহণের সুরক্ষা নিশ্চিত করার ফলে ভারতীয়, বিশেষ করে বস্ত্র শিল্পের বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। সাফাভিদদের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্কের জন্য গোলকুণ্ডার প্রধান বন্দর মসলিপট্টনম থেকে বণিকেরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপসমূহে এবং স্থলভাগে তাদের প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্য ছাড়াও এবার পশ্চিম এশিয়ার বন্দরগুলির সঙ্গে নৌবাণিজ্য শুরু করল।
আরও দুটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিম এশিয়ার বন্দরগুলিতে বাণিজ্যের পরিমাণ সমধিক বৃদ্ধি পায়। সুরাট গুজরাটের প্রধান বন্দর বলে আত্মপ্রকাশ করে। প্রসঙ্গত, সুরাটের বিস্তীর্ণ পশ্চাদভূমি গাঙ্গেয় সমভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং সিন্ধুদেশ ও পাঞ্জাব থেকেও সুরাটে বস্ত্রাদি নিয়ে আসা যেত। পশ্চিম এশিয়ায় এই সব বস্তুসামগ্রীর যথেষ্ট চাহিদা ছিল। সিন্ধু নদীপথে এইসব তন্তুজ বস্ত্র লাহিরি বন্দরে এসে পৌঁছোত। আবার হজযাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য ভারতীয় বণিকদের মক্কা পর্যন্ত হেজাজ অঞ্চলে ব্যবসার সুবিধা উৎপন্ন হল। আর দ্বিতীয় ঘটনা ছিল ইয়েমেন থেকে কফির রপ্তানি শুরু হওয়া। এই কফির জন্য তুর্কি এবং আরব ব্যবসায়ীরা মোচাতে এসে সেই কফি আবার ইউরোপে রপ্তানি করে বহুদূর বিস্তীর্ণ অটোমান সাম্রাজ্যে এর সরবরাহ করত। যদিও ভারতীয়েরা বেশি কফি ক্রয় করত না, তারা কিন্তু মোচায় আসত তাদের বস্ত্রাদি বিক্রির জন্য এবং সুরাটে নৌবাণিজ্যের সমৃদ্ধির মূল কারণ ছিল পশ্চিম এশিয়ায় রপ্তানির আয়তন বৃদ্ধি।
ওলন্দাজ এবং ইংরাজ বণিকদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও ভারতীয় বণিকেরা যে দক্ষিণ-পূর্ব পশ্চিম এশিয়ায় বাণিজ্য-কার্যে সফল হতে পেরেছিলেন তার বেশ কয়েকটি কারণ আছে। ভারতীয় বণিকেরা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মাত্র লাভের আশায় ব্যবসা করত। অপরদিকে ইংরাজ ও ওলন্দাজ বণিকদের কাছে ৪০ শতাংশের থেকে কম লভ্যাংশ গ্রহণযোগ্য ছিল না, সম্ভবত তাদের চাহিদা ছিল আরও বেশি। পরিবহণ খরচ বাবদও ভারতীয় পোতগুলি অনেক কম মূল্য দাবি করত, সময় সময় ইংরাজ এবং ওলন্দাজ জাহাজের মূল্যের ৫০ শতাংশ মাত্র। এর কারণ হিসাবে বিদেশি বণিকদের উচ্চ আনুষঙ্গিক অর্থব্যয়কে অংশত দায়ী করা যায়। কারণ তাদের কারখানা ও যুদ্ধজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ, কিল্লার আরক্ষণ ইত্যাদি খাতে প্রচুর ব্যয় হত যা এইসব আনুষঙ্গিক খরচের অন্তর্ভুক্ত। ভারতীয়রা তাদের জাহাজগুলির সাজ-সরঞ্জাম এবং তাদের সংস্থান কার্যনির্বাহের জন্য অনেক কম অর্থ ব্যয় করত। ভারতীয়রা আবার বাজারের খুঁটিনাটির বিষয়ে অনেক বেশি ওয়াকিবহাল ছিল। বিশেষ করে যেখানে তারা পণ্যের ক্রয়-বিক্রয় করত। তারা স্থানীয় সমাজের পছন্দ, রীতিনীতি এবং ব্যবস্থাপনার সম্বন্ধেও অনেক বেশি অবগত ছিল।
অশীন দাসগুপ্ত বলছেন যে অসংখ্য ছোটো ছোটো ব্যবসায়ীদের থেকে তীব্র প্রতিযোগিতার জন্যই ভারতীয় বণিকেরা উচ্চমূল্য দাবি করতে পারতেন না। এই সব ছোটো ছোটো ব্যবসায়ীরা, যারা ছোটো বলেই ব্যবসায়ে অনেক কম অর্থ বিনিযোগ করত, লাভের চাহিদাও ছিল অনেকে কম–তাদের তাই বাজার থেকে বিতাড়ন করা সম্ভব ছিল না এবং ক্ষুদ্রের সম্মিলিত শক্তি বৃহতের ক্ষমতাকে খর্ব করতে সক্ষম হয়েছিল। (ক্যামব্রিজ ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস’) তবে একচেটিয়া বিপণন ব্যবস্থার প্রচলনের পূর্বে সমস্ত ব্যবস্থা সম্বন্ধেই এই ধরনের যুক্তির অবতারণা করা যেত।
যে সময়কালকে ‘ভারতীয় নৌবাণিজ্যের এবং বস্ত্র শিল্প বিপণনের স্বর্ণযুগ বলা যায়’ সেই সপ্তদশ শতাব্দীতে ভারতীয় বণিকেরা দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ার সর্বত্র, পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে বসতি স্থাপন করে। তাই গুজরাটি ব্যবসায়ীরা প্রধানত কাথিওয়াডের বানিয়ারা, ইয়েমেনের সমস্ত শহরেই বাস করতে থাকে এবং এই অঞ্চলের সমগ্র ব্যবসাপত্র নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। মোচাতে বানিয়ারা ইয়েমেনি ডলারের সৃষ্টি করে এবং নওরোজের পরে বকেয়া অর্থপ্রদানের একটি পদ্ধতিরও রূপায়ণ করে। তারা মক্কার নিকটবর্তী জেড্ডা এবং জাহিদ ও তাইস-এর মতো অন্যান্য ইসলামি নগরীতেও বসতি স্থাপন করে। একটি ক্ষুদ্র গুজরাটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আফ্রিকান উপকূলের প্রধান নগরী মাসোওয়ারে সমগ্র ব্যবসায়িক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। ইসলামি দুনিয়ার অন্তঃস্থলে এই ভারতীয় অভিবাসীবৃন্দের অবস্থানে এটিই প্রতিপন্ন হয় যে ধর্মীয় সংস্কার ব্যবসা-বাণিজ্যের পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি। গুজরাটি বানিয়ারা পারস্যের সমস্ত সমুদ্র তীরবর্তী নগরে এবং অভ্যন্তরীণ শহরগুলিতেও বসবাস করতে থাকে। পারস্য এবং ভারতের মধ্যেকার বাণিজ্যে আর্মানিরাও অংশগ্রহণ করতে থাকে। কলিঙ্গ অর্থাৎ (ওড়িষ্যা এবং দক্ষিণ-ভারতীয় হিন্দু বণিকেরাও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বন্দরগুলিতে ছিল এক শক্তিশালী উপস্থিতি। একজন কলিঙ্গ শাহবন্দর বা অধ্যক্ষ ছিলেন এবং সুলতানের নৌবহরের পরিচালক ছিলেন। এছাড়া এরা ম্যাকাসার, মালয় এবং শ্যাম উপসাগরেও সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু ওলন্দাজ শক্তির উত্থান এবং ব্যবসায় একচেটিয়া করলে তাদের সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে এদের অবস্থান ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই এরা অনেকেই উত্তরদিকে বর্মায়, শ্যামদেশের আযুথ্যর রাজধানী ও বন্দরে এবং মালয় দেশের কেডাই, জোহর ইত্যাদি স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করে।
এই সময় কালে আন্ত-এশীয় বাণিজ্যে কোনো পরিবর্তন হয়নি বললেই হয়। নিঃসন্দেহে বস্ত্রসামগ্রীই ছিল ভারতের প্রধান রফতানি-কৃত দ্রব্য। এই বস্ত্রাদি একাধারে অভিজাত শ্রেণি ও জনসাধারণ উভয়েই ব্যবহার করত। সাধারণের ব্যবহারের জন্য মোটা কাপড় গুজরাটে প্রস্তুত হত এবং সেখান থেকেই বাজারে প্রেরণ করা হত। এছাড়া ভারত খাদ্যদ্রব্য, যথা চাউল, ডাল, গম, ভোজ্য তেল এবং ঘি ও বহিবিশ্বে বিপণনের জন্য প্রেরণ করত। দক্ষিণ-পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে এবং পশ্চিম এশিয়ার হরমুজ এবং এডেনে এইসব বস্তুর প্রচুর চাহিদা ছিল। বাংলা চিনি এবং কাঁচা রেশম, গুজরাট তুলা এবং মালাবার তার গোলমরিচ ভারত মহাসাগরের বাণিজ্য কেন্দ্রগুলিতে প্রেরণ করত। ভারতবর্ষে এইসব বস্তুর আবার উপকূলেও বাণিজ্য হত। করমণ্ডলের বন্দরগুলি এবং গুজরাট নীল এবং করমণ্ডল আবার তামাকও বহির্বাণিজ্যে প্রেরণ করত। অর্থাৎ ভারত যে কেবল বিলাসবস্তুই রফতানি করত না, তা এখন স্পষ্টতই প্রতীয়মান।
আমদানির বিষয়ে বলতে গেলে ভারতে প্রধানত ঘোড়াই আমদানি হত। এ ঘোড়া আসত স্থলপথে অথবা জলপথে। হিসাব অনুসারে প্রতি বৎসরে ভারতবর্ষে বহিদেশ থেকে ২১,০০০ ঘোড়া ক্রয় করা হত। ভারতে মশলাপাতির প্রচুর চাহিদা ছিল এবং এইসব গরম মশলা মালাক্কা, আছেই বা বানটাম থেকে বস্ত্রদ্রব্যের বিনিময়ে সংগৃহীত হত। অন্যান্য ছোটোখাটো বস্তুরও আমদানি করার প্রয়োজন হত যেমন মালয় থেকে টিন, পূর্ব আফ্রিকা থেকে হাতির দাঁত এবং পারস্য থেকে রঞ্জক যষ্ঠী, এছাড়া বিভিন্ন বন্দরে মদিরা, ফল, বাদাম, গোলাপ জল, ওষুধপত্র ইত্যাদি জাহাজ থেকে নামানো হত, তবে এগুলোকে অপ্রধান বা ছোটোখাটো বস্তুর তালিকায় রাখা যায়। কোন কোন সময়ে ডাচ বণিকরা জাপান থেকে তামা আমদানি করত।
পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যস্থিতি ছিল খুবই অনুকুল এবং এই বাণিজ্য মূল্য মেটান হত রৌপ্য মুদ্রায়। সেটাকে ভারতের রৌপ্য ভাণ্ডার হিসাবে গণ্য করা হত। পারস্য থেকে রৌপ্য আমদানি করা হত। ওলন্দাজদের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব এবং দক্ষিন পূর্ব এশিয়া থেকে যে মশলা এবং চিনামাটির দ্রব্য প্রভৃতি আমদানি করা হত তার দাম ও মেটানো হত রৌপ্য মুদ্রায়।
অশীন দাসগুপ্তের মতে এই সময়ের এশিয়ান বাণিজ্যের প্রকৃতির বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। এবং বলতে গেলে এশীয় বাণিজ্যের সিংহভাগই ছিল মোটামুটি ভাবে ভারতীয় বণিকদের হাতে। তবে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ইউরোপীয়দের হস্তক্ষেপের ফলে ভারতীয় সমুদ্রপোতগুলির জলযাত্রাভিযানের নির্ঘণ্টকে প্রায়ই পরিবর্তন করতে হত, তাদের যাত্রা হত ব্যাহত। ভারতীয় বন্দর এবং তাদের সন্নিহিত অঞ্চলগুলির ভাগ্যও চকিতে পরিবর্তিত হত। ভারতীয় নৌবাণিজ্য এই সময় ছিল এক উত্থানপতনের মধ্যে সঞ্চরমান। আবার ভারতের ঐতিহ্যপূর্ণ সংগঠনগুলিও ইউরোপীয় দক্ষতা এবং উদ্যমের সায়ুজ্যে আরও সম্পন্ন ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। তবে অনেক ঐতিহাসিকের মতে ইউরোপীয় হস্তক্ষেপের অভিঘাত ছিল
আরও অনেক গভীরতর। তাদের মতে উত্তমাশা অন্তরীপ এবং ফিলিপিন দ্বীপপুঞ্জের পথে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আগত রুপোর অন্তঃপ্রবাহ ঐতিহ্যশালী ভারতীয় এবং এশীয় অর্থনীতিকে দ্রবীভূত করে দিয়েছিল। এছাড়া সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ভারতীয় বাণিজ্যের দ্রুত বিস্তারই ধনতান্ত্রিক বিশ্ব বাজারের ভারতের সংযুক্তিকরণের প্রথম পদক্ষেপ বলা যায়।
ভারতের স্থল বাণিজ্য
সপ্তদশ শতাব্দীতে ভারতের নৌবাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে স্থলপথ বাণিজ্যেরও বিস্তার ঘটে। মহান এশীয় সভ্যতাগুলির পারস্পরিক বাণিজ্য পথগুলি অতি প্রাচীনকাল থেকে নির্মিত হয়ে আছে এবং ১৭শ-১৮শ শতাব্দীতে এইগুলি সক্রিয় ছিল। এই সমস্ত পথই বাগদাদে এসে মিলিত হত। ভারতবর্ষ, ইরান, মধ্য এশিয়া এবং চীন থেকে বণিকের দল তাদের বস্তুসামগ্রী নিয়ে বাগদাদে এসে মিলিত হত। শিরাজ হয়ে বাগদাদ সমুদ্রের সঙ্গেও সংযুক্ত ছিল যে পথ পারস্য উপসাগরের উপকূলবর্তী সিরাফে এসে শেষ হত। মূল রাজপথ নিশাপুরে এসে দুই ভাগে হয়ে যেত। এর একটি বাহু মাৰ্ভ এবং বুখারা হয়ে চীনদেশে পৌঁছেত, এবং অন্যটি যেত হিরাট ও কান্দাহার হয়ে মুলতান পর্যন্ত। অধুনা এদের মধ্যে একটি পথই, যেটি চীনদেশে যায়, সকলের নজরে আছে। এটিকে সিল্ক রুট বা রেশমি পথ বলে। অবশ্য ভুল করে ডাকা হয়। কেননা রেশম বস্ত্র আর এই পথের প্রধান পণ্য ছিল না। প্রকৃতপক্ষে রেশম ইরান ও ভারতবর্ষের ফসল ছিল। ঘোড়া, জেড পাথর, কিছু সিল্ক এবং কিছু চিনামাটির বস্তুই মূলত এই পথে বাণিজ্যের জন্য চলাচল করত। দক্ষিণের পথটি ভারতবর্ষ পৌঁছাত। কীর্তি চৌধুরীর মতে এই পথটিকে ‘সুতি পথ’ বলা যায়, কেননা এই পথ দিয়েই ভারতের প্রস্তুত বস্ত্র ও অন্যান্য সুতিদ্রব্য পশ্চিম ও মধ্য এশিয়া এবং পরবর্তীকালে এমনকি রাশিয়া পর্যন্তও পৌঁছাত। এই পথটি অটোমান তুরস্কের আলেপেপা শহরে এসে শেষ হত, এবং এখানে ভারতীয় বস্তুসামগ্রীর এতবড়ো বাজার গড়ে উঠেছিল যে এটিকে ‘ক্ষুদ্র ভারত’ও বলা হত। বহু ভারতীয় বণিকেরা এখানে বসতি স্থাপন করেন।
ভারতীয় বণিকেরা চীন থেকে কনস্ট্যান্টিনোপল পর্যন্ত এই সমগ্র অঞ্চলেই বসতি স্থাপন করেছিল। বৌদ্ধধর্মের অবনতির সঙ্গে সঙ্গেই এই পথের কর্তৃত্ব ইরানি, তুর্কি এবং মোঙ্গলদের হাতে চলে যায়। কিন্তু পাঞ্জাব থেকে লাদাখ এবং কাশ্মীর হয়ে মধ্য এশিয়া এবং চীন পর্যন্ত বিস্তৃত বাণিজ্যের তত্ত্বাবধান করার জন্য ১৯ শতক অবধি ইয়ারকন্দ এবং খোটান অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে ভারতীয় বণিকদের বসতি দেখা যেত। পশ্চিম এশিয়ার বন্দর আব্বাস, মোচা ইত্যাদি বন্দর শহরে এবং অন্তবর্তী যেসব স্থানে সারিবদ্ধভাবে বণিকরা এসে মিলিত হত যথা কনস্টান্টিনোপল, অ্যালেম্মো, বাগদাদ ইত্যাদি স্থানেও ভারতীয় সওদাগরদের দেখা মিলত। তবে ভারতীয়দের সবথেকে বড়ো গোষ্ঠী মনে হয় পারস্যে বাস করত। রুশি পর্যবেক্ষক সুতুর-এর মতে ১৭শ শতাব্দীতে ১০,০০০ ভারতীয় সাফাভিদ অধিরাজ্যে বাস করত। শোনা যায় যে সাফাভিদ শাসকেরা ভারতীয়দের স্বাধীনভাবে তাদের ধর্মমত ঘোষণা করতে বাধা তো দিতই না, আবার তাদের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য পুরোহিত নিয়োগ করারও অনুমতিও দিতেন।– ইরান থেকে ভারতীয় বণিকেরা বালখ, বুখারা এবং সমরখন্দে ছড়িয়ে পড়েন। ১৭২২ সালে দক্ষিণ রাশিয়ায় ভোলগা নদীর তীরে আস্ত্রাখান শহরে কর্মচারীবৃন্দ, প্রতিনিধি ও দালাল সহ ২০০-র অধিক ভারতীয় পরিবার বাস করতেন। একদল ভারতীয় বাবুতে বসবাস করতে থাকেন, এঁরা পুণ্য অগ্নির উপাসক ছিলেন। রুশী ইতিহাসবিদ ভি. আই. পাভলভ-এর উক্তি অনুসারে আস্ট্রাখান থেকে ভারতীয় বণিকেরা ভোলগা নদীপথে বাণিজ্যের ব্যাপারে একটি কার্যকরী ভূমিকা পালন করতেন, এবং নিজমি নভগোরড় এবং জারোশ্লাভূল তো বটেই এমনকি মস্কোতেও তারা প্রায়ই আসতেন। প্রকৃতপক্ষে আমরা একথাও শুনেছি যে এই অঞ্চল থেকে ভারতীয় বণিকেরা পোল্যান্ডেও তাঁদের বাণিজ্য বিস্তার করতে প্রস্তুত ছিলেন। তবে এই চিন্তা রূপায়িত হবার আগেই সাফাভিদ সাম্রাজ্য ভগ্ন হয়ে গেল, মুঘল সাম্রাজ্যেরও পতন হল, এবং এর ফলে মুদ্রা মূল্যের দ্রুত অবনমনের জন্য বিদেশে কর্মরত ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি হল।
এখানে লক্ষণীয় যে সর্বত্রই ভারতীয় বণিকেরা তাদের নিজস্ব ব্যবসায়িক সংগঠন বহন করে চলতেন, যাঁদের অনেকেই সেই পরিবারেরই সদস্য হতেন, তবে সকলে নয়। কোনো কোনো বহিরাগতদের মাঝে মাঝে সেই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হত। আত্মীয়, জ্ঞাতি, ভ্রাতুস্পুত্র ইত্যাদিদের বিভিন্ন স্থানে নিযুক্ত করা হত। এঁরা পরস্পরের সঙ্গে বাণিজ্য করতেন, মাঝেমধ্যে একে অপরকে আর্থিক সাহায্য দিতেন, ভারতীয় বস্তুসামগ্রী পরিবেশনের ক্ষেত্রেও সহযোগিতা করতেন এবং আমদানির সুবন্দোবস্তও এদের কর্মকাণ্ডের অংশীভূত ছিল। তারা মাঝেমধ্যে ভারতে যাতায়াত করেও মূল পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতেন। এইসব পরিবার বাজার এবং বিপণন-সংক্রান্ত খবরাখবর প্রদান করতেন এবং তখন কোনো ব্যাংক (অধিকোষ) না থাকায় এদের মাধ্যমে অর্থও স্থানান্তরিত হত। বাণিজ্যের জন্য ভারতীয়েরা অংশীদারী ব্যবস্থাও অবলম্বন করতেন। তারা আবার স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চুক্তি করতেন যাতে করে তারা বিভিন্ন স্থানে ভারতীয় জিনিসপত্র পরিবহণ এবং বিতরণের দায়িত্ব নিতেন। এর প্রয়োজনীয় মূলধন কিন্তু ভারতীয়রাই প্রদান করতেন। ভারতীয়দের দুই ভাগ এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের এক ভাগ, এইভাবেই এর লভ্যাংশ ভাগ করে নেওয়া হত। যে সমস্ত অঞ্চলে মূলধনের অভাব বিদ্যমান সেখানে স্থানীয় ব্যবসাপত্র সক্রিয় রাখার এটি একটি কার্যকরী ব্যবস্থা।
ভারতীয়দের সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল তাদের ব্যবসায়িক নৈপুণ্য এবং অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা। এছাড়া তারা ভারতীয় বস্ত্র নিয়ে ব্যবসা করত, যা স্থানীয় বস্তুসামগ্রীর থেকে মানে অনেক উন্নত অথচ দামেও সস্তা হওয়ায় বিপণনের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধাজনক ছিল। ফরাসি পরিব্রাজক শারডিন তাই বলছেন ‘পারসিকরাও খুবই ন্যায্য মূল্যে ছাপা কাপড় বিক্রি করত, কিন্তু ভারতীয়দের থেকে সস্তা দামে তৈরির চেষ্টায় সেগুলি গুণগত ভাবে উচ্চাঙ্গের হতে পারেনি। তারা বস্ত্রের উপর রং লাগাতেও পারত, কিন্তু এ বিষয়েও তারা ভারতীয়র মতো পারদর্শী ছিল না।
এই সব সুবিধাজনিত কারণে ভারতীয়েরা প্রচুর অর্থ আয় করেছিলেন, যার একাংশ দেশে প্রেরণ করে বাকি অংশ তারা সুদে ঋণ দিতেন। অর্থ ঋণ দিয়ে তার ৩ থেকে ৪ শতাংশ সুদ আদায় হত, কিন্তু ঋণের অঙ্ক কম হলে সুদের হার বেশি হত, কেন না এই স্বল্প ঋণের বিনিময়ে তো বিষয়-সম্পত্তি কেউ বাঁধা রাখত না। এই জন্য ভারতীয় বণিকদের অনেক সময় সুদখোর বলে নিন্দা করা হত।
ভারতবর্ষ থেকে বস্ত্রাদি ছাড়া নীল, মশলা এবং চিনি রপ্তানি হত, আর বৰ্হিদেশ থেকে অশ্ব, গালিচা, পশুলোম, শুকনো ফল এবং জিনিসপত্র ভারতে আনা হত। সর্ববৃহৎ আমদানিকৃত পণ্য ছিল অশ্ব। বস্ত্রাদি এবং কিছু পরিমাণ রৌপ্য রফতানি করে তুরান থেকে আনা ঘোড়াদের দাম পরিশোধ করা হত। পারস্য, সিরিয়া ও রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের সঙ্কলন ভারতের দিকেই ভারী ছিল, অর্থাৎ আমদানির থেকে রপ্তানিই হত অধিকতর। বস্তুসামগ্রী বিশেষ করে রৌপ্য রফতানি করে আমদানির দাম মেটানো হত।
ভারতীয়দের এইসব বৈদেশিক বাণিজ্যিক উদ্যোগ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যে দেশে মুঞ্জ ঘাস জন্মায় না সেখানে বাস করার নিষেধাজ্ঞা বা লবণাক্ত সমুদ্র (কালাপানি) অতিক্রম করলে জাত যায়, ইত্যাদি সামাজিক বাধানিষেধগুলি বিশেষ মানা হত না। বিদেশে বসতি স্থাপনকারী বণিকদের মধ্যে ছিল মুলতানিরা। মুলতানি বলতে একটি সাধারণ জনগোষ্ঠী বোঝাত যাদের মধ্যে ছিল মাড়োয়াড়ি বানিয়া, অসওয়াল, জৈন, সিন্ধি, গুজরাটি এবং পাঞ্জাবি ক্ষত্রি সম্প্রদায়ের লোকেরা। আফগানরাও ঘোড়া বেচাকেনা এবং মাল পরিবহণের কাজে সক্রিয় ছিল।
মুঘল সাম্রাজ্যের সীমা পার হয়ে কী পরিমাণ বস্তু বিদেশে যেত তার সঠিক পরিমাপ নিরূপণ করা কঠিন। একটি হিসাব অনুসারে সাম্রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী, অর্থাৎ কাশ্মীর, কাবুল, লাহোর, মুলতান এবং থাট্টার টাকশালগুলি থেকেই সমগ্র মুঘল মদ্রা প্রস্তুতকারী সংস্থার মধ্যে সর্বাধিক অর্থাৎ শতকরা ৩৬.৭ ভাগ মুদ্রা সরবরাহ হত। নদী বন্দর থাট্টা ছাড়া কাবুল, লাহোর এবং মুলতান থেকে যে রৌপ্যমুদ্রা সরবরাহ হত, তা ইরান ও তুরান থেকে আমদানি কৃত রুপো দ্বারা প্রস্তুত।
মুঘল প্রশাসন এবং বাণিজ্য
ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি প্রশাসনের, বিশেষ করে মুঘল সাম্রাজ্য এবং গোলকুণ্ডা, বিজাপুর ইত্যাদি সাম্রাজ্যের বাণিজ্য মনোভাব নিয়ে আলোচনা হবার পর স্বতঃসিদ্ধ ভাবেই আমাদের মনে প্রশাসনের প্রকৃতি ও চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন আসে। উপকূলবর্তী মালাবার রাজ্য, দক্ষিণ ভারতের হিন্দু নায়কগণ এবং মারাঠারাও সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পর্যায়ে পড়েন। তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নতির বিষয়ে বাণিজ্যের গুরুত্ব সম্বন্ধে তাঁরা সমধিক অবহিত ছিলেন এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন। এমনকি মুখ্য কিছু পণ্যের, যথা মরিচের রফতানি নিজেরাই একচেটিয়া করে নিতে চেয়েছিলেন। তবে তারা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের পরিস্থিতিতে কোনো হস্তক্ষেপ করেননি। মারাঠারা, বিশেষ করে স্বয়ং শিবাজি অন্য-কোনো ভারতীয় শক্তির তুলনায় নৌশক্তির গুরুত্ব অধিক উপলব্ধি করেছিলেন। তবে অনবরত মুঘলদের সঙ্গে বিবাদ-বিসংবাদের জন্য শিবাজির পরবর্তী প্রজন্মের একটি নৌশক্তি নির্মাণ করার প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়।
এ-কথা ধারণা করা ভুল হবে যে মধ্য এশিয়া থেকে উদ্ভূত হবার জন্য মুঘলরা বাণিজ্য সম্বন্ধে উদাসীন ছিল। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, অনুর্বর এবং চরম আবহাওয়া বিশিষ্ট স্তেপ সমভূমিতে অবস্থানের জন্য মধ্য-এশীয় রাজ্যগুলি পথের গুরুত্ব সম্বন্ধে আরও অধিক অবহিত ছিল। এসব পথ তাদের দেশের মধ্য দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে, আবার দক্ষিণ থেকে উত্তরে, পরস্পরের সঙ্গে কাটাকুটি করে (পরস্পরকে ছেদ করে) চলে যেত, এবং সব পণ্যদ্রব্য এইসব পথেই যাতায়াত করত। শুল্ক আদায় করার উদ্দেশ্যে এইসব পথের নিয়ন্ত্রণ লাভ তৈমুরের সাম্রাজ্য গঠনের একটি বিশেষ লক্ষ্য ছিল। মুঘলরা দেশের তিনটি বাণিজ্য প্রধান অঞ্চল–যথা গুজরাট, বঙ্গ এবং সিন্ধুদেশ জয় করে এবং দুটি প্রধান বৈদেশিক বাজার কাবুল ও কান্দাহারের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখে বাণিজ্যক্ষেত্রে যে অধিকার কায়েম করতে চেয়েছিলেন, মধ্য এশিয়ায় বাণিজ্য পথগুলি নিয়ন্ত্রণ করার তৈমুরের প্রচেষ্টা তার সঙ্গে তুলনীয়।
উত্তর ভারতের উর্বর সমৃদ্ধ সমভূমি অঞ্চলগুলি থেকে বাদশাহ উদ্বৃত্ত ফসলের যে অংশ পেতেন তার মূল্য বাণিজ্যের উপর বসানো কর থেকে প্রাপ্ত অর্থের অনেক বেশি। যাই হোক, দেশে বাণিজ্যের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে শাসক এবং অভিজাত উভয়েই বুঝতে পারলেন যে মূল উৎসের পাশাপাশি ব্যবসা ও আয় বৃদ্ধির আর-একটি পথ হতে পারে। তবে এই ব্যবস্থার সদর্থক ও নঙর্থক উভয় দিকই আছে। এর নঙর্থক বা খারাপ দিকটি প্রকাশ পায় যখন শাসক ও অভিজাতগণ নিজেদের ব্যক্তিগত সুবিধার দিকে লক্ষ রেখে বাণিজ্য প্রক্রিয়াকে বিকৃত করতে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ ১৬৬৩ সালে শাহজাহান মোহনদাস দান্ডা নামক একজন। গুজরাটি বানিয়াকে রাজ্যে উৎপন্ন সমগ্র নীল কিনে নেবার স্বত্ব প্রদান করেন। বিনিময়ে তাকে তিন বছর রাজকোষ থেকে অগ্রিম হিসাবে পাওয়া অর্থসমেত এগারো লক্ষ টাকা ফেরত দেবার চুক্তি করতে হয়। এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল ওলন্দাজ ও ইংরেজদের জন্য নীলের দাম বাড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু ইংরাজ ও ডাচেরা নিজেদের স্থির করা মূল্যসীমার উর্ধ্বে ক্রয় করতে অস্বীকার করায় এক বছর পরে এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
সোরা ছিল আরেকটি বস্তু যার ব্যবসায় বারেবারে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে। বঙ্গদেশের প্রশাসক থাকাকালীন মির জুমলা ইংরেজদের সোরা সরবরাহের একচেটিয়া অধিকার নিজের হাতেই রাখতে চেষ্টা করেন। মির জুমলার উত্তরাধিকারী শায়েস্তা খানও লবণ, মৌচাকের মোম এবং সোনা ক্রয়ের ব্যবসাগুলিও একচেটিয়া অধিকার নিজের হাতে রাখার চেষ্টা করেন।
এইরকম একচেটিয়া বন্দোবস্ত মোটেও অস্বাভাবিক ছিল না, যদিও বিদেশি বণিকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে বারবার এর প্রতিবাদ করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে বেশ কিছু বিদেশি কোম্পানি যথা, ওলন্দাজ (ডাচ) এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতেই পূর্বদেশের ব্যবসায়ের একচ্ছত্র অধিকার ছিল। ওলন্দাজদের মশলা বাণিজ্যর একচেটিয়া অধিকার অর্জন এবং শ্রীলঙ্কা এবং মালাবারের মতো মরিচ উৎপাদনকারী দ্বীপগুলির বিজয় সাধন সংঘটিত হবার পরেই মরিচের দাম তিন গুণ বৃদ্ধি পায়।
কোনো কোনো আমলা যে আবার নিজেদের এলাকাতে সমস্ত ব্যবসা একচেটিয়া করে নিয়ে অন্যান্য বণিকদের বেশি লাভ রেখে সকল পণ্য বিক্রয় করার চেষ্টা করতেন, তা ছিল আরও বেশি প্রতিবাদযোগ্য। এইভাবে শাহজাদা আজিম-উশ-শান বঙ্গদেশের সমগ্র আমদানি বাণিজ্য নিজের একচ্ছত্র অধিকারে এনে তার নাম দেন সওদা–ই–আম–ও–খাস৷ লাহোরের প্রশাসক ওয়াজির খান আবার লাহোরে সমস্ত বস্তুর ক্রয়-বিক্রয়ের উপর লভ্যাংশ আদায় করে প্রচুর লাভ করেছিলেন। তবে এইসব কার্যকলাপ কিন্তু নিন্দনীয় বলে গণ্য হত। সমস্ত ব্যবসায় একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টার খবর পেয়ে ঔরঙ্গজেব আজিম-উশ-শানকে তীব্র তিরস্কার করে একটি পত্র লেখেন।
তবে শাসককুল, রাজকীয় পরিবারের সদস্যগণ, এমনকি কোনো কোনো প্রথম সারির অভিজাতগণও নিজেদের জাহাজে করে নিয়মিত লোহিত সাগরের বন্দরগুলিতে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে নৌযাত্রা করতেন তা ছিল আরও অনেক নিয়মিত ঘটনা। যেমন জাহাঙ্গির, নূরজাহান এবং শাহজাদা খুররম-এর নিজস্ব জাহাজগুলি নিয়মিত সুরাট থেকে লোহিত সাগরের উপকূলবর্তী বন্দরগুলিতে বাণিজ্য করতে যেত। খুররম যখন গুজরাটের প্রশাসক ছিলেন তখন তার জাহাজগুলি মোচার সঙ্গে ব্যাপক বাণিজ্যে ব্যস্ত ছিল। শাহজাহান এই নৌ-বাণিজ্যর এক প্রধান অংশগ্রাহক ছিলেন, এবং তার বেগম এবং শাহজাদা এবং শাহজাদীগণের মধ্যেও এই যোগাযোগ বিস্তৃত হয়েছিল। ১৬৪০ সাল থেকে কুড়ি বৎসরেরও অধিক সময় কাল পর্যন্ত গুজরাটের বন্দরগুলিতে জাহাজ নির্মাণকার্যে ব্যাপক ব্যস্ততা দেখা গিয়েছিল। রাজকীয়। বা বাদশাহী পরিবারের সদস্যেরা ১০০টন পর্যন্ত ক্ষমতাসম্পন্ন বৃহৎ জাহাজ নির্মাণের জন্য আদেশ করতেন। রাজপুত্র দারা এবং ঔরঙ্গজেবের নিজস্ব জাহাজ ছিল যেগুলি আছে-ই এবং বানটানের সঙ্গে বাণিজ্য করত। জাহানারা তার নিজস্ব জাহাজ ছাড়াও ওলন্দাজ এবং ইংরাজদের সমুদ্রপোত নিয়েও বাণিজ্য করতেন। দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলিতেও নৌবাণিজ্য ছড়িয়ে পড়ে। যেমন গোলকুণ্ডার এক অগ্রণী অভিজাত মির জুমলার এক বিশাল নৌবহর ছিল যেগুলি লোহিত সাগরের বন্দর আব্বাস এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয়ার দ্বীপগুলিতে নিয়মিত বাণিজ্য করত। শোনা যায় যে বঙ্গদেশে নৌবাণিজ্য পোতগুলি সাধারণত প্রধান মুঘল অভিজাতদেরই সম্পত্তি ছিল।
বাদশাহ এবং রাজপরিবারের ব্যবসায় অংশগ্রহণের এই সমস্ত ঘটনাকে কিন্তু বাণিজ্যের পরিপন্থী বলা চলে না। প্রকৃতপক্ষে এদের এইসব উদ্যোগের ফলে পণ্য পরিবহণে যে অতিরিক্ত ক্ষমতার সৃষ্টি হয় তা ভারতীয় বণিকদের সুবিধাই করে দেয়। তবে সময় সময় সমস্ত রাজকীয় বাণিজ্যপোত সম্পূর্ণ ভরতি না হওয়া পর্যন্ত সুরাট বন্দরে ইংরাজ ও ওলন্দাজ জাহাজগুলিতে মাল বোঝাইয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হত।
পণ্যদ্রব্য বহনের ক্ষেত্রে এসময়ে ইংরেজরা বেশ ভালো ভাবেই নেমে পড়েছিল এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও ডাচেরা (ওলন্দাজরা) পশ্চিম এশিয়ায় বাণিজ্যে বিশেষ সফল হতে না পারার জন্য যখন এই ব্যবসায়ে লিপ্ত হয়, তখনই শুরু হয় প্রতিযোগিতা। একদিকে জলদস্যুদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা, ভারত মহাসাগরে নৌ চালানোর কুশলতা, আদি ইংরেজ ও ডাচ জাহাজে প্রাপ্তসুবিধা, অপরদিকে বাদশাহী বা রাজসিক মহলের দ্বারা সৃষ্টি করা চাপ এই ধন্ধে পড়ে ভারতীয় সওদাগরেরা সাধারণত ভারতীয় এবং ইউরোপীয়, উভয় জাহাজেই বিদেশে পণ্য পাঠান।
তবে রাজকীয় পরিবারের সদস্যগণ মাঝেমধ্যে ব্যবসায়ীদের যে অর্থ ঋণ দিতেন বা মাঝেমধ্যে রাজকীয় টাকশাল থেকে যে অগ্রিম অর্থ তাদের দেওয়া হত সেগুলি থেকেই ব্যবসায়ীরা আরও সরাসরি উপকৃত হতেন। ১৬৪৬ সালে ইংরাজ বণিকেরা। সুরাটে অর্থের অভাবের অনুযোগ করেন। কেননা মুদ্রা প্রস্তুত হবার সঙ্গে সঙ্গেই সুরাটের বণিকেরা অগ্রিম অর্থ পরিশোধ বাবদ সেই অর্থ বাদশার দেওয়ান বা অমাত্যের কাছে জমা দিতেন।
একদিক দিয়ে বলতে গেলে শাসকশ্রেণি কৃষির উদ্বৃত্ত অংশটুকু সংগ্রহ করে তাকেই বাণিজ্যিক (আর্থিক) মূলধনে পরিবর্তিত করতেন। আবার বাদশাহ স্বয়ং বা তার অগ্রণী অভিজাতরা সরাসরি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে বণিকদের সমস্যাগুলির সম্বন্ধে তাদের প্রত্যক্ষ পরিচয়ও গড়ে ওঠে।
তখন সমাজে প্রচলিত দর্শন, যাকে ইসলামিক বা এশীয় দর্শনও বলা যায়, সে অনুসারে সকল সম্প্রদায়ের মানুষই তাদের নিজেদের আইন ও রীতিনীতি অনুসারে তাদের জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে পারত, তাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলি নিষ্পত্তি করতে পারত। বণিকদের ক্ষেত্রেও এই ব্যবস্থা বলবৎ ছিল। প্রত্যেক বড়ো শহরের ব্যবসায়ীরা ধর্ম বা জাতির ভিত্তিতে গোষ্ঠীবদ্ধ থাকত। যেমন সুরাটে জৈনদের নিজস্ব সংগঠন ছিল, যার প্রধান ছিলেন একজন শেঠ। বাকিরা এবং মুসলিমদেরও এইরকম উপদল ছিল। এইসব গোষ্ঠী বা সংগঠন স্থানীয় বন্দরের প্রশাসকদের সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক রাখত। এবং মধ্যবর্তী বা প্রাদেশিক স্তরে এমনকি সর্বোচ্চ কেন্দ্রীয় স্তরের রাজনৈতিক শক্তির কাছেও এদের প্রবেশাধিকার ছিল। এরা এদের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে রাজনীতিতেও লিপ্ত হতেন। কোনো স্থানীয় সমস্যা বৃহদাকার ধারণ করে হাতের বাইরে চলে যাবার আগে, সর্বোচ্চ প্রাদেশিক প্রশাসনিক মহলে গিয়ে, ব্যবসায়ীরা তার সমাধান বা নিরসন করতে পারতেন। বণিকেরা আবার বাদশাহের দরবারে উপস্থাপক বা উকিলদের নিযুক্ত করতেন, যাঁদের কাজ ছিল সমস্যার সুবিচার চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করা, বা সরাসরি অভিযোগ দাখিল করা। উদাহরণস্বরূপ ১৬১৬-১৯ সালে ভারতীয় বণিকেরা প্রথমে ইংরেজ জাহাজগুলিকে মোচায় যাত্রা করার নিষেধাজ্ঞা চেয়ে বাদশাহকে সম্মত করান। কিন্তু যখন ইংরেজরা সুরাট অবরোধ করে, তখন এই বণিকেরাই প্রথমে গিয়ে বাদশাহের কাছে এই বিবাদের মীমাংসা করার জন্য প্রতিনিধি দল পাঠান। ১৬৮০ এবং ১৬৯০-এর সময়কালে যখন আরব সাগরে সুরাটের জাহাজগুলিকে ইংরেজ জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ইংরেজদের উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল, তখনই তিনজন বানিয়া ভাই কিষেণদাস, ভগওয়ান দাস এবং ত্রিকমদাস নৌবহর পরিচালনা করবার সময় ওলন্দাজদের আদেশ মান্য করার জন্য একটি হুকুমনামা জারি করেন, এটিতে আবার সুরাটের মুৎসুদ্দি প্রতি-স্বাক্ষর করেন।
সাধারণভাবে বলতে গেলে মুঘলরা বা বিজাপুরের শাসকেরা কেউই রাজকীয় বাণিজ্যে বিশ্বাস করতেন না যদিও শাহ আব্বাসের রাজত্বকালে পারস্যে রেশম ব্যবসার একচেটিয়া অধিকার সম্রাটেরই নিকট ন্যস্ত ছিল এবং আছে, আয়ুয্য, আরাকান, পেণ্ড ইত্যাদির রাজারা চাউল, টিন ইত্যাদির বাণিজ্যতে রাজা একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ত্রিবাঙ্কুরেও সমস্ত মরিচের ব্যবসায় রাজার একচেটিয়া দখল ছিল। মুঘল প্রশাসনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল যে বাণিজ্য যেন সকলের জন্যই মুক্ত থাকে এবং তাদের বণিকদের জন্য সমুদ্রপথ যেন খোলা থাকে। মুঘলদের কোনো নৌসেনা বা নৌবাহিনী ছিল না, তাই তাদের বন্দরগুলি এবং দূর সমূদ্রে ভাসমান বাণিজ্যপোত সকল বহিশক্তির, অর্থাৎ প্রথমে পর্তুগিজ পরে ওলন্দাজ এবং শেষে ব্রিটিশদের ভয় বা চাপের কাছে পরাজিত হতে পারত। যাই হোক, তাদের এলাকায় কোন বণিককে বাণিজ্য করার অনুমতি দেওয়া হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে তাদের ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা পর্যন্ত মুঘলরা তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে সেই সব সিদ্ধান্ত নিত। যাতে করে ভারতীয়রা স্বাধীনভাবে তাদের ব্যবসা নির্বাহ করতে পারে সেই জন্য বিদেশি বণিকদের তাদের এলাকায় কোনো দুর্গ বা সশস্ত্র শিবির স্থাপন করার অনুমতি ছিল না। এটি একটি বিশেষ সংবেদনশীল বিষয় এবং মুঘলরা তাদের সাম্রাজ্য ভেঙে যাওয়া পর্যন্ত এই ভারসাম্য বজায় রাখতে পেরেছিল। শতাব্দীর প্রথম তিন দশকে সুরাটের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয়ে প্রশাসনকে বহু কষ্টে সমতা বজায় রেখে অত্যন্ত সাবধানী পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল। এই সময় তিনটি। লড়াকু ইয়োরোপীয় শক্তির মুকাবিলায় সরকারকে নামতে হয়েছিল। এই তিন শক্তির অর্থাৎ পর্তুগিজ, ওলন্দাজ এবং ইংরেজ–এদের সকলেরই লক্ষ্য ছিল সমুদ্রের উপর । কর্তৃত্ব স্থাপন। এই তিন শক্তির পারস্পরিক পার্থক্যকে কৌশলে ব্যবহার করে মুঘল প্রশাসন যে ব্যবস্থা নেন তার ফলে সুরাট বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে এক অভূতপূর্ব স্বাধীনতা লাভ করে। জাহাঙ্গির হুগলি থেকে পর্তুগিজদের বিতাড়ন করে বঙ্গের বাণিজ্যক্ষেত্র যে শুধু ওলন্দাজ ও ইংরেজদের জন্য উন্মুক্ত করেছিলেন তাই নয়, এছাড়া মুঘল পরিশাসিত অঞ্চলে যে দুর্গাদি নির্মাণ করার ক্ষমতা যে কারও নেই সে বিষয়েও সকলকে শিক্ষা দেওয়া হল।
১৬৪০ সালে ওলন্দাজ বণিকরা যখন পর্তুগিজদের রূপ ধারণ করে ভারত মহাসাগরের নৌবাণিজ্য সম্পূর্ণভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার এমনকি নতুনদিকে পরিচালনা করারও চেষ্টা করতে থাকে, তখনই মুঘলরা সর্ববৃহৎ সংকটের মুখোমুখি হয়। কেননা জলপথ ব্যবহার করার স্বাধীনতাই এই পর্তুগিজ হস্তক্ষেপের ফলে বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। তারা তখন আছেই, পেরাক এবং কেদাহর শাসকদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত আছে এই অছিলায় ওলন্দাজরা কোনো ভারতীয় জাহাজ গুজরাট ও বাংলার বন্দর থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নৌযাত্রা করার অনুমতি দেয়নি। তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল ভারতীয় জাহাজগুলিকে নৌবাণিজ্যের বিষয়ে নিরুৎসাহ করা যাতে করে সমগ্র বৈদেশিক বাণিজ্যই তাদের হস্তগত হয় এবং তারাই ভারতীয় পণ্যের একমাত্র বিক্রেতার অধিকার লাভ করতে পারে। তবে ভারতে কর্মরত ওলন্দাজ ব্যবসায়ীরা বুঝতে পেরেছিলেন যে এই নীতি তাদের ভারতবর্ষের বুকে বসে বাণিজ্য, করার পক্ষে ক্ষতিকর হবে এবং সেই জন্য তারা এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বেশ কয়েক বছর ধরে ভারতীয় বাণিজ্যিক প্রচেষ্টাকে খর্ব করার এই নীতি প্রয়োগ করার চেষ্টা হয়েছিল, ওলন্দাজেরা সুরাট অবরোধ করে এবং পুরস্কার হিসেবে কিছু জাহাজ অধিকার করে নিয়ে দেখাতে চেয়েছিল এ বিষয়টি তাদের কাছে কত গুরুত্বপূর্ণ। মুঘলরা সমস্ত ওলন্দাজী কারখানা অধিকার করে নিয়ে এবং তাদের প্রতিনিধিদের গ্রেপ্তার করে স্থলভাগে এর প্রতিশোধ নিল। এর ফলে ১৬৪৮ থেকে ১৬৫২ সাল পর্যন্ত পারস্পরিক শত্রুতা চলতেই লাগল। কিন্তু যেহেতু সুরাট বন্দরের বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল, শাহজাহান শেষপর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন যে ভারতীয় বাণিজ্য জাহাজগুলি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বন্দরসমূহে যাবার পথে বাটাভিয়াতে বাল্টিক দিয়ে যাবে। কিন্তু ওলন্দাজরা শীঘ্রই বুঝতে পারল যে এর ফলে বঙ্গদেশ এবং ভারতে তাদের লাভজনক ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইতিমধ্যে রাজার। (বাদশাহের) আদেশ এল যে ওলন্দাজদের বাণিজ্যে বাধা সৃষ্টি করতে হবে। এদিকে ভারতীয় জাহাজ এবং তাদের পণ্যসামগ্রী সবই অবরুদ্ধ হয়ে রইল এবং সুরাট বন্দর থেকে জাহাজের যাত্রা করাও নানাভাবে বিঘ্নিত হতে থাকল। তাই উভয় পক্ষই ব্যাপারটি মিটমাট করতে আগ্রহী হয়ে উঠল। শাহজাহান ওলন্দাজদের একটি আদেশপত্র বা ফর্মান মঞ্জুর করেন, যাতে আশ্বাস দেওয়া হয় যে সুরাট থেকে কোনো জাহাজ আছেই বন্দর যাবে না। কিন্তু ওলন্দাজী অবরোধ উঠিয়ে নেওয়ার পরেই ভারতীয় জাহাজগুলিকে সমুদ্রযাত্রার অনুমতিপত্র দেবার জন্য কর্তৃপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করা হতে লাগল। ১৬৫২ সালের মধ্যেই ওলন্দাজরা ভারতীয়দের দাবি মেনে নিল এবং অনুমতিপত্র অকাতরে দেওয়া হতে লাগল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতীয় বাণিজ্যও আবার শুরু হল।
১৬৮৭ সালে মুঘলদের সঙ্গে ইংরাজ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সংঘর্ষ হয়। যদিও তারা প্রধানত শুল্কের জন্যই অভিযোগ করেছিল, তবু বলতে হয় যে মুঘলদের শুল্ক ছিল অত্যন্ত কম, আড়াই থেকে পাঁচ শতাংশের মধ্যেই। এছাড়া স্থানীয় শাসক এবং জায়গিরদারেরা রাহদারী বা পথ শুল্ক আদায় করত যদিও তা সরকারি ভাবে নিষিদ্ধ ছিল। এছাড়া শুল্ক ব্যবস্থাপকদের মাঝে মাঝেই উপহার বা তোফা দিতে হত। তবে এ শুধু ইংরেজদের জন্যই নয়, এগুলি সবই একটি বাণিজ্যিক পরিস্থিতির অঙ্গ ছিল যা ভারতীয় বণিকদের উপরেও সমভাবে প্রযোজ্য। ইউরোপীয় বণিকেরা প্রশাসনের থেকেই নানারকম সুবিধা চাইত, কারণ তারা একদিকে যেমন সংখ্যায় অল্প থাকার জন্য ভারতীয় বণিকদের সঙ্গে সমানে সমানে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকত, অপরদিকে এক বিশেষ ধরনের একাধিপত্য সৃষ্টির মানসিকতা তাদের মধ্যে সর্বদাই সক্রিয় ছিল। আবার ইউরোপীয় বাণিজ্যকে উৎসাহ দেবার জন্য এই ধরনের সুবিধা বা ছাড় তারা প্রায়শই পেয়ে থাকত। যেমন ১৬৫০ সালে বঙ্গদেশের প্রশাসক শাহসুজা ইংরাজদের একটি নিশান বা অধিকার দেন যার ফলে তারা বৎসরে একবার মাত্র ৩০০০ টাকা রাজকোষে জমা দিলে তাদের আর কোনো বহিঃশুল্ক দিতে হত না। তবে পরবর্তীকালের বিভিন্ন প্রশাসকদের অবশ্য এই নীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি, কেননা ১৬৫০-এর পরবর্তী সময়ে ভারতে ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্যের অতি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৬৮০ সালে ঔরঙ্গজেব এই মর্মে এক আদেশপত্র বা ফর্মান জারি করেন যে সুরাটে অন্তঃশুল্ক দিলে ইংরেজরা সমগ্র দেশে বাণিজ্য করতে পারবে। তবে এই ফর্মানের অর্থ নিয়ে মতভেদও দেখা যায়। ইংরেজরা দাবি করতে থাকে যে সুরাটে শুল্ক দিলে তাদের দেশের সকল বন্দরেই নিঃশুল্ক আমদানি ও রপ্তানির অধিকার দেওয়া হোক। এর ফলশ্রুতি হিসাবে ইংরেজরা হুগলি এবং চট্টগ্রাম। আক্রমণ করে (১৬৮৬-৮৭), বালেশ্বর ধ্বংস করে, সুরাট অবরোধ করে এবং সমুদ্রবক্ষে বহু ভারতীয় জাহাজ অধিকার করে নেয়। তবে মনে হয় ইংরেজরা তাদের শক্তিকে বাস্তবের থেকে অধিক বিবেচনা করেছিল। কারণ, সাম্রাজ্যের সর্বত্রই তাদের কর্মশালা বা কারখানাগুলি সরকার অধিকার করে নিলে এবং তাদের প্রধান প্রতিনিধিরা সকলেই গ্রেফতার হলে তারা শেষ পর্যন্ত মিটমাট করার আলোচনায় বসে। তবে পর্তুগিজদের সঙ্গে যে নীতি পূর্বে অবলম্বন করা হয়েছিল তদনুসারেই মুঘলরা কোনো একটি ইউরোপীয় বাণিজ্যকে সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করে দিতে চায়নি। কেননা তাতে করে তাদের সম্পূর্ণভাবে অন্য শক্তিটির উপর নির্ভর করতে হত। সেই মতো ঔরঙ্গজেব ১,৫০,০০০ টাকা অর্থদণ্ডের বিনিময়ে ইংরেজদের মাফ করে দিয়ে, তাদের বাৎসরিক ৩০০০ টাকার বিনিময়ে সমগ্র বঙ্গদেশে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করার অনুমতি দিলেন।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইংরেজ এবং ওমানি জলদস্যুদের উপদ্রব সৃষ্টি হলে মুঘলরা আরও একটি সংকটের মুখোমুখি হয়। তাদের মধ্যে সবথেকে কুখ্যাত দস্যুটির নাম ছিল ক্যাপ্টেন অ্যাভেরি। এই ক্যাপ্টেন অ্যাভেরি সুরাটের অনেকগুলি জাহাজ দখল করে নেয়, যাদের মধ্যে আবার বাদশাহী পরিবারের কিছু জাহাজও ছিল। আর সবথেকে বড়ো লুট’ ছিল গঞ্জ-ই সারওয়ার নামে একটি মুঘল জাহাজ, যাতে নাকি ৫২ লক্ষ টাকা মূল্যের পণ্য ছিল।
এই বিপদ থেকে উত্তীর্ণ হবার জন্য মুঘলেরা ইউরোপীয় বণিকদের উপর চাপ দিতে লাগল যাতে তাদের জাহাজগুলিও ভারতীয় জাহাজের সঙ্গে এক যোগে সমুদ্র যাত্রা করে। সেই সঙ্গে ভারতীয় জাহাজগুলির কামানের সংখ্যাও ক্রমশ চব্বিশ থেকে চল্লিশ এবং পরে ইউরোপীয় জাহাজগুলির মতো আবার পঞ্চাশটি পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এই কামানের বিস্ফোরণের ধাক্কা সহ্য করার মতো জাহাজের হালকেও আরও মজবুত করে তোলা হয়। শোনা যায় যে সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে সুরাটের জাহাজ-নির্মাতারা যেসমস্ত জাহাজ বানাতেন, সেগুলি প্রায় ইউরোপীয় জাহাজেরই সমতুল্য ছিল। এই জাহাজগুলির নির্মাণকৌশল এবং অস্ত্রধারণ ক্ষমতা ক্রমাগতই উন্নততর হয়ে উঠছিল। নৌচালনার ক্ষেত্রে দুর্বলতা, কামানগুলিকে যথাযথভাবে স্থাপন করতে না-পারা এবং পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতার অভাবের জন্যই এই ভারতীয় নৌবহর ইউরোপীয়দের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু ভারতীয় জাহাজগুলি ক্রমশ উন্নততর হয়ে ইউরোপীয় নৌশিল্পের কাছাকাছি উঠে আসছিল। কানোজীর আহরের জাহাজগুলিতে এমন দূরপাল্লার কামান লাগানো থাকত যাতে করে স্বয়ং শত্রুর কামানের ক্ষেপণসীমার বাইরে অবস্থান করেও শত্রুপক্ষের জাহাজ ধ্বংস করে দেওয়া যেত। সুরাটে তৈরি ওমানি রণপোতগুলি আরব সাগর অঞ্চলে বিশেষ সুনাম অর্জন করেছিলেন। মাস্কাটের আরবরাও বৃহৎ রণতরীতে অস্ত্রশস্ত্র লাগাবার ব্যবস্থা করতে শুরু করে। এবং ১৬৯৫ সালে চল্লিশটি কামানে সজ্জিত ফরাসি জাহাজ ‘লেজিয়ার’ গোঁয়ার উপকূলের সন্নিকটে চল্লিশটি এবং আশিটি কামানবাহী দুটি মাস্কাটের জাহাজের মুখোমুখি হলে সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়। রাত্রি কাল পর্যন্ত গোলাগুলি বর্ষণ চলতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে ফরাসি জাহাজটি পালিয়ে গিয়ে বিধ্বস্ত অবস্থায় গোয়ায় পৌঁছায়। এই জাহাজের অধিনায়ক (ক্যাপ্টেন) নিহত হয়েছিলেন।
তাহলে ইউরোপীয় এবং এশীয় জাহাজ নির্মাণের মধ্যকার প্রযুক্তি এবং অস্ত্রসজ্জা পার্থক্য ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছিল। মানুচ্চির দেওয়া তথ্য অনুসারে ঔরঙ্গজেব রণতরী নির্মাণের কথা চিন্তা করেছিলেন এবং তার আদেশে ইউরোপীয় কারিগরেরা পরীক্ষামূলক ভাবে নমুনাস্বরূপ একটি জাহাজও তৈরি করে। ইউরোপীয়দের অধীনে কর্মরত ইউরোপীয় গোলন্দাজগণ এই যুদ্ধজাহাজের একটি অত্যন্ত কার্যকরী প্রদর্শনের মাধ্যমে এর সবদিকেই গোলা বর্ষণ করার ক্ষমতা প্রতিপন্ন করেন। কিন্তু বাদশাহ শেষ পর্যন্ত এই প্রকল্পটি অনুমোদন করেননি। ইউরোপীয়রা কয়েকটি ভারতীয় তীর্থযাত্রীবাহী জাহাজ আটক করলে যখন বাদশাহ ইউরোপীয় আক্রমণের এই নিরন্তর ভীতিকে কী করে প্রতিরোধ করা যায় সে বিষয়ে চিন্তা করছিলেন, সেই সময় লিখিত ঔরঙ্গজেবের একটি চিঠিতে একটি অদ্ভুত মন্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়। ইউরোপীয়দের প্রতিহত করার জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের পর্যালোচনা করে ঔরঙ্গজেব সিদ্ধান্ত নেন যে সমুদ্রবক্ষে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার থেকে ইউরোপীয় বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির সঙ্গে সমঝোতা করে নেওয়া অনেক কম ব্যয়সাধ্য হবে। তবে যদি মুঘলেরা দাক্ষিণাত্য এবং সুদীর্ঘ তটরেখায় নিজেদের সুপ্রষ্ঠিত করতে পারতেন, তাহলে তারা সম্ভবত একটি নৌবাহিনী গড়ে তুলতে বাধ্য হতেন।
১৮শ শতাব্দীর প্রথমভাগে ভারতীয় অর্থনীতির ধরন
আমরা দেখেছি যে যদিও মুঘল সাম্রাজ্য একটি শ্রেণি-ভিত্তিক রাষ্ট্র ছিল, যেখানে শাসকশ্রেণির ব্যক্তিবর্গ শ্রমিকশ্রেণির পরিশ্রমের ফলকে উপভোগ করত, কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি একটি অনন্ত ক্ষুধা-বিশিষ্ট এবং সকল সম্পদগ্রাসী এক বিশাল সদা-অতৃপ্ত জলজন্তুর মতো ছিল না। তপন রায়চৌধুরীর অভিমত অন্তত তাই নির্দেশ করে। বা এটি কেবল অন্য রাজ্য জয় করে নেবার আগ্রাসী মনোভাবসম্পন্নও ছিল না, যেখানে আধুনিক কালের পূর্বতন সময়ে বেশিরভাগ রাজ্যেই ছিল কারুর-না-কারুর জয় করা সম্পদ। আসলে পূর্বতন হিন্দুরাষ্ট্র এবং পরবর্তীকালীন মুসলিম রাষ্ট্র উভয়েরই কৃষিকার্যের উন্নতির জন্য এবং ব্যবসায় এবং উৎপাদক শিল্পের সুরক্ষা এবং উৎসাহ প্রদানের নিমিত্ত কিছু নির্দিষ্ট আদর্শ ও চিন্তা ছিল। কারণ উভয়ের নিকটেই সার্বভৌমতা বলতে প্রজাদের সুরক্ষাই বোঝাত। এই প্রশাসকেরা ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্ব বুঝতে এবং পরম্পরাগতগত ভাবেই সাধারণ দোকানদার এবং পাইকারি এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে কর্মরত বড়ো বড়ো ব্যবসায়িক সংস্থার মধ্যে পার্থক্য রাখতেন। এইসর বৃহৎ সংস্থার মালিকদের ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সামাজিক ভাবে শাসকশ্রেণির ব্যক্তিদের প্রায় সমকক্ষ বলে গণ্য করা হত এবং প্রয়োজনে তাদের ডেকে অতিরিক্ত সাহায্যও চাওয়া হত। পঞ্চতন্ত্র এবং ‘Mirros of Princess’ অর্থাৎ রাজদর্শন ইত্যাদি পুস্তকে এর নিদর্শন পাওয়া যায়।
এই চিন্তাধারা বা দর্শন, প্রশাসক এবং তাদের লোভী কর্মচারীদের মধ্যেকার ফাঁকটি পূরণ করতে পারেনি বলে তর্ক শুরু হয়ে গেছে। অবশ্য কিছুটা হলেও একথা সত্য। যাই হোক, মুঘলদের অনেকগুলি পদক্ষেপ তথা ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করা, অর্থাৎ কেন্দ্রের শাসন প্রবর্তিত করা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন, আইন-শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠা, সারা দেশে খাঁটি ধাতুনির্মিত সমমানের মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন, এগুলি তো নেওয়া হয়েছিল-ই। এবং এছাড়া একমাত্র টাকার মাধ্যমেই বিনিয়োগ ব্যবস্থার প্রবর্তন করে রাজকোষে সর্বাধিক সম্পদ যে খাত থেকে আসত, সেই ভূমি রাজস্বও একমাত্র টাকার মাধ্যমে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত ইত্যাদির ফলে দেশের অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া সার্বিকভাবে দ্রুততর হয়। ১৮শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে মুঘল সাম্রাজ্য যখন দ্রুত খণ্ড খণ্ড হয়ে যাচ্ছিল তখনও কিন্তু এই প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যায়নি। আবার অনেক নূতন রাজ্য এবং সাম্রাজ্য থেকে ভেঙে যাওয়া খণ্ড বা রিয়াতের প্রতিষ্ঠা, উদীয়মান নূতন শক্তি যথা মারাঠা, জাঠ, আফগান এবং শিখদের সঙ্গে তাদের যুদ্ধসংর্ষের ফলেও আইন-শৃঙ্খলা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েনি, এবং দেশের অর্থনৈতিক সঞ্চালন ও গুরুতর ভাবে ব্যাহত হয়নি। নূতন শাসকশ্রেণি অপস্রিয়মান অভিজাত মুঘল শাসক সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার ধারাকেই অন্ধভাবে অনুসরণ করতে থাকে এবং নিজেদের অধিকৃত অঞ্চলে কৃষি ও বাণিজ্য, উদ্যোগকে উৎসাহ প্রদান করে। এর প্রমাণস্বরূপ বলা যায় যে ইংরেজ, ওলন্দাজ বা ফরাসি বাণিজ্য সংস্থাগুলিকে ইউরোপে ক্রমবর্ধমান রপ্তানির জন্য তুলা, রেশম ইত্যাদি পণ্যবস্তু সংগ্রহের ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা পেতে হয়নি। জ্যোতিষ্কমণ্ডলের মধ্যে সূর্যের মতো দীপ্যমান দিল্লি এবং আগ্রার মতো কিছু মহানগরের অবক্ষয় হলেও ফৈজাবাদ, বেনারস, পুনা, হুগলি ইত্যাদি বহু নতুন শহরের বিস্তার ও উত্থান এই শূন্যতাকে পূরণ করতে সক্ষম হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ১৮শ শতাব্দীর প্রথম অর্ধে নগরায়ণ প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়নি এবং ব্যবসা ও উৎপাদনেরও কোনো অবনমন ঘটেনি।
১৮শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে নাগরিকতার তো কোনো অবক্ষয় ঘটেইনি, বরং টাকাপয়সার লেনদেন বা মুদ্রাভিত্তিক বাণিজ্য এখন শহর থেকে সুদূর গ্রামাঞ্চলেও প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। এই পরিবর্তন কিছুটা তুলা, নীল, তামাক ইত্যাদির মতো টাকার বিনিময়ে বিক্রয়যোগ্য শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সম্ভব হয়েছিল। আবার ইউরোপে বস্ত্রশিল্প এবং কোনো কোনো প্রতিবেশী দেশে তামাক রফতানির ক্রমবর্ধমান চাহিদার জন্যও অর্থের লেনদেন বৃদ্ধি পেয়েছিল। যুদ্ধবিগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ হয় সাহুঁকার, অর্থাৎ বণিক-মহাজনের কাছ থেকে ধার নিয়ে, অথবা জমি চাষ করার জন্য বাঁধা দিয়ে বা ইজারা দিয়ে সংগ্রহ করা হত। এই সময় ইজারা দেওয়ার ঘটনা ক ইজারদারি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল যা থেকে দুটি বিষয় বোধগম্য হয়। প্রথমটি হল দূর গ্রামাঞ্চলের উপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের শক্তি হ্রাস, এবং দ্বিতীয়টি হল শাসকদের নগদ অর্থের প্রয়োজন বৃদ্ধি। সময়ে সময়ে তাদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ শোধ করার জন্য সাহুঁকারদের জমির ইজারা দেওয়া হত, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাহুঁকাররা নিজেরাই কোনো গ্রাম ইজারা নেবার জন্য লড়াই করত। যেমন ১৭৬৭ সালে মোহন রাম ইন্দর চান্দ পূর্বতন জয়পুর রাজ্যের খান্দেলা পরগনার দুটি তালুক ৬০,০০০ টাকার বিনিময়ে ইজারা নেন। তিনি হিসেব করেছিলেন যে এই গ্রামগুলির জমা অর্থাৎ উৎপন্ন রাজস্বের পরিমাণ হবে ১,০০,০০০ টাকা।
১৮শ শতাব্দীতে হোলকার এবং সিন্ধিয়া-শাসিত মধ্য ভারতের অভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন ইংরাজ পর্যবেক্ষক ম্যালকম তর মধ্য ভারতের স্মৃতি’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন এই মারাঠা রাজকুমারদের ভূমি মুখ্যত ভাড়া দেওয়া হত। এবং যাঁরা এই সব জমি ভাড়া নিতেন তারা বেশিরভাগই অধিকোষের (Bank) বা অর্থভাণ্ডারের মালিক অথবা সেই শ্রেণির মানুষদের দ্বারা সমর্থিত অন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সদস্য হতেন। এই অভিজাত শ্রেণির সঙ্গে যোগাযোগের ফলে তারা নিজেরাও যথেষ্ট প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন এবং রাজ্যের মন্ত্রিসভায় অথবা প্রদেশের জনশাসন ব্যবস্থায় এই প্রভাব বিস্তার করতে তারা কুণ্ঠিত হননি। ফলত তারা অতীব ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন, যে ক্ষমতার প্রয়োগ তারা করতেন একমাত্র সম্পদ সংগ্রহ ও সঞ্চয় কার্যে।
ম্যালকম আরও বলেন যে সমস্ত সম্পদশালী ব্যক্তিরা অর্থভাণ্ডার বা অধিকোষ থেকে প্রতিমাসে এক শতাংশ হারে সুদের বিনিময়ে টাকা ঋণ করতেন। তাদের কারও-কারও কাছ থেকে এই মারাঠা শাসকগণ একবছরের রাজস্বের হিসাবে দুই বৎসরের রাজস্বের সমান অর্থ অগ্রিম হিসাবে দাবি করতেন।
তবে যে সকল সাহুকাররা শহরে বাস করতেন, তাদের মধ্যে কতজনকে এই ইজারা দান করার প্রথা বর্তমান ছিল সে বিষয়ে আমরা স্থির নিশ্চিত নই। তবে মনে হয় যে গ্রামীণ অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিরাই সর্বাধিক ইজারার অধিকারী হতেন। যথা জমিদার, জায়গিরদার, স্থানীয় বর্ধিষ্ণু কৃষকেরা, মহাজন, প্যাটেল ইত্যাদি। অম্বর এবং অন্যান্য শাসকগণ মুঘল মনসবদারদের কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদি সূত্রে ইজারা নিতেন। তার উদ্দেশ্য ছিল নিজরাজ্যের শাসনের সীমানার আরও পরিবর্ধন। এই লেনদেনে সাহুঁকারদের প্রধান ভূমিকা মুল জামিন অথবা যে চুক্তি সম্পাদিত হচ্ছে তার জামিনদারের। মাঝেমধ্যে তাদের দেয় ভূমি রাজস্ব বা খাজনা মেটাবার জন্য জমিদাররাও সাহুঁকারদের নিকট থেকে ঋণ নিতেন। তাই আমরা একথাও শুনেছি যে আউধে জমির রাজস্ব দেবার সময় হলে তা পরিবারের অর্থকোষ বা ব্যাংকের মাধ্যমেই দেওয়া হত। যদিও জমিদার অথবা তালুকদাররা এক নতুন ধরনের ভূস্বামী, যারা জমিদারদের সঙ্গে চুক্তি করে তালুকের অধিকার লাভ করত এবং সেই তালুকের জন্য ভূমি রাজস্ব দিয়ে থাকত ব্যাংক–বা অধিকোষকে যথেষ্ট মূলধন দিতে না পারলে, অধিকোষের মালিক তার নিজস্ব সম্পদ থেকেই সেই অর্থ অগ্রিম দিত। এবং ভাড়া জমা পড়বার সময় প্রতিমাসে শতকরা এক টাকা হিসাবে সুদ নিয়ে সেই অগ্রিম দেওয়া অর্থ অধমর্ণের কাছ থেকে উদ্ধার করত। তবে এই সুদ শতকরা তিন টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারত।
অধিকোষপতি ব্যবসায়ীরা আর-একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। তা হচ্ছে বিমা-হুঁন্ডি পদ্ধতি অবলম্বন করে ভূমি রাজস্ব বা দেয় অর্থ দূর-দূরান্তরে প্রেরণ করা। এইভাবে এক কোটি টাকার অধিক উদ্বৃত্ত ভূমি রাজস্ব বঙ্গদেশ বা খালিশা জমি থেকে শতাব্দীর মধ্যভাগে হুন্ডির মাধ্যমে জগৎ শেঠকে প্রেরণ করা হয়।
অর্থবান সম্প্রদায় জমিদারি ক্রয় করার ব্যাপারে কোনো ঔৎসুক্য দেখিয়েছিলেন কি না আমরা ঠিক জানি না। এই সময় যদিও আমরা বহু জমিদারি বিক্রির কথা জানি, তবে সেগুলো সমস্তই ছিল ক্ষুদ্র আয়তনের। এই সব জমিদারির বিক্রয় মূল্য ছিল এর ভূমি রাজস্ব বা খাজনার প্রায় আড়াই গুণ মাত্র, সুতরাং কোনো বৃহৎ অধিকোষ এইসব জমিদারি ক্রয় করার ব্যাপারে কোনো ঔৎসুক্য দেখাত বলে মনে হয় না। এর একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম দেখা যায় যখন একজন পাঞ্জাব ক্ষাত্র ব্যবসায়ী বর্ধমানের রাজ্যটি কিনে নেন।
জায়গির ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন শক্তিশালী ব্যক্তিরা নিজেরাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন, তার থেকেই বড়ো বড়ো জমিদারির পত্তনী শুরু হয়। সুতরাং যেসব শক্তিমান এবং সুদক্ষ ব্যক্তিরা নিজেদের প্রভাবাধীন গোষ্ঠী বা জামিয়ত সৃষ্টি করতে পারতেন, তারাই এগিয়ে যান। আবার নীচের স্তরে বিভিন্ন প্রশাসকেরা পরম্পরাগত ভাবে মদদ-ই-মাশ সনদধারী জমিকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করায় তারা জমিদার হয়ে ওঠেন। এই ক্ষুদ্র জমিদারেরা গ্রামে বাস করতেন এবং কালক্রমে এরা একটি ভূস্বামী ভদ্রলোক গোষ্ঠীর সৃষ্টি করেন যাদের জীবনধারণের মান ছিল সামান্য উচ্চতর এবং তাই তারা শহরের জিনিসপত্রের ভক্ত ছিলেন। শহুরে পণ্যবস্তুর গ্রামে প্রবেশ করার এ আর-একটি নিদর্শন।
এক আধুনিক ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব দেখিয়েছেন যে সোনা ও তামার মতো অন্যান্য মুদ্রা-ধাতু’র তুলনায় ১৫৫০ থেকে ১৭০০ সালের মধ্যে রুপোর দাম বহুলাংশে কমে যায়। সতেরোশো সালের শেষ প্রান্তে এসে সোনার দাম রুপোর থেকে দেড়গুণ বেশি ছিল। (আসলে ১টি সোনার মোহরের দাম ৯ থেকে ১৪টি রুপোর টাকার সমান হয়ে দাঁড়ায়)। তামার মূল্যও পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ বেশি হয়ে ওঠে। ১৫৮২ সালে ৪০টি তামার ‘দাম’ থেকে ১৭ সালে টাকার মূল্য হ্রাস হয়ে মাত্র ১৬ তামার দামে পৌঁছোয়। এর কারণ মূলত ইউরোপে গরম মশলাপাতি এবং ভারতীয় বস্ত্রাদি, নীল, সোরা ইত্যাদির চাহিদা মেটাবার জন্য ভারতে মূল্য হিসাবে প্রচুর। পরিমাণে আমেরিকান রৌপ্যের অনুপ্রবেশ। শিরিন মুসভি একটি নূতন হিসাব করে দেখিয়েছেন যে সতেরোশো শতকে সাধারণভাবে দ্রব্যমূল্য মাত্র শতকরা ২৭ ভাগ বেড়েছিল অর্থাৎ বছরে মাত্র ০.৩০ শতকার হারে এই মূল্যবৃদ্ধি বর্ধিত হয়েছিল। অবশ্য দুর্ভিক্ষ ইত্যাদির জন্য মাঝে মাঝে কৃষিজ বস্তুর মূল্য বেশ বড়রকমের ওঠাপড়া লক্ষ করা গিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতীয় অর্থনীতি যে কতটা শক্তিশালী ছিল তার প্রমাণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে এত রৌপ্যমুদ্রা বাজারে এসে যাওয়া সত্ত্বেও মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ ছিল যথেষ্টই নিয়ন্ত্রিত। একথা সর্বজন স্বীকৃত যে এই সামান্য মূল্যবৃদ্ধিকে কখনোই মূল্য বিপ্লব’ বা বৈপ্লবিক বৃদ্ধি বলা যাবে না যেমনটি ইউরোপে ঘটেছিল। ভূস্বামী শ্রেণি এবং বণিক শ্রেণিকে আরও সমৃদ্ধিশালী করে তুলেছিল। তবে ১৭১০ সালের পর থেকে ভারতে খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধি হতে হতে মধ্য আঠারো শতকের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে ভারতের সর্বত্র একই হারে মূল্যবৃদ্ধি হয়নি। যখন দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় বাংলায় মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল অনেক কম, আবার এর কারণ হিসাবে পূর্ববঙ্গে কৃষিকার্যের সম্প্রসারণ, এবং ব্যবসা ও উৎপাদনের পরিবর্ধনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
তবে কেবল ব্যবসায়ীবৃন্দই নয়, কঁচা রেশম, নীল, চিনি, তেল সোরা ইত্যাদি বাণিজ্যিক শস্য উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কৃষকরাও এই মূল্যবৃদ্ধি থেকে উপকৃত হয়েছিল, বিশেষ করে দেশের মধ্যভাগের কৃষিজীবীগণ। এরা অবশ্য প্রায়ই ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত থাকত। প্রশাসনও আবার ইজারার ভিত্তিতে এই লাভের অংশ নিতে উদ্যোগী হয়ে পড়ে।
এই অবস্থার অবশ্য একটি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। যথা আভ্যন্তরিণ এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং উৎপাদক মণ্ডলীর উপর বণিকদের নিয়ন্ত্রণও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই নিয়ন্ত্রণ এসেছিল দাদনি (দাদন) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। যার দ্বারা কারিগরদের নগদ অর্থ বা কাঁচা মাল অগ্রিম হিসাবে দেওয়া হত। এটি কোনো নূতন পদ্ধতি না হলেও আঠারোশো সালে এর সম্যক বিকাশ হয়।
এই পদ্ধতিতে কারিগরদের সর্বদাই কোনো-না-কোনো বণিকের সঙ্গে সম্পর্কে বেঁধে রাখার চেষ্টা করা হত। সাধারণত কোনো ভারতীয় প্রতিনিধি বা গোমস্তার মাধ্যমে ইউরোপীয় সংস্থাগুলিও এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে থাকে। দক্ষিণ ভারতে বেশিরভাগ বস্ত্রশিল্পই গ্রামাঞ্চলে তৈরি হত। উৎপাদক কারিগরদের তাদের ইচ্ছামতো বিপণনের স্বাধীনতা থাকলেও এই পদ্ধতির মাধ্যমে তাদের কোনো-না-কোনো ব্যবসায়ীর সঙ্গে বেঁধে রাখার চেষ্টা করা হত। তাই যেমন আমরা আগেই দেখেছি যে কাশী ভিরান্না এবং তার সহযোগীদের মাদ্রাজ থেকে আরমাগাঁও পর্যন্ত সমগ্র উপকূলের উপর এত কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল যে তাঁতিদের বসতিগুলিকে ভিরান্না গ্রাম’ বলে ডাকা হত। এই পদ্ধতি ধীরে ধীরে সোরা, নীল, এমনকি কাশ্মিরী শাল পর্যন্ত বিভিন্ন উদ্যোগের ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হয়। তবে সাধারণত উৎপাদনের যন্ত্রপাতিগুলির মালিকানা কারিগরদেরই থাকত। এর ফলে উৎপাদন পদ্ধতিরও কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, যদিও বিশেষ করে ইউরোপীয় সংস্থাগুলি বস্ত্রশিল্পে উৎপাদনের উপর কঠিন শর্ত আরোপ করতে চেষ্টা করত, যথা কাপড়ের মাপ, গুণমান, উৎকর্ষ ও নকশার বিষয়ে তাদের বিনা দাবি থাকত। তবে যেমন আমরা দেখেছি, যে কয়েকটি মাত্র অবস্থাতেই কারিগরদের যৌথ তত্ত্বাবধানে কাজ করতে দেখা গেছে। বরং কারিগরদের। উপর বণিকদের আর্থিক নিয়ন্ত্রণ এত বেশি ছিল যে অনেক সময় শ্রমশিল্পীদের দেওয়া ঋণ বা আগামকে ‘মজুরি’ বলে ডাক হত। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে ‘দাদনি’ প্রথাও উৎপাদনের পদ্ধতির উপর কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। ওলন্দাজরা তন্তুবায়দের মজুরির মাধ্যমে তাদের বস্ত্রশিল্প চালু করেছিল বটে কিন্তু এধরনের ঘটনা ছিল অত্যন্ত বিরল।
কিন্তু স্বাধীনভাবে কর্মরত কারুবিদরা নিজেরাই নিজেদের উৎপাদন ও বিপণন কেন্দ্র খোলবার যে প্রচেষ্টা করে, তা ছিল নিঃসন্দেহে এই সময়কার এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে লক্ষ্ণৌতে এমন সব দক্ষ কারিগর বা ওস্তাদ ছিলেন। যাদের অধীনে ৫০০ জন পর্যাপ্ত শিক্ষানবীশ কর্মরত ছিল। আবার বঙ্গদেশে অনেক বর্ধিষ্ণু তন্তুবায় নিজের মূলধনেই উৎপাদন করতেন এবং স্বাধীনভাবেই সেইসব মাল বিক্রি করতেন। কাশ্মীরে শাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে কোনো কোনো দক্ষ শালকর শিল্পীর কর্মশালায় ৩০০ টি পর্যন্ত তাঁত থাকত। এই সমস্ত যন্ত্রপাতি এই সুদক্ষ ওস্তাদ শালকরেরই সম্পত্তি ছিল এবং তাঁর লভ্যাংশ ছিল মোট লাভের ৫ ভাগের ১ ভাগ হত।
এইগুলি অষ্টাদশ শতাব্দীর ভারতে সম্ভাবনাময় উন্নয়ন ক্ষেত্রের কয়েকটি নিদর্শন মাত্র। এই সময়ে দেশে ব্যবসায়িক মূলধন ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছিল, অর্থাৎ আরও বেশি মূলধন ব্যবসায়ে নিয়োজিত হচ্ছিল। এটি একটি নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সরকারি হস্তক্ষেপের আশঙ্কায় ব্যবসায়ীরা তাদের লভ্যাংশ-জনিত অর্থ জমিয়ে রাখতে পারতেন না বলে যে ধারণা প্রচলিত ছিল, আমরা ইতিমধ্যেই সে ধারণা বাতিল করে দিয়েছি। ইরফান হাবিবের মতে ‘দেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ব্যবসায়ে নিয়োগ করার মতো মূলধন বিদ্যমান ছিল এবং একটি সুশৃঙ্খল ঋণ বা লেনদেনের ব্যবস্থা থাকার দরুন এর যেমন আয়তন বৃদ্ধি হয়েছিল তেমনি এর গতিশীলতাও বৃদ্ধি পায়।
এ কথাও অনেকে বলেন যে মুলধনের স্বল্পতার কারণেই ইউরোপ থেকে ভারতে সুদের হার বেশি। ১৭শ শতাব্দীর মধ্যভাগে আবার সুদের হার কমে গিয়েছিল যথা উত্তর ভারতে প্রতি মাসে ১ থেকে ১২ শতাংশ থেকে এই হার • এমন কি ২ শতাংশ কি আরও কমে গিয়েছিল। কিন্তু এই সুদের হারও ইংল্যান্ডের থেকে বেশি ছিল। এর সঠিক কারণ বুঝে ওঠা কঠিন। হয়তো ভারতে পরম্পরাগত ভাবেই সুদের হার বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু দেশে যে মূলধনের কোনো ঘাটতি ছিল না সে ব্যাপারে প্রচুর প্রমাণ আছে। দেশের বিভিন্ন ভাগে বহু অত্যন্ত ধনশালী বণিক ছিলেন এবং তারা মাঝেমধ্যে যে ইউরোপীয় কোম্পানিদেরও মূলধন জোগাতেন সে কথা অনেকেই জানে। রফতানির চাহিদা মেটাবার জন্য দেশের উৎপাদনযোগ্য সম্পদের যথাসাধ্য সম্প্রসারণ করা হল, অথচ ব্যাপক মূল্য বৃদ্ধি হল না–দেশে মূলধনী অর্থের ঘাটতি থাকলে বাস্তবে এটা সম্ভব হত না।
তবে এর অর্থ এই নয় যে বাণিজ্যিক মূলধন বৃদ্ধি হলে স্বতঃসিদ্ধভাবে শিল্পে পুঁজিবাদ গড়ে উঠবে। যেসব মেশিন বা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে শিল্পে শ্রমিকদের কর্মচ্যুতি ঘটে, সে ধরনের কল-কবজা ভারতে তখন ব্যবহার হত না বললেই হয়। এছাড়া ভারতে তখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যারও ভিত্তি স্থাপিত হয়নি। মনে রাখতে হবে যে শিল্প-ভিত্তিক ধনতন্ত্রবাদ দক্ষিণ ইংল্যান্ডেরই একটি স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া ছিল যা সেই সময়ে পৃথিবীর অন্যত্র যথেচ্ছ গড়ে ওঠা সম্ভব ছিল না। তবে এই নূতন অর্থনীতি একস্থানে প্রবর্তন হলে অন্যত্র তার পুনরাবৃত্তি সম্ভব ছিল, যা ফ্রান্স, জার্মানি। এবং পরবর্তীকালে জাপানের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। এখানে যা বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় তা হল, দেশে প্রচুর ব্যবসায়িক মূলধন, সুনিপুণ অর্থ সরবরাহক, এবং উদ্যোগপতি ও সুদক্ষ কারিগর থাকার জন্য ভারতও এই পথে অগ্রসর হতে সক্ষম ছিল। কিন্তু ঔপনিবেশিকদের হস্তক্ষেপের ফলে ভারতের অর্থনীতির বিকৃতি ঘটে এবং এশিয়ার সর্বপ্রধান উৎপাদনশীল দেশ হবার সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভারত ধনতান্ত্রিক পরিমণ্ডলের একপাশে স্থানচ্যুত হয়ে কেবল কাঁচামাল উৎপাদনের দেশ বলেই পরিগণিত হয়।
শোনা যায় যে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ধনতান্ত্রিক বিশ্বঅর্থনীতির উদ্ভবের আগে পৃথিবীতে বেশ কয়েকটি পৃথক ‘বিশ্ব অর্থনীতি’ ছিল এবং ভারতবর্ষ ও ভারত মহাসাগর অঞ্চল নিয়ে এমন একটি ‘বিশ্ব অর্থনীতি’ গঠিত হয়েছিল। ফার্নান্ড ব্ৰদেল বিশ্ব অর্থনীতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলছেন যে এই গ্রহের এক অর্থনৈতিক স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চল, যা নিজের বেশিরভাগ প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম। এই অঞ্চলের সঙ্গে যার অভ্যন্তরীণ যোগসূত্র এবং আদানপ্রদানের মধ্য দিয়ে এক জৈবিক একতা গড়ে উঠেছে। তার যুক্তি ছিল যে ‘ভারতবর্ষ ঠিক এই রকমই একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্র যা আফ্রিকার পূর্ব উপকূল থেকে পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ অবধি ভারত মহাসাগরের বিস্তারকে একপ্রকার নিজস্ব সমুদ্রে পরিণত করেছে। বা এমন এক সমুদ্রে পরিণত করেছে যা সম্পূর্ণ ভাবে এদের নিজস্ব। আমরা ইতিমধ্যেই লক্ষ করেছি যে ইউরোপীয়দের আগমন সত্ত্বেও ১৮শ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত এই বাস্তবতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ব্রান্ডেল-এর মতানুসারে এই রকম প্রত্যেকটি অঞ্চলেরই একটি করে কেন্দ্রবিন্দু অবশ্যই ছিল, সেখানে ছিল একটি নগর এবং যেরূপেই হোক, সেখানে ইতিমধ্যেই এক ধরনের ধনতন্ত্রেরই প্রাধান্য ছিল। স্টিনস্ গার্ড-এর যুক্তি ছিল সমগ্র ভারতকে পশ্চাদপটে রেখে, ১৭শ শতাব্দীতে সুরাট এই রকমই একটি কেন্দ্র রূপে আত্মপ্রকাশ করে। ইউরোপের আমস্টার্ডাম-এর মতো সুরাটে মূলধন হিসাবে প্রচুর অর্থ ছিল, অনেকগুলি পরিশ্রমী এবং সুযোগ্য অধিকোষপতি এবং উদ্যোগী পুরুষ ছিল, সকল জাহাজেই বিনা বাধায় প্রবেশ করা যেত এবং এক বিরাট নৌবহর ছিল যা যে-কোনো একটি মরশুমের মধ্যেই সেই অঞ্চলের প্রত্যেকটি বন্দরে পৌঁছে যেতে পারত। ওলন্দাজরা বাটাভিয়াকে একটি কেন্দ্রচ্যুত কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এ কার্যে তারা সফল হয়নি কারণ মূলত মুঘল এবং অন্য এশীয় সাম্রাজ্যগুলি যেখানে অবাধ বাণিজ্যকে উৎসাহ দিত সেখানে ওলন্দাজরা নিজেদের একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার বিস্তারের চেষ্টায় বেশি মনোনিবেশ করেছিল। যাই হোক, ১৮শ শতাব্দীতে সুরাটের অবস্থানের অবনতি হয়। সাফাভিদ সাম্রাজ্য ভেঙে যাওয়ার ফলে সেই অঞ্চলে ভারতীয় পণ্যের রফতানি হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, এবং মুঘল সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ার জন্য সুরাটের ব্যবসায়ীরা ইংরাজ ও ওলন্দাজদের চাপ এবং একচেটিয়া আধিপত্য স্থাপনের জন্য তাদের নিরন্তর চেষ্টা সহ্য করে উঠতে পারেনি। এর ফলে সুরাটে ভারতীয় নৌবাণিজ্যের দ্রুত পতন হয়। ১৭০১ সালে যেখানে সুরাট বন্দরে ১১২টি জাহাজ প্রবেশ করত, ১৭১৬ থেকে ১৭৩৩-এর ভেতর তা কমে গিয়ে মাত্র ৩২টিতে এবং ১৭৩৪ থেকে ১৭৪১-এর মধ্যে ১৯ টিতে এসে দাঁড়ায়। অন্যান্য অঞ্চলের ভারতীয় বণিকেরা আরও ধীরে ধীরে এই সমস্যায় কবলিত হয়। ইউরোপীয় জাহাজে মাল বোঝাই করতে করতে তারা নিজেদের বণিক সত্তা ভুলে গিয়ে ক্রমশ ইউরোপীয় সংস্থাগুলির উপর অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। অশীন দাসগুপ্ত যুক্তি দিয়ে বলেন ‘মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতি এবং মারাঠাদের অভিযানের পরবর্তী সময়ে গুজরাটের নৈরাজ্যময় পরিস্থিতির জন্য গঙ্গা উপত্যকার উৎপাদন কেন্দ্রগুলির সঙ্গে সংযোগ ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ফলে কিছু সমস্যা সাময়িক ভাবে সৃষ্ট হয়েছিল বটে, তবে তা কিন্তু সুরাটের অবনমনের মূল কারণ হতে পারে না।’ এই সঙ্গে সঙ্গে এশীয় বাণিজ্যের অবনতি ঘটে এবং ইউরোপীয় জাহাজে করেই দেশ বিদেশে পৌঁছায়। স্টিনস গার্ডের বিশ্বাস যে ১৮শ শতাব্দীতে ভারতীয়দের বহির্বিশ্বে বাণিজ্যের অর্ধেকই ছিল ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে, এবং ধীরে ধীরে ভারতীয় বণিকদের অপ্রধান শ্রেণিতে অবনতি ঘটে। এবং ধীরে ধীরে ভারতবর্ষ বিশ্বজনীন পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অংশীভূত হয়ে পড়ে। তবে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক চাপে ভারতীয় হস্তশিল্পের ধ্বংস প্রাপ্তি, এবং ভারতবর্ষের কেবল এক বৃহৎ কাঁচামাল সরবরাহকারী দেশে পরিণত হওয়া, যেসব কারণে ভারতকে এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অঙ্গীভূত হতে হয়, তা কিন্তু ভারতের ইতিহাসের আর-এক সময়কালের ঘটনা।
—
১. প্রায়শই এই ঘটনা ঘটেছিল সপ্তদশ শতকে। কিন্তু এখন হিসাব করে দেখা গেছে যে মূল্য বৃদ্ধি পুরো বোড়শ শতক ধরে ঘটেছিল। ১৬২০ থেকে ১৬৮০ সালের মধ্যবর্তী সময়েই ইউরোপ, তুরস্ক ও চিন জুড়ে মূল্য হ্রাস হয়েছিল, শস্য হানি দেখা গিয়েছিল এবং জনসংখ্যা কমে গিয়েছিল। বহু ঐতিহাসিক সপ্তদশ শতকে এক নতুন বরফের যুগ সন্তর্পনে বয়ে গিয়েছিল বলে দাবি করেন। যার ফলে বৃষ্টিপাত কমে গিয়েছিল ও শস্য হানি দেখা দেয়। এই একই রকম ঘটনা এ সময় লক্ষ্য করা গিয়েছিল দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় যার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় অ্যান্থনি রীড-এর The combridge history of south east asia, vol. 1, 2, page 144-45-এ প্রবণতা ভারতকেও গ্রাস করেছিল সেই সময়। কারণ সপ্তদশ শতকে দেশজুড়ে অনেক ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ আছড়ে পড়েছিল। আর এর ফলেই হয়তো সপ্তদশ শতকে ভারতে মৃদু মূল্য বৃদ্ধি দেখা গিয়েছিল।