১৪. অরু এসে উপস্থিত

ভাদ্র মাসের শুরুতে অরু এসে উপস্থিত। হাতে একটা সুটকেস। তাকে নিয়ে এসেছে। সদ্য গোঁফ উঠা মুখচোরা ধরনের এক ছেলে। ভীতু ছাউনি, একবারও মাথা উঁচু করে তাকাচ্ছে না। স্যুটকেস নামিয়ে রেখেই সে উধাও হয়ে গেল। মিনু বললেন, ব্যাপার কি রে?

অরু মায়াকান্না জুড়ে দিল।

কান্নার ফাঁকে ফাঁকে ভাঙা ভাঙা কথা থেকে যা জানা গেল তা হচ্ছে– স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সে পালিয়ে এসেছে। যে তাকে পৌঁছে দিয়েছে তার নাম সাঈদ। কলেজে আইকম পড়ে। পাশের বাড়িতে লজিং থাকে। মিনু কঠিন গলায় বললেন, তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? পেটে ছয় মাসের বাচ্চা নিয়ে পালিয়ে চলে এলি? তার আগে বিষ খেয়ে মরতে পারলি না। বাজারে বিষ পাওয়া যায় না?

অরু শুকনো গলায় বলল, সব কিছু না শুনেই তুমি এই কথা বললে? বেশ, বিষ এনে দাও আমি খাব। সময় তো শেষ হয়ে যায়নি।

জালালুদ্দিন বললেন, কি শুরু করলে মিনু, মেয়েটা একটু ঠাণ্ডা হোক। সব আগে শুনি। না শুনেই বকাঝকা।

মিনু ঝাঝিয়ে উঠল, সব কিছুর মধ্যে কথা বলবে না। কথা শোনা শুনির এখানে কি আছে? বোকার বেহদা মেয়ে। পেটে ছমাসের বাচ্চা নিয়ে চলে এসেছে। কি সর্বনাশের কথা!

জালালুদ্দিন বললেন, একটা ব্যবস্থা হবেই। এত চিন্তার কি? বিপদ দেবার মালিক যিনি, বিপদ ত্ৰাণ করার মালিকও তিনি। তুমি এক কাপ গরম চা মেয়েটিকে দাও। মুড়ি থাকলে তেলমরিচ দিয়ে মেখে দাও। অরু মা, তুই আয় আমার কাছে। ঘটনা কি শুনি। মিনু বললেন,

তোমাকে কোনো ঘটনা শুনতে হবে না।

তিনি মেয়েকে নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, এখন বল কি হয়েছে? তোর এত বড় সাহস কেন হল শুনি! অরু কিছুই বলল না, মাকে জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। সমস্ত দিনেও এই কান্না থামল না।

তিথি এল চারটার দিকে। তিথিকে দেখে অরুর কান্না আরো বেড়ে গেল। জালালুদ্দিন বললেন, মেয়েটা কিছুই খায়নি। তিথি মা দেখ তো কিছু খাওয়াতে পারিস কি-না! বিরাট সমস্যা হয়ে গেল। বেশি কান্না ভাল না। চোখের ক্ষতি হয়।

হীরু এল সন্ধ্যার আগে আগে। সে কিছু না শুনেই খুব লাফঝাপ দিতে লাগল–দুলাভাই বলে রেয়াত করব না। চটি জুতা দিয়ে পিটিয়ে চামড়া ঢিলা করে দেব। দাঁত সব কটা খুলে ফেলব। শালাকে ডেনটিস্টের কাছে গিয়ে দাঁত বাধাতে হবে। তিথি এসে ধমক দিয়ে হীরুকে থামাল। এবং বুঝিয়ে-সুঝিয়ে টেলিগ্রাম করতে পাঠাল। টেলিগ্রাম করা হবে। আবদুল মতিনকে। সেখানে লেখা থাকবে, অরু এখানে আছে। চিন্তার কোনো কারণ নাই।

হীরু টেলিগ্রাম করে টাকা নষ্ট করার তেমন কোনো প্রয়োজন অনুভব করল না। বললেই হবে–টেলিগ্রাম করা হয়েছে। চিঠি যদি মিস হতে পারে তাহলে টেলিগ্রাম ও হতে পারে। বর্তমানে হাত একেবারেই খালি! টেলিগ্রাম উপলক্ষে পাওয়া বিশ টাকার নোটটা কাজে লাগবে। হীরু চলে এল ঢাকা মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে।

এ্যানার মা চারদিন হল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বেশির ভাগ সময় রাতে এ্যানা তাঁর সঙ্গে থাকে। ভাগ্য ভাল হলে আজও হয়ত সেই আছে।

অবশ্যি হাসপাতালে গিয়েও কোনো লাভ হবে না। ভদ্রমহিলার এখন-তখন অবস্থা। সারাক্ষণই নাকে অক্সিজেনের নল ফিট করা। মাকে এই অবস্থায় ফেলে মেয়ে নিশ্চয়ই তার সঙ্গে বকবক করবে না। তবু চেষ্টা করতে তো দোষ নেই।

ফিমেল ওয়ার্ডের দোতলায় জানালা ঘেঁষে এ্যানার মার বেড়। ফিমেল ওয়ার্ডে যাবার ব্যাপারে খানিকটা কড়াকড়ি আছে। হীরুর তেমন সমস্যা ছিল না। কলাপসেবল গেটের দারোয়ানকে কাঁদো। কাঁদো গলায় বলল, ভাই আমার মা ছিলেন হাসপাতালে। মারা গেছেন এ রকম সংবাদ পেয়ে এসেছি। একটু যদি কাইন্ডলি…

হাসপাতালের লোকজনও মৃত্যুর খবরে বিচলিত। দারোয়ান তাকে ছেড়ে দিল। হীরু চলে এল দোতলায়। আশ্চৰ্য ব্যাপার এ্যানা বারান্দাতেই আছে! রেলিং-এ ভর দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কাঁদছে নাকি? তার মার কি ভাল-মন্দ কিছু হয় গেল? তেমন কিছু হলে চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তোলার কথা। হাসপাতালে বোধ হয় সে রকম কিছু করার নিয়ম নেই।

এই এ্যানা?

এ্যানা চমকে তাকাল। বিরক্ত গলায় বলল, আবার হাসপাতালে চলে এসেছেন? পরশু দিন না বললাম হাসপাতালে আসবেন না।

তোমার কাছে তো আসিনি। আমার এক ক্লোজ ফ্রেন্ড ইমতিয়াজ, ব্যাটার হঠাৎ পেটে ব্যথা, অ্যাপেনডিসাইটিস-ফাইটিস হবে। হাসপাতালে নিয়ে এসেছি, ব্যাটার এখন অপারেশন হচ্ছে। অপারেশন হওয়া পর্যন্ত থাকতেই হবে। কাজেই ভাবলাম খোঁজ নিয়ে যাই। তোমার মা, তার মানে বলতে গেলে আমারো মা।

আপনার মা হবে কেন? কি-সব উল্টাপাল্টা কথা বলেন!। এইসব আর করবেন না। রাগে গা জ্বলে যায়।

উনি আছেন কেমন?

তা দিয়ে আপনার দরকারটা কি? মার খোঁজে তো আপনি আসেননি।

তোমার মার খোঁজে আসিনি– তাহলে এলাম কেন?

এসেছেন আমাকে বিরক্ত করতে।

হীরু অতি দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল, নিচু গলায় বলল, এখানে সিগারেট খাওয়া যায় এ্যানা?

না, খাওয়া যায় না। আপনি এখন চলে যান তো।

তুমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছো কেন?

মা ঘুমুচ্ছে তাই দাঁড়িয়ে আছি।

তুমি ঘুমাও কোথায়?

ঘুমাবো। আবার কোথায়? এখানে কেউ কি আমার জন্যে বিছানা করে রেখেছে?

সারা রাত জেগে থাক?

হুঁ, অনেকেই বারান্দায় চাদর পেতে ঘুমায়। আমি পারি না। ঘেন্না লাগে।

বলতে বলতে এ্যানা হাই তুলল। বেচারীর শরীর খারাপ হয়ে গেছে, ভেজা ভেজা চোখ। মুখ শুকিয়ে কেমন হয়ে গেছে। হীরুর মনটা মায়ায় ভরে গেল। সে কোমল গলায় বলল, চা খাবে নাকি এ্যানা?

কি-সব কথাবার্তা আপনার। এখানে চা খাব কোথায়? এটা কি রেস্টুরেন্ট?

হাসপাতালের গেটের ভেতর এক বুড়ে চা বিক্রি করছে। চা খেলে তোমার রাত জাগতে সুবিধা হবে। চল না।

এক কাপ চা খেলেই আপনি চলে যাবেন?

চলে যাব না তো কি? আমার ঐ ফ্রেন্ডের অপারেশনের কি হল খোঁজখবর করে বাসায় যেতে হবে। বিরাট সমস্যা বাসায়। আমার বড় বোন পালিয়ে চলে এসেছে। হেভি ক্রাইং হচ্ছে।

আপনার বাসাটা তো খুব অদ্ভুত। সব সময কেউ পালিয়ে যাচ্ছে। কিংবা পালিয়ে আসছে।

হীরু এর উত্তর দিল না। তার বড় ভাল লাগছে। রাতের বেলা এ্যানাকে পাশে নিয়ে চা খাওয়া, এত আনন্দ সে রাখবে কোথায়? মেয়েটা যে তার দিকে কি রকম উইক এই ঘটনায় তাও প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে। এক কথায় চা খেতে চলল। এদিকে তার মা এখন-তখন অবস্থা। মুখে অবশ্যি এই মেয়ে সারাক্ষণ উল্টো কথা বলছে। তা বলুক, এটা মেয়েছেলের ধর্ম। সোজা কথা সোজাভাবে বললে আর মেয়েছেলে রইল কোথায়?

চায়ে চুমুক দিয়ে এ্যানা বলল, চাটা তো ভাল। হীরু দরাজ গলায় বলল, ভাল লাগলে আরেক কাপ খাও।

এ্যানা হেসে ফেলল। এত সুন্দর লাগল মেয়েটার হাসিমুখ। আজ আবার শাড়ি পরেছে। ছাপা শাড়ি। পরীর মত লাগছে দেখতে। আল্লাহতালা মেয়েগুলিকে এত সুন্দর করে পাঠিয়েছেন কেন কে জানে। মেয়েদের সবই সুন্দর। এরা রাগ করলেও ভাল লাগে, অপমান করলেও ভাল লাগে। ভালবাসার কথা বললে কেমন লাগবে কে জানে। এ্যানার মুখ থেকে ভালবাসার একটা কথা শুনতে ইচ্ছা করে।

বলুন কি বলবেন?

আমি নিজে চায়ের দোকান দিচ্ছি। ভেরি সুন।

খুব ভাল।

নাম একটা মনে মনে ঠিক করে রেখেছি। এখনো ফাইন্যাল করিনি। নাম হচ্ছে–এ্যানা টি স্টল।

এ্যানা চায়ে চুমুক দিয়েছিল। হঠাৎ হাসি এসে যাওয়ায় বিষম খেল। হীরু অপ্রস্তুত গলায় বলল, হাসির কি হল?

কিছু হয়নি, এমনি হাসছি।

পীর সাহেবের কথামত দিচ্ছি। পীর সাহেব বলে দিলেন।

চায়ের দোকান দিতে বললেন।

হুঁ।

পীর সাহেবের কথা ছাড়া আপনি কিছুই করেন না?

না।

তাহলে উনার কাছে আমি একদিন যাব।

হীরু উৎসাহিত হয়ে উঠল। উৎসাহটা প্রকাশ করল না। মেয়েটা ঠাট্টা করছে কি না বুঝতে পারল না। ঠাট্টা হবারই সম্ভাবনা।

উনার কাছে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে যেতে হবে তাই না?

হুঁ। টাকা-পয়সা নেন না। টাকা-পয়সা উনার কাছে তেজপাতা।

দিনে ক প্যাকেট সিগারেট পান?

অনেক। ত্রিশ চল্লিশ, পঞ্চাশ।

একটা মানুষ কি এত সিগারেট খেতে পারে?

হীরু সাবধান হয়ে গেল। প্রশ্ন কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে পারল না। এই মেয়ে বড়ই ধুরন্ধর। এই মেয়েকে বিয়ে করলেই জীবনটা শেষ হয়ে যাবে।

এ্যানা বলল, আপনার পীর সাহেব ঐ সব সিগারেট বাজারে বেচে দেয়। এখন বুঝলেন ব্যাপারটা? পঞ্চাশ প্যাকেট সিগারেট একটা লোক খেতে পারে না, তাই না?

পীর-ফকির সম্পর্কে সাবধানে কথা বলবে এ্যানা। কখন ফট করে বরদোয়া লেগে যাবে।

লাগুক।

এ্যানা চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল। হীরুর বুক ছাঁৎ করে উঠল। এখন নিশ্চয়ই চলে যাবে। ইস আরো কিছুক্ষণ যদি আটকে রাখা যেত!

এ্যানা গেল না। দাঁড়িয়ে রইল। তারও সম্ভবত রুগ্ন মায়ের পাশে সারাক্ষণ থাকতে ভাল লাগে না।

আপনার চায়ের দোকান কবে স্টার্ট হচ্ছে?

শিগগির–ক্যাপিটালের অভাবে আটকা পড়ে আছে। হাজার পাঁচেক টাকা পেলেই ধাঁ করে বেরিয়ে যেতাম।

টাকাটা জোগাড় হচ্ছে না?

হয়ে যাবে। পীর সাহেব বলে দিয়েছেন। ঐ নিয়ে চিন্তা করি না।

আপনি এত বোকা কেন?

হীরু আহত চোখে তাকিয়ে রইল। রাগ হবার কথা। কিন্তু রাগ লাগছে না। মনটা খারাপ হয়ে গেছে। চোখে পানি এসে যাচ্ছে। এ্যানা বোধ হয় ব্যাপারটা টের পেল। সে কোমল গলায় বলল, আরেক কাপ চা খাব।

হীরুর মন খারাপ ভাবটা সঙ্গে সঙ্গে কেটে গেল। সে মনে মনে বলল অসাধারণ মেয়ে। অসাধারণ। এই মেয়ে পাশে থাকলে চোখ বন্ধ করে সমুদ্রে ঝাপ দেয়া যায়। বাঘের মুখের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে দেয়া যায়।

এ্যানা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আপনাকে একটা কথা বলব।

কি কথা?

আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে?

কি বলছ এই সব।

মার খুব ইচ্ছা। মরবার আগে বিয়ে দেখতে চায়।

তোমার বড় বোনেরই তো বিয়ে হয়নি?

ওদের সম্বন্ধ আসে না। আমার এসেছে। ছেলে আরব বাংলাদেশ ব্যাংকে কাজ করে। অফিসার। বড় অফিসার। আগে একটা বিয়ে করেছিল। বউ মরে গেছে। ছেলেপুলে কিছু নেই।

এইসব পাগলামী চিন্তা একদম করবে না। স্টপ। কমপ্লিট সটপ।

এ্যানা তরল গলায় বলল, কষ্ট করতে ভাল লাগে না। বড়লোকের বউ হতে ইচ্ছা করে। রোজ গাড়ি করে ঘুরব। আমি এখন যাচ্ছি। মার বোধহয় ঘুম ভেঙেছে। ঘুম ভেঙে আমাকে না। দেখলে পাগলের মত হয়ে যাবে।

বিয়ের ব্যাপারটা ঠাট্টা না সত্যি?

ঠাট্টা ভাবলে ঠাট্টা। সত্যি ভাবলে সত্যি।

এ্যানা চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে শাড়ির আঁচলে মুখ মুছল। হীরুর দিকে না তাকিয়ে বলল,–যাই। হীরু কিছুই বলতে পারল না। তার মনে হল সে ঠিকমত নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। যতটা বাতাস তার দুই ফুসফুসের জন্যে দরকার ততটা বাতাস এখন নেই। চায়ের বুড়ো দোকানদারের সামনে হীরু দাঁড়িয়ে রইল, নড়ল না। তার কেবলি মনে হচ্ছে এক্ষুণি এ্যানা নেমে এসে বলবে–আপনার সঙ্গে তামাশা করছিলাম। আপনি এমন বোকা কেন? মেয়েদের কোন কথা চট করে বিশ্বাস করতে নেই–বুঝলেন সাহেব।

এক ঘণ্টা পার হল, এ্যানা নামল না। হীরুর মনে হল নিৰ্ঘাত মার ঘুম ভেঙে গেছে! মাকে খাইয়ে টাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে তারপর নামবে।

অপেক্ষা করতে করতে রাত এগারোটা বাজল। এ্যানা নামল না।

চায়ের দোকানদার এক সময় বলল, আর কত চা খাইবেন? বাড়িত যান–চা বেশি খাওয়া ঠিক না। ভাইজান আপনের চা হইছে তেরটা। আপনের এগারোটা আপার দুইটা। তের টাকা পাওনা।

হীরু টাকা বের করে দিল। হাসপাতালের গেট পার হয়ে খোলা রাস্তায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। একজন রিকশাওয়ালা বলল, স্যার ভাড়া যাবেন? সে বিনা বাক্যব্যয়ে রিকশায় উঠে বসল। পরীক্ষণেই নরম গলায় বলল, না। আমি যাব না। ভাই আপনি কিছু মনে করবেন না। এক্সকিউজ করে দেন।

রিকশায় উঠেই তার মনে হয়েছে, এ্যানা নেমে এসে তাকে না দেখে ফিরে যাচ্ছে। তার চেয়েও বড় কথা, এ্যানার মার যদি এই রাতে ভালমন্দ কিছু হয় তাহলে তো বেচারী বিরাট প্রবলেমে পড়বে। এ্যানা তাকে যাই বলুক রাতটা তার থেকে যাওয়াই উচিত।

হীরু দ্বিতীয়বারে ফিমেল ওয়ার্ডে ঢুকতে পারল না। কলাপসেবল গেট অবশ্যি খোলা। দু’জন দারোয়ান সেখানে বসে আছে। তারা পাস না দেখে কাউকে ছাড়বে না। রেসিডেন্ট ফিজিশিয়ান ডিউটিতে আছেন। তিনি খুবই কড়া লোক। পাস ছাড়া কাউকে দেখলে তাদের না-কী চাকরি চলে যাবে।

হীরু রাত একটার দিকে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরল। সারা পথ প্রতিজ্ঞা করতে করতে এল–এই জীবনে মেয়েছেলের সঙ্গে সে কোনো কথা বলবে না। মেয়েছেলের সঙ্গে কথা বলার চেয়ে কাঁচা গু খাওয়া ভাল।

 

অরু বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় গিয়ে বসল। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। অরুর চোখ। আবার ভিজে উঠতে শুরু করল। বড় খারাপ লাগছে। সুমনের জন্যে বুকের মাঝখানে সন্ধ্যা থেকেই যন্ত্রণা হচ্ছিল সেই যন্ত্রণা এখন তীব্র হয়ে তাকে অভিভূত করে দিচ্ছে।

সুমনের বয়স তিন। এই বয়সেই সে সব কথা বলতে পারে। তিনটা ছড়া জানে। তাল গাছ ছড়াটা বলার সময় কেমন এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পুরো ছড়াটা সে এক পায়ে দাঁড়িয়ে বলতে চেষ্টা করে, শেষ পর্যন্ত অবশ্যি পারে না। ধুপ করে পড়ে যায়। তখন ছলোছলো চোখে বলে–আম্মা, তালগাছ ব্যথা দেয়।

অরুকে তখন বলতে হয়–আহারে ময়না সোনা।

দিনের মধ্যে কতবার যে ধূপ করে এসে তার কোলে বসবে মিষ্টি মিষ্টি গলায় বলবে, আদর খাও আম্মা। আদর খাও।

তখন অরুকে হামহুম করে আদর খাওয়ার ভঙ্গি করতে হয়। আর হেসে লুটুপুটি খায় সুমন। হাসির মধ্যেই সুমন বলে, আরো আদর খাও আম্মা। আরো খাও।

তুমি বড় বিরক্ত করছ, সোনামণি। এখন যাও খেলা কর।

না। আম্মা তুমি আদর খাও।

সুমনের ছোট হল রিমন। বয়স দেড় বছর। এমন শান্ত বাচ্চা এ পৃথিবীতে আর জন্মেছে বলে অরুর মনে হয় না। ক্ষিধে পেলেও কাঁদবে না। মুখে চুকচুক শব্দ করতে থাকবে। একবার খাইয়ে দিলে হাত-পা এলিয়ে ঘুমুবে কিংবা নিজের মনে খেলা করবে।

বিছানায় চারজনের একসঙ্গে জায়গা হয় না। সুমন ঘুমায় তার দাদীর সঙ্গে। রাতের বেলা চুপিচুপি উঠে এসে অরুর পায়ের কাছে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকে। এক’দিন দু’দিন না, এই কাণ্ড হয় রোজ রাতে। আজ বেচারা কার সঙ্গে ঘুমিয়েছে? ঘুম ভেঙে সে কী অরুকে খুঁজছে না?

অরুর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল।

তিথি এসে অরুর সামনে দাঁড়াল। কোমল গলায় বলল, আপা।

অরু চোখ তুলে তাকাল। কিছু বলল না। সে কান্না থামাতে চেষ্টা করছে, পারছে না। কান্না বন্যার জলের মত। বাঁধ দিতে চেষ্টা করলেই যেন বড় বেশি ফুলে ওঠে।

এস আপা বিছানায় শুয়ে গল্প করি।

অরু ধরা গলায় বলল, সুমনের জন্যে মনটা ভেঙে যাচ্ছে রে তিথি।

খুব বেশি খারাপ লাগলে ফিরে যাও।

না-রে ফিরে যাওয়া যাবে না।

এখানে তুমি যে কষ্ট পাবে তারচে বেশি কষ্ট কী দুলাভাইয়ের ওখানে? ওখানে তো তোমার সুমন, রিমন আছে। এখানে কে আছে? আমরা তোমার কেউ না আপা। এস ঘুমুতে এস।

অরু উঠে এল, এখন সে শান্ত। এখন আর কাঁদছে না। কাঁদারও হয়ত সীমা আছে। সীমা অতিক্রম করার পর কেউ কাঁদতে পারে না। সে শুয়েছে তিথির সঙ্গে। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে। আবার উঠে বসে। খাট থেকে নেমে বারান্দায় যায়, জলচৌকির উপর গিয়ে বসে। তিথি এক সময় বলল, বড় বিরক্ত করছি আপা।

ঘুম আসছে না।

চুপচাপ শুয়ে থাক। ছটফট করে লাভ হবে কিছু?

অরু ক্ষীণ গলায় বলল, এখানে এসে ভুল করেছি। তাই না?

ভুল করেছ কি শুদ্ধ করেছ তা জানি না। কোনটা ভুল কোনটা ভুল না, তা এখন আব্বা আমি জানি না।

তোরা সবাই বদলে গেছিস।

তিথি তরল গলায় হেসে উঠল। অরু তীক্ষু গলায় বলল, হাসছিস কেন?

সিরিয়াস সিরিয়াস সময়ে আমার কেন জানি হাসি আসে।

তোর সম্পর্কে যে সব শুনি সেগুলি কী সত্যি?

কি শোন?

অরু চুপ করে রইল। তিথি বলল, মুখে আনতে লজ্জা লাগছে, তাই না? তোমার কী আমার সঙ্গে ঘুমুতে এখন ঘেন্না লাগছে? ঘেন্না লাগলে মায়ের সঙ্গে ঘুমাও।

যা শুনছি সবই তাহলে সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি।

বলতে তোর লজ্জা লাগল না।

না।

আমি হলে গলায় দড়ি দিয়ে মরে যেতাম।

না মরতে না। এই যে এত যন্ত্রণার মাঝ দিয়ে তুমি যাচ্ছ তুমি কী গলায় দড়ি দিয়েছ? দাওনি। বাঁচার চেষ্টা করছ। করছ না?

অরু ক্ষীণ গলায় বলল, বাচ্চা দুটার জন্যে বেঁচে আছি। নয়ত কবেই…

তিথি আবার হেসে উঠল। অরু বলল, হাসিস না।

আচ্ছা যাও হাসব না। তুমিও ঘুমুবার চেষ্টা কর।

ঘুম আসছে না।

আমার কাছে ঘুমের অষুধ আছে, খাবে? মাঝে মাঝে আমি খাই। দু’টা আস্ত বোতল আছে এককটাতে বত্ৰিশটা করে ট্যাবলেট–এর পনেরটা খেলেই ঘুম হবে খুবই আনন্দের। খাবে আপা?

অরু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ঠাট্টা করছিস তিথি? আমার এই অবস্থায় তুই ঠাট্টা করতে পারিস?

হ্যাঁ পারি। আমি যে কী পরিমাণ বদলে গেছি। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।

তুই আমাকে ফিরে যেতে বলছিল?

বলছি।

একটা ব্যাপার শুধু তোকে বলি তার পরেও যদি তোর মনে হয় আমার চলে যাওয়াই ভাল, আমি চলে যাব।

বেশ তো বল।

অরু কিছু বলল না, চুপ করে রইল। তিথি বলল, বলতে যদি তোমার খারাপ লাগে তাহলে বলার দরকার নেই।

খারাপ লাগবে না, তুই শোন কোন-একজনকে বলার দরকার। কাকে বলব বল? আমার বলার লোক নেই।

অরু খানিকক্ষণের জন্যে থামল। তারপর নিচু গলায় বলতে লাগল–তোর দুলাভাই যে খুব নামাজী মানুষ তা তো তুই জানিস। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, তাহাজ্জুত পড়ে। রোজ ভোরবেলা আধঘণ্টা কুরআন শরীফ পড়ে।

রাতের বেলা সে কখনো স্বামী-স্ত্রীর ঐ ব্যাপারটায় যাবে না। কারণ তাতে তার শরীর অপবিত্র হবে। গোসল করতে হবে, নয়ত ফজরের নামাজ হবে না। কাজেই সে ফজরের নামাজ শেষ করে কুরআন শরীফ পড়া শেষ করে আমার ঘুম ভাঙাবে। দিনের পর দিন এই যন্ত্রণা। শারীরিক সম্পর্কের মধ্যে কী প্রেম-ভালবাসা থাকতে নেই? তুই কী আমার যন্ত্রণা বুঝতে পারছিস তিথি?

পারছি।

আরো শুনবি?

না।

তিথি দু’হাতে বোনকে জড়িয়ে ধরল। দু’জন দীর্ঘ সময় বসে রইল চুপচাপ। এক সময় অরু বলল, বাচ্চা দুটাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না রে তিথি। আমি কাল সকালে চলে যাব।

তিথি কিছু বলল না। অনেক’দিন পর তার কান্না পাচ্ছে, অনেক অনেক দিন পর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *