অভিমন্যুদাসকে আহত করে দীনদাসের পলায়নের কয়েক দিবস পরই সংবাদটি পাওয়া যায়। সংবাদটি নিয়ে আসে কন্যা সরস্বতীর দেবর নবীন স্নাতক মাধবাচার্য।
অভিমন্যু লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় সোমজিৎ ঈষৎ চিন্তিত হয়েছিলেন। আশঙ্কা হয়েছিলো, মহাসামন্ত হরিসেন কোনো না কোনো গোলযোগ সৃষ্টি করবে। কিন্তু দেখা গেলো, হরিসেনের পক্ষ থেকে কোনো উচ্চবাচ্য নেই–এমনকি অভিমন্যুদাসও তাঁর কাছে অতিমাত্রায় বিনয়ী হয়ে পড়েছে। তিনি আশ্চর্যই হচ্ছিলেন। একটি ক্ষুদ্র সংবাদ অবশ্য তার কর্ণগোচর হয়েছিলো, কিন্তু তিনি সংবাদটির গুরুত্ব দেননি। হরিসেনের পরিবার পরিজন নাকি কামাখ্যা তীর্থের উদ্দেশে যাত্রা করেছে। সংবাদটি শুনে তাঁর মনে হয়েছিলো–এ আর এমন কি ঘটনা? এরূপ ঘটনা তো ঘটতেই পারে।
মাধবাচার্যের আনা সংবাদ হরিসেনের আচরণের কারণ উদঘাটিত করে দিলো।
জামাতা কেশবাচার্যের পত্রের বিষয় এইরূপ: দেশে রাষ্ট্রবিপ্লব আসন্ন, শীঘ্রই যবনাক্রমণ হবে, রাজধানীর বণিক এবং ব্রাহ্মণেরা সকলেই পলায়ন করছেন–এমতাবস্থায় দেশত্যাগ করাই ব্রাহ্মণদের পক্ষে বিধেয়–পত্রপাঠ যেন সোমজিৎ সপরিবারে মাধবাচার্যের সঙ্গে যাত্রা করেন।
সোমজিৎ মাধবাচার্যের কাছে নিজ মনোভাব ব্যক্ত করলেন না। শুধু জানালেন, বৎস, তুমি ফিরে যাও–আমি আত্মরক্ষার যথোচিত ব্যবস্থা নিতে পারবো–কেশব ও সরস্বতাঁকে বলল, আমার জন্য চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
মাধবাচার্য বিদায় নিলে সোমজিৎ স্ত্রীকে ডেকে বললেন, ব্রাহ্মণি, এবার প্রস্তুত হও, মহাবিপদের কাল দ্বারে এসে উপস্থিত।
ব্রাহ্মণী হাসলেন স্বামীর উক্তি শুনে। বললেন, আমার ব্রাহ্মণের ব্ৰহ্মতেজ নিশ্চয়ই নিঃশেষিত হয়ে যায়নি–ঠাকুর আছেন আমাদের।
সর্বাপেক্ষা আশ্চর্য ঘটনা এই যে, এমন দুষ্কালে কয়েকজন যবন অশ্ব বিক্রেতা উজুবটে এলো। আরও আশ্চর্যের কথা এই যে, এই যবন বণিকেরা প্রত্যেকেই শস্ত্রধারী। সংবাদ পাওয়া গেলো, তারা মহাসামন্ত হরিসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সন্ধ্যা সমাগমের পূর্বেই প্রস্থান করেছে।
সোমজিৎ সন্দিগ্ধ হলেন। যবনাক্রমণের সংবাদে তার ভয় হয়নি। কিন্তু হরিসেনের সঙ্গে সাক্ষাতের এই ঘটনা তাকে চিন্তিত করে তুললো।
পথ এখন শকট চক্রের আর্তনাদে মুখর। শকটের পর শকট চলেছে উত্তরাভিমুখে। নদীতে নৌকা, পথে গো–মহিষাদির শকট। কোথায় যাবে হে, কৌতূহলী গ্রামবাসীর চিৎকার শোনা যায়। কিন্তু উত্তর আসে না, এলেও আসে বিলম্বে এবং অনুচ্চ কণ্ঠে।
অর্থাৎ স্ত্রী-কন্যা-পুত্র ও পিতা-মাতাদের নিয়ে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা কেউ কুটুম্ব গৃহে যাচ্ছেন, কেউ যাচ্ছেন তীর্থস্থানে।
কোন গ্রাম থেকে আগমন হে? প্রশ্ন শুনে নৌকার ক্ষেপণী তুলে নৌবাহক পশ্চাতের দিগন্ত দেখিয়ে বলে, তোমার পিতৃগৃহ যে গ্রামে, সেই গ্রাম থেকে আসছি, ভগিনীর সঙ্গে যেতে চাইলে এসো।
কে যাচ্ছেন? না কুসুম্বীর গ্রামপতি।
ঐ শকট সারি কার? না বিল্বমূলের সুধী মিত্রের।
আরে উদ্ধব দত্ত যে, কোথায় যাচ্ছো?
হেঁ হেঁ ভাই, গৃহিণীর ইচ্ছা, তীর্থস্নান করবেন–তাই
যাচ্ছেন ব্রাহ্মণেরা, যাচ্ছেন বণিকেরা, কিন্তু লক্ষণীয় যে, সামন্ত ও মহাসামন্তরা স্বয়ং যাচ্ছেন না কোথাও–এবং করণ কায়স্থদেরও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
ক্রমে পুন্ড্রনগরীতেও যবনাক্রমণের আতঙ্ক স্পর্শ করলো। মুখে মুখে জনরব। কেউ বলে, তারা প্রথমে পুন্ড্রনগরীতে আসবে, রাজধানীতে যাবে পরে। কেউ বলে, পুন্ড্রনগরীতে তারা আদৌ আসবে না, পুন্ড্রনগরী তো আর পূর্বের মতো সমৃদ্ধ নয়। যারা বিজ্ঞলোক, তারা বলতে লাগলেন যে, যবন সেনারা প্রথমে রাজধানী অধিকার করবে, তারপর আসবে অন্যান্য নগরীতে।
স্থানে স্থানে জল্পনা–যুদ্ধ হলে নগরীর কিছুই থাকবে না, সবই যাবে ভস্মসাৎ হয়ে! একজন সংবাদ জানায় যে, যবন সেনাপতির বাহু দুটি ভূমি স্পর্শ করে–আর সে অসুর বিশেষ, নর–রক্তপানে তার দারুণ আগ্রহ। কারও মুখে শোনা যায়, এরা যবন নয়, ভিন্ন। জাতি, এদের বলা হয় তুরুক–কিছুই নেবে না এরা, শুধু তোমার পত্নীটিকে, নয়তো। কন্যাটিকে তুলে নিয়ে যাবে। এই প্রকার সব আতঙ্কজনক জনরব।
একদা দ্বিপ্রহরে হঠাৎ দেখা গেলো, নগরীর লোক পলায়ন করছে। কেউ কিছু বলতে পারে না, শুধু ঊর্ধ্বশ্বাসে ধাবমান হয়। ঐ আসছে, ঐ এসে গেলো–পশ্চিম দ্বারে গিয়ে দেখো রক্তগঙ্গা প্রবাহিত হচ্ছে। কেউ বলে, নগরপাল যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন, আর রক্ষা নাই। কোথায় যুদ্ধ, কি বৃত্তান্ত, কেউ কিছু বলতে পারে না। নগরীতে ভয়ানক বিশৃঙ্খল অবস্থা। অপরাহু হতে না হতে নগরীর পথ নির্জন হয়ে গেলো। যারা সক্ষম ছিলো, পলায়ন করেছে, যারা পারেনি, তারা গৃহের বহিৰ্বার রুদ্ধ করে ভিতরে বসে আছে।
শ্যামাঙ্গ নগরীর ঐ অবস্থা দেখে যবন কেন্দ্রে গেলো। সেখানে অসংখ্য জনসমাবেশ, দ্বারপথ প্রায় অবরুদ্ধ। মানুষের আকুল আগ্রহ। সকলেই জানতে চায়, দরবেশ সাধুপুরুষ কী বলেন, তিনি কি আমাদের রক্ষা করবেন না?
শ্যামাঙ্গ অতিকষ্টে বহির্দ্বার অতিক্রম করে ভেতরে প্রবেশ করে। সংবাদ জানাতে হলো না, লীলাবতী ছুটে এলো। বললো, এতো বিলম্ব করলে কেন–আমার চিন্তা হচ্ছিলো।
লীলাবতীর উদ্বিগ্ন মুখ দেখে শ্যামাঙ্গ বলে, চলো লীলা, আমরা পলায়ন করি–এ নগরী ধ্বংস হয়ে যাবে।
লীলাবতী জানায়, কিছু হবে না, আমরা এখানে থাকবো। সাধুপুরুষ বলেছেন, তুমিও এখানে থাকবে।
শ্যামাঙ্গ চারিদিক দৃষ্টিপাত করে। কেন্দ্রের চারিদিকে অসংখ্য লোক, অধিকাংশই নবদীক্ষিত যবন–ধর্মী মোসলেমিন। সে বললো, আমি তো এদের ধর্মগ্ৰহণ করিনি, এরা কেন আমাকে থাকতে দেবে?
দেবে, তুমি চুপ করো–আমি দীক্ষাগ্রহণের ব্যবস্থা করছি।
লীলাবতীর মুখপানে চেয়ে শ্যামাঙ্গ কষ্ট পায় মনে। বলে, লীলাবতী, তুমি এসব কী বলছো? তুমি কি আমার অভিমত জানো না?
জানি, কিন্তু এখন প্রাণরক্ষার জন্যই না হয় দীক্ষা নিলে–পরে প্রায়শ্চিত্ত করো।
না, অসম্ভব, ধর্ম ত্যাগ করে প্রাণ রক্ষা করবো–অমন প্রাণের আমার প্রয়োজন নেই, আমি যাই।
লীলাবতী তার হাত ধরে, কোথায় যাবে, আমাকে কোথায় রেখে যাবে?
শ্যামাঙ্গ উত্তরে কিছু বলতে পারে না।
বলল, আমি কোথায় যাবো? আমি তো এদের ধর্মগ্রহণ করিনি–আমাকেই বা এরা থাকতে দেবে কেন? এরা অস্বীকৃতি না জানালেও যারা নবদীক্ষিত, তারা জানাবে, তখন?
শ্যামাঙ্গ তবু বলে, আমি যাই, আমাকে যেতে দাও।
চলো তাহলে, আমিও তোমার সঙ্গে যাবো।
শ্যামাঙ্গ দেখলো, লীলাবতী সত্যই যাবার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু তার সাহস হয় না। বাহিরে যদি বিপর্যয় সত্যই আরম্ভ হয়ে যায় তখন লীলাবতীকে সে কীভাবে রক্ষা করবে। সে মিনতি করে বলে, লীলাবতী কথা শোনো, অবুঝ হয়ো না–তোমার জন্য এ স্থান নিরাপদযবনেরা যতো নিষ্ঠুরই হোক, স্বধর্মীদের উপর অত্যাচার করবে না।
তুমি না থাকলে, নিরাপদ স্থানে থেকে আমার কী হবে। শোনো শ্যামাঙ্গ, আমার কথা শোনো, লীলাবতী নিরুপায় স্বরে বলে, আমার কোনো গত্যন্তর নেই–তুমি যেও না, তোমার সন্তান আমার উদরে।
শ্যামাঙ্গ স্তব্ধ হয়ে যায় ঐ কথা শুনে। এ কী বলছে লীলাবতী? চারিদিকে কোলাহল, মানুষ প্রাণভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করছে, ভয়ানক অনিশ্চিত অবস্থা–এই অবস্থায় এ কোন কথা বলছে লীলাবতী? সে লীলাবতীর মুখপানে চাইলো। লীলা তখনও তার মুখপানে চেয়ে আছে। শ্যামাঙ্গ লীলার দুচোখে দৃষ্টি রেখে বললো, সত্যি বলছো?
ঐ কথায় চিরন্তনী নারীর মুখে রহস্যময় হাসিটি ফুটলো। বললো, কেন বিশ্বাস হয় আমার কথা?
কথাটি বলবার সময় লীলার দুচোখে কি কৌতুকের ছায়া দেখা গেলো? শ্যামাঙ্গ নিশ্চিত নয়। কিন্তু তবু মনে হলো, যেন দেখা গেলো একটি ছায়া। হঠাৎ তার সন্দেহ হলো, লীলাবতীর এটি একটি ছলনাময় কৌশল নয় তো? পুনরায় সে জিজ্ঞাসা করে, সত্যি বলছো লীলাবতী?
লীলাবতী যেন বিজয়িনী। অশ্রুলাঞ্ছিত মুখে বিজয়িনীর হাসিটি উজ্জ্বল হয়ে ফুটলো। আর তাতেই শ্যামাঙ্গ বুঝলো ভুল। মনে হলো, তার অনুমানটি সত্যলীলাবতী ছলনাই করছে। ক্ষণেক পরে লীলা যখন বললো, পারবে এখন আমাকে একাকী রেখে যেতে? তখন সে প্রায় নিশ্চিত হলো। বুঝলো, লীলাবতী তাকে কাছে রাখতে চায় এবং যবন ধর্মে দীক্ষিত করতে চায়–সেই জন্যই তার এই ছলনাময় কৌশল। সেও হাসলো এবার। বললো, উত্তম কথা, তোমারই জয় হলো–আমি এ নগরী ত্যাগ করবো না নবধর্মে দীক্ষাও আমি নেবো, কিন্তু এখন নয়–বাইরে যখন অবস্থান করা বিপজ্জনক হয়ে উঠবে তখন, তখন আমি তোমাদের এই কেন্দ্রে আসবো–এখন আমাকে যেতে দাও।
লীলাবতীর মুখে হাসি উচ্ছল হয়ে উঠলো ঐ কথায়। শ্যামাঙ্গের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, তোমাকে দেখে এখন আমার লোভ হচ্ছে, ইচ্ছা হচ্ছে রাক্ষসীর মতো তোমাকে চর্বণ করে খাই।
শ্যামাঙ্গ আহত এবং প্রতারিত বোধ করতে লাগলো নিজেকে। লীলাবতী এমন হতে পারলো? এমন হীন কৌশল গ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব হলো! নিজে তো ধর্ম ত্যাগ করতেই চায়, অন্যকেও সে প্ররোচিত করে! তবে কি যবন কেন্দ্রের সাধুপুরুষটি কোনো প্রকার যাদুবিদ্যা প্রয়োগ করেছেন লীলাবতীর উপরে? তার মনে সন্দেহ উপস্থিত হয়।
আবার কখনও মনে হয়, লীলাবতীর সন্তান সম্ভাবনা কি একেবারেই অসম্ভব? নারী পুরুষে মিলিত হলে সন্তান সম্ভাবনা তো হতেই পারে। যদি লীলাবতীর কথা সত্য হয়? সে অতঃপর আর চিন্তা করতে পারে না। নিজের অনিবার্য পরিণামটি সে স্পষ্ট দেখতে পায় মানসচক্ষুতে। অমন পরিণাম তো সে চিন্তা করেনি কখনও। ।