১৪. অপালা বাসায় ফিরল

প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা নিয়ে অপালা বাসায় ফিরল। বাসায় অনেক মানুষ। ড্রয়িং রুমে আলো জ্বলছে। কিছু লোকজন বসে আছে সেখানে। বারান্দায় চিন্তিত মুখে ম্যানেজারবাবু এবং চিটাগাং ব্রাঞ্চের জি এম. হাঁটাহাঁটি করছেন। নিশানাথবাবু ছুটে এলেন, কোথায় ছিলে এতক্ষণ?

অপালা তার জবাব দিল না। নিশানাথবাবু বললেন, তুমি একটু বসার ঘরে এসো। পুলিশের কয়েকজন অফিসার এসেছেন।

আমার সঙ্গে তো তাদের কোনো দরকার নেই।

আমরা বলেছি। তবু তারা কথা বলতে চান। অনেকক্ষণ বসে আছেন।

আমি তাদের সঙ্গে কোনো কথা বলব না।

মা, তুমি বুঝতে পারছি না।

আমার কিছু বোঝার দরকার নেই। প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। আমি এখন ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকব।

দু’এক মিনিটের ব্যাপার।

ম্যানেজার কাকু, আপনি আমাকে বিরক্ত করবেন না।

অপালা দোতলায় উঠে গেল। এক বারও ফিরে তাকাল না। নিশানাথবাবুর চিন্তিত মুখ আরো ঝুলে পড়ল।

 

নার্সদের মুখশ্ৰী ভাল থাকা উচিত।

ফিরোজের তাই ধারণা। যেন মুখের দিকে তাকিয়েই মন প্রফুল্ল হয়। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল মোমবাতি হাতে হেঁটে যাচ্ছেন–এই দৃশ্য দেখে রুগীরা নতুন আশায় বুক বেঁধেছে। কারণ ঐ মহিলা ছিলেন অসম্ভব রূপবতী। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল যদি তাড়ক রাক্ষসীর মতো হতেন, তাহলে রুগীরা নিশ্চয়ই রাতের বেলা এই দৃশ্য দেখ ভিরমি খেত।

এই হাসপাতালে যে-কাটি নার্স ফিরোজ দেখেছে সবাই হয় তাড়কা রাক্ষসী, নয়ত তাড়কা রাক্ষসী হবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। ডাক্তার এবং নার্সদের প্ৰেম নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর গল্পউপন্যাস আছে। সে সব নিশ্চয়ই বানানো। এই ওয়ার্ডে যে গত দু’দিন ধরে আসছে তার চেহারা মন্দ নয়, তবে কথাবার্তা অসহ্য।

ধমক না দিয়ে কোনো কথা বলে না। আজ সকালেই ফিরোজের সঙ্গে বড় রকমের কথা কাটাকাটি হয়ে গেল। মেয়েটি ওয়ার্ডে ঢুকেই কড়া গলায় বলল, এই যে লোক, বসে আছেন কেন?

এই যে লোক বলে কেউ সম্বোধন করতে পারে, এটাই ফিরোজের ধারণা ছিল না। সে বহু কষ্টে রাগ সামলে বলল, বসে থাকা নিষেধ আছে নাকি?

হ্যাঁ, আছে। শুয়ে-শুয়ে রেস্ট নিন। ডন-বৈঠকের জন্যে হাসপাতাল না।

ফিরোজ শুয়ে পড়ল। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। রাত-দুপুরে আজেবাজে কোনো ওষুধ খাইয়ে দিতে পারে। একটা থ্রিলারে এ রকম একটা ঘটনা ছিল। নার্স রাত-দুপুরে ঘুমের ওষুধ বলে আফিমের ঢেলা গিলিয়ে দিত। অবশ্যি সেই নার্স ছিল রূপবতী এবং সে বেছে বেছে এই কাণ্ডগুলো করত। রূপবান তরুণ রুগীদের সঙ্গে।

ফিরোজ গলা পর্যন্ত চাদর টেনে কৌতূহলী চোখে নার্সটাকে দেখছে। এই মহিলা এক-একটা বেডের কাছে যাচ্ছে এবং বিনা কারণে রুগীদের ধমকাচ্ছে। গরিব রুগীদের তুমি-তুমি করে বলছে। সে খুরে-ঘুরে আবার ফিরোজের কাছে ফিরে এল।

আপনার জ্বর রেমিশন হয়েছে।

ফিরোজ জবাব দিল না। নার্স তার এ্যাপ্রনের পকেটে হাত দিয়ে বলল, আপনার একটা চিঠি এসেছে। গতকাল দিতে ভুলে গেছি। এই নিন।

ফিরোজ থমথমে গলায় বলল, আপনি চিঠি পড়েছেন কেন? খামের মুখ খোলা।

আপনার চিঠি পড়ার আমার দরকারটা কী? মুখখোলা অবস্থাতেই এসেছে। চিঠি পড়ুন, বালিশের নিচে রেখে দিচ্ছেন কেন?

আপনি এখান থেকে যান, তারপর পড়ব।

নার্স চলে যাবার পরও সে চিঠি পড়ল না। হাসপাতালে বসে চিঠি পাওয়ার বিস্ময়টা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা যাক। নার্স যে চিঠিটা পড়েছে, তাতে তাকে ঠিক দোষ দেয়া যায় না। হাসপাতালের রুগীদের কেউ চিঠি লেখে না, দেখতে আসে। গত দশ বছরে এটাই হয়ত প্রথম চিঠি এবং ফিরোজের ধারণা, হাসপাতালের জমাদারনী, মালী, ওয়ার্ডবয়… সবাই এই চিঠি পড়েছে।

কে লিখতে পারে এই চিঠি? তাজিন? হতে পারে। পরিচিতদের মধ্যে একমাত্র সে-ই তাকে দেখতে আসেনি। দুলাভাই বলেছেন–রাগ করে আসেনি। ফিরোজ অবাক হয়ে বলেছে, রাগ কী জন্যে?

নিজের দিকে তুমি তাকাবে না। অসুখ-বিসুখ বঁধিয়ে খবর পাঠাবে, সে রাগ করবে না? শোন ফিরোজ, তুমি কথা দাও, রিলিজ হলে আমার বাসায় গিয়ে উঠবে।

কথা দিলাম।

আমরা যে-মেয়ে ঠিক করব, চোখ বন্ধ করে তাকে বিয়ে করবে।

কথা দিলাম!

তোমাকে কেবিনে ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করছি। সব ধরাধরির ব্যাপার। একজন মেজর জেনারেলকে আজ ধরব। আমার ভাবির ফুপাত ভাই।

কাউকে ধরতে হবে না দুলাভাই। ওয়ার্ডে আমি ভালই আছি। আশপাশের রুগীদের সঙ্গে খাতির হয়েছে। গল্পগুজব করে সময় কেটে যাচ্ছে।

কার সঙ্গে খাতির হল?

বাঁ পাশের বেডের রুগীর সঙ্গে। খাতিরটা আরো জমত, বেচারা হঠাৎ মরে যাওয়ায় খাতিরটা জমতে পারল না।

সব সময় এমন ঠাট্টা-তামাশা করো না। মৃত্যু নিয়ে রসিকতা করবে না।

আর করব না। আপনি দুলাভাই, বড় আপনাকে পাঠিয়ে দেবেন। আপাকে দেখতে ইচ্ছা! করছে।

বাজে কথা বলবে না। তোমার কাউকেই দেখতে ইচ্ছা করে না।

তাজিনই নিশ্চয় এই পত্রলেখক। চিঠিপত্র লেখার অভ্যেস তার আছে। জন্মদিন, নববর্ষ এইসব বিশেষ দিনগুলোতে তার একটা সুন্দর কার্ড আসবেই।

এটাও বোধহয় একটা কার্ড। গেট ওয়েল কার্ড। বড়। আপার কাছে নানান ধরনের কার্ডের বিরাট সংগ্রহ।

ফিরোজ ভেবেছিল গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে চিঠি পড়বে। এতক্ষণ ধৈর্য ধরতে পারল না। তার কেবলই মনে হতে লাগল, চিঠির রচয়িতা হয়তবা অপালা। এ রকম মনে হবার কোনো কারণ নেই, কিন্তু তবু মনে হচ্ছে।

খাম খুলে ফিরোজের নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। অপালাই লিখেছে। আহ, এত গভীর আনন্দের ব্যাপারও ঘটতে পারে! চিঠিটি পড়তে ইচ্ছে করছে না। পড়া মানেই তো ফুরিয়ে যাওয়া। বরং গুটি-গুটি লেখা তিনটি পৃষ্ঠা নিয়ে সে সারা রাত জেগে বসে থাকবে। মাঝে-মাঝে ঘােণ নেবে। এই কাগজ কোনো ফুলের গুচ্ছ নয়। তবু নেশা-ধরানো সৌরভ নিশ্চয়ই লুকানো আছে। সবাই সে সৌরভ পাবে না। যার পাবার শুধু সে-ই পাবে।

ফিরোজ সাহেব।
আপনার হাসপাতালের ঠিকানা কোথায় পেয়েছি বলুন তো? না, এখন বলব না, আপনি ভাবতে থাকুন। এটা একটা ধাঁধা। দেখি আপনি কেমন বুদ্ধিমান। ধাঁধার জবাব দিতে পারেন কী না। আমি হাসপাতলে আপনাকে দেখতে অ্যাসিনি, যদিও খুব আসার ইচ্ছা ছিল। কেন আসিনি জানেন? ছোটবেলায় আমাদের একজন কাজের মেয়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আসে। তাকে দেখবার জন্যে এক’দিন হাসপাতালে এসে কী দেখি, জানেন? দেখি দুতিন মাস বয়সী একটা বাচ্চাকে বড় একটা গামলায় শুইয়ে রাখা হয়েহে। বাচ্চাটা মারা। বাচ্চার নাভি ও নাকে লাল-লাল পিঁপড়া। এই কুৎসিত দৃশ্যটি দুঃস্বপ্ন হয়ে বার-বার আমার কাছে ফিরে আসে। হাসপাতালে যেতে আমার এই কারণেই ইচ্ছা করে না।
এখন বলি আপনার ঠিকানা কোথায় পেলাম। আপনার বান্ধবীর বাবার কাছ থেকে। আপনার বান্ধবীর সঙ্গেও আমার আলাপ হয়েছে। খুব লাজুক মেয়ে, তত্ত্ব কিছু কথা শেষ পর্যন্ত বলেছে। তবে আমার ধারণা, আপনার সঙ্গে সে খুব বক-বক করবে।
আচ্ছা, আপনি আমাকে কিন্তু একটা ভুল কথা বলেছেন। আপনাদের বিয়ের ব্যাপারে। ভুল আমি ভেঙে দিয়েছি। আপনার বান্ধবী, তার বাবা এবং মা সবাই খুব খুশি। তারা মনে-মনে সুপাত্রে হিসেবে আপনাকে কামনা করছিলেন। মনের কথাটা পর্যন্ত বললেন না! আপনার সঙ্গে এই দিকে আমার কিছু মিল আছে। আমিও নিজের মনের কথাটা কিছুতেই বলতে পারি না। আমার একটা ডাইরি আছে, মাঝে মাঝে তাতে লিখি; এই মুহূর্তে আপনাকে আমার একটা মনের কথা বলি। অামাব মনে হচ্ছে, এখন বললে সেটা খুব দোষেব হবে না। কথাটা হচ্ছে, আমি যখন জানলাম— আপনার একজন ভালবাসার মানুষ আছে, তখন আমার কেন জানি মন-খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মন–খারাপ ভাবটা এখনো পুরোপুরি কাটেনি। কাটিতেই যে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই। না। কাটাই ভাল। কী বলেন। আপনি? আমি ঠিক বলিনি? কিছু কিছু কষ্ট আছে সুখের মত। আবার কিছু কিছু কষ্ট খুব কঠিন।
এখন আপনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন। আপনি সুস্থ হয়ে উঠলেই আপনাকে নিয়ে এক জায়গায় বেড়াতে যাব। যেখানে যাব, সেখানে চমৎকার একটা রহস্য আছে। দেখি, আপনি রহস্য ভেদ করতে পাবেন কি না; আমার মনে হয় আপনি পাববেন। কারণ, আপনার খুব বুদ্ধি—অন্তত আমার তাই ধারণা।
এই চিঠি আপনি পাবেন কী না বুঝতে পারছি না। কে জানে হয়ত চিঠি পৌঁছবার আগেই সুস্থ হয়ে ফিবে যাবেন। আগ্রহ নিয়ে এই চিঠি লিখছি, আপনি তা না পেলে খুব কষ্টের ব্যাপার হবে।
বিনীতা
অপালা

সারা রাত ফিরোজ ঘুমুতে পারল না।

কত বার যে চিঠিটা পড়ল! প্রতিবারই মনে হল এটা তো আগে পড়া হয়নি। এ্যাটেনডিং ফিজিশিয়ান এক সময় বললেন, আপনি এমন ছটফট করছেন কেন? কোনো অসুবিধা হচ্ছে কী?

জি হচ্ছে। অস্থির-অস্থির লাগছে।

অস্থির-অস্থির লাগার তো কোনো কারণ দেখছি না। অসুখ সেরে গেছে, কাল-পরশুর মধ্যে রিলিজ অর্ডার হবে। আসুন, আপনাকে একটা ট্রাংকুলাইজার দিয়ে দিই।

একটায় কাজ হবে না, বেশি করে দিন।

আপনার কী হয়েছে বলুন তো?

খুব আনন্দ হচ্ছে ডাক্তার সাহেব।

ফিরোজ ঘুমুতে গেল শেষরাতের দিকে। ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। নাশতা নিয়ে এসেছে। দরিদ্র দেশের হাসপাতালের তুলনায় বেশ ভাল নাশতা। দু পিস রুটি, একটা সেদ্ধ ডিম, একটা কলা, এক গ্লাস দুধ। নাশতা যে দিতে আসে, সে ট্রে নামিয়ে দিয়েই চলে যায় না। অপেক্ষা করে। কোনো রুগী যখন বলে ভাল লাগছে না, কিছু খাব না, তখন যে বড় খুশি হয়। ট্ৰে উঠিয়ে নিয়ে যায়। আজ তাকে খুশি করা গেল না। ফিরোজের খুব খিদে পেয়েছে। জানালা গলে শীতের রোদ এসেছে। খুবই ভাল লাগছে সেই রোদের দিকে তাকিয়ে থাকতে। বেড নাম্বার চল্লিশের বুড়ো রুগীটি খুব কষ্ট পাচ্ছে। গোঙানির মত শব্দ করছে। গভীর বেদনায় ফিরোজের মন ভরে গেল। তার ইচ্ছে করতে লাগল, রুগীর মাথার কাছে গিয়ে বসে। মাঝে মাঝে পৃথিবীর সবাইকে ভালবাসতে ইচেছ করে।

ফিরোজ সত্যি সত্যি বেড় নম্বর চল্লিশের দিকে এগিয়ে গেল। নরম গলায় বলল, আপনার কী খুব কষ্ট হচ্ছে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *