১৪. অদৃশ্য দানব
অনেক মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ঢোকার একটা লম্বা লাইন সেই লাইন ধরে মানুষেরা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে। বাইরে বিশাল একটা পোস্টার সেখানে ভয়ংকর একটা ছবি। বিশাল একটা দানব শেকল দিয়ে শক্ত করে বাঁধা, দানবটি শেকল ভেঙে বের হওয়ার চেষ্টা করছে, পারছে না। দানবটির মুখে হিংস্র এবং পৈশাচিক হাসি। ছবিটি দেখেই আত্মা শুকিয়ে যায়।
টুশি আর তপু লাইন ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। তপু ফিসফিস করে বলল, “ছ ছবিটা দেখেছ আপু?”
“দেখেছি।”
“কা-কাবিল কোহকাফী মোটেই দে-দেখতে এরকম না।”
“হ্যাঁ। কাবিল কোহকাফী কত সুইট!”
তপু টুশির হাত ধরে বলল, “আপু।”
“কী হল?”
“আমরা কি কা-কাবিল কোহকাফীকে উদ্ধার করতে পা-পারব?”
টুশি জোর গলায় বলল, “একশবার পারব। না পারার কী আছে?”
টুশি মনে-মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে তপুকে সাহস দেবার জন্যে অনেক জোর দিয়ে বলেছে একশবার পারবে, না পারার কী আছে! কিন্তু আসলে সে ভেতরে ভেতরে খুব ভয় পাচ্ছে। তার পেটের ভেতরে কেমন যেন পাক দিচ্ছে। যতবার পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করছে ততবার ভয়ে তার হাত-পা শরীরের ভেতর সেঁধিয়ে যাচ্ছে। মন্তাজ ওস্তাদ, কালাচান আর দবির মিয়ার মতো খারাপ খারাপ মানুষগুলো এখানে আছে। তারা টুশিকে আর তপুকে চেনে, যদি তাদের দেখে ফেলে তখন কী হবে? কাবিল কোহকাফীকে নিশ্চয়ই খুব কড়া পাহাড়ায় শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে। তপুকে নিয়ে সে কেমন করে সেখানে যাবে? যদি যেতেও পারে তাকে কি সে মন্ত্রটা বলতে পারবে? যদি বলতেও পারে কাবিল কোহকাফী কি তার কথা শুনতে পাবে?
টুশির শরীর কেমন জানি শক্ত হয়ে যায়–জোর করে সে মনের ভেতর থেকে সবকিছু দূর করে দিতে চেষ্টা করল।
গেটে টিকিট দেখিয়ে টুশি আর তপু ভেতরে ঢুকল। হোটেলের বিশাল বলরুমে আয়োজন করা হয়েছে। সামনে বিশাল স্টেজ। স্টেজ লাল ভেলভেটের পরদা দিয়ে ঢাকা। হলঘরের ভেতরে বেশ ঠাণ্ডা, কুলকুল করে এয়ার কন্ডিশনের বাতাস বইছে। ভেতরে আবছা অন্ধকার দেখে টুশি একটু স্বস্তি পেল, মন্তাজ ওস্তাদ আর তার খারাপ খারাপ সাঙ্গোপাঙ্গগুলো তা হলে তাদের দেখতে পাবে না।
ভেতরে সুন্দর কাপড় পরা অনেক মানুষ, তারা টিকিট পরীক্ষা করে সবাইকে তাদের সিটে বসাচ্ছে। টেলিভিশনের লোকজন ক্যামেরা নিয়ে এসেছে। তারা এখন দর্শকদের দিকে ক্যামেরা তাক করে রেখেছে। যদি হঠাৎ করে তাদের ছবি উঠে যায়, টেলিভিশনে সেটা দেখান হয়–আর চাচা-চাচি সেটা দেখে ফেলেন তা হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। টুশি আর তপু মিলে অনেকরকম কায়দা-কানুন করে মিথ্যে কথা বলে এখানে এসেছে। চাচা-চাচিকে বুঝিয়েছে তার বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে যাচ্ছে–একা একা যেতে ইচ্ছে করছে না বলে তপুকে নিয়ে যাচ্ছে। ধরা পড়ে গেলে কী হবে কে জানে।
টুশি আর তপুর সিট ইল সামনের দিকে। তারা দুজনে নিজের সিটে গিয়ে বসল। টুশি ফিসফিস করে তপুকে জিজ্ঞেস করল, “বোতলটা আছে তো?”
তপু পকেটে হাত ঢুকিয়ে নিশ্চিত হয়ে বলল, “হ্যাঁ আছে।”
ঠিক কী কারণ জানা নেই টুশি আর তপু কাবিল কোহকাফীর বোতলটা সাথে। করে নিয়ে এসেছে। বোতলের উপরে মন্ত্রটা লেখা–সেই মন্ত্র বলার সময় যদি বোতলটা কাছাকাছি থাকে তা হলে কে জানে হয়তো মন্ত্রের জোর আরও বেশি হবে।
তপু কিছুক্ষণ উসখুস করে বলল, “আপু, আমরা ক-কখন ভেতরে যাব?”
টুশি ঘড়ি দেখে বলল, “বেশি আগে যেয়ে কাজ নেই। মানুষের ভিড় আরেকটু বাড় ক।”
তপু জিজ্ঞেস করল, “কো-কোনদিক দিয়ে যাব আপু?”
স্টেজের দুইপাশে দুটি সিঁড়ি ভিতরে ঢুকে গেছে–সেদিক দিয়ে ছাড়া আর যাওয়ার জায়গা নেই। টুশি দেখাল, “ঐ যে ওদিক দিয়ে।”
“যদি আমাদের ধ-ধরে ফেলে?”
“ধরলে ধরবে। দুইজন দুইদিক দিয়ে যাবে। একজন কোনোভাবে ঢুকে যাব, বুঝলি? ভিতরে ঢুকে কাবিল কোহকাফীর খাঁচার কাছে গিয়ে বলব, “মাথা নিচু হাত উঁচু মাগারুফাস মাগারুফাস মাগারুফাস, মনে আছে তো?”
“হ্যাঁ। ম-মনে আছে।”
পরদা ওঠার পর যখন সবাই দেখবে কাবিল কোহকাফী বসে আছে–অদৃশ্য না ছাই তখন বদমাইশগুলো আচ্ছা মতন জব্দ হবে।”
তপু মাথা নাড়ল, “জ-জ-জব্দ হবে।”
টুশি উত্তেজিত গলায় বলল, “বুঝলি তপু এই বদমাইশগুলোর বিজনেসের। আসল ব্যাপারটাই হচ্ছে অদৃশ্য একজন মানুষ। কিন্তু যদি দেখা যায় মানুষটা অদৃশ্য না তা হলেই বিজনেসের বারোটা বেজে যাবে।”
তপু মাথা নাড়ল, “বা-বারোটা বেজে যাবে।”
টুশি মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, বিশাল হলঘর মানুষে ভরে যাচ্ছে। বড় বড় মানুষেরা তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসেছে। সবাই আগ্রহ নিয়ে বসে আছে। যারা বড় তাদের চোখেমুখে একধরনের অবিশ্বাসের হাসি, ছোটরা খুবই উত্তেজিত। যারা একটু বেশি ছোট তারা ভয় পেয়ে তাদের বাবা-মাকে ধরে রেখেছে। ঠিক এরকম সময় একটা ভয়ের মিউজিক বাজতে শুরু করল, উপস্থিত সবাই তখন নড়েচড়ে বসে।
টুশি ঘড়ি দেখে বলল, “চল এখন।”
তপু বলল, “আমার ভ-ভয় করছে আপু।”
টুশি তপুর ঘাড়ে হাত রেখে নরম গলায় বলল, “ভয়ের কী আছে? কুলহু আল্লাহ্ পড়ে বুকে একটা ফুঁ দে দেখবি ভয় চলে যাবে।”
তপু বিড়বিড় করে কুলহু আল্লাহ্ পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে স্টেজের দিকে এগুতে থাকে। সামনে এখনও কিছু মানুষ হাঁটাহাটি করছে। কাজেই আলাদা করে কেউ তাদের লক্ষ করল না। উইংসের সামনে একজন মানুষ পাহারা দিচ্ছে, মানুষটি দুইজন দর্শককে কী-একটা বোঝাচ্ছে, সেই ফাঁকে টুশি আর তপু চট করে ভিতরে ঢুকে গেল। বিশাল একটা উইংস তার পিছনে আবছা অন্ধকার, সেখানে নিজেদের আড়াল করে রেখে তারা একটা নিশ্বাস ফেলল।
উইংসের আড়াল থেকে স্টেজটাকে দেখে তারা হতবাক হয়ে যায়। বিশাল স্টেজ তার মাঝামাঝি একটা বড় খাঁচা, সেটা কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা। কাবিল কোহকাফীকে নিশ্চয়ই এর ভেতরে বেঁধে রাখা আছে। খাঁচার দুই পাশে খুব জমকালো সেট তৈরি করা হয়েছে। দেখে মনে হয় সেটা বুঝি বিশাল একটি অরণ্য। তার পিছনে প্রাসাদের মতো একটা ঘর–দেখে মনে হয় পুরোটা বুঝি একটা রূপকথার রাজ্য। পেছনে বিশাল স্ক্রিনে বড় বড় করে লেখা–
পৃথিবীর এক এবং অদ্বিতীয়
সবচেয়ে আশ্চর্য এবং সবচেয়ে ভয়ংকর
অদৃশ্য দানব!
স্টেজের দুই পাশে বিশাল কিছু স্পিকার, একেবারে ছাদ পর্যন্ত চলে গেছে। বেশ কয়েকজন মানুষ মিলে সেগুলো পরীক্ষা করছে। মাঝে মাঝেই সেগুলো গুম গুম শব্দ করছে, মনে হয় শব্দে ছাদ ধসে পড়বে। স্টেজের জন্যে নানারকম আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে, নানা রঙের স্পটলাইট ঝুলছে, স্টেজের দুই পাশেও অনেক মানুষ বড় বড় স্পটলাইট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মাঝে মাঝে লাইট জ্বলছে এবং নিভছে। সুন্দর সুন্দর কাপড় পরা সেজেগুজে থাকা কয়েকজন পুরুষ এবং মহিলা খুব ব্যস্ত হয়ে স্টেজের উপর হাঁটাহাঁটি করছে। তারা নিশ্চয়ই অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করবে। টুশি এবং তপু অবাক হয়ে এই ব্যস্ততা এবং হইচই দেখতে থাকে, এত মানুষের ভিড়ের মাঝে কোথাও তারা মন্তাজ ওস্তাদ কালাচান কিংবা দবির মিয়াকে দেখতে পেল না। তারা হচ্ছে গুণ্ডা এবং সন্ত্রাসী, এই অনুষ্ঠানে সেজন্যে তারা নেই, হয়তো গ্রিনরুমে কোথাও বসে আছে।
তপু জিজ্ঞেস করল, “আপু এখন কী-ক-করব?”
টুশি স্টেজটা ভালো করে পরীক্ষা করে ফিসফিস করে বলল, “প্রথমে লুকিয়ে এক দৌড়ে ঐ সেটের পিছনে যেতে হবে। তা হলে কেউ দেখতে পাবে না। তারপর সেটের পিছন দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে খাঁচার কাছে যাব।”
তপু বলল, “যদি ধ-ধ-ধরা পড়ে যাই?”
“ধুর গাধা! ধরা পড়বি কেন?” টুশি তপুকে সাহস দিয়ে বলল, “লাইটটা যখন কমাবে তখন মাথা নিচু করে একটা দৌড় দিবি। সোজা সেটার দিকে।”
“তু-তুমি আসবে না?”
“আসব কিন্তু একসাথে না। দুইজন আলাদা আলাদা, যেন ধরা পড়লেও একজন ধরা পড়ি। বুঝেছিস?”
তপু বলল, “বু-বুঝেছি।”
দূজন কয়েক মিনিট নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, স্টেজের লাইটিং পরীক্ষা করতে করতে একসময় আলোগুলো নিবুনিবু করেছে তখন টুশি তপুর পিঠে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, “যা।”
তপু তখন নিচু হয়ে একছুটে উইংস থেকে একটা বিশাল কার্ডবোর্ডের গাছের নিচে আড়াল হয়ে গেল। টুশি কয়েক মুহূর্ত নিশ্বাস বন্ধ করে থাকে কেউ দেখতে পায় নি। টুশি যদি নাও যেতে পারে কিংবা ধরাও পড়ে যায় তা হলেও এখন ক্ষতি নেই, তপু হামাগুড়ি দিয়ে কাবিল কোহকাফীর কাছে পৌঁছে যেতে পারবে।
টুশি আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষা করল, আবার যখন স্পটলাইটের আলোটা ঘুরে অন্যদিকে চলে গেল টুশি মাথা নিচু করে একছুটে সেটের আড়ালে চলে গেল তাকেও কেউ দেখতে পায় নি। টুশি কিছুক্ষণ বড় বড় নিশ্বাস নেয় তারপর হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে থাকে, ঠিক তখন একটা বিপর্যয় ঘটে গেল।
স্টেটাকে সাজানোর জন্যে যে বড় বড় সেট তৈরি করা হয়েছে সেগুলো কাঠের ফ্রেম ব্যবহার করে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে। দেখে সেগুলোকে বিশাল বড় মনে হলেও আসলে এগুলো তৈরি হালকা কার্ডবোর্ড দিয়ে। টুশি সেটা বুঝতে পারে নি-পিছন থেকে একটার ওপর হালকাভাবে হেলান দিতেই তাকে নিয়ে পুরোটা হুড়মুড় করে স্টেজের ওপর পড়ে গেল–সাথে সাথে হইচই চেঁচামেচি চিৎকার শুরু হয়ে যায়। টুশি শুনতে পেল, একজন বলল, “বাবারে গেছিরে!”
কয়েকজন দৌড়ে এল তার কাছে। একজন জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? কেমন করে পড়ল?”
যার মাথার উপর পড়েছে সে কোকাতে কোকাতে বলল, “জানি না। এত করে বললাম শক্ত করে পেরেক মার–”
“মেরেছি তো শক্ত করে।”
অন্যজন ধমক দিয়ে বলল, “শক্ত করে মারলে এইভাবে মাথার মাঝে খুলে পড়ে?”
আরেকজন বলল, “পিছনে গিয়ে দ্যাখ কী হয়েছে।”
টুশি বুঝতে পারল কয়েকজন মানুষ ব্যাপারটা দেখতে আসছে। সে তাড়াতাড়ি অন্য একটা কার্ডবোর্ডের গাছের আড়ালে লুকানোর চেষ্টা করছিল কিন্তু তার আগেই একজন তাকে দেখে চিৎকার করে বলল, “আরে! আরে! এইখানে এই মেয়ে কোথা থেকে এসেছে?”
টুশি ধরা পড়ে গেছে বুঝতে পেরে কিছুই হয় নি এরকম ভান করে তার ফ্রক ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে এল। লিকলিকে চিকন একজন মানুষ খপ করে তার হাত ধরে বলল, “এই মেয়ে? তুমি এখানে কী করছ?”
টুশি গলার স্বর যতটুকু সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল, “আমার ইঁদুরের বাচ্চা–”
‘ইঁদুরের বাচ্চা?”
“হ্যাঁ, আমার পোষা একটা ইঁদুরের বাচ্চা আছে। হঠাৎ হাত থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে গেল। এদিকে কোথায় জানি লুকিয়েছে।”
মানুষগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। একজন বলল, “তুমি তোমার ইঁদুরের বাচ্চা নিয়ে এখানে এসেছ?”
টুশি দাঁত বের করে হেসে বলল, “আমার পোষা ইঁদুর, সবসময় আমার সাথে থাকে।”
“সেইজন্যে তুমি এখানে এসে সব ভেঙেচুরে ফেলছ?” মানুষটা ধমক দিয়ে বলল, “তোমার বাবা-মা কোথায়?”
টুশি অনির্দিষ্ট একটা ভঙ্গি করে বলল, “ঐ তো ওখানে।”
একজন বলল, “যাও, ভাগো এখান থেকে।”
আরেকজন বলল, “আজকালকার ছেলেপিলে যে কী পাজি চিন্তাও করা যায় না। সাহস কত বড়–এখানে ঢুকে গেল!”
মানুষগুলো তার গল্প বিশ্বাস করেছে টুশি তাই আরও একটু চেষ্টা করল, “কিন্তু আমার ইঁদুর?”
লিকলিকে মানুষটা ধমক দিয়ে বলল, “তোমার ইঁদুরের খেতা পুড়ি। ভাগে” তারপর একটা ধাক্কা দিয়ে তাকে স্টেজ থেকে বাইরে নিয়ে যেতে থাকে। টুশি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, এতক্ষণে তপু নিশ্চয়ই কাবিল কোহকাফীর কাছে। পৌঁছে গেছে–তাকে তার মন্ত্রটাও বলে দিয়েছে। কাবিল কোহকাফীকে যখন দেখানো হবে তখন সবাই দেখবে নাদুস-নুদুস একজন ভালো মানুষকে এরা ধরে বেঁধে রেখেছে! অদৃশ্য মানবের পুরো ব্যাপারটাই তখন একটা ঠাট্টা হয়ে যাবে এরা সবাই পাবলিকের যা একটা মার খাবে সেটা আর বলার মতো নয়।
পোষা ইঁদুরকে ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে এরকম মন খারাপের ভঙ্গি করে টুশি হাঁটতে থাকে ঠিক তখন ভয়ংকর একটা ব্যাপার ঘটে গেল। টুশি তাকিয়ে দেখে স্টেজের এক পাশ থেকে মন্তাজ ওস্তাদ এবং দুই পাশে কালাচান আর দবির মিয়া তার দিকে লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছে। টুশি তখন ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে এক দৌড়ে বাইরে চলে যাবার চেষ্টা করল কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে, কালাচান আর দবির মিয়া দৌড়ে এসে তাকে ধরে ফেলেছে। মন্তাজ ওস্তাদ হুংকার দিয়ে বলল, “এই মেয়ে এখানে কোথা থেকে এসেছে?”
লিকলিকে মানুষটা হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, “ফালতু মাইয়া-ইন্দুরের পিছনে পিছনে চলে আসছে!”
মন্তাজ ওস্তাদ হিংস্র মুখে বলল, “ফালতু মাইয়া? তুমি জান এইটা কে?”
লিকলিকে মানুষটা আমতা-আমতা করে বলল, “কে?”
“এই মেয়ে তোমাকে দশবার কিনে দশবার বিক্রি করে দিতে পারবে। এর মতো ধুরন্ধর মানুষ আমি আমার জন্মে দেখি নাই”
“কী বলছেন আপনি?”
“হ্যাঁ।” মন্তাজ ওস্তাদ কঠিন মুখে বলল, “এই মেয়ে কেন এসেছে জান?”
“কেন?”
“আমাদের অদৃশ্য দানবকে ছুটিয়ে নেবার জন্যে।”
“কীভাবে নেবে?”
“সেইটা তোমার ব্রেনে ধরবে না–তাই বোঝার চেষ্টাও কোরো না।”
লিকলিকে মানুষটার মনে হল একটু অপমান হল, সে কিছু-একটা বলতে চাইছিল কিন্তু মন্তাজ ওস্তাদ তাকে কোনো পাত্তা না দিয়ে তার দুই সাগরেদকে বলল, “কালাচান, দবির মিয়া”
“জে?”
“এই মেয়েকে যদি এখানে পাওয়া যায় তার অর্থ কী জানিস?”
“কী?”
“তার অর্থ এইখানে সেই তোতলা পিচ্চিটাও আছে। এক্ষুনি খুঁজে বের কর।”
লিকলিকে মানুষটা চোখ কপালে তুলে বলল, “তোত পিচ্চি?”
“হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি যা খাঁচার কাছে–নিশ্চয়ই সেখানে আছে। দৌড়া-”
একসাথে তখন অনেকে দৌড়ে গেল খাঁচার দিকে।
.
তপু যখন হামাগুড়ি দিয়ে কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা খাঁচাটার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে তখন হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ করে কার্ডবোর্ডের গাছটা স্টেজে ভেঙে পড়েছে। তপু ভয়ে চমকে উঠল, সাথে সাথে বুঝতে পারল টুশি এখন ধরা পড়ে যাবে কাজেই যা। করার তার নিজেরই করতে হবে। ভয় তার বুকের ভিতর একটা কাঁপুনি দিয়ে গেল। নিজেকে শান্ত করে তপু তাড়াতাড়ি আরও একবার কুলহু আল্লাহ পড়ে নিজের বুকে ফুঁ দিয়ে নেয় তারপর হামাগুড়ি দিয়ে খাঁচাটার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। কালো কাপড় তুলে ভেতরে তাকাল, আবছা অন্ধকারে দেখতে পেল খাঁচার দেয়ালে হেলান দিয়ে কাবিল কোহকাফী বসে আছে। চোখেমুখে একধরনের ভয়ংকর মন খারাপ-করা উদাস ভঙ্গি। কাবিল কোহকাফীর দুই হাত দুই পা এবং গলা শিকল দিয়ে খাঁচার ভেতরে বাঁধা–দেখেই কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায়। তপু ফিসফিস করে ডাকল, “কাবিল কো-কোহকাফী–”
কাবিল কোহকাফী চমকে তপুর দিকে তাকাল, তাকে দেখে হঠাৎ তার মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, শিকল পরা অবস্থায় তার দিকে এগিয়ে এস বলল, “আরে তপু! তুমি কোথা থেকে এসেছে?”
তপু হড়বড় করে বলল, “তো-তোমাকে উদ্ধার করতে এসেছি!”
“কেমন করে তুমি উদ্ধার করবে?”
“যে জি-জিনিসটা বললে তো-তোমাকে সবাই দেখতে পাবে সে-সেটা বলতে এসেছি।”
কাবিল কোহকাফী অবাক হয়ে বলল, “সেটা তুমি কেমন করে জান?”
“আমরা বে-বে-বের করেছি। তুমি যে বো-বোতলটার ভেতরে ছিলে, সে সেখানে লেখা ছিল।”
“কী তাজ্জবের ব্যাপার!”
“হ্যাঁ। তু-তুমি সেটা বললেই স-সবাই তোমাকে দেখতে পাবে। ত-ত-তখন তোমাকে আর বেঁধে রা-রা-রাখতে পারবে না!”
কাবিল কোহকাফী আনন্দে তার শিকল ঝাঁকিয়ে বলল, “জবরদস্ত! চমৎকার!”
“হ্যাঁ, তুমি মা-মাথা নিচু করে দু-দু-দুই হাত দুই পাশে রাখো। তারপর বলো “
কাবিল কোহকাফী মাথা নিচু করে দুই হাত দুই পাশে রেখে বলল, “কী বলব?”
“বলো–মা-মা-মাগারুফাস”
কাবিল বলল, “মা-মা-মাগারুফাস।”
তপু বলল, “না, নামা-মা-মাগারুফাস না”
মাগারুফাস বলতে গিয়ে আবার তপুর মুখে কথাটা আটকে গেল, সে বলল, “মা-মা-মাগারুফাস”
কাবিল বলল, “তাই তো বললাম, মা-মা-মাগারুফাস।”
তপু উত্তেজিত হয়ে বলল, “না মা-মা-মাগারুফাস”
হঠাৎ করে সে নার্ভাস হয়ে যায় এবং বুঝতে পারে সে কোননাভাবেই এখন আর এই ছোট কথাটা ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারবে না। তার পরও সে প্রাণপণে চেষ্টা করল, বলল, “তোমাকে মা-মা-মাত্র তিনবার বলতে হবে। বলবে মা-মা-মাগারুফাস-” আবার তার মুখে কথাটা আটকে গেল। রাগে-দুঃখে তপুর চোখে পানি এসে যায়, সে মেঝেতে পা দাপিয়ে বলল, “আমি ঠি-ঠি-ঠিক করে বলতে পা-পারছি না। মা-মা-মা “
কাবিল বলল, “নার্ভাস হওয়ার কিছু নাই তপু। তুমি ঠাণ্ডা মাথায় আস্তে আস্তে বলো। কোনো তাড়াহুড়া নাই–
তপু বড় করে একটা নিশ্বাস নিল। চোখ বন্ধ করে মনে-মনে সে শব্দটা ঠিক করে উচ্চারণ করল। তখন সে চোখ খুলে যেই বলতে শুরু করল ঠিক তখন দুই পাশ থেকে দুইজন খপ করে ধরে এক হ্যাঁচকা টানে তাকে শূন্যে তুলে ফেলে বলল, “পেয়েছি!”
তপু চিৎকার করতে যাচ্ছিল, কিন্তু কে যেন তার মুখটা খপ করে ধরে ফেলল, সে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্যে ছটফট করতে থাকে কিন্তু কোনো লাভ হয় না। যারা তাকে ধরেছে তাদের হাত লোহার মতো শক্ত, গায়ে মোষের মতো জোর।
তপু তাকিয়ে দেখল, টুশিকেও মন্তাজ ওস্তাদ ধরে রেখেছে। টুশি তার মাঝেই তপুকে দেখে উত্তেজিত হয়ে বলল, “তপু–বলেছিস?”
তপু মাথা নেড়ে বলল, “না আপু। বলতে পা-পারি নি।”
টুশির মুখটা মুহূর্তে বিবর্ণ হয়ে গেল। বলল, “পারিস নি?”
তপুর চোখে পানি এসে যায়। মাথা নিচু করে বলল, চে-চেষ্টা করেছিলাম। মু মুখে আটকে গেল।”
তপু মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, “এখন কী হবে আপু?”
টুশি কোনো কথা না বলে তপুর দিকে তাকিয়ে রইল। সত্যিই তো–এখন কী হবে?