১৪০. আজান

১৪০. আজান

ভারতের কোনও কোনও রাজ্য বলেছে আজান ঠিক আছে, কিন্তু মাইকে নয়। শব্দ দূষণ নিয়ে কি আজ থেকে কথা হচ্ছে! মুসলমানদের অনেকে এতে মনে করে ইসলামের বারোটা বাজলো বুঝি। যে কোনও কিছুতেই ইসলামের বারোটা বেজে যায়। কেউ কোরানের আয়াত নিয়ে প্রশ্ন করলে, কেউ মোহাম্মদের ছবি আঁকলে, কেউ মুসলিম নারীর সমানাধিকার চাইলে।

মোহাম্মদের জমানায় তো মাইকের ব্যবস্থা ছিল না, আজান তো দেওয়া হতো। এখন কেন এত কিছুর দরকার পড়ে! দিন দিন ধর্ম কেন এত বিজ্ঞান নির্ভর হয়ে পড়ছে বুঝি না। ১৪০০ বছর আগের আইডিওলজি নিচ্ছ, ১৪০০ বছর আগের টেকনোলজিও নাও। আজান দিতে গেলে মাইক লাগবে। ধর্ম প্রচার করতে গেলে রেডিও লাগবে, টেলিভিশন লাগবে, কম্পিউটার লাগবে। ফ্যান লাগবে, এসি লাগবে। ফোন লাগবে, ইন্টারনেট লাগবে। ফেসবুক টুইটার ইউ টিউব হোয়াটস আপ লাগবে। বিজ্ঞানকে দিন রাত গালি দিচ্ছ, কিন্তু বিজ্ঞান ছাড়া তোমাদের চলছে না একটুও।

মাইকের দরকার কী! আসলে এলার্ম ঘড়ি থাকলে কিছুর আর দরকার পড়ে না। মাইকের আওয়াজের চেয়ে এলার্ম ঘড়ির আওয়াজ অনেক ভালো। নিজের নামাজ নিজে পড়ো, অন্যকে বিরক্ত করো না। তোমার মতো নামাজি তো সবাই নয়। শুধু তোমাকে আর তোমার মতো মানুষকে নিয়ে নয়, তোমার চেয়ে ভিন্ন মানুষকে নিয়েও পৃথিবী। অন্যকে তোমার পথে আনার জন্য দাওয়াত দেওয়ার, জোর জবরদস্তি করার শয়তানি বন্ধ করো। বেহেস্তের লোভে জিহ্বা বেরিয়ে আসছে তো, মাথায় এক ছটাক বুদ্ধি থাকলে বুঝতে বেহেস্ত বলে কিছু নেই কোথাও।

 ১৪ ১. কাবা

সৌদি আরব তো দেখি বাঘের বাচ্চা। আল্লাহর ঘর কাবা বন্ধ করে দিল। রওজা শরিফ মসজিদ সব বন্ধ করে দিল। এখন ঈদের উৎসবও বন্ধ। ঈদের দিন কার্ফু দিয়ে দিয়েছে। শেষ রোজার পরদিন থেকে টানা পাঁচদিন কার্ফু।

সৌদি আরবের লোকদের পোশাক আশাক ভাষা সংস্কৃতি নাম ধাম ইত্যাদির অন্ধ অনুকরণ করে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানেরা। তারা এসব কার্ফু কেন অনুকরণ করে না? সব মুসলিম দেশই এখন ঈদের নামাজ, কোলাকুলি ইত্যাদি বন্ধ করে কঠোরভাবে সামাজিক এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ দিক। রূপকথার উৎসবের চেয়ে জীবন মূল্যবান।

 ১৪২. মধ্যযুগ

মধ্যযুগে যখন ইউরোপে গির্জার শাসন চলতো, সেই যুগকে বলা হয় ডার্ক এজেস বা অন্ধকার যুগ। গির্জার অন্যায় অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে রাষ্ট্রের শাসনভার গির্জার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল। ধর্ম যখন সভ্য সমাজে ক্রমশ অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে লাগলো, গির্জা তখন অবিশ্বাসীদের এবং ঈশ্বরের নিন্দুকদের হত্যা করার অসহিষ্ণু সংকল্প থেকে সরে এলো, তারা গৃহহীনকে আশ্রয় দিতে লাগলো, ক্ষুধার্তদের খাবার দিতে লাগলো, তৃষ্ণার্তকে জল পান করাতে লাগলো—এই সেবামূলক কাজ করেই তারা সমাজে ধীরে ধীরে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠলো।

আমরা এখনও মন্দির মসজিদকে গির্জার মতো মানবতার সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখি না। এর কারণ বোধহয় এটিই যে এখনও মন্দির মসজিদের জনপ্রিয়তা প্রচণ্ড, এখনও মন্দির মসজিদের বিরুদ্ধে জনগণ যুদ্ধ ঘোষণা করেনি, এখনও তাদের প্রভাব এবং প্রতাপ ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য কোনও আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। কারণ এখনও ধার্মিকের সংখ্যা প্রচণ্ড, এখনও ধর্মের ব্যাবসা প্রচণ্ড লাভবান ব্যবসা। জনপ্রিয়তা হারালেই কি তবে গির্জার মতো মন্দির মসজিদ মানবতার সেবায় মনোযোগ দেবে? কিছু কিছু সেবায় মন্দির জড়িত থাকলেও, মসজিদকে খুব একটা সেবামূলক কাজে যোগ দিতে দেখা যায় না। আজকাল তো বাংলাদেশের মসজিদ থেকে লাঠিসোটা নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের দাবিতে লোকদের বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। ভায়োলেন্স, ধর্ষণ, মাদক—সবকিছুতে মসজিদ- মাদ্রাসার ইমাম আর মৌলনাকে জড়িত থাকতে দেখা যায়। বলছি না সবাই জড়িত। কেউ কেউ জড়িত। কেউ কেউই বা জড়িত থাকবে কেন ধর্ম তাদের সৎ এবং নিষ্পাপ বানিয়েছে এই দাবিই যখন তারা জোর গলায় করে?

 ১৪৩. ধর্মটর্ম

আমি যখন রান্না করি, বাসন মাজি, ঘর দোর পরিষ্কার করি, তখন অসহ্য নৈঃশব্দকে ভেঙে টুকরো করার জন্য ব্লুটুথের স্পিকারে জোরে গান চালিয়ে দিই। আজ শচীন দেববর্মণের পুরোনো বাংলা গানগুলো শুনেছি। তখনও কর্তার গান বাজছে, যখন বাংলাদেশের খবরে জনসমুদ্রের ছবি দেখলাম! লক্ষ টুপিওয়ালা কোনও এক মোল্লার জানাজায় যোগ দিয়েছে। বাংলাদেশে তো লক ডাউন চলছে। তাহলে! তাতে কিছু যায় আসে না ওদের! ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোক ওরা। আহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তো জন্মেছিলেন শচীন দেববর্মণ! বাংলা মায়ের কোল আর বাংলা মায়ের ঢোলের জন্য কী আকুলতাই না তাঁর ছিল! কী রূপ দেখি আজ সেই বাংলার!

এই মূর্খ ধর্মান্ধ বাংলাদেশকে তৈরি করেছে জিয়া, খালেদা, এরশাদ আর হাসিনা। এদের সম্মিলিত চাষের ফসল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পঙ্গপালগুলো। ওদিকে পাকিস্তানের মসজিদও খোলা। আল্লাহর ঘর কাবা বন্ধ হয়ে যেতে পারে, আর বাংলাদেশ পাকিস্তানের মসজিদ বন্ধ হতে পারে না। রমজানের তারাবি নামাজের জন্য পাকিস্তানের মসজিদ খোলা রাখার জন্য কথাবার্তা চলছে।

মাঝে মাঝে মনে হয় মরে যাক সব করোনায়। যাদের মস্তিস্ক এত ভোঁতা, সমাজের অনিষ্ট করা ছাড়া আর কোনও ভূমিকা নেই যাদের, তাদের কী লাভ বেঁচে থেকে ! এদের মগজ ধোলাই হয়েছে ছোটবেলায়, ব্যস এতেই কি এদের সাত খুন মাফ? এদের সকল অন্যায়কে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে চিরকাল? যুক্তি বুদ্ধি যে একেবারেই এদের নেই তা তো নয়, যে যুক্তিতে আকাশে বাঘ উড়ছে শোনার পর বিশ্বাস করার আগে নিজের চোখে দেখতে চায়, সেই যুক্তিতে আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করার আগে প্রমাণ দেখতে চায় না কেন! মরতে চাইছে মরে যাক, মুশকিল হল ওরা তো একা মরবে না, প্রচুর ভালো মানুষকে ওদের কারণে মরতে হবে।

হিন্দুদের ওপর মাঝে মাঝে রাগ হয়! কেন দলে দলে তোরা মুসলমান হয়েছিলি! আজ তো সে কারণেই উপমহাদেশ জুড়ে মুসলমানের এই ভয়ানক জনসংখ্যা! দেশভাগ করলি। মারামারি কাটাকাটি করলি। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বানালো তোদের ধর্মান্তরিত সন্তানেরা। এখনও ধর্মের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। লেখাপড়া জানা, না-জানা সকলে। অশিক্ষিত ধর্মান্ধগুলোকে দেখা যায়, ওরা বাইরে বেরোয় বলে। শিক্ষিত ধর্মান্ধগুলো ঘরে বসে বসে অপেক্ষা করছে কবে বিজ্ঞানীদের তৈরি করা ভ্যাক্সিন নেবে, ঘরে বসে বসে কোরানের আয়াতও খুঁজছে, যে আয়াতকে তারা বলতে পারবে এখানে আল্লাহ বলেছেন আমিই করোনা ভাইরাস দিয়েছি, আমিই সারিয়েছি। সুতরাং আল্লাহ জ্ঞানী, আল্লাহ মহান।

ঘোড়ার ডিম মহান। এসব ধর্ম টর্ম যে ঘোড়ার ডিম, তা প্রমাণের জন্য পৃথিবীতে করোনার মতো বড় উদাহরণ আর আসেনি। মানুষের দুর্যোগে কোনও আল্লাহ, কোনও ঈশ্বর, কোনও ভগবানই কখনও পাশে দাঁড়ায় না। আসলে ওদের অস্তিত্ব নেই বলেই দাঁড়ায় না। যদি কেউ দাঁড়ায়, সে বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানমনস্ক, প্রগতির পক্ষের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। ধর্মান্ধরা জন্মান্ধের মতো, চোখের সামনের এত বড় সত্যিটাও ওদের চোখে পড়ে না।

 ১৪৪. ছবি

রুমানিয়ার পরিচালক ক্রিস্টি পুইউএর দুখানা ছবি দেখলাম কাল। দ্য ডেথ অফ মিস্টার লাযারেস্কু, আর অরোরা। ঘটনার ঘনঘটা নেই, কিন্তু শ্বাস বন্ধ করে দেখতে হয়। প্রথমটি এত বাস্তব, মনে হচ্ছিল যেন ডকুমেন্টারি দেখছি। দ্বিতীয়টিতে তো সংলাপ বলতেই নেই, কিন্তু চোখ সরানো যায় না। অরোরায় একটি লোক তার স্ত্রীসহ দুতিনজনকে খুন করে। সারাটা ছবিতে নিঃশব্দে সে তার প্রস্তুতি নেয়। দর্শক মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই প্রস্তুতি দেখে। তারপর লোকটি ঠিকই খুন করে, তখন খুনীর মতো দর্শকও চায় সে যেন ধরা না পড়ে। খুনীকে কোনও জনদরদী কাজ করতে দেখা যায়নি, কারও সঙ্গে অতি মধুর ব্যবহার করতেও দেখা যায়নি, যে কারণে সহানুভূতি তৈরি হতে পারে। সারা ছবিতে শুধু যাদের মারবে তাদের ফলো করেছে, বন্দুক কিনেছে, নানা কসরত করে সেসব জায়গায় গিয়েছে যেসব জায়গায় গেলে তাদের খুন করা যেতে পারে। তাহলে এই লোকের প্রতি সহানুভূতি জন্মায় কেন মানুষের? কেন মানুষ চায় লোকটি দূরে কোথাও পালিয়ে যাক, ধরা না পড়ুক, শাস্তি না পাক! যে লোকগুলো খুন হল, তাদের বলতে গেলে দর্শক দেখেনি। খুনীকেই দেখেছে। খুনীর স্নান করা, খাওয়া, ঘুমোনো, হাঁটাচলা,বাজারে যাওয়া, ঘর গোছানো, অফিস যাওয়া, বাড়ি ফেরা ইত্যাদি দেখেছে। খুনীর সঙ্গে তাই একাত্মবোধ করেছে, খুনীর প্রতি তাই দর্শকের সহানুভূতি তৈরি হয়েছে। গল্পের, অভিনয়ের, পরিচালনার গুণ এটি! ভালো লেখকের, ভালো পরিচালকের, ভালো শিল্পীর ক্ষমতা সাংঘাতিক! কত কিছু ওলোটপালোট করে দিতে পারে!

 ১৪৫. পয়লা বৈশাখ

পয়লা বৈশাখ পালন হল না আজ। লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা হল না, বাইরে বেরোনো হল না, বাঙালি খাবার খাওয়া হল না, গাওয়া হল না ”বাঁধ ভেংঙে দাও..” গান। শর্টস আর টি শার্ট পরে সারাদিন রইলাম, খেলাম গতকাল যা রান্না করেছিলাম তা, গান শোনা বা গাওয়ার মতো মন ছিল না। এভাবেই কাটলো শখের পয়লা বৈশাখ।

আসলে এই পরবগুলো খুব তুচ্ছ এখন, যেখানে বেঁচে থাকাটাই একটা বড় প্রশ্নের সামনে দাঁড়ানো! মহামারির সময় ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, জাত, জাতীয়তা ইত্যাদি তুচ্ছ হয়ে মানুষ পরিচয়টিই বড় হয়ে ওঠে। মানুষকেই একতাবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করতে হয় মানুষের শত্রুর বিরুদ্ধে।

 ১৪৬. মৃত্যুদণ্ড কোনও সমস্যার সমাধান নয়

শিশু ধর্ষণে ভারতের চেয়ে খুব বেশি পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ। প্রতিদিন শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন চলছে। শুধু ধর্ষণ নয়, গণধর্ষণের খবর আসছে। ছয় মাসের শিশুকেও রেহাই দিচ্ছে না ধর্ষকরা। ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে, মাথায় পাথর মেরে, গলা কেটে হত্যা করছে শিশুদের। বীভৎস এমন অপরাধের শাস্তি, অধিকাংশ মানুষই বলছে, মৃত্যুদণ্ডই শ্রেয়। বেশ কিছুদিন যাবৎ ভারতবর্ষে আন্দোলন চলছে শিশু ধর্ষণের বিরুদ্ধে, জম্মু-কাশ্মীরের কাঠুয়ায় আট বছর বয়সী এক মেয়েকে অপহরণ করে গণধর্ষণ করেছে কয়েকটি পুরুষ, তারপর খুন করে ফেলে রেখেছে জঙ্গলে। ধর্ষক আর খুনীদের বিরুদ্ধে পুলিশের দেওয়া চার্জশিট থেকেই মূলত মানুষ জানতে পেরেছে কী অকথ্য নির্যাতন চলেছে একটি নিরীহ শিশুর ওপর। ভারতে এখন ১২ বছরের চেয়ে কম বয়সী শিশুকে ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ডের আইন আনা হচ্ছে। ভারত সরকার যে জনতার আর্জি শুনেছেন, ধর্ষণ বন্ধ করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন, এ অধিকাংশ শান্তিপ্রিয় ভারতবাসীকে স্বস্তি দিয়েছে।

মৃত্যুদণ্ডের আইন বহাল করা নিয়ে যখন তোড়জোড় চলছে, মনে পড়লো ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের কথা, হেতাল পারেখ নামের একটি ১৪ বছর বয়সী স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ এবং হত্যা করার জন্য ২০০৪ সালে যে লোকটির ফাঁসি হয়েছিল! পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য ধনঞ্জয়ের ফাঁসির জন্য এমন জোর আন্দোলন করেছিলেন, মিডিয়াও সঙ্গে ছিল তাঁর যে, শেষ অবধি ফাঁসি দিতেই হল ধনঞ্জয়কে। ধনঞ্জয় এবং তার ফাঁসি নিয়ে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি মুক্তি পেয়েছে গত বছর, ওতে দেখানো হয়েছে ধনঞ্জয় যে দোষী, তার কোনও প্রমাণ নেই। হেতাল পারেখকে আসলে মেরেছেন তার মা, ওটি এক ধরনের ‘অনার কিলিং’। ধনঞ্জয় নির্দোষ এমন কথা তখন মানবাধিকার সংস্থাগুলোও বলেছিল। বলেছিল ধনঞ্জয় গরিব বলে তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। আমি জানি না ধনঞ্জয় আসলে নির্দোষ কিনা, তবে এরকম ঘটনা যে ঘটে না তা নয়, ঘটে। নির্দোষকে ফাঁসি দেওয়ার পর আসল দোষীর দেখা মেলে। তখন, সবাই বুঝি যে, বড্ড দেরি হয়ে যায়। নির্দোষকে আর বাঁচিয়ে আনা সম্ভব হয় না। কত নিরপরাধ কত নির্দোষ জেলে পচে মরছে। টাকার অভাবে ভালো উকিল জোগাড় করতে পারেনি। কত অপরাধী ঘুরে বেড়াচ্ছে, আনন্দে স্ফূর্তিতে বেঁচে আছে। আমাদের তো বৈষম্যের সমাজ। যার টাকা আছে, ক্ষমতা আছে, খ্যাতি আছে, সে অপরাধ করেও পার পেয়ে যায়। নীরব মোদী ১৩ হাজার কোটি টাকা চুরি করে নিরাপদে পালিয়ে যেতে পারে দেশ থেকে, আর ১৩ হাজার টাকা চুরির অপরাধে কেউ নিশ্চয়ই জেল খাটছে। পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে এই অভিযোগ করে সংখ্যালঘুদের ফাঁসানো হয়। পাকিস্তানের এক গরিব খ্রিস্টান মহিলা আসিয়া বিবিকে এক দল খ্রিস্টান বিরোধী মুসলিম-মৌলবাদী চক্রান্ত করে ব্লাসফেমির অভিযোগ দিয়ে ফাঁসিয়েছে। আসিয়া বিবির মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেছে, জেলে বসে আছে, মাথার ওপর ঝুলছে ফাঁসির দড়ি। আসিয়া বিবি যে নির্দোষ, তা বুঝতে কোনও কিছুর বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার পড়ে না। জাপানের হাকামাদা ৪৫ বছর মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিয়ে পাঁচ বর্গমিটার সেলের ভিতর কাটিয়েছেন। ৭৮ বছর বয়সে মানসিক অসুস্থতা দেখা দেওয়ার পর তাঁকে জেল থেকে আপাতত মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল তাঁর নিজের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে। লোকে বলে, পুলিশের নির্যাতন সইতে না পেরে তিনি বলেছিলেন তিনি অপরাধী। হাকামাদার মতো আরও অনেক মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি জাপানের সেলের ভিতর একা বসে থেকে থেকে মানসিকভাবে অসুস্থ হচ্ছে। হাকামাদা বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্র তার নিজের লোকদের হত্যা করবে, এটা মানা যায় না।’ যদিও আন্তর্জাতিক আইন বলে, মানসিক অসুস্থতা যাদের আছে, তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু জাপান সে কথা মানবে না। ১৪০টি দেশ মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত করেছে, কিছু দেশ খুব বড় অপরাধ ছাড়া সাধারণ অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে না। হতে পারে, জাপানও একদিন মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত করবে।

ধনঞ্জয়ের ফাঁসির পর কি পশ্চিমবঙ্গে ধর্ষণ বা খুন বন্ধ হয়েছে, নাকি কমে গেছে? সত্যি কথা বলতে, বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গে নারীবিরোধী অপরাধের সংখ্যা গত কয়েক বছরে এত বেড়েছে যে ভারতের নারীবিরোধী রাজ্যগুলোর কাতারে এটি বেশ পাকাপোক্ত আসন গেড়ে নিয়েছে। ফাঁসি কি অপরাধ কমায়? খুনিকে মৃত্যুদণ্ড দিলে কি সমাজে আর খুন হয় না? ধর্ষককে মৃত্যুদণ্ড দিলে কি ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যায়? জরিপে দেখা যায়, খুন ধর্ষণসহ কোনও অপরাধই বন্ধ হয় না। কানাডায় ১৯৭৬ সালে মৃত্যুদণ্ডের বিধান বিলুপ্ত করা হয়। অপরাধের সংখ্যা ১৯৭৬ সালে যা ছিল কানাডায়, তার চেয়ে অর্ধেক কমে গেছে এখন। তাহলে মৃত্যুদণ্ড না থাকলেও অপরাধ কমে। তাহলে অপরাধ কমানোর পেছনে মৃত্যুদণ্ডের ভয় নয়, অন্য কিছু কাজ করে।

মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা দেশগুলোয় যত অপরাধ ঘটে, তুলনায় তার চেয়ে কম ঘটে মৃত্যুদণ্ড না থাকা দেশগুলোয়। সুইজারল্যান্ড, আইসল্যান্ড, নরওয়ে, লুক্সেম্বার্গ, অস্ট্রিয়া, ফিনল্যান্ড এসব দেশে সবচেয়ে কম অপরাধ ঘটে, এসব দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। যে-সব দেশে মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে, সে-সব দেশে যে মৃত্যুদণ্ডের কারণে অপরাধের সংখ্যা কম, তা নয়। সেসব দেশ ধীরে ধীরে সভ্য হয়েছে; মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, সমানাধিকার, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা এবং সচেতনতা বেড়েছে বলে অপরাধের সংখ্যা কমেছে।

আমিও হয়তো আর সবার মতো মৃত্যুদণ্ডে সায় দিতাম, যদি আমি ভায়োলেন্সে বিশ্বাস করতাম। আমি মনে করি না মৃত্যুদণ্ড কোনো সমস্যার সমাধান। ধর্ষণের কারণ বের করতে হবে, সেই কারণকে নির্মূল করতে হবে। ধর্ষণ ঘটে ভায়োলেন্ট বা টক্সিক মাস্কুলিনিটি আর ভিকটিম ব্লেইমিংয়ের কারণে। পুরুষতন্ত্র জন্ম দেয় নারীবিদ্বেষ, নারীঘৃণা, নারীকে ক্ষুদ্র তুচ্ছ নিকৃষ্ট আর ধর্ষণের বস্তু ভাবার মানসিকতা। এটিই পেশিসর্বস্ব অহংকারী পৌরুষকে দিয়ে ধর্ষণ ঘটায়। সঙ্গে আছে ধর্ষককে নয়, ধর্ষিতাকে দোষ দেওয়ার সমাজ। মিডিয়াও ব্যস্ত হয়ে পড়ে ধর্ষণের সময় মেয়েটি কী পোশাক পরে ছিল, তখন দিন ছিল কী রাত ছিল, মেয়েটির চরিত্র কেমন, মেয়েটি একা ছিল কি না, মেয়েটি মদ্যপান করেছিল কিনা ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। কেউ জিজ্ঞেস করে না পুরুষটির কেন মনে হয়েছিল ধর্ষণের মতো একটি ভয়াবহ অন্যায় কাজ করা তার উচিত।

যতদিন অবধি ধর্ষণের, নারীহত্যার, শিশু পাচারের, যৌন নির্যাতনের আসল কারণগুলো বিলুপ্ত করা না যায়, ততদিন পর্যন্ত ধর্ষণ চলবে। অপরাধ যে কারণে হচ্ছে, সেই কারণকে নির্মূল করা গেলে অপরাধ কমবে। এই নির্মূল করার কাজটি কঠিন ভেবে অনেকে সোজা পথটি ধরতে চায়। সোজা পথটি হল, অপরাধীকে মেরে ফেল, চোখের বদলে চোখ নিয়ে নাও, খুনের বদলে খুন। এর নাম কিন্তু বিচার নয়, এর নাম প্রতিশোধ। এটি করে জনগণকে ধোঁকা দেওয়া যায়। জনগণ ভাবে অপরাধ দমনে সরকার বিরাট এক ভূমিকা নিয়েছে।

অপরাধীর জেল হলে এমন তো হতে পারে, সে ভালো মানুষ হয়ে জেল থেকে একদিন বেরোবে। সমাজের জন্য খারাপ নয় বরং ভালো কাজই করবে। জেল বাসের পর তো কত মানুষের অনুশোচনা হয়। আমরা সবাই জানি, কেউ অপরাধী হয়ে জন্মায় না। কেউ জন্ম থেকে ধর্ষক, খুনী নয়। সমাজের কুশিক্ষা মানুষকে অপরাধী বানায়। অপরাধ করলে অপরাধীকে শুধু দোষ দিলে চলবে কেন। কুশিক্ষাকেও দিতে হবে দোষ। আমি মনে করি, ধর্ষককে মৃত্যুদণ্ড দিলেও পুরুষেরা ধর্ষণ বন্ধ করবে না। পুরুষ তখন ধর্ষণ বন্ধ করবে যখন মেয়েদের ধর্ষণের বস্তু হিসেবে তারা আর দেখবে না। এই নষ্ট নারীবিদ্বেষী পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পুরুষদের শিখিয়ে ফেলেছে যে মেয়েরা ধর্ষণের বস্তু, এই শেখাটা মাথা থেকে দূর করতে হবে। তাহলেই ধর্ষণ বন্ধ হবে। নতুন করে কাউকে আর নতুন কিছু শেখাতে হবে না, শেখাতে হবে না যে মেয়েরাও মানুষ, তাদেরও শ্রদ্ধা করা উচিত।

ভারতকে যেন অনুসরণ না করে বাংলাদেশ। যেন ভারতের চেয়েও সভ্য দেশ, যে-সব দেশে মৃত্যুদণ্ড নেই, যে-সব দেশে অপরাধের সংখ্যা কম, সে-সব দেশের নীতি আদর্শ অনুসরণ করে।

 ১৪৭. মেয়েদের চেহারা

ফেসবুকে মেয়েরা দেখলাম তাদের প্রোফাইল ছবি কালো করে দিয়েছে। ব্ল্যাক আউট! আমি কালো করিনি কিছু। ওরা তো হিজাবে, বোরখায়, নিকাবে, অন্দরমহলে, অন্ধকারে আমাদের বন্দি করেইছে। বেরোতে গেলে ওরা চুনকালি মাখিয়ে দেয় চেহারায়। ওরা চায় আমাদের অবয়ব যেন লুকিয়ে রাখি, ওরা চায় আমাদের অস্তিত্বটাই যেন কবরে ঢুকিয়ে রাখি। শুধু ওদের যখন সেবা নেওয়ার এবং ধর্ষণ করার প্রয়োজন হবে, চুল ধরে টেনে উঠিয়ে সেবা নিয়ে এবং ধর্ষণ করে আবার লাথি দিয়ে ওই কবরে ফেলে রাখবে। নিজেদের অবয়ব লুকিয়ে ফেলে আমি প্রতিবাদ করতে চাই না। ইউরোপের কিছু মেয়ে ভিড়ের রাস্তায় উলঙ্গ হয়ে বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। মেয়েদের শরীরে বিশেষ করে বুকে কাপড় না দেখলে সভ্য দেশের মানুষও ভয় পেয়ে যায়। মেয়েরা তাদের অস্তিত্বের জানান ওইভাবেই দেয়। সমাজের গালে চপেটাঘাত ওইভাবেই করে।

মেয়েদের চেহারা বেশি বেশি দেখানো উচিত। মেয়েদের শরীর বেশি বেশি প্রকাশিত হওয়া উচিত। মেয়েদের অস্তিত্বের বেশি বেশি উপস্থিতি প্রয়োজন। রাস্তা ঘাটে বাসে ট্রেনে জাহাজে দোকানে মাঠে ময়দানে অফিসে আদালতে ক্লাবে পাবে সর্বত্র মেয়েদের সরব উপস্থিতি জরুরি। সবচেয়ে জরুরি রাতের রাস্তায় মেয়েদের অবাধ চলাচল। মনে আছে ‘টেইক ব্যাক দ্য নাইট’ আন্দোলন? সাতের দশকে আমেরিকার মেয়েরা যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়েছিল! তারা নিরাপদ রাত ফেরত চেয়েছিল। মেয়েদের বাড়ি ফিরতে বলো না, বরং পুরুষদের সন্ধে সন্ধে বাড়ি ফিরে যাওয়ার উপদেশ দাও। তাদের বলো অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে রাখতে। তাদের মধ্যেই তো আছে ধর্ষক আর যৌন-নির্যাতক।

 ১৪৮. নারীর প্রতি মানুষের কেন এত ঘৃণা

 ১

মানুষ লেখাপড়া করছে কিন্তু শিক্ষিত হচ্ছে না। মানুষের জীবনযাপনের মান উন্নত হচ্ছে, কিন্তু মানুষ সভ্য হচ্ছে না। এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে পৃথিবীর সব রকম তথ্যের নাগাল পাচ্ছে মানুষ, ভালো এবং মন্দ, ন্যায় এবং অন্যায়, শান্তি এবং অশান্তি, ভালোবাসা এবং ভায়োলেন্স, সমতা এবং বৈষম্য, সততা এবং অসততা, নারীর সমানাধিকার এবং নারী নির্যাতন, মানবাধিকার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিজ্ঞান এবং কুসংস্কার, যুক্তিবাদ এবং ধর্মান্ধতা। বাংলাদেশের মানুষ যারা মন্দকে বেছে নিচ্ছে, তারা তো জেনে বুঝেই নিচ্ছে। তারা জেনে বুঝেই অন্যায়, অশান্তি, ভায়োলেন্স, বৈষম্য, অসততা, নারীনির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, কুসংস্কার এবং ধর্মান্ধতার প্রতি ঝুঁকেছে। এরা জ্ঞানপাপী, এদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা খুব কঠিন।

কিন্তু যে যুবসমাজকে সৎ এবং সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যেত, সঠিক পথ যাদের দেখানো যেত, সুস্থ সুন্দর জীবনকে গ্রহণ করার প্রেরণা দেওয়া যেত, শিশুকাল থেকেই তাদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে এক পাল অসৎ, নারী-নির্যাতক, ধুরন্ধর, ধর্ষক, দুর্নীতিবাজ বদ লোকের হাতে। তারা প্রতিনিয়ত তাদের অমানবিক, নির্মম নিষ্ঠুর হওয়ার জন্য ইন্ধনই যোগাচ্ছে না, তারা নারীকে ঘৃণা করার জন্য নারীর বিরুদ্ধে যত কুৎসিত কুকথা বলা দরকার বলছে। নারীর কোনও অধিকার বা স্বাধীনতা থাকতে নেই, নারীর শিক্ষা এবং স্বনির্ভরতার প্রয়োজন নেই, নারীর জন্ম হয়েছে পুরুষের সেবা ও সঙ্গমের জন্য, পুরুষের সন্তান গর্ভে ধারণ করার জন্য, নারীর দুশ্চরিত্রা, নারী ডাইনি, নারীর ঘাড়ের একটি হাড় বাঁকা, নারী পাপী, একে বিশ্বাস করো না, একে মারো, একে ঘৃণা করো, কোনও পবিত্র জায়গায় একে প্রবেশাধিকার দিও না। যুব সমাজের মস্তিষ্কের কোষে কোষে ঢুকে যাচ্ছে নারীবিদ্বেষ। নারীবিদ্বেষী ওয়াজিদের বক্তৃতা শুধু শহরে বন্দরে গ্রামে গঞ্জে সীমাবদ্ধ নয়, অন্তর্জালে তাদের উপস্থিতি ভয়াবহ রকম। সন্ত্রাসী দল আইসিসে যারা যোগ দিয়েছিল, তারা কিন্তু ইউটিউব থেকে ইসলামী সন্ত্রাসীদের দ্বারা মগজধোলাই হওয়া তরুণ তরুণী!

দিন দিন ধর্ষণ বাড়ছে। বাংলাদেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে কিছু যুবককে গ্রেফতার হতে হয়েছে। এ কেমন অদ্ভুত আচরণ। ধর্ষণের বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদই তো হওয়া উচিত। পুলিশের কাজ রাতে টহল দেওয়া, চোর ছ্যাঁচড়, গুণ্ডা বদমাশ, ধর্ষক নির্যাতক, খুনী সন্ত্রাসীদের ধরা, শহর বন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অথচ আশ্চর্য, বাংলাদেশের পুলিশ ধর্ষণের বিরুদ্ধে যে সচেতন ছাত্রছাত্রী গ্রাফিতি আঁকছিল, তাদের মেরে ধরে ভ্যানে উঠিয়ে থানায় নিয়ে রাতভর অত্যাচার করেছে। পুলিশ বলছে ধর্ষণের বিরুদ্ধে গ্রাফিতি আঁকতে অনুমতি নিতে হয়। ধর্ষণ করতে গেলে কি অনুমতি নিতে হয়? অবশ্যই নয়। অনুমতি ছাড়া অন্যায় করা যাবে, অনুমতি ছাড়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যাবে না।

দেশটা নষ্ট হতে হতে একেবারে গলে গেছে। দেশের মস্তিষ্ক থেকে এখন দুর্গন্ধ পুঁজ বেরোচ্ছে। এই দেশই তো মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলাম বলে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে আমাকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আমাকে বলা হয়েছিল, ‘লেখালেখি পত্র-পত্রিকায় ছাপাতে চাইলে আমাদের অনুমতি নিতে হবে’। মৌলবাদিরা যে দেশ জুড়ে নারী নির্যাতন করে বেড়াচ্ছিল, তাতে অবশ্য তাদের অনুমতি নেওয়ার কথা কেউ বলেনি।

ভালো কাজ করার সময় যে সরকার অত্যাচার করে, নির্বাসনে পাঠায়, জেলে ভরে, সেই সরকার নিজের ভালো ছাড়া আর কারও ভালো চায় না। দেশের ভালো তো চায়ই না।

বাংলাদেশের একটি খবর, একটি ভিডিও এখন দাবানলের মতো ছড়িয়ে গেছে চারদিকে। ‘এক মেয়েকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করেছে কিছু পুরুষ’। কেন খবরটি ভাইরাল হল? ওই ‘বিবস্ত্র’ শব্দটির জন্য। স্বামীকে বেঁধে রেখে নির্যাতন করেছে ওরা। কেউ কেউ বলছে ধর্ষণ করতে চেয়েছিল, সম্ভব না হওয়ায় বিবস্ত্র করেছে। বিবস্ত্র করার ভিডিও করেছে ওরা, ফেসবুকে ভিডিও আপ্লোড করবে বলে। মেয়েটির শরীর শুধু ওরা নয়, আরও হাজার লোকে দেখবে, এর চেয়ে বড় শাস্তি একটি মেয়ের জন্য ওরা মনে করে না আর কিছু আছে।

যদি একটি পুরুষকে বিবস্ত্র করে অত্যাচার করা হত, তাহলে কি খবরটা এমন ছড়াতো? মানুষ তখন পুরুষকে মারধর করার বিরুদ্ধে কিছু হয়তো বলতো, বিবস্ত্র করার বিরুদ্ধে নয়। পুরুষ বিবস্ত্র হলে ঘটনা ভয়ানক নয়, মেয়ে বিবস্ত্র হলে ঘটনা ভয়ানক। দুটোই শরীর। দুটো শরীরে শুধু যৌনাঙ্গগুলো ভিন্ন। তাহলে এক যৌনাঙ্গ প্রকাশ হলে ক্ষতি নেই, আরেক যৌনাঙ্গ প্রকাশ হলে ক্ষতি কেন?

যদি খবরটি এমন হত— ‘একটি মেয়েকে নির্যাতন করেছে কিছু পুরুষ’, তাহলে কারও কিছু যেত আসতো না। বিবস্ত্র শব্দটি শুনে লোকে লাফিয়ে উঠেছে। কী, এত বড় স্পর্ধা, বিবস্ত্র করেছে! তার মানে মেয়েটির বুক মুখ পেট পিঠ হাত পা এমন কী যৌনাঙ্গ পর্যন্ত দেখে ফেলেছে! কী সর্বনাশ।

মেয়েরা তো শুধু স্বামীর সম্পত্তি নয়, মেয়েরা কোনও না কোনও ভাবে সমস্ত পুরুষের সম্পত্তি। সে কারণেই সব পুরুষই মেয়েদের শরীর নিয়ে চিন্তিত, এই শরীর আবার কেউ না দেখে ফেলে! সে কারণেই তো মেয়েরা কী পোশাক পরবে, তা পুরুষেরাই নির্ধারণ করে। বিবস্ত্র না করে নির্যাতন করলে সেটিকে অন্যায় বলে মনে করা হত না। বিবস্ত্র না করে জবাই করে ফেললেও মানুষ এতটা ক্ষিপ্ত হতো না, যতটা বিবস্ত্র করায় ক্ষিপ্ত।

মেয়েকে বিবস্ত্র করাটা লোকের কাছে বড় নির্যাতন মনে হয়েছে, ওই চড় ঘুসি, লাথির চেয়েও। কারণ মানুষ বিশ্বাস করে, মেয়েরা আস্ত একখানা ‘শরীর’ ছাড়া কিছু নয়। যেহেতু মেয়েরা শুধুই ‘শরীর’, তাই শরীরের সবকিছু আগলে রাখতে হবে, ঢেকে রাখতে হবে, কারণ ওগুলো মেয়েটির হলেও মেয়েটির নয়, ওগুলো মেয়েটির মালিক অর্থাৎ স্বামীর খাদ্য, ওই খাদ্যে মালিক ছাড়া কারো নজর পড়লে, ওই খাদ্যে মালিক ছাড়া আর কারও লালা ঝরলে, ওই খাদ্যে মালিক ছাড়া আর কারও ছোঁয়া লাগলে খাদ্য নষ্ট হয়ে যায়, ভক্ষণের অযোগ্য হয়ে পড়ে।

যে মানসিকতা মেয়েদের বোরখায় ঢেকে রাখে, মেয়েদের বিবস্ত্র করাকে অন্যায় বলে বিচার করে, কারণ মেয়েরা তো শুধুই ‘শরীর’, এই শরীরটাই উলঙ্গ হয়ে গেলে শরীরের আর কিছুই থাকে না—এই একই মানসিকতা মেয়েদের বিবস্ত্র করে, ধর্ষণ করে, কারণ মেয়েরা তো শুধুই ‘শরীর’।

অনেকে পুরুষকে অনুরোধ করে নারীকে শ্রদ্ধা করো, নারীকে মা, বোন, কন্যা হিসেবে দেখো, নারীকে সম্মান করো। আমি মনে করি না, নারীকে এত ফেভার করা উচিত। নারীকে মা বোন কন্যা হিসেবে দেখার দরকার নেই, নারীকে মায়ের জাত হিসেবে শ্রদ্ধা করারও দরকার নেই, নারীকে নারী বলে সম্মান করারও দরকার নেই। কই, পুরুষকে বাপের জাত হিসেবে সম্মান করার কথা বলা হয় না, পুরুষকে তো মানুষ হিসেবে দেখার অনুরোধ করা হয় না! কারণ পুরুষ বলে তাদের কেউ অসম্মান করে না, পুরুষ বলে তাদের কেউ ঘৃণা করে না। যেভাবে নারীকে করে।

তাহলে কী করতে হবে? কী করলে নারী নির্যাতন বন্ধ হবে? আমি মনে করি, শিশুকাল থেকে মানুষের মগজধোলাই হয়েছে যা দিয়ে সেসব শুধু মগজ থেকে বিদেয় করতে হবে। কী সেটা? সেটা হল কুশিক্ষা বা ভুল শিক্ষা, যেমন : নারী যৌনবস্তু, নারী পুরুষের ভোগের সামগ্রী, নারীকে নির্যাতন করা, ধর্ষণ করা কোনও অপরাধ নয়, নারীর কোনও স্বাধীনতা বা অধিকার থাকতে নেই, নারীর জন্য শিক্ষা আর স্বনির্ভরতা নয়, নারীকে পরনির্ভর হতে হবে, নারীকে পিতা, স্বামী এবং পুত্রের অধীনে বাস করতে হবে, পুরুষের ক্রীতদাসী আর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র ছাড়া নারী কিছু নয়—এইসব হাজারো নারীবিদ্বেষী শিক্ষা। এই বিদ্বেষগুলো মগজ থেকে বিদেয় করতে পারলেই যথেষ্ট, তাহলেই নারী পুরুষে সমতা আসার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

 ১৪৯. মুসলিম বিদ্বেষ

টুইটারে কিছুদিন ট্রাম্পের কীর্তিকলাপ নিয়ে লিখেছি, আর আক্রমণের শিকার হয়েছি। কে আক্রমণ করেছে আমাকে? আমেরিকার সাদা বর্ণবিদ্বেষী গোষ্ঠী? আমেরিকার চরম দক্ষিণপন্থী দল? না। আক্রমণটা এসেছে ভারতীয় হিন্দুদের কাছ থেকে। তারা ট্রাম্পের সমর্থক। ট্রাম্প তো সাংঘাতিক বর্ণবিদ্বেষী লোক, কালো আর বাদামি লোকদের ঘৃণা করেন! না, এতে তাদের কোনও আপত্তি নেই, ট্রাম্প মুসলিমদের ঘৃণা করেন, ট্রাম্প মুসলিমদের আমেরিকায় ঢুকতে দেবেন না, ট্রাম্প মুসলিমদের বারোটা বাজাবেন—এই কারণেই তারা ট্রাম্পকে ভালোবাসে, এই কারণেই তারা ট্রাম্প আবার জিতুন চায়। ট্রাম্প দক্ষিণপন্থী, তারাও দক্ষিণপন্থী, এই একখানা মিল আছে বটে। কিন্তু দুই দক্ষিণপন্থীতে আবার অমিলও প্রচুর। দক্ষিণপন্থী ক্রিশ্চান আবার দক্ষিণপন্থী অক্রিশ্চানদের, দক্ষিণপন্থী সাদা আবার দক্ষিণপন্থী কালোদের, দক্ষিণপন্থী ধনী আবার দক্ষিণপন্থী গরিবদের অতটা কাছের লোক বলে মনে করে না। সুতরাং অসাদা বাদামিগুলোকে ‘মুসলিম’ হিসেবে ভাবতে তাদের কোনও অসুবিধে হয় না। কিছু শিখ লোককে মুসলিম ভেবে ওরা তো গুলি করে মেরেই দিয়েছে। ত্বকের রঙ বাদামি হলে ‘মুসলিম’, মাথায় টুপি বা টারবান পরলে ‘মুসলিম’, ইমিগ্রেন্ট হলে ‘মুসলিম’। অস্পৃশ্যতার আরেক নাম এখন ‘মুসলিম’। তুমি মুসলিম নও বলে, তুমি হিন্দু বলে ট্রাম্প তোমাকে পছন্দ করবে, তা কিন্তু নয়। আজ ট্রাম্প মুসলিম-বিরোধী বলে তুমি ট্রাম্পকে ভালোবেসে ফেলেছো, এমনও হতে পারে মুসলিমদের ভোট পাওয়ার জন্য, বা অন্য কোনও স্বার্থে পার্টি থেকে আদেশ এলো, ট্রাম্পকে খুব মুসলিমপ্রীতি দেখাতে হবে, ব্যস ট্রাম্প তখন মুসলিম-বিরোধিতা বন্ধ করে দেবেন। রাজনৈতিক স্বার্থে হিন্দু-বিরোধীও হয়ে উঠতে পারেন, বলা যায় না। সুতরাং সাদা বর্ণবিদ্বেষী রাজনীতিকদের এত বুক ভরা ভালোবাসা না দান করাই ভালো। বুক ভরা ভালোবাসা বরং সৎ এবং নিঃস্বার্থ মানুষের জন্য রেখে দেওয়া উচিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *