১৩-১৬. জ্যামিতি ক্লাশ শেষ হয়েছে

জ্যামিতি ক্লাশ শেষ হয়েছে সমাজপাঠ এখনো শুরু হয়নি ঠিক এরকম সময় একজন দপ্তরি একটা নোটিশ নিয়ে এলো। দপ্তরিরা সাধারণত স্যার-ম্যাডাম না আসা পর্যন্ত নোটিশ পান না। কিন্তু আজকে মনে হয়ে জরুরি কিছু ঘটেছে। ক্লাশরুমে ঢুকে বলল, “তোমাদের চাইরজনকে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বোলায়।”

মাসুক জিজ্ঞেস করল, “কোন চারজন?”

দপ্তরি তখন হাতের চিরকুটটা দেখে পড়ল, “রাজু, সঞ্জয়, রূপা আর মিম্মি।”

চারজনেরই বুকটা ধড়াস করে উঠল, একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। মিম্মি ফিসফিস করে বলল, “স্মোক বম্ব।”

রূপা জিজ্ঞেস করল, “স্মোক বম্ব কী?”

“মনে নাই আমরা জ্বালালাম আর প্রিন্সিপাল ম্যাডামের ঘরে ধোয়া গেল? আমাদের টিসি দিয়ে বিদায় করে দেবে!”

“কেন টিসি দেবে? আমরা কী করেছি?”

“সারা স্কুল ধোয়া দিয়ে অন্ধকার করে দিসনি?”

“কিন্তু সেটা তো মিটে গেল। মিটে যায়নি?”

“মিম্মি মুখ শক্ত করে বলল, “নিশ্চয়ই মিটে যায়নি। দেখছিস না?”

দপ্তরি তখন তাগাদা দিল, “তাড়াতাড়ি চলো। তাড়াতাড়ি।”

চারজন তখন শুকনো মুখে রওনা দিল। সঞ্জয় দপ্তরিকে জিজ্ঞেস করল, “প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কেন ডাকছেন আমাদের? আপনি জানেন?”

দপ্তরি মাথা নাড়ল, বলল, “না জানি না। তবে—”

”তবে কী?”

“এই চৌদ্দ বছরে কখনো দেখি নাই কোনো ভালো কিছুর জন্যে ম্যাডাম কাউকে ডেকে এনেছে। তোমাদের কপালে মনে হয় দুঃখ আছে।”

প্রিন্সিপাল ম্যাডামের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রাজু শুকনো মুখে বলল, “আসতে পারি ম্যাডাম?”

“আসো।”

চারজন ভেতরে ঢুকল। ম্যাডামের অফিসঘরটা অনেক বড়। চারদিকে বড় বড় আলমারি। কিছু আলমারিতে বই, কিছু আলমারিতে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় এই স্কুলের ছেলেমেয়েদের পাওয়া মেডেল, কাপ, শিল্ড আর ক্রেস্ট। দেয়ালে স্কুলের নানা অনুষ্ঠানের বড় বড় ছবি। ঘরটা সাজানো-গোছানো এবং কেমন যেন ছমছমে ভাব।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম হাতের একটা কাগজ দেখে বললেন, “তোমরা ক্লাশ এইট বি?”

সবাই একসাথে মাথা নাড়ল, “জি ম্যাডাম।”

“রাজু, সঞ্জয়, রূপা আর মিম্মি?”

আবার মাথা নাড়ল, “জি ম্যাডাম।”

“তোমরা সবাই সোহেলের বন্ধু?”

এবার তারা লক্ষ করল ম্যাডামের অফিসে এক পাশের চেয়ারে একজন মাঝবয়সী মানুষ বসে আছে। মানুষটির পোশাক আধুনিক, গলায় টাই এবং চোখে চশমা। মিম্মি ফিসফিস করে রূপাকে বলল, “সোহেলের আব্বু।”

রূপা মাথা নাড়ল, মানুষটি নিশ্চয়ই সোহেলের আব্বু, চেহারায় হুবহু মিল।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আবার জিজ্ঞেস করলেন, “সায়েন্স ফেয়ারের জন্যে তোমরা যে টিম করেছ সেখানে সোহেল একজন মেম্বার?”

রূপা বলল, “জি ম্যাডাম।”

“তোমরা মাঝে মাঝে সোহেলের বাসায় গিয়েছ?”

“জি ম্যাডাম।”

“তার সাথে তোমাদের কথা হয়েছে? কথা হয়?”

“জি ম্যাডাম।”

“শেষবার কবে কথা হয়েছে?”

সঞ্জয় বলল, “এই তো–পাঁচ-ছয়দিন আগে।”

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তখন চেয়ারে বসে থাকা মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই যে–এরাই আপনার বাসায় গিয়েছে। এদের সাথেই যোগাযোগ আছে–কথা বলেন।”

সোহেলের আব্বু বিড়বিড় করে কিছু একটা বললেন, কাকে বললেন পরিষ্কার বোঝা গেল না। ম্যাডামকেও হতে পারে, এই চারজনকেও হতে পারে। রাজু বলল, “জি চাচা-”

“সোহেল-মানে সোহেল। ইয়ে সোহেল হয়েছে কী-” সোহেলের আব্বু কথা শেষ করলেন না।

রূপা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে সোহেলের?”

“না মানে–ইয়ে নিশ্চয়ই তার আম্মুর কাছেই গিয়েছে কিন্তু মানে আমাকে বলে যায়নি।” কথাটা নিজেকে বললেন না তাদেরকে বললেন, বোঝা গেল না।

রূপা জিজ্ঞেস করল, “সোহেল তার আম্মুর কাছে চলে গেছে?”

“নিশ্চয়ই গেছে। কিন্তু মানে-” সোহেলের আব্বু তার টাইটা ঠিক করলেন, “তার আম্মু বলছে যায়নি।”

রাজু জিজ্ঞেস করল, “তা হলে কোথায় গেছে?”

“সেটাই জানতে তোমাদের কাছে এসেছিলাম। তোমরা না কী একটা টিম তৈরি করেছ। সায়েন্স ফেয়ারের টিম, সোহেলকে নিয়ে।”

সঞ্জয় বলল, “জি। আমাদের টিমের নাম মিরূসোরাস। মি হচ্ছে মিম্মি, রূ হচ্ছে রূপা, সসা হচ্ছে সোহেল–”

রূপা সঞ্জয়কে থামাল, বলল, “হয়েছে হয়েছে আর বলতে হবে না।”

সোহেলের আব্বু বললেন, “তোমাদেরকে কী কিছু বলেছে, কোথায় গেছে বা কোথায় যেতে পারে?

রূপা মাথা নাড়ল, “না।”

“ময়নার মা বলেছে কোনো ব্যাগ, জামা-কাপড় নেয় নাই। বিকেলে বের হয়েছে আর ফিরে আসেনি।

ময়নার মা নিশ্চয়ই সোহেলদের বাসার কাজের মহিলাটি। সোহেল বিকেলে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি সেটা নিয়ে সোহেলের বাবার খুব দুশ্চিন্তা আছে বলে মনে হল না। স্কুলে আসার আগে সেজেগুঁজে টাই লাগিয়ে এসেছেন।

রাজু জিজ্ঞেস করল, “সোহেল কবে গিয়েছে?”

“গতকাল।”

ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, “পুলিশে জিডি করেছেন?”

“না করিনি। আমি ভেবেছিলাম মায়ের কাছে গেছে।”

“সোহেলের মা, মানে আপনার স্ত্রী আপনার সাথে থাকেন না?”

“উঁহু।” সোহেলের বাবা মাথা নেড়ে হাসির ভঙ্গি করলেন, যেন ব্যাপারটা খুব মজার একটা ব্যাপার।

ম্যাডাম এবারে রূপাদের দিকে তাকালেন, “সোহেল কী ক্লাসে রেগুলার?”

রূপা, রাজু, মিম্মি আর সঞ্জয় নিজেদের মাঝে দৃষ্টি বিনিময় করল, তাদের মনে হয় এখন সবকিছু খুলে বলা দরকার। রাজু একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, “না ম্যাডাম। সোহেল বহুদিন থেকে ক্লাসে আসে না। আমরা মাঝে মাঝে গিয়ে তাকে ক্লাসে আসতে বলেছি, আসতে রাজি হয় না।”

“কেন ক্লাসে আসে না?” সোহেলের আব্বুকে প্রশ্নটা করেছেন বলে রাজু কোনো কথা বলল না। সোহেলের আব্বু অবশ্যি প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করলেন না খুব মনোযোগ দিয়ে টাইটা ঠিক করতে লাগলেন।

এবারে মিম্মি মুখ খুলল, “আংকেল-আন্টি ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে সেই জন্যে খুব মন খারাপ।”

সোহেলের আব্বু ঝাঁকুনি দিয়ে সোজা হয়ে বসলেন, “না। ছাড়াছাড়ি হবে কেন? তোমরা এসব কী হাবিজাবি কথা বল?”

মিম্মি মুখ শক্ত করে বলল, “সোহেল বলেছে।”

“যত সব বাজে কথা।”

রূপা বলল, “সেটা যাই হোক এমনিতে সোহেলের খুব মন খারাপ ছিল। তা ছাড়া সোহেলের একটা সমস্যা হচ্ছে–”

সোহেলের আব্বু হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, “ঠিক আছে তা হলে আমি যাই। একটু খোঁজ নেই। খুব দুশ্চিন্তার ব্যাপার হল।”

তারপর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অফিস ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। ম্যাডাম কিছুক্ষণ টেবিলে আঙুল দিয়ে শব্দ করলেন তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ব্রোকেন ফ্যামিলি খুব বড় সমস্যা।”

রূপা একটা নিশ্বাস ফেলল, যে ফ্যামিলি ভাঙেনি তার মাঝেও খুব কম সমস্যা নেই–তার নিজেরটাই তো বড় উদাহরণ।

প্রিন্সিপাল ম্যাডামের অফিস থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটে ক্লাশরুমে যাবার সময় রাজু বলল, “সোহেলের আব্বুকে বলতে পারলাম না সোহেল ড্রাগ ধরেছে। বলা উচিত ছিল।

রূপা বলল, “ম্যাডামের সামনে বলা ঠিক হবে কী না বুঝতে পারছিলাম না।”

রাজু বলল, “স্কুল ছুটির পর চল সোহেলের বাসায় গিয়ে ওর আব্বুকে সবকিছু খুলে বলি। ওর আব্বুর জানা দরকার।”

সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল, “সোহেল কোথায় গিয়েছে?”

রূপা চিন্তিত মুখে বলল, “কে বলবে?”

মিম্মি বলল, “আমি জানি কোথায় গেছে।”

“কোথায় গেছে?”

“ও কোথায়ও যায়নি। ওকে ধরে নিয়ে গেছে।”

“কে ধরে নিয়ে গেছে?”

“ড্রাগ ডিলাররা।”

রূপা মুখে বলল, “ধুর! ড্রাগ ডিলাররা কেন ওকে ধরে নেবে?” কিন্তু ভয়ে হঠাৎ করে ওর ভেতরটা কেমন যেন নড়েচড়ে গেল।

.

দুপুরবেলা টিফিনের ছুটিতে চারজন মিলে তাদের স্মোক বম্বগুলো তৈরি করল। তারা অনেক তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে পারত কিন্তু ক্লাসের অনেকেই তাদের সাহায্য করার জন্যে হাজির ছিল বলে সময় বেশি লেগে গেল। স্মোক বম্বগুলো রোদে শুকিয়ে তারা তাদের ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়। আজকে বাসায় নিয়ে রাখবে সায়েন্স ফেয়ারের দিন নিয়ে আসবে। খাবার সোডা আর ভিনেগার দিয়ে তাদের আরেকটা এক্সপেরিমেন্ট দাঁড় করানোর জন্যে রাজুর ফিল্মের প্লাস্টিকের কৌটা নিয়ে আসার কথা ছিল। দেখা গেল সে ব্যাগ ভর্তি করে প্রায় পঞ্চাশটা কৌটা নিয়ে এসেছে। সঞ্জয় চোখ কপালে তুলে বলল, “এতগুলো? এতগুলো দিয়ে কী হবে?”

রাজু বলল, “স্টুডিওতে গিয়ে যখন জিজ্ঞেস করলাম তখন ফটোগ্রাফার তার ময়লার ঝুড়ি থেকে সব আমার ব্যাগে ঢেল দিল! আমি বলতেই পারলাম না দুই তিনটা হলেই হবে!”

রূপা বলল, “থাকুক। সমস্যা নাই। সারাদিন ধরে সায়েন্স ফেয়ার হবে–একটু পর পর দেখাতে হবে। যত বেশি তত ভালো।”

রাজু বলল, “এখন আমাদের বাকি আছে শুধু পোস্টারটা লেখা।”

সঞ্জয় বলল, “কী লিখতে হবে বলে দে। আমি লিখে দেই।”

মিম্মি বলল, “তুই লিখবি? তুই তোর হাতের লেখা কোনোদিন দেখিসনি? কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং!”

সঞ্জয় গরম হয়ে বলল, “আর তোরটা এমন কী রসগোল্লার টুকরা?

মিম্মি আরো গরম হয়ে বলল, “আমি কী বলেছি আমার হাতের লেখা ভালো? আমি শুধু বলেছি তোরটা জঘন্য।”

সঞ্জয় চিৎকার করে বলল, “আমার ইচ্ছে হলে আমি আরো জঘন্য করে লিখব। তোর কী?”

দুইজনের মাঝে ঝগড়া লেগে যেত কিন্তু কপাল ভালো ঠিক তখন ক্লাশের ঘণ্টা পড়ে গেল, সবাইকে ক্লাশে চলে আসতে হল। ওরা সবাই নিজের কাজ করছে, ঝগড়া করছে কিন্তু বুকের ভিতর অশান্তি। সোহেল কোথায়?

.

স্কুল ছুটির পর চারজন ঠিক করল সোহেলের বাসা হয়ে যাবে। সোহেলের বাবাকে বলে যাবে সোহেলের ড্রাগ নিয়ে সমস্যা আছে, ড্রাগ ডিলারদের কাছ থেকে সে ড্রাগ কেনে। চায়ের দোকানের কথাটাও বলে আসবে–তবে তারা যে তাদের একটা চালান তুলে এনেছে সেটা হয়তো বলা যাবে না।

এই ব্যাপারটা হয়তো কখনোই কাউকে বলা যাবে না।

সোহেলের আব্বুকে বাসায় পাবে কী না সেটা নিয়ে তাদের সন্দেহ ছিল। কিন্তু তাকে বাসায় পেয়ে গেল। দরজা ধাক্কা দেওয়ার পর ময়নার মা দরজা খুলে

তাদেরকে দেখে পাথরের মতো মুখ করে বলল, “সোহেল বাসায় নাই।”

“জানি।” রূপা বলল, “আমরা সোহেলের আব্বুর কাছে এসেছি। চাচা কী আছেন?”

“আছেন।” বলে সে দরজাটা খুলে দিতেই তারা সোহেলের আব্বুর দিকে তাকিয়ে রইল, তাকে কেমন জানি জবুথবু দেখাচ্ছে। বসার ঘরে একটা সোফায় পিঠ সোজা করে বসে আছেন হাতে একটা কাগজ সেই কাগজটা দেখছেন কী না বোঝা যাচ্ছে না।

রূপা, রাজু, সঞ্জয় আর মিম্মি ঢোকার পরও তাদেরকে সোহেলের আব্বু দেখলেন বলে মনে হল না। রাজু তখন একটু গলা খাকারি দিয়ে ডাকল, “চাচা।”

সোহেলের আব্বু ঘুরে তাদের দিকে তাকালেন। বিড়বিড় করে বললেন, “আমি এখন সব বুঝতে পারছি।”

রূপা অবাক হয়ে বলল, “আপনি কী বুঝতে পরছেন?”

“চিঠিতে কী লেখা।”

“কীসের চিঠি?”

“এই যে একটা চিঠি এসেছে।” সোহেলের আব্বু হাতের কাগজটা দেখালেন।”কে লিখেছে? কী লিখেছে?”

সোহেলের আব্বু চিঠিটা তাদের দিকে এগিয়ে দিলেন। রূপা চিঠিটা নিল, কম্পিউটারে কম্পোজ করা একটা চিঠি। উপরে কোনো সম্বোধন নেই-হঠাৎ করে শুরু হয়েছে। চিঠিতে লেখা :

তোর ছেলের এত বড় সাহস তার পার্টনারদের নিয়ে আমাদের মাল ডেলিভারি নেয়? দশ লাখ টাকার মাল? এখন অস্বীকার যায়? কত বড় সাহস! হয় মাল ফেরত দে না হলে দশ লাখ টাকা দে। মোবাইলে বলে দিমু রেডি থাকিস। দুই দিন সময়।

পুলিশের কাছে যাবি না। খবরদার। গেলে খবর আছে। ছেলের কল্লা পলিথিনে করে তোর বাসার দরজায় রেখে যামু। ছেলেরে জ্যান্ত ফেরত চাস তো মাল ফেরত দে না হলে দশ লাখ টাকা দে।

উনিশ-বিশ যেন না হয়। খবরদার। ফিনিস।

-তোর বাবা, আজরাইল

তারা কয়েকবার এই ভয়ংকর চিঠিটা পড়ল। প্রত্যেকবারই একটা করে নতুন জিনিস চোখে পড়ল। চিঠির শেষে লেখা ফিনিস-কী ফিনিস হবে বলা নাই কিন্তু শব্দটা পড়লেই কেমন জানি হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

রূপা চিঠিটা সোহেলের আব্বুর কাছে ফেরত দিল। সোহেলের আব্লু চিঠিটা হাতে নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকালেন। ভাঙা গলায় বললেন, “আমি টের পাচ্ছিলাম ছেলেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে খারাপ ছেলেদের সাথে মিশে। তাদেরকে নিয়ে সে ড্রাগ ডিলারদের সাথে ড্রাগ ডেলিভারির কাজে জড়িয়েছে টের পাইনি। সর্বনাশ।”

রাজু বলল, “না চাচা ব্যাপারটা সেইটা না।”

“সেইটাই ব্যাপার। চিঠিতে পরিষ্কার লেখা আছে। ড্রাগ ডেলিভারি নিয়ে পেমেন্ট করেনি। এত ছোট ছেলে এই রকম কাজে কেমন করে জড়াল!”

“চাচা, আসলে ব্যাপারটা অন্যরকম।”

সোহেলের আব্বু রাজুর কথাটায় গুরুত্ব দিলেন না। মাথাটা ধরে বললেন, “দুইদিন সময় দিয়েছে। দুইদিন। এই সময়ে এত টাকা কোথায় পাব?” তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “অন্তত ছেলেটা তো জানে বেঁচে আছে।” মাথাটা তুলে ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আছে না?”

ওরা মাথা নাড়ল। বলল, “জি বেঁচে আছে।”

“তোমরা কাউকে কিছু বলবে না। আমি চিন্তা করে দেখি কী করা যায়।”

রাজু আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল রূপা তাকে থামাল, গলা নামিয়ে বলল, “এখন আমরা যাই।”

মিম্মি বলল, “হ্যাঁ। যাই।”

বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় চারজন দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কথা বলতে থাকে। মিম্মি বলল, “আমার কথা এখন বিশ্বাস হল? বলেছিলাম না সোহেলকে ড্রাগ ডিলাররা ধরে নিয়ে গেছে?”

সঞ্জয় বলল, “এখন কী হবে?”

রূপা বলল, “কিছু একটা করতে হবে।”

“কী করতে হবে?”

কী করা যায় রূপা সেটা নিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন রাস্তার পাশে একটা মাইক্রোবাস এসে দাঁড়াল। মাইক্রোবাসের দরজা খুলে চারজন মানুষ নেমে আসে। মানুষগুলো তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেল। রূপা চোখের কোনা দিয়ে দেখল হঠাৎ করে চারজনই ঘুরে তাদের চারজনকে খপ করে ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে মাইক্রোবাসে ঢুকিয়ে নেয়।

কিছু বোঝার আগে রাস্তায় কর্কশ শব্দ করে মাইক্রোবাসটা ছুটে যেতে থাকে।

রূপা একটা চিৎকার দিতে গিয়ে থেমে গেল-তার মাথায় একটা মানুষ একটা রিভলবার ধরে রেখেছে। রূপা ঘুরে মানুষটির দিকে তাকাল, তার চোখ দুটি কী ভয়ংকর-সেগুলো যেন ধক ধক করে জ্বলছে। মানুষটির চেহারা আশ্চর্য রকম নিষ্ঠুর, মনে হয় যেন মানুষ নয়, যেন একটা দানব। একটা প্রেতাত্মা।

রূপা শুনল কে একজন বলল, “জে বস। এই দুইটা ছেমড়িই। এরাই মাল ডেলিভারি নিছে।”

“ঠিক তো?”

“জে বস। ঠিক আমার স্পষ্ট মনে আছে।”

রূপা চোখের কোনা দিয়ে দেখল, চায়ের দোকানের সেই দোকানদারই কথা বলছে। যাকে সে বস ডাকছে সেই মানুষটিই তার মাথায় রিভলবার ধরে রেখেছে। হাতটা ট্রিগারে, মনে হয় অবলীলায় ট্রিগারটা টেনে দিতে পারে।

রূপা কুলকুল করে ঘামতে লাগল।

.

১৪.

ঘরটা ছোট। ঘরের মাঝামাঝি একটা টেবিল। টেবিল ঘিরে কয়েকটা কাঠের চেয়ার। একটা চেয়ারে বস পা তুলে বসেছে। বসের বয়স ত্রিশ-চল্লিশের মতো। গায়ের রং ফরসা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, লালচে চুল। মানুষটির চেহারায় একটা বিচিত্র নিষ্ঠুরতা রয়েছে, ঠিক কোন কারণে তাকে এত নিষ্ঠুর দেখায় কেউ সেটা বুঝতে পারে না।

বসের পাশে আরো দুইজন মানুষ বসে আছে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে দুইজন-রাজু এই দুইজনকে চিনতে পারল। একজনের নাম আক্কাস অন্যজন বকর, চায়ের দোকানে রাজু তাদের দুইজনকেই দেখেছিল। চায়ের দোকানের দোকানি মেঝেতে পা ভাঁজ করে বসে আছে। ঘরের ভেতর বেশ কয়েকজন সিগারেট খাচ্ছে, তবে সিগারেটের সাথে নিশ্চয়ই কোনো নেশার জিনিস আছে কারণ ঘরের ভেতর এক ধরনের বোটকা গন্ধ।

এই ঘরের মাঝে রূপা, রাজু, মিম্মি আর সঞ্জয়কে আনা হয়েছে। তারা ঘরের একপাশে দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সাথে কেউ কোনো কথা বলছে না, মনে হচ্ছে তারা যে এখানে দাঁড়িয়ে আছে সেটা বুঝি সবাই ভুলেই গেছে।

দিনেরবেলা ঘরের মাঝে অনেক আলো তারপরও বস তার টেবিলের উপর একটা মোমবাতি জ্বালাল। তারপর টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা চামচ বের করে আনে। পকেট থেকে কয়েকটা রঙিন ট্যাবলেট বের করে চামচের উপর রাখে তারপর চামচটা মোমবাতির শিখার উপরে রেখে ট্যাবলেটগুলো গরম করতে থাকে। দেখতে দেখতে ট্যাবলেটগুলো গলে সেখান থেকে ধোঁয়া বের হতে থাকে। বস তখন চামচটার খুব কাছে নাক লাগিয়ে সেই ধোঁয়াটা নাকের মাঝে টেনে নিতে শুরু করে। সাথে সাথে তার চেহারা পরিবর্তন হতে শুরু করে, মুখটা টকটকে লাল হয়ে ওঠে, তার মুখের মাংসপেশী অনিয়ন্ত্রিতভাবে নড়তে থাকে। মুখ থেকে লালা বের হয়ে আসে, সে হাতের উল্টাপিঠ দিয়ে লালাটা মুছে নেওয়ার চেষ্টা করে। রূপা দেখল মানুষটার চোখ উল্টে যাচ্ছে, দ্রুত নিশ্বাস নিচ্ছে আর শরীরটা থরথর করে কাঁপছে।

বস নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে নিজের হাত কামড়ে ধরে গোঙানোর মতো শব্দ করে চাপা গলায় বলে, “একটা বোতল।”

কেউ একজন কালচে লাল রঙের পানীয় ভরা একটা বোতল তার হাতে ধরিয়ে দেয়। সে মুখে লাগিয়ে ঢক ঢক করে খানিকটা খেয়ে মুখ তুলে তাকাল, বিড়বিড় করে বলল, “তোদের কে পাঠিয়েছে?”

রূপা, রাজু কিংবা মিম্মি সঞ্জয়ের কেউই বুঝতে পারল না যে তাদেরকে প্রশ্নটা করা হয়েছে। তাই তারা কিছু বলল না। বস তখন হঠাৎ সোজা হয়ে বসে দুই হাতে টেবিলে জোরে থাবা দিয়ে চিৎকার করে বলল, “কে পাঠিয়েছে তোদের?”

রাজু ভয়ে ভয়ে বলল, “আ-আমাদের?”

“হ্যাঁ। কে পাঠিয়েছে?”

“আমাদেরকে কেউ পাঠায়নি।”

“তুই বলবি আর আমরা সেটা বিশ্বাস করব? গোপন পাসওয়ার্ড বলে আমাদের মাল নিয়ে গেলি আর সেইটা এমনি এমনি হয়েছে? কার জন্যে কাজ করিস তোরা?”

“আমরা কারো জন্যে কাজ করি না।”

বস ভয়ংকর খেপে গেল, হাতের বোতলটা হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে তাদের দিকে ছুঁড়ে দিল। অল্পের জন্যে সেটা মিম্মির মাথায় না লেগে পিছনের দেয়ালে লেগে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল, ভেতরের তরলটা ছিটকে সারা ঘরের মাঝে একটা ঝাঁঝালো গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। বস হিংস্র মুখে বলল, “খুন করে ফেলব আমি। এখনো বল তোরা কার জন্যে কাজ করিস? আমাদের মাল ডেলিভারি নেবার জন্যে তাদেরকে কে পাঠিয়েছে?”

মিম্মি হঠাৎ ভয়ে আতঙ্কে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু তার কথায় কিছুই বোঝা গেল না। বস তখন প্রচণ্ড জোরে একটা ধমক দিয়ে বলল, “চোপ! চোপ ছেমড়ি। কাঁদবি না।”

মিম্মি তখন আরো জোরে কেঁদে উঠল।

বসের পাশে বসে থাকা কালো মতোন মানুষটা বলল, “বস, আমার মনে হয় ইদরিসের দল। আমি শুনছি ইদরিস স্কুলের বাচ্চাদের ব্যবহার করে। প্রথমে ফ্রি বুলবুলির ব্যবস্থা করে দেয়। যখন এডিক্ট হয়ে যায় তখন এদেরকে বন্দি গোলামের মতো ব্যবহার করে।”

বস তখন ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোরা কী ইদরিসের দলের সাথে কাজ করিস?”

সবাই মাথা নাড়ল। বলল, “না।”

কালো মতোন মানুষটা বলল, “কাজ করলেও স্বীকার করবে না বস। ইদরিস খুবই চালু, তার দলে কে কোন দায়িত্বে থাকে কেউ জানে না।”

আক্কাস বলল, “মাইর দিলে সবকিছু বলে দেবে। আমার হাতে দেন আমি ঠিকমতো বানাই। দেখবেন সবকিছু বলে দেবে।”

বকর মাথা নাড়ল, “এইটা সত্যি কথা। মাইরের ওপরে ওষুধ নাই।”

বস বলল, “কেমন করে কথা বের করতে হয় সেইটা তোমাদের আমারে শিখাতে হবে না। আমার নাক টিপলে দুধ বের হয় না। দল কেমন করে চালাতে হয় আমি জানি।”

আক্কাস শুকনা মুখে বলল, “জে বস। অবশ্যি জানেন।”

“তোমরা জান না কেমন করে কাজ করতে হয়। গোপন পাসওয়ার্ড বলে আণ্ডা-বাচ্চারা মাল ডেলিভারি নেয়। তার অর্থ কী?”

আক্কাস ও বকর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর সাহস করে চায়ের দোকানের দোকানিকে দেখিয়ে বলে, “বস, আমাদের দোষ নাই। এই মদন-”

বস ধমক দিয়ে বলল, “গোপন পাসওয়ার্ড অন্যেরা কেমন করে জানল। তোমরা মানুষরে বলছ?”

দোকানি দাঁড়িয়ে কাচুমাচু করে বলল, “আল্লাহর কসম বস। কাউরে বলিনি। কেউ ছিল না আশেপাশে—”

“খবরদার আমার সামনে কিরা-কসম কাটবি না।” আমি কিরা-কসম শুনতে চাই না, আমি কোনো ওজুহাত শুনতে চাই না। আমি কাজ চাই।”

কালো মতোন মানুষটা বলল, “বস। এই চাইরটা পোলা-মাইয়া তো ভদ্রলোকের ঘর থেকে আসছে। এদের ফ্যামিলিরে চাপ দিলেও তো পাঁচ-দশ লাখ টাকা আসবে। আসবে না?”

“আসবে। কিন্তু আমাদের ব্যবসা কি কিডন্যাপিং? এই রকম উল্টা-পাল্টা ঝামেলা হাতে নিলে পরে সামলাবে কে? আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের ড্রাগ খাওয়া শিখানো। যত ছোটদের শিখাতে পার তত ভালো। একবার এডিক্ট হয়ে গেলে পারমানেন্ট কাস্টমার। সারাজীবনের জন্যে নিশ্চিন্ত। আর আমাদের ব্যবসাও নিশ্চিন্ত।”

আক্কাস জিজ্ঞেস করল, “এখন এগুলোরে কী করব বস?”

“ঘরটাতে বন্ধ করে রাখ।”

আক্কাস তখন ওদের চারজনকে ঠেলে নিতে থাকে। বস থামাল, বলল, “ব্যাগের ভেতরে কী? দেখ।”

আক্কাস ওদের ব্যাগ খুলে এলুমিনিয়াম ফয়েলে মোড়ানো স্মোক বম্বগুলো দেখতে পেল। একটা হাতে নিয়ে গন্ধ শুকে মুখ বিকৃত করে জিজ্ঞেস করল, “এগুলো কী? পিজ্জা না কি?”

“না। আমাদের সায়েন্স প্রজেক্ট।”

সঞ্জয় বলতে গেল, “এগুলো–” রূপা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, “গাছের সার। ফুলগাছে দিলে এত বড় বড় ফুল হয়।”

“সাথে নিয়ে ঘুরছিস কেন?”

“স্কুলে ফুলবাগানের কম্পিটিশান হচ্ছে তো সেই জন্যে।”

সঞ্জয় বলল, “এক ক্লাসের সাথে আরেক ক্লাসের।”

রূপা বলল, “যাদের বাগান সবচেয়ে সুন্দর হবে তারা ফার্স্ট প্রাইজ পাবে।”

সবগুলো ব্যাগে একই জিনিস। শুধু রাজুর ব্যাগে অনেকগুলো ফিল্মের কৌটা। খাবার সোডা আর ভিনেগার। আক্কাস জিজ্ঞেস করল, “ফিল্মের কৌটা দিয়ে কী করবি?”

“কেক বানাব।”

“কেক!”

“হ্যাঁ। ময়দা, খাবার সোডা, চিনি আর ভিনেগার মিশিয়ে এই কৌটার মাপ মতোন ছোট ছোট কেক-”

বকর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল। হো হো করে হেসে বলল, “এরা দেখি চূড়ান্ত বেকুব। এরা মালের ডেলিভারি নিছে বিশ্বাস হয় না।”

বস বলল, “চূড়ান্ত বেকুব দেখেই মালের ডেলিভারি নিয়েছে। মাথায় কোনো ঘিলু থাকলে কেউ এই লাইনে আসে না।”

“সেইটা সত্যি কথা।”

আক্কাস তখন চারজনকে ঠেলে পাশে একটা ঘরের সামনে নিয়ে গেল। ঘরের দরজার ছিটকানি খুলে তাদেরকে ভেতরে ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে আবার ছিটকানি লাগিয়ে দিল।

চারজন ভেতরে ঢুকে দেখে ঘরের এক কোনায় গুটিসুটি মেরে সোহেল বসে আছে। সোহেল মাথা তুলে তাকিয়ে তাদের চারজনকে দেখে খুব অবাক হল বলে মনে হল না। বিড়বিড় করে বলল, “তোদের কাছে বুলবুলি আছে?”

“বুলবুলি?” সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল, “মানে ড্রাগ?”

“হ্যাঁ। দিবি আমাকে একটা। প্লীজ–”

“কোথা থেকে দিব?”

“তোরা না কী ওদের সব ড্রাগস নিয়ে গেছিস? সেখান থেকে আমাকে একটা দিবি? প্লীজ! মাত্র একটা। আর কোনোদিন চাইব না। প্লীজ! প্লীজ!”

রূপা অবাক হয়ে সোহেলের দিকে তাকিয়ে রইল, এক মুহূর্তের জন্যে ভুলে গেল শুধু সোহেল না, তারা সবাই একটা ভয়ংকর বিপদের মাঝে আছে।

রূপা হেঁটে সোহেলের কাছে যায়, চোখ গর্তের মাঝে ঢুকে গেছে, মাথার চুল এলোমেলো। শরীরের চামড়া খসখসে, হাত দিয়ে চুলকিয়ে জায়গায় জায়গায় রক্ত বের করে ফেলেছে। সোহেল বিড়বিড় করে বলল, “শরীরটা জানি কী রকম করছে। মনে হচ্ছে চামড়ার নিচে দিয়ে কিছু একটা কিলবিল কিলবিল করছে।”

“ড্রাগস। এগুলো হচ্ছে ড্রাগস খাওয়ার ফল।”

“দিবি না আমাকে একটা?”

“নাই আমাদের কাছে।”

সোহেল তখন হঠাৎ করে কথা বলার উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। সে হাঁটু মুড়ে হাঁটুতে মাথা রেখে চুপচাপ বসে রইল। দেখে মনে হল সে বুঝি জীবন্ত মানুষ না। সে বুঝি একটা মৃত দেহ।

রূপা অন্যদের কাছে গিয়ে বলল, “সোহেলের কী অবস্থা হয়েছে দেখেছিস?” মিম্মি বলল, “আমাদেরও এই অবস্থা হবে।”

রূপা একবার মিম্মির দিকে তাকাল, কোনো কথা বলল না।

মিম্মি বলল, “তোদের সাথে থাকাই আমার ভুল হয়েছে।”

সঞ্জয় রেগে বলল, “আমাদের সাথে থাকা ভুল হয়েছে? চায়ের দোকানে গিয়ে গিলা-কলিজার বাটি কে বলেছিল? তুই যদি ওই গাধামো না করতি তা হলে আমরা আজকে এখানে থাকতাম না। বুঝেছিস?”

“তোদের সাথে যদি না মিশতাম তা হলে–”

রূপা মিম্মিকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “অনেক হয়েছে। এখন চুপ করবি? একটা বিপদের মাঝে আছি এখন সবাই একসাথে থাকবি তা না ঝগড়াঝাটি শুরু করলি।”

রাজু বলল, “খুব বিপদে পড়ে গেলাম। এই মানুষগুলো খুব খারাপ। আমাদের মুখ থেকে কথা বের করার জন্যে আমাদের মারবে বলছে—”

মিম্মি বলল, “কী কথা বের করবে? আমরা তো সত্যি কথা বলেই দিতে পারি।”

“আমাদের কোনো কথা বিশ্বাস করবে না।”

রূপা বলল, “ওদের সব ড্রাগস আমরা কমোডে ফেলে ফ্লাশ করে দিয়েছি।”

“যদি শুধু খবর পায় আমাদের খুন করে ফেলবে।” সঞ্জয় বলল, “দশ লাখ টাকার ড্রাগ কমোডে ফেলে দিয়েছি! চিন্তা করে

মিম্মি বলল, “কিন্তু এখন আমাদের কী হবে?”

রূপা বলল, “এখান থেকে পালাতে হবে।”

“কীভাবে পালাবি? পালানো কী এতো সোজা?”

রূপা দরজার কাছে গিয়ে সেটা একটু পরীক্ষা করে বলল, “দরজাটা পুরানো, খুব শক্ত না। আমরা পাঁচজন মিলে যদি ধাক্কা দেই দরজার ছিটকিনি ভেঙে যেতে পারে।”

মিম্মি মুখ ভেংচে বলল, “দরজা ভাঙতে দেওয়ার জন্যে ঐ লোকগুলো তো বসে আছে। তারা তোমাকে ভাঙতে দেবে?”

“আমি কী ওদের পারমিশান নিয়ে দরজা ভাঙব?”

“দরজায় যখন ধাক্কা দেবে তখনই তো শব্দ হবে। শব্দ শুনে সবগুলো ছুটে আসবে না?”

রূপা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “স্মোক বম্ব।”

সবাই রূপার দিকে তাকাল। রাজু জিজ্ঞেস করল, “স্মোক বম্ব কী?”

“আমরা আমাদের স্মোক বম্ব জ্বালিয়ে দেই–সারা বাড়ি ধোয়ায় অন্ধকার হয়ে যাবে তখন এখানে একটা হই চই, গোলমাল শুরু হবে–সেই গোলমালের মাঝে আমরা দরজা ভেঙে বের হয়ে পালিয়ে যাব।”

মিম্মি চোখ বড় বড় করে বলল, “পারব আমরা?”

সত্যি সত্যি পারবে কী না সেটা নিয়ে রূপার মাঝে সন্দেহ ছিল কিন্তু সেটা প্রকাশ করল না। বলল, “কেন পারব না? একশবার পারব।”

রাজু বলল, “আমাদের কাছে ফিল্মের কৌটাগুলো আছে। তার মাঝে খাবার সোডা আর ভিনেগার ভরে সেগুলোও ছুঁড়ে দিতে পারি। ঠাস ঠাস শব্দ করে সেগুলো ফুটতে থাকবে।”

রূপা হাতে কিল দিয়ে বলল, “গুড আইডিয়া।”

ওরা তখনই কাজ শুরু করে দিল। প্রথমে ফিল্মের কৌটাগুলো খুলে সারি সারি সাজিয়ে রাখল তারপর সবগুলোর ভেতর একটু করে খাবার সোডা ঢালল। যখন সেগুলো ছোঁড়ার সময় হবে তখন ভেতরে একটু ভিনেগার ঢেলে মুখ বন্ধ করে ছুঁড়ে দেবে।

এরপর ওরা সবগুলো স্মোক বম্ব বের করে নেয়। সঞ্জয়ের পকেটে ম্যাচ ছিল, সেটা দিয়ে প্রথমে কাগজে আগুন ধরিয়ে নিল। রূপা আর মিম্মি স্মোক বম্বে আগুন লাগিয়ে দেবে, সঞ্জয় সেগুলো ছুঁড়ে দেবে। রাজু ফিল্মের কৌটায় ভিনেগার ঢেলে মুখটা বন্ধ করে ছুঁড়ে দিতে থাকবে।

রূপা জিজ্ঞেস করল, “সবাই রেডি?”

“হ্যাঁ।”

সোহেল নির্জীব গলায় জিজ্ঞেস করল, “কীসের জন্যে রেডি?”

“আমরা দরজা ভেঙে পালিয়ে যাব।”

“ও!” সোহেল কোনো উৎসাহ দেখাল না, বলল, “মাথার মাঝে কী যেন হয়েছে, মনে হচ্ছে সবকিছু আউলে গেছে।”

ওরা তখন সোহেলকে নিয়ে আর মাথা ঘামাল না। রূপা আর মিম্মি কাগজ জ্বালিয়ে স্মোক বম্বে আগুন দিতে শুরু করল। আগুন জ্বলতেই গলগল করে ধোঁয়া বের হতে থাকে, সাথে সাথে সঞ্জয় জানালা দিয়ে সেগুলো বাসাটার ভেতরে ছুঁড়ে দিতে থাকে।

কিছুক্ষণের মাঝেই তারা ভেতরে মানুষের হইচই, চিৎকার শুনতে পেল।”আগুন আগুন” বলে লোকজন চিৎকার করতে থাকে, এদিক-সেদিকে ছোটাছুটি করতে থাকে। রূপা আর মিম্মি থামল না, একটার পর একটা স্মোক বম্ব জ্বালিয়ে কখনো সঞ্জয়ের হাতে দিতে লাগল কখনো নিজেরাই ছুঁড়ে দিতে লাগল। দেখতে দেখতে পুরো বাসা ধোয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়। ততক্ষণে রাজু তার ফিলের কৌটায় ভিনেগার ঢেলে কৌটার মুখ বন্ধ করে ছুঁড়ে দিতে থাকে। কিছুক্ষণ পর সেগুলো শব্দ করে ফাটতে শুরু করে। ভেতরের লোকজনের মাঝে সেটা আবার নতুন একটা আতঙ্কের জন্ম দিল। কেউ একজন বলে উঠল, “পুলিশ! গুলি করছে।”

ব্যস! আর যায় কোথায়-সাথে সাথে সবাই দুদ্দার করে ছুটে পালাতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মাঝে পুরো বাসাটা নীরব হয়ে গেল, শুধু বাইরে কিছু মানুষের দৌড়াদৌড়ি এবং চিৎকার শোনা যায়।

রাজু বলল, “সবাই মনে হয় বাসা ছেড়ে চলে গেছে।”

“হ্যাঁ।” রূপা বলল, “এখন দরজা ভাঙার সময়।”

সঞ্জয় দরজায় কয়েকটা লাথি দিল কোনো লাভ হল না। রূপা বলল, “লাথি দিয়ে ভাঙতে পারবি না।”

“কেমন করে ভাঙবে?”

“দূর থেকে দৌড়ে এসে ধাক্কা দিতে হবে। গতিশক্তি হচ্ছে হাফ এম ভি স্কয়্যার। গতিবেগের বর্গ। তাই যত জোরে দৌড়াব তত বেশি গতিশক্তি। দুই গুণ বেশি জোরে দৌড়ালে চার গুণ বেশি শক্তি।”

রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”

“কাজেই আমরা দূর থেকে যত জোরে সম্ভব দৌড়ে আসব একসাথে, কাঁধ দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিব।”

মিম্মি বলল, “দেখেছি আমি।”

“কী দেখেছিস?”

“সিনেমায়। সবসময় দৌড়ে এসে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দেয়।”

রূপা বলল, “হ্যাঁ। সিনেমার মতোন।”

তখন চারজন ঘরের অন্য মাথায় গিয়ে দাঁড়াল। রূপা বলল, “ওয়ান টু থ্রী-” সাথে সাথে চারজন ছুটে এসে কাঁধ দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিল। প্রথমবারেই দরজাটা মটমট করে উঠল, ছিটকিনিটাও একবারেই নড়বড়ে হয়ে গেল। তারা যখন দ্বিতীয়বার ছুটে এসে ধাক্কা দিল পুরো দরজাটা ধড়াস করে খুলে যায় আর তারা হুড়মুড় করে একজনের উপর আরেকজন এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

রাজু জিজ্ঞেস করল, “সবাই ঠিক আছিস?”

রূপা ব্যথায় কে কে করে বলল, “ঠিক নাই। কিন্তু সেটা নিয়ে পরে চিন্তা করব। আগে সবাই বের হ।”

“বের হবার দরজা কোথায়?”

সঞ্জয় বলল, “সামনে।”

রূপা বলল, “সামনে হয়তো ঐ লোকগুলো আছে। দেখ পিছনে কোনো দরজা আছে কি না।”

রাজু পিছনে গিয়ে একটু পরে চাপা স্বরে বলল, “হ্যাঁ পাওয়া গেছে। পিছনে একটা দরজা আছে।”

“গুড। চল পালাই।”

ওরা নিজেদের ব্যাগ নিয়ে ছুটে যেতে থাকে। সোহেল তখনো হাঁটুতে মাথা রেখে বসে আছে। রূপা চাপা স্বরে বলল, “সোহেল, আয় তাড়াতাড়ি।”

“কোথায়?”

“পালাব।”

“কেন?”

রূপা অধৈর্য হয়ে বলল, “আরে! পালাবি কেন এটা আবার কী রকম প্রশ্ন? উঠে আয়।”

“উঁহু। আক্কাস ভাই রাগ করবে। আমাকে বলেছে গোলমাল না করতে।”

রূপা তখন ছুটে গিয়ে সোহেলকে টেনে তুলল। সঞ্জয়কে বলল, “তুই আরেকদিকে ধর। মনে হচ্ছে টেনে নিয়ে যেতে হবে।”

সোহেল অবাক হয়ে বলল, “কী করছিস? কী করছিস তোরা। আমি যাব। আমাকে নিস না।”

সঞ্জয় ধমক দিয়ে বলল, “এখানে থাকবি? তোর মাথা খারাপ হয়েছে? আয় আমাদের সাথে।”

“না।” সোহেল ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তার গায়ে জোর নেই, নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারল না।

“আয় আমাদের সাথে।” রূপা ফিসফিস করে বলল, “তা হলে তোকে একটা বুলবুলি দেব।”

এই কথাটায় ম্যাজিকের মতো কাজ হল। সোহেলের চোখ চকচক করে ওঠে, জিব দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল, “সত্যি?”

“হ্যাঁ। সত্যি। আয় আমাদের সাথে।”

সোহেলকে টেনে বের করে এনে তারা ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল। তারপর তারা ছুটে পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে বাইরে থেকে দরজায় ছিটকিনিটা লাগিয়ে দেয়। একটা সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে সেটা দিয়ে দুদ্দাড় করে হেঁটে তারা রাস্তায় চলে এলো। ততক্ষণে চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে।

মিম্মি ফিসফিস করে বলল, “বেঁচে গেছি আমরা।”

“হ্যাঁ। প্রাণে বেঁচে গেছি। পালা।” রূপা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল।

মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “কী হল?”

“ধোঁয়া যখন কমে যাবে তখন ঐ লোকগুলো আবার বাসাটাতে ঢুকবে। ঢুকে যখন দেখবে ভেতরে আমরা নেই তখন বের হয়ে আমাদের খুঁজবে। না হয় নিজেরাও পালাবে। তাদেরকে আর ধরা যাবে না।”

“তা হলে তুই কী করবি?”

“লোকগুলো যখন ভেতরে ঢুকবে তখন বাইরে থেকে ছিটকিনি দিয়ে লোকজনকে ডেকে আনব, পুলিশকে ফোন করব।”

“বাইরে থেকে যদি ছিটকিনি দেওয়া না যায়?”

“তা হলে অন্য ব্যবস্থা–আগে গিয়ে দেখি।”

মিম্মি মাথা নেড়ে বলল, “তোর মাথা খারাপ হয়েছে? কোনোমতে পালিয়ে এসেছি এখন ভেতরে গিয়ে আবার ধরা খাব? মরে গেলেও না।”

রূপা বলল, “ঠিক আছে, তোরা তা হলে এইখানে অপেক্ষা কর। আমি বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে আসি।”

রাজু বলল, “তুমি একা যাবে কেন? আমিও আসি।”

“যাবে আমার সাথে? ঠিক আছে আসো।”

রাজু বলল, “অন্ধকার আছে, আমাদের কেউ দেখবে না।”

মিম্মি বলল, “তোরা একা একা যাবি না। চেষ্টা কর অন্য মানুষজনকে সাথে নিয়ে যেতে।”

রূপা বলল, “দেখি।”

.

রাজু আর রূপা খুব সাবধানে বাসাটার সামনে গেল। সেখানে মানুষের ভিড়, সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। রাজু আর রূপা একটু দূর থেকে দেখল ধোয়াটা কমে যাবার পর ড্রাগ ডিলারের দলটা ভেতরে ঢুকে গেল, ওরা গুনে গুনে যখন দেখল ছয়জনই ঢুকেছে তখন তারা সাবধানে এগিয়ে গেল। তখনো বাসার সামনে মানুষের জটলা-রূপা মানুষগুলোকে বলল, “প্লীজ আপনারা চলে যাবেন না!”

বয়স্ক একজন বলল, “কেন? কী হয়েছে?”

“বলছি। একটু দাঁড়ান। আগে দরজায় ছিটকিনিটা লাগিয়ে দিয়ে আসি।”

“ভেতরে মানুষ, বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগালে মানুষগুলো বের হতে পারবে না।”

“সেই জন্যেই লাগাচ্ছি যেন মানুষগুলো বের হতে না পারে।”

“কী আশ্চর্য! কেন?”

“বলছি, একটু দাঁড়ান। বলে রূপা আর রাজু বাসাটার দিকে ছুটে গেল। কপাল ভালো সত্যি সত্যি বাইরে একটা ছিটকিনি আছে। তারা সাবধানে ছিটকিনি লাগিয়ে ফিরে এলো।

বয়স্ক মানুষটি বলল, “কিন্তু ভেতরে আগুন–”

রূপা মাথা নাড়ল, “না, আগুন না। শুধু ধোয়া।”

“তুমি কেমন করে জান?”

“কারণ আমরা পালানোর জন্যে তৈরি করেছিলাম। আমাদের কিডন্যাপ করে ভেতরে আটকে রেখেছিল।

এবারে আরো কিছু মানুষ এগিয়ে এলো, বলল, “কী বলছ?”

“সত্যি বলছি। প্লীজ আপনারা কেউ একজন পুলিশকে ফোন করে দেন। প্লীজ। তাড়াতাড়ি।”

কয়েকজন মোবাইল ফোন বের করল, কিন্তু দেখা গেল কারো কাছে পুলিশের নাম্বার নেই। রাজু তখন তাড়াতাড়ি তার পকেট থেকে সোহেলের আব্বুর নাম্বার বের করে বলল, “এখানে ফোন করে বলে দেন। তা হলেই হবে–”

একজন নাম্বার ডায়াল করে কথা বলে ফোনটা রূপার হাতে দিয়ে বলল, “নেও। তোমার সাথে কথা বলবেন।”

রূপা ফোনটা হাতে নিল ভেবেছিল অন্য পাশে সোহেলের আব্বুর গলার স্বর শুনবে কিন্তু একজন মহিলার গলার স্বর শুনল।”হ্যালো। আমি সোহেলের আম্মু-কী হয়েছে? সোহেল কোথায়?”

“চাচি, সোহেল আর আমরা পালিয়ে বের হয়ে এসেছি। কিডন্যাপারগুলো বাসার ভেতরে আছে। ওদেরকে ধরার জন্যে পুলিশকে খবর দিতে হবে। এক্ষুনি। ওরা খুব ডেঞ্জারাস মানুষ।”

“আমরা থানাতেই আছি, পুলিশকে দেই, কোথায় আসতে হবে বল।”

রূপা ঠিকানা জানে না বলে আবার ফোনের মালিককে কথা বলতে দিল। মানুষটি এলাকার ঠিকানা বলে দিল। রূপা শুনল ঠিকানা বুঝিয়ে দেবার পর মানুষটি বলছে, “আপনারা চিন্তা করবেন না। আমরা আছি। ছেলেমেয়ের গায়ে কেউ হাত দিতে পারবে না। ড্রাগ ডিলাররাও পালাতে পারবে না।”

ড্রাগ ডিলাররা কিছুক্ষণের মাঝেই দরজা ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিল কিন্তু ততক্ষণে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে বাসাটা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। মানুষজনের ভিড় দেখে মিম্মি আর সঞ্জয়ও ওদের কাছে চলে এলো। সোহেলকে দেখে মনে হল এখনো সে একটা ঘোরের মাঝে আছে, চারপাশে কী হচ্ছে বুঝতে পারছে না। রূপাকে দেখে ফিসফিস করে বলল, “রূপা! তুই বলেছিলি আমাকে একটা বুলবুলি দিবি। দে না! না হলে মরে যাব।”

রূপা বলল, “মরবি না। একটু অপেক্ষা কর।”

কিছুক্ষণের মাঝে পুলিশের গাড়ি চলে এলো, পুলিশেরা হাতে রাইফেল নিয়ে বাসাটার দিকে ছুটে যেতে থাকে। পুলিশ নামার পর গাড়ি থেকে সোহেলের বাবা আর তার মা নেমে এলেন। সোহেলকে দেখে সোহেলের মা ছুটে এলেন, সোহেল তখন কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হল সে বিশ্বাস করতে পারছে না, ফিসফিস করে ভাঙা গলায় বলল, “মা। তুমি?”

“হ্যাঁ বাবা। তোর এ কী অবস্থা হয়েছে?”

“মা, আমি মরে যাচ্ছি মা। আমাকে একটু ধরবে?”

সোহেলের মা ছুটে এসে সোহেলকে ধরলেন আর ঠিক তখন সোহেল এলিয়ে পড়ে গেল। সোহেলের মা চিৎকার করতে লাগলেন, “সোহেল! সোহেল বাবা–”

রূপা সোহেলের মায়ের হাত ধরে বলল, “চাচি, এক্ষুনি হাসপাতালে নেন, ওর ড্রাগ উইথড্রয়াল সিনড্রোম হচ্ছে।”

সোহেলের মা কেমন যেন বিস্ফারিত চোখে তার ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

.

১৫.

রূপা, রাজু, মিম্মি আর সঞ্জয় স্কুল মাঠের মাঝখানে বসে আছে। এখানে ওদের স্মোক বম্বটা জ্বালানোর কথা ছিল, গলগল করে নানা রঙের ধোঁয়া বের হয়ে আসত আর সেটা ঘিরে ছোট ছোট বাচ্চাদের লাফ-ঝাঁপ দেওয়ার কথা ছিল। সঞ্জয়ের ধারণা তাদের স্মোক বম্বটা নির্ঘাত ফাস্ট প্রাইজ পেয়ে যেত যদিও রূপা জানে তার সম্ভাবনা খুব বেশি ছিল না। তবে দেখানোর জন্যে সেটা চমৎকার একটা প্রজেক্ট ছিল। কিন্তু এখন তাদের দেখানোর কিছু নেই, যতগুলো স্মোক বম্ব বানিয়েছিল সবগুলো ড্রাগ ডিলারের বাসায় জ্বালিয়ে দিয়ে এসেছে। নতুন করে বানানোর সময় নেই, কেমিক্যাল কেনার টাকাও নেই! ফিল্মের কৌটায় খাবার সোডা আর ভিনেগার দিয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড বানানোর প্রজেক্টটাও শেষ করতে পারেনি। ড্রাগ ডিলারদের ধরার পর তাদের অনেকবার থানা-পুলিশ করতে হয়েছে। ভাগ্যিস পুলিশের বড় অফিসাররা একটু পরে পরে তাদের সাহস আর বুদ্ধির প্রশংসা করেছে, বিশাল এক ড্রাগ ডিলারদের দল ধরে ফেলে এলাকার অনেক মানুষের জীবন বাঁচিয়ে ফেলেছে বলে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে তা না হলে বাসায় বাবা-মায়েরা তাদের বারোটা বাজিয়ে ফেলতেন। ভেতরে ঠিক কী হয়েছে কেউ জানে না। সবাই ধরে নিয়েছে সোহেলকে ড্রাগ ডিলাররা ধরেছিল, সোহেলের টিম বলে তাদেরকেও ধরেছে। তারা বুদ্ধি খাঁটিয়ে পালিয়ে এসেছে আর ড্রাগ ডিলারদের ধরেও ফেলেছে। পুলিশ বলেছে এটা নিয়ে বেশি কথা না বলতে–যত কম মানুষ জানে তত ভালো, ড্রাগ ডিলাররা না কী খুব সাংঘাতিক, দল অনেক বড়। সোহেল সম্পর্কে সবাই এখন ভাসা ভাসা জানে। তার মা ঢাকায় নিয়ে কোনো একটা হাসপাতালে ভর্তি করেছেন, সেরে উঠতে সময় নেবে। এই বছর স্কুলে যেতে পারবে না। প্রাণে বেঁচে গেছে এটাই বেশি।

রূপার অবশ্যি আলাদাভাবে মন খারাপ। তার আম্মু আজকে স্কুলের সায়েন্স ফেয়ারে আসবেন–সবার প্রজেক্টগুলো দেখবেন, শুধু ক্লাশ এইট বিয়ের মিরূসোরাস টিমের টেবিলে গিয়ে দেখবেন সেটা খালি। তারপর বাসায় গিয়ে সেটা নিয়ে রূপাকে বাকি জীবন খোটা দেবেন। অন্যেরা কত সুন্দর প্রজেক্ট করেছে আর সে কিছুই করতে পারেনি সেটা একটু পরে পরে মনে করিয়ে দেবেন। তাদের প্রজেক্টটা দিয়ে যে একটা ড্রাগ ডিলারের আস্তানা থেকে পালিয়ে এসেছে সেটা বুঝতেই চাইবেন না। যখন পুরস্কার দেওয়া হবে তখন যে তারা কোনো পুরস্কার পাবে না সেটা নিয়ে নানারকম কথাবার্তা বলবেন। পৃথিবীতে মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের ভালোবাসে কিন্তু তার মা কেন তাকে দুই চোখে দেখতে পারেন না কে জানে!

মিম্মি বলল, “ঐ যে বিজ্ঞান ম্যাডাম আসছেন।”

রূপা তাকিয়ে দেখল বিজ্ঞান ম্যাডাম লম্বা লম্বা পা ফেলে তাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। তারা চারজন উঠে দাঁড়াল, ম্যাডাম কাছে এসে বললেন, কী হল তোমরা মাঠের মাঝখানে বসে আছ কেন?”

রূপা বলল, “আমাদের মন খারাপ সেই জন্যে।”

“মন খারাপ কী জন্যে?”

“আমাদের কোনো প্রজেক্ট নাই সেই জন্যে।”

ম্যাডাম তাদের পুরো অ্যাডভেঞ্চারের সবকিছু জানেন, তাই তাদের সান্ত্বনা দিলেন, বললেন, “কে বলেছে প্রজেক্ট নাই! তোমাদের প্রজেক্টটাই তো সবচেয়ে

বেশি আছে। সেটা ব্যবহার করে কত কাজ করেছ।”

“কিন্তু এখানে তো নাই।”

“তাতে কী আছে? পরেরবার হবে। এখানে বসে থেকে কী করবে? ভেতরে যাও। তোমাদের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে থাক।”

রাজু বলল, “এমনি এমনি দাঁড়িয়ে থাকব?”

“কিছু একটা বল। কোনো একটা আইডিয়া–”

“আইডিয়া?”

“হ্যাঁ। সেটাই হোক তোমাদের প্রজেক্ট!”

মিম্মি বলল, “এখন চিন্তা করে আইডিয়া বের করব?”

“হ্যাঁ। কোনো আইডিয়া নাই? আমি যখন তোমাদের বয়সী ছিলাম তখন মাথার মাঝে কত আইডিয়া কিলবিল কিলবিল করত।”

সঞ্জয় চোখ বড় বড় করে বলল, “আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।”

ম্যাডাম বললেন, “গুড! সেটা নিয়ে দাঁড়িয়ে যাও।”

“বলব আইডিয়াটা?”

“আমাকে বলার দরকার নেই, নিজেরা নিজেরা ঠিক করে নাও।” ঠিক তখন ম্যাডামের মোবাইল ফোন বাজল, ম্যাডাম তখন ফোনে কথা বলতে বলতে স্কুলের দিকে হেঁটে চলে গেলেন।

রাজু সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার আইডিয়াটা কী?”

“ডারউইন না কে বলেছেন যে, মানুষ বাঁদর থেকে এসেছে।”

“হ্যাঁ।”

“সেটা ভুল। আমরা এইটাই বলব।”

“ডারউইন ভুল?”

“হ্যাঁ। মানুষ যদি বাদর থেকে আসত তা হলে এখন কেন বাঁদর থেকে মানুষ হচ্ছে না। কোনোদিন চিড়িয়াখানায় দেখেছিস কোনো বানরের লেজ খসে সে মানুষ হয়েছে?”

মিম্মি সঞ্জয়ের কথা শুনে হি হি করে হাসতে লাগল। রূপা বলল, “পরশু দিনের পেপার দেখেছিস?”

সঞ্জয় বলল, “কেন? কী আছে পেপারে?”

“পৃথিবীর সব বিজ্ঞানীরা মিলে ঠিক করেছেন এই পৃথিবীতে বিজ্ঞানের যত আবিষ্কার আছে তার মাঝে ফার্স্ট হচ্ছে ডারউইনের বিবর্তন থিওরি। আর তুই বলবি সেটা ভুল? তোক হাসাবি?”

“কিন্তু আমার যুক্তিতে ভুল কোথায়? দেখেছিস বাঁদরকে মানুষ হতে? দেখেছিস?”

“তোর কথাটাই ভুল। ডারউইন মোটেও বলেননি, মানুষ বাঁদর থেকে এসেছে। ডারউইন বলেছেন, মানুষ আর বাঁদর দুটোই একটা প্রাণী থেকে এসেছে। একটা ভাগ হয়েছে মানুষ আরেকটা ভাগ হয়েছে বাঁদর। আরেকটা ভাগ হয়েছে শিম্পাঞ্জী, আরেকটা গরিলা–এরকম।”

সঞ্জয় রূপার যুক্তি মানতে চাইল না, গলার রগ ফুলিয়ে তর্ক করতে শুরু করল। রাজু তখন বলল, “ব্যস, অনেক হয়েছে। নিজেরাই যেটা নিয়ে তর্ক করবে সেইটা তো আর ওখানে বলতে পারবে না!”

রূপা বলল, “কিন্তু আমাদের তো একটা আইডিয়া দরকার।”

রাজু বলল, “হ্যাঁ। বৈজ্ঞানিক আইডিয়া।”

মিম্মি মাথা চুলকে বলল, “আমরা যদি বলি একটা টাইম মেশিন তৈরি করে আমরা অতীতে চলে যাব। গিয়ে যত রাজাকার আছে সবগুলোকে ঝুলিয়ে দেব।”

রূপা বলল, “টাইম মেশিনটা বানাবি কেমন করে?”

“বানাতে হবে কেন? ম্যাডাম বলেছেন আইডিয়ার কথা। ম্যাডাম তো বলেননি বানাতে হবে। বলেছেন?”

“কিন্তু টাইম মেশিনের আইডিয়া তো আর আমাদের আইডিয়া হল না।”

মিম্মি মাথা নাড়ল। রাজু বলল, “তা হলে ব্ল্যাক হোল দোষ করল কী? ছোট একটা ব্ল্যাক হোল দিয়ে যত ময়লা-আবর্জনা শুষে নেবে।”

রূপা বলল, “আর তার সাথে সাথে যখন তোকে আমাকেও শুষে নেবে তখন কী হবে?”

রাজু মাথা চুলকাল, বলল, “তা ঠিক।”

তাদের পায়ের কাছে একটা পানির বোতল পড়েছিল, রূপা বোতলটা নিয়ে খানিকটা পানি খেয়ে মুখ বিকৃত করে বলল, “ধুর! পানিটা গরম হয়ে গেছে।”

মিম্মি বলল, “রোদে ফেলে রেখেছিস পানি গরম হবে না?”

হঠাৎ করে রূপা চোখ বড় বড় করে বলল, “ইউরেকা! পেয়েছি!”

“কী পেয়েছিস?”

“আইডিয়া।”

“কী আইডিয়া?”

“রোেদ দিয়ে পানি গরম করা।”

রাজু হতাশভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “এইটা তোমার নতুন আইডিয়া! সারা দুনিয়ার সবাই জানে যে সূর্যের আলো দিয়ে পানি গরম করা যায়।”

রূপা উত্তেজিত গলায় বলল, “কিন্তু আমরা বলব অন্যভাবে।”

“কীভাবে বলবে?”

“আমরা বলব আমরা যদি ঠাণ্ডা পানি দিয়ে রান্না না করে সূর্যের আলো দিয়ে পানিটাকে একটু গরম করে রান্না করি তা হলে অনেক জ্বালানি বেঁচে যাবে।”

সঞ্জয় ভুরু কুঁচকে বলল, “সূর্যের আলো দিয়ে পানি গরম?”

”হ্যাঁ।”

“কীভাবে করা হবে?”

“প্রত্যেকটা বাসায় একটা পানির গামলা থাকবে, সেই গামলায় পানি ভরে রোদে রেখে দেবে। একটা প্লাস্টিকের ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেবে, যেন তাপ বের হতে না পারে। রান্না করার সময় সেখান থেকে পানি নিয়ে রান্না করবে।”

সঞ্জয় হাত নেড়ে উড়িয়ে দিয়ে বলল, “ধুর! রান্নাবান্না আবার সায়েন্স প্রজেক্ট হল না কি?”

রূপা রেগে গিয়ে বলল, “গাধা, এটা রান্নাবান্না না। এটা হচ্ছে জ্বালানি বাঁচানো। শুধু জ্বালানি বাঁচবে না গ্রিন হাউস গ্যাসও কম বের হবে। পরিবেশের জন্যে ভালো–”

“ধুর!” সঞ্জয় বলল, “এর থেকে টাইম মেশিন ভালো।”

মিম্মি বলল, “না হয় ব্ল্যাক হোল!”

রাজু মাথা চুলকে বলল, “টাইম মেশিন আর ব্ল্যাক হোল তো আমরা বানাতে পারব না। রূপার আইডিয়াটা তো কাজে লাগানো যাবে।”

“কিন্তু খুবই বোরিং।” মিম্মি হতাশ ভঙ্গিতে বলল, “কেউ শুনবেই না।”

রূপা বলল, “না শুনলে নাই। আমি এটাই বলব।”

.

কাজেই দেখা গেল সবাই তাদের টেবিলে নানা ধরনের মজার মজার সায়েন্স প্রজেক্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মিরূসোরাস টিমের টেবিল খালি। শুধু পিছনে একটা কাগজে লেখা :

জ্বালানি সাশ্রয় এবং গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন থেকে
রক্ষার সহজ পন্থা : সূর্যের আলো দিয়ে পানি গরম
করে সেই পানি রান্নার কাজে ব্যবহার করা।

তাদের সেই লেখাটি কেউ পড়েও দেখল না, সবাই আশেপাশের বিজ্ঞান প্রজেক্ট দেখতে লাগল। মাসুক রোবট সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা সবচেয়ে বেশি ভিড় জমিয়ে ফেলল। ইলেকট্রিক বেল, অদৃশ্য আলো, মানুষের পরিপাকতন্ত্র, রঙের মিশ্রণ–এরকম মজার মজার এক্সপেরিমেন্ট ছেড়ে কে তাদের বক্তৃতা শুনতে আসবে? কাজেই তাদের টিম থেকে প্রথমে মিম্মি তারপর সঞ্জয় খসে পড়ল। রাজু হয়তো আরো কিছুক্ষণ থাকত কিন্তু ভলান্টিয়ার কম পড়ে গেল বলে ম্যাডাম তাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। কাজেই রূপা একা তার পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে রইল, কেউ তার কাছে কিছু শুনতে এলো না। ছেলেমেয়েদের আব্বু আম্মুরা এসেছে তারা ঘুরে ঘুরে প্রজেক্টগুলো দেখছে কেউ তার টেবিলের সামনে দাঁড়াল না।

শুধু আম্মু তার টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন, সরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “এইটা তোর প্রজেক্ট?”

রূপা লজ্জায় লাল-বেগুনি হয়ে বলল, “হ্যাঁ।”

“একটা কাগজে দুই-তিনটা লাইন লিখে টানিয়ে রেখেছিস?”

“আসলে এইটা একটা আইডিয়া।”

“এইটা আইডিয়া?”

রূপা মাথা নাড়ল। আম্মু গলা নামিয়ে বললেন, “গাধামোর তো একটা সীমা থাকা দরকার। সবাই কত সুন্দর সুন্দর প্রজেক্ট করেছে আর তুই একটা কাগজে ফালতু একটা কথা লিখে বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে আছিস? কেউ ঘুরেও তাকাচ্ছে না। লজ্জা করে না তোর?”

রূপা কী বলবে বুঝতে পারল না, সত্যিই তো, কেউই তার কাছে আসেনি। সত্যিই তো সে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। আম্মু চলে যেতে যেতে আবার ফিরে এলেন, “তুই সারাক্ষণ বলিস না যে সায়েন্স গ্রুপে পড়বি? সেই জন্যে আমি আজকে এসেছি দেখতে। কারা সায়েন্স গ্রুপে পড়বে জানিস?” আম্মু আশেপাশের সবাইকে দেখিয়ে বললেন, “ওরা! তুই না। তুই সায়েন্সের ‘স’ও জানিস না।”

বলে আম্মু গট গট হেঁটে চলে গেলেন। রূপার মনে হল তার চোখ ফেটে পানি বের হয়ে আসবে। পৃথিবীতে তার আম্মুর থেকে নিষ্ঠুর কোনো মানুষ কী আছে? রূপা তখনই তার পোস্টারটা টেনে ছিঁড়ে চলে যেত কিন্তু যেতে পারল না তার কারণ বিজ্ঞান ম্যাডামের সাথে তিন-চারজন মানুষ ঠিক তখন হাতে কাগজ কলম নিয়ে তার টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্ক মানুষটা তার পোস্টারে লেখা কাগজটার লেখাগুলো পড়ে বলল, “ইন্টারেস্টিং! তোমার প্রজেক্ট হচ্ছে এই স্টেটমেন্ট?”

রূপা লজ্জায় লাল হয়ে গেল, বলল, “আসলে আমাদের আরেকটা প্রজেক্ট ছিল, সেটা শেষ হয়ে গেছে তাই-”

পিছনের মানুষটা বলল, “এটাতে তো দেখার কিছু নেই। আমরা গ্রেড দিব কীসে?”

রূপা বুঝতে পারল এরা হচ্ছে বিচারক, বাইরে থেকে এসেছেন। সবার প্রজেক্টে নম্বর দিতে দিতে যাচ্ছেন। তাকে কত নম্বর দেবেন? শূন্য? না কী শূন্য থেকেও কম, নেগেটিভ নম্বর?

মানুষগুলো চলে যাবার জন্যে রূপা দাঁড়িয়ে রইল। পিছনের দুইজন চলেও যাচ্ছিল কিন্তু বয়স্ক মানুষটা দাঁড়িয়ে কী যেন চিন্তা করল তারপর রূপাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার এটা তো বিজ্ঞানের প্রজেক্ট হয় নাই।”

রূপা মাথা নিচু করে বলল, “জানি। আসলে আমাদের আসল যে প্রজেক্ট ছিল–”

বয়স্ক মানুষটা বাধা দিয়ে বলল, “না না, আমি সেটা বলছি না। তুমি যদি দাবি কর একটা আইডিয়া দিয়ে জ্বালানি কিংবা গ্রিন হাউস গ্যাস কমানো সম্ভব তা হলে তোমাকে একটা সংখ্যা বলতে হবে। বল, কতখানি জ্বালানি বাঁচাবে?”

রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “ইয়ে-জানি না।”

“তা হলে তো হবে না। আমিও তো একটা আইডিয়া দিতে পারি, বলতে পারি মোবাইল ফোনে কথা না বললে ব্যাটারি চার্জ করতে হবে না। আর ব্যাটারি চার্জ করতে না হলে অনেক ইলেকট্রিসিটি বাঁচবে। দেশের উপকার হবে। বলতে পারি না?”

“জি। পারেন।”

“কিন্তু আমি যদি সংখ্যা দিয়ে দেখাতে না পারি তা হলে তো আমার কথার কোনো গুরুত্ব নাই। কাজেই তোমার এই আইডিয়াটা আসলেই ঠিক না ভুল যদি আমাকে জানতে হয় তা হলে তোমাকে কোনো সংখ্যা দিয়ে বলতে হবে। বলতে পারবে?”

রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “না, পারব না।”

“ঠিক আছে আমি তোমাকে সাহায্য করি। সূর্যের আলো থেকে রাফলি প্রতি বর্গমিটারে একশ বিশ ওয়াট এনার্জি আসে। আর প্রতি সি এফ টি গ্যাস থেকে তাপ তৈরি হয় আনুমানিক এক মেগাজুল। এখন তুমি আমাকে বলো তোমার আইডিয়া দিয়ে তুমি দেশের কত সম্পদ রক্ষা করতে পারবে?”

রূপা মাথা নিচু করে বলল, “পারব না স্যার।”

“পারবে না কেন? নিশ্চয়ই পারবে। বলো।”

রূপা দাঁড়িয়ে রইল, আর তখন বয়স্ক মানুষটার একটু মায়া হল। তাই তাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে তুমি পারলে বের কর। আমি যাবার সময় দেখব তুমি পেরেছ কী না।”

তিনজনের বিচারকের টিম তখন পাশের টেবিলে গেলেন অদৃশ্য আলো দেখার জন্যে। সায়েন্স ম্যাডাম টিমের সাথে আছেন। কিন্তু নিজ থেকে একটা কথাও বলছেন না।

বিচারকের দলটা বেশ খানিকটা দূর চলে যাবার পর রূপা হঠাৎ করে বুঝতে পারল বয়স্ক মানুষটা তার কাছে কী জানতে চেয়েছেন–আসলেই তো কঠিন কিছু জানতে চাননি, বেশ সোজা একটা জিনিস জানতে চেয়েছেন। সারাদিন যদি কেউ একটা পানির গামলায় সূর্যের আলো ফেলে পানি গরম করে তা হলে কত সি এফ টি গ্যাস বাঁচানো যাবে। রূপা তখন একটা কাগজে হিসাব করতে বসল। বাংলাদশে সোল কোটি মানুষ, যদি পাঁচজনের একটা পরিবার হয় তা হলে প্রায় তিন কোটি পরিবার। প্রত্যেকটা পরিবার যদি এক স্কয়ার মিটারের এক গামলা পানি রোদে রেখে দেয় তা হলে সারাদিনে সেই পানি কতটুকু গরম হবে। যদি গ্যাস জ্বালিয়ে সেই পরিমাণ তাপ তৈরি করতে হয় তা হলে কত গ্যাস লাগবে। ক্যালকুলেটর নেই তাই কাগজে লিখে অনেক গুণ, ভাগ করতে হল এবং তার উত্তর হল বছরে পঞ্চাশ বিলিওন সি এফ টি! হিসাবে কোথাও নিশ্চয়ই গোলমাল করেছে তাই আরেকবার হিসাব করল তারপরও একই উত্তর। তা হলে কী আসলেই পঞ্চাশ বিলিওন সি এফ টি গ্যাস? সেটা তো অসম্ভব একটা ব্যাপার। রূপা আরো একবার হিসাব করল একই উত্তর এলো। কী আশ্চর্য!

বিচারকের দলটা যাবার আগে সত্যি সত্যি তার কাছে আরো একবার এলো। বয়স্ক মানুষটা রূপাকে জিজ্ঞেস করলেন, “বের করেছ?”

রূপা মাথা চুলকে বলল, “বের করেছি, কিন্তু মনে হয় উত্তরটা ভুল।”

“কেন?”

“আমার উত্তর এসেছে বছরে পঞ্চাশ বিলিওন সি এফ টি গ্যাস বাঁচানো যাবে!”

ভদ্রলোক শিস দেবার মতো শব্দ করে হেসে ফেললেন, তারপর বললেন, “কেমন করে বের করেছ?”

“ধরেছি পাঁচজন করে ফ্যামিলি, বাংলাদেশে মোট ফ্যামিলি প্রায় তিন কোটি। সবাই সূর্যের আলো দিয়ে দিনে বারো ঘণ্টা এক মিটার স্কয়্যারের গামলায় পানি গরম করে। সেভাবে ধরলে–”

বয়স্ক ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, বললেন, “বুঝেছি।” বিচারকের দলটি হেঁটে চলে যেতে যেতে থেমে গেলেন, রূপার দিকে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা, “তোমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তোমার এই আইডিয়াটার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক কী তুমি কী বলবে?”

রূপা মাথা চুলকাল তারপর বলল, “এইটা খুবই সোজা। সত্যি সত্যি যে কোনো মানুষ এটা করতে পারবে। একটা চাড়ি কিনে পানি ভরে বাইরে ফেলে রাখবে। রান্না করার সময় এখান থেকে পানি নিয়ে রান্না করবে!”

ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন তারপর হেসে ফেললেন। তারপর দল নিয়ে চলে গেলেন। রূপার আম্মু তার মাঝে যে তেতো একটা লজ্জা আর অপমানের ভাব দিয়ে গিয়েছিলেন, বয়স্ক ভদ্রলোকের হাসিটুকু দিয়ে তার অনেকটুকু দূর হয়ে গেল। পুরস্কার সে না পেতে পারে কিন্তু অপমানিত তো হতে হল না!

.

পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং আরো অনেক বুড়ো বুড়ো মানুষ স্টেজে বসে রইল। টেবিলে অনেকগুলো মেডেল সাজানো-কারা কারা সেটা পাবে সবাই এর মাঝে অনুমান করে ফেলেছে। পুরস্কার দেবার আগে বক্তৃতা শুরু হল এবং লম্বা লম্বা বক্তৃতা শুনে সবার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা। রূপা ফিসফিস করে মিম্মিকে বলল, “আয় পালাই।”

মিম্মি বলল, “চল।”

দর্শকদের সাথে আম্মুও বসে আছেন, কাজেই আম্মুর চোখ এড়িয়ে রূপা হলঘর থেকে বের হয়ে এলো। রূপার পিছু পিছু মিম্মি এবং সবার শেষে সঞ্জয়। তিনজন বারান্দায় খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল, সঞ্জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ইশ! আমরা ফার্স্ট প্রাইজটা মিস করলাম।”

রূপা বলল, “তুই কেমন করে জানিস?”

সঞ্জয় বলল, “আমি জানি।”

“ঠিক আছে তা হলে পরের বার।”

তিনজন হলঘরের বারান্দার এই মাথা থেকে ঐ মাথা পর্যন্ত একবার হেঁটে আসে। ভেতরে বক্তৃতা শেষ, এখন মনে হয় পুরস্কার দেওয়া শুরু হবে। রূপা মিম্মিকে জিজ্ঞেস করল, “সোহেলের কোনো খবর জানিস?”

“মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হয়েছে।”

“কতদিন লাগবে?”

“অনেকদিন। আর মজা কী হয়েছে জানিস?”

“কী?”

“এই গোলমালের কারণে সোহেলের আব্বু-আম্মুর মিলমিশ হয়ে গেছে।“

”সত্যি?”

“সত্যি!”

ঠিক এরকম সময়ে হলঘরের ভেতর থেকে একটা বিস্ময়ের মতো শব্দ শোনা গেল। মনে হল সব ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবক অবাক হয়ে একটা নিশ্বাস ফেলেছে। রূপা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

মিম্মি বলল, “নিশ্চয়ই কেউ স্টেজ থেকে আছাড় খেয়ে পড়ে গেছে!”

কে আছাড় খেয়ে পড়েছে সেটা দেখার জন্যে তারা তিনজন তখন হলঘরের একটা দরজা দিয়ে উঁকি দিল। মঞ্চে ডায়াসের সামনে বিচারকদের মাঝে বয়স্ক মানুষটি ডায়াসের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। রূপা শুনল মানুষটি বলছেন, “আমি জানি তোমাদের মনে হতে পারে একটা কাগজে দুই লাইন কথা লিখে একটা টিম কেমন করে সায়েন্স ফেয়ারে ফাস্ট প্রাইজ পেতে পারে! কিন্তু তোমরা বিশ্বাস কর এই দুটি লাইন কিন্তু অসাধারণ একটা আইডিয়া। এটা বাস্তবে করা সম্ভব এবং দেশের কোটি কোটি টাকার জ্বালানি বাঁচানো সম্ভব। ছোট মেয়েটি প্রায় নিখুঁতভাবে হিসাব করে আমাকে এটা দেখিয়েছে এবং আমি এনজিও ফোরামে গিয়ে বলব তারা যেন গ্রামে গ্রামে এই আইডিয়াটা ছড়িয়ে দেয়–

ভদ্রলোক একটু থামতেই হঠাৎ করে হাততালি শুরু হয়ে গেল। হাততালি থামার পর বয়স্ক মানুষটি বললেন, “টিম মিরূসোরাস, তোমরা মঞ্চে এসে তোমাদের প্রথম পুরস্কার নিয়ে যাও।”

সঞ্জয় তখন প্রথমবার বুঝতে পারল তারা পুরস্কার পেয়েছে। তখন সে একটা গগনবিদারী চিৎকার দিল, তারপর স্টেজের দিকে ছুটতে লাগল। দর্শকদের ভেতর থেকে রাজু ছুটে এলো, বারান্দা থেকে মিম্মি এবং সবার শেষে রূপা। প্রধান অতিথি তাদের গলায় মেডেল ঝুলিয়ে দিলেন এবং তখন হঠাৎ রূপা আবিষ্কার করল আম্মু তার জায়গা থেকে উঠে ছুটতে ছুটতে স্টেজের সামনে চলে এসেছেন, হাতে তার মোবাইল ফোন যেটা দিয়ে ছবি তোলা যায়। আম্মুর ছবি তুলতে অনেক সময় লাগল, যতক্ষণ ছবি তোলা শেষ না হল প্রধান অতিথি ততক্ষণ মেডেলটা রূপার গলায় ঝোলানোর ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

ছবি ভোলা শেষ হবার পর আম্মু রূপার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেললেন আর রূপা হঠাৎ করে আবিষ্কার করল, আম্মুর চেহারা খুব সুন্দর, হাসলে আম্মুকে কী সুন্দরই না দেখায়।

.

১৬.

দরজায় শব্দ শুনে রূপা গিয়ে দরজা খুলে দিল। মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে টিশটাশ একজন সুন্দরী মহিলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রূপা মহিলাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল তখন টিশটাশ সুন্দরী মহিলাটি হি হি করে হেসে ফেলল। বলল, “রূপ-রূপালী, আমাকে চিন না?”

রূপা তখন অবাক হয়ে চিৎকার করে বলল, “সুলতানা! তুমি?”

“হ্যাঁ, আমি! কী হল? আমারে ঢুকতে দিবা না?”

“তোমাকে কী সুন্দর লাগছে সুলতানা! আমি চিনতেই পারিনি!”

সুলতানা তার সেই ময়লা কামিজ পরেনি। সে সুন্দর একটা সুতির শাড়ি পরেছে। মাথার চুলগুলো তেল চিটচিটে হয়ে নেতিয়ে নেই। সুন্দর হয়ে ফুলে আছে। কপালে টিপ আর ঠোঁটে খুব হালকা লিপস্টিক। কাঁধ থেকে একটা আধুনিক হ্যান্ডব্যাগ ঝুলছে। দুই হাতে কাঁচের চুড়ি, গলায় সরু একটা নেকলেস। সুলতানাকে মনে হয় কোনোদিন রূপা ভালো করে দেখেনি। সে যে এত সুন্দর সে কখনো কল্পনা করেনি। শুধু যে দেখতে সুন্দর হয়েছে তা না, কথাও বলে সুন্দর করে। এই প্রথমবার রূফ-রূফালী না বলে রূপ-রূপালী বলছে! রূপা গিয়ে সুলতানাকে জড়িয়ে ধরল, বলল, “তুমি আমাদেরকে ভুলেই গেছ।”

সুলতানা বলল, “না ভুলি নাই। রূপ-রূপালী আমি তোমাকে একটুও ভুলি নাই। খালাম্মা কই?”

“ভেতরে।”

“আমার উপরে অনেক রাগ?”

রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”

“দেখি রাগ ভাঙানো যায় কী না” বলে সুলতানা বাসার ভেতরে ঢুকল।

রূপা যে রকম প্রথমে সুলতানাকে চিনতে পারেনি আম্মুও ঠিক সেরকম সুলতানাকে চিনতে পারলেন না। সুলতানা ডাইনিং টেবিলে মিষ্টির প্যাকেটটা রেখে রান্নাঘরে গিয়ে আম্মুর পায়ে ধরে সালাম করে যখন বলল, “খালাম্মা, আপনার শরীরটা ভালো?” তখন আম্মু সুলতানাকে চিনতে পারলেন। অবাক হয়ে বললেন, “সুলতানা? তুই!”

“জি খালাম্মা। আপনার শরীর ভালো?”

“আর আমার শরীর! আমার শরীর নিয়ে কার ঘুম নষ্ট হয়েছে?”

আম্মু হাতে চাকু নিয়ে পেঁয়াজ কাটছিলেন, রূপা আম্মুর হাত থেকে চাকুটা টেনে নিয়ে বলল, “খালাম্মা আপনি বিশ্রাম নেন। আমি রেন্ধে দেই।”

“তুই বেঁধে দিবি? এই রকম সেজেগুঁজে রাধা যায় না কি?”

“যায় খালাম্মা।” বলে সুলতানা শাড়ির আঁচলটা কোমরে পেঁচিয়ে নিল। মাথার চুলগুলো মাথার উপরে ঝুঁটির মতো করে খোঁপা করে নিল। হাতের চুড়িগুলো টেনে উপরে নিয়ে আটকে দিয়ে দক্ষ হাতে পেঁয়াজ কাটতে লাগল।

আম্মু কী করবেন বুঝতে না পেরে একটা ডেকচি একটু ধুতে যাচ্ছিলেন, সুলতানা হা হা করে উঠল, বলল, “যান খালাম্মা, যান! আপনার ডেকচি ধুতে হবে না।”

আম্মু বললেন, “আমি কি বাসন ধুই না?”

“কিন্তু আমি যতক্ষণ আছি আপনাকে ধুতে হবে না। আমি ধুয়ে দেব। যান আপনি।”

আম্মু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একটা নিশ্বাস ফেললেন, বললেন, “তোর কাজকর্ম তা হলে ভালোই হচ্ছে?”

“এই এক রকম।”

“দেখে তো ভালোই মনে হচ্ছে।”

“ভালো আর কী খালাম্মা। আপনারা আমার জন্যে যেই রকম দোয়া করবেন আমি সেই রকম থাকব।”

সুলতানা পেঁয়াজ কেটে সরিয়ে রেখে আম্মুকে জিজ্ঞেস করল, “কী খাবেন আজকে খালাম্মা? ফ্রিজে মুরগি আছে? আলু দিয়ে রেন্ধে দেই?”

“রাধবি?”

“আপনি যদি বলেন।” সুলতানা চোখ বড় বড় করে বলল, “সাথে ভাত না রেন্ধে একটু পোলাও করে দেব? ছুটির দিনে সবাই খাবেন?”

আম্মু বললেন, “ঠিক আছে। সাথে সবজি–”

সুলতানা বলল, “যান খালাম্মা, আপনি বিশ্রাম নেন, কী রান্ধতে হবে আমার হাতে ছেড়ে দেন। আমি দেখি কী আছে।”

আম্মুকে রান্নাঘর থেকে সরিয়ে দিয়ে সুলতানা রান্না শুরু করে দিল। সুলতানা এসেছে শুনে তিয়াশা আর মিঠুনও রান্নাঘরে তাকে দেখতে এলো। মিঠুন বলল, “সুলতানা আপু তোমাকে দেখে এখন অন্যরকম লাগছে! মনে হচ্ছে তুমি কলেজে পড়!”

সুলতানা হি হি করে হেসে বলল, “তা হলে কী আমি এখন তোমার সাথে ইংরেজিতে কথা বলব? কামিং গোয়িং ইটিশ মিটিশ?”

মিঠুন বলল, “তুমি খুবই ফানি সুলতানা আপু!”

.

যখন রান্নাঘরে কেউ নেই তখন গুটিগুটি পায়ে রূপা সেখানে হাজির হল। রূপাকে দেখে সুলতানা দাঁত বের করে হাসল, গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “রূপ রূপালী, কী মনে হয় খালাম্মার রাগ কি একটু কমেছে?”

রূপা মাথা নাড়ল, “আম্মুর রাগ কমেছে। তুমি এসে যে রান্না শুরু করে দিয়েছ সেই জন্যে আম্মু খুব খুশি। আব্বুকে গিয়ে বলছেন, মেয়েটার আদব কায়দা এখনো আছে।”

সুলতানা মুরগির মাংস কাটতে কাটতে বলল, “এমনিতে বাসার কী অবস্থা?”

“খাওয়া-দাওয়ার অবস্থা খুব খারাপ। তোমার রান্না খেয়ে অভ্যাস–এখন আম্মুর রান্না মুখে দেওয়া যায় না!”

“তোমরা সাহায্য কর না কেন? একা খালাম্মা কত করবে?”

“করি তো।” রূপা সুর পাল্টে বলল, “এখন তোমার কথা বলো। তোমার কাজ কেমন চলছে?”

“কাউরে বলবা না, আমার প্রমোশন হইছে।”

“প্রমোশন! এই তো মাত্র সেইদিন জয়েন করেছ। এর মাঝে প্রমোশন?”

“আসলে একটা কারণ আছে। কয়দিন আগে ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগেছিল সবগুলো মেয়ে ভয় পেয়ে চিৎকার করে ছোটাছুটি শুরু করেছে। ছোট একটা সিঁড়ি দিয়ে একসাথে সবগুলো দৌড় দিচ্ছে। আরেকটু হলে পায়ের চাপা খেয়ে কমপক্ষে দশজন মারা পড়ত। আমি তখন সবগুলোরে শান্ত করালাম, লাইন ধরে একজন একজন করে নামালাম। দেয়ালে আগুন নিভানোর একটি যন্ত্র ছিল সেইটা দিয়ে আগুন নিভায়া দিলাম।”

“সত্যি? সুলতানা, তুমি হচ্ছ সুপার গার্ল!”

“ফ্যাক্টরির ম্যানেজার সেই জন্যে খুবই খুশি। আমারে দশ হাজার টাকা বোনাস দিছে!”

“দ—শ—হা—জা–র! তুমি তো বড়লোক।”

“আমি আসলেই বড়লোক, তোমার টাকা লাগলে বলো!” সুলতানা হি হি করে হাসে।

“বলব। তারপর কী হল বলো। তোমার প্রমোশন কেমন করে হল সেটা বলো।”

সুলতানা মুরগির মাংসগুলো একটা ডেকচিতে নিয়ে ধুতে ধুতে বলল, “তারপর তারা একটা তদন্ত করার সময় সবার সাথে কথা বলেছে। আমার সাথেও কথা বলেছে। তারপর ম্যানেজার একদিন আমারে ডেকে বলে, সুলতানা, তোমার ভেতরে কী যেন কী যেন আছে-”

রূপা জিজ্ঞেস করল, “কী যেন কী যেন মানে?”

“ইংরেজিতে বলেছে তো, তাই মনে নাই। কথাটার বাংলা হল নেতা নেতা ভাব-”

“ও আচ্ছা বুঝেছি। লিডারশীপ কোয়ালিটি”

সুলতানা বলল, “হ্যাঁ। এই কথাটাই বলেছে। বলেছে তুমি শিফটে কাজ করে কী করবে, তোমাকে ম্যানেজারের দায়িত্ব দেই! শুনে আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। বলে কী পাগলে! আমি বললাম আমি লেখাপড়া জানি না মুখ সুখ মানুষ আমি এই সব পারব না। তারা বলে তুমি পারবে। তোমারে ট্রেনিং দেব!”

রূপা হাতে কিল দিয়ে বলল, “কী মজা!”

“মজা না কচু। একসাথে সবাই যোগ দিছি এখন আমারে বানাইছে লিডার–সবগুলো আমার দিকে চোখ বাঁকা করে তাকায়। অনেক কষ্ট করে তাদের সাথে মিলেমিশে আছি। আস্তে আস্তে শেষ পর্যন্ত সবগুলো মনে হয় আমারে আবার বিশ্বাস করা শুরু করছে।”

“কী সাংঘাতিক সুলতানা। তুমি আসলেই সুপার গার্ল।”

সুলতানা হঠাৎ ডেকচিটা নিচে রেখে রূপাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “সব তোমার জন্যে রূপ-রূপালী! তুমি ছিলে বলে আমি টিকে গেছি। তুমি না থাকলে আজকে আমি কোথায় থাকতাম কে জানে।”

.

খাবার টেবিলে অনেকদিন পর সবাই আগের মতো খেতে বসেছে আর সুলতানা টেবিলে খাবার এনে দিচ্ছে। একটা খুব বড় পার্থক্য অবশ্যি আছে এই সুলতানা আগের সুলতানা না। ময়লা কাপড় পরা ভীত দুর্বল কাজের মেয়ের বদলে সে এখন ফুটফুটে সুন্দর হাসিখুশি আত্মবিশ্বাসী একজন তরুণী। টেবিলে খাবার দিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, “রান্না কেমন হয়েছে খালাম্মা?”

আম্মু মুখে দিয়ে বললেন, “ভালো।”

মিঠুন বলল, “ফার্স্ট ক্লাশ!”

আব্বু বললেন, “তুমি খাবে না?”

“জি খাব। সব শেষ করে খাব।”

হঠাৎ করে আম্মু বললেন, “সুলতানা তুইও বসে যা আমাদের সাথে।”

সুলতানা বলল, “আমি পরে খাই খালাম্মা। আপনারা খান। আমি খাওয়াই।”

“খাওয়ানোর কী আছে। আমরা নিজেরা নিয়ে নেব। তুই বস। এই চেয়ারটা খালি আছে।”

সুলতানা বলল, “থাক খালাম্মা।”

আব্বু বললেন, “বসে যাও।”

রূপা বলল, “প্লী-ই-জ!”

সুলতানা তখন খালি চেয়ারটাতে বসল। সে খুব বেশি খেল না–একটু পরে পরে রান্নাঘরে উঠে গেল খাবার আনতে। কেউ দেখল না রান্নাঘরে গিয়ে আসলে সে তার চোখ দুটো মুছে আসছিল।

.

রাতেরবেলা আম্মু বাসন ধুচ্ছিলেন, রূপা রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, “আম্মু।”

“কী হল?”

“একটা কথা বলি?”

“বল।”

“তোমাকে থ্যাংকু আম্মু।” রূপা কোনোদিন তার আম্মুর সাথে এভাবে কথা বলেনি, কোনোদিন বলবে সে চিন্তাও করেনি।

আম্মু সরু চোখে তাকিয়ে বললেন, “কেন?”

“তুমি আজকে সুলতানাকে আমাদের সাথে একসাথে বসে খেতে বলেছ সে জন্যে।”

আম্মু বললেন, “লাভ কী হল, কিছুই তো খেতে পারল না। কাঠ হয়ে বসে থাকল।”

“খাওয়াটা তো বড় কথা ছিল না আম্মু। সম্মান দেওয়াটা বড় ছিল। থ্যাংকু আম্মু।”

“আমাকে থ্যাংকু দিতে হবে না। যা।”

রূপা চলে গেল না, এসে পিছন থেকে তার আম্মুকে জড়িয়ে ধরল। জীবনের প্রথম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *