১৩-১৪. পউরির পথে

এখন আবার পউরির পথে চলেছে রওনাক সিং-এর গাড়ি। গাড়ির বাইরেও কোনও উত্তেজনা নেই, ভিতরেও নেই, শুধুমাত্র রওনাক-এর কান টানাটানি ছাড়া।

চারণ ভাবছিল, কান ব্যাপারটা সত্যিই বড় অভিশাপের। কান না থাকলে নব্যকালের কত রবীন্দ্রসংগীত গায়ক-গায়িকাদের গান শোনার অত্যাচার থেকেই পার পেতে পারত। সেই সব দোর্দণ্ডপ্রতাপদের নাম না হয় নাই করল।

চন্দ্রবদনী খুব ভাল মেজাজেই আছে।

একটু আগেই ও বলেছে চারণকে, ঈশ্বরের অশেষ দয়া যে, যা ঘটেছিল তার চেয়ে সাম্প্রতিক কিছু ঘটেনি। অথচ ঘটতে পারত। In one piece আপনাকে নিয়ে যে আবার রুদ্রপ্রয়াগের দিকে চলেছি এ কথা ভেবেই আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। রক্ত-টক্ত আমি দেখতে পারি না। দাদুর এক বন্ধু কাব্রাল সাহেব আমাদের গ্রামের উপরে যে মালভূমি আছে সেখানে একটি বড় শম্বর মেরেছিল। তখন আমি আর চুকার দুজনেই ছোট। কী একটা ছুটিতে আমরা ল্যান্সডাউন থেকে রুদ্রপ্রয়াগে এসেছিলাম। ইসস কী রক্ত! কী রক্ত! আমার মনে হয় সে রক্ত দেখার কয়েক বছর পরই দাদু তিব্বতে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম নিয়েছিলেন। কিন্তু চুকারটা ছিল অন্যরকম। রক্ত দেখে ওর উদাস হয়েছিল। তখনই জানতাম ওর মধ্যে একজন খুনে আছে। নিষ্ঠুরতা সুপ্ত আছে, ছাইচাপা আগুনের মতন। হাওয়া পেলেই দপদপিয়ে উঠবে। যারা রক্ত ভালবাসে, তাদের অনেক সময় নিজের বুকের রক্ত দিয়ে সেই ভালবাসা পূরণ করতে হয়।

চারণ বলল, হঠাৎ এই কথা? তারপর বলল, রক্তের মূল্যে ছাড়া কিছু কি কেনা যায় আদৌ? স্থায়ী কিছু?

তা বটে।

গাড়িটা সম্ভবত পউরির কাছাকাছি এসে পড়েছে। চড়া চড়াই উঠছে। গোঁ গোঁ করছে ফাস্ট গিয়ারে ফেলা এঞ্জিন। এরপর উতরাই নেমে পউরিতে পৌঁছবে। নানা কথার মাঝে মাঝেই চারণের বুকটা এ্যাৎ করে উঠছে। তাও তো চুকার শর্মাকে সে চোখেও দেখেনি। তার ছেড়ে যাওয়া জিনিস, ঘর, তার বইপত্র, ঘর ভর্তি তার অদৃশ্য আশা-আকাঙ্ক্ষা, আদর্শ কল্পনা এক রাত তার ঘরে শুয়ে অনুভব করেছে অবশ্যই। সব অনুভবের কথা অন্যকে বলা যায় না।

চন্দ্রবদনী মুখ ফিরিয়ে বসে জানালা দিয়ে চেয়েছিল। গম্ভীর মুখে। কী যেন ভাবছিল। ও কী ভাবছে কে জানে!

চারণ বলল, মন খারাপ লাগছে?

কী করে বুঝলেন?

চোখ দেখে। কিন্তু কেন মন খারাপ লাগছে?

 এমনিই।

এমনিই আবার কারও মন খারাপ হয় না কি?

এমনি মানে, ভাবছিলাম কতগুলো বছর কেটে গেল জীবনের। উত্তরের হাওয়াতে এক এক করে জীবনের পাতাগুলি ঝরে যাচ্ছে। এই ল্যান্সডাউনেই মা ছিলেন। আজ মা নেই। আমার বিয়ের পরে আমরা এখানে এক রাত থেকে গেছিলাম, আমার নববিবাহিত স্বামীকে আমার আর চুকারের শৈশবের দিনগুলোর কথা জানাতে। আজ ও-ও নেই। একদিন হয়তো চুকারও থাকবে না। বাবাও।

তারপরেই বলল, আসলে, কী ভাবছিলাম জানেন?

কি?

মানুষেরা গাছেদের কাছে হেরে যায়, হেরে যাবে চিরদিন।

 মানে?

মানে, মানুষও পর্ণমোচী, অনেক গাছেরাও পর্ণমোচী। অথচ গাছেদের ডালে ডালে পরের বসন্তে আবারও কিশলয় আসে। কিন্তু পর্ণমোচী মানুষের জীবনে পাতা ঝরে গেলে তা ঝরেই যায়। আর কোনওদিনও নবকিশলয়ে সে ভরে ওঠে না। তাই না?

চারণ একটু চুপ করে থেকে বলল, তাইই।

তারপর বলল, আপনার ভারী সুন্দর একটি মন আছে। মনের চোখ দুটি আপনার ভারী সুন্দর। ওরিজিনাল।

মনের চোখ? না, চোখের মন?

হল। অত জানি না আমি।

চারণ প্রসঙ্গ বদলে বলল, চন্দ্রবদনীর চুড়ো দেখিনি তবে কুঞ্জাপুরীর মন্দিরের কুঁবারসিংজী আমাকে অন্য দুটি শৃঙ্গার মধ্যেখানের আড়াল-পড়া একটি জায়গার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেছিলেন ঐ খানে চন্দ্রবদনী। সত্যি কথা বলতে কি, নাম শুনেই প্রেমে পড়ে গেছিলাম।

চন্দ্রবদনী হেসে উঠল জোরে।

রওনাক সিং চমকে উঠে বলল, গাড়ি রোকেগা ক্যা?

হাসতে হাসতেই চন্দ্রবদনী বলল, নেহি, নেহি। চলিয়ে, আগে বাড়িয়ে। চারণের মনে পড়ল যে, ন-মাসীমা বলতেন ওরা বেশি হাসাহাসি করলেই, যত হাসি তত কামা, বলে গেছে রাম শা। বেশি হাসলেই উনি ওদের ঐ প্রবচনটি বলে ভয় দেখাতেন।

এই গাড়োয়াল হিমালয়ের অথবা কুমায়ু হিমালয়েও এক বিশেষ উচ্চতাতে উঠে এলে পরপর পাহাড়ের গায়ের বনে বোধহয় তেমন বৈচিত্র্য আর থাকে না। ওক, মেপল, চেস্টনাট, পাইন, ফার এই সব গাছের বনে এক ধরনের একঘেয়েমি আছে। তবে বৈচিত্র্য আছে গিরিখাদের হরজাই জঙ্গলে। খুব ভাললাগে উঁচুতেও, যখন অর্কিড ফোটে। নানারঙা। বসন্তে। প্রজাপতি ওড়ে। ইউ এস এ, কানাডা বা ইউরোপেও হেমন্তে যখন নানাগাছের পাতাতে নানারঙের ছোঁয়া লাগে হলুদ, বাদামি, খয়েরি, পাটকিলে, কালো, ম্যাজেন্টা, পারপ তখন যে কী অপূর্ব শোভা হয়। সেই শোভার সঙ্গে চারণের নিজের দেশ-এর মার্চ-এপ্রিলের পর্ণমোচী বনেরই শুধু তুলনা চলে। যখন তার স্বদেশের বসন্তবনের কুসুম গাছে নতুন পাতা আসে, তখন যে না চেনে কুসুম গাছ, তার মনে হতেই পারে যে, ফুলেই সেজেছে যেন সে গাছ।

মনটা বড়ই বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে চারণের। চুকারের মৃত্যু সংবাদটা ও না পারছে গিলতে না ফেলতে। অথচ খবরটা চন্দ্রবদনীকে ওর দেওয়াটা অবশ্যই উচিত।

হঠাৎ চন্দ্রবদনী বলল, আপনি কখনও চন্দ্রবদনীতে গেছেন?

চমকে উঠল চারণ। তার ভাবনার জাল ছিঁড়ে গেল। চন্দ্রবদনীর প্রশ্নটা দ্ব্যর্থক মনে করে নিজেই হঠাৎ পুলকিত হল। মনে মনে বলল, যেতে হয়তো চাই, ভীষণই চাই, কতখানি চাই তা এই মুহূর্তের এই প্রশ্নর সম্মুখীন হবার আগে হয়তো বুঝতেও পারেনি। কিন্তু মুখে কিছুই বলল না।

চুপ করে আছেন যে?

 চন্দ্রবদনী বলল।

ইচ্ছে করে না? যেতে?

জানি না।

বলল, চারণ।

কোন চন্দ্রবদনীতে যাবার প্রতি তার অনীহা, সেকথা নিজে না বুঝেই।

এমন সময়ে ট্রাফিক পুলিশের প্রসারিত হাতের সামনে দাঁড়াল রওনাক সিং-এর গাড়ি ঠিক যে জায়গাটিতে ছেলেরা তাদের গতকাল সকালে পথে আটকেছিল, সেই ম্যাল-এই।

পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ হয়ে রয়েছে পুরো পউরি।

কাঁহা যানা?

পুলিশ শুধোল।

রওনাক বলল, জাহান্নাম।

মজাক কর রহা হ্যায় ক্যা?

 কিস লিয়ে? তুম মেরি শ্বশুরালকি আদমী থোড়ি হ্যায়!

 বকোয়াস মত করো। যানা কঁহা?

 ই পাহাড়ি রান্তে কাঁহাপর উতরে হ্যায়?

 শ্রীনগরমে।

তো য়াই যানা।

উসকি বাদ?

শোচা নেই। রাতমে কেয়া খানা হ্যায় উ আভভি আভভি শোচ লিয়া ক্যা তুমনে? পুলিশজি?

 পুলিশকে তাজ্জব বানিয়ে উলটো প্রশ্ন করল রওনাক।

পুলিশ, অজীব রওনাক সিংকে কজা করতে না পেরে বলল, আ রহা কাঁহাসে?

ডান কানটা ডান হাতে দুবার নেড়ে রওনাক সিং বলল, বেহেস্ত সে। কিউ? আপকি কোঈ তকলিফ হ্যায় ক্যা? যানা হ্যায় উহা?

চলো, তুমকো বন্ধ করে গা থানেমে।

পুলিশ বলল, রেগে গিয়ে।

এই শিবঠাকুরের আপন দেশে রামগড়রের সরকারি ছানাদের পক্ষে কোনও অপকর্মই করা অসম্ভব নয় বলেই চারণ তাড়াতাড়ি বলল, আমরা আসছি ল্যান্সডাউন থেকে, যাব শ্রীনগর হয়ে রুদ্রপ্রয়াগ। শ্রীনগরে কি এখনও খুব টেনশান আছে?

টিশান? টিশান তো নেহি হ্যায় কোঈ শ্রীনগরমে। রেলস্টেশন তো আপকি মিলোগি নিজামাবাদ নেহি ত হারদ্বেয়ার যা কর! শ্রীনগর সে বাঁয়া ঘুম কর, হৃষীকেশ পৌঁছনেকে বাদ দেরাদুন ভি চল দেনে শকতা হ্যায়। হঁয়াভি টিশান হ্যায়।

টেনশনকে যে টিশান বলে জানে তার সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে চারণ ডানহাতটি তুলে বলল, সুক্রিয়া।

উত্তরপ্রদেশের সমতলবাসী ফো পুলিশ বলল উম্মার সঙ্গে, আপকি ড্রাইভার সাহাবকি জারা শুধারিয়ে, নেহি তো…

রওনাক তার কানসর্বস্ব সুন্দর মুখটি জানালার মধ্যে দিয়ে গলিয়ে দিয়ে বলল, আররে পুলিশ কি বাচ্চে, তু খুদকে শুধার। ভারী আয়া মাস্টার মেরা! হাঃ!

চারণ রওনাককে ভর্ৎসনা করে বলল, ক্যা হে রহা হ্যায় রওনাক? বাঁতে মত বনাকে, আভি উতরো ধীরে ধীরে পাহাড়কে নীচে। ইয়ে ক্যা মজাককি ওয়াক্ত হ্যায়?

বাঁদিকে বরফ ঢাকা শৃঙ্গগুলো সকালের রোদ পড়ে ঝলমল করছিল। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই রওনাক সিং-এর গাড়ি সেই স্বর্গ থেকে ঝুপ করে নীচে নেমে ডানে একটা বাঁক নেওয়া মাত্রই সেই ইলাস্বর্গ মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। চারণ ভাবছিল এ জীবনে স্বর্গমাত্রই বোধহয় এমনই মিলোয়।

চন্দ্রবদনী হেসে বলল, টিশান আর টেনশন-এ গোল বাঁধিয়ে ট্রাফিক পুলিশটি খুব একটা ভুল করেনি, কারণ প্রতিটি স্টেশনেরই মতো প্রতিটি টেনশানও তত মানুষকে বহুদিকে চারিয়েই দেয়।

প্রতিটি টেনশানই এক একটি স্টেশন বইকী!

তা ঠিক! চারণ বলল।

উত্তরটা কিন্তু দিলেন না আপনি আমার কথার।

 কোন কথার?

চন্দ্রবদনীতে গেছেন কি না?

না। যাইনি।

বলল, চারণ।

তারপর নিরুচ্চারে বলল, তাছাড়া, চন্দ্রবদনীতে যাওয়া কি সোজা কথা? কী করে যেতে হয় তাও ত জানি না ছাই। যাওয়া কি আদৌ যাবে? যে-কোনও তুষারাবৃত গিরিশৃঙ্গকে দূর থেকে দেখেই তার মনে হয় একেকটি মৌন তাপস-তাপসীই যেন তাঁরা। কত হাজার হাজার বছর ধরে কত কথা, কত জ্ঞান, কত স্মৃতি বুকে করে নিথর নির্বাক হয়ে রয়েছেন তাঁরা একেকজন। তাঁদের মাথায় চড়তে চাওয়াটা শুধু আস্পর্ধার ব্যাপারই না, কুরুচিকরও হয়তো বা। তবে তীর্থযাত্রীরা তো কোনও শৃঙ্গেরই মাথায় চড়তে যান না। তাঁরা শৃঙ্গের পাদদেশের কোনও না কোনও মন্দিরেই যান। তাঁরা যখন মন্দিরের মধ্যের অন্ধকারের মধ্যে ঢুকে প্রদীপ-জ্বলা ফুল-গন্ধী, ধূপ-গন্ধী ঘরে তাঁদের আরাধ্য দেবতাকে খোঁজেন তখন আসল দেবতা গিরিশৃঙ্গর উপর থেকে অথবা নীলাকাশের নীলিমাতে লীন হয়ে থেকে পুণ্যার্থীদের দিকে তাকিয়ে নীরবে হাসেন। আশীবাদও হয়তো করেন।

যদি যেতে চান তো পথ বলে দিতে পারি। চন্দ্রবদনী বলল।

 কীভাবে যেতে হয়?

দেবপ্রয়াগে তো আপনি ছিলেনই। সেখান থেকেই যেতে হয়।

তাই? আশ্চর্য! পাটন তো একবারও বলল না কিছু। দেবদেবীতে কোনও ভক্তিশ্রদ্ধাই নেই ওর। শুধু রক্তমাংসর চন্দ্রবদনীর কথাই সে জানিয়েছিল আমাকে।

পাটন তো পুণ্য বা ভক্তি অর্জন করতে দেবপ্রয়াগে ছিল না।

 তো কি করতে?

 তা ওই জানে। অদ্ভুত এক ছেলে সে। নইলে চুকারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়।

বলুন না কী করে যেতে হয়?

দেবপ্রয়াগ থেকেই চন্দ্রবদনীর বাস ছাড়ে।

তাই?

হ্যাঁ।

বাসে যেতে হয় কুড়ি কিমি মতো। তারপর আরও সাত-আট কিমি যেতে হয় হেঁটে। অথবা জিপেও। সিজন এর সময়ে জিপ পাওয়া যায় বাসস্ট্যান্ডে।

শেষ দেড় কিমি পথ যেতে হয় পায়ে হেঁটেই। তবে বাস তো নিয়মিত বা সময়মতন যায়, এমন নয়। দেবপ্রয়াগ থেকেই জিপ ভাড়া করে যাওয়াটাই ভাল।

কোন দিকে যেতে হয়?

ভাগীরথীর উপরে যে ব্রিজ আছে দেবপ্রয়াগে, তা পেরিয়ে কিছুটা শ্রীনগরের দিকে গিয়ে বাঁদিকে পথ উঠে গেছে খাড়া পাহাড়ে। মহড় নামের একটা ছোট গ্রাম ও হিন্দোলখাল নামের একটি বড় গ্রাম পেরিয়ে গিয়ে যে গ্রামে পৌঁছতে হয় সেই গ্রামটির নামও চন্দ্রবদনী।

বলেন কি? চন্দ্রবদনী নামের গ্রামও আছে? বাঃ। মনটা ভাল হয়ে গেল।

 কেন? মন ভাল হল কেন?

আপনাকে তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গর সঙ্গে এতদিন একাত্ম করে রেখেছিলাম। ওইসব গিরিশৃঙ্গে আমার মতন পঙ্গুর তো কোনওদিনও ওঠা হত না। এখন গ্রামও আছে ওই নামে শুনে, চেষ্টা করতে হবে আপনার কাছে পৌঁছনোর। পৌঁছলেও হয়তো পৌঁছনো যেতে পারে।

ওই গ্রাম থেকেই উপরে হেঁটে উঠতে হয়। মানে, মন্দিরে।

কোন দেবীর মূর্তি আছে চন্দ্রবদনীর মন্দিরে?

 কেন? দুর্গার। চন্দ্রবদনী আর দুর্গা তো একই।

তাই বলুন। এতদিনে আপনার মাহাত্ম্যটা বোঝা গেল।

দেবদেবীকে মানুন আর নাই মানুন, ঠাট্টা করতে নেই কখনও।

তাই?

হ্যাঁ। তবে সিংহবাহিনী দুর্গা ছাড়াও আরও দেব-দেবীর মূর্তি আছে মন্দিরের গায়ের নানা অলিন্দে।

কার কার?

গণেশ, হনুমান, হরপার্বতী এবং কালীর মূর্তি আছে। আসল আরাধ্য স্থানে কোনও মূর্তি নেই। সেখানে পৌঁছতে হয় একটি অপরিসর দরজা দিয়ে গিয়ে। সেখানেই মায়ের শিলাপিঠ আছে। অনেকে বলেন, চন্দ্রবদনী বাহান্ন পীঠের এক পীঠ। সতীর শরীরের গোপনাঙ্গর অংশ নাকি পড়েছিল এখানে, কামাখ্যারই মতন।

তাই?

কুঞ্জাপুরী কুঁয়ারসিংহী বলছিলেন যে স্তন পড়েছিল।

হতেও পারে।

শুনেছি। আমার মায়ের খুব প্রিয় জায়গা ছিল এই চন্দ্রবদনী। প্রতি বছরেই আসতেন একাধিকবার বিয়ের পর থেকেই। এই নামটিও মায়ের খুব পছন্দ ছিল। তাই কনসিভ করার সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করেন যে, মেয়ে হলে তার নাম রাখবেন চন্দ্রবদনী।

নামটা আমারও খুব পছন্দ।

চারণ বলল।

আর নামের মালিককে?

 সেটা এখন নাই বা বললাম।

 চন্দ্রবদনী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কে?

শুনেছি, কুঞ্জাপুরীর মন্দিরেরই মতন তেহরির রাজারাই এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করছিলেন। আগে এখানে নরবলিও হত নাকি। তবে এ বছরও গিয়ে দেখেছি, কুঞ্জাপুরীরই মতন সংস্কারের নামে মোজাক মার্বেল লাগিয়ে শ্রীবিঘ্নিত করার ষড়যন্ত্র করেছেন পুরোহিতেরা।

এই আমাদের এক দোষ। কী বনবাংলো, কী মন্দির, প্রকৃতির মধ্যে যা কিছুই ছিল না বা করা হয়েছিল অনেকদিন আগে, তার সংস্কারের নামে এমন কুরুচিকর সব সংযোজন হয় যা প্রকৃতির সঙ্গে এবং মূল স্থাপত্যর সঙ্গে একেবারেই বেমানান। প্রাচীনত্ব আর আভিজাত্য যে সমার্থক সে কথা বুঝতে বুঝতেই আমাদের জীবন শেষ হয়ে যায়।

ঠিক তাই। বলল চন্দ্রবদনী।

পাহাড় থেকে নামার সময়ে পায়ে হেঁটে নামলে কষ্ট হয় হয়তো ওঠার চেয়েও বেশি। কিন্তু গাড়িতে নামলে তরতর করে নামা যায়। কষ্ট তো হয়ই না। সময়ও কম লাগে।

রওনাক সিং-এর পক্ষিরাজ শ্রীনগরের উপত্যকার দিকে গড়িয়ে চলল প্রতি বাঁকেই হর্ন দিতে দিতে। গড়িয়ে চলল মানে, গিয়ার নিউট্রাল করে নয়, গাড়ি গিয়ারে দিয়েই। নামার সময়ে যে সব নভিস পেট্রল বাঁচাবার জন্য গাড়ি নিউট্রালে ফেলে নামেন তাঁদের পেট্রল হয়তো বাঁচে কিন্তু প্রাণ সম্ভবত বাঁচে না।

দেখতে দেখতে অনেকই নীচে নেমে এল ওরা। তারপর চীর আর পাইনের গন্ধমাখা আলোছায়ার সুগন্ধি পথ পেছনে ফেলে রেখে এসে পড়ল শ্রীনগরের উপত্যকাতে। এখানে অলকানন্দার দৃশার কোনও তুলনা নেই। গেরুয়া, পাটকিলে, কমলা এবং সাদা রঙা বালি, নানা প্যাস্টেল শেডস এর নুড়ি, আর নীল সবুজ এবং সাদা জল। নদীর উপরে পর্বতরাজির গায়ে সবুজ ফ্রেমে বাঁধানো ঘন নীল আকাশ।

হঠাই নদীর দিকে তাকিয়েই যেন স্তব্ধ হয়ে গেল চন্দ্রবদনী। এক মুহূর্তের জন্য। তারপরই সেদিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে গাড়ির ভিতরে করল। গাড়িটা শ্রীনগরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাতে ঢুকতেই চন্দ্রবদনী রওনাককে বলল, গাড়ি জারা রুকিয়ে তো!

গাড়ি দাঁড়ালে, অলম্ব পথের বাঁদিকে একটি প্রাচীন গাছের নীচের সামোসা-জিলিপির দোকানের সামনের বেঞ্চে বসে থাকা এক যুবককে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকল।

যুবক সম্ভবত দোকানের মালিক।

 গরম হবে কি?

স্বগতোক্তি করল, চারণ।

কী?

চন্দ্রবদনী জিজ্ঞেস করল।

ওই সামোসা আর জিলিবি?

 ইতিমধ্যে হাতছানি দিয়ে ডাকা সেই গাড়োয়ালি ছেলেটি এসে গাড়ির জানলাতে দাঁড়াল।

 চন্দ্রবদনী যুবককে কিছু বলল, গাড়োয়ালিতে।

চন্দ্রবদনী ইশারাতে তাকে গাড়ির সামনের সিটে উঠে বসতে বলল। সপ্রতিভ যুবকটি গাড়ির সামনের দরজা খুলে উঠে বসল সঙ্গে সঙ্গে। তার মাথায় গাড়োয়ালি টুপি। মুখে বুদ্ধির প্রসাধন। পরনে, ফেডেড জিনস।

রওনাক, গাড়ি স্টার্ট করে একটু এগোতেই যুবক বাঁ হাত জানালা দিয়ে বের করে রওনাককে লক্ষ করে বলল, বাঁয়া! বাঁয়া! লেফট।

রওনাক গাড়ির স্টিয়ারিং বাঁয়ে ঘোরাল। ছেলেটাকে গাড়োয়ালিতে যা বলল চন্দ্রবদনী তার মধ্যে চুকার শব্দটি ছিল। সেই নামটি কানে যাওয়া মাত্রই চারণের মনে এক ভয়মিশ্রিতকৌতূহল জাগল।

ছেলেটির নির্দেশে রওনাক, গাড়িটি অলকানন্দার ধারের একটি জায়গাতে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল। তারপর ছেলেটিরই নির্দেশে এঞ্জিন বন্ধ করল। গাড়ি থামলে, ছেলেটি দরজা খুলে নামল। বাঁদিকে বসেছিল চন্দ্রবদনী। বাঁদিকের দরজা খুলে চন্দ্রবদনীকে নামতে সাহায্য করল সেই যুবক। ভারী ভদ্র ও শিক্ষিত ছেলে। তার মুখশ্রী এবং ব্যবহারই বলে দেয়।

চারণ, তার কি করা উচিত তা বুঝতে না পেরে ডানদিকের দরজা খুলে গাড়ি থেকে নামল। নদীর জলের পাশে কতগুলো ল্যানটানা ঝোঁপ। তার পাশে একার ঘন সবুজ পাতায়-মোড়া গাছ। দার্জিলিং-হিমালয়ে যে গাছকে বলে ধূপী। এই অঞ্চলে এদের কি নাম কে জানে। তাছাড়া, সে গাছ কি এই অল্প উচ্চতাতে হয়? ভাবছিল চারণ।

চন্দ্রবদনী সেই ছেলেটার সঙ্গে নীচে নেমে জলের দিকে এগিয়ে চলল বাধোবাধো পায়ে।

রওনাক সিং গাড়িতে বসেই কান টানাটানি করছিল। স্টিয়ারিং ছাড়লেই ওর হোল-টাইম অকুপেশান হয় কান। স্টিয়ারিং বাঁহাতে ধরেও অনেক সময় ডানহাতে টানাটানি করে। চারণের কান দেখেই মনে হচ্ছে এটা ওর কোনও অসুখ নয়। হয় মুদ্রাদোষ, নয় অবসেশান। ওই এক নিরন্তর খেলায় পেয়েছে যেন তাকে। কোনও মধ্যান্তর পর্যন্ত নেই। কিন্তু চন্দ্রবদনীর হাবভাব দেখে সেই কানধারীও দরজা খুলে নেমে পড়ে চারণের পাশে পাশে চলতে লাগল।

ছেলেটা চন্দ্রবদনীকে একেবারে জলের পাশে নিয়ে গেল। গিয়ে, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ওই যে! ওইখানে!

নদী সেখানে একটি বাঁক নেবার আগে থমকে গিয়ে একটি উপলবিছানো ব্যাকওয়াটারের সৃষ্টি করেছে। বড় বড় প্রস্তরখণ্ডে জায়গাটা আকীর্ণ। সেই পাথরের উপরে কোথাও কোথাও রক্তের দাগ লেগে আছে। রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে। আঙুল দিয়ে দেখাল ছেলেটি। আর তা দেখামাত্রই চন্দ্রবদনী একটি পাথরের উপরে বসে পড়ে মুখ নিচু করে দুহাতে মুখ ঢাকল। ঢেকেই, হঠাৎই অসংযতভাবে ডুকরে কেঁদে উঠল। কিন্তু চাপা কান্না। এবং ক্ষণিকের জন্য। তার বুক যে ভেঙে যাচ্ছিল তা ওরা তিনজনেই বুঝতে পারছিল। কিন্তু অনাত্মীয় যুবতীর গায়ে হাত দিয়ে, তাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে, কোলে বসিয়ে সান্ত্বনা দেবার যে কোনওই উপায় নেই অনাত্মীয় পুরুষের! অথচ চারণের খুবই ইচ্ছে করছিল যে, চন্দ্রবদনীকে বুকের মধ্যে নিয়ে তার সব শোককে মুছে দেয়, শুষে নেয়।

ভালবাসার জনের দুঃখে, যে, ভালবাসে, তার বুক তো ভেঙে যায়ই! ভালবাসার জনকে কাঁদতে দেখে কত মানুষে যে অন্যকে খুন করে, দুর্বল একা হাতে সবলের সঙ্গে লড়তে গিয়ে প্রাণ হারায়, শতাব্দীর পর শতাব্দী এই ক্ষণিক দৃশ্য যে কত মারাত্মক ও দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষরা যুদ্ধের কারণ হয়েছে তা কজনে জানে?

কিন্তু চন্দ্রবদনী?…ও কি জানত?…

রওনাক সিংও অবাক হয়ে চারণের দিকে চাইল। চারণও অবাক হয়ে তাকাতে লাগল একবার রওনাক-এর মুখের দিকে আর একবার চন্দ্রবদনীর মুখের দিকে।

একটা মাছরাঙা নীল-হলুদ পাখি অনেক দূরের ওপার থেকে চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে উডে এল ওদের দিকে। তার ডানা দুটো এতই জোরে সে নাড়ছিল, মনে হচ্ছিল যে, কোনও একটি গোলাকার রঙিন উড়ন্ত জিনিস ধেয়ে আসছে ওদের দিকে। পাখিটা চন্দ্রবদনীর থেকে হাত পাঁচেক দূরে থাকতে থাকতেই হঠাৎই দিক পরিবর্তন করে রুদ্রপ্রয়াগের দিকে মুখ ঘুরোল।

রওনাক সেই গাড়োয়ালি ছেলেটিকে অনেকটা দূরে ডেকে নিয়ে গিয়ে, তাকে ফিসফিস করে জিজ্যেস করল, কী ব্যাপার?

চারণও পায়ে পায়ে এগিয়ে সেখানে গিয়ে পৌঁছল।

ছেলেটা হিন্দিতে বলল, এইখানেই চুকার শর্মা আর সতীশ সিং-এর ডেডবডি ভেসে এসে আটকেছিল। ছেলেরা যখন বডি তোলে তখন তাদের শরীরের বিভিন্ন ক্ষতস্থানে রক্তস্রোত আর ছিল না বটে, ধুয়ে গিয়েছিল সারা রাত হিম-নদীতে পড়ে থেকে। কিন্তু মুখ দিয়ে ঝলক ঝলক রক্ত বেরিয়েছিল। বডি নাড়াচাড়া হতেই।

ডেডবডি এখন কোথায়?

পোস্টমর্টেম হওয়ার জন্য লাশকাটা ঘরে গেছিল।

মারা তো গেছে পরশুদিন।

 রওনাক বলল।

তাতে কি? অজীব দেশে অজীব নিয়ম। এই দেশের নাম ভারত। এই দেশ আমাদের গর্ব যেমন, তেমন লজ্জাও।

তারপর বলল, ছেলেরা মৃতদেহ শোভাযাত্রা করে শহর প্রদক্ষিণ করিয়ে নিয়ে এসে নদীপারে দাহ করতে চেয়েছিল কিন্তু পুলিশ অনুমতি দেয়নি। পুলিশ বলেছিল, আত্মীয়রা এলে, বডি আইডেনটিফাই করলে, তারপরই পুলিশের হেপাজতে নদীপারে দাহ হবে।

তারপর?

আত্মীয়রাও থাকেন একজনের রুদ্রপ্রয়াগে আর অন্য জনের চামৌলিতে। তাঁরা নাকি পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছেন যে ওই বীভৎস ফোলা-গলা মৃতদেহ তাঁরা দেখতে চান না। তাছাড়া, ওরা দুজন ওদের পরিবারের বা আত্মীয়দের যতখানি তার চেয়ে অনেকই বেশি ওই ছেলেদের, যারা উত্তরাখণ্ড-এর জন্য আন্দোলন করছে। যাদের কারণে, যাদের দাবিতে ভর করে ওরা প্রাণ দিয়েছে। ওরাই ওদের আসল আত্মীয়। রক্তের আত্মীয়তার দাবি ওরা তুলে নিয়েছেন।

আপনাকে এসব কে বলল? চন্দ্রবদনী জিজ্যেস করল।

ওই চায়ের দোকানটিতে ছেলে-ছোকরাদের আড্ডা। ওইখানেই বিপ্লবের বীজ বোনা হয়, ওইখান থেকেই ফসল ভোলা হয়। আমি দোকানে বসে বসেই সব শুনেছি।

আপনি কি দোকানের মালিক?

না আমি আমার মালিক।

 ডেডবডি তাহলে এখন কোথায়?

কাল রাতে দাহ হয়েছে অলকানন্দার পারে।

কী লোক! কী লোক! সারা শহর ভেঙে পড়েছিল। এমনিতে তো বনধ ছিলই। শোভাযাত্রা করতে দেয়নি বটে পুলিশ কিন্তু শোভাযাত্রার বাবা হয়েছিল ওই অন্ত্যেষ্টি।

আত্মীয়দের আইডেন্টিফিকেশন ছাড়া অন্ত্যেষ্টি হল কি করে?

তাদের কাছ থেকে পুলিশ চিঠি নিয়ে এসেছিল। দুজনের আত্মীয়দেরই কাছ থেকে। রুদ্রপ্রয়াগ এবং চামৌলি থেকে।

সিচুয়েশন খুব টেন্স হয়ে গেছিল?

হয়নি? পুলিশ চৌকি তো জ্বালিয়েই দিয়েছিল ছেলেরা!

তারপর?

তারপর মিলিটারি এসেছিল উপর থেকে নেমে। তবে ততক্ষণে ছেলেদের রাগ গাড়োয়ালের প্রশাসনের মাথা এবং স্থানীয় এম এল এ-দের মধ্যস্থতাতে অনেকখানি প্রশমিত হয়েছিল। তাদের বলা হয়েছিল যে, এই ত্যাগ বৃথা হবে না। তেমন বড় কিছু পেতে হলে তার দামও বেশি পড়েই। কেন্দ্রীয় সরকার নাকি কথা দিয়েছেন ছাত্র নেতাদের সঙ্গে দেখাও করবেন। এবং আলাদা রাজ্যের দাবি মেনে নেবেন।

ওরা সকলে গিয়ে গাড়িতে বসলে, চন্দ্রবদনী তখন রওনাককে বলল, গাড়ি ঘুমাকে ইনকো পহিলো উতারনা।

যুবকটি গাড়িতে উঠে বসে বলল, আপকি কোই রিস্তা হ্যায় ক্যা? উনদোনোসে?

 রিস্তাতে হর ইনসানকি সাথ হর ইনসানকি হোতাই হ্যায়। ইনসানিয়াত কি রিস্তা।

বলেই, চুপ করে গেল চন্দ্রবদনী।

চুকারকে তো চোখে দেখেনি চারণ কিন্তু তার দিদিকে দেখেছে। বয়সে তরুণী হলেও এক আশ্চর্য সুন্দরী এবং সম্ভ্রান্ত মহিলা, সম্ৰান্ততার সংজ্ঞাই যেন!

চুকারদেরই মতন আদর্শবাদী, সৎ, সাহসী, অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী অনন্য যুবকের প্রয়োজন আজকে আমাদের এই হতভাগী রাজনীতিক নামক একদল ঘৃণ্য পেয়ে জানোয়ারদের দ্বারা ধর্ষিত এই সুন্দর দেশে। চুকারদের মতো অনেক তরুণদের দেখেই সম্ভবত আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে একজন সৎ এবং নিজস্বার্থহীন ভারতপ্রেমী জিম করবেট MAN EATING LEOPARD OF RUDRAPRAYAG বইটির শেষ প্যারাগ্রাফে লিখেছিলেন :

A typical son of Garhwal of that simple and hardy hill-folk; and of that greater India, whose sons only those few who live among them are privileged to know. It is these big-hearted sons of the soil, no matter what their caste or creed, who will one day weld the contending factors into a composite whole, and make India a great nation.

চারণের দুচোখ জ্বালা করে উঠল। সে নিরুচ্চারে বলল, কবে? কবে সত্যি হবে এই ভবিষ্যদ্বাণী করবেট সাহেব? কবে?

চারণ স্তম্ভিত ছিল। তাই নতুন করে স্তম্ভিত হবার কিছু ছিল না। বুঝল যে, চন্দ্রবদনী চুকারের মৃত্যুর খবর সম্ভবত কাল রাতে বা আজ সকালেই পেয়েছিল। যখন ওকে টুরিস্ট লজ-এর অফিস ঘরের থেকে বেরোতে দেখেছিল সম্ভবত তখনই কেউ ফোনে তাকে খবরটা দিয়েছিল। তার বাবা বা তার দাদু অথবা চুকারদেরই কেউ। পাটনও হতে পারে। আশ্চর্য! এইরকম মানসিকতার কোনও মানুষ বা মানুষীর সংস্পর্শে এর আগে আর কখনওই আসেনি চারণ। ওর মনে পড়ে গেল, কোথায় যেন পড়েছিল যে, রবীন্দ্রনাথ নাকি জোড়াসাঁকোয় এক সাহিত্যসংক্রান্ত ছোট সভা ডেকেছিলেন। কয়েকজন মিলে সেই সভার কাজ করতেন। তাঁর এক কন্যা অত্যন্ত অসুস্থ ছিলেন। সেই সভাচলাকালীন একদিন সভার কাজ কিছুদুর এগোনোর পরে সভাস্থ একজন প্রশ্ন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে, আপনার কন্যা আজ কেমন আছে?

রবীন্দ্রনাথ নাকি, সভার কাজে নিমগ্ন নিরুত্তাপ গলাতে চোখ না তুলেই বলেছিলেন যে, সে আজ সকালেই চলে গেল।

এই ঘটনার কথা পড়ে চারণ স্তম্ভিত হয়েছিল। শোকের কদর্য বিস্তৃত বহিঃপ্রকাশ ও যেমন দেখেছে নগরে-গ্রামে অনেকই মৃত্যুতে তেমনই অনেক ব্রাহ্ম এবং ক্রিশ্চান বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে দেখেছে আশ্চর্য এক সমাহিত ভাব। কিন্তু এও ঠিক যে, প্রক্ষোভের এমন সুন্দর প্রক্ষেপন নিজের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কমই দেখেছে।

চন্দ্রবদনী আজ সাদা সালোয়ার কামিজ পরেছে। গরম সার্জ-এর। সকালে ল্যান্সডাউন থেকে বেরোবার আগে তেমন করে লক্ষ করেনি চারণ তার পোশাক। গলায় মালা পরেনি আজ, হাতে চুড়িও পরেনি। দুল পরেনি কানে। লিপস্টিকও মাখেনি। কাল মেখেছিল, হালকা। নাও মাখতে পারে। লক্ষ করেনি তেমন করে চারণ। মেয়েদের ঠোঁটের দিকে বেশি মনোযোগের সঙ্গে তাকালে চুমু খেতে ইচ্ছে যায় ঠোঁটে। তাই, তাকায় না। এখন বুঝতে পারছে যে, সকাল থেকেই চন্দ্রবদনী চুকারের জন্যে শোক পালন করছে। সে যাই হোক, চন্দ্রবদনীর পাশে, গাড়ির পেছনের সিট-এ বসে চারণের ভয় ভয় করতে লাগল। চন্দ্রবদনী কি মানবী নয়? সে কি সত্যিই দেবী টেবী? নিজের উপরে এরকম সংযমের কোনও উদাহরণ আর তো আগে দেখেনি কখনওই!

মৃত্যুর বিষয়ে, শোকের বিষয়ে কত বড় বড় মানুষের কত কথাই তো পড়েছে চারণ এ পর্যন্ত কিন্তু সেই সব পড়াশোনা কি জীবনে কাজে লাগাতে পেরেছে?

ইতালিয়ান মনীষী স্পিনোজার লেখাতে পড়েছিল চারণ The more things the mind knows, the better it understands its own powers and the order of nature. The better it

inderstands its own powers, so much the more easily can it direct itself and propose ules to itself. The better, also, it understands the order of nature, The more easily an it restrain itself from what is useless.

চন্দ্রবদনী হয়তো দার্শনিক স্পিনোজার এই লেখা না পড়েই এক স্থিতিতে এসে পৌঁছেছে সেখানে মনেক সাধু-সন্তও অনেক দিন তপস্যা করে এসে পৌঁছতে পারবেন না।

চন্দ্রবদনী স্বগতোক্তি করল, এসে গেলাম।

উঁ?

অন্য জগতে চলে-যাওয়া চারণ বলল, সে জগত থেকে রুদ্রপ্রয়াগের পথে ফিরে এসে।

আর মিনিট পনেরো।

ওঃ।

তারপর বলল, আমাকে তাহলে এখান থেকে ফিরে যেতেই বলছেন?

মাথা নাড়ল চন্দ্রবদনী। ইতিবাচক। যেন অনিচ্ছাতে। তারপরই মুখ ঘুরিয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল চারণের দুচোখে। চোখ রাখল টায়ে টায়ে। যেন, একটু চাউনিও উপছে না পড়ে যায় বাইরে।

কোথায় যাবেন? এখান থেকে? দেবপ্রয়াগে? না হৃষীকেশে?

চন্দ্রবদনী বলল।

ঠিক করিনি।

হরিদ্বারেও যেতে পারেন। দেখেননি তো তেমন করে।

না। থাকিনি একদিনও। দেরাদুন থেকে তো সোজাই এসেছিলাম হৃষীকেশে।

 তবে, তাই যান।

বললাম যে, ঠিক করিনি। কলকাতাতেও ফিরে যেতে পারি।

তাই?

 বিষণ্ণ গলাতে বলল, চন্দ্রবদনী।

তারপর বলল, আর আসবেন না এদিকে?

চন্দ্রবদনীর চোখ থেকে চোখ না সরিয়ে চারণ বলল, আসব। আপনি যদি আসতে বলেন।

আমি কে? এখানে ডাকার মতন এত সব বড় বড় অপ্রতিরোধ্য শক্তি আছেন। তাঁরা থাকতে আমি আপনাকে ডাকি এমন সাধ্য কি?

তবু, ডেকেই দেখবেন।

ডাকলে, শুনতে পাবেন? নিরুচ্চারের ডাক?

দেখতে দেখতে গাড়িটা জিম করবেট সাহেবের মানুষখেকো চিতা মারার জায়গাটি ছাড়িয়ে গেল। এবার নীচে নামবে অলকানন্দার উপরের ব্রিজ পেরুবে বলে। একটু পরই পৌঁছে যাবে গাড়ি। বড় রাস্তা থেকে, চন্দ্রবদনীর গ্রামের সরু পাকদণ্ডীর পথ যেখানে উঠে গেছে, সেই পথের মোড়ে নেমে চলে যাবে চন্দ্রবদনী।

কে জানে! এই যাওয়া কেমন হবে। যাওয়ার কতই না রকম হয়।

অবশেষে রওনাক সিং-এর গাড়িটা এসে অকুস্থলে দাঁড়াল। যা ঘটিতব্য তা ঘটেই। যতই উইশফুল থিংকিং করা হোক না কেন!

চন্দ্রবদনী নেমে রওনাকের হাতে একটা কিছু দিল। হাত উপুড় করে দিল, যাতে অনন্য দেখতে পায়। সব দানই গোপনেই করা উচিত যে, তা চন্দ্রবদনী জানে। জেনে, ভাল লাগল চারণের।

 রওনাককে তো দিল গোপনেই, যা দেবার। এখন চারণকে কি দেয়, তা কে বলতে পারে।

 চারণও নেমে দাঁড়িয়েছিল। রওনাক সিংও গাড়িটা বাঁদিকে চেপে পার্ক করিয়ে নেমে দাঁড়াল। চন্দ্রবদনী তার ডানহাতটা বাড়িয়ে দিল হাতের পাতা চিৎ করে। চারণ, পাপড়িমেলা চন্দ্রবদনীর নরম পদ্মফুলের মতন সুগন্ধি হাতে হাত রাখল। অন্য কেউই জানল না, কে দিল, আর কে নিল? এবং তা কি?

আপনার ঠিকানা দিয়ে চিঠি লিখবেন কিন্তু। লিখবেন তো?

পেছন ফেরার আগে বলল, চন্দ্রবদনী।

ততক্ষণে দু-একজন মানুষ চন্দ্রবদনীর ফিরে আসা লক্ষ করে তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। সে এখন আর শুধুমাত্র চন্দ্রবদনীই তো নয়! সে যে শহিদ চুকার শর্মার দিদি। নায়িকা।

চলি!

বলেই, চন্দ্রবদনী জনতার সমবেদনার মতন অস্বস্তিকর অনুভূতির হাত এড়াতে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল। তার মালপত্র সব পড়ে রইল। কেউ না কেউ তুলে বয়ে নিয়ে যে যাবেই সে কথা ও জানে।

চিঠি দেবেন কিন্তু? কালই দেবেন। বুঝলেন।

 আদেশের সুরে বলল ও, কিছুটা উঠে, ঘুরে দাঁড়িয়ে।

 চন্দ্রবদনীর মুখ দেখে মনে হল চুকারের চলে-যাওয়ার শোকের উপরে চারণের চলে-যাওয়া দুঃখেরও একটি পরত লেগেছে তার মুখে। পাছে, সেই দুঃখ প্রকাশ পায়, তাই সে তাড়াতাড়ি মু ঘুরিয়ে নিয়েই উঠতে লাগল চড়াই। শ্লথ পায়ে।

চারদিকের পাহাড়ে ঘনসবুজ গাছপালাতে প্রস্তরপুঞ্জর নীচে নীচে বসে থাকা ঘন নী রক-পিজিয়নের পিঠে, অলকানন্দার আশ্চর্য সুন্দর রঙিন জল এবং তার বুকের নুড়িময় তীরভূমিতে সকালের উষ্ণ, উজ্জ্বল রোদ ঝিকমিক করছে। সেই পূর্ণ সকালে একরাশ আলোর মধ্যে দাঁড়িয়েও হঠাৎই চারণের ঠাণ্ডা লাগতে লাগল। আক্ষরিকার্থে নয়। এক অন্য ধরনের উষ্ণতার অভাব। প্রত্যেক মানুষ-মানুষীই হয়তো বাঁচে একটু উষ্ণতারই প্রত্যাশায়। একটু উষ্ণতার জন্যে প্রার্থনায়। কোনও মানুষই পর্বত নয়, সমুদ্র নয়, আকাশের মতন বিরাট বিশাল নয়। মানুষ মাত্র পাখিরই মতন। ছোট্ট পাখি। খুবই সামান্য তার অবয়ব, সামন্যতর তার জীবনের আয়োজন হয়তো প্রয়োজনও। চারণের মতন প্রত্যেক সাধারণ মানুষেরই প্রার্থনা শুধুমাত্র একটি নীড়েরই। কবোষ্ণ, ছোট্ট, প্রিয়ার প্রিয় শরীরের সুগন্ধে আমোদিত একটি ছোট্ট নীড়ের।

রওনাক হঠাৎ চারণের ভাবনার জাল ছিঁড়ে দিয়ে বলল, চলে অব? ক্যা সাহাব?

 জি হাঁ। চলল।

বলল, চারণ।

তারপর গাড়ির সামনের দরজা খুলে রওনাক এর পাশে বসল ও। সব মানুষ-মানুষীই অন মানুষের শরীরের, হৃদয়ের উত্তাপের কাঙাল। তাই পেছনের সিটের অতখানি জায়গাতে একা বসত ইচ্ছে করল না।

যানা কাঁহা?

রওনাক শুধোল।

উত্বারকে তো চলো রওনাক। কাঁহা যানা, উ বাদমে শোচে গা।

গাড়িটা ঘুরিয়ে নিল রওনাক।

জানলা দিয়ে মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখল চারণ। চন্দ্রবদনী সেই বড় চ্যাটালো কালো পাথরটা উপরে, যার উপরে সে শিশুকালে এক পূর্ণিমার রাতে বাঘ দেখেছিল, তার সাদা পোশাক পরে দাঁড়ি হাত নাড়ছে চারণকে। একটি সাদা ম্যাগনোলিয়া গ্রান্ডিফ্লোরার ফুলের মতন দেখাচে চন্দ্রবদনীকে।

চারণও হাত নাড়ল।

রওনাক গাড়িতে গিয়ার দিয়ে ক্লাচ টিপে অপেক্ষা করছিল।

শুধোল, অব চলা যায়?

হাঁ। হাঁ। জী হাঁ।

বলল, চারণ। সম্ভবত একটু বিরক্তিরই সঙ্গে।

রওনাক বুঝী মানুষ। তাকাল একবার চারণের মুখে। কিছু বলল না।

গাড়িটা এবারে উঠতে লাগল। কিছুটা উঠে কিছুটা সমান্তরালে গিয়ে আবার নামা শুরু করবে। তারপর অলকানন্দার ব্রিজ পেরিয়ে গাড়িটা আবারও উঠবে। কিছুটা ওঠা, কিছুটা সমান্তরাল পথে যাওয়া তারপরে কিছুটা নামা, আবারও ওঠা। এই পথ, হয়তো যে কোনও পথেরই সঙ্গে, মানুষের জীবনেরও বড়ই মিল। তাই কি শব্দদুটো জমাট বেঁধেছে?

জীবন-পথিক?

এখন বলার কথা আর কিছুই রইল না। এখন সময়, শুধু ভাববারই। ভাবতে ভাবতে যাবে চারণ।

ভাবতে, ভাবতে, ভাবতে…

ফাঁকা রাস্তায় পড়ার একটু পরেই রওনাক বলল, হামারা আজ হৃষীকেশ লওটানাহি পড়েগা। দুসরা প্যাসেঞ্জারকো লেকর কাল সুব্বে সুব্বে তেহরি যানা হ্যায়। উনলোগ কোম্পানিকো অ্যাডভান্স কর চুকা। ঔর গাড়ি নেহি হ্যায়। তিনঠো গাড়ি ইধার-উধার সওয়ারী লেকর পহিলেই চলা গিয়া।

আচ্ছা? চারণ বলল।

গত চব্বিশ ঘণ্টাতে রওনাক সিং যেন ওদের দুজনের পরিবারভুক্তই হয়ে গেল। ওকে ছেড়ে দিতে বিচ্ছেদ-ব্যথা বোধ করবে চারণ। তারপরই ভাবল, ছেড়ে দিতে তো একদিন সকলকেই হয়।

অথচ ট্রেনের এক কামরার যাত্রী, প্লেনের পাশের সিটের যাত্রীও একধরনের আত্মীয়ই হয়ে ওঠেন স্বল্পকালের মধ্যেই।

রওনাককে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেই যদি একধরনের কষ্ট বোধ করে চারণ তাহলে চুকারকে চিরদিনের জন্যে ছেড়ে দিতে কত কষ্টই না হচ্ছে এখন দিদি চন্দ্রবদনীর।

.

১৪.

আও বেটা আও।

প্রথমে একটু ইতস্তত করছিল চারণ।

তারপর গুহার দিকে এগিয়েই গেল পায়ে পায়ে। একটি পুরনো ছিন্ন বাঘের চামড়ার ওপরে যোগাসনে বসে ছিলেন এক সাধু। সাধুর চোখের দৃষ্টি অসাধারণ তীক্ষ্ণ। শাঁখামুটি সাপের দৃষ্টির মতন। তবে, তা দেখে ভয় লাগে না, সম্মোহিত হতে হয়।

দেবী চন্দ্রবদনীর মন্দিরের সিঁড়ির কাছ অবধি গিয়ে নেমে আসছিল চারণ। কোনও মন্দিরের ভিতরেই তো সে কখনওই প্রবেশ করেনি আজ অবধি। কিন্তু কে জানে কেন, চন্দ্রবদনীর মন্দিরে মধ্যে ঢুকতে খুব ইচ্ছা করছিল ওর। ওর মনে, মানুষী চন্দ্রবদনীর শরীরের মন্দিরে প্রবেশ করার যে এক গোপন ইচ্ছা অনবধানে জেগে ছিল তা যেন হঠাৎই প্রথম বৃষ্টি পাওয়া শুকনো, মরা ডালে ডালে কিশলয়ের নবাঙ্কুরের মতন উদ্ভাসিত হল। লজ্জা পেল চারণ।

ও যখন মন্দিরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, মন্দিরের দিকে পেছন ফিরে ভাবছিল মন্দিরে ঢোকার মতন প্রাকৃত ও পৌত্তলিক ও হবে কি হবে না, ঠিক সেই সময়েই দূর থেকে সেই সাধু তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। তার পর মুহূর্তেই সে পায়ে পায়ে যেন কোনও অমোঘ সমোহনে সম্মোহিত হয়ে সেদিকে এগিয়ে যেতে লাগল।

তখন ভর দুপুর। মাথার উপরে ঝুঁকে-পড়া নগাধিরাজ নীচের ছায়া নিয়ে দাবা খেলছেন। কিন্তু সাধুর প্রস্তরাশ্রয়ে শুধুই ছায়া, শীত, প্রায়ান্ধকার। কাছে আসার পরেই বুঝেছিল সে, সেটা গুহা ঠিক নয়, ভারতের মধ্যপ্রদেশের ভীমবৈঠকার মতন রক-শেলটার। তবে বেশ গভীর।

কাছে পৌঁছলে, সাধু তাকে বসতে বললেন।

খিদে পেয়েছিল বেশ চারণের। রওনাক-এরও নিশ্চয়ই পেয়েছিল। কিন্তু রওনাক তো নীচেই আছে। উপর অবধি চারণের সঙ্গে উঠে আসেনি। দেব-দেবী দর্শনের পুণ্য সম্ভবত রওনাকের রাখার জায়গা নেই। গাড়ির পেছনের সিটে বসে সামনের সিট-এর পিঠ রাখার জায়গাতে পা দুটি তুলে দিয়ে সে আবারও তার কানের পরিচযাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। রওনাক-এর মতন এমন উদ্ভট অথচ লাভেবল, ইন্টারেস্টিং মানুষ খুব বেশি দেখেনি এযাবৎ।

সাধু বললেন, ম্যায়নে বোলায়া ঔর তুরন্ত আ পড়া। মগর দেবীজীনে বোলায়াত গ্যায়া কাহে। নেহি?

শোচতা থা।

তুমহারা পরিসানি ক্যা হ্যায় বেটা? তুমহারা দিল কি লিয়ে দুখী হ্যায়?

চারণ মনে মনে বলল, ভেবেছ আমাকে মুরগী বানাবে? আমি অত বোকা নই। গত দুমাসে কত সাধুসন্ন্যাসী পার হয়ে এলাম। অত সোজা নাকি?

সাধু যেন তার মনের কথা বুঝে গিয়ে বললেন, কাম আহসানহি হ্যায়।

কওনসি কাম?

 নিজেই নিজের হিন্দি উচ্চারণে তাজ্জব বনে গেল চারণ। গত দুমাসে তার নানাবিধ উন্নতির মধ্যে উত্তর ভারতের হিন্দির (দূরদর্শনের আজগুবি হিন্দি নয়!) উচ্চারণের উন্নতিও একটি।

চারণ আবারও বলল, কওনসি কাম?

 তুমকো মোরগা বানানা। মগর ম্যায়…।

মাফ কর দিজিয়ে সাধুজি। মুঝে মাফ কর দিজিয়ে।

জবানসে কহ রহা হ্যায় সাধুজি ঔর দিলমে শোচ রহা হ্যায় ম্যায় তুমকো থোকা দেগা। তুমলোগ ভারী ভারী শহরকে পড়ে লিখে আদমীওঁনে অ্যায়সাহি হোতা হ্যায়। আপনা দোনো হাত পহিলে সাফতে করো তবহি না ইনসাফ মাঙ্গোগে বেটা? ক্যা হামসে, ঔর ক্যা ভগয়ানসে।

চারণ, লজ্জা পেয়ে চুপ করে গেল।

সাধু বললে, আজ তুম চলে যাও। তুমহারা লিয়ে কোঈ ইন্তেজার করতা হোগা নিচুমে। দিল কিয়া, তো কাল ফিন আয়া করো। মগর ইসটাইমমে নেহি। ইসবখত বড়ি ভিড়ভাড় রহত্যা যায়। তুম সামকি পহিলে আ যাও বেটা। রাত হিয়াই বিতানা। তুমহারা দিলমে যো আঁধি চল রহি হায়..

না, না, আন্ধি-টান্ধি কিছু নয়।

 চারণ প্রতিবাদ করে বলল।

 উঠবে। আন্ধি উঠবেই। এখন শুধু মেঘ করছে। সবে। ঝড় উঠবে।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, মারা গেছে যে, সে তোমার কে? আর মেয়েটিই বা কে?

কোন মেয়েটি?

যার কথা ভাবতে ভাবতে তুমি উপরে উঠে এলে। তুমি তো চন্দ্রবদনীজির কথা ভাবতে ভাবতে আসোনি। এসেছিলে কি?

চারণ, বলবে না ঠিক করেও বলে ফেলল, যার কথা ভাবছিলাম তার নামও চন্দ্রবদনীই।

সাচ? বড়ি তাজ্জব কি বাত। কওন জানে, উনোনেভি কোঈ দেবীই হোগী।

 মানুষী কি করে দেবী হবে?

চারণ অবিশ্বাসের গলাতে বলল।

হবে না কেন? মানুষের চেহারাতে কি দেব-দেবীরা নেই? অবশ্যই আছেন। তুমি শহরে তেমন করে খোঁজোনি তাই তো এতদূরে দেব-দেবী খুঁজতে আসতে হল।

আর আপনি? তাহলে আপনিই বা এখানেই মৌরসী পাট্টা গেড়ে নিয়ে বসে আছেন কেন? দেবদেবীর দর্শনের আকাঙ্ক্ষাতেই তো!

নেহি। উসলিয়ে ম্যায় হিয়া পর নেহি আয়ে থে।

তো কিসলিয়ে আগেঁথে?

 উও এক লম্বি কাঁহানী। কিন্তু পূর্বাশ্রমের কথা তো আমি বলব না। আমার সম্বন্ধে বেশি উৎসুক হয়ো না তুমি। নিজের মনকে স্পষ্টভাবে জানো। মনকে জানতেই তো তোমার এখানে আসা। না, কি?

চারণের মনে হল, এই সন্ন্যাসী অন্য দশজনের মতন নন। একেবারেই তাঁর নিজের মতন। তবে ইনি কথা বড় বেশি বলেন। ভাব দেখে মনে হয়, এই সাধু কোনও বাঙালিই হবেন। বাঙালি ছাড়া আর কোনও ভারতীয় নিজের গলার স্বরকে এত ভালবাসে না।

হঠাৎই সন্ন্যাসী চারণকে রীতিমতো ধমক দিয়ে বললেন, এখন যাও। ক্ষিদে পেয়েছে খুব। মুখ দেখেই মনে হচ্ছে।

আপনি বাঙালি?

 হ্যাঁ।

চারণ চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই সাধু বললেন, যাওয়া নেই, এসো।

দেবপ্রয়াগে পৌঁছে চন্দ্রবদনীর এই মন্দিরে বোধহয় না উঠে এলেই ভাল করত। ভাবল, চারণ। এই সাধু কে? তা কে জানে! সাধু যিনিই হন না কেন তিনি হয়তো অসাধু নন। চারণের যে কালকে এখানে ফিরে আসতেই হবে সে কথাও ও বেশ বুঝতে পারল। এই রহস্যময়তার শেষ দেখে যেতে চায় ও। তাছাড়া চন্দ্রবদনীর মন্দিরের সঙ্গে মানুষী চন্দ্রবদনী এমন করে জড়িয়ে গেছে যে, এই দুই যেন অবিচ্ছেদ্যই হয়ে গেছে। সেই কারণেই এই মন্দিরকে অন্য যে-কোনও মন্দির বলে আর ভাবতে পারছে না ও কিছুতেই।

ভাবছিল ও, সত্যিই! এই পথ, আর জীবনের পথ মানুষকে যে কোথায় কোথায় নিয়ে যায়। কখন কোন দিকে মোড় ফেরায় তা যদি আগের মুহূর্তেও জানা যেত, এই লোকটা কি বলতে চায়? তা জানতে হবে। তেমন হলে, গলা টিপে মেরে রেখে যাবে চারণ এই সাধুকে তার প্রস্তরাশ্রয়ের ভিতরেই কাল রাতে। সাংঘাতিক সব আজেবাজে কথা বলছে লোকটা।

সাধু পেছন থেকে গলা তুলে বললেন, সব পাট চুকিয়ে এসো। লোটা কম্বল সব নিয়েই এসো। থেকে যেও কদিন। দেবী চন্দ্রবদনীর টানও বড় কম টান নয়।

চারণ উত্তর দিল না সে কথার কিন্তু গভীর চিন্তাতে মগ্ন হয়ে পড়ল।

 দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর দেবপ্রয়াগ থেকে বেরিয়ে চন্দ্রবদনীর মন্দিরের পথে গাড়ি যতখানি আসে ততখানি এসে রওনাককে ছুটি করে দিয়েছে। বলেছে, হৃষীকেশে পৌঁছে, প্রয়োজন হলে আবার তাদের কোম্পানিতে যোগাযোগ করবে।

মোটা বকশিস দিয়ে রওনাককে ছুটি করে দেওয়ার সময়ে চারণের বুকের মধ্যে কিছু একটা বিশেষ অনুভূতি যে হয়নি এমন নয়, কিন্তু রওনাককে দেখে একটুও মনে হয়নি যে তার হৃদয়েও চারণের বা চন্দ্রবদনীর কারণে সামান্যতম আলোড়ন ঘটেছে।

রওনাক-এর কাছে ওরা শুধুমাত্র দুজন প্যাসেঞ্জারই হয়তো ছিল। তার ভাড়া গাড়ির দুজন সওয়ারি মাত্র।

যাবার সময়ে রওনাক শুধুমাত্র তার ডান কানই নয় তার দুহাতে দুকান ধরে বলেছিল, কুছ গলতিয়া হুয়া হোগাতো মাফ কর দিজিয়ে গা সাব।

কোঈ গলতিয়া হুয়া নেহি তুমহারা। মগর হৃষীকেশমে পৌঁছকর তুমহারা কান কি ইলাজতে ঠিকসে করে রওনাক।

রওনাক হেসে বলেছিল, করুঙ্গা।

 তারপরই আকর্ণ হাসি হেসে বলেছিল,

গলতিঁয়া করতা হুঁ জী ভর ইস লিয়ে
বকশীসোঁপর তেরে, মুঝকো নাজ হ্যায়।

চারণ হেসে বলেছিল, বহত খুব।

এই দ্বিপদীটি জানত চারণ। মির্জা গালিবের লেখা। মানে হল, সারাজীবনটা ধরে এই জন্যেই তো শুধু ভুলই করে আসছি বারে বার। আমি যে জানি, তোমার ক্ষমা তো আমি পাবোই।

.

রওনাক গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেছিল, হাত তুলে সেলাম সাব বলে। চারণও পায়ে হেঁটে চন্দ্রবদনীর মন্দিরের দিকে ওঠা শুরু করেছিল।

এখন সন্ধ্যে নেমে গেছে। একটু পরেই অন্ধকার হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ আগেও যে স্থান নানা দর্শনার্থী, ফুলের ও পাড়ার দোকানি এবং আরও নানারকম মানুষের গলার স্বরে সরগরম ছিল, অনুরণিত ছিল ঘন ঘন ঘণ্টাধ্বনির শব্দে, সেখানে যেন শ্মশানের স্তব্ধতা নেমে এসেছে। মন্দিরের এবং পাহাড়ের ছায়া চাঁদের আলোতে মাখোমাখো পুরো এলাকাতে কোনও এক রহস্যময় বাতাবরণের সৃষ্টি করেছে। সমস্ত পরিবেশেই কী এক সুগন্ধ মাখামাখি হয়ে আছে। মিশ্র সুগন্ধ। শেষ চৈত্রর বনপথে যেমন থাকে।

সাধুজির প্রস্তরাশ্রয়ের মুখে ততক্ষণে ধুনি জ্বলে উঠেছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে তা। সেখানে পৌঁছে দেখল, আজ কোথা থেকে যেন একজন চেলা এসে জুটেছে। আগের দিন সন্ন্যাসী একাই ছিলেন। অবশ্য তখন দুপুরবেলা। লোকটার চেহারা-ছবি বিশেষ ভাল নয়। চোখ দুটো জবাফুলের মতন লাল। সেই লালিমার কতটা দিবানিদ্রার কারণে আর কতটা অগ্রিম গঞ্জিকা সেবনের কারণে সেটা বুঝে উঠতে পারল না চারণ। সাধুজি তাঁকে ডাকছিলেন তুরতি নামে। অদ্ভুত নাম। তুরতি কারও নাম যে হতে পারে তা ভাবতেও অবাক লাগে।

সাধুজি মন বুঝে বললেন, ও হল গিয়ে তুরন্তবাবা। তাই শর্ট-এ বলি তুরতি।

তাই?

ইয়েস।

বলেই, এক হাঁক ছাড়লেন, ব্যোম শংকর।

তুরতিও গলা মেলাল, ব্যোম শংকর। তারপর চারণের চোখের দিকে চেয়ে তুরতি বলল, চলবে তো?

কি?

সিদ্ধি। তা করবেন তো একটু পেসাদ?

ও আবার কি বলবে র‍্যা? ও তো আমাদের অতিথি। যে তিথিতে যা দিবি ও তাই খাবে। ও কী শ্বশুরবাড়ি এয়েচে না কি?

চারণ চুপ করে রইল।

সাধু তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললেন, এই তুরতি। আমার বাঘছালটা ভাল করে ঝেড়ে দে সিদ্ধি বানাবার আগে। শালার ছারপোকার চাষ হয়েছে র‍্যা। ব্যাটা বাঘ বেঁচে থাকলে কী বে-ইজ্জৎটাই না হতো।

তুরতি, তুরন্তই বলল, কী আর এমন হত! চৌরঙ্গিতে আশু মুকুজ্যের স্ট্যাচুর গোঁফের ওপরে বসে যখন চড়াইপাখি পায়কানা করে তখন বাংলার বাঘের যেমন মনে হয়, ঠিক তেমনই মনে হত আর কী?

আসলে সব বাঘেরাই জীবদ্দশাতেই ভাল থাকে। মরে গেলে ছুঁচোয় এসে পোঁদে নাতি মেরে যায়।

চারণ ভাবল, ভাল সাধু আর তার সাগরেদ-এর খপ্পরে পড়ল এসে যা হোক।

সাধুর নামটা এখনও জানা হল না। হবে এখন সময় মতন। সাধুর পেছন পেছন হেঁটে মন্দির চত্বর পেরিয়ে পর্বতের উপরের একটি নির্জন জায়গাতে এসে পৌঁছল চারণ। নীচে এক গভীর জঙ্গলে ভরা গিরিখাতের কালো গভীর রেখা দেখা যাচ্ছে। নানারকম রাতচরা পাখি ডাকছে। গাড়োয়লের রাতের পার্বত্যবনের মিশ্র সুগন্ধ আসছে নাকে। বেশ ঠাণ্ডা লাগছিল চারণের।

খাদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে সাধু বললেন, যে মারা গেছে সে তোমার কে?

কে?

চমকে উঠল চারণ।

বলল, আমার কেউ নয়। আমার কেউ নয়।

তোমার খুব আপনজনের কেউ তাহলে।

তাও নয়।

না বললে তো হবে না বাবা।

বলেই বললেন, দেখি তোমার হাতটা দেখি।

অন্ধকারে হাত দেখবেন কি করে?

হাত দেখব না রে ছাগল।

বলেই, চারণের ডান হাতটি নিজের দুহাতে তুলে নিতে তাঁর দুটি হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষতে লাগলেন জোরে জোরে। মিনিট খানেক ঘষার পরে চারণের ডানহাতখানি নিজের নাকের সামনে তুলে ধরে শুকলেন দুতিনবার। তারপর বললেন, যে মারা গেছে সে বৌদ্ধ ছিল। তাই নয়?

জানি না। তার ঠাকুর্দা বৌদ্ধ। তবে তিব্বতী বৌদ্ধ। যে মারা গেছে, সে কোনও ধর্ম মানত বলে জানি না আমি। কিন্তু আশ্চর্য কথা! আপনি আমার হাত শুঁকেই এতসব বললেন কী করে।

শুধু হাত শুঁকেই কেন? তোমার মুখ দেখেও বুঝেছিলাম গতকাল।

কী করে?

বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানিস রে তুই শালা?

ঠিক সেই সময়ে নীচের গিরিখাদ থেকে একটি বড় বাঘের ডাক ভেসে এল। বাঃ বাঃ সে কী ডাক। পর্বত অরণ্য আকাশ সব যেন কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল।

সাধু, গিরিখাদের অন্ধকারে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। বাঘটা আরও কয়েকবার ডাকতে ডাকতে সম্ভবত গিরিখাদের অন্যদিকের পাহাড়ে চড়তে লাগল।

সাধু বললেন দ্যাখ শালা! এই জন্যেই বলেছিলাম। বেঁচে থাকলে বাঘের গায়ে হেঁটেরোপটেরাদের জ্ঞাতিগুষ্টি সংসার করার মতো আম্পর্ধা দেখাতে পারত?

হেটেরোপটেরাটা কি জিনিস?

ছারপোকার বংশের নাম।

বাঃ বাঃ। আপনি কত কিছু জানেন।

হাঃ। অতই যদি জানতাম, তবে তো দিল্লি গিয়ে কিকব্যাকের ব্যবসা ফাঁদতাম রে। আমি কিছুই জানি না। আজকাল যে জ্ঞান ভাঙিয়ে টু পাইস কামানো না যায়, তাকে জ্ঞানই বলে না।

তা ঠিক।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, চারণ।

অ্যাই দ্যাখসো। এ শালা তো ভণ্ড এক নম্বরের। দীর্ঘশ্বাস ফেললি যে বড়।

 লজ্জিত হয়ে চারণ বলল, না। পড়ে গেল আর কী!

তারপর বলল, রাতের বেলা চন্দ্রবদনীর মন্দিরের আশেপাশে তো কেউই থাকে না বলতে গেলে। আপনার ভয় লাগে না এমন নির্জনে থাকতে।

লাগে না যে, তা নয়। এখনও পুরো সন্ন্যাসী তো হতে পারিনি। হাফ-গেরস্তদের যেমন শাড়ি খুললেও লজ্জা জেগে থাকে, হাফ সন্নিসীদেরও তেমনই ছয় রিপু ল্যাভোটের মধ্যের ছারপোকার মতন কুটুস কুটুস করে কামড়ে দেয়। তাই ভয় এখনও পাই। তবে বাঘটা যেমন জেনেছে, আমিও তেমনই জেনেছি, যে অন্যের মনে ভয় জাগিয়ে না রাখতে পারে, ভয়টা এসে তার নিজের বুকেতেই সেঁধোয়। তাই আমি ভয় জাগিয়ে রাখি, অন্যকে ভয় পাওয়াই। এই তুই যেমন ভয় পেয়েছিস।

ভয়?

আলবাৎ! ভয় নয় তো কি বে শালা! ভয় না পেলে তুই কি আসতিস আমার কাছে?

না, না ঠিক ভয় নয়। ভয় পেয়েছিলাম বলে আসিনি কিন্তু।

তবে?

কৌতূহল হয়েছিল। হয়তো বলতেও পারেন, ভয়-মিশ্রিত কৌতূহল। অথবা হয়তো সম্ভ্রম। বাংলাটা আমি অত ভাল জানি না।

ইংরেজি ভাল জানিস বলে গুমোর আছে বুঝি?

চারণ লজ্জা পেয়ে বলল, না না, তাও নয়। ভাল করে কিছুই জানি না। আপনাদের প্রজন্মের মানুষ আর আমাদের প্রজন্মের মানুষদের মধ্যে এই তফাৎ। আপনারা যেটুকু জানতেন খুবই ভাল করে জানতেন।

আমাদের আগের প্রজন্মের মানুষেরা আমাদের চেয়েও ভাল জানতেন সব কিছু। আমার বাবা যেমন ইংরেজি লিখতেন, আমার ঠাকুমা যেমন বাংলা জানতেন, তেমন ইংরেজি বা বাংলা-নবীশ আজকাল দশ শহর খুঁজেও পাওয়া যাবে না।

সাধু বললেন।

তা ঠিক।

চল, ফিরি এবারে।

ফিরে চলতে চলতে বললেন, বাঘকে তো এখানে থাকতেই হবে। চন্দ্রবদনীজি তো মা দুর্গারই। আর-এক নাম। আর মা দুর্গার বাহন যে বাঘ তা কি তুই জানিস নে?

আচ্ছা এসব কি সত্যি? চারণ জিগ্যেস করল।

তুই তো আচ্ছা রে। যিশুখেষ্ট সত্যি, মহম্মদ সত্যি, মহাবীর সত্যি আর আমাদের মা দুর্গাকে সত্যি বললেই কি তোকে মানুষে অসভ্য বলবে? বলবে, প্রাকৃত। সবজান্তা নিরীশ্বরবাদীদের ব্যবসাটাই তো এখন রমরমা হয়েছে কি না।

একটু চুপ করে থেকে বললেন, যত্ব সব বাঁদরামমা। তোদের দেশে কি মানুষ নেই র‍্যা আর? সব বাঞ্চোতই দলে ভিড়ে গেছে। সব বাঞ্চোতই ভিখিরি। ছাঃ ছ্যাঃ। মীর সাহেবের একটা দ্বিপদী পড়েছিলাম। কেবলি সেই কথা মনে হয়। হিয়া আদম নেহি হ্যায়, সুরত এ আদম বহত হ্যায়।

মানে?

মানে, এখানে মানুষ নেই। মানুষের চেহারার জীব আছে অনেকই। সত্যি বলতে কি, এই সব জায়গাতেও যে-সব বাঙালি দলে দলে আসেন তাঁদের দেখে আমি যে বাঙালি এ কথা ভেবে বড়ই লজ্জা পাই। অথচ এই জাতের মধ্যেই কত রিয়্যাল রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ছিল একদিন।

চারণ বলল, হয়তো আজও আছে। আপনি এত দুরে বসে জানতে পান না।

তা যদি হয়, তবে তো খুশিই হব।

সেই প্রস্তরাশ্রয়ে ফিরে যাবার পরে চারণ দেখল আরও দুজন অল্পবয়সী সাধু তুরতির সঙ্গে জুটেছে। সাধুকে দেখে তাঁরা দাঁড়িয়ে উঠলেন।

সাধু বললেন, বৈঠ বৈঠ। লওটা কব?

আজহি।

ওঁরা সমস্বরে বললেন।

সেই দুই তরুণ সাধুর চোখগুলি উজ্জ্বল। নিষ্পাপ শিশুদের চোখ যেমন হয়। তাকালে মনে হয়, ও চোখগুলি কোনও নীচতা, তঞ্চকতা, অকৃতজ্ঞতা দেখেনি। এখনও শিকার হয়নি বঞ্চনার। তাঁদের চোখের দৃষ্টিতে একটুও আবিলতা নেই।

খানাপিনা কাঁহা কিয়া? কিয়া না?

 জি হাঁ। জিষ্ণু মহারাজ।

জিষ্ণু নামটি শুনে চমকে উঠল চারণ। কবি বিষ্ণু দের ছেলের নাম জিষ্ণু। চারণ তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চেনে না কিন্তু তার পরিচিত অনেককেই চেনে। জিষ্ণু শব্দের মানে সঠিক জানে না চারণ। শিব কি? ভর্তৃহরি নাকি লিখেছিলেন অলিনীং জিষ্ণু কচানাং চয়। জিষ্ণু মানে আবার বিষ্ণুও। তা বুঝতে না-পারার মতন মূর্খ চারণ নয়।

জিষ্ণু মহারাজ বললেন, তুরতি সেই গানটা গা তো শুনি।

কোনটা মহারাজ?

আরে সেই রাম দত্তর গানটা।

ও। কিন্তু সিদ্ধি।

এখনও সরবৎ হয়নি? করিস কি তুই? দুধ আর মালাই কি নিজেই সব সাবড়ে দিলি? থাকগে। শরবৎ হবেখন। আগে গানটা গা।

গানটা ধরে দিল তুরতি হঠাৎ করে, খালি গলায়, এবং গান ধরার সঙ্গে সঙ্গে মমুগ্ধ হয়ে গেল চারণ।

তুরতি গাইছিল :

অকারণ মন আশা কোরো না।
অনিত্য সুখেতে মন মজোনো, মজোনা।
যতই করিবে আশা মিটিবে না সে পিপাসা
দুস্তর সে আশা নদী জেনেও কি তা জানো না।

কার মধ্যে যে কী থাকে। ভাবছিল চারণ। সুরেলা গান, যার সুরজ্ঞান আছে তাকে যেমন করে বিদ্ধ করে তেমন করে সম্ভবত রাইফেলের বুলেটও বিদ্ধ করতে পারে না। এই ভাবগম্ভীর পরিবেশে, এই চালোকিত সুগন্ধি রাতে, চন্দ্রবদনীর মন্দিরের পরিবেশে সেই গান যে কী মহিমার সঙ্গে স্বরাট হয়ে সমস্ত আকাশ বাতাসের অণু-পরমাণু ভরে দিল তার ব্যাখ্যা চারণের কাছে ছিল না কোনও।

তুরতি গাইছিল :

ভিখারি কামনা করে, হতে চায় লক্ষপতি
লক্ষপতি হলেও হতে চায় কোটিপতি
কোটিপতি হলেও পরে হতে চায় শচীপতি
ইন্দ্রত্ব লভিলেও পুনঃ শিবত্ব করে কামনা।

দীনরাম বলে ওরে, সে নদী অতি ভীষণা
কামাদি কুম্ভীর তাহে ক্ষুধিত আছে ছয়জনা
 নামিলে গ্রাসিবে তোরে, যেওনা সেথা যেওনা
হও নিত্যধনে অভিলাষী নিষ্কাম সে বাসনা।
অকারণ মন আশা কোরো না…

গান শেষ হলে চারণ জিগ্যেস করল, এই রাম দত্ত কে?

 রাম দত্ত কে, তাও জানিস নি?

না।

 রাম দত্ত ছিলেন, পুরনো কাঁকুড়গাছির একজন কুখ্যাত প্রজাপীড়ক জমিদার। রামকৃষ্ণদেবের সান্নিধ্যে এসে ভক্তিমার্গের পথিক হন। শুনলি না? গানের বাণীর মধ্যেই রয়েছে দীনরাম বলে ওরে?

তাই তো! তা এই সব গান তুরতি শিখল কোথায়?

আরে ও মাকড়া বউবাজারের ক্ষেমি বাঈজির বাড়িতে বহুবছর ছেল যে!

করত কি?

 ব্যায়লা বাজাত।

তা চলে এল কেন?

ক্ষেমির মেয়েকে একদিন বেশি মাল খেয়ে ব্যায়লার মতন বাজাতে গেছিল। না পাইল্যে এলে পরাণটাই যেত। পাইল্যে এইখানে ঠেকেছে এসে। যা কিছু ফুল, পাতা, নিভে যাওয়া প্রদীপের ভেলা নদী পারে ভেসে আসে, তার সবই কি আর ধোওয়া তুলসী পাতা রে?

তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, সে কথা থাকগে। তুরতির দয়ায় বড় ভাল ভাল গান শুনতে পাই।

আবার বললেন, ওরে, শুধু এই অঞ্চলেই কেন, অন্যত্রও যত সাধুসষিসী দেখিস তাদের অনেকেরই অতীত খোঁচালে সাপ বেরুবে। তবে অতীতটা অতীতই। তাদের বর্তমানটা কী সেইটিই বিবেচ্য। পূর্বাশ্রম-এর কথা যে তারা কারওকে বলে না, বা আমিও বলি না, তার কারণ হয়তো এই যে, বড়মুখ করে আমাদের মধ্যে অধিকাংশেরই বলার কিছু নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *