॥ ১৩ ॥
সঞ্জয় এবং মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র যে প্রাসাদের অলিন্দে বসে আছেন, সেখান থেকে সামনের যুদ্ধক্ষেত্রটিকে মনে হয় মহাসমুদ্রের মতো। অসংখ্য সৈন্য সেখানে যুদ্ধে মেতে আছে। কোথায়, কে, কার সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ করছে, তা বোঝার উপায় নেই। কিন্তু সঞ্জয় তাঁর দিব্যদৃষ্টিতে সবকিছুই দেখতে পারেন।
সঞ্জয় একটু পরে থেমে যেতেই ধৃতরাষ্ট্র তাঁকে কিছুটা অভিযোগের সুরে বললেন, “বৎস, আমার মনে হয়, পাণ্ডবদলের প্রতিই তোমার পক্ষপাতিত্ব আছে! কৌরবপক্ষের কত বড়-বড় বীর যোদ্ধা এর মধ্যেই নিহত হয়েছে, তা বলে কি পাণ্ডবপক্ষের কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি? পাণ্ডবপক্ষের কোনও মহান যোদ্ধা কি নিহত হননি?”
সঞ্জয় বললেন, “হে মহারাজ, এই মহাযুদ্ধের কী যে ভয়ংকর রূপ, তা তো সব একসঙ্গে বলা যায় না! তাই আমি বেছে-বেছে আপনাকে মূল ঘটনাগুলো শোনাচ্ছি। পাণ্ডবপক্ষেরও বেশ কিছু যোদ্ধা এর মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন। আপনি তো জানেন, অনেকবারই শুনেছেন, যে পক্ষে ভীম, অর্জুন ও কৃষ্ণের মতন মহাবীরেরা রয়েছেন, এঁদের পরাজিত করা তো দেবতাদের পক্ষেও সম্ভব নয়! জয়-পরাজয় নির্ধারিত হওয়ার আগে কত মানুষকে যে প্রাণ দিতে হবে, তার ইয়ত্তা নেই।”
মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র একটু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “ঠিক আছে, তুমি আবার আমাকে জানাতে শুরু করো। অর্জুনের ছেলে নাকি দারুণ সংগ্রাম করছে? সে এখন কোথায়?”
সঞ্জয় বললেন, “সে-ই এখন যুদ্ধের প্রধান নায়ক। এ রকম বিস্ময়কর ব্যাপার আগে কেউ কখনও শোনেওনি, দেখেওনি। অভিমন্যুর বিরুদ্ধপক্ষীয় সৈন্যরা অবাক হয়ে দেখছে তার যুদ্ধ-নৈপুণ্য। কেউ-কেউ যুদ্ধ থামিয়ে প্রশংসা করতে শুরু করেছে অভিমন্যুর। তার অমন চেহারা, অত কম বয়স, তবু তার তেজের কাছে কৌরবপক্ষের বড়-বড় বীরেরাও দাঁড়াতে পারছেন না।”
ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞেস করলেন, “এখন সে যুদ্ধ করছে কার সঙ্গে?”
সঞ্জয় বললেন, “আজ দেখছি, পাণ্ডব এবং কৌরবপক্ষে প্রধান বীরপুরুষদের সন্তানেরাই যুদ্ধের জন্য এগিয়ে এসেছে এবং বীরত্ব দেখাচ্ছে। যেমন, দুর্যোধনের ছেলে লক্ষ্মণ, সেও তো একজন মহাবীর, তবু অভিমন্যু একসময় তার প্রাণ হরণ করল!”
এ-কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্রের চোখে জল এসে গেল।
সঞ্জয় বললেন, “মহারাজ, এখন তো দেখছি, অভিমন্যু যেমন যুদ্ধে অসম্ভব প্রতাপ দেখাচ্ছে, তেমনই সে আবার এই ব্যূহ থেকে বেরোবার পথও খুঁজতে চাইছে। আমরা তো জানি যে, অভিমন্যু তার বাবার কাছ থেকে এই ব্যূহে ঢোকার কৌশল শিখে নিয়েছিল। কিন্তু এখান থেকে বেরোবার কৌশলটা শেখার সময় পায়নি।”
তারা ভেবেছিল, ভীম এবং অন্য যোদ্ধারা অভিমন্যুর সঙ্গে-সঙ্গে এই ব্যূহের মধ্যে ঢুকে এসে পুরো ব্যুহটাই ভেঙে তছনছ করে দেবেন। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। দ্রোণ, দুর্যোধন এবং কর্ণের মতো বীরেরা প্রবল প্রতাপে ওঁদের আর ভিতরেই আসতে দেননি। অভিমন্যুর একলারই প্রতাপে কৌরবপক্ষের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাবার চেষ্টা করছেন।
দুর্যোধন ঠিক করলেন, এখন আর অভিমন্যুকে বধ না করে উপায় নেই! অভিমন্যু যে-কোনও একটা পথে বেরোবার চেষ্টা করেই দেখতে পেলেন, সেখানে দ্রোণ বা কর্ণ বা দুর্যোধন বা অশ্বত্থামা বা কৃপ প্রমুখ কেউ না-কেউ পাহারা দিচ্ছেন সেই পথ। সকলেরই মনে হচ্ছে, এই অভিমন্যু তাঁর বাবা অর্জুনের মতনই সমান বীর। এমনকী, তিনি হয়তো তাঁর বাবাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারেন।
দ্রোণ তো প্রকাশ্যেই বলে ফেললেন, “এ রকম যুদ্ধে অভিমন্যুর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো আর কি কেউ আছেন? এখন একমাত্র উপায়, অভিমন্যুকে যদি রথ থেকে নীচে নামানো যায়। যতক্ষণ সে রথের উপর থাকবে, ততক্ষণ তার কেশ স্পর্শ করার মতো যোগ্যতাও আমাদের নেই। তার রথ নষ্ট করে দিয়ে যদি এখনকার মতো যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে পরে আবার যুদ্ধ শুরু করা যেতে পারে।”
তা শুনে কর্ণ এবং অন্য বীরেরা অভিমন্যুর রথের সারথিকে হত্যা করলেন এবং রথটাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিলেন। কিন্তু তাতেও অভিমন্যুকে নিরস্ত করা গেল না। তিনি একটি গদা হাতে নিয়ে লাফিয়ে নেমে এলেন নীচে। তখন দুঃশাসনের পুত্রও একটি গদা হাতে এগিয়ে এলেন মুখোমুখি অভিমন্যুর সঙ্গে লড়াই করার জন্য।
অনেকেরই ধারণা যে, সাত জন মহারথী মিলে একসঙ্গে হত্যা করেছেন অভিমন্যুকে। তা অবশ্য ঠিকই।
তাঁকে ঘিরে ধরেছেন ছ’জন। তাঁদের কারওরই মৃত্যুবাণ অভিমন্যুর বুকে বেঁধেনি। অভিমন্যুর সঙ্গে শেষ লড়াইটা হয়েছিল দুঃশাসনের ছেলের। রক্তাক্ত শরীরে অনেক ক্লান্তি নিয়েও অভিমন্যু গদাযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু একসময় দুঃশাসনের ছেলে তাঁর মাথায় প্রবলভাবে একটা আঘাত করতেই তিনি পড়ে গেলেন মাটিতে। সেটাই তাঁর শেষনিশ্বাসের সময়।
দুঃশাসনের যে পুত্রটি শেষ পর্যন্ত অভিমন্যুকে মারেন, তাঁর নাম আমরা জানি না। কাহিনিকার ঋষি বেদব্যাস সেই নামটি আমাদের জানাতে ভুলে গিয়েছেন।
তার কিছুক্ষণ পরে থেমে গেল সেদিনের যুদ্ধ। অর্জুন তখনও ব্যস্ত ছিলেন সংসপ্তকদের সঙ্গে যুদ্ধে। তিনি কিছুই জানতে পারলেন না।
সন্ধে হয়ে এসেছে। আজকের মতো যুদ্ধের বিরতি। তাই অর্জুন আর কৃষ্ণ ফিরে চললেন তাঁদের শিবিরের দিকে। যেতে-যেতে অর্জুন একবার কৃষ্ণকে বললেন, “দ্যাখো সখা, অন্যদিন এই সময় কত রকম আওয়াজ শোনা যায়। কেউ হাসে, কেউ কাঁদে, কেউ গান গায়, কেউ অস্ত্রে শান দেয়। কিন্তু আজ যেন সব দিকই থমথম করছে। কোনও আওয়াজই শোনা যাচ্ছে না। কী ব্যাপার বলো তো?”
কৃষ্ণ বললেন, “তা আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না। চলো, শিবিরে পৌঁছই, আজকের সব বৃত্তান্ত জানতে পারা যাবে।”
অর্জুনের রথ নিজের শিবিরের কাছাকাছি আসতেই দেখা গেল, অনেকেই মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে। অনেকে দু’ হাত মুখে চাপা দিয়ে বসে আছে। তারপর যুধিষ্ঠির এবং অন্য প্রধান পুরুষদের দেখে অর্জুনের বুক কেঁপে উঠল। নিশ্চয়ই আজ এদিকের রণক্ষেত্রে সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে।
অন্যদিন অভিমন্যু এই সময় তাঁর বাবার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। আজ তিনি কোথায়। তাঁকে তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না!
একটুক্ষণের মধ্যেই অর্জুন জানতে পারলেন, সেদিনের সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ। অভিমন্যু অর্জুনের সবচেয়ে প্রিয় পুত্র। তিনি আর বেঁচে নেই! এটা অর্জুন সহ্য করবেন কী করে?
তখন অর্জুনও মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে প্রবলভাবে কাঁদতে লাগলেন। সকলে মিলে অর্জুনকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। যুদ্ধ তো এখনও শেষ হয়নি! আগামীকাল হয়তো আরও ঘোর যুদ্ধ হবে। এই সময় অর্জুন যদি ভেঙে পড়েন, তা হলে পাণ্ডবপক্ষের জয়ের আশা তলিয়ে যাবে।
সেই জন্যই সকলে মিলে অর্জুনকে সান্ত্বনা দিতে-দিতে বললেন যে, “অভিমন্যু শেষ পর্যন্ত বীরের মতো লড়াই করতে-করতে প্রাণ দিয়েছেন। যে-কোনও ক্ষত্রিয়ের পক্ষে এটা খুবই গৌরবের কথা। অভিমন্যু নিশ্চয়ই এরই মধ্যে স্বর্গে পৌঁছে গিয়েছেন।”
অর্জুন একসময় শোক সামলে নিয়ে বজ্রকঠিন কণ্ঠে বলে উঠলেন, “কাল আমি জয়দ্রথকে নিশ্চিত হত্যা করব। কাল সূর্য অস্ত যাওয়ার মধ্যে জয়দ্রথকে মেরে আমি পুত্রহত্যার প্রতিশোধ নেব।”
কৌরবপক্ষে বড়-বড় বীরদের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ করতে অর্জুন পরাঙ্খুখ নন, তবু হঠাৎ শুধু জয়দ্রথের কথা বললেন কেন?
এর আগে আমরা সপ্তরথীর ছ’জনের কথা জেনেছি। জয়দ্রথই হচ্ছেন তার সপ্তম। আর এই জয়দ্রথ অভিমন্যুকে বিভিন্ন জায়গায় বাধা দেওয়ার জন্য ঘোরাঘুরি করেছেন। বলা যায়, তাঁর তৎপরতাতেই অভিমন্যু কিছুতেই বেরোতে পারেননি সেই ব্যূহ ভেঙে। সুতরাং জয়দ্রথকেই বলা যায়, অভিমন্যু হত্যার প্রধান উদ্যোগী।
এ ছাড়াও জয়দ্রথের উপর আগে থেকেই অর্জুনের খুব রাগ ছিল।
কৌরবরা একশো, আর পাণ্ডবেরা পাঁচজন। এই একশো-পাঁচজন ভাইয়ের সঙ্গে ছিল একটি মাত্র বোন, তাঁর নাম দুঃশলা। সেই দুঃশলার সঙ্গেই বিয়ে হয়েছে জয়দ্রথের। এই জয়দ্রথ লোকটি একটি দেশের রাজা এবং সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করতেও জানেন। কিন্তু মানুষ হিসেবে মোটেই ভাল নন। তাঁর ছোটখাটো অনেক অন্যায় ভাইদের চোখে পড়েছে। তবু তাঁরা তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
একবার তো জয়দ্রথ এমন কাণ্ড করেছিলেন যে, তক্ষুনি অর্জুন বা ভীম তাঁকে হত্যা করতে পারতেন। তখন পাণ্ডবেরা নির্বাসনের মধ্যে জঙ্গলে ঘুরছেন। রাত কাটাচ্ছেন। কোনও কুটিরে। সেদিন পাঁচ ভাই-ই গিয়েছেন শিকার বা না কোনও কাজে। তারই মধ্যে জয়দ্রথ এসে পড়ে দ্রৌপদীকে জোর করে নিজের রথে তুলে নেন।
তিনি বারবার বলতে থাকেন, দ্রৌপদীর মতন রূপসি সারা পৃথিবীতে কোথাও দেখেননি। দ্রৌপদীর তুলনায় অন্য সব নারীকেই মনে হয় মেয়ে-বাঁদরের মতন। সুতরাং দ্রৌপদীকে তাঁর চাই-ই চাই।
দ্রৌপদী অবশ্য এই ঘটনায় ভয় পাননি। তিনি তেজের সঙ্গে বারবার জয়দ্রথকে জানিয়েছিলেন, তাঁর পাঁচজন স্বামী যখন এই ব্যাপারটা জানতে পারবেন, তখন জয়দ্রথের যে কী অবস্থা হবে, তা তিনি নিজেই কল্পনা করতে পারবেন না!
যথাসময়ে পঞ্চপাণ্ডব এই ঘটনা জানতে পেরে জয়দ্রথের রথ আটকে দাঁড়ালেন। প্রচণ্ড ক্রোধে ভীম বা অৰ্জুন তৎক্ষণাৎ জয়দ্রথকে কুচিকুচি করে ফেলতে পারতেন। কিন্তু ভীম আর অর্জুন রাগে ফুঁসতে থাকলেও যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে তাঁরা নিবৃত্ত হলেন। কারণ, জয়দ্রথ নিহত হলে তাঁদের বোনও যে বিধবা হয়ে যাবে। জামাই বলে কথা! অনেক পরিবারেই জামাইদের কিছু-কিছু বায়নাক্কা বা অপরাধ মেনে নিতেই হয়। কিন্তু আজ আর সেই পুত্রহন্তা জয়দ্রথকে ক্ষমা করার কোনও প্রশ্নই নেই।
সেইজন্যই অর্জুন বারবার বলতে লাগলেন, কাল সূর্যাস্তের আগেই জয়দ্রথকে হত্যা করবেন। আর যদি তা না পারেন, তা হলে তিনি আত্মহত্যা করবেন নিজেই।
যথাসময়ে গুপ্তচরদের মুখে অর্জুনের এই ভয়ংকর প্রতিজ্ঞার কথা পৌঁছল এসে কৌরবশিবিরের কাছে। তাতে অনেকে ভয় পেলেও কেউ-কেউ খুশিও হলেন। কারণ, কাল সারাদিন যদি জয়দ্রথ দূরে কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকেন, তা হলে অর্জুন আর তাঁর খোঁজই পাবেন না। তাঁকে মারবেনই বা কী করে? সুতরাং তিনি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হবেন।
জয়দ্রথ অবশ্য রণক্ষেত্র ছেড়ে দূরে কোথাও যেতে রাজি হতে চান না। তিনিও তো একজন রাজা! যুদ্ধবিদ্যায় তাঁর খ্যাতিও আছে। সুতরাং ক্ষত্রিয় হিসেবে রণক্ষেত্র ছেড়ে তাঁর পলায়ন মোটেই শোভা পায় না। অন্য বীরেরা ঠিক করলেন, তাঁরা সব সময় অর্জুনের মুখোমুখি হয়ে তাঁকে ব্যস্ত রাখবেন, যাতে তিনি নিতে না পারেন এই চরম প্রতিশোধ।
সেরকমই ঘটতে লাগল পরের দিন।
অর্জুন কিছুতেই সুযোগ পেলেন না জয়দ্রথের মুখোমুখি হওয়ার। ক্রমশ দিনের আলো কমে এল। আকাশের দিকে তাকালেই মনে হয় সন্ধ্যা আসন্ন। সত্যি-সত্যিই সন্ধ্যা এসে গেল।
এর পর তো যুদ্ধ থেমে যাওয়ার কথা।
কৌরবদল আনন্দে ধ্বনি দিতে লাগলেন। জয়দ্রথও দেখা দিলেন প্রকাশ্যে। অর্জুন এখন কী করবেন? তিনি কি নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য এখন যাবেন আত্মহত্যা করতে?
অর্জুনের সারথি কৃষ্ণ বললেন, “সখা, এবার তুমি ওই পাপী জয়দ্রথকে হত্যা করো।”
অর্জুন বিভ্রান্ত হয়ে ভাবতে লাগলেন, সেটা কী করে সম্ভব! তার প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী তো দিন শেষ হয়ে গিয়েছে!
কৃষ্ণ তবু বললেন, “যাও, যাও, ওকে শাস্তি দাও।”
তখন একটা অলৌকিক ব্যাপার ঘটতে লাগল। আকাশের মেঘগুলো যেন নিজেদের ইচ্ছে মতো সরে যেতে লাগল। ফুটে উঠল আবার বিকেল। সন্ধ্যা হতে যেন এখনও বেশ কিছুটা সময় বাকি।
কৃষ্ণ বললেন, “আমি আসলে সূর্যকে আড়াল করে রেখেছিলাম। তাই আকাশে তাকে দেখা যায়নি। অন্ধকারটাকে সবাই স্বাভাবিক বলে ভেবেছিল।”
কৌরবশিবিরেও এক দারুণ বিভ্রান্তি দেখা গেল। সূর্য আবার ফিরে এলেন! তার মানে কি, সন্ধ্যা এখনও হয়নি?
এর পর তো জয়দ্রথকে হত্যা করা অর্জুনের পক্ষে আর কিছুই নয়!
সঞ্জয়ের মুখে এই কাহিনি শুনতে-শুনতে রাজা ধৃতরাষ্ট্র হতাশভাবে বললেন, “আমার পুত্ররা তো এক-এক করে মরছেই, এখন আমার জামাইটাও গেল!”
আবার পরদিন দু’পক্ষই মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন যুদ্ধক্ষেত্রে। যুদ্ধ শুরু হতেই কত রকম কোলাহল ও অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা যেতে লাগল। কোথাও পরাজয়ের চিৎকার, কোথাও জয়ের হর্ষধ্বনি।
কিছুক্ষণ বাদে সঞ্জয় বললেন, “মহারাজ, আমরা আগেই দেখেছি এক-এক দিন এক-এক জন যোদ্ধা যেন বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে রণক্ষেত্র দাপিয়ে বেড়ায়। আজও তো দেখছি সেরকমই ঘটছে। যেমন, একদিন প্রধান ভূমিকা ছিল অর্জুনের পুত্র অভিমন্যুর। আজ দেখা যাচ্ছে, ভীমের পুত্র ঘটোৎকচ সেই ভূমিকা নিয়েছে।”
ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “এই ঘটোৎকচটা কে যেন? ওকে কি আমি আগে দেখেছি?”
সঞ্জয় বললেন, “হ্যাঁ, আপনি দু’-একবার দেখেছেন। পাণ্ডবরা যখন প্রথমবার বনে-বনে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, এটা সেই সময়কার কথা। দ্রৌপদী তখন ছিলেন না।”
হিড়িম্বা নামে এক রাক্ষসী এসে দাঁড়িয়েছিল ওদের সামনে। তার ভাইয়ের নাম হিড়িম্ব। সেই হিড়িম্ব পাণ্ডবদের, দ্রৌপদী ও কুন্তীকে গিলে খেয়ে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু বেচারা তো জানত না, এই মানুষদের মধ্যে একজন রয়েছে, যার নাম ভীম। সে একশোটা রাক্ষসকেও ভয় পায় না। সুতরাং শুরু হল হিড়িম্বর সঙ্গে ভীমের যুদ্ধ। বলাই বাহুল্য, সেই ঘোরতর যুদ্ধ বেশ কিছুক্ষণ চললেও শেষ পর্যন্ত ভীম ওই রাক্ষসকে পাঠিয়ে দিলেন যমের বাড়ি।
হিড়িম্বা অবশ্য সেই উদ্দেশ্য নিয়ে আসেনি। রাক্ষসীরূপের বদলে সে এসেছে এক সুন্দরী মহিলা সেজে। সে ভীমকে দেখে এতই মুগ্ধ যে, ভীমকে বিয়েও করতে চায়। কিন্তু এরই মধ্যে যখন বোঝা গেল যে, হিড়িম্বাও একটা রাক্ষসী, তখন ভীম তাকে হত্যা করতে গেলেন।
হিড়িম্বা এমন কান্নাকাটি শুরু করল যে, অন্যদের মনে হল, আহা, এই রমণীটি রাক্ষসী হলেও স্বভাব-চরিত্রে মানুষের মতো। সে গিয়ে কুন্তীর পায়ে পড়তেই কুন্তী তাঁর ছেলেকে বললেন, “বাবা ভীম, এই মেয়েটিকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। তুই ওকে বিয়ে করে ফ্যাল।”
মায়ের যে-কোনও কথাই আদেশের মতো। তাই ভীম কুন্তীর বাক্য উপেক্ষা করতে পারলেন না। তিনি রাজি হয়ে গেলেন।
পঞ্চপাণ্ডবই দ্রৌপদীর স্বামী। কিন্তু সেকালের রীতি অনুযায়ী, এঁদের দু’-চার জন স্ত্রী থাকায় কোনও বাধা ছিল না।
তারপর একসময় ওঁদের একটি পুত্রসন্তান জন্মায়।
মহারাজ, আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, রাক্ষস কিংবা দেবতাদের কোনও সন্তান জন্মালে তাদের সুদীর্ঘকাল শৈশব কাটাতে হয় না। জন্মের অল্প সময় পরেই তারা সাবালক হয়ে যায়।
হিড়িম্বার সেই সন্তানটি ভীমের দিকে তাকিয়ে বিনীত ভাবে বলল, “বাবা, আপনারা এই জঙ্গলের বাইরে গেলে, আমাদের সঙ্গে আর দেখা হবে না। কিন্তু আমি চিরকাল আপনাকে মনে রাখব। যখনই আমাকে আপনার প্রয়োজন হবে, আমি এসে দাঁড়াব আপনার পাশে। আর কোনও কিছু লাগবে না। শুধু আমার কথা চিন্তা করলেই হবে।”
মহারাজ, সেই ছেলেটির নামই ঘটোৎকচ। এত বড় যুদ্ধের খবর তো সবদিকেই পৌঁছে যায়। তাই ঘটোৎকচ এসে দাঁড়িয়েছে তার বাবার পাশে। ছেলেটি বেশ নম্র, ভদ্র। কিন্তু চেহারা দেখলেই শত্রুপক্ষের ভয় করে। সে অন্য সব মানুষের তুলনায় অনেক লম্বা। গায়ের রং মিশমিশে কালো। ভয় হয় সত্যিই। আর সে যে যুদ্ধবিদ্যাতেও এতখানি দক্ষ, সেটাও আগে অনেকের জানা ছিল না।
আজ সে এমন ভাবে সমস্ত রণক্ষেত্র জুড়ে দাপট দেখাতে লাগল, যেন কেউ-ই তার মুখোমুখি হতে পারছে না। এমনকী, বড়-বড় যোদ্ধারাও তার সঙ্গে টক্কর দিতে পারলেন না বেশিক্ষণ। এক-এক সময় মনে হল যে, ঘটোৎকচই বুঝি আজকের যুদ্ধে সবাইকে শেষ করে দেবে।
তাই দুর্যোধন কর্ণর কাছে গিয়ে বললেন, “বন্ধু, তুমি ছাড়া তো আর কেউ এই রাক্ষসটাকে মেরে ফেলতে পারবে না। আজ একে থামাতে না পারলে নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনব।”
কর্ণর আসল যুদ্ধ তো হবে অর্জুনের সঙ্গে। তাই কর্ণ ভীমের ছেলের সঙ্গে লড়াই করার জন্য মনে-মনে একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। তবু দুর্যোধনের অনুরোধে তিনি সম্মুখীন হলে ঘটোৎকচের। কিছুক্ষণ ঘোর যুদ্ধের পরেও কর্ণ দমন করতে পারলেন না ঘটোৎকচকে।
তখন কর্ণ একটি বিশেষ বাণ সরাসরি ঘটোৎকচের বক্ষে নিক্ষেপ করলেন। তাতেই ধরাশায়ী হয়ে গেল ঘটোৎকচ। তার অত বড় মৃতদেহের চাপে পড়েও মৃত্যু হল কৌরবপক্ষের অনেক সেনার। এত বড় একজন শত্রু নিপতিত হয়েছে বলে কৌরবশিবিরে একটা দারুণ আনন্দের কোলাহল শুরু হয়ে গেল।
কিন্তু পাণ্ডবপক্ষেও এ কী, এ কী, এটা কী হচ্ছে! আমি তো দেখতে পাচ্ছি, ঘটোৎকচের মৃত্যু উপলক্ষে কৃষ্ণও এত আনন্দিত হয়েছেন যে, তিনি নাচতে শুরু করে দিয়েছেন।
ধৃতরাষ্ট্র বিস্মিত হয়ে বললেন, “সে কী! ওই রাক্ষসটা তো শুধু ভীমের ছেলেই নয়, সে পাণ্ডবপক্ষকে এতখানি সাহায্য করছিল, তার মৃত্যুতে কৃষ্ণ আনন্দিত বা হবেন কেন, নাচতে শুরু করবেনই বা কেন?”
সঞ্জয় বললেন, “কৌরবপক্ষের অনেকেই তা বুঝতে পারছেন না। কৃষ্ণর ব্যবহার দেখে তাঁরা অনেকেই বিস্মিত আর বিরক্ত। কিন্তু আমি কারণটা অনেকটা বুঝতে পেরেছি।”
কর্ণ অর্জুনকে পরাজিত করার জন্য তাঁর একটা বিশেষ অস্ত্র আলাদা করে রেখেছিলেন। তার নাম একাঘ্নী বাণ। সেই বাণ কারও দিকে ধাবিত হলে, তাকে মৃত্যুবরণ করতেই হবে। এর থেকে বাঁচার কোনও পথ নেই। আর ঘটোৎকচকে মারতে গিয়ে কর্ণ বাধ্য হয়ে তাঁর সেই অস্ত্র খরচ করে ফেললেন। তাতে অর্জুনের বিপদ অনেক কমে গেল।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘আমাদের মহাভারত’ এই পর্যন্ত লিখেছিলেন। পাঠকদের কৌতূহল মেটাতে আমরা মহাভারত-এর বাকি অংশটুকু সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করলাম।
ঘটোৎকচের মৃত্যুর পর দ্রোণ আবার পাণ্ডব সৈন্যদের মারতে লাগলেন। তাঁর সামনে পাণ্ডবরা কেউ দাঁড়াতে পারলেন না। তখন কৃষ্ণ পরামর্শ দিলেন, দ্রোণকে ঠেকানোর একটাই উপায়, কেউ তাঁর সামনে গিয়ে বলুক, “অশ্বত্থামা মারা গিয়েছে।”
অর্জুন তো গুরুকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। তাই তিনি রাজি হলেন না এ কাজ করতে। বাকিরা অবশ্য আপত্তি করলেন না। এমনকী, যুধিষ্ঠিরও সায় দিলেন কৃষ্ণর প্রস্তাবে। পাণ্ডবপক্ষের ইন্দ্রবর্মার একটা হাতি ছিল, যার নাম অশ্বত্থামা। পরিকল্পনা মতো গদা দিয়ে সেই হাতিটা মেরে ভীম গিয়ে দ্রোণের সামনে বললেন, “অশ্বত্থামা মরে গিয়েছে।”
অশ্বত্থামার মৃত্যুর কথা হঠাৎ কানে আসায় দ্রোণ যুদ্ধ থামিয়ে দিলেন। তারপরই তাঁর মনে হল, আরে, অশ্বত্থামা তো অমর! ও কীভাবে মরবে? তবু বাবার মন তো! এমন খবর শুনলে কি স্থির থাকা যায়? দ্রোণ জানতেন, যুধিষ্ঠির সব সময় সত্যি কথা বলেন। দ্রোণ তখন যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে বললেন, “যুধিষ্ঠির, এটা কি সত্যি যে অশ্বত্থামা মারা গিয়েছে?”
কিন্তু দ্রোণ ভাবতেও পারেননি, তাঁর শিষ্য সত্যবাদী যুধিষ্ঠির, এভাবে তাঁর সঙ্গে চালাকি করবেন। যুধিষ্ঠির করেছিলেন কী, তিনি জোরে দ্রোণকে শুনিয়ে বললেন, “অশ্বত্থামা হত।”
তারপর নিচু গলায় বললেন, “ইতি গজ।”
কৃষ্ণর বুদ্ধি সফল হল। দ্রোণ যুদ্ধের হইচইয়ের মাঝখানে শুধু শুনলেন , “অশ্বত্থামা হত।”
কোনও বাবা কি পারেন, ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে ঠিক থাকতে? দ্রোণও পারলেন না। তিনি অস্ত্র ত্যাগ করলেন। সেই সুযোগে ধৃষ্টদ্যুম্ন বধ করলেন দ্রোণকে।
দ্রোণ মারা যেতে কর্ণ হলেন কৌরবপক্ষের সেনাপতি। কিন্তু কর্ণর কোনও ভাল সারথি ছিল না। তাই কর্ণ চাইলেন, শল্যকে নিজের রথের সারথি করত। সেকথা শুনে শল্য ভারী রেগে গেলেন। তবু দুর্যোধন অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাঁকে রাজি করালেন। কর্ণ মহাদাপটে পাণ্ডবদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
এরই মধ্যে যুদ্ধের অন্য এক প্রান্তে লড়াই লাগে ভীম আর দুঃশাসনের। ভীমের সঙ্গে দুঃশাসনের বহুদিনের শত্রুতা। পাশা খেলায় যুধিষ্ঠির হেরে যাওয়ার পর দ্রৌপদীর চুলের মুঠি ধরে দুঃশাসনই টানতে-টানতে তাঁকে রাজসভায় নিয়ে আসেন। তখনই ভীম শপথ নিয়েছিলেন, একদিন দুঃশাসনকে মেরে তাঁর বুকের রক্ত পান করবেন। এবার ভীম সেই সুযোগ পেয়েছেন। গদার আঘাতে ঘায়েল করে তিনি চড়ে বসলেন দুঃশাসনের উপর। তারপর দুঃশাসনের বুক চিরে রক্তপান করতে থাকেন।
ওদিকে হয়েছে কী, অর্জুন আর কর্ণ তো এবার মুখোমুখি। দু’জনেই পরস্পরের দিকে প্রবল বিক্রমে তির ছুড়তে লাগলেন। কিন্তু যুদ্ধ যখন চরম পর্যায়ে তখন কর্ণর রথের চাকা মাটিতে বসে যেতে থাকল। এর পিছনে রয়েছে আরও দু’টো ঘটনা। কর্ণ অস্ত্রবিদ্যা শিখেছিলেন পরশুরামের কাছে। পরশুরাম ক্ষত্রিয়দের পছন্দ করতেন না। অথচ কর্ণ তো আসলে ক্ষত্রিয়। কর্ণ করেছিলেন কী, নিজের পরিচয় চেপে গিয়ে পরশুরামকে বলেছিলেন, “আমি ব্রাক্ষণ।”
পরশুরাম সরল মনে কর্ণকে বিশ্বাস করে তাঁকে নানা অস্ত্রবিদ্যা শেখালেন। তারপর একদিন তিনি জানতে পারলেন, কর্ণ ব্রাক্ষণ নন, ক্ষত্রিয়। আর যান কোথায়! তৎক্ষণাৎ পরশুরাম অভিশাপ দিলেন, “মুত্যুর সময় তুমি এই বিদ্যা ভুলে যাবে।”
এখানেই শেষ নয়। কর্ণ একবার ভুল করে এক ব্রাহ্মণের বাছুর মেরে ফেলেছিলেন। সেই ব্রাহ্মণ বাছুরের দুঃখে কাতর হয়ে কর্ণকে শাপ দিয়েছিলেন, “যুদ্ধের সময় তোমার মনে যখন আতঙ্ক হবে, তখন তোমার রথের চাকা মাটিতে বসে যাবে।”
অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ নিয়ে কর্ণর মনে আতঙ্ক ছিলই। ফলে তাঁর রথের চাকা মাটিতে গেঁথে যায়। কর্ণ অনেক টানাটানি করেও সেই চাকা তুলতে পারলেন না। বাধ্য হয়ে অর্জুনের উদ্দেশে বললেন, “অর্জুন, তুমি তো ভারী ধার্মিক। একটু দাঁড়াও, আমি আগে রথের চাকা তুলে নিই। তারপর আবার যুদ্ধ করব।”
অর্জুন কিছু বলার আগে কৃষ্ণ বললেন, “কর্ণ, নিজের রথের চাকা মার্টিতে গেঁথে যাওয়ায় তোমার ধর্মের কথা মনে পড়েছে। কিন্তু যখন ভীমকে বিষ খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলে, দ্রৌপদীকে সভায় এনে অপমান করেছিলে, যুধিষ্ঠিরকে ছল করে পাশা খেলায় হারিয়েছিলে, জতুগৃহে পাণ্ডবদের পোড়াতে গিয়েছিলে, সবাই মিলে অভিমন্যুকে বধ করেছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল?”
কর্ণ কোনও উত্তর দিতে পারলেন না। আর অর্জুন তির ছুড়ে তক্ষুনি কর্ণকে মেরে ফেললেন। এর পর একা দুর্যোধন ছাড়া কৌরবশিবিরে আর কোনও বড় বীর রইলেন না। তবু শল্যকে সেনাপতি করে যুদ্ধ চালাতে লাগলেন দুর্যোধন। কিন্তু সেই যুদ্ধে তাঁর বাকি ভাইরা মারা পড়ল। মারা পড়লেন শল্যও। সহদেব বধ করলেন শকুনিকে। কৌরবসৈন্যরা ততক্ষণে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে শুরু করেছেন। দুর্যোধন ছাড়া শুধু কৃপ, কৃতবর্মা বেঁচে রইলেন। বিপদ বুঝে দুর্যোধন দ্বৈপায়ন হৃদের জলের তলায় লুকোলেন। সেই খবর পেয়ে পাণ্ডবরাও হৃদের ধারে এসে দুর্যোধনকে যুদ্ধের জন্য ডাকতে লাগলেন।
সেই ডাকে থাকতে না পেরে দুর্যোধন বেরিয়ে এলেন। ঠিক হল, ভীম এবং দুর্যোধন গদাযুদ্ধ করবেন। ততক্ষণে দু’জনের গুরু বলরামও সেখানে হাজির। সবাই মিলে গেলেন কুরুক্ষেত্রে। শুরু হল দু’জনের গদাযুদ্ধ। সেই যুদ্ধ দেখে কৃষ্ণ বুঝতে পারলেন, দুর্যোধনকে হারানো মুশকিল। তাই কৃষ্ণ ইশারায় ভীমকে বললেন, দুর্যোধনের ঊরুতে আঘাত করতে। আসলে গদাযুদ্ধের নিয়ম হল, নাভির নীচে আঘাত করা যাবে না। কিন্তু ভীমও লড়াই করতে-করতে টের পাচ্ছিলেন দুর্যোধনকে সরাসরি হারানো সম্ভব নয়। সেই জন্য দুর্যোধন একবার লাফিয়ে উঠতেই ভীম গদার বাড়ি মারলেন তাঁর ঊরুতে। সেই আঘাতেই পড়ে গেলেন দুর্যোধন। কিন্তু ভীমের এই আচরণে অনেকেই ছি ছি করে উঠলেন। বলরাম তো ভীষণ রেগে গেলেন। অনেক কষ্টে কৃষ্ণ শান্ত করলেন তাঁকে।
দুর্যোধনকে ওখানে ফেলে পাণ্ডবরা গেলেন শিবিরে। তবে কৃষ্ণর কথা শুনে তাঁরা শিবিরে না থেকে চলে যান নদীর ধারে।
সেই রাতে দুর্যোধনের কাছে আসেন অশ্বত্থামা, কৃপ, কৃতবর্মা। মর-মর অবস্থায় দুর্যোধন তখন অশ্বত্থামাকে সেনাপতি করলেন। সেই রাতে পাণ্ডবশিবিরে ঢুকে অশ্বত্থামা হত্যা করলেন সব ঘুমন্ত বীরদের। শিবিরের বাইরে তখন পাহারা দিয়েছেন কৃপ এবং কৃতবর্মা। সেই খবর দুর্যোধনকে দেওয়ার পর তিনি মহানন্দে মারা গেলেন।
পরদিন পাণ্ডবরা নদীর ধার থেকে ফিরে সব জানতে পারলেন। ভীম, অর্জুন, যুধিষ্ঠির এবং কৃষ্ণ এবার অশ্বত্থামার খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। কিছুদূর যাওয়ার পর অশ্বত্থামার দেখা মিলল। পাণ্ডবদের এবং কৃষ্ণকে দেখেই অশ্বত্থামা ব্রহ্মশির অস্ত্র ছুড়লেন। অর্জুনও ছুড়লেন দ্রোণদও অস্ত্র। তখন নারদ এবং ব্যাসদেব এসে এই দুই অস্ত্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দু’জনকে অস্ত্র সংবরণ করতে বললেন। না হলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু একবার অস্ত্র ছুড়লে তার ফলে তো কিছু ক্ষতি হবেই। তাই অর্জুনের অস্ত্রের ফলে অশ্বত্থামার মাথার মণি পাণ্ডবরা পেলেন। আর ওদিকে অভিমন্যুর শিশুপুত্র মারা গেল। তবে কৃষ্ণ এসে আবার শিশুটিকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যুধিষ্ঠির রাজা হলেন। তারপর তিনি গেলেন ভীষ্মের কাছে। কীভাবে রাজ্য চালাতে হয় মারা যাওয়ার আগে তা নিয়ে ভীষ্ম প্রচুর উপদেশ দিলেন যুধিষ্ঠিরকে। রাজা হওয়ার পর যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞও করেন।
কিন্তু ওদিকে ধৃতরাষ্ট্র আর গান্ধারী হস্তিনাপুরে থেকে স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। তাঁদের সব ছেলে মারা গিয়েছেন। তা ছাড়া তাঁদের বয়সও বেড়েছে। সেই জন্য ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী, বিদুর, সঞ্জয় বনে গিয়ে তপস্যা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁরা বনে যাওয়ার তিন বছর বাদে, সেই বনে আগুন লাগে। তাতে ধৃতরাষ্ট্র, কুন্তী, গান্ধারী পুড়ে মারা যান।
অন্যদিকে যুধিষ্ঠির ছত্রিশ বছর রাজত্ব করার পর এমন কিছু ঘটনা হতে থাকল, যাতে বোঝা গেল বিপদ আসছে। সেই বিপদ এল অন্যভাবে। একদিন কৃষ্ণর বংশের সবাই গেলেন প্রভাস তীর্থে। সেখানে নিজেদের মধ্যে সামান্য ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া বাধে। তখন মারামারির ফলে কৃষ্ণ-বলরাম ছাড়া সবাই মারা পড়লেন। একজনকে দিয়ে হস্তিনাপুরে খবর পাঠিয়ে, রাজ্যের মেয়েদের বাবা বসুদেবের কাছে রেখে কৃষ্ণ যখন বলরামের সামনে এলেন, তখন দেখলেন বলরামের মুখ দিয়ে এক ভয়ংকর সাপ বেরিয়ে আসছে। কৃষ্ণ বুঝলেন, বলরাম দেহত্যাগ করলেন। তিনি তখন জঙ্গলের এক জায়গায় শুয়ে থাকলেন। দূর থেকে তাঁকে দেখে এক ব্যাধের মনে হল, ওটা বোধ হয় কোনও হরিণ। তাই সে তির ছুড়ে মারল। সেই তিরে মৃত্যু হল কৃষ্ণর।
অর্জুন যখন দ্বারকায় এসে পৌঁছলেন তখন সব শেষ। তিনি করলেন কী, দ্বারকার মেয়েদের নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থের দিকে রওনা হলেন। কিন্তু মাঝপথে ডাকাতরা হামলা করে। অবাক কাণ্ড, অত বড় বীর অর্জুন, তিনিও গাণ্ডিব তুলে ডাকাতদের মারতে পারলেন না। ডাকাতরা সব লুটপাট করে চলে গেল।
অর্জুনের কাছে সব শুনে যুধিষ্ঠির বুঝলেন, তাঁদের এবার মহাপ্রস্থানের পথে রওনা দেওয়ার সময় এসে গিয়েছে। তখন পরীক্ষিৎকে রাজা ঘোষণা করে পাণ্ডবভাইরা এবং দ্রৌপদী যাত্রা শুরু করলেন। তাঁদের সঙ্গে চলল একটা কুকুরও। সেই মহাপ্রস্থানের পথে একে-একে দ্রৌপদী, সহদেব, নকুল, অর্জুন, ভীম পড়ে গেলেন। ভীমের প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির বলতে থাকেন, কোন পাপে কার পতন হয়েছে। অবশেষে স্বশরীরে স্বর্গে পৌঁছলেন যুধিষ্ঠির। দেবতারা যখন যুধিষ্ঠিরকে স্বর্গে নিতে চাইলেন, যুধিষ্ঠির তখন কুকুরটিকে সঙ্গে নেওয়ার কথা জানালেন। সেই মুহূর্তে কুকুরটি নিজের রূপ বদলাল। দেখা গেল, কুকুরটি সাক্ষাৎ ধর্ম। যুধিষ্ঠিরকে পরীক্ষা করার জন্যই কুকুর সেজেছিলেন।
স্বর্গে গিয়ে যুধিষ্ঠির দেখলেন, সেখানে তাঁর ভাইয়েরা এবং দ্ৰৌপদী নেই। কিন্তু দুর্যোধন মহানন্দে স্বর্গে রয়েছেন। যুধিষ্ঠির খুব অবাক হলেন। দেবতাদের কাছে তিনি জানতে চাইলেন, অন্য পাণ্ডবভাইরা আর দ্রৌপদী কেন স্বর্গে নেই? আর এত কুকর্ম করার পর দুর্যোধনই বা কীভাবে স্বর্গে আসতে পারেন!
নারদ তখন যুধিষ্ঠিরকে বোঝালেন, দুর্যোধন ধর্মযুদ্ধে মারা গিয়েছেন। আর বিপদে পড়লেও তিনি কখনও ভয় পাননি। সেই জন্য মৃত্যুর পর দুর্যোধন স্বর্গে এসেছেন।
সেই কথা শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, “আমার ভাইয়েরা এবং দ্রৌপদীকে ছাড়া আমি স্বর্গে কীভাবে থাকব? ওদের দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। ওরা যেখানে আছে, সেটাই আমার স্বর্গ।”
যুধিষ্ঠিরের দুঃখ দেখে দেবতারা তখন একজন দেবদূতকে ডেকে নির্দেশ দিলেন, তাঁকে আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করানোর জন্য।
দেবদূত এর পর যুধিষ্ঠিরকে নিয়ে চললেন সেই পথে। কিছু দূর গিয়েই যুধিষ্ঠির টের পেলেন পথ বড় ভয়ংকর। পাপীরাই শুধু ওই অন্ধকার, পচা-গলা মৃতদেহ পড়ে থাকা পথ দিয়ে যাতায়াত করে। আবার আগুনের আঁচও এসে লাগছে। মাথার উপর উড়ছে শকুনেরা। যুধিষ্ঠির আর থাকতে না পেরে দেবদূতকে জিজ্ঞেস করলেন, “আর কতটা যেতে হবে?”
দেবদূত বললেন, “মহারাজ, আপনার কষ্ট হলে দেবতারা আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বলেছেন। আপনি কি ফিরবেন?”
যুধিষ্ঠির তখন ঠিক করলেন ফিরে যাবেন। যেই তিনি ফিরতে গেলেন, অমনি চারদিক থেকে করুণ স্বরে কারা বলতে লাগল, “যাবেন না মহারাজ! আর একটু থাকুন। আপনি আসায় অনেকদিন বাদে চারপাশ ঠান্ডা হয়েছে।”
যুধিষ্ঠিরের বড় মায়া হল। তাই তিনি জানতে চাইলেন, “তোমরা কারা?”
এবার যুধিষ্ঠিরের আশপাশ থেকে শব্দ আসতে থাকল।
কেউ বলল, “আমি ভীম।”
কেউ বলল, “আমি অর্জুন।”
কেউ বলল, “আমি দ্রৌপদী।”
যুধিষ্ঠির তৎক্ষণাৎ দেবদূতকে বললেন, “আপনি স্বর্গে গিয়ে দেবতাদের বলুন, আমি এখানেই থাকব। ভাইদের পেয়ে আমি সুখী হয়েছি।”
দেবদূতের কাছে এ কথা জানার পর সব দেবতারা সেই ভয়ংকর জায়গায় এলেন। ইন্দ্র এসে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “মহারাজ, আপনি আর আপনার ভাইয়েরা যে পাপ করেছেন, তার জন্যই সকলকে একবার নরকে আসতে হল। এবার আপনারা স্বর্গে চলুন।”
কিন্তু যুধিষ্ঠিরের মতো মানুষ আবার কোন পাপে নরকে এলেন! আসলে এই নরকদর্শন যুধিষ্ঠিরের দরকার ছিল। কারণ, দ্রোণকে “ইতি গজ,” কথাটী ফিসফিসিয়ে বলে তিনি পাপ করেছিলেন। একবার নরকদর্শনে সেই পাপ কেটে গেল।
ধর্ম তখন যুধিষ্ঠিরকে নিয়ে গেলেন মন্দাকিনী নদীতে। ওই নদীর জলে স্নান করলে মানুষের শোক, দুঃখ, হিংসে, রাগ কিছুই থাকে না।
যুধিষ্ঠির মন্দাকিনী নদীতে স্নান করার পর মানব শরীর ত্যাগ করে স্বর্গে গেলেন। সেখানে গিয়ে যুধিষ্ঠির বাকি ভাইদের, দ্রৌপদী এবং অন্য আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দিন কাটাতে লাগলেন।