অধ্যায় ১৩ — স্টয়িসিজম ও মানসিক স্বাস্থ্য
আগে যেখানে অনেক শিক্ষাগত সমস্যার সুরাহা (খুবই অসফলভাবে) করা হতো নিছক নৈতিক শৃঙ্খলা দ্বারা, সেসব সমস্যা এখন আধুনিক মনোবিজ্ঞানের সাহায্যে আরো অপ্রত্যক্ষভাবে কিন্তু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সমাধা করা হয়। বিশেষত মনঃসমীক্ষণ সম্পর্কে যাদের জ্ঞান সীমিত তারা মনে করেন স্টয়িক আত্ম-পরিচালনার কোনো দরকার নেই। আমি এই মতের অনুসারী নই। বর্তমান নিবন্ধে আমার অভিপ্রায় হলো যেসব পরিস্থিতি একে দরকারি করে তোলে এবং যেসব পদ্ধতিতে এটা তরুণদের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট করা যায় তা বিবেচনা করা; এই অবস্থা সৃষ্টির জন্য কিছু বিপদ এড়ানোর উপায়ও বিবেচনা করতে চাই।
আমরা এখনি সবচেয়ে দুরূহ এবং সবচেয়ে দরকারি সমস্যা নিয়ে নিবন্ধের সূচনা করব। এই সমস্যার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার স্টয়িসিজম: আমি মৃত্যুর কথা বলছি। বিভিন্ন উপায়ে মৃত্যু-ভয় মোকাবেলার চেষ্টা করা যেতে পারে। আমরা একে এড়িয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করতে পারি; আমরা কখনো এর উল্লেখ পর্যন্ত না করতে পারি, এবং সবসময়ই মৃত্যু-চিন্তা এলে আমাদের ভাবনা ভিন্নমুখী করতে পারি। ওয়েলসের টাইম মেশিনের প্রজাপতি জনগণের পদ্ধতি এটাই ছিল। কিংবা আমরা উল্টো পথও অবলম্বন করতে পারি এবং বিরামহীনভাবে মানবজীবনের স্বল্পায়ু সম্পর্কে ভাবতে বা ধ্যান করতে পারি, এই আশায় যে অতি-পরিচয় অবজ্ঞা জন্ম দেবে; পঞ্চম চার্লস সিংহাসন ত্যাগের পর নিভৃত জীবনে এই পথটাই বেছে নিয়েছিলেন। কেমব্রিজের একটি কলেজের জনৈক ফেলো এতদূর গিয়েছিলেন যে নিজের কক্ষে শবাধার নিয়ে ঘুমাতেন এবং ঐ কলেজের চত্বরে কোদাল নিয়ে যেতেন কৃমি দ্বি-খণ্ড করার জন্য। এবং নির্ভুলভাবে বলতেন: হয়েছে! তুমি এখনও আমাকে ধরতে পারনি। তৃতীয় একটি পন্থাও রয়েছে, এই পন্থাটি ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়, পন্থাটি হলো নিজেকে এবং অপরকে বোঝানো যে মৃত্যু মৃত্যু নয়। বরং মৃত্যু হলো নতুন ও উন্নততর জীবনের দরোজা। এই তিনটি পন্থা, বিভিন্ন অনুপাতে মিশ্রিত হয়ে অধিকাংশ মানুষকে এই আপসে পৌঁছায় যে অস্বাচ্ছন্দকর বাস্তবতা হলো মৃত্যু।
সে যাই হোক, এই প্রত্যেকটি পদ্ধতি সম্পর্কে আমার আপত্তি রয়েছে। আবেগগত কৌতূহলের কোনো বিষয় সম্পর্কে ভাবনা এড়ানোর চেষ্টা করা, যৌনতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ফ্রয়েডপন্থিরা যেমন উল্লেখ করেছেন, অসফল হতে বাধ্য, এবং এর পরিণাম দাঁড়ায় নানা ধরনের অবাঞ্ছনীয় বিকৃতি বা বিচ্যুতি। এখন অবশ্যই একটি বাচ্চা ছেলের জীবন থেকে মৃত্যু-চেতনা সরিয়ে রাখা সম্ভব হতে পারে। এটি ঘটে কি ঘটে না, তা ভাগ্যের ব্যাপার। যদি বাবা বা মা, ভাই বা বোন মারা যায়, তাহলে এমন কোনো উপায় নেই কিংবা কিছু করার থাকে না যাতে একটি বাচ্চা ছেলের মৃত্যু সম্পর্কে আবেগগত সচেতনতা অর্জনে বাধা দেওয়া যায়। এমনকি যদিও, ভাগ্যগুণে, একটি ছেলের প্রথম জীবনে মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবিতা স্বচ্ছ নাও হয়, শীঘ কিংবা বিলম্বে সে এই সচেতনতা অর্জন করবে; এবং যারা এ বিষয়ে একেবারেই অপ্রস্তুত তারা সচেতন হওয়ার পরই খুব সম্ভব অত্যন্ত ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে। অতএব মৃত্যুকে এড়িয়ে না গিয়ে, মৃত্যু সম্পর্কে আমাদের একটা দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠার অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে।
আবার বিরামহীনভাবে মৃত্যু-চিন্তার অভ্যাস অন্তত সমান ক্ষতিকর। কোনো একটা বিষয়ে খুবই একান্তভাবে চিন্তা ভুল, বিশেষত যখন আমাদের চিন্তা কার্যে পরিণত হতে পারে না। অবশ্য আমরা মৃত্যু মুলতবি রাখতে চেষ্টা করতে পারি, এবং সীমাবদ্ধতার ভেতর যে-কোনো স্বাভাবিক ব্যক্তি তা করে থাকেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা আমাদের মৃত্যুকে ঠেকাতে পারি না। অর্থাৎ এটি একটি লাভহীন চিন্তার বিষয়। উপরন্তু এটি একজন মানুষের অপরের প্রতি এবং ঘটনাবলির প্রতি কৌতূহল হ্রাস করে এবং বস্তুগত কৌতূহলই শুধু মানসিক স্বাস্থ্য সংরক্ষণ করতে পারে। মৃত্যু-ভয় মানুষকে এই বোধ তাড়িত করে যে সে বাহ্যিক শক্তির দাস, এবং দাস মনোবৃত্তি থেকে সুফল আসতে পারে না। যদি কোনো ব্যক্তি গভীর ধ্যান করে সত্যিই মৃত্যু ভয় থেকে আরোগ্য লাভ করতে পারেন, তাহলে তিনি এ বিষয়ে ভাবনায় ক্ষান্তি দেবেন। যতক্ষণ তিনি এই চিন্তায় নিমগ্ন থাকবেন, তা প্রমাণ করবে যে তিনি মৃত্যু ভয় ছাড়তে পারেন নি। অতএব এই পদ্ধতি অন্য পদ্ধতি থেকে উন্নততর নয়।
মৃত্যু উন্নততর জীবনের দরোজা, এই বিশ্বাসে, যৌক্তিকভাবে, যে-কোনো ব্যক্তির যে-কোনো প্রকার মৃত্যু-ভয় বন্ধ করা উচিত। ডাক্তারি পেশার জন্য সৌভাগ্য যে বস্তুত এ ধরনের কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটে না। অবশ্য কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা এর মধ্যে ধরা হচ্ছে না। কেউ কি দেখতে পান, যারা মৃত্যুকে চরম পরিণতি মনে করেন তাদের চেয়ে ভবিষ্যৎ জীবনে বিশ্বাসীরা অসুখ-বিসুখ ব্যাপারে কম ভীত কিংবা যুদ্ধে অধিকতর সাহসী। স্বৰ্গত এফ, ডব্লু. এইচ, মাইয়ার্স বলতেন, তিনি কীভাবে এক নৈশ ভোজনোৎসবে জনৈক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন মৃত্যুর পর তার কী পরিণতি হবে বলে তিনি মনে করেন। ঐ ব্যক্তি প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু চাপ প্রয়োগ করা হলে জবাব দেন, ও হ্যাঁ, আমি চিরন্তন আশীর্বাদের উত্তরাধিকারী হবো, কিন্তু আমি আশা করব আপনি এ ধরনের অপ্রীতিকর বিষয়ে কথা বলবেন না। অবশ্যই এ ধরনের পরিষ্কার অসংলগ্নতার কারণ হলো ধর্মীয় বিশ্বাস শুধু অধিকাংশ মানুষের সজাগ চিন্তায় অস্তিত্বশীল, এবং কোনো মতেই মানুষের নিশ্চেতন কার্যকারিতা সংশোধন করতে সফল হয়নি। মৃত্যু-ভয় সফলভাবে মোকাবেলা করতে হলে, তা করতে হবে কতকগুলো পদ্ধতিতে, যা সামগ্রিকভাবে মানবিক আচরণ প্রভাবিত করে, শুধু, যাকে আমরা সাধারণভাবে বলি সজাগ-চিন্তা, আচরণের সেই অংশ প্রভাবিত করলে চলবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রভাব কাজ করতে পারে, কিন্তু মানবজাতির সংখ্যাগুরু এই প্রভাবের বাইরে থাকবে। আচরণগত যুক্তি ছাড়াও এই ব্যর্থতার আরো দুটি উৎস রয়েছে: একটি হলো আন্তরিক ধর্মানুরাগী হওয়া সত্ত্বেও নির্দিষ্ট কিছু সন্দেহ থেকে যায়, এবং এটা সংশয়বাদীদের মধ্যে ক্রোধের আকারে প্রকাশ পায়; অপর কারণটি হলো, ভবিষ্যৎ জীবনে বিশ্বাসীরা, তাদের বিশ্বাস যদি ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়, তাহলে মৃত্যুর সঙ্গে যে-আতংক জড়িত হবে তার মাত্রা কমানোর চেয়ে বাড়িয়ে দেয়, ফলে যারা এ ব্যাপারে সর্বাত্মক নিশ্চিত বোধ করেন না তাদের ভীতি বৃদ্ধি পায়।
তাহলে, অতঃপর, আমরা তরুণদের এই জগতের সঙ্গে মানিয়ে চলার জন্য কী করব, যেখানে মৃত্যু বাস্তব ঘটনা? আমাদের তিনটি লক্ষ্য অর্জন করতে হবে এবং এই লক্ষ্য তিনটি মেলানো কঠিন কাজ। ১. আমরা অবশ্যই তাদের মধ্যে এমন কোনো বোধ অনুপ্রাণিত করব না যে মৃত্যু এমন একটি বিষয় যা নিয়ে আমরা আলোচনা করতে ইচ্ছা করি না, কিংবা এ ব্যাপারে ভাবতে তাদের উৎসাহিত করি না। এ ধরনের বোধ যদি আমরা তাদের মধ্যে অনুপ্রাণিত করি তাহলে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে যে এর মধ্যে একটা মজাদার রহস্য রয়েছে, এবং এ বিষয়ে অতিরিক্ত ভাবতে শুরু করবে। এক্ষেত্রে যৌনশিক্ষা ব্যাপারে সুপরিচিত যে আধুনিক অবস্থান, তা প্রযোজ্য। ২. তথাপি, আমরা অবশ্যই, যদি সম্ভব হয়, এমন কাজ করবো যাতে তাদের অধিক এবং ঘন-ঘন মৃত্যু নিয়ে ভাবনা থেকে বিরত রাখা যায়। মৃত্যুভাবনা নিয়ে নিমগ্ন থাকার প্রতি এক ধরনের আপত্তি রয়েছে, যে ধরনের আপত্তি তোলা হয় নোংরা পুস্তকে (Pornography) নিয়ে নিমগ্ন থাকার ব্যাপারে। কারণ, এতে দক্ষতা হ্রাস পায়, সার্বিক বিকাশ ব্যাহত হয়, এবং এমন আচরণে অভ্যস্ত করে যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং অপরের জন্যও সন্তোষজনক নয়। ৩. আমরা অবশ্যই কারো মধ্যে শুধুমাত্র সচেতন চিন্তা দ্বারা মৃত্যু বিষয়ে সন্তোষজনক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করার আশা করবো না; বিশেষত, এই বিশ্বাস থেকে কোনো কল্যাণ হয় না যে মৃত্যু কম ভয়ংকর (অন্যকিছু হওয়ার চেয়ে), যেহেতু (স্বাভাবিকভাবেই) ঐ ধরনের বিশ্বাস সচেতনতার নীচু স্তরে অনুপ্রবেশ করতে পারে না।
উপযুক্ত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট শিশু বা কিশোরের অভিজ্ঞতা অনুসারে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। যদি শিশুটির অতি নিকটের কেউ মারা না যায়, তাহলে মৃত্যুকে সাধারণ ব্যাপার বলে গ্রহণ করা খুবই সহজ হবে। এতে বড় কোনো আবেগগত স্বার্থ জড়িত থাকবে না। মৃত্যু ব্যাপারটা যতক্ষণ বিমূর্ত ও নৈর্ব্যক্তিক, ততক্ষণ এর উল্লেখ করতে হবে অনাসক্ত কণ্ঠে, ব্যাপারটা ভয়ানক, ও রকম কোনো আভাস যেন না মেলে। যদি শিশুটি জিজ্ঞেস করে আমি কি মরব? তাহলে একজনের বলা উচিত হবে, হ্যাঁ, তবে কিছুকালের মধ্যেই নয়। মৃত্যু সম্পর্কে কোনো প্রকার রহস্যময় ধারণা সৃষ্টি হওয়ায় বাধা দিতে হবে। অযোগ্য হয়ে যাওয়া খেলনার পর্যায়ে একে নামিয়ে আনতে হবে। যদি সম্ভব হয়, তাহলে এটা অবশ্যই বাঞ্ছনীয় যে তরুণদের কাছে মৃত্যু দূরতম ঘটনা বলে মনে করাতে হবে।
যদি শিশুটির নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কেউ মারা যায়, তাহলে ব্যাপারটা ভিন্নভাবে বিবেচনা করতে হবে। উদাহরণত, শিশুটির একটি ভাই মারা গেলে স্বাভাবিকভাবেই পিতামাতা অসুখী হবেন এবং যদিও তারা চাইবেন না যে শিশুটি বুঝতে পারুক তারা কতটা অসুখী, তবু এটা সঠিক এবং প্রয়োজনীয় যে ছেলেটা অন্তত কিছু বুঝুক তার পিতামাতার অসুখটা কোথায়। স্বাভাবিক স্নেহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবং ছেলেটির অনুভব করা উচিত তার মুরুব্বীরা এটা অনুভব করেন। উপরন্তু, যদি অতিমানবিক প্রচেষ্টায় তারা তাদের দুঃখ ছেলেটির কাছে গোপন রাখেন তবে সে ভাবতে পারে: আমি মারা গেলে তারা কিছুই মনে করবে না। এই ধরনের চিন্তা থেকে মানসিক ব্যাধি বিকাশলাভ করতে পারে। সুতরাং যদিও এ ধরনের ঘটনার আঘাত শৈশবকালের শেষের দিকে পেলে তা ক্ষতির কারণ হয় (প্রথমদিকে খুব বেশি অনুভব করা যায় না)। এবং ঘটলে তার গুরুত্ব আমাদের খুব বেশি খাটো করে দেখা উচিত হবে না। এই বিষয়টি এড়িয়ে চলাও উচিত হবে না, অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদানও হবে অন্যায়। অভীষ্ট সম্পর্কে সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ না ঘটিয়ে যা কিছু সম্ভব তা অবশ্যই করতে হবে: ছেলেটির মনোযোগ নতুন বিষয়ে আকৃষ্ট করতে হবে, সর্বোপরি নুতনভাবে স্নেহসিক্ত করতে হবে। আমি মনে করি কোনো ছেলের একটি ব্যক্তির প্রতি তীব্র অনুরাগ সবসময়ই কিছু হারানোর চিহ্ন। এই অনুরাগ পিতা-মাতার মধ্যে একজনের প্রতি জাগতে পারে যদি এদের মধ্যে একজনের ভেতর দয়ার অভাব দেখা দেয়, এই অনুরাগ শিক্ষকের প্রতিও জাগতে পারে যদি পিতা-মাতা উভয়ে হন নির্দয়। সাধারণত এটা ভীতি থেকে জন্মে থাকে: অনুরাগের লক্ষ্য তিনিই হন যিনি নিরাপত্তা বোধ জাগাতে পারেন। শৈশবে এই ধরনের অনুরাগ স্বাস্থ্যকর নয়। উক্ত অনুরাগের অস্তিত্ব যেখানে রয়েছে সেখানে যদি ভালোবাসার পাত্র মারা যায় তাহলে ছেলেটির জীবন বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। বাইরে থেকে সবকিছু ভালো মনে হলেও, পরবর্তীকালীন অনুরাগের সঙ্গে আতংক জড়িত হবে। স্বামী (কিংবা স্ত্রী) এবং সন্তানেরা উল্কণ্ঠা-আক্রান্ত হবে। তাছাড়া যখন নিজের জীবন স্বাভাবিকভাবে যাপন করে যাবে, তাদের কাছে মনে হবে হৃদয়হীন। সুতরাং পিতা বা মাতার এ ধরনের অনুরাগের বস্তুতে পরিণত হয়ে খুব উফুল্ল বোধ করা উচিত হবে না। ছেলেটির পরিবেশ যদি হয় স্বাভাবিকভাবে বন্ধুতাপূর্ণ এবং সুখী তাহলে বিয়োগব্যথা অধিক অসুবিধা ছাড়াই উত্তীর্ণ হতে পারবে। জীবনের প্রতি ঝোঁক ও আশাই যথেষ্ট, শর্ত থাকে যে উন্নতি ও সুখের অনুকূলে স্বাভাবিক সুযোগ থাকতে হবে।
কিন্তু বয়ঃসন্ধিকালে মৃত্যুর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপারে আরো সদর্থক কিছু থাকা দরকার। সাবালক জীবন সন্তোষজনক হওয়ার জন্যই এটা প্রয়োজনীয়। পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির উচিত মৃত্যু সম্পর্কে কম ভাবা, কি নিজের কি তার ভালোবাসার পাত্রদের সম্পর্কে, এজন্য নয় যে সে ইচ্ছাকৃতভাবে তার চিন্তা ভিন্ন পথে পরিচালিত করবে, কারণ তা হবে অকেজো প্রচেষ্টা, যা বাস্তবে কোনোদিন সফল হয় না। বস্তুত এটা করতে হবে তার কৌতূহল ও কার্যক্রমের বিভিন্নমুখিনতার জন্য। যখন তিনি মৃত্যু সম্পর্কে ভাববেন, প্রকৃষ্ট কাজ হবে স্টয়িকসুলভ ঔদাসীন্য সহকারে তা ভাবা, ইচ্ছাকৃত এবং সুস্থিরভাবে, ব্যাপারটার গুরুত্ব কমানোর চেষ্টা এতে থাকবে না। বরং ব্যাপারটার উর্ধ্বে ওঠার নির্দিষ্ট গর্বানুভব এত কাজ করবে। নীতিটা হবে অপরাপর যে-কোনো আতংক থেকে অভিন্ন সম্ভাব্য চিকিৎসা হলো আতংকজনক বস্তু সম্পর্কে দৃঢ়সংকল্প অনুধ্যান। কেউ মনে-মনে বলতে পারেন: আচ্ছা হা, যদি তা ঘটেই যায় তাহলে কি ই বা হলো? লোকেরা যুদ্ধে মৃত্যুর মতো ঘটনায় এই মনোভাব অর্জন করে, কারণ ঐ সময় তাদের নিশ্চিত ভাবে বোঝানো হয় যে তারা একটা লক্ষ্যের জন্য তাদের কিংবা প্রিয়জনের জীবন উৎসর্গ করেছে। এই ধরনের উপলব্ধি সবসময়ই কাম্য। সবসময়ই একজনকে ভাবতে হবে যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারের জন্য তিনি বেঁচে আছেন এবং তার মৃত্যু, তার স্ত্রী কিংবা সন্তানের মৃত্যু জগৎ সম্পর্কে তার প্রবল আগ্রহের পরিসমাপ্তি ঘটায় নি। সাবালক জীবনে এই মনোভাব আন্তরিক এবং গম্ভীর হতে হবে। বয়ঃসন্ধিকালে একজন তরুণের উচিত উদার উৎসাহে আপুত হওয়া এবং তার জীবন ও বৃত্তি সেই মোতাবেক উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। বয়ঃসন্ধি ঔদার্যের পর্যায়কাল; এই সময়টা কাজে লাগাতে হবে উদার অভ্যাস গড়ার জন্য। পিতা কিংবা শিক্ষকের প্রভাবে এটা অর্জন করা যেতে পারে। উন্নততর সমাজে মায়েরাই অনেক সময় এটা করতে পারেন; কিন্তু বর্তমানে দেখা যায় মহিলাদের জীবন এমন যে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে এবং আমি যতটা বিদগ্ধ হওয়া উচিত মনে করি তা হয় । একই কারণে নব্য যুবকদের (যুবতিদেরও) পুরুষ শিক্ষকের সঙ্গ পাওয়া উচিত। যতক্ষণ না এক নতুন শ্রেণির মহিলার আবির্ভাব ঘটে যারা আগ্রহের দিক থেকে অধিকতর নৈর্ব্যক্তিক।
সম্প্রতিকালে মানবজীবনে স্টইকবাদের স্থানকে সম্ভবত কিছুটা খাটো করে দেখা হয়, বিশেষত প্রগতিশীল শিক্ষাবিদগণ খাটো করে দেখে থাকেন। যখন দুর্ভাগ্যের হুমকি আসে, তখন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য দুটি উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে। আমরা দুর্ভাগ্য এড়িয়ে চলতে পারি কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি যে অবিচল ধৈর্য নিয়ে আমরা এই দুর্ভাগ্যের মোকাবেলা করব। প্রথম পদ্ধতিটি খুবই শ্রদ্ধেয় যদি ভীরুতা ব্যতিরেকে তা সম্ভব হয়; কিন্তু দ্বিতীয়টিরও দরকার আছে, অবিলম্বে কিংবা কিছুকাল। পরই এর দরকার হবে, অন্তত তার জন্য তো অবশ্যই দরকার, যিনি ভীতির ক্রীতদাসে পরিণত হতে প্রস্তুত নন। এই দৃষ্টিভঙ্গিই স্টইকবাদ। একজন শিক্ষকের পক্ষে তরুণদের মধ্যে স্টইকবাদ বিস্তার দূরূহ হয়ে পড়ে এজন্য যে এই কাজটি করতে গেলে ধর্ষকাম মুক্তির পথ খুঁজে পায়। অতীতকালে শৃঙ্খলা-সম্পর্কিত ধারণা এতটা হিংস্র ছিল যে, শিক্ষা হয়ে দাঁড়াত নিষ্ঠুরতার প্রতি অনুরাগের সদর রাস্তা। শিশুকে ভোগান্তির শিকারে পরিণত করে আনন্দ লাভ না করে তাদের প্রয়োজনীয় ন্যূনতম শৃঙ্খলা শেখানো কি সম্ভব? প্রাচীনপন্থিরা অবশ্য অস্বীকার করে বলবেন, এই কাজটি করে তারা কোন সুখ বোধ করেন না। এই গল্পটা সবাই জানেন; জনৈক পিতা আর পুত্রকে বেত্রাঘাত করার সময় বলেছেন : পুত্র, এতে আমি তোমার চেয়ে বেশি আঘাত পাচ্ছি। পুত্র জবাবে বলেছিল : তাহলে বাবা, তুমি কি এ কাজটি আমাকে করতে দেবে? The Way of all Flesh উপন্যাসে স্যামুয়েল বাটলার কঠোর পিতামাতার ধর্ষকামী সুখের যে চিত্র এঁকেছেন তা আধুনিক মনস্তত্ত্বের যে-কোনো ছাত্র সাগ্রহে গ্রহণ করবেন। তাহলে আমরা এ ব্যাপারে কী করব?
অনেক বিষয়ের মধ্যে মৃত্যু-ভীতি একটি যা আমরা স্টইকবাদের সাহায্যে মোকাবেলা করতে পারি। দারিদ্র্যের ভয় রয়েছে, দৈহিক যন্ত্রণার ভয় রয়েছে, সন্তানের জন্মদানের ভীতিও ধরতে হবে,-এটা ধনবান মহিলাদের মধ্যে খুবই ক্রিয়াশীল। এই সব ভয় ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং এখন কম-বেশি তুচ্ছ গণ্য করা হয়। কিন্তু যদি আমরা এই পথ বেছে নিই যে জনগণের এ ব্যাপারে কিছু মনে করা উচিত হবে না, তাহলে, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মধ্যে এই ঝোঁকও দেখা দেবে যে অকল্যাণ লঘু করার জন্য কিছু করা নিষ্প্রয়োজন। দীর্ঘকাল মনে করা হতো সন্তান জন্মদানের সময় মায়েদের চেতনানাশক (Anaesthetics) কিছু গ্রহণ করা উচিত হবে না। জাপানে এই ধারণা আজ পর্যন্ত টিকে আছে। পুরুষ ডাক্তারগণ অভিমত ব্যক্ত করতেন যে, চেতনা নাশক ক্ষতিকারক। অথচ এই অভিমতের পক্ষে কোনো যুক্তি নেই, নিঃসন্দেহে এর অন্তর্নিহিত কারণ ছিল নিশ্চেতন ধর্ষকাম। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো জন্মদানের বেদনা প্রশমিত করা হতে লাগল, ধনাঢ্য মহিলারা বেদনা সহ্য করতে কম ইচ্ছুক হতে লাগলেন, তাদের সাহস প্রয়োজনের তুলনায় দ্রুতগতিতে হ্রাস পেল। স্পষ্টতঃই একটা ভারসাম্য থাকা উচিত। গোটা জীবন মখমল-তুল্য এবং সুখকর করা অসম্ভব, সুতরাং মানুষকে এমন মনোভাব গড়ে তুলতে সমর্থ হতে হবে যা জীবনের অপ্রীতিকর পর্যায়ের জন্য উপযুক্ত হবে। তবে আমাদের এটা করতে নিষ্ঠুরতা যথাসম্ভব কম উৎসাহিত করতে হবে।
যাদের বাচ্চা ছেলেদের লালন পালন করতে হয় তারা অতিশীঘ্র শেখেন অতিরিক্ত সহানুভূতি ভ্রমাত্মক। একেবারে কম সহানুভূতি অবশ্য সমধিক ভ্রমাত্মক, কিন্তু এক্ষেত্রে, অন্যান্য ক্ষেত্রের মতোই, কোনো চরমপন্থা ভালো নয়। যে শিশু শুধু সহানুভূতি পেতেই অভ্যস্ত যে অতিক্ষুদ্র দুর্ভোগের জন্য সোরগোল তুলবে। গড় পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি সাধারণ আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেন এই জ্ঞানের কল্যাণে যে সোরগোল তুলে সহানুভূতি লাভ করা যাবে না। শিশুরাও অবিলম্বে বুঝতে পারে, যে ব্যক্তি অনেক সময় কিছুটা কঠোর সেই ব্যক্তি তাদের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট। সহজাত প্রবৃত্তি তাদের জাগিয়ে দেয়, তাদের ভালোবাসা হচ্ছে কি হচ্ছে না এবং যাদের কাছ থেকে তারা স্নেহ আশা করে তারা যদি শিশুর উপযুক্ত বিকাশের আন্তরিক ইচ্ছা থেকে কঠোরও হন, তবে সে কঠোরতা তারা সহ্য করবে। সুতরাং তত্ত্বগতভাবে সমাধান অত্যন্ত প্রাঞ্জল: ভালোবাসা দ্বারা অনুপ্রাণিত হোন, তারাও সঠিক কাজটি করবে। যাহোক, বস্তুত ব্যাপারটা কিন্তু আরো জটিল। ক্লান্তি, বিরক্তি, অধৈর্য পিতা বা মাতা কিংবা শিক্ষককে আক্রান্ত করতে পারে। অতএব এমন শিক্ষাতত্ত্ব থাকা বিপজ্জনক যেখানে শিশুর চূড়ান্ত কল্যাণের স্বার্থে একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি এই অনুভূতিগুলো তাদের উপর চাপিয়ে দেবে। তথাপি এই তত্ত্ব যদি সত্য হয় তবে তা গ্রহণ না করে উপায় নেই এবং বিপদের দিকটা সম্পর্কে পিতা-মাতা কিংবা শিক্ষককে সচেতন করতে হবে, যাতে শিশুদের রক্ষার জন্য সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
এতক্ষণ আলোচনার ভেতর আমরা যে সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করেছি এখন তার সারসংক্ষেপ করা চলে। জীবনের বেদনাদায়ক দুর্ভোগ সম্পর্কে বলা যায়, এ সম্পর্কে জ্ঞান শিশুদের কাছ থেকে আড়াল করা যেমন উচিত হবে না তেমনি অনুচিত হবে তাদের উপর জেদ করে এই জ্ঞান আরোপ করা। এই জ্ঞান আসবে যখন পরিস্থিতি একে অনিবার্য করে তুলবে। বেদনায়ক ঘটনা সততা ও নিরাসক্তির সঙ্গে বোঝাঁপড়া করা উচিত, তবে পরিবারে কারো মৃত্যু হলে দুঃখ গোপন করা স্বাভাবিক কাজ হবে না। বয়স্ক ব্যক্তিদের উচিত হবে আচরণে জাঁকালো সাহস প্রদর্শন, যা তরুণরা নিশ্চেতনভাবে তাদের উদাহরণ থেকে আয়ত্ত করবে। বয়ঃসন্ধিকালে তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে বিশাল কিছু নৈর্ব্যক্তিক স্বার্থ এবং এমনভাবে শিক্ষাদান করতে হবে (ইশারায়, সুস্পষ্ট উপদেশের আকারে নয়) যাতে তারা এই ধারণা লাভ করে যে বেঁচে থাকার লক্ষ্য শুধু স্বীয় স্বার্থ হাসিল নয়। দুর্ভাগ্য সহ্য করার শিক্ষা তাদের দেয়া উচিত; দুর্ভাগ্যে পতিত হলে তারা যেন স্মরণ করতে পারে জীবনে বেঁচে থাকার আরো অনেক কারণ রয়েছে। কিন্তু তাদের সম্ভাব্য দুর্ভাগ্য সম্পর্কে চিন্তা করা উচিত হবে না। দুর্ভাগ্য মোকাবেলার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্যও তাদের এ নিয়ে চিন্তা করা ঠিক নয়।
শিশুদের শিক্ষা দেয়া যাদের পেশা তাদের নিজেদের উপর নজর রাখতে হবে শিক্ষার প্রয়োজনীয় উপাদান শৃঙ্খলা থেকে তারা যেন ধর্ষকামী সুখ আহরণ না করেন; শিক্ষার লক্ষ্য সবসময়ই হবে চরিত্র ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ। কারণ বুদ্ধির জন্যও শৃঙ্খলার প্রয়োজন, শৃঙ্খলা ব্যতিরেকে সঠিক চিন্তাশক্তি অর্জন করা যায় না। তবে বুদ্ধির শৃঙ্খলার প্রকৃতি ভিন্ন এবং তা বর্তমান নিবন্ধের আওতা-বহির্ভূত বিষয়। আমি শুধু আর একটি কথা বলব, তা হলো সেই শৃঙ্খলা সর্বোত্তম যা অন্তর্গত প্রবণতা থেকে আসে। এটা যাতে সম্ভব হয় তার জন্য শিশু বা কিশোরকে কঠিন একটা কিছু অর্জনের অভিলাষ পোষণ করতে হবে, এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করার জন্য ইচ্ছুকও হতে হবে। এ ধরনের অভিলাষ সম্পর্কে পরিপার্শ্বের কিছু ব্যক্তির কাছ থেকে সাধারণত ইঙ্গিত আসে; ফলে আত্ম-শৃঙ্খলাও শেষ পর্যন্ত শিক্ষাগত উদ্দীপনার উপর নির্ভর করে।